১১.
মিসেস ব্যান্ট্রি অ্যাডিলেড জেফারসনের সঙ্গে ছিলেন। তিনি এসে স্যার হেনরি ও মিস মারপলের সঙ্গে মিলিত হলেন।
মার্ক গ্যাসকেল বারান্দায় কোণের দিকে একাই বসেছিলেন। চারজনে বেরিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে যোগ দিলেন।
মিস মারপল ছাড়া অপরাপর সকলেই পুরনো বন্ধু। কাজেই মার্ক গ্যাসকেল আর এডিলেড জেফারসন মিস মারপলের পরিচয় বন্ধুদের কাছ থেকেই জানতে পারলেন।
ব্যান্ট্রি বললেন, মিস মারপল অপরাধের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। তিনি এব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে আগ্রহী।
আমার শ্বশুরমশায় পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড ওই হাবাগোবা মেয়েটাকে দিতে চেয়েছিলেন, ভাবতে পারেন? মার্ক গ্যাসকেল বললেন। অ্যাডি আর আমি দুজনেই মেয়েটার মৃত্যু কামনা করেছিলাম।
স্যার হেনরি বললেন, ব্যাপারটা জানতে পেরে আপনারা কনওয়েকে কিছু জানাননি?
–আমাদের আপত্তি জানাবার অধিকার কোথায়? টাকাটা ওর। তবে ওই রুবিকে আমরা ভাল চোখে দেখতাম না।
–সবকিছুর জন্য যোসিই দায়ী। বললেন মার্ক, ওই রুবিকে এখানে নিয়ে এসেছিল। অবশ্য এটাও ঠিক, আমার স্ত্রী রোজামণ্ডের সঙ্গে ওর যেন কি রকম মিল ছিল। আর এজন্যই ওর প্রতি বুড়োর টান জন্মেছিল।
কথা বলতে বলতে মার্ক লাউঞ্জের সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, দেখ অ্যাডি কে এসেছে।
মিসেস জেফারসন ঘুরে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পরে এগিয়ে গেলেন দীর্ঘকায় মাঝবয়সী এক ভদ্রলোকের দিকে।
–হুগো ম্যাকলীন মনে হচ্ছে না? মিসেস ব্যান্ট্রি বললেন।
–অবশ্যই হুগো ম্যাকলীন ওরফে উইলিয়ম ডবিন। তার আশা অ্যাডি একদিন ওকে বিয়ে করবে। অ্যাডি আজই বলেছিল তাকে টেলিফোন করবে।
এই সময় এডওয়ার্ড এগিয়ে এসে মার্কের পাশে দাঁড়িয়ে জানাল, মিঃ জেফারসন আপনাকে এখুনি একবার ডেকেছেন।
মার্ক উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। তারপর সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
–খুবই হীনমনা মানুষ, বললেন মিস মারপল, পুরুষ মানুষ হিসেবে আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই কিন্তু মগজে বুদ্ধির বড় অভাব রয়েছে।
এই সময় দেখা গেল সাদা ফ্ল্যানেলের পোশাকপরা এক সুপুরুষ তরুণ বারান্দায় উঠে এল। অ্যাডিলেড আর হুগো ম্যাকলীনের দিকে তাকাল।
স্যার হেনরী বললেন, ইনি হলেন রেমণ্ডস্টার, রুবী কীনের নাচের জুড়ি। যোগসূত্র এর সঙ্গেও কিছুটা রয়েছে। ভাল টেনিস খেলোয়াড়।
মিস মারপল সাগ্রহে তার দিকে তাকালেন।
এই সময় বাচ্চা কারমেলি বারান্দায় ঘোরাঘুরি করতে করতে তাদের দিকে এগিয়ে এল। স্যার হেনরির দিকে তাকিয়ে সে বলল, আপনি নিশ্চয়ই একজন গোয়েন্দা। ওই সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে আপনাকে কথা বলতে দেখেছিলাম। জানেন, আমি খুঁজছি, খুনের যদি কোন সূত্র পাওয়া যায়।
–কে খুন করেছে জানতে পেরেছ নাকি? মিসেস ব্যান্ট্রি আগ্রহের সঙ্গে তার দিকে ঝুঁকে বসলেন।
–একটা স্মৃতিচিহ্ন পেয়েছি।
বলতে বলতে পিটার পকেট থেকে একটা দেশলাইয়ের বাক্স বার করে সেটা খুলে দেখাল।
–দেখছেন একটা নখের টুকরো–সেই রুবি মেয়েটার নখ। একটা দারুণ স্মৃতিচিহ্ন, তাই?
–এটা কোথায় পেয়েছ? মিস মারপল বললেন।
রুবির নখ যোসির শালে আটকে গিয়েছিল। তাই ওটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। মা ওটা কেটে দিয়েছিলেন। আমাকে নখের টুকরোটা দিয়ে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিতে বলেছিলেন। আর একটা জিনিসও পেয়েছি।
একটা খাম থেকে অনেকটা বাদামী রঙের ফিতের মত জিনিস বার করে দেখলে সে।
–এটা হল জর্জ বার্টলেট নামের লোকটার জুতোর ফিতে। দরজার সামনে পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়েছি–তুচ্ছ জিনিসও পরে অনেক কথা বলতে পারে।
–কি কাজে লাগতে পারে মনে কর তুমি? জানতে চাইলেন মিস মারপল।
–ওই তো শেষ বার রুবীকে দেখেছিল। লোকটার চাল-চলনও কেমন সন্দেহজনক। আরে ওই তো হুগো কাকা-মা ঝামেলায় পড়লেই তাকে ডেকে পাঠান। আজও খবর দিয়েছিলেন। হাই যোসি”..
বারান্দা পার হয়ে আসছিল যোসেফাইন টার্নার। মিসেস ব্যান্ট্রি আর মিস মারপলকে দেখে কেমন চমকে গেল।
–কেমন আছেন মিস টার্নার? বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি, আমরা একটু গোয়েন্দাগিরি করতে এলাম এখানে।
–আশা করি কিছু মনে করবেন না। আপনাকে খোলাখুলি একটা প্রশ্ন করতে চাই।
নিশ্চয়ই করবেন। কিছুটা অখুশি হয়েই বলল যোসি।
-ওই ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সঙ্গে কি মিসেস জেফারসন ও মিঃ গ্যাসকেলের কোন তিক্ততা হয়েছিল? ওই খুনের ব্যাপারটা বলছি না আমি।
–ব্যাপারটার জন্য তারা আমাকেই দায়ী করছেন রুবিকে আমিই তো এনেছিলাম। কিন্তু এরকম কিছু যে হতে পারে আদৌ আমার মনে হয়নি।
–হ্যাঁ, ব্যাপারটা আপনার পক্ষে খুবই অস্বস্তিকর। বললেন মিস মারপল।
–এটা ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যায় বলুন। ভাগ্যের সহায়তা যে কেউই পেতে পারে।
কথা শেষ করে প্রত্যেকের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে গটগট করে হোটেলে ঢুকে গেল মিস টার্নার।
-নাঃ, ও খুব করেছে বলে মনে হয় না। বলে উঠল পিটার।
–আমি ভাবছি নখটা নিয়ে, বললেন মিস মারপল।
–নখ? আশ্চর্য হলেন মিঃ হেনরি।
–ওর নখ খুব ছোট করে কাটা ছিল। জেনও তাই বলেছে। বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি। তবে এ ধরনের মেয়েদের তো বড় নখই রাখতে দেখি।
–ওর ঘরে আরও কাটা নখের টুকরো পাওয়া গেলে বোঝা যাবে, একটা নখ ভেঙ্গে যাওয়ায় অন্যগুলোও সমান করে কেটে নিয়েছিল। বললেন মিস মারপল।
-সুপারিন্টেডেন্ট হার্পারকে প্রশ্ন করলে জানা যাবে। তিনি তো আবার একটা অ্যাকসিডেন্টের তদন্ত করতে চলে গেছেন। বললেন স্যার হেনরী।
–অ্যাকসিডেন্ট? চমকে উঠলেন মিস মারপল।
–হ্যাঁ, একটা খনির খাদে জ্বলন্ত একটা গাড়ি দেখা গেছে।
–গাড়িতে কেউ ছিল?
–আশঙ্কা হচ্ছে ছিল।
–আমার ধারণা দেহটা সেই গার্ল গাইডের–ওর নাম পামেলা রীভস।
–আশ্চর্য কাণ্ড। আপনি একথা বলছেন কি করে?
রেডিওতে শুনেছিলাম, গতরাত থেকে মেয়েটা নিরুদ্দেশ। ওর বাড়ি কাছেই ডেনলে ভেলে। তাকে শেষবার দেখা গিয়েছিল ডেনবারি ডাউনে–গার্ল গাইড র্যালিতে। ডেনমাউথ হয়েই তার বাড়ি ফেরার কথা। আমার ধারণা মেয়েটা এমন কিছু দেখে বা শুনে থাকবে যা খুনীর কাছে বিপজ্জনক ছিল। সেকারণেই তাকে সরানো দরকার হয়ে পড়েছিল। যোগসূত্রটা খুবই পরিষ্কার।
স্যার হেনরি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে বলছেন, এটা দু-নম্বর খুন?
–হ্যাঁ। তৃতীয় খুনের ঘটনা ঘটলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।
–তৃতীয় একটা খুনও হতে পারে বলছেন?
–আমার মনে হয় খুবই সম্ভব।
–কে খুন হতে পারে, তাও কি আপনি জানেন মনে করেন?
–জানি বইকি। বললেন মিস মারপল।
.
১২.
সুপারিন্টেন্ডেন্ট হার্পার মাচ বেনহ্যামে কর্নেল মেলচেটের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছেন।
-রুবি কীন আর পামেলা রীভস এই দুটো মৃত্যু আমাদের এখন মোকাবেলা করতে হবে। বললেন মেলচেট। একটা জুতো পোড়েনি, সেটা দেখেই ওকে সনাক্ত করা সম্ভব হল। নৃশংস, ভয়ঙ্কর কাজ।
একটু থেমে আবার বললেন মেলচেট, ডাঃ হেডক জানিয়েছেন গাড়িতে আগুন লাগার আগেই মারা গিয়েছিল মেয়েটা। তার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল সম্ভবত।
শ্বাসরোধ করেও মারা যেতে পারে।
-এখন আমাদের দেখতে হবে দুটো খুনের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা। বললেন মেলচেট।
মেয়েটা ডেনবারি ডাউনসে গার্ল গাইড র্যালিতে যোগ দিয়েছিল। তার সঙ্গীরা মেডচেষ্টারের বাসে উঠে গিয়েছিল। একজন সঙ্গী জানিয়েছে পামেলা রীভস ডলওয়ার্থে যাওয়ার জন্য ডেনমাউথে যাবে। সর্টকাট করবার জন্যই সে দুটো মাঠের মধ্য দিয়ে গলি আর ফুটপাথ ধরে এগিয়েছিল। ওই গলিটা ডেনমাউথে ম্যাজেস্টিক হোটেলের পশ্চিম দিক ঘেঁষে চলে গেছে। সম্ভবত ওই পথেই সে কিছু দেখে থাকবে যা রুবি কীনের সঙ্গে জড়িত। ফলে নিরপরাধ স্কুলের মেয়েটাকে খুন হতে হয়েছে।
-রুবি কীনের সম্পর্কিত যদি কিছু ঘটে থাকে তা ঘটেছিল রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। এতরাতে স্কুলের মেয়েটার ম্যাজেস্টিক হোটেলের কাছে যাবার কি কারণ থাকতে পারে?
–মিস মারপল কিন্তু ঘটনা শুনেই দুটো ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন গাড়িতে গার্ল গাইড মেয়েটিরই দেহ পাওয়া গেছে কিনা। অসম্ভব বুদ্ধিমতী মহিলা। বললেন হাপার।
মিস মারপল এরকম কাজ আগেও অনেকবার করেছেন। বললেন মেলচেট।
হুগো ম্যাকলিন আর অ্যাডিলেড জেফারসন সমুদ্রের দিকের পথ ধরে এগিয়ে গেছে।
হোটেলের বারান্দায় বসেছিলেন মিস মারপল আর মিসেস ব্যান্ট্রি।
–অ্যাডিলেড জেফারসন এতক্ষণ আমাকে বলছিল তার স্বামী সব টাকাপয়সা খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মিঃ জেফারসনকে তারা কিছুই বুঝতে দেয়নি। বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি।
-আর কি বলছিল। জানতে চাইলেন মিস মারপল।
–বলছিলেন হুগো ম্যাকলিন তাকে বিয়ে করতে চায়।
–হ্যাঁ বুঝতে পারছি। ওর হাবভাব দেখেই মিঃ জেফারসেন বুঝতে পেরেছিলেন। ব্যাপারটা তার পছন্দ না। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চেয়েছিল রুবি কীন।
.
স্যার হেনরি ক্লিদারিং ঠিক সেই মুহূর্তেই ম্যাককে বলছিলেন, তুমি বরাবরই একজন জুয়াড়ি। এই করেই ডুবেছ।
-জুয়াড়ি হতে পারি তবে খুনী নই। আমি কাউকে গলা টিপে হত্যা করতে পারি না। তবু জানি পুলিসের চোখে আমিই এক নম্বর আসামী। তবে আঘাতটা মিঃ জেফারসনের ভালই লেগেছে। অন্ততঃ আসল কথাটা জানার চেয়ে ভাল।
চমকে উঠলেন স্যার হেনরি ক্লিদারিং। বললেন, আসল কথাটা জানা–একথার অর্থ কি?
-আমার দৃঢ় বিশ্বাস রুবি কীন গত রাতে অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। আমার শ্বশুর তার এই ছলনা জানতে পারলে সহ্য করতে পারতেন না। তিনি মেয়েটিকে নিষ্পাপ নিরীহ ভেবে নিয়েছেন। আমার আর অ্যাডির যে এই বন্দিজীবন, বইতে পারছিলাম না আমরা তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই রুবি কীনকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন।
.
১৩.
ডেনহ্যামের অতি পরিচিত ডাক্তার মিঃ মেটকাফ। তিনি কনওয়ে জেফারসনের চিকিৎসকও। সুপারিন্টেন্টে হার্পার তার সঙ্গে দেখা করলেন মিঃ জেফারসনের শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে জানবার জন্য।
ডাঃ মেটকাফ জানালেন; মিঃ জেফারসনের হৃদপিণ্ড, ফুসফুস্; রক্তচাপ–সবই অত্যন্ত চাপের মধ্যে রয়ে গেছে। মেরুদণ্ডও ক্ষতিগ্রস্ত। কোন রকম পরিশ্রম বা আঘাত বা আচমকা ভয়–এ ধরনের কিছু হলে তার মৃত্যু ঘটে যাওয়া সম্ভব।
ডাঃ মেটকাফ আরও জানালেন যে আগে মিঃ জেফারসন খুব শক্তিমান পুরুষ ছিলেন। এখনও তার দুই হাত ও কাঁধে যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে।
হার্পার বললেন, আপনার কথার সূত্র ধরে তাহলে ধরে নিতে পারি যে কেউ হয়তো ধরে নিয়ে থাকতে পারে যে মেয়েটির মৃত্যু সংবাদে মানসিক আঘাতজনিত কারণে তার মৃত্যু ঘটতে পারে।
–হ্যাঁ, সেটা সহজেই হতে পারে। বললেন ডাঃ মেটকাফ।
দেখা যাক
বলে বিদায় নিলেন হার্পার।
ইতিমধ্যে হাপার কয়েকজন গার্ল গাইডকে চিহ্নিত করেছিলেন। তারা পামেলা রীভসের ঘনিষ্ঠ ছিল। বন্ধুর ব্যাপারে কোন কথা তাদের জানা থাকতে পারে সন্দেহ করা হচ্ছিল।
পথ চলতে চলতে আলোচনা করছিলেন হার্পার আর মিঃ ক্লিদারিং।
–মিস মারপলকে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ জানাব। তিনি মনে হয় এ ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন।
–মনে হয় আপনি ঠিকই ভেবেছেন। ওঁর নজর খুব তীক্ষ্ণ একথা ঠিক।
-আর একটা কথা স্যার। আমি চাইছিলাম আপনি যদি একবার মিঃ জেফারসনের ব্যক্তিগত পরিচারক এডওয়ার্ডকে একটু নাড়াচাড়া করে দেখেন।
তার কাছে কি পাওয়া যাবে বলে ভাবছেন?
–সে এই ঘটনা নিয়ে কি ভাবছে, পরিবারের সকলের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক কেমন, রুবি কীন সম্পর্কে তার ধারণা কি রকম–এসব ভেতরের কথা যেমন খুশি প্রশ্ন করে আপনি জেনে নিতে পারেন। আপনি জেফারসনের বন্ধু, আপনাকে সে মন খুলে জানাতে ভরসা পাবে।
দুজনে কথা বলতে বলতে মিস মারপলের টেবিলে গিয়ে বসলেন। তিনি খুশি হয়ে স্বাগত জানালেন। হার্পার প্রস্তাব দিতেই তিনি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে সম্মত হলেন।
স্যার হেনরি বললেন, ওহো, আপনাকে বলা হয়নি মিস মারপল-হার্পার জানিয়েছেন রুবি কীনের বাজে কাগজের ঝুড়িতে কাটা নখের কিছু টুকরো পাওয়া গেছে।
খুশি হয়ে মিস মারপল বললেন, তাহলে যা ভেবেছি তাই
-কি ভেবেছিলেন আপনি মিস মারপল? সুপারিন্টেন্টে হার্পার নিতে চাইলেন।
–সাধারণতঃ যেসব মেয়ে কড়া রকমের মেকআপ করে তাদের নখ বড় থাকে। রুবি কীনেরও বড় নখ ছিল। একটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। সেই কারণেই সে সব নখ সমান করে নেবার জন্য বাকিগুলোও কেটে ফেলে। এটাই স্যার হেনরিকে দেখতে বলেছিলাম।
–তাহলে এবিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কি। জানতে চাইলেন হাপার।
–আপাতত কোন ব্যাখ্যাই নেই। তবে এটা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে পারছি। বললেন মিস মারপল।
.
১৪.
রেমণ্ডস্টারের টেনিস প্রশিক্ষণ পর্ব চলছিল তারের জালে ঘেরা জায়গাটায়।
শক্তসমর্থ মাঝবয়সী এক মহিলা রেমণ্ডের কাছে তালিম নিচ্ছিলেন। এবারে হোটেলের দিকে চলে গেলেন। বেঞ্চে তিনজন দর্শক বসেছিল।
কাজটা বেশ একঘেয়ে। বললেন মিস মারপল।
স্যার হেনরি রেমণ্ডকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কোন জবাব দিলেন না। সুপারিন্টেন্টে হার্পার উঠে পড়লেন। বললেন, মিস মারপল, আমি এখন উঠি, আপনাকে একঘণ্টা পরে ডেকে নেব।
–বেশ, আমি তৈরি থাকব।
হার্পার বিদায় নিলে রেমণ্ড সামনে এসে বেঞ্চিতে বসল।
রেমণ্ড একজন নৃত্যশিল্পী আর পেশাদার টেনিস কোচ। তাকে লক্ষ্য করে স্যার হেনরি খুশি হতে পারলেন না।
র্যামন…রেমণ্ড…আপনার আসল নামটা কি? আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন স্যার হেনরি।
র্যামন আমার পেশাদারী নাম। যদিও নামটা দিয়েছিলেন আমার এক ঠাকুমা। তবে প্রথম নাম টমাস, বলে স্যার হেনরির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো ডেভনসায়ারের মানুষ, নাম টমাস, বলে স্যার হেনরির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো ডেভনসায়ারের মানুষ, তাই না স্যার? স্টেন? আমার আত্মীয়স্বজনরাও ওই দিকেই থাকতেন, আলসম্পটনে।
–আপনি কি আলসম্পটনের স্টারেদের কেউ? এ তো আমার জানা ছিল না।
–তিনশ বছর ওখানেই আমাদের বাস। এখন অবশ্য আমার বড়ভাই নিউইয়র্কবাসী। আমাদের বাকিরা সবাই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছি।
একটু থেমে আবার বলল, আমি নাচ আর টেনিস খেলাটা জানতাম। সেই কাজই নিলাম রিভিয়েরাতে এক হোটেলে। সেখান থেকে চলে এলাম এখানে। মেয়েদের টেনিস খেলা শেখাতে হয় তার সঙ্গে বড় মানুষের সুখী মেয়েদের সঙ্গে নাচা, এই হল জীবন।
–আপনার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেলাম। বললেন স্যার হেনরি, একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল।
রুবি কীন সম্পর্কে? দুঃখিত, এ ব্যাপারে সাহায্য করার মত কিছুই আমি মেয়েটার সম্পর্কে জানি না। ব্যাপারটাতে কোন মোটিভ আছে বলে আমার মনে হয় না।
–দুজন মানুষের মোটিভ ছিল, বললেন মিস মারপল, রুবি কীনের মৃত্যুতে সম্ভবতঃ লাভবান হচ্ছেন মিসেস জেফারসন আর মিঃ গ্যাসকেল–প্রায় পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড।
–না, না, এ অবিশ্বাস্য। এ ঘটনায় ওদের হাত থাকতে পারে না।
–টাকা সবই সম্ভব করে তুলতে পারে। বললেন মিস মারপল।
ঠিক এই সময়ে অ্যাডিলেড জেফারসন সেখানে উপস্থিত হলেন। তার সঙ্গে ছিলেন হুগো ম্যাকলীন।
দেরি হয়ে গেল, বলে ক্ষমা চেয়ে টেনিস কোর্টের দিকে চলে গেলেন মিস জেফারসন। তাকে অনুসরণ করল রেমণ্ড। হুগো ম্যাকলিন বেঞ্চে বসে পড়লেন। তার দৃষ্টি টেনিস কোর্টে খেলায় ব্যস্ত দুটি সাদা মূর্তির দিকে।
-এই রেমণ্ড লোকটা কে? পেশাদারেরা কেমন অদ্ভুত হয়। বললেন হুগো।
–ও হল ডেভনসায়ার স্টারেদের বংশধর। স্যার হেনরি বললেন।
-সত্যিই তাই? হুগো ম্যাকলীন অখুশিই হলেন বোঝা গেল। অ্যাডি আমাকে কেন যে ডেকে পাঠাল বুঝতে পারছি না।
–আপনাকে কখন ডেকে পাঠিয়েছে? সাগ্রহে জানতে চাইলেন স্যার হেনরি।
–যখন এসব ঘটছিল–টেলিগ্রাম পেলাম গলফ খেলে আসার পরেই। সঙ্গে সঙ্গে চলে আসি।
–আপনাদের ডেনবারি হেড শুনেছি খুব ভাল জায়গা। খরচও কম। বললেন মিস মারপল, একদিন যেতে হবে ওখানে।
-যাবেন–ইয়ে…হ্যাঁ, বেশ তো।
বলে হুগো ম্যাকলীন উঠে পড়লেন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
–আমিও চলি। অনেক কাজ রয়েছে। এই তো, মিসেস ব্যান্ট্রি আসছেন আপনাকে সঙ্গ দেবেন।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পৌঁছলেন মিসেস ব্যান্ট্রি।
–পরিচারিকাদের সঙ্গে কথা বললাম। কিন্তু কিছুই জানতে পেলাম না। মেয়েটা যে বাইরের কারো সঙ্গে প্রেম করত, হোটেলের কেউই সেটা জানতে পারেনি।
ততক্ষণে টেনিস কোর্টের দিকে চোখ পড়েছে।
–অ্যাডি টেনিস ভালই খেলে দেখছি।
–মিঃ জেফারসন মারা গেলে উনি বেশ পয়সাওয়ালা মহিলা হয়ে যাবেন। বললেন মিস মারপল।
–জেন, তুমি এখনো রহস্যের কোন কিনারা করতে পারলে না। ভেবেছিলাম তুমি সঙ্গে সঙ্গেই সব বুঝতে পারবে। মিসেস ব্যান্ট্রির গলায় অনুযোগ ঝরে পড়ল।
-প্রথমে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারছি। বললেন মিস মারপল।
–রুবি কীনকে কে খুন করেছে, এখন বুঝতে পেরেছ বলছ?
–হ্যাঁ, তা জানি।
–সে কে, জেন?
–তোমাকে কেবল ইঙ্গিত দিতে পারি। তোমার পেটে কথা থাকে না ডলি।
–কিন্তু আমি যে এটা জানার জন্যেই ডেনমাউথে এসেছি জেন। তাকে একা বাড়িতে রেখে আসতে হয়েছে।
–আমি তা জানি ডলি। আর তোমার মত আমিও একই কারণে এখানে এসেছি।
.
১৫.
হোটেলের একটা নিরিবিলি কামরা। এডওয়ার্ডস সমসম্ভ্রমে স্যার হেনরি ক্লিদারিং-এর বক্তব্য শুনছিল।
-তুমি তো জান এডওয়ার্ডস, এখানে দুর্ঘটনাটা ঘটে যাবার পরে তোমার মনিব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এই রহস্য ভেদ করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
আমি আগে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে পুলিস কমিশনার ছিলাম। আমার বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে আছেন তিনি।
মৃত মেয়েটির মৃত্যু সম্পর্কে আসল সূত্রগুলো তুমি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ। মেয়েটিকে মিঃ জেফারসন দত্তক নেবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ওরা দুজন–মিঃ গ্যাসকেল আর মিসেস জেফারসন–এদের ঘোরতর আপত্তি ছিল ব্যাপারটাতে। এখন আমার ধারণা ভেতরের খবরাখবর যা তোমারই তা জানা সম্ভব। একজন পুলিস হিসেবে নয়, তোমার মনিবের হিতাকাঙ্ক্ষী একজন বন্ধু হিসেবে আমি এসব জানতে চাইছি। তুমি আমাকে নির্ভয়ে সব বল।
এডওয়ার্ডস দু মিনিট চুপ করে থাকল। পরে বলল, আমি অনেক দিন মিঃ জেফারসনের কাছে রয়েছি। তার ভালমন্দ দুটো দিকই আমার জানা আছে। আমি দেখেছি সবচেয়ে যেটা পছন্দ করতে পারেন না, তা হল তাকে ঠকানোর চেষ্টা।
–কোন বিশেষ কারণে একথা বলছ?
–হ্যাঁ স্যার। যে মেয়েটাকে মিঃ জেফারসন দত্তক নেবেন মনস্থ করেছিলেন, সে তার যোগ্য ছিল না। মিঃ জেফারসনের প্রতি তার কণা মাত্র টান ছিল না।
মিসেস জেফারসনও যথেষ্ট সহানুভূতি পেয়ে এসেছেন তার কাছ থেকে, কিন্তু তিনিও গত গ্রীষ্মকাল থেকে কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করেছেন।
মিঃ জেফারসন সেটা লক্ষ্য করে মনে খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। আর মিঃ মার্ককেও তিনি কখনও ভাল চোখে দেখেননি।
–তা সত্ত্বেও তিনি তাকে কাছে রেখেছিলেন?
-হ্যাঁ স্যার। সবই ওই মেয়ে রোজামণ্ডের জন্য। মেয়েকে তিনি চোখের মণির মত ভালবাসতেন।
–মিসেস জেফারসন যদি বিয়ে করতেন?
–তিনি সেটাও মেনে নিতে পারতেন না। কেবল ওই মেয়েটির প্রতি একটু টান অনুভব করতেন।
–তুমি তাহলে বলছ, রুবি কীন খুবই মতলববাজ ছিল?
–আসলে অল্প বয়স। তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না।
–আচ্ছা মেয়েটি সম্পর্কে পরিবারে কোন রকম আলোচনা হয়েছিল?
–কোন আলোচনা হত না। মিঃ জেফারসন তার মনোভাব পরিষ্কার ভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন।
–মেয়েটির মনোভাব কেমন ছিল?
–আমার মনে হয়েছিল সে খুবই খুশি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে স্যার।
বেশ তো। বল শুনি।
–এর মধ্যে তেমন কিছু সম্ভবত নেই। একদিন মেয়েটি তার ব্যাগ খুলবার সময় একটা ফটো পড়ে গিয়েছিল। ফটোটা একজন তরুণের ছিল স্যার। মিঃ জেফারসন খুবই বুদ্ধিমান। তিনি বেশ রেগে গিয়েছিলেন মেয়েটির কৈফিয়ত শুনে। সে বলেছিল, তরুণটিকে চেনে না। পরে বলেছিল, মাঝে মাঝে এখানে আসে; তার সঙ্গে দু-একবার নেচেছে। নামধাম জানে না। মিঃ জেফারসন কড়া দৃষ্টিতে কয়েকবার তাকিয়ে তাকে কেবল দেখে নিয়েছিলেন। তাছাড়া সে কোথাও গেলে, তিনি আমার কাছে জানতে চাইতেন, সে কোথায় গেল।
স্যার হেনরি মাথা দোলালেন। তিনি আরও কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। কিন্তু এডওয়ার্ডস তেমন কিছু বলতে পারল না।
.
ডেনমাউথের পুলিস দপ্তরে সুপারিন্টেন্ডেন্ট হার্পার কয়েকটি মেয়ের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলেন।
প্রত্যেকেই প্রায় একই কথা চাইছিল, পামেলা রীভস তাদের কাছে বলেছিল সে উলওয়ার্থ যাচ্ছে আর পরের বাসে করে ফিরবে।
ঘরের এককোণে অত্যন্ত সাধারণ হাবভাব নিয়ে বসেছিলেন মিস মারপল। কেউই তাকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করেনি।
শেষ মেয়েটিকে বিদায় দেবার পর মিস মারপল, ঘর্মাক্ত হাপারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ফ্লোরেন্স স্মলের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
হার্পার একটি কনস্টেবলকে দিয়ে মেয়েটিকে আবার ডেকে পাঠালেন।
ফ্লোরেন্স স্মল একজন অবস্থাপন্ন কৃষকের মেয়ে। দীর্ঘাঙ্গী, কালো চুল, বাদামী চোখ। সে খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিল।
মিস মারপল মেয়েটিকে বললেন, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, পামেলার মারা যাওয়ার দিনের সব ঘটনার কথা বিশেষ ভাবে জানা দরকার। তুমি যা জান, আমাকে খুলে বল। যদি তা না বল, তাহলে পুলিস তোমাকে সন্দেহ করবে–তোমাকে জেলে পাঠানো হতে পারে। সবকথা এখনই আমাকে খুলে বল।
ফ্লোরেন্স কয়েকবার ইতস্ততঃ করল। পরে মিস মারপলের ভাবলেশহীন চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল।
পামেলা সেদিন উলওয়ার্থে যাচ্ছিল, তাই না? মিস মারপল তীব্র স্বরে বললেন।
কাতরভাবে মেয়েটি মিস মারপলের দিকে তাকাল। মিস মারপল প্রশ্ন করলেন, কোন ফিল্মের ব্যাপার ছিল, তাই না?
মেয়েটি চাপা স্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ।
–এবারে সবকথা গোড়া থেকে খুলে বল। পামেলা তোমাকে কি বলেছিল?
র্যালিতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় আমরা এক সঙ্গে বাসের জন্য হাঁটছিলাম, ও আমাকে বলেছিল ওর সঙ্গে একজন ফিল্মের প্রযোজকের আলাপ হয়েছিল। লোকটা পামকে বলেছিল পামের অভিনয় ক্ষমতা আছে, তবে কিছুদিন শিক্ষানবিশী করতে হবে। পামকে র্যালির পরে ডেনমাউথে একটা হোটেলে লোকটার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিল। সে তাকে স্টুডিওতে নিয়ে যাবে। সেখানে পরীক্ষা নেয়ার পর পাম বাস ধরে বাড়ি ফিরতে পারবে।
-বেশ, বলে যাও।
–আমাদের র্যালি ভালভাবে শেষ হয়েছিল। পাম আমাকে বলেছিল, সে এবারে ডেনমাউথ হয়ে উলওয়ার্থ যাচ্ছে। ওকে আমি ফুটপাথ ধরে যেতে দেখেছিলাম।
কথা শেষ করে বেদনার্ত দৃষ্টিতে মেয়েটি মিস মারপলের চোখের দিকে তাকাল।
–আমাকে সবকথা বলে তুমি ঠিক কাজ করেছ।
ফ্লোরেন্সকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার পর মিস মারপল ওর কাহিনী হার্পারকে শোনালেন।শেষে বললেন, এরকম কিছুই আমি ভেবেছিলাম।
-আপনি অসাধারণ মিস মারপল। কি করে যে এতগুলো মেয়ের মধ্যে এই মেয়েটিকেই । বেছে নিলেন ভেবে পাচ্ছি না…লেনভিল স্টুডিও বললেন, তাই না?
কোন উত্তর না দিয়ে মিস মারপল উঠে দাঁড়ালেন।
এবারে উঠি। এখুনি হোটেলে ফিরে যেতে হবে।
.
১৬.
মিস মারপলের বাগানের পাশের গির্জার যাজক ভদ্রলোকের স্ত্রী গ্রিসলডার সঙ্গে দেখা করলেন মিস মারপল।
গ্রিসলডা, একটা রসিদ বই টাকা তোলার জন্য দাও।
ছেলে সামলাচ্ছিল গ্রিসলডা। হেসে বলল, নিশ্চয়ই কোন মতলব এঁটেছেন? ব্যাপার কি আমাকে বলবেন না?
-পরে বলব। এখন ব্যস্ততা রয়েছে।
.
চাঁদা তোলার একখানা রসিদ বই নিয়ে মিস মারপল গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চললেন। চৌমাথা থেকে বাঁ দিক ঘুরে ব্লু বোর পেরিয়ে চ্যাটস ওয়ার্থে মিঃ বুকারের নতুন বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালেন।
দরজা খুলে দিল স্বর্ণকেশী এক তরুণী ডিনালী। তার দেহে ধূসর রঙের স্ল্যাকস আর হালকা সবুজ জাম্পার।
-এক মিনিট একটু ভেতরে আসতে পারি?
বলতে বলতেই ভেতরে ঢুকে পড়লেন মিস মারপল।
–অশেষ ধন্যবাদ। একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়লেন মিস মারপল। আমি এসেছিলাম সামান্য কিছু চাদার জন্য। সামনের বুধবার গির্জায় কিছু হাতের কাজ বিক্রি হবে
-ওহ। আমি মানে
সামান্য আধ ক্রাউন চাঁদা দিতে পারবেন না?
ডিনা লী তার হাতব্যাগ খুঁজতে লাগল।
মিস মারপল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দ্রুত ঘরের চারপাশ জরিপ করে নিলেন।
–আপনার চুল্লীর সামনে কোন কার্পেট নেই দেখছি। অন্তরঙ্গ স্বরে বললেন মিস মারপল।
অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল ডিনা লী। বৃদ্ধা যে তাকে খুঁটিয়ে দেখতে বুঝতে পারল।
-এটা কিন্তু বিপজ্জনক। আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়তে পারে। বললেন মিস মারপল।
ডিনা লী মিষ্টি করে বলল, কোথায় যে রাখা আছে, জানি না। এই নিন
সে ব্যাগ থেকে আধ ক্রাউন বার করে বাড়িয়ে ধরল।
–অসংখ্য ধন্যবাদ। মিস মারপল বই খুললেন, কি নাম লিখব?
–লিখুন মিস ডিনা লী।
–এ বাড়িতে মিঃ বেসিল ব্লেকের বলেই শুনেছি।
–হ্যাঁ। আর আমি মিস ডিনা লী।
স্বামীর সঙ্গে রয়েছেন অথচ কুমারী নাম বলছেন–এখানকার গ্রামীণ জীবনে ওটা ব্যবহার না করাই ভাল।
–আপনি কিভাবে জানলেন আমরা বিবাহিত? আপনি নিশ্চয়ই সমারসেট হাউসে যাননি?
–সমারসেট হাউস? ওহ না। তবে আন্দাজ করতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু জানেন তো গ্রামে। সহজেই নানা কথা রটনা হয়ে যায়। আপনাদের মধ্যে যে ধরনের ঝগড়াঝাটি হয়েছিল সেটা। অবৈধ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেমানান। তারা ঝগড়া করতে সাহস পায় না। বিবাহিত স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই প্রথম দিকে এই ঝগড়াঝাটি বেশ উপভোগ্য হয়।
-হ্যাঁ, মানে
ডিনা লী বলতে গিয়ে হেসে ফেলল। সে বসে বলল, আপনি অসাধারণ। কিন্তু আমাদের সম্পর্কের কথাটা সম্মানজনকভাবে প্রকাশের কথা বলছেন কেন?
–কারণ যে কোন মুহূর্তেই আপনার স্বামীকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
.
১৭.
–বেসিল..খুন করেছে বলছেন? আপনি কি সেই ম্যাজেস্টিক হোটেলের মেয়েটির কথা বলছেন?
-হ্যাঁ।
–কিন্তু ও তো একদম বাজে কথা।
ঠিক সেই সময়েই বাইরে একটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল। দুহাতে কয়েকটা বোতল নিয়ে বেসিল ব্লেক দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।
ডিনা লী উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল, উনি কি বলছেন শোন তো। সেই মেয়েটাকে খুন করার অপরাধে তোমাকে নাকি গ্রেপ্তার করা হবে।
–ওহ ভগবান।
বেসিল ব্লেকের হাত থেকে বোতলগুলো সোফার ওপর পড়ে গেল। সে ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢাকল।
–বেসিল, আমি জানি একথা সত্য নয়। আমার দিকে তাকাও বেসিল। তুমি তো তাকে চিনতেই না, তাই না?
-হ্যাঁ, উনি ওকে জানতেন। বললেন মিস মারপল।
-চুপ করুন। বেসিল তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল, ম্যাজেস্টিক হোটেলে দু-একবার ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল মাত্র। তুমি একথা বিশ্বাস কর ডিনা?
ডিনা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, তোমার ওপরে তাহলে সন্দেহ পড়ছে কেন?
কার্পেটটা কি করেছেন? মিস মারপল বলে উঠলেন।
–ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি।
আর্তনাদের স্বরে বেসিলেন গলা চিড়ে বেরিয়ে এল কথাগুলো।
-কাজটা খুব বোকার মত হয়ে গেছে। ওর মধ্যে নিশ্চয় মেয়েটির পোশাকের আঁশ লেগেছিল।
–হ্যাঁ। সেটা কিছুতেই তুলে ফেলতে পারিনি।
–এসব কি বলছ তোমরা!
তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠল।
–ওকে জিজ্ঞেস কর, তিক্তস্বরে বলল বেসিল, উনি মনে হচ্ছে সবই জানেন।
-আমি অনুমান করতে পারছি। তাহলে শুনুন বলছি, বললেন মিস মারপল, আমার মনে হয় এক পার্টিতে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর আপনি গাড়ি চালিয়ে এখানে চলে এসেছিলেন। সে রাতে মাত্রা ছাড়িয়ে পান করার ফলে সময়টা নিশ্চয়ই খেয়াল করতে পারেননি।
-রাত প্রায় দুটোর সময় বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। বলল বেসিল, দরজা খুলে আলো জ্বালাতেই চোখে পড়ল
-হ্যাঁ বাকিটা আমি বলছি, বললেন মিস মারপল, দেখলেন সামনে কার্পেটের ওপরে একটা মেয়ের অসাড় দেহ পড়ে আছে। সান্ধ্য পোশাকে শ্বাসরুদ্ধ একটি মেয়ে।
-হ্যাঁ, মুখ প্রায় নীল হয়ে গিয়েছিল, ফোলা, দেখে মনে হয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই মারা গিয়েছিল। কিন্তু সে পড়েছিল আমারই শোবার ঘরে।
বলতে বলতে কেঁপে উঠল বেসিল।
–আমার ভয় হচ্ছিল, যে কোন মুহূর্তে ডিনা এসে পড়বে, ওই অবস্থায় আমাকে দেখলে ভেবে নেবে আমিই মেয়েটিকে খুন করেছি। সেই মুহূর্তেই একটা মতলব মাথায় এসে গেল। নাকউঁচু দাম্ভিক বুড়ো ব্যান্ট্রির কথা মনে পড়ল। আমাকে বরাবর অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। তাকে জব্দ করার জন্য মৃত স্বর্ণকেশীকে ব্যান্ট্রির লাইব্রেরিতে চালান করে দিলাম।
সকালে কিন্তু পুলিস এখানেই চলে এল। সেই চিফ কনস্টেবল। ইচ্ছে করেই লোকটির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। এ সব ঘটনা যখন ঘটছে, তখনই ডিনা এসে পড়ে।
ডিনা জানালার বাইরে তাকাল। বলল, একটা গাড়ি আসছে, অনেকগুলো লোক রয়েছে ভেতরে।
-খুব সম্ভব ওরা পুলিস, বললেন মিস মারপল, বেসিল ব্লেক উঠে দাঁড়াল। হাসবার চেষ্টা করল।
–তাহলে এর সঙ্গে আমি জড়িত? ভাল কথা, ডিনা ভয় পাবার কিছু নেই। আমাদের পারিবারিক উকিল বুড়ো সিমের কাছে যেও। মার কাছে গিয়ে আমাদের বিয়ের কথা জানিও। ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই–আমি খুন করিনি–সবই ঠিক হয়ে যাবে।
ঘরে ঢুকলেন ইনসপেক্টর স্ল্যাক। সঙ্গে একজন।
–মিঃ বেসিল ব্লেক।
–হ্যাঁ।
–গত কুড়ি সেপ্টেম্বর রাতে রুবি কীন নামে একটি মেয়েকে খুন করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা রয়েছে। আমার সঙ্গে আপনাকে আসতে হবে।
বেসিল মাথা নিচু করল। ডিনাকে দেখল। বলল, বিদায় ডিনা।
ইনসপেক্টর স্ল্যাক মিস মারপলের উপস্থিতি লক্ষ্য করে সুপ্রভাত জানালেন।
উৎসাহে তিনি টগবগ করছিলেন। কার্পেটটা হাতে পেয়েছিলেন। তাছাড়া গাড়ি রাখার জায়গার লোকটাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলেন বেসিল ব্লেক রাত এগারটার সময় চলে এসেছিল। বেসিলকে বিকারগ্রস্ত বলেই মনে হচ্ছিল তার। প্রথমে রিভস মেয়েটাকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। পরে নিজের গাড়ি নিয়ে পার্টিতে চলে আসে তারপর ডেনমাউথে। তারপর রুবি কীনকে এখানে এনে গলা টিপে মেরে কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরিতে ফেলে আসে। যৌন উন্মাদ ছাড়া কিছু নয়।
ছকটা নিজের মনে গোছাতে গোছাতে বেসিলকে নিয়ে বেরিয়ে যান স্ল্যাক।
ডিনা মিস মারপলের দিকে তাকাল। তার চোখে কাতরতা।
–আমি জানি না। আপনি কে–কিন্তু বেসিল কখনও এমন কাজ করেনি।
–আমি জানি সে করেনি। কে করেছে তাও জানি। তবে প্রমাণ করতে একটু সময় লাগবে।
.
১৮.
বাড়ি ফিরেই স্টাডি রুমে ঢুকলেন মিসেস ব্যান্ট্রি। রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন, আমি ফিরে এলাম আর্থার।
কর্নেল ব্যান্ট্রি লাফিয়ে উঠে স্ত্রীকে আদর করে কাছে টেনে নিলেন।
-খুব ভাল হল।
স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিসেস ব্যান্ট্রির মনে হল, তিনি যেন কেমন চুপসে গেছেন। একটু কৃশও। চোখের কোণে কালি পড়েছে।
–ডেনমাউথে কেমন কাটালে বল। বললেন কর্নেল ব্যান্ট্রি।
–খুব মজা হল। তুমি তো জেফারসনদের পছন্দ করতে। তুমি গেলে খুব আনন্দ হত।
–যেতে পারলাম না, অনেক কাজ।
ব্র্যাফফাডসায়ারে তোমাদের সভা কেমন হল? তুমিই তো সভাপতি
–কিন্তু ইয়ে মানে..আমি যাইনি।
মিসেস ব্যান্ট্রি থমকে গেলেন। কড়া স্বরে বললেন, বৃহস্পতিবার ডাফের সঙ্গে ডিনারের কথা ছিল
-ওহ, হা–সেটা বন্ধ রাখা হয়েছিল। ওদের রাঁধুনি অসুস্থ।
–গতকাল তো জেলরদের কাছে যাওয়ার কথা ছিল।
–শরীর ভাল নেই বলে ওদের টেলিফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম।
.
খুবই বিরস মুখে বসেছিলেন মিসেস ব্যান্ট্রি। এমন সময় মিস মারপল ঘরে ঢুকলেন।
-তোমাকে টেলিফোন করে কোথাও পেলাম না জেন। তাই ভাবছিলাম কি করব, বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি, সবকিছুই বিশ্রী লাগছে। লোকে আর্থারকে এড়িয়ে চলতে আরম্ভ করেছে। ও কেমন যেন বুড়োটে হয়ে গেছে। জেন, তুমি একটা কিছু কর। আমার ভয় করছে।
–ভাবনার কিছু নেই, ডলি। বললেন মিস মারপল।
কর্নেল ব্যান্ট্রি ঘরে ঢুকলেন। মিস মারপলকে দেখে খুশি হলেন।
–একটা খবর দিতে এলাম। বললেন মিস মারপল, রুবি কীনের হত্যাকারী হিসেবে বেসিল ব্লেককে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে। তবে সে খুন করেনি। সে লাশটাকে আপনার লাইব্রেরিতে এনে রেখেছিল।
–একদম বাজে কথা। নিশ্চয়ই খুন করেছে। বললেন কর্নেল ব্যান্ট্রি।
–সে মেয়েটির মৃতদেহ তার কটেজেই দেখতে পায়।
–গল্পটা পুলিস বিশ্বাস করল? ভাল মানুষ হলে তো সঙ্গে সঙ্গে পুলিসকে জানানো উচিত ছিল।
–ঠিকই বলেছেন। বললেন মিস মারপল। কিন্তু সবার স্নায়ু তো আপনার মত দৃঢ় নয়। আজকালকার তরুণ প্রজন্ম একেবারেই আলাদা।
একটু থেমে তিনি পরে বললেন, বেসিলের সম্পর্কে অনেক কথাই আমি শুনেছি। ছেলেটি আঠারো বছর বয়সে এ আর পি-র হয়ে কাজ করেছে। একবার একটা জ্বলন্ত বাড়িতে ঢুকে চারটি শিশুকে পরপর উদ্ধার করেছিল। এরপর একটা কুকুরকে বাঁচাতে জ্বলন্ত বাড়িটাতে ঢুকেছিল। সবাই ওকে বারণ করেছিল। বাড়িটা ওর ওপরেই ভেঙ্গে পড়ে। ওকে উদ্ধার করা হয়েছিল। বুকে চোট লেগেছিল-বহুদিন শয্যাশায়ী ছিল। এরপরেই সে নকশা আঁকার কাজে হাত দিয়েছিল।
-ওহ, অসাধারণ। কর্নেল লজ্জিত স্বরে বললেন, আমি ইয়ে–এতসব জানতাম না।
বেসিল এসব বলে বেড়ায় না। বললেন মিস মারপল।
–এটাই উপযুক্ত কাজ। ছেলেটা দেখছি, যা ভেবেছিলাম তা নয়। না জেনে শুনে হঠাৎ কিছু ভেবে নেয়া ঠিক কাজ হয়নি। যাই হোক, এটা খুবই দুর্বোধ্য ঠেকছে, আমার ওপরে ও কেন খুনের দায় চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল?
–আমার মনে হয়, সে ঠিক এভাবে ব্যাপারটাকে ভাবতে চায়নি। বললেন মিস মারপল, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ব্যাপারটাকে একটা তামাশা বলেই মনে করেছিল, আমার ধারণা।
নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কিছু করে থাকলে অবশ্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। আপনি বিশ্বাস করেন না সে খুন করেছিল?
–সে খুন করেনি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
–কে করেছে সে বিষয়ে কোন
মিস মারপল মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
–জেন, তুমি বাঁচালে। আমি জানতাম তুমিই পারবে।
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন মিসেস ব্যান্ট্রি।
–তাহলে খুনী কে?
–এজন্যেই আপনার সাহায্য দরকার। আমরা যদি সমারসেট হাউসে যাই তাহলে, সেটা পরিষ্কার ভাবে জেনে যেতে পারব।
.
১৯.
স্যার হেনরির মুখ গম্ভীর হল। তিনি বললেন, ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না।
–আমি জানি, আপনার কাছে এটা নীতিসম্মত বলে মনে হবে না। তবে অন্তত নিশ্চিত হয়ে নেবার পক্ষে এটা না করে উপায় নেই। মিঃ জেফারসন যদি রাজি হন ।
–তাহলে হার্পারকেও তো সঙ্গে নিতে হয়।
-না, তার পক্ষে বেশি জেনে ফেলা ঠিক হবে না। তবে আপনি খানিকটা ইঙ্গিত দিয়ে রাখতে পারেন, যেমন কোন বিশেষ ব্যক্তির ওপর নজর রাখা বা ওই রকম একটা কিছু।
–হ্যাঁ, এটা করা চলতে পারে।
–স্যার হেনরি বললেন ধীরে ধীরে।
.
–আপনি কি আমাকে কোন ইঙ্গিত করতে চাইছেন স্যার?
সুপারিন্টেন্টে হার্পার স্যার হেনরি ক্লিারিংকে সসম্ভ্রমে জিজ্ঞেস করলেন।
–আমার বন্ধু আপনাকে যেটুকু জানাতে বলেছেন, আপনাকে আমি শুধু সেটুকুই জানাচ্ছি। এর মধ্যে গোপনীয়তা কিছু নেই। তিনি আগামীকাল ডেনমাউথে একজন সলিসিটারের কাছে যাচ্ছেন–একটা নতুন উইল করার ইচ্ছা তার।
হাপারের ভ্রু কুঁচকে উঠল। তিনি বললেন, মিঃ কনওয়ে জেফারসন একথা কি তার জামাতা ও পুত্রবধূকে জানিয়েছেন?
–আজ সন্ধ্যায়ই কথাটা জানাবেন।
-বুঝলাম, হার্পার চিন্তিত ভাবে বললেন, তাহলে বেসিল ব্লেকের অপরাধ সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত নন, স্যার?
-আপনি নিজে নিশ্চিত নিশ্চয়ই?
মিস মারপল…তিনিও কি নিশ্চিত?
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আপনি সব ব্যাপার আমার হাতে ছেড়ে দিন স্যার। কয়েকজন লোককে লাগিয়ে রাখব–নতুন করে আর কোন ঘটনা আমি ঘটতে দেব না।
–আর একটা কথা।
স্যার হেনরি একটুকরো কাগজ টেবিলের ওপরে এগিয়ে ধরে বললেন, এই কাগজটা দেখে নাও।
কাগজটার ওপর চোখ বুলিয়েই হাপারের মুখভাব বদলে গেল। তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, এই ব্যাপার? তাহলে গোটা ব্যাপারটাই অন্যরকম দাঁড়িয়ে গেল। এটা খুঁজে বের করলেন কি করে?
-বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের আগ্রহের কথাটা তো তোমার অজানা নয়।
–তার ওপরে স্যার, বয়স্কা অবিবাহিতা স্ত্রীলোক।
.
স্যার হেনরি নিচে নেমে এসে পোর্টারের কাছে খোঁজ নিলেন মিঃ গ্যাসকেলের।
সে জানাল, তিনি তো এই মাত্র গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, লণ্ডন যাবেন।
–মিসেস জেফারসন?
–তিনিও একটু আগেই শুতে গেলেন। লাউঞ্জ আর বলরুমের দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন স্যার হেনরি। বলরুমে নাচগান চলছে।
শুতে যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল। স্যার হেনরি ওপরে উঠে গেলেন।
.
রাত তখন তিনটে। নিস্তব্ধ চরাচর। শান্ত সমুদ্রের বুকে লুটোপুটি খাচ্ছে চাঁদের আলো।
কনওয়ে জেফারসনের শোবার ঘর থেকে তাঁর চাপা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। বালিশে পিঠ রেখে উঁচু হয়ে শুয়েছিলেন তিনি।
বাইরে বাতাসের বেগ কমে এসেছিল। তবু একসময় জানালার পর্দা নড়ে উঠল। কয়েক মুহূর্ত পরেই সামান্য ফাঁক হল পর্দা। তার আড়ালে চাঁদের আলো আঁধারিতে দেখা গেল একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি।
পর্দা আবার যেমনকার তেমনি হয়ে গেল। চারপাশে অখণ্ড নিস্তব্ধতা।
ঘরের ভেতরে সন্তর্পণে একজন আগন্তুক নড়েচড়ে উঠল। নিঃশব্দে পা ফেলে বিছানার দিকে এগিয়ে চলেছে।
বালিশের ওপরে গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ তবু থামল না। মিঃ জেফারসন তৈরি হয়েই ছিলেন। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে চামড়ার কিছু অংশ টেনে ধরলেই হয় এখন। অপর হাতে ধরা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা কাজে লাগাতে পারবেন।
ঠিক এমনি সময়েই অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে সিরিঞ্জ ধরে রাখা হাতটা চেপে ধরল। অন্য হাত তার দেহটা সবলে জাপটে ধরল।
অন্ধকারের ভেতর ভাবলেশহীন একটা কণ্ঠস্বর জেগে উঠল, না, একাজ করতে দেব না। উঁচটা আমার চাই।
দপ করে আলো জ্বলে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে বালিশে পিঠ রেখে জেগে থাকা মিঃ জেফারসন দেখতে পেলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে রুবি কীনের হত্যাকারী।
.
২০.
–আপনার তদন্তের কৌশলটা আমাদের জানতে ইচ্ছে করছে মিস মারপল।
সবার প্রথমে কথা বললেন স্যার হেনরি ক্লিদারিং।
–আমার জানার আগ্রহ হচ্ছে প্রথম কিভাবে আপনি সন্দেহ করতে শুরু করলেন। বললেন সুপারিন্টেন্টে হার্পার।
এবারেও আপনি বাজি মাৎ করলেন মিস মারপল। আপনি সত্যিই অসাধারণ। গোড়া থেকে সবকথা আমরা শুনতে চাই। বললেন কর্নেল মেলচেট।
মুহূর্তের জন্য মুখ লাল হয়ে উঠলেও সচেতনভাবে সামলে নিলেন মিস মারপল।
সপ্রতিভ কণ্ঠে তিনি বললেন, আমার পদ্ধতির কথা শুনলে আপনাদের সকলেরই খুবই অপেশাদার সুলভ বলে মনে হবে।
আসলে কি জানেন, বেশিরভাগ মানুষই, এমনকি পুলিসও সরলভাবে সবকিছুই বিশ্বাস করে নেয়। আমি কিন্তু উল্টো পাপে ভরা পৃথিবীর কোন কিছুই আমি নিজে যাচাই না করে কখনো বিশ্বাস করি না।
-এটাই সঠিক মনোভাব বললেন স্যার হেনরি।
–একেবারে গোড়া থেকেই এই ঘটনার কয়েকটা বিষয় ঠিক বলে ভেবে নেওয়া হয়েছিল, বললেন মিস মারপল, কিন্তু এই ঘটনাগুলো আমি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলাম।
নিহত মেয়েটির বয়স খুবই অল্প ছিল। দাঁতে নখ কাটার অভ্যাস ছিল তার। লক্ষ্য করেছিলাম তার দাঁত একটু বাইরে ঠেলে বেরিয়ে থাকত। ছেলেবেলা থেকে দাঁতে নখ কাটার অভ্যাস বন্ধ করতে না পারলে সহজে দূর করা যায় না।
এত অল্প বয়সী একটি মেয়ের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। বুঝতে পেরেছিলাম শয়তান চরিত্রের লোক ছাড়া এমন নৃশংস কাজ কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।
ব্যাপারটা শুরু থেকেই ছিল বড় গোলমেলে। মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছিল কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরি ঘরে। যোগাযোগ ভেবে নেওয়া খুবই কঠিন।
আসলে ব্যাপারটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। তাই এমন গোলমেলে হয়ে উঠেছিল।
আসল মতলবটা ছিল, মৃতদেহটার দায় বেসিল ব্লেকের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া। অনেক দিক থেকেই তাকে ফাঁসানো যেত। কিন্তু সে মৃতদেহটা কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরিতে চালান করে দিয়েছিল। আসল খুনী এতে খুবই অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। আর আমাদেরও অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়।
স্বাভাবিক ভাবেই পুলিসের সন্দেহ মিঃ ব্লেকের ওপরেই পড়ত। খোঁজ নিলেই তারা জানতে পারত, সে মেয়েটিকে চিনত। আরও জানা যেত সে অন্য আর একটি মেয়ের সঙ্গেও মেলামেশা করে।
পুলিস ধরে নিত, রুবি কোন ভাবে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছিল মিঃ ব্লেককে। তখন তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। নৈশ ক্লাবগুলোতে সাধারণতঃ এ ধরনের অপরাধই ঘটে থাকে।
কিন্তু ব্যাপারটা ঘুরে গিয়েছিল অন্য দিকে। সকলের দৃষ্টি পড়েছিল জেফারসন পরিবারের ওপর। আর এই ব্যাপারটা বিশেষ একজনের খুবই বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল।
আমার যে প্যাঁচালো মন, আগেই তা বলে দিয়েছি। কোন কিছু সোজা ভাবে নিতে আমি অভ্যস্ত নই। আমি অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি। অবশ্য এরকম না ভেবে উপায় ছিল না।
বুঝতে পেরেছিলাম, মেয়েটির মৃত্যুতে লাভবান হবে দুজন লোক। পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড নেহাৎ ছেলেখেলা নয়। বিশেষ করে যার অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গীন।
ওই দুজন লোকেরও অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। যদিও তাদের দুজনকেই বাইরে থেকে খুবই ভদ্র মানুষ বলে মনে হয়েছিল। সন্দেহ করার মত নয়। তবু কিছুই তো বলা যায় না।
মিসেস জেফারসন যেভাবে জীবন কাটিয়ে চলেছিলেন, শ্বশুরের ওপর নির্ভরশীলতার জীবন, তাতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। গত গ্রীষ্মকাল থেকে তার মধ্যে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। যদিও তিনি জানতেন। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, তার শ্বশুর বেশিদিন বাঁচবেন না। রুবি কীনের আবির্ভাব না হলেও অবস্থাটা মোটামুটি মানিয়ে নিয়ে চলার মতই ছিল।
মিসেস জেফারসন তার ছেলেকে খুবই ভালবাসতেন। সন্তানের ভালর জন্য কোন অপরাধকে নৈতিক দিক থেকে সঠিক বলে মনে করে এমন বহু স্ত্রীলোক দেখা যায়। মিসেস জেফারসন ছিলেন সেই শ্রেণীর।
মিঃ মার্ক গ্যাসকেল স্বভাবতই সন্দেহ করার মত মানুষ। তিনি জুয়ায় আসক্ত ছিলেন, তাঁর নৈতিক চেতনাও তেমন জোরালো ছিল না। তবু তাকে আমি উপেক্ষা করেছিলাম।
বিশেষ কতগুলো কারণে আমার ধারণা হয়েছিল এই হত্যার ঘটনার সঙ্গে কোন স্ত্রীলোক জড়িত।
তবে এই দুজনের ব্যাপারটা অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেও আমি হতাশ হয়েছিলাম। কেননা রুবি কীনের মৃত্যুর সময়ে এদের দুজনেরই জোরালো অ্যালিবাই ছিল।
এর পরেই পাওয়া গেল দগ্ধ গাড়িটা আর তার মধ্যে পামেলা রিভসের দেহ। এই ঘটনার পরেই সমস্ত কিছু আমার চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি বুঝে গেলাম ওই অ্যালিবাইয়ের কোন মূল্য নেই।
এভাবে মূল ঘটনার দুটো অংশ আমার হাতে এল। কিন্তু অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও দুটো ঘটনাকে মেলাতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম কোথায় একটা যোগসূত্র আছে, কিন্তু আমি তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
যে লোকটিকে অপরাধী বলে সন্দেহ করছিলাম, তার কোন মোটিভই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বীকার করতেই হয়, আমি খুবই বোকামী করে ফেলেছিলাম। ডিনা লীর সঙ্গে দেখা হবার পর কথাটা আমার মনে পড়ে। অথচ অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
বিবাহ! সমারসেট হাউস। কেবল মিঃ গ্যাসকেল বা মিসেস জেফারসনের বিয়েই নয়। আরও একটা বিয়ের সম্ভাবনা ছিল।
ওই দুজনের কারো বিয়ে হয়ে থাকলেও, এই বিয়ের চুক্তিতে অন্য আর একজনেরও জড়িত থাকার কথা।
রেমণ্ডের মনে এমন ভাবনা থাকতেই পারত যে একজন ধনী স্ত্রী পাবার তার সম্ভাবনা ছিল। মিসেস জেফারসনের প্রতি সে গভীরভাবে আকৃষ্ট ছিল। আর তার প্রেরণাতেই মিসেস জেফারসন একটা সময়ে বৈধব্যের জীবন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিশেষভাবে চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন।
রেমণ্ড ছাড়া আর একজন ছিলেন। তিনি হলেন মিঃ ম্যাকলীন। তাকে মিসেস জেফারসন খুবই পছন্দ করতেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো তিনি তাকেই বিয়ে করতেন।
মিঃ ম্যাকলীন আর্থিক দিক থেকে খুবই দুরবস্থার মধ্যে ছিলেন। আর তিনি ডেনমাউথ থেকে সে রাতে খুব দূরেও ছিলেন না। সেকারণেই আমার ভাবনাচিন্তা আমি একজনের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত করে নিয়েছিলাম। কেননা এদের যে কোন একজনের পক্ষে কাজটা করে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়।
তবে ওই দাঁতে নখ কাটার ব্যাপারটাই আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল খুনী কে।
–সেই নখ। সবিস্ময়ে বলে উঠলেন স্যার হেনরী, একটা নখ ভেঙ্গে যাওয়ায় বাকি নখ তো সে কেটে ফেলেছিল।
–কথাটা কিন্তু ঠিক নয় স্যার হেনরী। কেননা দাঁতে কাটা নখ আর এমনি ভেঙ্গে যাওয়া নখ কিন্তু আলাদা। মেয়েদের নখ সম্বন্ধে যাদের ধারণা আছে তারা আমার কথাটা অস্বীকার করবেন না। নখগুলো ছিল বাস্তব ঘটনা। তা না হলে আর একটা অর্থই হতে পারে। কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরী ঘরে যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল সেটা রুবি কীনের নয়।
যে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, এই সূত্র সরাসরি তার দিকেই আঙ্গুলি নির্দেশ করছিল। লাশটা সনাক্ত করেছিল যোসি। সে ভাল ভাবেই জানত দেহটা রুবি কীনের নয়। লাইব্রেরি ঘরে দেহটা দেখার পরে সে খুবই ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিল। সব রহস্য ফাঁস করে দেবার মুখে প্রায় চলে এসেছিল সে। কারণ সে জানত দেহটা কোথায় পাওয়ার কথা ছিল।
সে জানত, দেহটা পাওয়ার কথা ছিল বেসিল ব্লেকের কটেজে। আপনাদেরও নিশ্চয় মনে পড়বে, যোসিই বেসিলের দিকে ইঙ্গিত করেছিল। সে রেমণ্ডকে জানিয়েছিল রুবি হয়তো ফিল্মের লোকটার কাছে গিয়ে থাকতে পারে।
আরও একটা কাজ সে আগেই করে রেখেছিল। বেসিলের একটা ফটো রুবির হাতব্যাগে তার অগোচরে ঢুকিয়ে রেখেছিল।
যোসি এমন একটা মেয়ে যে টাকা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু চেনে না। তার বাস্তবজ্ঞান টনটনে, আর অত্যন্ত কুটিল। এসব মানুষ নখের মতই শক্ত ধাতের হয়ে থাকে।
তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে, দেহটা যখন রুবি কীনের নয়, তখন অবশ্যই আর কারও হবে। কিন্তু সে কে? সম্ভাবনা তো একটাই–যে মেয়েটি নিরুদ্দেশ বলে জানা যায়। নিশ্চয় তার দেহ–সে হল পামেলা রীভস।
বয়সের দিকটা লক্ষ্য করুন। রুবিন ছিল আঠারো, পামেলার মোল। দুজনেই স্বাস্থ্যবতী এবং অপক।
আমি ব্যাপারটা একটু নেড়েচেড়ে ভাববার চেষ্টা করলাম। পেছনে এমন কি ব্যাপার কাজ করছে যাতে ব্যাপারটাকে এমন গোলমেলে করে তুলবার দরকার হল?
আমি একটাই সম্ভাবনা খুঁজে পেলাম। সেটা হল, কোন বিশেষ ব্যক্তির জন্য অ্যালিবাই তৈরি করা। তাহলে সেই বিশেষ ব্যক্তিটি কে?
রুবি কীনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে অ্যালিবাই ছিল তিনজনের ক্ষেত্রে–মার্ক গ্যাসকেল, মিসেস জেফারসন আর যোসির।
ওদের পরিকল্পনা কিভাবে কাজ করেছিল, সেটা খুঁজে পাওয়া আপাত দৃষ্টিতে খুবই কঠিন বলে বোধ হবার কথা। অথচ ব্যাপারটা ছিল খুবই সরল।
প্রথমত বেছে নেওয়া হয়েছিল হতভাগ্য পামেলাকে। ফিল্মের টোপ ফেলে তাকে সহজেই বশ করা গিয়েছিল। ফিল্মে নামার সম্ভাবনাটাকে খুব বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তার সামনে তুলে ধরেছিল মার্ক গ্যাসকেল। লোভ সামলাতে না পেরে টোপ গিলে নিয়েছিল সে।
মার্ক গ্যাসকেল তার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করে ছিল। পামেলা হোটেলে আসে। সে মেয়েটিকে পাশের দরজা দিয়ে যোসির কাছে নিয়ে যায়। মেয়েটিকে তার পরিচয় দেয় একজন মেকআপ বিশেষজ্ঞ বলে।
হতভাগ্য সরল মেয়েটির কথা ভাবলে আমার খুব কষ্ট হয়।
বাথরুমে বসে যোসি ওর চুল আর মুখে প্রসাধনী লাগিয়ে দেয়। হাত ও পায়ের নখে । নখপালিশ লাগিয়ে দেয়। এরই মাঝখানে তাকে ওরা সম্ভবতঃ কোন আইসক্রীম বা সোডার মধ্য দিয়ে ওষুধও প্রয়োগ করে। ফলে পামেলা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
শুনেছি হোটেলের ঘরগুলো সপ্তাহে একবার মাত্র সাফ করা হয়। এই সুযোগটা ওরা নিয়েছিল। পাশের কোন খালি কামরাতেই তারা পামেলাকে রেখে দেয়।
ডিনারের পর মার্কা গ্যাসকেল তার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে জানিয়েছিল সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। সেই সময়েই সে পামেলার দেহ মিঃ ব্লেকের কটেজে নিয়ে যায়।
গাড়িতে তুলবার আগেই রুবির একটা পুরনো পোশাক পামেলাকে পরিয়ে নিয়েছিল। তখনো সে মারা যায়নি, অজ্ঞান হয়ে ছিল। তারপর কটেজে চুল্লীর সামনে কার্পেটের ওপরে নামিয়ে দেয়। তারপর পামেলার ফ্রকের বেল্ট দিয়ে সে তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। স্বস্তির বিষয় যে এই নৃশংস কাজটা বেচারী মেয়েটা টের পায়নি। ওই নিষ্ঠুর লোকটা–মার্ক গ্যাসকেল ওকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে না দেখলে আমার শান্তি হবে না।
রাত দশটার মধ্যেই সমস্ত কাজ সারা হয়ে গিয়েছিল। মিঃ ব্লেকের কটেজ থেকে বেরিয়ে সে দ্রুত গাড়ি হাঁকিয়ে হোটেলে ফিরে আসে।
সেই সময় রুবি কীন রেমণ্ডের সঙ্গে নাচছিল। মেয়েটা সবসময়ই যোসি যেভাবে বলত তাই মেনে চলতে অভ্যস্ত ছিল। আমার ধারণা যোসি আগেই তাকে কিছু বলে রেখেছিল। সেই মতই সে নাচের শেষে পোশাক বদলে যোসির ঘরে চলে এসেছিল। তাকেও মাদক প্রয়োগ করা হয়েছিল। যার ফলে দেখা গেছে তরুণ বাৰ্টলেটের সঙ্গে কথা বলার সময় সে হাই তুলছিল।
রেমণ্ড যোসিকে জানিয়েছিলে, রুবিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে রাতের দ্বিতীয় নাচের সময় হয়ে আসছিল।
যোসি রেমণ্ডকে নিয়ে ওকে খুঁজতে আসে। রুবিকে ঘরে অনুসন্ধান করা হয়। তবে রুবির ঘরে ঢুকেছিল যোসি নিজে। আর কেউ না।
সম্ভবতঃ সেই সময়ই সে মেয়েটিকে শেষ করে। হয় ইনজেকশান দিয়েছে নয়তো মাথায় আঘাত করে।
এরপর নিচে গিয়ে যোসি রেমণ্ডকে বলে, রুবিকে বদলে সেই তার সঙ্গে নাচবে। এবং দুজনেই নাচে অংশ নেয়। তারপর শুতে যায়।
রুবির দেহ সেভাবেই পড়েছিল। ভোরে উঠে যোসি রুবির পামেলার পোশাক পরিয়ে দেয়। পাশের সিঁড়ি দিয়ে তাকে বাইরে নিয়ে যায়।
যোসির বয়স কম, স্বাস্থ্যবতী, কাজটা করতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। এরপর সে বার্টলেটের গাড়ি নিয়ে দুমাইল দূরে খনির দিকে চলে যায়। গাড়ির গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এরপর সে আবার হোটেলে ফিরে আসে।
সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলেন মিস মারপলের ব্যাখ্যা। সবার আগে কথা বললেন কর্নেল মেলচেট।
–খুবই জটিল ছক।
কাজও নিখুঁত, বললেন মিস মারপল, নখের গোলমালের ব্যাপারটা যোসি ঠিক লক্ষ্য করেছিল। সেজন্য সে কোন ত্রুটি রাখতে চায়নি, রুবির একটা নখ ভেঙ্গে শালের ওপর লাগিয়ে রেখেছিল। যাতে পরে দরকার হলে বলতে পারে রুবি তার সব নখ কেটে ফেলেছে।
-হ্যাঁ, সবদিকেই সতর্ক নজর ছিল, হার্পার বললেন, আপনি যে প্রমাণ পেয়েছিলেন তা ছিল কোন স্কুলের মেয়ের কামড়ানো নখ।
–মার্ক গ্যাসকেল বেশি কথা বলে। রুবির সম্পর্কে সে বলেছিল, তার দাঁত ভেতরে ঢোকানো। কিন্তু কর্নেল ব্যান্টির লাইব্রেরিতে যে মৃতদেহ পাওয়া যায় তার দাঁত ছিল উঁচু, বাইরে ঠেলে বেরিয়ে আসা।
কনওয়ে জেফারসন গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন। বললেন, শেষের ওই নাটকীয় দৃশ্যটাও নিশ্চয়ই আপনারই কল্পনা প্রসূত, মিস মারপল?
–তা বলতে পারেন। সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবার জন্যই পরিকল্পনা নিতে হয়েছিল। ব্যাপারটা হল, আপনি একটা নতুন উইল করতে চলেছেন, এই কথা এরা দুজন যখনই শুনল, বুঝতে পারল, তার আগেই একটা কিছু করা দরকার।
তাদের দরকার টাকার। টাকার জন্য ইতিমধ্যেই দুটো খুন করা হয়েছিল, প্রয়োজনে তৃতীয় খুনটি করবার জন্যও তারা পিছপা ছিল না।
মার্ককে ঝামেলার বাইরে রাখার দরকার ছিল নানা কারণেই। তাই আলিবাই তৈরি করার উদ্দেশ্যেই সে লণ্ডনে চলে গিয়েছিল।
সেখানে সে বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় ডিনার খায়, পরে নৈশ ক্লাবেও যায়।
কাজটা করার দায়িত্ব ছিল যোসির। মিঃ জেফারসনের মৃত্যু ঘটানো।
রুবির মৃত্যুর দায় তখনও তারা বেসিলের ওপরেই চাপাতে চাইছিল। তাই তাদের প্রমাণ করবার দরকার ছিল, মিঃ জেফারসনের মৃত্যুটা হয়েছে হার্ট ফেল করে।
সুপারিন্টেণ্ডেন্টের কাছে শুনলাম সিরিঞ্জে ডিজিট্যালিস ছিল। এরকম অবস্থায় মৃত্যুকে যে কোন ডাক্তারই হার্টের গোলমাল বলেই রায় দিতেন।
ইতিমধ্যে যোসি ব্যালকনিতে একটা পাথরের বল আলগা করে রেখেছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল সেটা পরে মাটিতে আছড়ে ফেলে আচমকা কোন শব্দ তৈরি করা।
সকলে ধরে নিত সেই প্রচণ্ড শব্দের ধাক্কাতেই মিঃ জেফারসনের মৃত্যু ঘটেছে।
উঃ বিশ্বাস করা যায় না। একেবারে জ্যান্ত শয়তান। বললেন মেলচেট।
–তাহলে, তৃতীয় মৃত্যুটা বলছেন হত কনওয়ে জেফারসন? বললেন স্যার হেনরি।
–ওহ, না, বললেন মিস মারপল, আমি বলেছিলাম বেসিল ব্লেকের কথা। তাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্যেই ওরা উঠে পড়ে লেগেছিল।