টেন ডলস – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ
০১.
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিঃ ওয়ারগ্রেভ চলেছেন ট্রেনে। প্রচণ্ডগতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। তিনি ভাবছেন চিঠিটির কথা। একসময় পকেট থেকে সেটি বার করে পড়লেন।
প্রিয় লরেন্স,
অনেকদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হতে পারে, যদি পান্না দ্বীপে আস। মনোরম পরিবেশ। ১২-৪০ মিঃ প্যাডিংটন… ওক ব্রিজে দেখা হবে।
প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে
কনসটান্স কালমিংটন।
অস্পষ্ট ছোট্ট চিঠি। তার মনে পড়ে সাত-আটবছর আগে পত্রলেখিকার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ইতালিতে। এতদিন পরে কি মনে করে চিঠি লিখছেন কে জানে?
পান্না দ্বীপটার কথা হালে খবরের কাগজে চোখে পড়েছে। এক ধনী ব্যক্তি দ্বীপটা প্রথমে কিনেছিলেন। সুন্দর একটা বাড়িও সেখানে তৈরি করেছেন।
পরে সেটা তিনি বেচে দেন এক চিত্রাভিনেত্রীর কাছে। অবশ্য অনেকের ধারণা নৌবাহিনীর কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে সরকার কিনেছে দ্বীপটা।
কেউ অবশ্য বলছেন মিঃ আওয়েন নামে এক ধনী ব্যক্তি বর্তমানে দ্বীপটার মালিক।
মিঃ ওয়ারগ্রেভ পলকের মধ্যে সবকিছু ভেবে নিলেন। পরে চিঠিটা পকেটে রেখে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলেন।
.
ভেরা ক্লেথর্ন, সেও চলেছে ট্রেনে, তৃতীয় শ্রেণীর একটা কামরায়। এই ভ্যাপসা গরমের সময় সমুদ্রতীরের মনোরম পরিবেশে আরামে থাকা যাবে এই ভেবেই সে আনন্দ পাচ্ছে। তার ওপর মনটা উল্লসিত নতুন একটা কাজ পেয়ে।
অবশ্য মাত্র একমাসের জন্য, প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজ। স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে হাঁপ ধরে যায়, একটা মাস অন্তত নিরিবিলিতে থাকা যাবে। স্কুল থেকে একমাসের জন্য ছুটি নিয়ে নিয়েছে।
আবেদন করেছিল কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে। সঙ্গে সঙ্গেই যে নিয়োগপত্র পেয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি।
এ মাসের ৮ তারিখ থেকে কাজে যোগদানের কথা জানানো হয়েছে। নিয়োগকর্তা লিখেছেন–
… প্যাডিংটন থেকে ১২-৪০ মিঃ-এ ট্রেন। ওক ব্রিজ স্টেশনে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে। এই সঙ্গে পথখরচের টাকা পাঠানো হলো।
ধন্যবাদান্তে–
উনা নানসি আওয়েন
হঠাৎ, কি জানি কেন, হুগোর কথা ভেরার মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে সামনের লোকটির দিকে মনোযোগ দিয়ে তা ভুলে যাবার চেষ্টা করল।
সামনের সিটেই বসে আছে লম্বা-চওড়া লোকটি। গায়ের রং তামাটে। মুখে একটা, নিষ্ঠুরতার ছাপ। দেখেই মনে হয় গ্রীষ্মমণ্ডলে ঘোরা লোক।
ভেরার সামনে বসেছিল যে লোকটি তার নাম ফিলিপ লমবার্ড। ভেরার দিকে তারও চোখ পড়েছিল, সুন্দরী বলেই তার মনে হয়েছে। তবে মুখে মাস্টারনির ছাপ স্পষ্ট।
আসলে নতুন কাজটার কথাই সে তখন ভাবছে। এজেন্ট তাকে জানিয়েছে, ডেভনের পান্না দ্বীপে গিয়ে নিয়োগকর্তার সঙ্গে দেখা করতে হবে।
সমুদ্রের ধারে মনোরম পরিবেশে কাজটা তার ভাল লাগবে বলেই সে মনে করছে।
প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। আর এক কামরায় বসে আছেন মিস এমিলি ব্রেনট। বয়স পঁয়ষট্টি। চিরকুমারী। সেকেলে চিন্তাভাবনার মানুষ। বাইবেল নিয়ে বসে থাকতেই ভালবাসেন।
একটা চমৎকার আমন্ত্রণ পেয়ে, তিনি পান্না দ্বীপে চলেছেন। তার পুরনো এক বান্ধবী লিখেছে–
…বেলহাভেনের এক অতিথি-নিবাসে আলাপ হয়েছিল, নিশ্চয় মনে আছে। আপাতত জানাচ্ছি, ডেভনের কাছে আমি নিজেই একটা অতিথি-নিবাস খুলছি। আপনার মত সুরুচিসম্পন্ন লোকেরা থেকে আনন্দ পাবেন।
চলে আসুন না আগস্ট মাসের ৮ তারিখে। খুব আনন্দ হবে।
শুভেচ্ছান্তে
ইতি
ইউ, এন, ও
বছর দুয়েক আগে মিস এমিলি বেলহাভেনে গিয়েছিলেন। মনে আছে, সেখানে মাঝবয়সী এক মহিলার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। অবশ্য নাম বা পদবী এখন আর মনে পড়ছে না। তাতে কি, আমন্ত্রণটা আন্তরিক, কদিন শান্তিতে থাকা যাবে। চারপাশে আজকাল ছেলেছোকরাদের যা চলন-বলন হয়েছে, ঘেন্না ধরে যায়।
.
অন্য একটা ট্রেনে জানালার কাছে বসে আছেন জেনারেল ডগলাস। শাখা লাইনের ট্রেন-গতি মন্থর। পান্না দ্বীপে পৌঁছতে অনেক সময় লাগিয়ে দেবে।
কে এক আওয়েনের চিঠি পেয়েই তিনি চলেছেন সেখানে। লোকটিকে চিনতে না পারলেও চিঠিটা অগ্রাহ্য করতে পারেননি।
ভদ্রলোক লিখেছেন–
… পুরনো বন্ধুরাও অনেকেই আসছেন। আপনিও চলে আসুন না, বেশ ভাল লাগবে। পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করা যাবে।
হারানো দিনের কথা জেনারেলের ভালই লাগে, এক রিচমণ্ড প্রসঙ্গ বাদে। প্রায় ত্রিশ বছর আগের এক বিষাক্ত অতীত সেটা। তা হোক–ওই প্রসঙ্গে না এলেই হল।
ট্রেনের গতিটা যদি বাড়ত। অধীর হয়ে পড়ছেন ক্রমেই জেনারেল।
.
ডাঃ আরমস্ট্রং চলেছেন সলসবেরি থেকে। মরিস গাড়িটা নিজেই চালাচ্ছেন। ধোপদুরস্ত পোশাক, সুন্দর চেহারা। সাফল্যের ঔজ্জ্বল্য মাখানো মুখে।
চিকিৎসক হিসেবে তিনি নিঃসন্দেহে খ্যাতিমান। জীবনে অবসর বলে কিছু নেই। এটাই খ্যাতির বিড়ম্বনা। তাই পান্না দ্বীপের ডাক পেয়ে খুশি হয়েছেন।
রুগী দেখাও হবে, সেই সঙ্গে নির্জন পরিবেশের সুখও উপভোগ করা যাবে।
চিঠি পাঠিয়েছেন মিঃ আওয়েন। তাঁর স্ত্রী নার্ভের অসুখে ভুগছেন। এ অবশ্য এমন কিছু রোগের পর্যায়ে পড়ে না।
ডাঃ আরমস্ট্রং-এর সাফল্যের ইতিহাস অবশ্য একেবারে কলঙ্কমুক্ত নয়। সেই অধ্যায় অবশ্য তাঁর চিকিৎসক জীবনের গোড়ার দিককার।
তারপর থেকে কোন দিন আর পানপাত্র স্পর্শ করেননি। আগের তুলনায় অনেক বেশি সতর্কও হয়ে গেছেন।
পান্না দ্বীপ আরও একশো মাইল। এই পথটা দ্রুত অতিক্রম করবার জন্য বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে চলেছেন অ্যান্টনি মাসটন।
সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য তরুণী মহলে খুবই জনপ্রিয় মার্সটন। এ বিষয়ে তিনি নিজেও যথেষ্ট সচেতন।
.
প্লাইমাউথ থেকে ট্রেনটা চলেছে মন্থরগতিতে। ব্লোর এই ট্রেনে চলেছে পান্না দ্বীপে। কামরায় দ্বিতীয় যাত্রী বলতে এক বৃদ্ধ নাবিক। জানালার ধারে বসে ঝিমোচ্ছে।
ব্লোর পকেট থেকে একটা নোটবই বার করে নামগুলোর ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল–
এমিলি ব্রেনট, ভেরা ক্লেথর্ন, ডাঃ আরমস্ট্রং, অ্যান্টনি মার্সটন, বিচারপতি মিঃ ওয়ারগ্রেভ, ফিলিপ লমবার্ড, জেনারেল ডগলাস, আর পরিচারক রজার্স ও তার স্ত্রী।
ব্লোর ভাবে, তালিকায় তার নামটাও থাকা উচিত ছিল। নিজেকে কি বলে পরিচয় দেবে সে? দলে একজন ফৌজি জেনারেল রয়েছে, নইলে স্বচ্ছন্দে সে রিটায়ার্ড ফৌজি অফিসার হতে পারত।
একটা পরিচয় অবশ্য নেওয়া যায়–দক্ষিণ আফ্রিকার একজন বিশিষ্ট নাগরিক। খাঁটি ইংরাজ ব্যবসায়ী।
সে আরও ভাবল, ভ্রমণকাহিনী যা পড়া আছে, তাতে দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বলে নিজেকে জাহির করতে পারবে।
তালিকায় যাদের নাম দেখল, এরা নিশ্চিত কেউ তার ফাঁকিবাজি ধরতে পারবে না।
জানালার ধারের বুড়ো নাবিক হঠাৎ নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল–সমুদ্রের গতিক বড় সুবিধার মনে হচ্ছে না।
ব্লোর উপযাচক হয়েই বুড়োর কথার সমর্থন জানাল–তাই বুঝি?
বুড়ো খুক খুক করে কাশল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ঝড় আসছে–ঝড়–
–কিন্তু আবহাওয়া তো ভালোই দেখছি।
–না, না, গন্ধ পাচ্ছি। বড়–ঝড় ভয়ঙ্কর ঝড় আসছে।
ব্লোর কোন জবাব করল না এবারে।
.
০২.
ওক ব্রিজ স্টেশনের বাইরে চারজনের একটা দল জড়ো হয়েছে।
তাদের কারুর সঙ্গে পরিচয় নেই। প্রত্যেকের পেছনেই একটা করে সুটকেস নিয়ে কুলি দাঁড়িয়ে আছে।
দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। একজন চালক এগিয়ে এল। দলের মধ্যে মিঃ ওয়ারগ্রেভ বয়স্ক এবং সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষ। তাকে উদ্দেশ্য করেই ট্যাক্সিচালক বলল, আপনারা পান্না দ্বীপে যাবেন তো, স্যার?
–হ্যাঁ।
–আপনাদের জন্য দুটো ট্যাক্সি রয়েছে। পাঁচমিনিট পরেই এক্সেটার থেকে ট্রেনে এক ভদ্রলোক আসছেন। তাকেও নিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মধ্যে একজন তার জন্য অপেক্ষা করে বাকি সকলে আমার সঙ্গে চলুন।
এই ব্যবস্থা মত ভেরা ক্ৰেথর্ন এবং ফিলিপ লমবার্ড রইল। অন্যরা সকলে একটা ট্যাক্সি চেপে। পান্না দ্বীপের দিকে রওনা হয়ে গেল।
ভেরা এবং লমবার্ড স্টেশনের একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছে। পারস্পরিক পরিচয় বিনিময়ের পর কথায় কথায় তারা দুজনেই জানতে পারে নিমন্ত্রণকর্তা মিঃ আওয়েন কারুরই পরিচিত নন।
ব্লোর বলে, আমি মিসেস আওয়েনের সেক্রেটারির চাকরি নিয়ে একমাসের জন্য এখানে এসেছি। আওয়েনদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।
.
একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায় স্টেশনে। বিরাট চেহারার এক বয়স্ক ভদ্রলোক প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে এলেন। নিখুঁত পোশাকের মানুষটির চালচলন ফৌজিদের মত। ইনিই হচ্ছেন জেনারেল ডগলাস।
ভেরা এবং লমবার্ড এগিয়ে গিয়ে সম্ভাষণ বিনিময় করে। ভেরা বলে, আপনার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। চলুন যাওয়া যাক।
তিনজনে ট্যাক্সিতে উঠে বসেন। তীব্রগতিতে ট্যাক্সি ধেয়ে চলে।
.
সমুদ্রতীরে ফেরিঘাটে এসে পৌঁছয় ট্যাক্সিটা। একটা চায়ের দোকানে মাঝি-মাল্লারা বসে আড্ডা মারছে। সেখানেই বসেছিলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ এবং যে বোটে করে তারা যাবে তার চালক ডেভিসও ছিল তাদের সঙ্গে।
ভেরা ট্যাক্সি থেকে নামতেই ডেভিস এগিয়ে গিয়ে জানাল, আসুন, আমরা আপনাদের জন্যই প্রতীক্ষা করছি। আমাদের সকলের জন্য হয়তো মিঃ এবং মিসেস আওয়েন অধীর আগ্রহে রয়েছেন।
নির্জন জায়গাটা দেখে সকলের মনেই কেমন অদ্ভুত একটা শিহরণ জেগে ওঠে। কোথায় যাচ্ছেন, কার কাছে যাচ্ছেন কিছুই তাঁরা জানেন না, তবু অজ্ঞাত সেই আমন্ত্রণকারীর আকর্ষণ তারা কেউ অবহেলা করতে পারছেন না।
বোটচালক ডেভিস বোটে গিয়ে ওঠে। অন্যান্য সকলেও তাকে অনুসরণ করে।
ডেভিস বলে, মিঃ আওয়েন বলেছিলেন, আরও দুজনের আসার কথা আছে। তবে তাদের জন্য আমাদের অপেক্ষা করবার প্রয়োজন নেই।
ঠিক সেই সময়েই প্রচণ্ডগতিতে ধেয়ে এসে একটা সুন্দর ট্যাক্সি সমুদ্রতীরে থামল। নেমে এলেন অপূর্ব সুন্দর একজন মানুষ। গ্রীক ভাস্কর্যেই কেবল তার তুলনা মেলে। ইনিই হলেন অ্যান্টনি মার্সটন।
ডেভিস সম্ভাষণ জানিয়ে আহ্বান জানায়। মিঃ মার্টন বোটে উঠতেই বোট ছেড়ে দিল।
.
সামনেই পান্না দ্বীপ। কিন্তু একটা ছোট্ট পাহাড় তাকে আড়াল করে রেখেছে বলে এখান থেকে দ্বীপটাকে দেখা যায় না।
বোটটা কিছুটা ঘুরে গিয়ে দুটো পাথরের মাঝখানে থামল।
একে একে সকলেই অবতরণ করলেন। জায়গাটা নির্জন ও সুন্দর। চারপাশে ফল, ফুলের গাছ, সুন্দর বাগান, তার মাঝখানে চমৎকার একটা বাড়ি। প্রাসাদোপম। সকলেরই পছন্দ হয় জায়গাটা।
একজন বয়স্ক পরিচারক এগিয়ে এসে বলে, দয়া করে আপনারা এদিকে আসুন।
সকলে পাশাপাশি বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বিরাট হলঘর সামনে। উপযুক্ত টেবিল চেয়ারও রয়েছে। বড় টেবিলে অনেক পানীয় রয়েছে।
পরিচারকটি আবার বলে, আপনারা এখানে বিশ্রাম করুন। আমার নাম রজার্স। আমি এবং আমার স্ত্রী আপনাদের দেখাশোনা করব।
মিঃ আওয়েন দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছেন, তিনি আজ আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। তবে আগামীকাল দুপুরের মধ্যে এসে যাবেন। আপনাদের সকলের জন্যই আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা আছে।
আপনারা বিশ্রাম করুন, আটটায় ডিনার।
এই বলে বিদায় নিয়ে রজার্স তার কাজে চলে গেল।
রজার্সের স্ত্রীর সঙ্গে ভেরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। একটা ঘরের দরজা খুলে সে বলল, ম্যাডাম এটা আপনার ঘর।
চমৎকার সাজানো গোছানো ঘরটা দেখে ভেরার খুব পছন্দ হল। সে খুশি হয়ে বলল, খুব সুন্দর ঘর।
–আপনার কিছু প্রয়োজন হলে দয়া করে বেল বাজাবেন।
ভেরা বলল, আচ্ছা শোন, আমি হলাম মিসেস আওয়েনের সেক্রেটারি। আমার কথা তোমাকে নিশ্চয়ই কিছু বলেছেন তিনি?
–না ম্যাডাম; আমি কিছুই জানি না। আমরা কেবল একটা তালিকা পেয়েছি, তাতেই জানানো ছিল কে কোন ঘরে থাকবেন।
ভেরা কথাটা শুনে বিরক্ত হল। ভদ্রমহিলা তো অদ্ভুত! তাঁর নিজস্ব কর্মচারি হয়ে আসছে। সে, অথচ–
ভেরা জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাজের লোক এখানে কজন আছ?
–আমরা দুজন। রান্নার কাজটা আমি দেখি, বাইরের অন্যসব কাজ আমার স্বামী দেখেন। আপনাদের কোনো অসুবিধাই হবে না।
–আমরা তো লোক কম নই, দশজন। তার ওপর মিঃ ও মিসেস আওয়েন আসবেন। এতজনের কাজ–
–অসুবিধে হবে না। ম্যাডাম, এবার আমি একটু কিচেনের দিকে যাচ্ছি।
রজার্সের স্ত্রী চলে গেল। মহিলার চোখমুখ ফ্যাকাসে। রক্তশূন্যতা বলেই মনে হল ভেরার। কিন্তু সমস্ত অবয়বে কেমন যেন একটা ভয়-ভয় ভাব। কিসের ভয়?
দিন শেষ হবার মুখে মুখে ডাঃ আরমস্ট্রং বোট থেকে পান্না দ্বীপে নামলেন। বোটচালকের নাম নরোকট।
অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। দ্বীপের চারদিক পরিষ্কার দেখা গেল না। ডাক্তার সমুদ্রের দিকে তাকালেন। মনে বড় আরাম পেলেন।
ধীর পায়ে এগিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন ডাক্তার। একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের দিকে চোখ পড়ল তার। চিনতে পারলেন তাকে–বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ।
একবার তার এজলাসে ডাক্তারকে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল। দক্ষ বিচারপতি। দোষীদের প্রতি নিষ্করুণ। সেই কারণে অনেকেই আড়ালে তাকে নিষ্ঠুর বলে।
এখানে যে তার দেখা পাবেন ডাক্তার আশা করতে পারেননি।
.
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভও ডাক্তারকে দেখে ভাবছিলেন, এই ভদ্রলোকই তো–হ্যাঁ, নামটা মনে পড়েছে, আরমস্ট্রং–একবার সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন।
মিঃ ওয়ারগ্রেভ একবার যাকে দেখেন, সহজে তাকে ভোলেন না। তিনি ডাক্তারকে বললেন, ওই হলঘরে গিয়ে বসুন।
ডাক্তার জানান, ভাবছি মিঃ ও মিসেস আওয়েনের সঙ্গে একবার দেখা করব।
–তা তো সম্ভব নয়!
–নয়?
–ওরা কেউ এখানে নেই। কোথায় যে এসেছি, কিছুই বুঝতে পারছি না।
ডাক্তার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর তিনি হলঘরের দিকে এগিয়ে যান।
.
অ্যান্টনি মার্সটন পথের ক্লান্তি দূর করল প্রাণভরে স্নান করে। নতুন পোশাক পরে বেশ ধোপদুরস্ত হয়ে নিয়েছে।
নির্জন জায়গাটা তার কেমন অদ্ভুত লাগছে। একটা যেন ছমছমে ভাব। তবে এ নিয়ে তার মনে ভয়টয়ের কোনো ব্যাপার নেই। ভয় কাকে বলে সে জানে না।
.
ব্লোর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় চিরুনি বোলায়, টাইয়ের নটটাও ঠিকঠাক করে নিতে ভোলে না।
মনে মনে ভাবছে, এতগুলো মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে, কেউ কাউকে চেনে না। আমন্ত্রণকারীও অনুপস্থিত। সবই যেন কেমন অদ্ভুত। কেউ বিশেষ কোন কথা বলছে না, কিন্তু পরস্পরের দিকে যেন কেমন করে তাকাচ্ছে।
ব্লোর-এর মনে পড়ল, ছোটবেলায় একবার এই দ্বীপে বেড়াতে এসেছিল। ভাগ্যের কি নির্বন্ধ, আবার এসেছে এখানে।
.
কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটায় ডিনারের ঘন্টা বাজল। ফিলিপ লমবার্ড ঘর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল।
মিস এমিলি বাইবেল খুলে বসেছিলেন। ডিনারের ঘন্টা শুনে বই বন্ধ করে রাখলেন। তারপর ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগলেন।
.
০৩.
ডিনারে রজার্সের স্ত্রীর রান্নার প্রশংসা করলেন সকলে। রজার্স নিজেও চমৎকার পরিবেশন করল। অতিথিরা সকলেই খুশি।
এসে অবধি সকলের মধ্যেই যে একটা গুমোট ভাব ছিল সেটা এখন নেই। একে অন্যের সঙ্গে মন খুলে গল্পগুজব করছেন।
ডাক্তার ও মাসটন গল্প জুড়েছেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভের সঙ্গে। আদালতের নানা কাহিনী তিনি শোনাচ্ছেন।
ওদিকে ডগলাস ও মিস এমিলির মধ্যেও আলাপ যেন বেশ জমে উঠেছে।
ভেরা ক্লেথর্ন বরাবরই বড্ড কৌতূহলী। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প শুনছেন ডেভিসের কাছ থেকে। পাশে বসে শুনছেন লমবার্ডও। মাঝে মাঝে অন্যদের দিকেও তাকাচ্ছে।
–এগুলো কি?
মার্সটনের কথায় সকলেই তাকাল তার দিকে। সকলেরই চোখে পড়ল, ডাইনিং টেবিলের দক্ষিণ কোণে একটা টেবিলে কাচের স্ট্যান্ডে সাজান রয়েছে রঙীন দশটা পুতুল।
-বাঃ ভারি সুন্দর তো। ভেরা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, এ যে অনেকগুলো। এক…দুই… তিন…বাব্বাঃ দশটা পুতুল। ছেলেবেলায় আমারও ছিল কতগুলো।
–সবারই থাকে। একজন বলল।
–এসব হল বড়লোকের বিচিত্র খেয়ালের নমুনা। বললেন ওয়ারগ্রেভ।
–ঠিকই বলেছেন। সমর্থন জানাল মিস এমিলি।
বাতাসের সঙ্গে সমুদ্রের গর্জন ঘরে ঢুকছে। কখনো বাড়ছে কখনো স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। ভেরা বলে, মনে হয়েছিল ঝড় উঠবে। তাহলে অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। মিসেস আওয়েনরা আমাদের জন্য সব ব্যবস্থাই করে রেখেছেন।
–কে মিস আওয়েন? বলে ওঠেন মিস এমিলি, ওরকম কোনো নাম আমার মনেই পড়ছে না। অথচ–
এমন সময় রজার্স কফি নিয়ে ঘরে ঢুকল। আপাততঃ আওয়েন প্রসঙ্গ চাপা পড়ল। সকলে কফি নিয়ে বসলেন।
ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত নটা ঘোষণা হল। সকলেই চুপচাপ। কফি পান করছেন নিঃশব্দে। ডাঃ আরমস্ট্রং বারবার তাকাচ্ছে পুতুলগুলোর দিকে।
সহসা বাতাসের দাপাদাপি থেমে যায়। কেমন থমথমে হয়ে ওঠে ঘরের পরিবেশ। যেন এখুনি ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে। যেন তারই প্রতীক্ষা করছে সকলে।
তা কিন্তু ঘটলও। সহসা নিস্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে একটা অজানা গম্ভীর কণ্ঠস্বর শূন্যে ভেসে এল
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমোদয়গণ শুনুন। আপনাদের সকলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। একে একে বলে যাচ্ছি–
(১) এডওয়ার্ড জর্জ আরমস্ট্রং–আপনি ১৪ই মার্চ ১৯… লুইসা মেরি ক্লেসের মৃত্যু ঘটিয়েছেন।
(২)। এমিলি ক্যারোলাইন ব্রেনট–আপনি ৫ই নভেম্বর … বিয়াত্রিচে টেলর-এর মৃত্যুর জন্য দায়ী।
(৩) উইলিয়াম হেনরি ব্লোর–আপনি ১০ই অক্টোবর … জেমস স্টিফেন ল্যান্ডার-এর মৃত্যু ঘটিয়েছেন।
(৪) ভেরা এলিজাবেথ ক্লেথর্ন–আপনি ১১ই আগস্ট … সিসিল অগিলভি হ্যামিল্টনকে হত্যা করেছেন।
(৫) ফিলিপ লমবার্ড–আপনি … ফেব্রুয়ারি, আফ্রিকায় একুশজন লোকের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
(৬) জন গর্ডন ডগলাস–৪ঠা জানুয়ারি …, আপনি আপনার স্ত্রীর প্রণয়ী রিচমণ্ডকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
(৭) অ্যান্টনি জেমস মার্সটন–আপনি ১৩ই নভেম্বর … জন লুসি ও কোম্বের হত্যার জন্য দায়ী।
(৮) ও (৯) টমাস রজার্স ও এথেল রজার্স–তোমরা, ৬ই মে … জেনিফার ব্র্যাডির মৃত্যুর কারণ।
(১০) লরেন্স জন ওয়ারগ্রেভ–১০ই জুন, আপনি এডওয়ার্ড সেটনকে হত্যার অপরাধে অপরাধী।
অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ, আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনাদের কোন বক্তব্য আছে কি?
.
যেমন আচমকা কথাগুলো শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে রজার্স কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল। ঘরের বাইরে একটা আর্তনাদ আর কিছু পড়ে যাবার শব্দ শোনা গেল।
লমবার্ড দৌড়ে বাইরে এসে দেখল, রজার্সের স্ত্রী এথেল অচেতন হয়ে পড়ে আছে। লমবার্ড ও এমিলি দুজনে ধরাধরি করে তাকে সোফায় নিয়ে শুইয়ে দিল।
ডাঃ আরমস্ট্রং এগিয়ে এসে পরীক্ষা করলেন। বললেন, ভয় নেই, অজ্ঞান হয়ে গেছে, এখুনি ঠিক হয়ে যাবে।
লমবার্ড ব্র্যান্ডি আনতে ছুটল। ভেরা চিন্তিতভাবে বলল, এভাবে কে কথা বলল?
ডগলাস বলল, নিশ্চয়ই মশকরা করেছে। কিন্তু বড্ড বিশ্রী। স্বর কাঁপছে তার।
ব্লোর কপালে ঘাম জমে উঠেছিল। রুমাল দিয়ে তা মুছল। তবে সে বিচলিত হয়নি। ওয়ারগ্রেভ এবং এমিলির মধ্যেই কেবল কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।
লমবার্ড সাহসের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দাটা খুঁজল, কিন্তু কাউকে কোথাও দেখতে পেল না।
একপাশে একটা ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। আর তখনই রহস্যটা ধরা পড়ে গেল।
–এই তো দেখছি। আনন্দে লাফিয়ে উঠে লমবার্ড ঘরে ঢুকে পড়ল। এমিলি ছাড়া সকলেই সেখানে ছুটে গেল।
ঘরে একটা টেবিল। তার ওপরে চোঙাওয়ালা একটা সেকেল গ্রামাফোন। তাতে একটা রেকর্ড চাপানো রয়েছে। চোঙার মুখ দেওয়ালের দিকে। তাই ঘরের দেওয়ালের ওপারেই বসার ঘর, বেশ কয়েকটা ফুটো রয়েছে দেওয়ালে।
পিনটা রেকর্ডের ওপর রেখে চালাতেই আবার আগের কথাগুলো বেজে উঠল।
–সর্বনাশ, বন্ধ করুন। ভেরা চেঁচিয়ে ওঠে।
লমবার্ড সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেয়। ডাক্তার হেসে বললেন, ঠাট্টা বটে তবে খুবই নিকৃষ্ট শ্ৰেণীর।
–কিন্তু চালালো কে?
সকলে আবার বসার ঘরে ফিরে গেল। রজার্স ইতিমধ্যে ব্র্যান্ডি নিয়ে এসেছে। তার স্ত্রীর সেবা করছেন এমিলি। সে এখন কথা বলতে পারছে। তার সারা মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
রজার্স বলে, এথেল, ভয় পাবার কিছু নেই। এটা খুবই বাজে একটা ব্যাপার।
–কিন্তু কী ভয়ঙ্কর সেই স্বর। কাঁপা গলায় বলে এমিলি।
ডাক্তার খানিকটা ব্র্যান্ডি এথেলের গলায় ঢেলে দেন। সে চাঙা হয়ে উঠতে থাকে।
–কী সাংঘাতিক সব মিথ্যা কথা। আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বলল রজার্স।
–কিন্তু রেকর্ডটা বাজাল কে?
রসার্জ কাঁপা কাঁপা স্বরে জানায়, মিঃ আওয়েনের নির্দেশেই এটা করা হয়েছে।
–কি নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি?
–বলেছেন, আপনারা সকলে যখন কফি পান করবেন, সেই সময় গ্রামাফোনে রেকর্ডটা চাপিয়ে চালিয়ে দিতে। কাজের ভার দিয়েছিলেন আমার স্ত্রীকে।
মিঃ ওয়ারগ্রেভ রেকর্ডটা তুলে তার গায়ের লেখাটা পড়ে বললেন, একটা গানের রেকর্ড দেখছি। বেলা শেষের গান।
সকলে একই সঙ্গে কথাটার পুনরাবৃত্তি করে উঠল।
.
ডগলাস বলে উঠলেন, লোকটা দেখছি মোটেই সুবিধের নয়। তাকে একটা শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
–কিন্তু আওয়েন লোকটা কে? এমিলি তিক্ত স্বরে জানতে চাইলেন।
–ঠিক বলেছেন, লোকটার খবরাখবর জানা দরকার। রজার্স তুমি তোমার স্ত্রীকে শুইয়ে দিয়ে এসো। তোমার সঙ্গে দরকারী কথা আছে। বললেন ওয়ারগ্রেভ।
ডাক্তার রজার্সকে সাহায্য করলেন। তাদের দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে এমিলি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ডাক্তার একটু পরেই ফিরে এসে জানালেন, এথেল ভাল আছে। তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে এলাম।
রজার্সও ঘরে ঢুকল প্রায় তার পেছন পেছন।
বয়স এবং পদমর্যাদায় মিঃ ওয়ারগ্রেভই ছিলেন প্রধান। আলোচনা সভার পরিচালনার দায়িত্ব তিনিই নিলেন।
সকলকে সম্বোধন করে বললেন, আওয়েন-রহস্যের একটা কিনারা হওয়া দরকার। আচ্ছা, রজার্স, এই লোকটি কে?
–পান্না দ্বীপের মালিক।
–তুমি নিশ্চই তাকে দেখেছ?
–না স্যার, মোটে এক সপ্তাহ হল আমি আর আমার স্ত্রী এসেছি। খবরের কাগজে বক্স নম্বর দেখে চাকরির দরখাস্ত করেছিলাম। একটা চিঠির মাধ্যমে আমাদের চাকরি দেওয়া হয়েছিল।
সেই চিঠি অনুসারে আমরা এখানে এসে সব ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে নিয়েছিলাম।
তারপর আর একটা চিঠি এল, তাতে জানানো হল, অতিথিরা আসছেন, তাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়।
গতকাল বিকেলে আর একটা চিঠিতে জানানো হল, ওঁরা আপাতত আসতে পারছেন না। আর ডিনার, কফি এবং রেকর্ড সম্পর্কেও তাতে নির্দেশ ছিল।
রজার্স পকেট থেকে একটা খাম বার করে মিঃ ওয়ারগ্রেভের দিকে বাড়িয়ে দিল।
একটা টাইপ করা চিঠি। তাতে ঠিকানা লেখা রয়েছে–বিৎস হোটেল।
আরও দু-একজন চিঠিটা দেখল। ওয়ারগ্রেভ বললেন, এখানে সকলেই আমরা আওয়েনের অতিথি। কিন্তু তিনি কে তা আমাদের ভালভাবে জানা দরকার। তাঁর সম্পর্কে কে কতটা জানেন তা জানা প্রয়োজন।
এমিলি বললেন, আমিই প্রথমে বলছি। গোড়া থেকেই ব্যাপারটা আমার খুব গোলমেলে ঠেকেছে। এক বান্ধবীর কাছ থেকে এখানে আসার আমন্ত্রণপত্র পাই। কিন্তু চিঠির তলায় নামটা ছিল অস্পষ্ট–ভালভাবে পড়া যাচ্ছিল না। তবে আওয়েন বলে কাউকে আমি চিনি না।
এরপর ভেরা জানাল, সে এখানে সেক্রেটারির নিয়োগপত্র পেয়ে এসেছে।
মার্সটন জানাল, বার্কলে বলে আমার এক বন্ধু থাকে নরওয়েতে। কিন্তু আশ্চর্য হল, তার চিঠিতে এখানকার চাকরির ব্যাপারটা জানতে পারি।
ডাক্তার বললেন, আওয়েন বলে কাউকে আমি চিনতাম না। তবে আমার পেশার ব্যাপারে কল পেয়েই এখানে এসেছি।
জেনারেল ডগলাস জানালেন, আওয়েনের একটা চিঠি আমি পাই। তাতে জানানো হয়েছিল, এখানে এলে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে।
লমবার্ড বললেন, এরকম একটা চিঠি আমিও পেয়েছিলাম। জানানো হয়েছিল, আমার পুরনো বন্ধুরা আসছেন, আপনিও এলে আনন্দ হবে।
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ চুপ করে সকলের কথা শুনলেন। পরে ব্লোরের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা অজ্ঞাত কণ্ঠস্বর আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা শুনিয়েছে। সেসব সত্যি কি মিথ্যা তা অবশ্য যাচাইয়ের প্রশ্ন।
তবে, একটা বিচিত্র ব্যাপার হল যে একমাত্র উইলিয়াম হেনরি ব্লোরের নামেই কোন অভিযোগ নেই। এই নামে আমাদের মধ্যে কেউ নেই–একজন আছেন মিঃ ডেভিস বলে। তার নামও এই অপরাধের তালিকায় নেই।
ব্লোর একথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, আমার নাম ডেভিস নয়—
তাহলে আপনি উইলিয়াম হেনির ব্লোর?—
হ্যাঁ।
লমবার্ড সঙ্গে সঙ্গে ব্লোরের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ম গলায় বলল, তুমি বলেছিলে, দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাটাল থেকে এসেছ। আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছি। আমার ধারণা, তুমি ন্যাটাল বা দক্ষিণ আফ্রিকায় জীবনে যাওনি।
সকলের দৃষ্টি ব্লোরের দিকে ঘুরল। ক্রুদ্ধ সে দৃষ্টি। মার্সটন তো ঘুসি বাগিয়েই এগিয়ে এল।
ব্লোর সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আপনারা শুনুন, আমার পরিচয়পত্র সঙ্গেই রয়েছে। আমি আগে পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগে ছিলাম। এখন আমি প্রাইভেট গোয়েন্দা। এখানে সেই কাজ নিয়েই এসেছি।
–আপনাকে কে আসতে বলেছে?
–মিঃ আওয়েন। মনিঅর্ডারে মোটা টাকার পারিশ্রমিক পাঠিয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন, আপনাদের ওপর নজর রাখার জন্য।
–নজর রাখতে? কিন্তু কেন?
–যাতে মিসেস আওয়েনের মূল্যবান গয়নাগাঁটি খোয়া না যায়। এখন বুঝতে পারছি, সবই ভাঁওতা, ও নামে এখানে কেউ নেই।
ভেরা বলল, যদি থাকেও, বদ্ধ পাগল ছাড়া কিছু নয়।
মিঃ ওয়ারগ্রেভ বললেন, তবে তাকে ভয় করবার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই আমার মনে হচ্ছে।
.
০৪.
হঠাৎ করে সকলেই কেমন নীরব হয়ে যায়। যেন হতাশায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছে।
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ। বললেন, আমি কেন এখানে এসেছি এবারে বলি।
বলে পকেট থেকে একটা খাম বার করে তিনি টেবিলে রাখলেন। তার ভেতরের চিঠিটা বার করে সকলকে দেখিয়ে বললেন, কয়েকদিন আগে এটা পেয়েছি, লিখেছেন লেডি কনস্টান্স কালমিংটন।
তিনি আমার বিশেষ পরিচিত হলেও বেশ কয়েক বছর কোন যোগাযোগ নেই। এই চিঠিটা ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে। আপনারাও এরকম চিঠি একটা করে পেয়েছেন। যে বা যারা এই চিঠি পাঠানোর পেছনে রয়েছে, বোঝা যাচ্ছে তারা আমাদের ব্যাপারে অনেক খবরাখবর জোগাড় করেছে।
তাই অপরাধগুলো একে একে আমাদের সবার ঘাড়ে চাপিয়েছে।
জেনারেল ডগলাস সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, এসবই মিথ্যা কথা।
–একটা বদমাশ লোকের কারসাজি এসব। ভেরা চিৎকার করে বলে।
পরপর সকলেই প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ওয়ারগ্রেভ হাত তুলে সকলকে থামতে অনুরোধ জানালেন। পরে বললেন, আমি আমার নিজের কথাই প্রথমে বলি শুনুন।
এই অজানা বন্ধুটি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে জনৈক এডওয়ার্ড সেটনের মৃত্যুর জন্য নাকি আমি দায়ী।
ঘটনাটা বললেই আপনারা বুঝতে পারবেন আমি দোষী কি নির্দোষ। ১৯… জুন মাসে আমার এজলাসে লোকটির বিচার হয়। বয়স্কা এক নারীকে হত্যা করেছিল সে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে সে জোরালো যুক্তি দিয়েছিল, জুরীরাও যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।
কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ পাওয়া গেছে তার চুলচেরা বিচার করে আমি তাকে মৃত্যুদণ্ড দিই।
মিঃ ওয়ারগ্রেভ সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে ফের বললেন, আমি বিচারকের আসনে বসে আইন রক্ষার পবিত্র কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। আমার বিবেকের কাছেও আমি পরিষ্কার। আপনারাই বলুন, আমার অপরাধটা কোথায়?
ডাঃ আরমস্ট্রং-এর মনে পড়ে যায় মামলাটার কথা।
এক অ্যাডভোকেট বন্ধুর কাছে তিনি শুনেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, আসামীর ওপর জজের নিশ্চয় কোন পোষা রাগ ছিল। তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আইন ঘেঁটে তাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিল।
ডাক্তার বললেন, মামলার আগে থেকে আপনি কি সেটনকে চিনতেন?
কথাটা শুনে ওয়ারগ্রেভের মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে নিজেকে সংযত করলেন। বললেন, তার নাম পর্যন্ত আগে কখনো শুনিনি। পরিচয়ের প্রশ্নই আসে না।
ডাক্তার আরমস্ট্রং কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। মনে মনে বললেন, জজসাহেব, তুমি মিথ্যাবাদী।
.
বিচারপতির বক্তব্য শেষ হলে ভেরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমার কথাটা বলছি শুনুন। একটা শিশু, তার ডাকনাম ছিল সিরিল। আমি তার গভর্নেস ছিলাম। আমি তাকে খুব ভালবাসতাম।
বলতে বলতে কান্নায় বুজে এলো তার গলা। পরে সামলে নিয়ে বলল, একদিন আমি তাকে সাঁতার শেখাচ্ছিলাম।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। আমার জলে নামার আগেই দুষ্টুটা জলে নেমে পড়েছিল। খেয়াল হতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
তাকে টেনে তুললাম বটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। এই শিশুটির মৃত্যুর জন্য আমি তো দায়ী ছিলাম না।
ভেরা রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিল। পরে বলল, তদন্তে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই। ওদের পরিবারের কারোরই কোনো অভিযোগ ছিল না আমার ওপরে, সকলেই আমাকে ভালবাসতো।
কিন্তু এখন এতদিন পরে আমাকে এই মৃত্যুর জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে। এসব কি? কার এই কারসাজি? উদ্দেশ্য কি?
বলতে বলতে ভেরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
জেনারেল ডগলাস ভেরাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তুমি কেঁদো না। সবই মিথ্যে। আমরা সকলেই তা বুঝতে পারছি। কোন পাগলেরই কাণ্ড এসব।
এরপর ডগলাস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অকল্পিত দৃঢ় স্বরে বললেন, আর্থার রিচমণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আমার স্ত্রীর সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, তার কোন সত্যতা নেই। আমার স্ত্রী ছিলেন নির্মল চরিত্রের সাধ্বী মহিলা।
রিচমণ্ড ছিল আমার বাহিনীর এক নতুন অফিসার। যুদ্ধক্ষেত্রেই সৈনিকের মত মৃত্যুবরণ করেছিল সে। একজন সৈনিকের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঘটনা।
কথা শেষ করে জেনারেল বসে পড়লেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করছেন।
এবারে লমবার্ড বলতে শুরু করলেন। দুচোখে কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে তিনি বললেন, অদৃশ্য অভিযোগকারী কালামানুষগুলোর কথা বলল, তা সম্পূর্ণ সত্য। সকলে চমকে উঠে তাকাল লম্বার্ডের দিকে।
–হ্যাঁ, সম্পূর্ণ সত্যি, হাসল লমবার্ড, বনের মধ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। খাবারও ফুরিয়ে গিয়েছিল।
দলে আমরা ইংরাজ ছিলাম তিনজন। সবাই চায় নিজের প্রাণ বাঁচাতে। আমরাও ওদের ফেলে রেখে পালিয়ে এসেছিলাম।
–ছিঃ ছিঃ, দলের লোকদের ফেলে পালিয়ে এলে? এ তো কাপুরুষের কাজ। ধিক্কার জানালেন ডগলাস।
–হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারছি, লমবার্ড বলল, খাঁটি ইংরাজের মত কাজটা হয়নি। আমাদের তখনকার মনের অবস্থা আশা করি আপনারা বিবেচনা করবেন। তাছাড়া, কুড়িটা জংলী মানুষের চেয়ে তিনজন শ্বেতাঙ্গের প্রাণের মূল্য অনেক বেশি।
.
–আমার নিজের কথা এবারে বলছি, অ্যান্টনি মার্টন বলতে শুরু করলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনানো হয়েছে, জন এবং লুসি কোম্বের হত্যার জন্য নাকি আমি দায়ী।
কিন্তু ঘটনাটা যে একটা দুর্ঘটনা ছিল, তা আপনারাও নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। কেম্বুিজের কাছে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম, কাছের একটা বাড়ি থেকে দুটো বাচ্চা দৌড়ে আমার গাড়ির তলায় এসে পড়েছিল। এভাবেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল।
.
মিঃ ওয়ারগ্রেভ রজার্সের দিকে তাকালেন। বুঝতে পেরে সে বলল, মিস ব্র্যাডির মৃত্যুর সঙ্গে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে যা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
–বলে যাও।
সেই বৃদ্ধা ছিলেন চিরকুমারী। তাঁর শরীর ভাল ছিল না। আমরা দুজন দেখাশোনা করতাম। একদিন রাতে তার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি। তার মধ্যেই পায়ে হেঁটে ডাক্তারের বাড়ি গেলাম। তিনিও এলেন, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মিস ব্র্যাডি হার্টফেল করে মারা যায়।
লমবার্ড মুখে কিছু বলল না কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রজার্সের দিকে।
.
লমবার্ড ব্লোরের দিকে তাকিয়ে বলল, এবারে নিজের কথা আপনি কিছু বলুন।
–আমার আর কি কথা!
–কেন, অভিযুক্তদের তালিকায় আপনার নামও তো ছিল।
–ল্যান্ডারের কথা বলছেন, সে-তো ছিল একটা ব্যাঙ্কলুটের আসামী।
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ একটু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, এই মামলাটা আমার এজলাসে ওঠেনি। তবে মামলার কথা আমার মনে আছে।
আপনার সাক্ষ্য বিবেচনা করেই ল্যান্ডারের শাস্তি হয়েছিল। পুলিসের পক্ষে আপনিই তো মকদ্দমাটা তদারক করেছিলেন, তাই না?
–হ্যাঁ। ব্লোর বলল, রাতের পাহারাদারকে কাবু করে সে তার কাজ হাসিল করেছিল। তার অপরাধ স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছিল। কারাবাসেই অসুস্থতায় মৃত্যু হয়েছিল।
–দক্ষতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা করার জন্য আপনি কোন পুরষ্কার পাননি?
–হ্যাঁ, আমার পদোন্নতি হয়েছিল। তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমি আমার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করেছিলাম। জানায় ব্লোর।
.
এরপরে ডাঃ আরমস্ট্রং তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন।
–সকলেই যখন বললেন, আমাকেও বলতে হল। কিন্তু কি বলব বলুন? ওই রোগীর নামও আমার মনে নেই আর। অনেকদিন আগের কথা। মনে হয় হাসপাতালের কোন অপারেশন কেস।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন কিছু মনে করবার চেষ্টা করলেন ডাক্তার। পরে বললেন, শেষ মুহূর্তে এসেছিল হাসপাতালে। হ্যাঁ, আমি মদ্যপান করেছিলাম, কিছুটা নেশাও হয়েছিল। সেই অবস্থাতেই তাকে অপারেশন করেছিলাম।
হ্যাঁ, বলতে পারেন সেই মহিলাকে আমিই মেরে ফেলেছি। সামান্য অপারেশন হলেও, হাত কাঁপছিল, গোলমাল করে ফেলেছিলাম। কিন্তু এক সিনিয়র সিস্টার ছাড়া আর কেউ জানত না সেই ঘটনা।
কিন্তু, এই রহস্য আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এতদিন পরে কে সেই কথা জানল?
-আমার কাছ থেকে কিছু শুনবার জন্য নিশ্চয় আপনারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন? বললেন এমিলি ব্রেনট, কিন্তু আমার কিছুই বলার নেই।
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ প্রশ্ন করলেন, কিছুই নেই?
–না, কিছুই নেই। কেন না, চিরকাল আমি আমার বিবেকের নির্দেশেই চলে এসেছি, আজও সেভাবেই চলেছি।
–বেশ, তাহলে এখানেই আমার তদন্ত শেষ হল।
এই বলে বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ সামান্য কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর রজার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা রজার্স আমরা কজন, তুমি আর তোমার স্ত্রী ছাড়া এই দ্বীপে আর কি কেউ আছে?
–না স্যার, আমি ভাল করেই জানি।
-দেখ, যে লোকের আমন্ত্রণে আমরা এখানে এসেছি সে মোটেই সুবিধের লোক বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের সকলের পক্ষেই ক্ষতিকর। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দ্বীপ থেকে আমাদের চলে যাওয়া উচিত। সম্ভব হলে আজ রাতেই–
–কিন্তু স্যার এখন তো বোট নেই।
–তাহলে তীরের সঙ্গে তোমরা যোগাযোগ রাখ কি করে?
–নারাকোট রোজ সকালে আসে, রুটি, দুধ আর চিঠিপত্র থাকলে দিয়ে যায়। কিছু ফরমাস থাকলে পরে তার ব্যবস্থা করে।
–তাহলে, কাল সকালেই আমরা দ্বীপ ছেড়ে চলে যাব, আপনারা কি বলেন?
সকলেই বিচারপতির প্রস্তাব একবাক্যে সমর্থন করল। একমাত্র মার্সটন বলল, আমি কিন্তু যাচ্ছি না, বিপদে আমি ভয় পাই না, এই রহস্যের শেষ দেখে আমি যেতে চাই।
কথা শেষ করে টেবিলের ওপর থেকে একটা জলের গ্লাস তুলে নিলেন। কিন্তু মুখে ঠেকাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে গেল। মুখটা কুঁচকে উঠল, চেয়ার থেকে টলে পড়ে গেলেন।
.
০৫.
এমন আকস্মিকভাবে ঘটনাটা ঘটল যে, বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই সকলের কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল।
সবার আগে ছুটে গেলেন ডাক্তার। নাড়ী পরীক্ষা করলেন, গম্ভীর গলায় বললেন, আশ্চর্য, এর মধ্যেই মৃত্যু!
গ্রীক ভাস্কর্যের মত সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল যুবক মার্সটন। এমনভাবে তার মৃত্যু হবে, কেউ যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না। এমন অসম্ভব ঘটনা কি করে সম্ভব হয়?
জেনারেল ডগলাস জানতে চাইলেন, বিষম লেগেই কি এমনটা হল?
–হ্যাঁ, শ্বাসরোধেরই ঘটনা। তবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
এই কথা বলে ডাক্তার গ্লাসটা তুলে নাকের কাছে ধরলেন। আঙুলের ডগা দিয়ে তলানি থেকে কি তুলে নিলেন, আলতো করে জিভে ঠেকালেন।
এবারে তিনি তাকালেন মার্সটনের মৃতদেহের দিকে। মুখটা সামান্য বিকৃত হয়ে গেছে। ঠোঁটদুটো নীল।
ডাক্তার উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, এ মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
–তবে? ভেরা অস্ফুটে উচ্চারণ করল।
–আমার বিশ্বাস পটাসিয়াম সায়ানাইড, তাই সঙ্গে সঙ্গে কাজ করেছে।
–তাহলে কি গ্লাসে ছিল? ওয়ারগ্রেভও বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
–হ্যাঁ!
–এমন বিষ কি নিজেই মিশিয়েছিল? লমবার্ড জানতে চান।
ব্লোর প্রতিবাদ করেন, অমন মানুষের আত্মহত্যা করা অসম্ভব। অসম্ভব।
–মনে হয় আত্মহত্যাই। চিন্তিতভাবে বললেন ডাক্তার।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে অন্য সকলেই ডাক্তারের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন।
অন্য গ্লাসগুলোও পরীক্ষা করা হল। কিন্তু সন্দেহ করার মত কিছুই পাওয়া গেল না।
ব্লোর বলল, এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।
–আমিও আপনার সঙ্গে একমত। চিন্তিতভাবে বললেন ডাক্তার।
.
মার্টনের মৃতদেহ ধরাধরি করে তার ঘরে রেখে এলেন ডাক্তার আর লমবার্ড। সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে আসা হয়েছে।
একটা অদৃশ্য ঝড় যেন বয়ে গেল সকলের ওপর দিয়ে। অস্বাভাবিক থমথমে হয়ে গেল সমস্ত পরিবেশ।
রাত অনেক হয়েছিল। বারোটা। ওয়ারগ্রেভ বললেন, রাত অনেক হল, সবারই একটু ঘুম দরকার।
রজার্স বলল, আপনারা শুতে চলে যান। আমি খাবার ঘরটা পরিষ্কার করে এখুনি যাচ্ছি।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার স্ত্রী এখন কেমন আছে?-
-এখন ঘুমোচ্ছে।
–বেশ। ঘুমটা দরকার।
.
রাতের পোশাক পরে ওয়ারগ্রেভ শুতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। সহসা এডওয়ার্ড সেটনের কথা তার মনে পড়ল।
দুঁদে উকিল ম্যাথুস ওর হয়ে খুব জোরালো সওয়াল করেছিল। কিন্তু সরকার পক্ষের উকিল ছিল একেবারে অপদার্থ।
জেরার উত্তরে সেটনও শান্ত সংযতভাবে সুন্দর জবাব দিয়েছিল। জুরিরাও প্রভাবিত হয়েছিল। সকলেই ধরে নিয়েছিল সে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে।
ওয়ারগ্রেভ ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখলেন। বাঁধানো দুপাটি দাঁত খুলে একটা গ্লাসে জলে ডুবিয়ে রাখলেন।
কিন্তু এত কিছুর পরেও সেটন মুক্তি পায়নি। তার রায়েই মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল লোকটার।
ওয়ারগ্রেভ যেন আলো সহ্য করতে পারছিলেন না। দ্রুত হাতে আলোটা নিভিয়ে দিলেন।
রজার্স তার কাজ শেষ করে এনেছে। এমনি সময়ে হঠাৎ ঘটনাটা তার নজরে পড়ে গেল।
এ কী করে সম্ভব? হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। একটু আগেও দশটা পুতুল সে দেখেছে, কিন্তু এখন রয়েছে একটা কম–নটা পুতুল।
আর্থার রিচমণ্ডের মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। তাই বিছানায় শুয়েও কেবলই এপাশ-ওপাশ করছেন জেনারেল ডগলাস।
তরুণ অফিসারটিকে তিনি পছন্দ করতেন। তাঁর স্ত্রী লেসলিও খুশি হয়েছিল তাকে দেখে। ফলে যাতায়াত বাড়ল।
গল্পগুজব, একসঙ্গে খেলা ঘোরা সবই হতে লাগল। এখন বুঝতে পারছেন, স্নেহের ভাবটাকে প্রশ্রয় দিয়ে সেদিন কী ভুলটাই করেছিলেন।
লেসলির বয়স ছিল উনত্রিশ আর রিচমণ্ডের আঠাশ। বয়সের পার্থক্যটা চিন্তা না করেই দুজেনর মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
লেসলি ছিল সুন্দরী। তিনি ভালবাসতেন তাঁকে। বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এমনভাবে যে আঘাত পাবেন বুঝতে পারেননি।
তিনি ছিলেন ফ্রান্সে–বাহিনীর সঙ্গে। রিচমণ্ডও সেখানে। মাঝে মাঝে সে দেশে–ইংলণ্ডে যেত। লেসলি ছিল সেখানেই। অবাধে মেলামেশার সুযোগ তারা পেয়েছে।
বিচিত্র উন্মাদনায় ডুবেছিল তারা। হঠাৎ লেসলির একটা চিঠি তার হাতে পড়ে যায়–রিচমণ্ডকে লেখা। কিছু আর জানতে বাকি থাকে না।
রিচমণ্ডের ঘন ঘন দেশে যাবার রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। উঃ কী নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন তিনি।
সেই সময় লড়াই শেষ হবার মুখে। ফ্রান্সে শত্রুপক্ষের কয়েকটা সুরক্ষিত ঘাঁটি তখনো থেকে গিয়েছিল। তারই একটায় আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন রিমণ্ডকে। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হয়।
লেসলিকে তিনি রিচমণ্ডের মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে দেশে ফিরেছেন তিনি। কিন্তু লেসলিকে কিছুই জানতে দেননি।
চমৎকার অভিনয় করে গেছেন চার বছর। লেসলি তারপর মারা গেল নিউমোনিয়া জ্বরে। সে তো আজ ষোল বছর আগের ঘটনা।
কিন্তু এই ঘটনা তো কেউ জানতো না। অথচ এতদিন পরে জানা গেল কেউ একজন। রিচমণ্ডের কথা জেনে গেছে। কিন্তু কে সে?
সমুদ্রের গর্জন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। জেনারেল ডগলাসের মনে হল শব্দটা যেন ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে।
.
ঘরের ছোট্ট আলোটা জ্বলছে, ভেরা শুয়ে আছে বিছানায়। ঘুম আসছে না তার চোখে।
হুগোর কথা মনে পড়ছে তার। মার্সটনের মৃত্যু কী এক অজ্ঞাত কারণে আলোড়ন তুলেছে। মনে।
মিষ্টি চেহারার চঞ্চল ছোট্ট সিরিল। শ্রীমতি হ্যাঁমিলটন তার মা।
সেদিন সন্ধ্যায় সিরিলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল ভেরা। নিজের ঘরে যেতে গিয়ে পেছন থেকে হুগোর ডাক শুনতে পেল। বলল, চলো, দুজনে একটু বেড়িয়ে আসি।
করনওয়াল … পাহাড়ঘেরা অঞ্চল … নীল আকাশ … সামনে সমুদ্র … নরম হলুদ বালির বালিয়াড়ি–
ভেরা সম্মত হয়। নির্জন সমুদ্রতীরে এসে পাশাপাশি বসে দুজন।
হুগো জানায়, ভেরা আমি তোমায় ভালবাসি।
–আমি জানি।
–কিন্তু তুমি জান না, আমি খুব গরীব। তোমার আমার মাঝের ব্যবধান কোনোদিনই ঘুচবার নয়।
–গরীব তো কি এসে যায়–গরীব তো আমিও।
–সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দাদার। আমিই সম্পত্তির মালিক হতে পারতাম—কিন্তু
কিন্তু কি?
–না, দাদার তো বয়স অনেক হয়েছে, সকলেই ধরে নিয়েছিল ছেলেপুলে কিছু আর হবে না। কিন্তু … তার পরেই এলো সিরিল। সে যদি মেয়ে হতো তাহলে … যাক …. সিরিলকে আমি ভালবাসি, ও বেঁচে থাকুক।
ভেরার বুঝতে কিছুই বাকি থাকল না। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সে জানতো, হুগো, তার ভাইপোকে অসম্ভব ভালোবাসে।
তারপরের দিনই তো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দুষ্টুমি করে জলে নেমে আর ওঠেনি সিরিল।
ভেরা জানে, সেদিন সে তাকে স্বচ্ছন্দে বাঁচাতে পারতো। কিন্তু তার যে কোথায় বাধা ছিল–সে সিরিলকে ইচ্ছে করেই বাঁচাবার চেষ্টা করেনি।
হা ঈশ্বর! ক্ষমা করো।
ভেরা জানে না ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করেছেন কি না। কিন্তু হুগো ক্ষমা করেনি। ওই ঘটনার পর সে আর তার মুখদর্শন করেনি।
ভেরার বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো। সে উঠে ঘুমের ওষুধ খেলো। তারপর দুহাতে মুখ গুঁজে বসে থাকে।
রাত এগিয়ে চলে ভোরের দিকে।