পুরোনো পাপের লম্বা ছায়া
একটা ছোটো রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকলেন ঘূর্ণায়মান দরজা ঠেলে এরকুল পোয়ারো। দিনের একটা বেখাপ্পা সময় বলে সেখানে খুব বেশি লোক ছিল না। তবে যাঁর সঙ্গে তার দেখা করার কথা তাকে তিনি দেখতে পেলেন টেবিলের এক কোণায়, চারচৌকা ভারিক্কি চেহারায় বসেছিলেন। তিনি হলেন সুপারিনটেন্ডেন্ট স্পেন্স। তিনি বললেন, ‘ভালো’ এটা খুঁজে বার করতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?
না, একেবারেই নয়। আপনার ডিরেকসান যথেষ্ট ছিল।
আসুন এবার আমরা পরিচয় করি। ইনি হলেন চীফ সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারোওয়ে। আর ইনি হলেন মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো। গ্যারোওয়ের চেহারা ছিল পাতলা রোগাটে, কঠোর তপস্বীর মতো মুখ এবং ধূসর চুল। খুব ভালো বললেন পোয়ারো।
গ্যারোওয়ে বললেন, এখন আমি অবসর প্রাপ্ত, এমন কিছু ঘটনা আছে যে কেউ সেটা মনে রাখতে পারে তা যতই অতীত হোক না কেন। এবং সাধারণ লোক সম্ভবত সব কিছুই মনে রাখতে পারে না কিন্তু, হ্যাঁ।
এরকুল পোয়ারো প্রায় বলেই ফেলছিলেন হাতিরা মনে রাখে, কিন্তু সময় মতো নিজেকে খুব সামলে নিলেন। মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভারের সেই প্রবাদ বাক্যটা তার মনের মধ্যে এমন গেঁথে গেছে যে, যে কোনো স্থানে সেটা চেপে যাওয়া খুবই কষ্টকর।
সুপারিনটেন্ডেন্ট বললেন, আমি আশা করতে পারি যে, আপনি খুব একটা অধৈর্য হচ্ছেন না।
একটা চেয়ার টেনে তারা তিনজনে বসলেন। সুপারিনটেন্ডেন্ট স্পেন্স এই রেস্তোরাঁয় আসক্ত সুতরাং মেনু চার্ট দেখে তিনি তার মনের মতো খাবারের অর্ডার দিলেন, গ্যারোওয়ে ও পোয়ারো তারাও তাদের পছন্দমতো খাবারের অর্ডার দিলেন, তারা কিছুক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে শেরিতে চুমুক দিলেন। পোয়ারো বললেন, কতকগুলো ঘটনার ব্যাপারে আপনাদের এখানে ডেকে আনার জন্য আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ সেই ঘটনাগুলো অনেক বছর আগের এবং নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে অনেক দিন আগে।
স্পেন্স বললেন, যা আমাকে আগ্রহ জাগায় সেটা যে আপনাকেও আগ্রহী করে তুলেছে, আমি শুনে খুব খুশি হলাম। আমি ভেবেছিলাম অতীত নিয়ে গবেষণা করা নেহাতই একটা মামুলি ব্যাপার কিন্তু এ ব্যাপারে আপনি যে খুবই আন্তরিক এখন বুঝছি সেটা। অতীতের সেই ঘটনার সাথে এখনকার ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে বা হঠাৎ কৌতূহল জাগার মতো কিছু ঘটনা এবং যার কোনো ব্যাখ্যা নেই কারণ নির্ণয় করার উপায়ও নেই। আপনিও কি সেটার সাথে একমত?
টেবিলের চারপাশে তিনি তাকালেন।
ইন্সপেক্টর গ্যারোওয়ে বললেন, র্যভেন্সক্রট শু্যটিং-এর কেসে তদন্তের কাজ পরিচালনা করছিলেন অফিসার-ইন-চার্জ। উনি আমার বিশেষ পুরানো বন্ধু আর সেই কারণেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
যথেষ্ট দায় দেখিয়ে আজ এখানে উনি এসেছেন কারণ খুব সহজ এবং আমাকে স্বীকার করতেই হবে এটা কৌতূহল। তার ফলে আমার আগ্রহ দেখানোর কোনো অধিকার নেই। যেহেতু এটা অতীতের ঘটনা এবং নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে অনেক আগে। বললেন পোয়ারো।
গ্যারোওয়ে বললেন, আমি কিন্তু এমন কথা বলব না কারণ অতীতের কয়েকটি মামলার প্রতি আমাদের সকলেরই কিন্তু আগ্রহ আছে। যেমন আজও আমার জানতে ইচ্ছা হয় লিজি বোর্ডব সত্যিই কি তার বাবা মাকে কুঠার দিয়ে হত্যা করেছিল? আজও কিন্তু অনেক লোক আছে যারা এখনও তা বিশ্বাস করে না। আবার চার্লস ব্রেভোকে যে হত্যা করেছিল, আর তার মোটিভ কি ছিল। এ-ব্যাপারে অনেক ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। কিন্তু আজও লোকেরা এর বিকল্প ব্যবস্থার ব্যাখ্যা খুঁজে বার করার চেষ্টা করে।
তাঁর আগ্রহী তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল পোয়ারোর ওপর।
আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো অতীতের এ-ধরনের খুনের মামলার ব্যাপারে দু-বার কিংবা তিনবার আমরা আগ্রহ প্রকাশ করেছি, তাই না? অবশ্য যদি ভুলচুক না করে থাকি।
সুপারিনটেন্ডেন্ট স্পেন্স বললেন, অবশ্যই তিনবার আমার মনে হয়। একবার বোধহয় একজন কানাডিও মেয়ের অনুরোধে, তাই না?
হ্যাঁ, তা ঠিক। বললেন পোয়ারো। সেই কানাডিও মেয়েটি ছিল খুব উদ্দীপ্ত, আবেগপ্রবণ এবং বেশ শক্তিশালী। সে এখানে একটি খুনের মামলার তদন্তে এসেছিল এবং সে মামলায় তার মাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। আর যদিও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগেই তার মা মারা যায় তবুও তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যে তার মা ছিলেন নির্দোষ।
গ্যারোওয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মেনে নিয়েছিলেন?
পোয়ারো বললেন, আমি মেনে নিইনি কারণ প্রথম যখন সে আমাকে ঘটনাটি বলেছিল মেয়েটি ছিল খুব উদ্দীপ্ত এবং একেবারে নিশ্চিত।
স্পেন্স বললেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। যে কোনো মেয়ে তার মাকে নির্দোষ ভাববেই এবং সে সর্বশক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে তার মা নির্দোষ।
পোয়ারো প্রত্যুত্তরে বললেন, এটা তার থেকেও একটু যেন বেশি এবং মেয়েটি আমাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে তার মা ঠিক কি ধরনের মহিলা ছিলেন।
তার মা খুন করতে পারে না এই তো?
না, বললেন পোয়ারো। সেটা বলা খুব কঠিন ব্যাপার, এবং আমি নিশ্চিত আপনারা দুজনেই আমার সঙ্গে একতম হবেন এই কথা ভাবতে, কোন পরিস্থিতিতে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সেই মামলায় তার মার নির্দোষিতা সম্পর্কে কোনো উল্লেখই করেননি। তিনি যেন দোষী সাব্যস্ত হতেই কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার কৌতূহলের শুরু এখান থেকেই, আমার মনে হয় না তার মনে পরাজয়ের মনোভাব জেগে উঠেছিল। এবং আমি যখন খোঁজ নিতে শুরু করলাম তখন পরিষ্কার হয়ে গেল মোটেই তিনি সেরকম ছিলেন না। যে কেউ বলবে তিনি ছিলেন ঠিক তার উলটা।
গ্যারোওয়েকে বেশ চিন্তান্বিত দেখাল। তিনি প্লেটের খাবারগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন।
তিনি কি সত্যি সত্যিই নির্দোষ ছিলেন?
হ্যাঁ, সত্যিই তিনি নির্দোষ ছিলেন। পোয়ারো বললেন।
সেটা আপনাকে অবাক করে দিয়েছিল?
আমি যে সময় সেটা উপলব্ধি করি সেই সময় নয়, বললেন পোয়ারো। বিশেষ করে একটা ব্যাপার যা দেখিয়ে দেয় এবং তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। এই সেখানে যেমন আছে সেটা দেখে কেউ কী ভাবতে পারে এর বাইরেও অন্য কিছু থাকতে পারে। এবং তার জিজ্ঞাস্য কেন কেউ সেটা ভাবতে পারে না। আমরা কী তাহলে এদিক ওদিক তাকিয়েই বলব মেনু কী?
ঠিক সেই সময় মাছ ভাজার প্লেট রেখে বয় চলে গেল।
স্পেন্স বললেন, আরও একটা মামলায় আপনি অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়ে ছিলেন। যেমন একটা পার্টিতে একটি মেয়ে বলেছিল, সে নাকি একবার একটা খুন হতে দেখেছিল। পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ, সেটা খুবই সত্য।
মেয়েটি কি কাউকে খুন হতে দেখেছিল?
না, পোয়ারো বললেন, কারণ সেটা ছিল ভুল মেয়ে। তিনি মাছভাজার খুব প্রশংসা করলেন।
সুপারিনটেন্ডন্ট স্পেন্স বললেন, এখানে মাছের সব ডিসই ভালো করে থাকে এরা। পরবর্তী তিন মিনিট ধরে শুধু খাবারের প্রশংসা আলোচনা হল।
সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে বললেন, স্পেন্স যখন আমার কাছে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন র্যাভেন্সক্রফট মামলার ব্যাপারে আমি কিছু জানি কিনা তখন আমি সঙ্গে সঙ্গে খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠি।
এ-ব্যাপারে তো দেখছি আপনি কোনো কিছুই ভোলেননি?
র্যাভেন্সক্রফটের এমন মামলা, যা সহজে ভোলো যায় না।
আপনি কি জানেন এই মামলার ব্যাপারে কিছু ভুল-ত্রুটি ছিল? যেমন সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব অথবা বিকল্প সমাধান? পোয়ারো বললেন না সেরকম কিছু নয়, গ্যারোওয়ে বললেন, যা প্রত্যক্ষ করা যায় এমন সময় ঘটনার ওপর সাক্ষ্য প্রমাণ রেকর্ড করা হয়েছিল এবং যার মৃত্যুর ধরন ছিল আগের অনেক উদাহরণের মতন খুবই মামুলি আর তবুও
ঠিক? জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো।
তবুও সবই ভুল। বললেন গ্যারোওয়ে।
স্পেন্স বললেন, আজ তাকে যেন বেশ আগ্রহী দেখাচ্ছিল।
তার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বললেন, এক সময় আপনি ঠিক এইরকম ভেবেছিলেন তাই? মিসেস ম্যাকগিল্টির মামলায়? হা আপনি কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি যখন সেই কঠিন প্রকৃতির যুবকটি গ্রেপ্তার হল। সে যে অপরাধটা করতে পারে ঠিক সেই রকম অপরাধীর মতনই তাকে দেখাচ্ছিল। তার পক্ষে সেটা করার প্রত্যেকটি কারণ ছিল এবং সবাই ভেবেছিল সে সেটা করেছে। কিন্তু আপনি একমাত্র জানতেন সে সেটা করেনি। এবং আপনি এতটাই নিশ্চিত ছিলেন তাই আপনি আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন এবং আমাকে বলেন কেসটা হাতে নেওয়ার জন্য যাতে আমি প্রকৃত তথ্য কী সেটা বার করতে পারি।
দেখুন যদি আপনি সাহায্য করতে পারেন আর আপনি আমাকে সাহায্য করেও ছিলেন। কি করেননি আপনি?
লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পোয়ারো।
হ্যাঁ, আপনাকে সাহায্য করেছিলাম ঠিকই কিন্তু কী অস্বস্তিকর যুবক সে ছিল। ধরুন যদি কখনও কোনো যুবকের ফাঁসি কাঠে ভোলোর মতো শাস্তি তার প্রাপ্য হয় কারণ খুন করার অপরাধে নয় এবং সে যে অপরাধী নয় সেটা প্রমাণ করবার জন্যও নয়। এবং সে যে অপরাধী নয় সেটা প্রমাণ করানোর জন্য কাউকেই সে সাহায্য করবে না। আমাদের সামনেই এখন উপস্থিত র্যাভেন্সক্রফট-এর মামলা। এখানে কোথায় যেন একটা ভুল রয়ে গেছে তাই না, সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে?
হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই নিশ্চিত যে আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে নিশ্চয়ই আপনি পারছেন।
আমি বুঝতে পারি, একসাথে বললেন পোয়ারো আর স্পেন্স। সময়ে সময়ে সবাই এ-ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়ে থাকে। যেমন প্রমাণ, মোটিভ, সুযোগ, কু। আপনি যাকে বলেন একটা সম্পূর্ণ ব্লু-প্রিন্ট। যাদের এই পেশা তারা সবাই জানে এসবই ভুল। ঠিক যেমন শিল্প জগতের সমালোচক জানে কোন ছবিটা নকল এবং কোনটাই বা আসল।
সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে বললেন, এই কেসের ব্যাপারে আমার করার কিছুই ছিল না, আর আপনি যেমন বলেন এ-কেসের সমস্ত ব্যাপার আমি লক্ষ্য করে দেখেছি। সেখানকার লোকেদের সঙ্গেও কথা বলে দেখেছি কিছুই ছিল না সেখানে। এটা একটা স্রেফ আত্মহত্যার চুক্তি বলেই মনে হয়েছে। কারণ এর মধ্যে আত্মহত্যার চুক্তির সব রকম চিহ্নই দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য এর বিকল্প হতে পারে যেমন স্বামী তার স্ত্রীকে গুলি করে তারপর নিজেকে অথবা স্ত্রী তার স্বামীকে গুলিবিদ্ধ করার পর, নিজেকে গুলিবিদ্ধ করেন। যদি কারোর এই ঘটনা পর্যালোচনা করার ইচ্ছা থাকে তাহলে সে জানতে পারবে সেগুলো ঘটেছিল এবং কেন এমন ঘটল? এ মামলার কি কোনো কেন-র স্থান ছিল? পোয়ারো বললেন।
হ্যাঁ, সেই রকমই। যে মুহূর্তে আপনি একটা কেসে তদন্ত করতে শুরু করলেন মানুষ এবং ঘটনা সম্পর্কে একটা ধাঁধা নিয়মমাফিক ছবি আপনি সংগ্রহ করলেন। অথচ এ-কেসে দেখা যাচ্ছে এঁরা বয়স্ক দম্পতি। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক খুব ভালো এবং সুখী পরিবার যা বোঝায় তাই ছিল। এক সঙ্গে বেড়োতে যেতেন এবং সন্ধ্যায় তাস খেলতেন। তাদের দুটি সন্তান ছিল। ছেলে ইংল্যান্ডে এবং মেয়ে সুইজারল্যান্ডে পড়াশুনা করত। শুধু তাই নয় মেডিক্যাল রিপোর্ট থেকেও দেখা যায় তাদের স্বাস্থ্যের কোনো খারাপ লক্ষণ ছিল না। যদিও স্বামী ব্লাডপ্রেসারে ভুগছিলেন, চিকিৎসার পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। স্ত্রী একটু বধির ও অল্প হার্টের ব্যারাম ছিল। এর জন্য অবশ্য চিন্তার কারণ ছিল না কোননা। জানেন এমন অনেক লোক আছে যাদের স্বাস্থ্য খুব ভালো অথচ তাদের বদ্ধমূল ধারণা তাদের ক্যান্সার হয়েছে। এবং শুধু তাই নয় তাদের দৃঢ় বিশ্বাস তারা আর এক বছর বাঁচবে না। এক্ষেত্রে তারা সময় সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে থাকে। তাই বলে র্যাভেন্সক্র সেই প্রকৃতির লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন ধীর, স্থির, সুস্থ, স্বাভাবিক প্রকৃতির মানুষ।
তাহলে আপনি সত্যিই কী ভাবেন? জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো।
অতীতের দিকে যদি তাকাই তাহলে আমি নিজেকে বলি এটা আত্মহত্যার কেস। একমাত্র আত্মহত্যা ছাড়া কিছুই হতে পারে না। যে কোনো কারণেই হোক, আর্থিক দিক থেকে নয়, স্বাস্থ্য খারাপের দিক থেকেও নয় এবং অসুখী জীবনেরও কোনো কারণ নয় তবু তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, জীবন তাদের কাছে দুর্বিসহ। তারা যখন বেড়োতে বের হন তাদের সাথে রিভলবার ছিল। এবং ওই রিভলবারটা তাদের মৃতদেহের মাঝখানে পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং ওই রিভলবারের ওপর দু-জনেরই হাতের ছাপ ছিল। দু-জনেই ওটা ব্যবহার করেছিল কিন্তু কে যে শেষ গুলি চালিয়েছিল তার কোনো চিহ্ন অবশ্য পাওয়া যায়নি। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন স্বামীই প্রথমে তার স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ করেন এবং এটাই বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। এত সব যুক্তি ছিল বলেই এই কেসের আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এটা স্রেফ আত্মহত্যা, যদি কখনও সংবাদপত্রে স্বামী স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা লেখা থাকে দেখি আমি আমার মনের অজান্তে সেই বারো কী চোদ্দ বছর আগেকার ঘটনার অতীতে ফিরে যাই এবং নিজের মনকেই প্রশ্ন করি কি এমন ঘটনা র্যাভেন্সক্রফটের কেসে ঘটেছিল? একটাই কথা তখন আমি চিন্তা করি স্ত্রী কী তাহলে স্বামীকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেতে চেয়েছিলেন? কিংবা তারা কি পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা করতেন? এবং সেই ঘৃণা বোধটাই কি তাদের দুজনের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল?
আরও এক টুকরো রুটি মুখে নিয়ে চিবোতে থাকলেন গ্যারোওয়ে?
আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো এ-সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা? কেউ এমন কি আপনার কাছে এসেছিল এবং কিছু বলেছে যার ফলে আপনি আপনার মধ্যে এতটা আগ্রহ জাগিয়ে তুলছেন? আপনি কি কিছু জানেন যার ব্যাখ্যা আপনি করতে পারবেন–কেন?
প্রত্যুত্তরে পোয়ারো বললেন, না। সেই একই ব্যাপার। আপনার কাছে নিশ্চয় এর ব্যাখ্যা আছে তাই না?
আপনি ঠিকই বলেছেন কারণ প্রত্যেকেরই কাছে কিছু না কিছু ব্যাখ্যা থাকে যা শোনার জন্য সবাই আশা করে থাকে অথবা সেগুলোর মধ্য থেকে অন্তত একটাও। সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা যায় কিন্তু সাধারণ কোনো কাজে লাগে না। আমার অবশ্য মনে হয় আমার ব্যাখ্যা একেবারে শেষ পর্যায়ের যার কোনো কারণ আপনি খুঁজে পাবেন না, কারণ আমার মনে হয় খুব বেশি কিছু কারোর জানা থাকে না। সঠিকভাবে তাদের সম্পর্কে আমি যা জনি তা তাদের জীবিতকালের শেষ পাঁচ কী ছয় বছরের ঘটনার কথা। জেনারেল র্যাভেন্সক্রফট-এর বয়স প্রায় ষাট। অবসর নিয়ে পেনসন পাচ্ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর বয়স পঁয়তাল্লিশ। বিদেশ থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন তারা। সাক্ষ্য প্রমাণ আমি যা পেয়েছিলাম তাই থেকে বলা যায় তারা প্রথমে বোর্নমাউথে একটা বাড়ি নেন এবং এর অল্প কয়েকদিন পর আর একটি বাড়িতে উঠে আসেন এবং এখানেই ঘটেছিল সেই বিয়োগান্ত ঘটনা। যাইহোক সেখানে স্কুলের ছুটির সময় তাদের ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে আসত। তারা সুখে শান্তিতে বাস করতেন সেই সময়। আমি আরও জানি অবসর নেবার পর ইংলন্ডে তাদের পরিবারের জীবনধারা কেমন ছিল। তাদের মধ্যে আর্থিক অস্বচ্ছলতা ছিল না, ঘৃণার মোটিভ বলতে যা বোঝায় তা নয়, যৌন সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তাও নয়। এমন কি অবৈধ প্রেমের কোনো ব্যাপার তাদের মধ্যে ছিল না। আপনারা হয়তো প্রশ্ন করবেন সে সম্পর্কে আমি কী জানি? আমি যা জানি তা হল জীবনের বেশির ভাগ সময় তারা বিদেশে কাটিয়েছেন। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে, তাঁরা ঘরে ফিরে আসতেন। ভদ্রলোকের রেকর্ড ভালো ছিল কারণ তার স্ত্রীর বন্ধুরা তাকে সৌজন্য প্রকাশ করত। তাদের জীবনে তেমন দ্বন্দ্ব বিরোধ ছিল না, এর পরও যদি কোনো বিরোধ থেকে থাকে, শুধু আমি কেন সেটা কারোরই জানা নেই। কুড়ি থেকে তিরিশ বছর বিদেশে কাটিয়েছেন মালয় এবং বিভিন্ন কয়েকটি জায়গায়। সম্ভবত সেখানেই ট্রাজেডির মূল শিকড় গেঁথে গিয়েছিল। আমার ঠাকুমা প্রায়ই একটা প্রবাদের কথা বলতেন পাপের লম্বা ছায়া। তাহলে তাদের মৃত্যুর কারণ কি অতীতের কোনো ছায়া? অথবা পাপের দীর্ঘ ছায়াকে অনুসরণ করে? সেটা খুঁজে বার করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। আপনি হয়তো একটা লোকের রেকর্ড খুঁজে বার করলেন যা আপনার বন্ধু বা পরিচিতরা বলে থাকে কিন্তু তাই বলে তাদের ভিতরের বিস্তারিত খবর আপনি জানেন না। আমার মনে যে ব্যাখ্যাটা জমে ওঠে তা হল সেই জায়গাটা যদি আমি ভালো করে দেখতাম। আমার মনে হয় কিছু একটা ঘটেছিল অন্য দেশে। একটা ঈর্ষা যার সূত্রপাত বিদেশ বা ইংলন্ডে যার অস্তিত্ব আজও আছে।
যদি কেউ জানে কোথায় তার খোঁজ পাওয়া যাবে, মনে হয় তার কাছে সেটা আর অজানা থাকবে না, আপনি এটাই বোঝাতে চাইছেন।
না, সেরকম কিছু নয়, বললেন পোয়ারো। মানে আমি বলতে চাইছি এমন মনে রাখার কথা যা ইংলন্ডে তাদের কোনো বন্ধু বান্ধবরাও জানে না।
ইংলন্ডে তাদের বন্ধুদের মধ্যে বেশির ভাগ অবসর নিয়েছেন। পুরানো বন্ধুরা বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে আসেন শুধু চোখের দেখা দেখবার জন্য। যদিও আমার ধারণা অতীতে কী ঘটেছিল তা অনেকেই শোনেনি আর তাছাড়া মানুষ কিছুতেই মনে রাখতে পারে না তারা ভুলে যায়।
একটু হেসে হঠাৎ সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে কথাটা বললেন যে, তারা হাতি নয়, কারণ হাতিরা সব সময় বলে থাকে তারা সব কিছু মনে রাখতে পারে।
পোয়ারো বললেন, আপনি যা বললেন তা বড়োই অদ্ভুত।
আপনার এই হাতি সম্পর্কের মন্তব্য করার কথাটা আমার মনে খুব আগ্রহ জাগায়।
বেশ আশ্চর্য হয়েই পোয়ারের দিকে তাকালেন সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে। আরও কিছু শোনার জন্যই যেন তিনি উন্মুখ হয়ে আছেন। স্পেন্সও তার পুরানো বন্ধুর দিকে ফিরে একবার তাকালেন।
তিনি পরামর্শ দিলেন যা কিছুই ঘটেছিল সম্ভবত প্রাচ্যে অর্থাৎ হাতিরা যেখান থেকে আসছে, তাই তো? তা যাইহোক, আপনাকে এই হাতিদের প্রসঙ্গ কে উল্লেখ করেছে? পোয়ারো তার এক বন্ধুর নাম বললেন।
সুপারিনটেন্ডেন্ট স্পেন্সকে বললেন, আপনি তাকে চেনেন। তার নাম মিসেস অলিভার।
ওহো মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভারের কথা বলছেন–বলে থামলেন একটু এবং আবার বললেন, ভালো কথা।
ভালো কথা মানে কী বলতে চাইছেন? জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো।
ভালো কথা মানে বলতে চাইছি তাহলে কী তিনি কিছু জানেন জিজ্ঞেস করলেন তিনি। অন্তত এখনও পর্যন্ত আমি তা মনে করি না পোয়ারো বললেন। কী যেন চিন্তা করে তিনি বললেন, তবে আমার মনে হয় তিনি হলেন সেই ধরনের মহিলা যিনি কিছু জানেন। আশা করি আমি কী বলতে চাইছি আপনি তা বুঝতে পেরেছেন।
হ্যাঁ, উত্তর দিলেন স্পেন্স এবং জিজ্ঞেস করলেন, তার কোনো ধারণা আছে?
এতক্ষণে গ্যারোওয়ে তার আগ্রহ প্রকাশ করে বললেন, আপনি কি ওই লেখিকা মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভারের কথা বলছেন?
হ্যাঁ তিনিই, পোয়ারা বললেন।
আমি জানি তিনি অপরাধ কাহিনি লেখেন।
অপরাধ সম্পর্কে তার কি ভালো বিশেষ জ্ঞান আছে? আমি জানি না তিনি সেইসব কাহিনির ধারণা বা প্লট কোথা থেকে পান?
পোয়ারো বললেন, আমার ধারণা সবই তার মাথা থেকে আসে। এবং ঘটনাগুলো
সে তো আরও কঠিন ব্যাপার, একটু অল্প সময়ের জন্য তিনি চুপ করে থাকলেন।
আপনি কি কিছু বিশেষ চিন্তা করছেন পোয়ারো, একটা বিশেষ কিছু?
হ্যা। একটা ঘটনা সম্পর্কে তার মনে সুন্দর একটার ধারণার জন্ম হয়েছিল। অনেকটা ঠিক উল্যে, লম্বা হাতওয়ালা জামার প্রয়োজন মেটানোর মতন। সেই ধারণাটা তিনি তাঁর মাথা থেক গল্পের আকারে বার করেন। আমি তাকে ফোনে কিছু কথা জিজ্ঞেস করি। এবং তার একটা গল্প নষ্ট করে দিই।
কৌতূহলী হয়ে উঠে বললেন স্পেন্স। বলুন বলুন তারপর! ঠিক যেন গরমের দিনে মাখনের ওপর সুগন্ধি পাতা ভাসার মতন। শার্লক হোমসকে সেই কুকুরটা আর রাত্রে কোনো কিছুই করত না জানেন তাদের?
ওদের কি কুকুর ছিল? জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো, আপনি কি বলতে চাইছেন মাপ করবেন একবার বলুন তো?
আমি বলতে চাইছি ওঁদের কি কুকুর ছিল? র্যাভেন্সক্রফটরা যেদিন গুলিবিদ্ধ হন সেইদিন বেড়োনোর সময় তারা কি কুকুর নিয়ে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তাদের একটা কুকুর ছিল। গ্যারোওয়ে বললেন, আমার ধারণা যতদিন তারা বেড়োতে যেতেন ততদিনই কুকুর তাদের সঙ্গে থাকত। স্পেন্স বললেন, মিসেস অলিভারের কাহিনি যদি এরকম হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে দেখতে হবে মৃতদেহ দুটি ঘিরে তাঁদের সেই কুকুর চিৎকার করেছিল কিনা, কিন্তু মনে হয় এক্ষেত্রে তা হয়নি।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন গ্যারোওয়ে।
পোয়ারো বললেন, আমি কিন্তু খুব অবাক হচ্ছি সেই কুকুরটা কোথায় গেল?
এই কথার উত্তরে গ্যারোওয়ে বললেন, চোদ্দ বছর আগের ঘটনা তো আমার মনে হয় কারোর বাগানে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। তাহলে সেখানে গিয়ে কুকুরটাকে আমরা কিছু জিজ্ঞেস করতে পারব না। খুব চিন্তিত হয়ে তিনি আরও বললেন, এটা খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার, বাড়িতে সেদিন কি ঘটেছিল মানে সেই অপরাধের ঘটনা জানতে পারে। গ্যারোওয়ে বললেন, একটা তালিকা এনেছি। যদি প্রয়োজন মনে করেন দেখতে পারেন। একজন বয়স্ক রাধুনি মিসেস হুইটেকার সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। সুতরাং তার থেকে কিছু আমরা জানতে পারব না। একজন গভরনেস থাকতেন র্যাভেন্সক্রফটের ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা করার জন্য পরে চলে যান। কিন্তু লেডি র্যাভেন্সক্রফট হাসপাতালে ছিলেন স্নায়ু যন্ত্রের দুর্বলতার জন্য এবং হাসপাতাল থেকে আসার পর গভরনেস ফিরে এসেছিলেন লেডি র্যাভেন্সটকে দেখাশুনা করার জন্য। আর একজন মালিও সেখানে ছিল।
কিন্তু একজন আগন্তুক নিশ্চয়ই বাইরের থেকে এসে থাকবেন। হয়তো অতীতের কোনো আগন্তুক। আচ্ছা সুপারিনটেন্ট গ্যারোওয়ে এটাই আপনার ধারণা? ঠিক অতটা ধারণা নয়, তবে একটা স্রেফ একটা ব্যাখ্যা বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। চুপ করে রইলেন পোয়ারো কারণ তাঁকে যখন অতীতে ফিরে যেতে বলা হয়েছিল ঠিক সেই সময়টার কথাই তিনি ভাবছিলেন এখন। সেই অতীতে থেকে পাঁচটা লোককে তিনি পর্যালোচনা করেছিলেন যা এখন তাকে ছেলে ভোলোনো ছড়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল ফাইভ লিট পিগ। এবং সেটা খুব উৎসাহব্যঞ্জক ছিল আর একেবারে শেষ পুরস্কার পাওয়ার মতন কারণ সত্যকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন।
.
পুরোনো বন্ধু মনে রাখে
পরের দিন সকালে বাড়ি ফিরলেন মিসেস অলিভার এবং দেখলেন তার জন্য অপেক্ষা করে আছে মিস লিভিংস্টোন।
মিসেস অলিভার, আপনার দুটো ফোন এসেছিল।
হ্যাঁ, কোথা থেকে বলো?
প্রথম ফোন এসেছিল ক্রিস্টোন এ্যান্ড স্মিথ থেকে। এবং তারা জানতে চাইছিল লাইম-গ্রীণ ব্রোকেড বা পেল ব্ল কোনটা আপনি পছন্দ করেছিলেন?
এখনও পর্যন্ত আমি কোনো কিছুই মনঃস্থির করতে পারিনি, মিসেস অলিভার বললেন, তুমি বরং কাল-সকালে আমাকে একবার মনে করিয়ে দিও। কারণ রাতের আলোয় আমি সেটা দেখতে চাই।
আর দ্বিতীয় ফোন এসেছিল একজন বিদেশীর কাছ থেকে। আমার অবশ্য বিশ্বাস তিনি মিঃ এরকুল পোয়ারো।
ও! মিসেস অলিভার বললেন, তা তিনি আবার কী চাইছিলেন?
তিনি বললেন, আজ অপরাহ্নে আপনি কি একবার তার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন?
সেটা একেবারেই অসম্ভব। এখুনি আবার আমি বাইরে বেরুব। তিনি কি তার টেলিফোন নম্বর দিয়েছেন? ওকে ফোন করো তো।
হ্যাঁ, তিনি দিয়েছেন।
তাহলে তো খুব ভালো হল। ওঁকে একবার ফোন করো এবং ওঁকে বলো এখন ওঁর সাথে দেখা করতে পারলাম না। আমি খুব দুঃখিত কারণ আমি এখুনি বেরিয়ে যাচ্ছি হাতির খোঁজে।
মিস লিভিংস্টোন বলল আমাকে মাপ করবেন।
ওঁকে বলো এখন আমি হাতির খোঁজ করছি।
আচ্ছা ঠিক আছে, মিস লিভিংস্টোন বলল। কিন্তু তার বাঁকা দৃষ্টি তখন তার নিয়োগকর্তীর ওপর। কারণ সে বোঝবার চেষ্টা করছিল তিনি ঠিক আছেন তো! যদিও তিনি একজন সফল ঔপন্যাসিক তথাপি এক এক সময় তার মাথার ঠিক থাকে না।
মিসেস অলিভার বললেন, আমি এর আগে কখনও হাতির খোঁজ করিনি। তবুও একাজে দারুণ আগ্রহ আছে।
এরপর তিনি বসবার ঘরে গেলেন এবং সোফার ওপর বসে বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগলেন। গতকাল সন্ধ্যা থেকে এই বইটা নিয়ে বসে আছেন কিন্তু তিনি কতগুলো ঠিকানা সংগ্রহ ছাড়া আর কিছুই এগোতে পারেননি।
ও ভালো কথা প্রত্যেককেই কোনো না কোনোখান থেকে শুরু করতে হয়। সবদিক থেকে বিবেচনা করে আমার মনে হয় জুলিয়াকে দিয়েই শুরু করব। ও এখনও দৌড়ঝাঁপ ছাড়েনি। সব সময়েতেই ওর একটা না একটা ধারণা মনে আসবেই। আর দেশের সেই অংশটার ব্যাপারে ওর জানা আছে কারণ ওর কাছাকাছি জায়গাতেই ও বাস করে। সুতরাং আমি জুলিয়াকে দিয়েই শুরু করব, মিসেস অলিভার বলল। মিস লিভিংস্টোন চারটে চিঠি তার সামনে দিয়ে বললেন, এই চারটে চিঠিতে আপনাকে সই করতে হবে।
এখন আমি এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। সত্যি সত্যিই এক মিনিটও আমি বাজে খরচ করতে পারব না, বললেন মিসেস অলিভার। কারণ তাকে এক্ষুনি হ্যাঁম্পটনগের্টে যেতে হবে আর সেই জায়গাটা এখান থেকে অনেক দূর।
অনারেবল জুলিয়া কারস্টেয়ার্স তার আর্মচেয়ার থেকে উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ভালো করে নড়তে চড়তে পারেন না। চোখে ভালো দেখতে পান কিন্তু কানে একটু কম শোনেন। বয়স সত্তরেরও বেশি।হোম ফর দি প্রিভিলেজের সদস্য সূত্রে একটা এ্যাপার্টমেন্টে দু-জনে থাকেন। কানে একটু কম শোনেন বলে প্রথমে মিসেস অলিভারের নামটা শুনতে পারেননি। মিসেস অলিভার? কিন্তু ওই নামের কোনো মহিলাকে তো আমি চিনি না। হাঁটুর ব্যথার জন্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন সামনে এবং পিটপিট্ করে তাকালেন সামনের দিকে।
আমার ধারণা আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না হয়তো কারণ অনেক অনেক বছর আগে আমরা এক সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম।
ঠিক বয়স্ক লোকেরা যেমন গলার স্বর শুনে বুঝতে পারেন, মিসেস কারস্টেয়ার্স সে রকম কণ্ঠস্বর শুনে মিসেস অলিভারকে চিনতে পারলেন। আনন্দে মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলেন, কেন চিনতে পারব না। তুমিই তো আমার প্রিয় অ্যারিয়াডন না! উফ তোমাকে দেখে আমার কী আনন্দ লাগছে না!
দু-জনের মধ্যে কুশল বিনিময় হল।
মিসেস অলিভার ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন, আমি এখানেই আছি। একজনের সাথে এখানে দেখা করতে এসেছিলাম। আর গতকাল রাত্রে খাতার পাতা ওলটাতে গিয়ে আপনার ঠিকানা দেখলাম। যেখানে গিয়েছিলাম তার কাছেই দেখলাম আপনার এ্যাপার্টমেন্ট, তাই চলে এলাম। এই জায়গাটা খুব আনন্দদায়ক তাই না? ঘরের চারিদিক তিনি তাকিয়ে দেখলেন।
খুব একটা খারাপ জায়গা নয় জানো, যে কেউ তার ফার্নিচার, আসবাবপত্র এখানে নিয়ে আসতে পারে। মিসেস কারস্টেয়ার্স বললেন, সব চেয়ে সুবিধা হল কাছেই রেস্তোরাঁ সেখান থেকে তুমি তোমার খাবার সংগ্রহ করতে পারো। তোমাকে দেখার পর বেশ ভালো লাগছে। আরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হয়, বসো। এই সেইদিন সাহিত্যের ভোজসভায় তোফা দেওয়ার খবর পড়লাম কাগজে, আর আজ সেই কি না সশরীরে হাজির হয়েছে। কি অদ্ভুত ঘটনা বলো তো? দারুণ বিস্ময়কর ঘটনা নয় কি? তুমি কি বলে?
চেয়ারে মিসেস অলিভার বসতে বসতে বললেন, জানি, সব জিনিই এরকম হয়ে থাকে, হয় না?
তুমি কি এখনও লণ্ডনেই আছ?
মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ। তিনি আপন মনে ছোটবেলাকার স্মৃতির পাতা ওলটাতে থাকেন। তারপর তিনি মিসেস কারস্টেয়ার্সের মেয়ে এবং দুটি নাতি-নাতনির খবর জিজ্ঞেস করলেন। অপর মেয়েটির খবর নিয়ে তিনি জানতে পারলেন সে এখন নিউজিল্যান্ডে থাকে তবে সেখানে মেয়েটি ঠিক কি করছে তা তিনি জানেন না। বোধহয় সোস্যাল রিসার্চের কাজ হবে। তিনি চেয়ারের হাতলে লাগানো ইলেকট্রিক বেলের সুইচ টিপে এম্মাকে চা আনার জন্য বললেন। মিসেস অলিভার বললেন, ব্যস্ত হবার দরকার নেই। কিন্তু জুলিয়া, কারস্টেয়ার্স জোর দিয়ে বলে উঠলেন, অবশ্যই অ্যারিয়াডনকে চা খাওয়াতেই হবে।
দু-জনে পুরানো বন্ধু। চেয়ারে হেলান দিয়ে ভালো করে বসে গল্প করলেন।
বেশ কয়েক বছর আগে তোমাকে শেষ দেখে ছিলাম, মিসেস কারস্টেয়ার্স বললেন। মিসেস অলিভার বললেন, আমার মনে হয় লেঞ্জয়েলিন্স-এর বিয়ের সময়! হা সেই সময়েতেই হবে। কারণ ময়রাকে সহচরী সাজে কী যে ভয়ঙ্কর লাগছিল দেখতে। আর কী যে ভয়ঙ্কর তাদের পোশাক।
আমি জানি, ওদের ওই পোশাকে মানায় না।
আমাদের সময়কার বিয়ের পোশাকের তুলনায় এখনকার বিয়ের পোশাক মোটেই ভালো নয়। আমার অন্তত তাই মনে হয়, বর এবং কনের কি বিশ্রী সব পোশাক।
অ্যারিয়াডনকে বললেন, তুমি কি চিন্তা করতে পারো চার্চের হালত কেমন? কিন্তু আমি যদি যাজক হতাম দেখতে ঠিক আমি তাদের বিয়ে দিতে অস্বীকার করতাম।
চা খেতে খেতে মিসেস অলিভার বললেন, আগের দিন আমার ধর্মকন্যা সিলিয়া র্যাভেন্সক্রক্টকে দেখলাম। আচ্ছা র্যাভেন্সক্রফটদের কি মনে আছে আপনার। যদিও অবশ্য অনেক অনেক বছর আগের ঘটনা।
র্যাভেন্সক্রফটদের এক মিনিট দাঁড়াও, হা হা, জোড়া আত্মহত্যা, সেই ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি তাই না? তাদের বাড়ির কাছেই পাহাড়ের ওপর। তারা তাই মনে করেছিল না?
মিসেস অলিভার বললেন, আপনাকে তারিফ করি আপনার অসাধারণ স্মৃতিশক্তির জন্য।
সব সময়েই আমার এইরকম কিন্তু এক এক সময়ে নামগুলো ঠিক খেয়াল করতে পারি না। ঘটনাটা ছিল বড়ই মর্মান্তিক তাই না? অবশ্যই মর্মান্তিক।
আমার এক ভাইপো মালয়েতে তাদের ভালো করে চিনত। রডিফ্রস্টারকে তুমি চেনো তো। র্যাভেন্সক্রফট-এর কর্মজীবন ছিল খুব উঁচুমানের, প্রতিভাবান পুরুষ ছিল। তবে অবসর নেওয়ার পর কানে একটু কম শুনতেন। স্বাভাবিক কথাবার্তা খুব একটা ভালো শুনতে পেত না সে।
হ্যাঁ, আপনি তাদের ভালোভাবে চিনতেন?
ও হ্যাঁ, সত্যি মানুষকে কেউ ভুলতে পারে না। আমার ধারণা ওভারক্লিফের কাছে ওরা পাঁচ কী ছয় বছর ছিল।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন আমার মনে আছে, বললেন মিসেস অলিভার। তবে মিসেস র্যাভেন্সক্রফট-এর খ্রিস্টান যে নামটা ছিল সেটা আমি ভুলে গেছি। কি যেন নাম ছিল?
আমার মনে হয়, মার্গারেট। তবে সবাই কিন্তু তাকে মলি বলেই ডাকত। হ্যাঁ ঠিকই মার্গারেট। তোমার কি মনে আছে সে পরচুলো ব্যবহার করত?
মিসেস অলিভার বললেন, স্পষ্ট হয়তো মনে নেই তবে মনে হয় পরচুলা ব্যবহার করতেন। সে আমাকে বলেছিল আপনি যখন বিদেশ ভ্রমণে যাবেন পরচুলা খুব কাজে লাগে। তার চার রকমের পরচুলা ছিল। একটা সন্ধ্যাবেলা, একটা ভ্রমণের আর একটা খুব অদ্ভুত জানেনা, মাথায় নাকি টুপি পরলেও পরচুলা অবিন্যস্ত হয় না।
মিসেস অলিভার বললেন, ঠিক আপনার মতন আমিও তাদের জানতাম। তারা যখন গুলিবিদ্ধ হন আমি তখন ছিলাম আমেরিকায় লেকচার টুরে। তাই এই ব্যাপারে আমি বিস্তারিত কিছু জানি না।
জুলিয়া কারস্টেয়ার্স বললেন, হ্যাঁ বটে এটা বিরাট একটা রহস্য। তাদের মৃত্যু রহস্য কিন্তু কেউ জানে না। তাদের সেই মৃত্যুকে ঘিরে অনেক মুখরোচক কাহিনি রটেছিল লোকের মুখে মুখে।
আমার ধারণা পুলিশি তদন্ত নিশ্চয়ই হয়েছিল। এবং তখন সেখানকার উপস্থিত লোকেরা কি বলেছিল মনে আছে আপনার?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই মনে আছে। এবং সেই অস্বাভাবিক জোড়া আত্মহত্যার ব্যাপারে পুলিশি তদন্ত হয়েছিল বৈকি। আর সেটা ছিল একটা অমীমাংসিত কেস। মৃত্যু হয়েছিল ঠিকই রিভলবারের গুলিতে কিন্তু কী সেই ঘটনা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি তারা। হতে পারে জেনারেল র্যাভেন্সক্রফট প্রথমে তার স্ত্রীকে গুলি করেন তারপর নিজেকে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে বিচার করলে লেডি র্যাভেন্সক্রফট তার স্বামীকে গুলি করার পর নিজেকে নিজেই গুলিবিদ্ধ করেছিলেন এ সম্ভাবনাটাকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমার মনে হয় যে এটা একটা আত্মহত্যার চুক্তি। আবার জোর দিয়েও কিন্তু বলা যায় না যে কি করেই বা এই রকম একটা সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছিল।
তার মানে আপনার কি মনে হয় এর মধ্যে অপরাধের কোনো প্রশ্ন নেই?
না, পুলিসি রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়েছিল এর মধ্যে কোনো অন্যায় কিছু ছিল না। তার মানে আমি বলতে চাই তাদের কাছে অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এলে তার পায়ের অথবা হাতের ছাপ বা অন্য কোনো চিহ্ন অবশ্যই থাকত। সেখানে সেরকম কিছুই ছিল না। প্রত্যেক দিনের অভ্যাসমতো চা খেয়ে তারা বেড়োতে বেড়িয়েছিলেন, তবে নৈশভোজের পর আর তারা ফিরে আসেনি। তখন পুরুষ পরিচারক এবং বাগানের মালি, তাদের খোঁজের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হল এবং একটু দূরে বাড়ির কাছেই মৃত অবস্থায় তাদের দেখতে পায় এবং রিভলবারটা মৃতদেহের পাশেই পড়েছিল।
রিভলবারটা কার ছিল? জেনারেলের তাই না? হ্যাঁ বাড়িতে তার দুটো রিভলবার ছিল। আজকাল যে রকম দেশের অবস্থা মানে খুন খাবাপি হচ্ছে সেই জন্যই নিরাপত্তার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র রেখে দেয় তারা। তারা মারা যাবার সময় দ্বিতীয় রিভলবারটা বাড়ির ড্রয়ারেই ছিল, তাই মনে করে নেওয়া যায় রিভলবার সঙ্গে নিয়েই জেনারেল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, অবশ্য আমার মনে হয় না মিসেস র্যাভেন্সক্রক্ট রিভলবার সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন।
না, না, সেটা অত সহজ ব্যাপার নয়।
কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণের মধ্যে কোথাও জানা যায়নি তারা অসুখী ছিল কিনা বা তাদের দু-জনের মধ্যে কোনো ঝগড়া বিবাদ হয়েছিল কিনা এবং কেনই বা তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিল তারও কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে কত ধরনের দুঃখবোধ থাকতে পারে কেউ তা জানতে পারে না। মিসেস অলিভার বললেন, না, না, কেউ তা জানতে পারে না। কী যে ভীষণ সত্য কথা সেটা জুলিয়া, আপনার কি নিজস্ব কোনো ধারণা আছে?
ভালো কথা, প্রিয়, জানো তো সব সময় সবাই এসব ক্ষেত্রে কম বেশি অবাক হয়ে থাকে?
হ্যাঁ ঠিকই, মিসেস অলিভার বললেন, প্রত্যেকে সব সময় অবাক হয়ে থাকে।
আমার অনুমান নয় শোনা কথা যে–জেনারেলের একটা কঠিন অসুখ ছিল। আমার ধারণা তাকে হয়তো বলা হয়েছিল সে ক্যান্সারে মারা যাবে কিন্তু মেডিকেল রিপোর্টে সেরকম কোনো উল্লেখ নেই। তার স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল। আমি বলতে চাই তার করোনারি ছিল। ওটা রাজমুকুটের মতো শোনায়, রাজকীয় অসুখই বটে। জেনারেলের সেই অসুখটা হয়েছিল তবে ভালো হয়ে যায়। আর মিসেস র্যাভেল ট স্নায়ুর রোগে ভুগত। মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ, আমার মনে আছে, হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মৃত্যুর সময় কি তিনি পরচুলা পড়েছিলেন?
ওহো সত্যি আমি মনে করতে পারছি না, তবে আমি জানি ও সব সময়ে পরচুলা পড়ে থাকত। আমার ধারণা সেগুলোর মধ্যে একটা-মিসেস অলিভার বললেন, শুনে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। আমার মনে হয় যে ভাবেই হোক আপনি যদি নিজেকে গুলি করতে যান এবং আপনার স্বামীকেও গুলি করতে যান তখন কি আপনি পরচুলা পড়ে যাবেন?
জুলিয়া, আপনি কি ভাবেন?
দেখো তোমাকে তো আগেই বলেছি প্রত্যেকেই অবাক হয়। আর এ-ব্যাপারে একটা গুজব শোনা যায়–জেনারেল না তার স্ত্রীর সম্পর্কে?
হ্যাঁ, তারা বলেছিল একজন যুবতী মহিলা সে জেনারেলের সেক্রেটারির কাজ করত। জেনারেল তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতি লিখছিল–আমার বিশ্বাস, একজন প্রকাশকের প্রেরণা সেই মেয়েটিকে দিয়ে সে লেখাতো। কিছু কিছু লোক বলে মেয়েটির সঙ্গে কোনোভাবে ফেঁসে গিয়েছিল জেনারেল। মেয়েটি কিন্তু খুব একটা যুবতী ছিল না। তিরিশের ওপর বয়স, দেখতেও ভালো নয়। সেই মেয়েটি সম্পর্কে কোনো স্ক্যান্ডাল বা অন্য কিছু রটানো করা হয়েছিল যা এখনও কেউ জানে না। লোকেরা ভেবেছিল মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য জেনারেল তার স্ত্রীকে গুলি করে থাকবে। কিন্তু লোকেরা সেরকম রটনা করলেও আমি কিন্তু কখনওই বিশ্বাস করি না।
তা আপনার কী মনে হয়?
মিসেস র্যাভেন্সক্রফট-এর সম্পর্কে একটু চিন্তা করি। আপনি কি সেই লোকটার কথা উল্লেখ করতে চাইছেন?
আমার বিশ্বাস মালয়েতে কিছু একটা ঘটে থাকবে এবং সে ধরনের কাহিনী আমি শুনেছিলাম তার সম্পর্কে। এমন একটি যুবকের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ে বয়সে তার থেকে ছোটো। এবং তার স্বামী সেটা মেনে নেয়নি। এই ব্যাপারে কিছু স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়ে। যাইহোক সে অনেককাল আগের ঘটনা। আমার মনে হয় না পরে কখনও জানাজানি হয়েছে।
বাড়ির কাছে মানে প্রতিবেশীদের মধ্যে কারোর সঙ্গে কোনো বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠার খবরে কোনো আলোচনা হয়েছিল বলে আপনার মনে হয় না? বা ওদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া আপনার জানা নেই?
না, তা আমার মনে হয় না। কারণ সেই সময় খবরের কাগজের প্রতিটি খবর পড়েছিলাম। তবে যে কোনো লোকই তার মনোভাব ব্যক্ত করতে পারে সে সত্য বা মিথ্যাই হোক। এর সঙ্গে একটা বিয়োগান্ত প্রেমের কাহিনি জড়িয়ে আছে। কিন্তু বাস্তবে তা যে ছিল না আপনি কি সেটা মনে করেন? ওঁদের ছেলেমেয়ে বর্তমান ছিল। তার আমার ধর্মকন্যাও ছিল।
ওহো হ্যাঁ, ওদের একটি ছেলেও ছিল। কোথাও কোনো স্কুলে পড়াশুনা করত। জোয়ান মেয়েটির বয়স তখন বারো কিংবা আর একটু বেশি। সুইজারল্যান্ডে একটি পরিবারের সঙ্গে থাকত।
তোমার কি মনে হয় না পরিবারের মধ্যে কোনো মানসিক যন্ত্রণা ছিল?
তুমি ছেলেটির কথা বলছ। হতেই পারে, তবে তোমাকে একটা আশ্চর্যের কথা শোনাই এ-ঘটনার কয়েক বছর আগে একটি ছেলে তার বাবাকে গুলি করে। এই ঘটনাটা ঘটেছিল নিউ ক্যাসেলের কাছাকাছি কোথাও হবে। খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে। আমি শুনেছি তারা বলেছিল ছেলেটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তখন সে নাকি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। এবং তারপর সে তার বাবার কাছে এসে তাকে গুলি করে। কেউ কিন্তু জানে না কেন তার বাবাকে সে গুলি করতে গেল? অবশ্য র্যাভেন্সক্রফটদের সঙ্গে সেই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্য কোনোভাবেই এরকমএকটা চিন্তা আমি কিছুতেই করতে পারি না।
হ্যাঁ জুলিয়া!
আমি এও চিন্তা করতে পারি না যে সেই লোকটি আপনি। কি তাহলে বলতে চাইছেন মিসেস র্যাভেন্সট-হা জানো কেউ কেউ ভাবে এটা হতেই পারে কারণ সেই পরচুলাগুলো।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না এর মধ্যে পরচুলা আসে কী করে?
তার চেহারা এবং সৌন্দর্য দেখবার জন্য।
তিনি তখন বোধহয় পঁয়ত্রিশ বছরের মহিলা, তাই নয় কি?
আমার মনে হয় আরও বেশি, ছত্রিশ হবে হয়তো। আমার পরিষ্কার মনে আছে একদিন সে আমাকে পরচুলাগুলো দেখিয়েছিল। পরচুলা পড়লে সত্যিই তাকে দারুণ আকর্ষণীয় বলে মনে হত। এসব তার শুরু হয় যখন তারা সেখানে বসবাস করতে আসল। এবং বলতেই হবে সে রীতিমতন সুন্দরী মহিলা ছিল।
আপনি বলতে চাইছেন অন্য কোনো পুরুষের সাথে তিনি মিলিত হয়েছিলেন?
হ্যাঁ, আমি সেটা সব সময়ই ভেবেছিলাম। বললেন মিসেস কারস্টেয়ার্স। যদি কোনো পুরুষ কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে, সাধারণ লোকেরা কিন্তু সেটা লক্ষ্য করে থাকে। কারণ পুরুষরা এ-ব্যাপারে একদম গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু একজন মহিলা কোনো পুরুষের সঙ্গে মিলিত হলে সে খুব বেশি কিছু জানতে পারে না। আপনি কি সত্যি তাই মনে করেন জুলিয়া?
জুলিয়া বললেন, সত্যি আমি তা মনে করি না। কারণ আমি মনে করি লোকেরা সব সময়েই জানতে পারে। তার মানে আমি বলতে চাইছি তুমি জানো, চাকরবাকররা জানে, মালিরা জানে, বাস চালকরা জানে কিংবা পাড়ার কেউ জানে। এখানেই সেরকম কিছু হতে পারে আর সেটা দেখে ফেলে থাকবে…
আপনি বলতে চাইছেন যে, এটা একটা ঈর্ষাজনিত অপরাধ?
হ্যাঁ, আমার মনে হয় তাই।
তাহলে আপনি এও মনে করেন জেনারেল তার স্ত্রীকে প্রথম গুলি করেছিল। তারপর নিজেকে। নিশ্চয়ই আপনি মনে করেন না মিসেস র্যাভেন্সক্রফট তার স্বামীকে গুলি করার পর নিজেকে গুলি করেছেন? হা সেই রকমই ভাবা উচিত। কারণ আমি মনে করি তিনি যদি তার স্বামীর হাত থেকে রেহাই পেতে চাইতেন তাহলে ওরা দুজনে একসাথে বেড়াতে বেরত না। এবং সে ক্ষেত্রে মিসেস র্যাভেন্সক্রফট রিভলবারটা হ্যান্ডব্যাগে নিত কারণ সেই হ্যান্ডব্যাগটা বেশ আকারে বড়ো হতে হত। আর তখনই অনেকে তার হাতে একটা বেমানান হ্যান্ডব্যাগ দেখে বাস্তব দিকের ব্যাপার চিন্তা করত।
মিসেস অলিভার বললেন, আমি জানি। এটা খুবই আগ্রহব্যঞ্জক।
প্রিয়, তুমি অপরাধ কাহিনি লিখে থাকো। এটা তোমার মনেও খুব আগ্রহ জাগাবে। তাই আমি আশা করছি এ বিষয়ে তোমার ভালো ধারণা থাকতে পারে এবং কি ঘটতে পারে তা তুমি বেশ ভালোই জানো।
মিসেস অলিভার বললেন, কী ঘটতে পারে আমি তা জানি না। কারণ সমস্ত অপরাধ কাহিনিগুলোতে যা লিখি তা সবই আমার আবিষ্কার, তার মানে আমার কাহিনিতে আমি যা ঘটাতে চেয়েছি ঠিক সেটাই ঘটেছে। আর এসব ঘটনাগুলো ঠিক সে ধরনের নয় যা আসলে ঘটেছিল বা ঘটতে পারে। আপনি কি এই ব্যাপার চিন্তা করেন সেটা জানতে খুব আগ্রহ হচ্ছে। কারণ লোকগুলোকে আপনি ভালো চেনেন জুলিয়া। এবং আমি আরও মনে করি যে, মিসেস র্যাভেন্সক্রফট কিংবা জেনারেল আপনাকে একদিন নিশ্চয়ই কিছু বলে থাকবে।
তুমি যখন বললেই একটু অপেক্ষা করো। আমার মনে হচ্ছে অতীতের কিছু কিছু মনে আসছে।
মিসেস কারস্টেয়ার্স চেয়ারে হেলান দিয়ে দ্বিধাগ্রস্তভাবে মাথা নাড়লেন। চোখ দুটি তার অর্ধনিমীলিত যেন তার মনে এখনও সন্দেহ আছে। উলটোদিকে মিসেস অলিভার নীরবে গভীর আগ্রহ নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক যেমন করে চায়ের কেটলিতে জল দিয়ে প্রত্যেক নারী তাকিয়ে থাকে কখন জল ফুটবে এবং কেটলির ঢাকা খুলে যাবে।
হ্যাঁ, আমার মনে হচ্ছে একবার মিসেস র্যাভেন্সক্র কিছু যেন একটা বলেছিল এবং তখন আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেটা দিয়ে কী সে বোঝাতে চেয়েছিল নতুন করে জীবন শুরু করার ব্যাপারে বোধহয়। আমার ধারণা সেন্ট টেরেসার সম্পর্কে এ্যাভিলার সেন্ট টেরেসা…
মিসেস অলিভারকে একটু হতভম্বের মতো দেখাল কিন্তু এখানে এ্যাভিলার সেন্ট টেরেসার কথা আসে কী করে।
আমার মনে হয় সে নিশ্চয়ই তার জীবনী পড়ছিল তখন। সে বলেছিল চমৎকারভাবে মহিলারা তাদের নতুন জীবন পেয়ে যায়। ঠিক এই রকম ভাষা সে ব্যবহার করেনি। তুমি কি জানো মেয়েদের বয়স যখন চল্লিশ পঞ্চাশ হয় হঠাৎ তারা নতুন জীবন শুরু করতে চায়। এ্যাভিলার টেরেসা তাই করেছিলেন। তারপর তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন সমস্ত কনভেন্ট গুলোর সংস্কার করতে। এবং তারপর তিনি একজন মহান সেন্ট হয়ে যান।
কিন্তু সেটা একই ধরনের ব্যাপার বলে তো মনে হচ্ছে না।
সেটা নয়, বললেন কারস্টেয়ার্স। কিন্তু জানো মেয়েরা ভীষণ বোকার মতো কথা বলে যখন তারা জীবনের মানে খুঁজে পায়, তখন তারা প্রেম সম্পর্কে উল্লেখ করে থাকে।
.
ছেলেবেলা পিছু ডাকে
রাস্তার ধারে একটা অতি জীর্ণ কটেজ। মিসেস অলিভার চোখে একরাশ সন্দেহ নিয়ে সামনের দরজার দিকে তাকালেন। এবং একটু এগিয়ে থামলেন তিনি। ঠিকানা লেখা ছোট্ট খাতাটা খুললেন এবং মিলিয়ে দেখলেন ঠিকানাটা, কারণ যেখানে আসার কথা ছিল সেই জায়গায় ঠিক এসেছেন কিনা। ইলেকট্রিক বেল বাজালেন, সাড়া না পেয়ে দরজায় আস্তে ধাক্কা মারলেন। এবং তাতেও কোনো যখন কাজ হল না আবার জোরে নক্ করলেন। এবার ভেতর থেকে শব্দ পাওয়া গেল। তারপরেই এলোমেলো পায়ের শব্দের সঙ্গে হাঁপানির টানের শব্দ এবং কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খোলার শব্দ তার কানে ভেসে ভেসে এলো৷ আর এই শব্দের সঙ্গে লেটার-বক্সে কিছু অস্পষ্ট শব্দের প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া গেল।
দরজার ক্যাচক্যাচ শব্দ এবং কেমন একটা ভুতুড়ে শব্দ তুলে দরজাটা খুলে গেল। দরজা খুলে তখন দাঁড়িয়েছিলেন অতি বৃদ্ধ এক মহিলা।
মুখে বলিরেখা, বাতে পঙ্গু, ঝুঁকে পড়া কাঁধ, ভাসাভাসা চোখে তিনি তাকালেন অতিথির দিকে। তার মুখটা দেখে মনে হল গোমড়া। তাকে স্বাগত জানাবার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। অবশ্য তার চোখে মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন ছিল না। তার বয়স সত্তর বা আশি হতে পারে। কিন্তু এই বয়সেও যে তিনি তার বাড়ির রক্ষকের কাজ করছেন বাহবা দিতে হয়।
কিসের জন্য তুমি এসেছ? একটু থামলেন এবং বললেন, তুমি মিস অ্যারিয়াডন না? বাঃ! চমৎকারভাবে আপনি দেখছি আমাকে মনে রেখেছেন। আপনি কেমন আছেন মিসেস ম্যাচাম? মিস অ্যারিয়াডন! দাঁড়াও, আমাকে একটু ভাবার সুযোগ দাও।
অনেক আগে উনি আমাকে মিস অ্যারিয়াডন বলে ডাকতেন, ভাবলেন মিসেস অলিভার। তবে বয়সের ভারে গলার স্বর একটু ভেঙ্গে গেছে। তাহলেও বেশ ভালোই চেনা যায়।
আরে ভেতরে এসো। তোমাকে বেশ ভালোই দেখাচ্ছে। কতকাল আগে যেন তোমাকে দেখেছি। তা প্রায় কম করেও পনেরো বছর হবে না? বৃদ্ধা বললেন, পনেরো বছরেরও বেশি হবে তা শুধরে দিতে চাইলেন না মিসেস অলিভার। ভেতরে ঢুকে মিসেস ম্যাচামের সঙ্গে করমর্দন করলেন। বয়সের ভারে অসম্ভব কাঁপছিল তার হাতটা। যাইহোক কোনো রকমে দরজা বন্ধ করে এলোমেলো পায়ে হেঁটে গিয়ে একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকলেন। অবশ্যই ঘরটা তাঁর পছন্দমতো অথবা অপছন্দ অতিথিদের সম্বর্ধনা জানানোর জন্য সেইভাবেই সাজানো এবং এই ঘরের মধ্যে অসংখ্য ফটো, তার মধ্যে কিছু শিশুর আর কিছু প্রাপ্তবয়স্কদের। কিছু কিছু ছবি চামড়ার ফ্রেমে আঁটা। রুপোর ফ্রেমে একটা যুবতীর ছবি মাথায় তার পাখির পালক। সেই ছবির মধ্যে দুজন নৌ বাহিনীর অফিসার, দুজন সামরিক অফিসার আর আছে কিছু নগ্ন শিশুর ছবি এবং ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে একটা সোফা, দুটো চেয়ার। একটা চেয়ারে বসলেন মিসেস অলিভার আর সোফার ওপর নিজে বসলেন। বসতে তার কষ্ট হচ্ছিল বলে পিছনে একটা কুসান ঠেসান দিলেন।
তোমাকে দেখবার খুব ইচ্ছা ছিল। আচ্ছা তুমি কি তোমার সুন্দর লেখা এখনও লিখছ তো?
মিসেস অলিভার হ্যাঁ বললেন বটে তবে তার মনে সন্দেহ হল যে, একটা গোয়েন্দা গল্প, বা অপরাধ কাহিনি এবং অপরাধীদের ব্যবহার কী করে সুন্দর ও চমৎকার আখ্যা পেতে পারে।
মিসেস ম্যাচাম বললেন, আমি এখন একেবারে একা নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছি। আমার বোন গ্রেসি গত হেমন্তে মারা গেছে, তার ক্যান্সার হয়েছিল। অপারেশনও হয়েছিল কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে আমার। বোনকে তুমি চিনতে তো? আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি সত্যিই দুঃখিত, বললেন মিসেস অলিভার।
মিনিট দশেক বৃদ্ধা এক এক করে আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর আলোচনা করলেন এবং কোনো কোনো আত্মায় এখনও জীবিত রয়েছেন তা বলে আলোচনা শেষ করলেন।
তোমার শরীর কেমন? নিশ্চয়ই ভালো। তোমার স্বামী-ওহো এখন মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে সে মারা গেছে তাই না? তা লিটল স্যাটার্ন মাইনার কেন এসেছ, আমি কি জানতে পারি?
মিসেস অলিভার বললেন, এ-পাড়ার কাছেই ত্রাসে ছিলাম। ঠিকানা লেখা খাতায় আপনার ঠিকানা লেখা ছিল। তাই মনে করলাম আপনার বাড়িতে একবার ঘুরে যাই। আপনি কেমন আছেন?
আহ। সম্ভবত পুরোনো দিনের কথা বলতে এবং যখন তুমি তা করো খুব ভালো লাগে তাই না?
মিসেস অলিভার হ্যাঁ বললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন–যে কারণে তিনি এখানে এসেছেন সেই প্রসঙ্গের একটা ইঙ্গিত মিসেস ম্যাচামের কথায় পাওয়া গেল। তিনি বললেন, না জানি কতগুলো ফটোই আপনি পেয়েছেন।
পুরোনো দিনের একটা বাড়ির কথা মনে পড়ছে। সেই বাড়িতে আমি ছিলাম। বাড়িটার নাম সূর্যাস্ত নীড়। এক বছর তিন মাস সেখানে ছিলাম। কী জঘন্য ব্যবস্থা। আমি আমার নিজস্ব কোনো জিনিস ব্যবহার করতে পারব না। সব কিছুই হোমের। আমি বলছি না সেগুলো ভালো নয় কিন্তু আমি আমার নিজের জিনিসই ব্যবহার করতে পছন্দ করি। যেমন আমার ফটো, আমার ফার্নিচার। তারপর সেখানে একটি নারী এলো কোনো একটি কাউন্সিল থেকে বা সোসাইটি থেকে কিংবা অন্য কোথা থেকে। আমাকে বলল তাদের একটা ভালো হোম আছে সেখানে আমি আমার পছন্দমতো যে কোনো জিনিস ব্যবহার করতে পারব। প্রতিদিন সেখানকার কর্তৃপক্ষ থেকে তোক এসে খোঁজ নিয়ে যায় আমি ভালো আছি কিনা। সত্যি খুব আরামে আছি। কারণ এখানে আমি আমার সব কিছুই কাছে পেয়েছি।
চারিদিক তাকিয়ে দেখলেন মিসেস অলিভার এবং বললেন, সব জায়গা থেকেই যা পাওয়া যায়।
হ্যাঁ ওই টেবিলটা। ওই ব্রাসটা ওই দুটো ক্যাপ্টেন উইলসন সিঙ্গাপুর থেকে আমাকে দিয়েছিলেন। বেনারস ব্রাসটা খুব সুন্দর না। ছাইদানির ওপর ওই জিনিসটা, ওটা একটা মুগুর বা গদা, পাথরের তৈরি ওটা ইজিপ্টের জিনিস। ওরা ওটা দামি পাথর বলে থাকে, এর রঙ উজ্জ্বল নীল।
মিসেস অলিভার বললেন, লাজিস লাজুলি।
তা ঠিক। আজও ঠিক ওটা একই রকম আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকের একটি দল মাটি খুঁড়ে পায় এবং ওটা আমাকে পাঠিয়ে দেয়, মিসেস অলিভার বললেন, আপনার অতীতের মতো সব জিনিস সবই কিন্তু সুন্দর।
হ্যাঁ এরাই সব আমার ছেলেমেয়ে। এদের মধ্যে কাউকে জন্মের প্রথম মাস থেকে পেয়েছিলাম। কয়েকজনকে বয়স্কা অবস্থায় আবার আমি যখন ভারতবর্ষে গিয়েছিলাম তখন কয়েকজনকে পাই। ওই মেয়েটি মিস মোওয়া। ও খুব সুন্দর ছিল। ওর দু-দুবার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়। প্রথম বিয়ের পর স্বামীর সাথে এ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধা হচ্ছিল তাই বিচ্ছেদ হয়। দ্বিতীয়বার বিয়ে করে, একজন পপ গায়ককে। সেই বিয়েও ওর বেশি দিন টিকল না। আবার কালিফোর্নিয়ায় বিয়ে করেছিল। বছর দু-তিন আগে মেয়েটি মারা যায় মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে।
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আপনি ঘুরে বেরিয়েছেন যেমন ভারত, হংকং, ইজিপ্ট এবং দক্ষিণ আমেরিকা। তাই না? মিসেস অলিভার বললেন।
হ্যাঁ বলতে পারো বিদেশ ভ্রমণে আমার ভালো অভিজ্ঞতা আছে।
মিসেস অলিভার বললেন, আমি যখন মালয়েতে ছিলাম, তখন আপনি না একজন সৈনিক পরিবারের সঙ্গে ছিলেন? নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না জেনারেল এবং লেডি র্যাভেন্সক্রফট তাই কি?
না, না, নামটা তুমি ভুল বলছ। বারনেবিদের সঙ্গে যখন ছিলাম তুমি তখনকার কথা ভাবছ। তুমি তখন ট্যুরে ছিলে এবং ফিরে এসে বারনেবিদের সঙ্গে ছিলে। তুমি ওই মহিলার পুরোনো বন্ধু ছিলে। এবং তার স্বামী ছিলেন বিচারপতি।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ। নামগুলো কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। মনে রাখা খুব কষ্টকর। বললেন মিসেস অলিভার।
ম্যাচাম বললেন, ওঁদের দুটি ছেলেমেয়ে ছিল। ছেলেটি পড়তে যায় হ্যাঁরোয়ে এবং মেয়েটি যায় রোডিনে। সেইজন্য আমি অন্য আর এক পরিবারের কাছে চলে গিয়েছিলাম। ভালো কথা তুমি যেন কাদের কথা বলছিলে? র্যাভেন্সক্রফটদের কথা? হ্যাঁ তাদের কথা খুব ভালো মনে আছে। এখন তারা সেখানে বাস করছেন জায়গাটার নাম ঠিক মনে আসছে না। আমাদের কাছ থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। ওই পরিবারটি প্রত্যেকের খুব পরিচিত ছিল। যদিও অনেক দিন আগের কথা তবুও আমি সব মনে করতে পারি। বারনেবিদের ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যেত তখন মিসেস বারনেবিদের দেখাশুনা করার জন্য সেখানে থাকতাম। আর হ্যাঁ আমি যখন ওখানে ছিলাম তখনই সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটেছিল, আমি র্যাভেন্সক্রফটদের কথা বলতে চাইছি। সে কথা আমি ভুলতেই পারব না এবং সে ব্যাপারে আমি নিজেকে জড়াতেও চাই না।
মিসেস অলিভার বললেন, আমারও তো একই ধারণা। আপনি ইংলন্ডে ফিরে যাওয়ার পর বেশ অনেক বছর কেটে গেছে। তারা চমৎকার দম্পতি ছিলেন এবং তাদের কাছে এটা একটা বিরাট আঘাত ছিল। সত্যি এখন আর আমার কিছুই মনে নেই। বললেন মিসেস অলিভার।
আমি জানি। কেউ কেউ আছে যারা সব ভুলে যায় কিন্তু আমি ভুলিনি একদম। তারা আলোচনা করছিল যে, ভদ্রমহিলা যেন কেমন অদ্ভুত ধরনের ছিলেন। যেমন পেরামবুলেটার থেকে একটা পিণ্ডকে উঠিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন এটা নাকি ঈর্ষা। আবার কেউ বলেছিল সেই পিণ্ডটিকে স্বর্গে পাঠাতে চেয়েছিলেন। অপেক্ষা করতে, চাননি।
আপনি কি লেডি র্যাভেন্সক্রফট-এর কথা বলছেন?
না, আমি তা বলতে চাইছি না। আমি বোনের কথা বলতে চাইছি।
কার বোনের কথা বলতে চাইছেন?
এখন আমি ঠিক জানি না। সে জেনারেলের বোন না লেডি র্যাভেন্সক্রফট-এর বোন, তারা বলেছিল মেয়েটি নাকি দীর্ঘদিন পাগলা গারদে ছিল, তখন তার বয়স এগারো কি বারো। তারপর সেখান থেকে ভালো হয়ে ফিরে এসে কোনো এক সৈনিককে বিয়ে করেছিল। এবং এখান থেকেই গণ্ডোগোলের সূত্রপাত। আবার তাকে নির্জন মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানো হয়েছিল। আমার বিশ্বাস জেনারেল এবং তার স্ত্রী সেখানে গিয়ে তাকে দেখে আসত। ছেলেমেয়ের দেখাশুনা করার ভার অন্য কেউ নিয়েছিল। তারা বলেছিল শেষের দিকে নাকি সে ভালো হয়ে উঠেছিল। এবং স্বামীর কাছে থাকবার জন্য ফিরে আসে। তার অল্প কয়েকদিন বাদে সে মারা যায় বা ওই রকম কিছু একটা হবে। যে কারণেই হোক সে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং স্বামীর ঘর ছেড়ে ভাই কিংবা বোনের কাছে চলে এসেছিল। যেখানেই সে থাকুক সে তার ছেলেমেয়েদের কাছে পেত। একদিন বিকেলে ছেলেটি তখন স্কুলে। সেই ছোট্ট মেয়েটি এবং আর একটি বাচ্চা মেয়ে এক সঙ্গে খেলা করছিল। অনেকদিন আগেকার কথা। সব খবর আজ আর মনে নেই। তবে শোনা গিয়েছিল সেটি আদৌ তার ছিল না, তারা ভেবেছিল আম্মা যেহেতু তাদের ভালোবাসত তাই সেটা আম্মার কাজ। সেই জন্য সে খুব ভেঙ্গে পড়ে এবং তাদের সেখান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কারণ সেখানে তারা নিরাপদে ছিল না। অন্যেরা কিন্তু তা বিশ্বাস করত না। এমন কি তাদের ধারণা সেটা তাদের কেন্দ্র করেই ঘটেছিল। যাইহোক তার নাম আমি এখন আর মনে করতে পারছি না।
ঘটনাটা হল এইরকম।
জেনারেল বা লেডি র্যাভেন্সক্রফট-এর যেই হোক তার জীবনে কী ঘটনা ঘটেছিল জানেন?
আমার বিশ্বাস সেই একই জায়গায় সেটা হবে একেবারে শেষের দিকে কোনো চিকিৎসক তাকে সঙ্গে করে ইংলন্ডে ফিরে যায়। তবে আমার মনে হয় তার স্বামীর অনেক টাকা ছিল। হয়তো আবার সে সুস্থ হয়ে উঠবে এই আশায় কোনো এক জায়গায় তার দেখাশোনা ভালোই হত। আমি অন্তত বলতে পারি বহুদিন এই বিষয়ে আর ভাবিনি, আমি বলতে পারব না তারা এখন কোথায়, কিংবা অনেকদিন আগেই তারা–মিসেস অলিভার বললেন, এটা খুব দুঃখের কথা হয়তো আপনি খবরের কাগজে পড়ে থাকবেন
ইংল্যান্ডে তাদের একটা বাড়ি কেনার কথা এবং তারপর
হ্যাঁ হ্যাঁ খবরের কাগজে সে রকম একটা ঘটনা যেন পড়েছিলাম, র্যাভেন্সক্রফটের কথাটা এখন যেন ঠিক মনে করতে পারছি না। কখন এবং কেমন করে তারা পাহাড়ের ওপরে উঠে ছিল। তারপর তারা যেন–? কিছু একটা হবে। হা সেরকম কিছু একটা হবে বললেন মিসেস অলিভার।
তোমাকে দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, এখন এক কাপ চা না খাওয়ালেই নয়।
না, না আমি চা খাব না, মিসেস অলিভার বললেন।
আমার সাথে এখন রান্নাঘরে এসো। কারণ দিনের বেশি সময় ওখানেই কাটাই। আমি অতিথিদের এঘরেই আপ্যায়ন করে থাকি। কারণ হল আমার সংগ্রহ অতিথিদের দেখালে আমি মনে মনে খুব গর্ববোধ করি যেমন গর্ববোধ করি সব ছেলেমেয়েদের এবং অন্যদের সম্বন্ধে।
আমার ধারণা আপনি যে সব ছেলেমেয়েদের প্রতি নজর রাখতেন তাদের সঙ্গে আপনার জীবন বেশ ভালোভাবেই কেটেছিল। মিসেস অলিভার বললেন।
হ্যাঁ, তুমি খুব গল্প শুনতে ভালোবাসতে তাই তোমায় ছোটোবেলায় আমি বাঘের, বাঁদরের গল্প বলতাম, মিসেস অলিভার, সে তো অনেক দিন আগের কথা, সেসব গল্প আমার খুব মনে আছে।
এই গল্পের আলোচনা করতে করতে তার মন চলে গেল সেই ছয় কিংবা সাত বছরের শৈশবের দিনগুলিতে। তার মনে পড়ল তিনি বোতাম আঁটা জুতো পড়ে ইংল্যান্ডের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মিসেস ম্যাচামের কাছ থেকে একটার পর একটা গল্প শুনতেন ভারত এবং ইজিপ্ট সম্বন্ধে।
মিসেস অলিভার চারিদিক তাকিয়ে দেখলেন স্কুলের ছেলেমেয়েদের, শিশুদের এবং মাঝবয়সি লোকেদের ছবি আটকানো। সম্ভবত তারা তাদের আয়াকে হয়তো ভুলতে পারেনি। হঠাৎই মিসেস অলিভার চিৎকার করে রান্নাঘর পর্যন্ত গেলেন এবং তিনি যে জিনিসটা তার জন্য এনেছেন সেটা তার হাতে দিলেন।
জিনিসটা হাতে নিয়ে তিনি আনন্দে বলে উঠলেন, এটা তো টোফোল থাথামোর টয়ের টিন। এখন এ চা খুবই কম পাওয়া যায়। দেখছি তুমি কখনও কিছু ভোলো না। আরে যে ছেলে দুটো খেলতে আসত তাদের তোমার মনে আছে হয়তো, তারা তোমাকে কি বলে ডাকত জানো? একজন বলত লেডি হস্তি এবং অপর জন বলত লেডি হংসী। যে লেডি হস্তি বলত সে তোমার পিছনে বসত এবং তুমি মেঝের ওপর ঘুরে ঘুরে তাদের কাছে গিয়ে তাদের তোলার ভান করতে।
মিসেস অলিভার বললেন, দেখছি আপনি প্রায় কিছুই ভোলেননি?
মিসেস ম্যাচাম বললেন, তুমি হয়তো জানো একটা পুরন প্রবাদ হাতিরা কখনও ভোলে না।
.
কাজ করে চলেন মিসেস অলিভার
উইলিয়ামস এ্যান্ড বারনেট বলে একটা কেমিস্ট কাম কসমেটিকের দোকানে ঢুকলেন মিসেস অলিভার, নানাধরনের সেলস কাউন্টারের সামনে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা জায়গায় বেশ মোটাসোটা চেহারার একটা মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং কিছু লিপস্টিকের খোঁজ করলেন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে চিৎকার করে বললেন, তুমি মারলিন না?
হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন এবং সেও চিনতে পেরে বলে উঠল, আপনি তো মিসেস অলিভার? আপনি এখানে কেনাকাটা করতে এসেছেন শুনলে মেয়েরা উত্তেজিত হয়ে উঠবে।
মিসেস অলিভার বললে ওদের নোলো না
আচ্ছা অটোগ্রাফ চাইতে পারে এই মনে করে কি বলছেন আপনি?
আমি চাই সেরকম ওরা যেন কিছু না করে এবং বলো তুমি কেমন আছ?
মারলিন বলল, মোটামুটি চলে যাচ্ছে।
আমি কিন্তু জানতাম না যে তুমি এখানে কাজ করছা?
আমার মনে হয় অন্য জায়গার মতোই ভালো এটা। আপনার সাথে ওরা বেশ চমৎকার ব্যবহার করবে। আর হ্যাঁ আমি এখন ওই কসমেটিক কাউন্টারের ইনচার্জ।
তোমার মা এখন কেমন, নিশ্চয়ই ভালো আছেন?
মা যদি শুনতে পান যে, আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছে, খুবই আনন্দ পাবেন তিনি।
হাসপাতালের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে তিনি কি সেখানে ওই বাড়িতেই আছেন?
হ্যাঁ আমরা সেখানেই থাকি। তবে বাবা খুব ভালো নেই। এই সবে হাসপাতাল থেকে এসেছেন। মা ভালোই আছেন, আপনি কি এখানেই কোথাও থাকেন কাছাকাছি?
না, মিসেস অলিভার বললেন। আসলে কি জানো, আমার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম এখানে। ঘড়ির দিকে তিনি তাকালেন। পরে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মারলিন, তোমার মা কি এখন বাড়িতে আছেন? ওঁর সাথে একবার দেখা করে কিছু কথা বলতে চাই। কারণ অনেকদিন তো আর দেখা হয় না।
নিশ্চয়ই উনি খুব খুশি হবেন আপনাকে দেখে, মারলিন বলল। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগছে যে, এখন আপনার সাথে আমি যেতে পারব না বলে।
ঠিক আছে কোনো ব্যাপার নয়। আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে। মিসেস অলিভার বললেন, তোমার বাড়ির নম্বর, বা কোনো নাম আছে কি? আমার ঠিক মনে নেই।
মারলিন বলল, হ্যাঁ বাড়ির নাম আছে লরেন কটেজ।
দেখো তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো হল।
মিসেস অলিভার একটা লিপস্টিক কিনলেন এবং গাড়ি নিয়ে গ্যারেজ এবং হাসপাতাল পেরিয়ে একটা সরু রাস্তায় এলেন।
লরেন কটেজের সামনে গাড়ি রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন এবং দেখলেন, বয়স প্রায় পঞ্চাশ। ধূসর চুল রোগাটে একজন ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন এবং তাকে দেখেই চিনতে পারলেন। আরে আপনি মিসেস অলিভার না? কতদিন বাদে দেখা। প্রায় এক যুগ হবে তাই না?
হ্যাঁ সে অনেকদিন হবে।
আরে আসুন আসুন ভেতরে। একটু চা খেয়ে যান।
মিসেস অলিভার বললেন, একটু আগেই এক বন্ধুর সঙ্গে চা খেলাম। এবং সেখানে কেমিস্টের দোকানে কিছু কেনাকাটা করতে যেতেই সেখানে মারলিনকে দেখলাম।
–হ্যাঁ, খুব ভালো একটা চাকরি পেয়েছে।
আপনি কেমন আছেন মিসেস বাকল? আপনার সাথে যখন শেষ দেখা হয়েছিল তার থেকে এখন খুব একটা বেশি বয়স হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু।
না, চুল আমার ধূসর হয়ে গেছে আর ওজনও আমার খুব কমে গেছে?
বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে মিসেস অলিভার বললেন, আমার পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হল। আপনার মনে আছে কিনা জানি না মিসেস কারস্টেয়ার্স, মিসেস জুলিয়াকে।
নিশ্চয়ই মনে আছে। তিনি কেমন আছেন?
হ্যাঁ, তিনি ভালোই আছেন। তার সাথে কথা বলতে বলতে পুরোনো দিনের কিছু কথাবার্তা হল। কথা প্রসঙ্গে সেই বেদনাদায়ক ঘটনার কথাও উঠল আমি তখন আমেরিকায় ছিলাম। সেই ব্যাপারে আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। তবে লোকেরা বলত র্যাভেন্সক্রফট
হ্যাঁ, আমার বেশ ভালোই মনে আছে।
আচ্ছা মিসেস বাকল এক সময় আপনি না তাদের কাজ করছিলেন?
হ্যাঁ সাতদিনের মধ্যে তিনদিন সকালে ওঁদের বাড়িতে যেতাম। সত্যিকারের মিলিটারি লেডি বলতে যা বোঝা যায় তিনি তাই ছিলেন এবং ভদ্রলোকও খুবই ভদ্র ছিলেন।
সত্যিই সেই ঘটনাটা বড়োই বেদনাদায়ক।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।
আচ্ছা সেই সময় কি আপনি সেখানে কাজ করতেন?
সেই সময় আমি ওখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম কারণ ঠিক সেই সময়ে আমার এক বৃদ্ধা অন্ধ মাসিমা আমার বাড়িতে থাকতেন। ওঁকে দেখাশুনা করার পর আর বাড়তি সময় ছিল না যে, বাইরে কোথাও কাজ করার। তবে বলতে পারি সেই ঘটনার এক কী দুমাস আগে পর্যন্ত ওখানে আমি কাজ করেছিলাম।
আমি জেনেছি, মিসেস অলিভার বললেন, ওদের ধারণা এটা নাকি একটা আত্মহত্যার চুক্তি।
মিসেস বাকল বললেন, আমি নিশ্চিত ওঁরা কখনও একসঙ্গে আত্মহত্যা করতে পারে না। কারণ–ওঁরা যেভাবে মিলেমিশে থাকতেন, তাঁদের মধ্যে যেভাবে বোঝাঁপড়া ছিল তাতে এরকম অস্বাভাবিক কিছু ভাবাই যায় না। যদিও তারা সেখানে বেশি দিন ছিলেন না।
আমারও তা মনে হয় না, বললেন মিসেস অলিভার, বোরোন মাউমের কাছে ওঁরা যেন থাকতেন, আগে ইংল্যান্ডে এসে যেখানে বসবাস শুরু করেন ওঁরা তাই তো? হ্যাঁ কিন্তু ওঁরা দেখলেন যেখানে ওঁরা ছিলেন সেই জায়গাটা ইংল্যান্ড থেকে অনেক দূর। তাই তাঁরা চিপিং বারট্রামে চলে এলেন। তাদের বাড়িটা ছিল খুব সুন্দর এবং সেই বাড়িতে ছিল একটা সুন্দর বাগান।
ওঁদের বাড়িতে যখন আপনি শেষ কাজ করেন তখন কি ওঁদের স্বাস্থ্য ভালো ছিল?
জেনারেলের একটু হার্টের কষ্ট ছিল। মাঝখানে একবার স্ট্রোক হয়েছিল। ঘুরেফিরেই একটু বেশি চিন্তিত হয়ে পড়তেন। তাই এক এক সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতেন।
লেডি র্যাভেন্সক্রফট কেমন ছিলেন?
তবে আমার মনে হয় বিদেশের জীবনযাত্রা এখানে এসে তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। যদিও এখানে ওঁদের সমকক্ষ অনেক ভালো পরিবার ছিল। এখানে খুব বেশি লোকদের ওঁরা চিনতেন না। সেখানে ওঁদের অনেক চাকর ও জমকালো পার্টি ছিল।
আপনার কি মনে হয় সেইসব জমকালো পার্টি উনি হারিয়ে ফেলেছিলেন?
আমি ঠিক সেটা বলতে পারব না।
আমাকে একজন বলেছেন, আচ্ছা উনি কি পরচুল ব্যবহার করতেন?
মিসেস বাকল একটু মৃদু হাসলেন এবং বললেন, অনেক ধরনের পরচুল ছিল যা খুব মূল্যবান। সত্যিই সত্যিই সেইসব পরচুল পড়লে তাকে খুব স্মার্ট এবং আকর্ষণীয় মনে হত। শুধু তাই নয়, তিনি খুব দামি দামি পোশাকও পরতেন।
মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, সেই ঘটনার ব্যাপারে আপনার কী মত?
–আচ্ছা দেখুন সেই সময় আমি ছিলাম আমেরিকায়। ফিরে আসার পর আমার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তেমন দেখা হয়নি। আমি কাউকে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করিনি বা কাউকে চিঠি লিখে খোঁজও করিনি কারণ আমি সেটা চাইনি। সুতরাং এই ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। তবে আমার মনে হয় এই ঘটনার পেছনে কোনো কারণ থাকলেও থাকতে পারে। আমি যেটুকু জানতে পেরেছি যে এ-ক্ষেত্রে জেনারেল র্যাভেন্সক্রফট তার নিজস্ব রিভলবার ব্যবহার করেছিলেন। হ্যাঁ, তিনি বলতেন বাড়িতে দুটো রিভলবার না থাকলে নাকি কোনো নিরাপত্তাই থাকে না। হয়তো ওঁর কথাই ঠিক, একদিন বিকালবেলায় একটা বিশ্রী দেখতে লোক জেনারেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। যখন সে তরুণ ছিল তখন নাকি সে জেনারেলের রেজিমেন্টে ছিল। জেনারেলের সন্দেহ হওয়ায় তিনি কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু আমার ধারণা লোকটি সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। এবং তার আরও মনে হয়েছিল লোকটি একদম বিশ্বাসযোগ্য নয়। জেনারেল তাকে পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে বললেন।
আপনার কি মনে হয় বাইরের কোনো লোক একাজ করেছে?
হ্যাঁ, আমার মনে হওয়ার কারণ আর কোনো যুক্তিই নেই এরকম ঘটনা ঘটার জন্য। ওদের বাগান পরিচর্যা করত যে মালিটা আমি তাকে পছন্দ করতাম না। শোনা কথা তবে প্রথম জীবনে সে কয়েকবার জেল খেটেছিল নাকি। এতসব ঘটনা সত্ত্বেও জেনারেল তার বাগানে পরিচর্যার জন্য তাকে রেখেছিল।
তাহলে কি আপনি মনে করেন সেই মালিটাই ওঁদের হত্যা করেছিল?
হ্যাঁ, আমি এরকম ধারণার কথাই বলছি। কিন্তু আমার মনে হয় না যে, লোকেরা যখন ওঁদের সম্পর্কে কোনো স্ক্যান্ডাল বা নোংরা আলোচনা করে সবাই তখন বোকার মতো কথা বলে। সুতরাং আমি জোর দিয়ে বলছি এমন নিষ্ঠুর কাজ বাইরের কোনো লোক করে থাকবে। আজকের দিনের সংবাদপত্রের খবরগুলোর দিকে লক্ষ্য করুন শুধু শুধু অপরাধমূলক পরিবেশিত হয়। কোন কোন খবর? যেমন কোনো ছেলেরা প্রচুর ড্রাগ খাচ্ছে, কে বা কারা অকারণে নিরীহ লোককে গুলি করছে, কারা বন্য মনোভাব পোষণ করছে অথবা মেয়েদের অনুরোধ করছে বারে বসে তাঁদের সঙ্গে মদ খেতে এবং পরের দিন তারই মৃতদেহ ড্রেনে বা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কিংবা কাউকে শ্বাসরোধ করে মারা আজকাল নিয়মমাফিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ-ধরনের অপরাধ আজকাল যে কেউ করতে পারে। অথচ এক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায় জেনারেল এবং তার স্ত্রী সেদিন সন্ধ্যায় বেড়োতে বেরিয়েছিলেন এবং এঁদের দুজনকেই মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
গুলিটা কি ওদের মাথায় করা হয়েছিল?
আমি সন্দেহজনক তেমন কিছু দেখিনি আর এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে ওঁরা অন্য দিনের মতো সেদিনও বেড়োতে বেরিয়েছিলেন।
তবে ওঁদের দুজনের মধ্যে কি কোনো তিক্ততা ছিল?
ওহো এ-প্রসঙ্গে আমি ওদের বয়সের দিকটা আলোচনা করতে চাই। এই বিশেষ দিকটাকে কেন্দ্র করে অনেক কথা উঠবে। আদৌ কোনো কিছু ছিল না। আর পাঁচজন তো পাঁচ কান করবেই।
ওঁদের মধ্যে কেউ একজন হয়তো অসুস্থ ছিলেন। লেডি র্যাভেন্সক্রফট একবার কী দু-বার লন্ডনে গিয়েছিলেন। তবে আমার মনে হয় হয়তো কোনো কিছু অপারেশন করার জন্য তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তাঁর অসুখ কী যদিও তিনি কিছু বলেননি। আমার ধারণা ওরা ঠিক খবরই সংগ্রহ করেছিল যে, অল্প সময়ের জন্য তিনি হাসপাতালে ছিলেন। এবং উনি যখন ফিরে আসেন তখন দেখে মনে হচ্ছিল ওঁনার মুখের অনেক চিকিৎসা হয়েছে। কারণ ওঁনাকে তখন তরুণী বলে মনে হচ্ছিল এবং পরচুল পরলে খুব সুন্দর দেখাত। এক কথায় বলা যায় তিনি যেন নতুন জীবন লাভ করেছেন।
জেনারেল র্যাভেন্সক্রফট?
তিনি ছিলেন চমৎকার ভদ্রলোক। কোনো স্ক্যান্ডাল আমার কানে আসেনি ওঁর সম্পর্কে এবং আমি মনে করি না সেরকম কিছু ছিল। অথচ সেই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে তারা এ নিয়ে অনেক কথা বলতে শুরু করে। তাতে আমার একটা কথা মনে হয়েছে হয়তো মালয় কিংবা অন্য কোথাও জেনারেলের মাথায় আঘাত লেগে থাকবে। এরকম মনে করার কারণ হল আমার এক কাকা কিংবা জ্যাঠামশাই একসময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান এবং মাথায় আঘাত পান। ছ-মাস বাদে তিনি এমন বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন যে তাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। কারণ তিনি সব সময়ই তার স্ত্রীকে হত্যা করার কথা বলছিলেন এবং এও বলছিলেন তাঁর স্ত্রী নাকি তাকে নির্যাতন করছেন। আরও আশ্চর্য হবেন শুনলে তার স্ত্রী নাকি অন্য দেশের হয়ে গুপ্তচরগিরি করছেন। ভাবুন একবার, তাকে যদি মানসিক হাসপাতালে পাঠানো না হতো কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে পারত তাদের পরিবারে। ওঁদের দুজনকে ঘিরে যে সমস্ত কথা প্রচার হয়েছিল এবং আমি যা শুনেছি ওঁদের মধ্যে এর ফলে একটা খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয়। আর সেই কারণেই ওদের মধ্যে কেউ একজন অপরকে গুলি করে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিলেন। এ-ঘটনা আপনি সত্য বলে মনে করেন না তাই তো?
না, না, আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না। ওঁদের ছেলেমেয়েরা কি তখন বাড়িতে ছিল?
না, মেয়েটির নাম যেন কি রোজি না পেনেলোপ?
মিসেস অলিভার বললেন, আমার ধর্মকন্যা সেলিয়া।
ওহো হ্যাঁ, মনে পড়েছে। একবার ওকে নিয়ে আপনি যেন কোথায় বেড়োতে যান। ও দারুণ তেজস্বী ও সাহসী মেয়ে ছিল তবে একটু বদ মেজাজিও ছিল। তবু আমার মনে হয় মেয়েটি ওর বাবা মার খুব প্রিয় ছিল। ও তখন সুইজারল্যান্ডের স্কুলে ছিল। মানুষের মুখের কথা যে, দুর্ঘটনার সময় যদি ও বাড়িতে থাকত বাবামা-র অমন বীভৎস মৃতদেহ দেখলে ও খুব আঘাত পেত।
ওঁদের সেই ছেলেটি, সে কি তখন বাড়িতে ছিল না?
হ্যাঁ, ওকে দেখলে মনে হত যে, ও ওর বাবাকে পছন্দ করত না। ওর ব্যাপারে ওর বাবা খুবই চিন্তিত ছিলেন বলে আমার ধারণা।
ছেলেরা অমনি হয়ে থাকে। সেটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। আচ্ছা আপনার কি মনে হয় ছেলেটি ওর মার প্রতি অনুগত ছিলো?
ওর মা ছেলের ব্যাপারে বড়ো বেশি হইচই করতেন। এর জন্য বোধহয় ছেলেটিকে খুব বিরক্ত বলে মনে হত। আর কোনো ছেলেই চায় না তার মা তার ব্যাপারে ব্যস্ততা দেখাক। ছেলেটির চুলের স্টাইল তার বাবা পছন্দ করতেন না। আজকালকার ছেলেদের ফ্যাসন সম্পর্কে বাবা-মার আপত্তি করাটা ঠিক নয়। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কি বতে চাইছি।
কিন্তু সেই ঘটনা ঘটার সময় ছেলেটি তো তার বাড়িতে ছিল না তাই তো?
না।
আমার ধারণা হয়তো সে খুব আঘাত পেয়েছিল।
হ্যাঁ আঘাত পেতেই পারে। অবশ্য সে সময় আমি তার বাড়িতে যেতাম না, ফলে আমি বেশি কিছু জানি না। তবে আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করেন বাগানের সেই মালিটা যাকে আমি পছন্দ করতাম না, তার নাম ছিল ফ্রেড উইজেল, আমার মনে হয় সে এমন একটা অন্যায় কাজ করেছিল যার ফলে জেনারেল তাকে পদচ্যুত করতে চেয়েছিলেন এবং সেই কারণেই মনে হয়–
সে কি স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই গুলিবিদ্ধ করেছিল?
আমার মনে হয়েছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জেনারেলকে গুলি করে মারা। কিন্তু জেনারেলকে হত্যা করার পর যদি সে তার স্ত্রীকে ঘটনাস্থলে আসতে দেখে সাক্ষী মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে তাকেও সে গুলি করতে বাধ্য হবে। গল্প উপন্যাসে এরকম ঘটনা অনেক ঘটে থাকে এবং আপনি হয়তো পড়েও থাকবেন।
মিসেস অলিভার চিন্তিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ গল্প উপন্যাসে এরকম ঘটনার কথা সবাই পড়ে থাকে।
সেখানে একজন শিক্ষক ছিলেন আপনি হয়তো জানেন না। আমি তাকেও ঠিক পছন্দ করতাম না।
শিক্ষক! সে আবার কী রকম?
আগে ছেলেটি যখন গ্রেপ স্কুলে পড়ত সে পরীক্ষায় কিছুতেই পাশ করতে পারত না। তাই ওঁরা ছেলের জন্য একজন শিক্ষক রেখেছিলেন। লেডি র্যাভেন্সক্রফট তাকে খুব পছন্দ করতেন। আপনি জানেন নিশ্চয়ই লেডি র্যাভেন্সক্রফট গান জানতেন এবং সেই শিক্ষকটিও গান জানতেন। যুবকটির খুব অভিমান ছিল। আমার মনে হচ্ছে তার নাম ছিল মিঃ এডমন্ড। যতদূর মনে হয় জেনারেল তাকে খুব বেশি পাত্তা দিতেন না।
জেনারেল না দিলেও লেডি র্যাভেন্সক্রফট তো দিতেন।
নিশ্চয়ই তা তিনি করবেন। আমার ধারণা ওঁদের দুজনের মধ্যে খুব মিল ছিল। এবং জেনারেলের থেকেও তিনি তাকে বেশি ভালোবাসতেন। কারণ যুবকটির আদব কায়দা ছিল চমৎকার। সুন্দর কথা বলতে পারত। এবং যা করার সবই যে–সেই করত, হা কী যেন তার নাম ছিল? এডওয়াড? আমার মনে হয় নায়কোচিত ধ্যান ধারণা ওঁদের সম্পর্কে কোনো স্ক্যান্ডাল বা খোশগল্প কিছু শুনে থাকলে একদম বিশ্বাস করবেন না। লেডি র্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গে কোনো পুরুষের বা জেনারেলের সঙ্গে ফাইলিং ক্লার্কের মধ্যে সেরকম কিছু কানে এলে একদম আমল দেবেন না। সেই ভয়ঙ্কর বদমাশ খুনি আর যেই হোক না কেন সে অবশ্যই বাইরের কেউ। পুলিশ কিন্তু কারোরই সন্ধান পায়নি যার ভিত্তিতে আটক করা যেতে পারে। সেখানে শুধু একটা গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল তবে সেটা কোনো কাজে লাগেনি। আমার মনে হয় মালয় অথবা বিদেশের কোথাও কিংবা ইংল্যান্ডের রোম সাউথে যদি একটু খোঁজ নেওয়া যায় একটু ক্ল অন্তত খুঁজে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সেখানে গেলে সে খুনির সন্ধান পাওয়া যাবে না এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না।
মিসেস অলিভার প্রশ্ন করলেন, এ ব্যাপারে কি মত আপনার? কিন্তু আপনি ওঁদের সম্বন্ধে যতটা জানেন ঠিক ততটা ওঁর জানা নেই। অবশ্য তিনি নিশ্চয়ই কিছু শুনে থাকলে থাকতে পারেন। হা নানান লোকের ধারণার কথা উনি শুনেছিলেন। যেমন লেডি র্যাভেন্সক্রফট নাকি মাত্রাতিরিক্ত মদ খেতেন এবং মাতাল হয়ে পড়তেন। মদের খালি পেটি পাওয়া যায় নাকি তাদের বাড়ি থেকে। আমি ওঁকে খুব ভালো করেই জানতাম। সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস এসব একেবারেই অসত্য। ওদের এক ভাইপো ওদের সঙ্গে দেখা করতে আসত মাঝে মাঝে। সে নাকি কোনো এক মামলায় পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল।
পুলিশের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল ঠিকই কিন্তু আমার মনে হয় না এর সাথে সেই ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে। কারণ পুলিশই তাকে কোনোরকম সন্দেহ করেনি।
জেনারেল ও লেডি র্যাভেন্সক্রফট ছাড়া আর কেউ কি ওদের বাড়িতে থাকত?
হ্যাঁ কখনও কখনও লেডি র্যাভেন্সক্রফটের এক বোন তাঁদের বাড়িতে এসে থাকত। সে এঁদের মধ্যে একটা গণ্ডগোলের সৃষ্টি করেছিল আর ও আসলেই আমার আতঙ্কের সৃষ্টি হত কারণ কী জানি আবার কী ঝামেলা বাঁধাবে।
লেডি র্যাভেন্সফুটের সে প্রিয় ছিল?
আমার ধারণা না। মেয়েটি তাদের বাড়িতে আসার চেষ্টা করত। কিন্তু লেডি র্যাভেন্সক্রফট চাইতেন না যে, তার বোন এসে তাদের মধ্যে গণ্ডগোলের সৃষ্টি করুক। আবার জেনারেল কিন্তু তাকে খুব পছন্দ করত কারণ সে তাস দাবা খুব ভালো খেলতে পারত। ও খুব আমুদে মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল মিসেস জেরিবয় বা ওই ধরনের কিছু। আমার অনুমান সে ছিল বিধবা এবং আমার আরও মনে হয় হয়তো মেয়েটি তাদের কাছ থেকে টাকা ধার করতে আসত।
আপনি কি তাকে পছন্দ করতেন?
আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমি বলব তাকে আমি মোটেই পছন্দ করতাম না। কারণ কী জানেন, সব গণ্ডগোলের মূলে ছিল সে, তবে সেই ঘটনা ঘটার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সে আসছিল না। তার একটা ছেলে ছিল, এক কী দু-বার তার ছেলে এসেছিল, সে তার ছেলেকে খুব একটা পছন্দ করত না। আমার মনে হয় এটাও তার একটা চালাকি।
মিসেস অলিভার বললেন, আমার মনে হয় কখনই কেউ এর সত্য উদঘাটন করতে পারবে না। এখনও নয় এবং পরেও নয়। কারণ আমি আমার ধর্মকন্যাকে সেদিন দেখলাম।
আচ্ছা ম্যাডাম, আমি জিজ্ঞেস করছি আপনি কি তাকে সম্প্রতি দেখেছেন? তার সম্পর্কে আমার জানার খুব কৌতূহল। সে এখন কেমন আছে? নিশ্চয়ই ভালো?
হ্যাঁ, তাকে দেখে আমার মনে হয়েছে সে খুবই ভালো আছে। সে তার বিয়ের জন্য চিন্তা করছে, যেভাবেই হোক সে পেয়েছে–
মিসেস বাকল জিজ্ঞেস করলেন, কি পেয়েছে বয়ফ্রেণ্ড পেয়েছে? আমরা তো সবাই সেটা পেয়েছি। তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে আমাদের সবাইকে প্রথম প্রেম মেনে নিয়ে বিয়েটা ঠিক করতে হবে। আপনি যদি আপনার ইচ্ছাটাকে কাজে না লাগান দশবারের মধ্যে ন-বার–
মিসেস বারটন কক্সকে কি আপনি জানেন? প্রশ্ন করলেন মিসেস অলিভার।
বারটন কক্স। মনে হচ্ছে আমি নামটা যেন কোথাও শুনেছি। তাদের সঙ্গে অথবা অন্য কারোর সঙ্গে তিনি কি থাকতে এসেছিলেন? তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে তাদের আমি মনে রেখেছি। তবে হ্যাঁ আমি কিছু কিছু শুনেছিলাম। আমার ধারণা জেনারেল র্যাভেন্সক্রফটের পরিচিত কোনো গৃহকর্ত্রী। তবুও আমি আরও কিছু খবর আশা করছি।
আচ্ছা আপনার সাথে আর আমি গল্প করব না। আপনাকে এবং মারলিনকে দেখে খুব আনন্দ হল বললেন মিসেস অলিভার।
.
হাতি গবেষণার ফলাফল
এরকুল পোয়ারোর পুরুষ পরিচারক জর্জ বলল-মিসেস অলিভারের কাছ থেকে আপনার একটা ফোন এসেছিল।
হ্যাঁ জর্জ, তিনি কী বললেন?
তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, আজ রাতে ডিনারের পর আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন কিনা?
পোয়ারো বললেন, চমৎকার, খুব ভালো হয় কারণ আজকের দিনটা বড়ো ক্লান্তিকর। তাকে দেখলেই আমার একটা উত্তেজক অভিজ্ঞতা হয়। তিনি এমন সব কথা বলেন যা সত্যিই অভাবনীয়। আচ্ছা হাতির কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন?
এ্যাঁ, কি বললেন স্যার, হাতি? না তিনি কিছুই বলেননি। আমার মনে হচ্ছে হাতিরা তাকে নিরাশ করেছে। এক এক সময় পোয়ারোর কথা সে ঠিক বুঝতে পারে না তাই সে সন্দেহের চোখে তার প্রভুর দিকে তাকাল। পোয়ারো বললেন, ওঁকে ফোন করো এবং বলল ওঁনাকে আমি অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।
তার কথামতো জর্জ ফোন করতে গেল এবং অল্পক্ষণ পরেই এসে জানাল পৌনে নটার সময় মিসেস অলিভার এখানে আসবেন।
পোয়ারো বললেন, কফির ব্যবস্থা করে রাখো।
না, আমার মনে হয় তার দরকার হবে না। আমার নির্দিষ্ট ব্ৰাণ্ডই যথেষ্ট।
আচ্ছা স্যার, বলে চলে গেল।
ঠিক নটার সময় মিসেস অলিভার তাঁর বাড়িতে এলেন এবং পোয়ারো তাকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন।
ম্যাডাম, কেমন আছেন?
আমি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছি–মিসেস অলিভার বললেন।
চেয়ারে তার ক্লান্ত দেহটা নিয়ে বসে পড়লেন।
সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষিত, আপনার কথাটার অর্থ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ম্যাডাম।
আমি সেটা মনে করতে পারি কারণ ছেলেবেলায় আমি সেটা শিখেছিলাম। মিসেস অলিভার বললেন।
আমি নিশ্চিত। কিন্তু আপনি যার সন্ধান করছেন তার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। আমি হাতির সন্ধানের কথা বলছি। সেটা যদি না কথার কথা হয়ে থাকে।
মিসেস অলিভার বললেন, আদৌ তা নয়। আমি পাগলের মতো হাতির সন্ধান করে চলেছি। যেমন যত পরিমাণ পেট্রল ব্যবহার করেছি বা যে পরিমাণ ট্রেন ভাড়া খরচ করেছি অথবা যত চিঠি এবং তার বার্তা পাঠিয়েছি আপনি কল্পনাই করতে পারবেন না। আর এসব করতে গিয়ে আমি একেবারে নিঃশেষ হয়ে পড়েছি।
তাহলে বরং আপনি একটু কফি খেয়ে বিশ্রাম নিন।
হ্যাঁ সুন্দর করে কড়া কফি আমি ভাবছিলাম।
আপনি কি কোনো ফল পেলেন?
মিসেস অলিভার বললেন, ফলাফল প্রচুর। কিন্তু কি জানেন, কোনটা কার্যকর হবে কিছুই জানি না।
ঘটনাটা তো আপনি জেনেছেন?
না, লোকেরা যা বলছে আমি সেইটুকুই ঘটনা বলে জেনেছি। কিন্তু আমার মনে সন্দেহ জাগছে এতগুলো ঘটনার মধ্যে একটাও সত্য ঘটনা আছে কিনা!
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন সেগুলি সবই লোকের মুখের কথা?
না, আমি যা বলেছি তা সবই স্মৃতি। এই স্মৃতিগুলো অনেক লোকের মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। কিন্তু যেই সেগুলো মনে করার চেষ্টা করবেন কিছুতেই আপনি ঠিক ঠিক মনে করতে পারবেন না। কি পারবেন আপনি?
না। আপনি যেগুলো ফলাফল, হিসাবে বর্ণনা করবেন তাই নয় কি?
মিসেস অলিভার প্রশ্ন করলেন আপনি কি করলেন?
পোয়ারো বললেন, আপনি এত কঠোর যে ম্যাডাম আপনার দাবি অনুযায়ী আমি সবসময় কাজ করে যাচ্ছি।
বেশ, তাহলে বলুন আপনিও কাজের পিছনে ছুটছেন।
আমি নিজে ছুটছি না, আমার নিজস্ব পেশার কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করেছি।
আপনার কাজ শুনে মনে হচ্ছে আমার থেকে অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ। বাঃ, আপনার কফি সত্যিই খুব কড়া হয়েছে। আমি যে কি পরিমাণ ক্লান্ত আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না।
আপনাকে দেখে আমার অনুমান আপনি কিছু একটা পেয়েছেন।
আমি প্রচুর লোকের কাহিনি এবং লোকের পরামর্শ পেয়েছি। বুঝতে পারছি না সেগুলোর মধ্যে একটাও সত্যি কাহিনি আছে কিনা।
পোয়ারো বললেন, হয়তো সেগুলোর মধ্যে কোনো সত্য ঘটনা নেই তবু সেগুলো কোনো না কোনো সময় কাজে লাগতে পারে।
মিসেস অলিভার বললেন, আপনি কী বলতে চাইছেন তা আমি জানি আর সত্যি কথা বলতে আমিও সেটা মনে করি। লোকেরা যখন কিছু মনে করার চেষ্টা করে এবং সে ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলে আমার মনে হয় সেগুলো কখনও ঘটেনি। তারা নিজেরা যা ভেবে রেখেছে সেটাই ঘটেছে।
পোয়ারো বললেন, কোনো তথ্য ছাড়া কোনো অনুমান গড়ে ওঠে না।
মিসেস অলিভার বললেন, এই ধরনের তালিকা আপনার জন্য আমি এনেছি। আর শুনুন আমি কোথায় গিয়েছিলাম, এবং কী জিজ্ঞেস করেছিলাম কিনা এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা চাইবেন না। আমার এই অভিযানের উপলব্ধি হল সাধারণত এদেশে কেউ চাইলেও তার মনের মতো খবর সংগ্রহ করতে পারে না; কিন্তু আমি সব জেনেছি। এমন কিছু লোকের কাছ থেকে যারা নাকি র্যাভেন্সক্রফটদের সম্পর্কে কিছু না কিছু খবরা-খবর রাখে।
আপনি কি বোঝাতে চাইছেন বিদেশের খবরের কথা?
হ্যাঁ বেশ কিছু খবর আছে বিদেশের। কারণ এখানে তাদের সামান্য তোক চিনত। আর এমন সব লোকের মুখের খবর যারা তাদের মাসিমা, কাকিমা অথবা বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছিল অনেকদিন আগে।
আপনার প্রত্যেকটি লিপিবদ্ধ করা তথ্য, সেই ঘটনার উল্লেখ এবং কিছু ব্যক্তির নাম সংগ্রহ সবই তো এই কেসের সঙ্গে জড়িত তাই না?
মিসেস অলিভার বললেন, এই রকমই একটা ধারণা, তা আপনাকে সংক্ষেপে বলব।
তাহলে শুনুন যে মতামতগুলো আমি সংগ্রহ করেছি। তাদের শুরু হল যেমন কিরকম দুঃখের খবর এটা, পুরো কাহিনিটাই, বা অবশ্যই আমার মনে হয়, প্রত্যেকেই জানেন, প্রকৃত ঘটনা কি ঘটেছিল কিংবা ওহো হ্যাঁ অবশ্যই প্রভৃতি সব কথাবার্তা। হা হা আপনি বলে যান আর আমি সব শুনছি, এইসব লোকেরা জানে সেদিন কী ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু আশ্চর্য লাগে তাদের ধারণার সমর্থনে তেমন কোনো অকাট্য যুক্তি নেই। যেমন কেউ তাদের বলেছে অথবা তারা তাদের বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে শুনেছে। তাদের মতামতগুলো আপনিও যা ভেবেছেন সেইরকম কিছু মনে করা যাক। জেনারেল তার মালয়ের স্মৃতিকথা যখন লিখেছিলেন তাকে লেখার কাজে সাহায্য করেছিলেন তার একজন যুবতী সেক্রেটারি। মেয়েটি দেখতে সুন্দর ছিল এবং তাদের দুজনের মধ্যে কিছু যে একটা সম্পর্ক ছিল তাতে কোনো দ্বিমত নেই। এই সম্পর্কের পরিণাম দু-রকমের হতে পারে। যেমন মেয়েটিকে তিনি বিয়ে করার আশা করেছিলেন তাই তিনি তার স্ত্রীকে গুলি করে থাকতে পারেন অথবা তার স্ত্রীকে গুলি করার পর মুহূর্তে ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয় যার ফলে তিনি নিজেই নিজেকে গুলি করেন….
পোয়ারো বললেন, ঠিক তাই। এটা একটা রোমান্টিক ব্যাখ্যা। আরেকটা ধারণা হল তাদের ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ছ-মাস স্কুলে ক্লাস করতে পারেনি। পরীক্ষায় তাকে তৈরি করানোর জন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। সে ছিল বয়সে তরুণ এবং সুপুরুষ। আচ্ছা দেখছি তাহলে সবই মিলে গেল। সেই যুবকটির প্রেমে পড়ে যান লেডি র্যাভেন্সক্রফট। হয়তো তার সঙ্গে নিবিড়ো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকবে।
মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ সেই রকমই একটা ধারণা হয়েছিল, এক্ষেত্রেও কোনো প্রমাণ নেই। আবার সেই রোমান্টিক ধারণা।
সুতরাং তাহলে?
সুতরাং আমার ধারণা সম্ভবত তার স্ত্রীকে জেনারেল আগে গুলি করেছিলেন এবং তারপর তীব্র আতঙ্কে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিলেন। অথবা তাঁর স্ত্রী সেই মেয়েটির সঙ্গে তার স্বামীর গোপন সম্পর্কের কথা জেনে থাকবেন, সেই ঘৃণায় তিনি তাঁর স্বামীকে গুলি করে নিজেই নিজেকে গুলিবিদ্ধ করেন। কিংবা সব সময় এরকম একটা কাহিনি প্রচার হয়ে থাকে যেমন মেয়েটির সঙ্গে জেনারেলের কোনো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকবে অথবা অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে জেনারেলের কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকবে বা কোনো এক বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকবে। অপর দিকে এও হতে পারে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে তার স্ত্রীর কোনো অবৈধ সম্পর্ক থাকতে পারে। এই সমস্ত কাহিনি সামান্য তফাত থাকলেও মূল বিষয়বস্তু প্রায় এক। এইসব কাহিনির সাক্ষ্য প্রমাণ কিছুই নেই। বারো বা তেরো বছর আগে যে কাহিনির সূচনা তা এখন লোকেরা প্রায় ভুলেই গেছে বলতে পারা যায়। কিন্তু আশ্চর্য লাগে কাউকে কয়েকটা নাম সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে লোকের মুখে শোনা খবরই দেয় অথচ প্রকৃত তথ্য তারা জানে না। আর সে কাহিনি যে ভুল হতেই পারে তা তাদের জানা নেই। বাগানের পরিচর্যার জন্য একজন মালি ছিল। একজন বয়স্ক কুক-হাউসকিপার ছিল। যে নাকি অন্ধ ও বোবা ছিল। অথচ সেই ঘটনার সঙ্গে মেয়েটি যে জড়িয়ে থাকতে পারে এদের দুজনের মধ্যে কোনো সন্দেহ জেগে ওঠেনি। আমি নামগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছি। সেখানে কতকগুলো নাম ভুল আবার কতকগুলো নাম ঠিকও হতে পারে। এবং সেটা নির্ধারণ করা খুব কঠিন ব্যাপার। আমি আরও জেনেছি, একসময় তার স্ত্রী এমন কঠিন ধরনের অসুখে পড়েন যাতে তার চুল সব উঠে গিয়েছিল এবং সেই কারণেই তিনি চার চারটে পরচুল কিনেছিলেন।
পোয়ারো বললেন, ঠিক বলেছেন আমিও সেই একই রকম শুনেছিলাম।
এখবর আপনি কোথা থেকে শুনলেন?
আমার এক বন্ধু পুলিশে কাজ করে। সেই ঘটনার সময় পুলিশি তদন্ত হয়। এবং তদন্ত করতে গিয়ে ওদের বাড়ি থেকে যে সব জিনিস পাওয়া যায় তার একটা তালিকা পুলিশ সংগ্রহ করেছিল। আমার সেই পুলিশ বন্ধুটি আমাকে সেই তালিকা দেখায় এবং তাতে দেখি চারটে পরচুলের কথা লেখা আছে। আচ্ছা ম্যাডাম, আমি আপনার মত এই ব্যাপারে জানতে চাই।
সত্যিই আমি এটা বেশি বলে মনে করি, মিসেস অলিভার বললেন। তিনি আরও বললেন, আমার এক কাকির একটা পরচুল ছিল, আর একটা বাড়তি পরচুল ছিল। একটা পরচুল ফেরত পাঠান আমার কাকি নতুন করে সংস্কার করার জন্য। এবং দ্বিতীয়টি তিনি ব্যবহার করতে থাকেন। চারটে পরচুল কারোর থাকতে পারে আমি কখনও আগে শুনিনি। মিসেস অলিভার তার ব্যাগ থেকে একটা ছোটো নোটবুক বার করলেন এবং তার পাতা ওলটালেন বিশেষ প্রতিলিপি খোঁজ করার জন্য।
মিসেস কারস্টেয়ার্স, বয়স সাতাত্তর, একটু ভীমরতিগ্রস্ত। তার মুখের কথাই এখানে লিখে রেখেছি। র্যাভেন্সক্রফটদের আমি ভালো করেই জানতাম। তারা চমৎকার দম্পতি। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম ওঁদের দুজনের মধ্যে কার ক্যান্সার হয়েছিল? কিন্তু মিসেস কারস্টেয়ার্স ঠিক মনে করতে পারলেন না কার যে ক্যান্সার হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, তার ধারণা লেডি র্যাভেন্সক্রফট লন্ডনে এসেছিলেন চিকিৎসকদের কাছ থেকে পরামর্শ করার জন্য এবং সম্ভবত একটা অপারেশনও করে থাকবেন তিনি। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এলে তার স্বামী খুব মুষড়ে পড়েন। অতএব এর থেকে মনে করে নেওয়া যেতে পারে তিনি প্রথমে তার স্ত্রীকে গুলি করেন। পরে নিজেকে…।
এ-ব্যাপারে তিনি কি নির্দিষ্ট করে কিছু জানতেন, না সম্পূর্ণ তার ধারণা?
আমার মনে হয় পুরোপুরি এটা একটা ধারণা। মিসেস অলিভার বললেন, আমার তদন্তের সময় যা শেষ শুনেছি তা হল, যখন কেউ শোনে তার কোনো এক বন্ধু যাকে সে ভালো চেনে না, অসুস্থ হওয়ায় চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করছে, তখন সে ধরে নেয় তার সেই বন্ধুরই ক্যান্সার হয়েছে। কেউ একজন নামটা ঠিক পড়তে পারছি না, তার মনে হয় নামটা টি দিয়ে শুরু, সেই মহিলাটি বলেছিল স্বামীরই ক্যান্সার হয়েছে। ভদ্রলোক সেইজন্য খুব অসুখী ছিলেন। এই অসুখের কথা চিন্তা করেই হয়তো তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করেন আত্মহত্যা করবেন।
পোয়ারো বললেন, দেখুন ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক আবার রোমান্টিক।
আমি এটা সত্য বলে মনে করি না। মিসেস অলিভার বললেন। আর এটা চিন্তার ব্যাপার তাই না? সত্যিই লোকেরা কেমন মনগড়া গল্প করতে পারে।
পোয়ারো বললেন, তারা যতটুকু কাহিনি জানে ততটুকু সমাধান করে ফেলে। যেমন কতগুলো লোক জানে কেউ একজন আসছে লন্ডনে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য। আবার কেউ দু-তিন মাস হয়তো হাসপাতালে রয়েছে।
মিসেস অলিভার বললেন, দীর্ঘদিন বাদে তারা যখন এ ব্যাপারে কথা বলে, এমন ভাব দেখায় যেন তারা সমাধান খুঁজে পেয়ে গেছে। অথচ সেটা তাদের মনগড়া। সেটা কোনো সাহায্যেই লাগতে পারে না। এটা কোনো কাজের কথাও নয়, তাই নয় কি?
আপনি যা বলেছিলেন সেটা যেমন ঠিক আবার এটা কাজেরও হতে পারে, বললেন পোয়ারো।
একটু সন্দেহের সঙ্গে মিসেস অলিভার বললেন, হাতির ব্যাপারে?
পোয়ারো বললেন, কয়েকটা ঘটনার কথা জানা খুব জরুরি যা মানুষের স্মৃতিপটে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে আছে। প্রকৃত ঘটনা কী, বা কেন সেটা ঘটেছিল অথবা তার পরিণতিই বা কি হতে পারে তারা সহজেই যা জানতে পারে আমরা তা জানি না। বিশ্বাসঘাতকতা, অসুস্থতা বা আত্মহত্যার চুক্তি সবই তাদের ধারণার কথা এবং মতামতের কথা আপনাকে জানিয়েছি।
মিসেস অলিভার বললেন, মানুষ অতীতের কথা বলতে ভালোবাসে। প্রথমে তারা অন্য সব লোকেদের কথা যা তাদের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে তাদের কথা বলেন যা আপনি শুনতে চান না। তারপর তারা এমন লোকেদের প্রসঙ্গ টানত যা নিজেরাই জানে না। অন্য কারোর কাছ থেকে শুনে থাকবে। জানেন প্রথম ভাইপো একবার অপসারিত হলে দ্বিতীয় ভাইপো কিন্তু দু-বার অপসারিত হবে। আর তারপর বাকিরাও ওই একইভাবে অপসারিত হবে। তাই আমার মনে হয় এত সব তথ্য জোগাড় করার পরও সত্যিকারের কোনো কাজের কাজ হয়নি।
পোয়ারো বললেন, সেরকম ভাবার কোনো কারণ আপনার নেই। আমি একদম নিশ্চিত যে, আপনার ওই ছোট্ট নোটবুকে যে সব ঘটনার কথা লেখা আছে তা থেকে একদিন নিশ্চয়ই অতীতের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কিছু হদিশ আপনি পাবেনই। সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে অর্থাৎ পুলিশি ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে সেই মৃত্যু আজও রহস্য রয়ে গেছে। তারা ছিলেন সুখী দম্পতি। তাদের কোনো যৌন অসুবিধা ছিল না। এবং এমন কোনো অসুখ ছিল না তাদের, যা থেকে তারা তাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। সুতরাং সেই ঘটনা ঘটার আগের সময় নিয়ে আলোচনা করতে চাই। কিন্তু তারও আগের সময়ের কথা ভাবতে হবে।
মিসেস অলিভার বললেন, আপনি কী বলতে চাইছেন আমি তা জানি। আর এ-ব্যাপারে আমি বৃদ্ধা আয়ার কাছ থেকে কিছু তথ্যও পেয়েছি। আমার ধারণা সেই বৃদ্ধার বয়স হবে আশি। আমি তাকে ছেলেবেলা থেকে চিনি। এবং তিনি আমাকে বিদেশে সৈনিকদের গল্প শোনাতেন।
আকর্ষণীয় কোনো কিছু পেয়েছিলেন?
মিসেস অলিভার হ্যাঁ বললেন। সেখানে যে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল তার কথা বললেন। কিন্তু কথা শুনে মনে হল তিনি সেই ব্যাপারে অনিশ্চিত। কারণ তাদের পদবী তিনি মনে করতে পারছিলেন না। একজন মানসিক রোগিনীর কথা বললেন। সে হয় জেনারেলের বোন নয় লেডি র্যাভেন্সক্রফটের বোন হবে। সে কয়েকবছর মানসিক হাসপাতালে ছিল। এবং সে নাকি তার নিজের শিশুদের হত্যা করেছিল অথবা হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তারপর সে সুস্থ হয়ে ইজিপ্ট কিংবা মালয়ে অথবা অন্য কোনো দেশে চলে যায়। আমার এখন আশঙ্কা হল যে, তাদের পরিবারে সত্যিই কোনো মানসিক রোগী ছিল কিনা। আমার মনে হয় তদন্তের ব্যাপারে এটা একটা সূত্র হতে পারে।
পোয়ারো বললেন, সব সময়েতেই একটা না একটা সম্ভাবনা থেকেই থাকে। তারপর দীর্ঘ কয়েক বছর পর সেটা রোমাঞ্চকর খবর হয়ে যায়। সেই কারণেই কে যেন আমাকে বলেছিল, পুরোনো পাপের দীর্ঘ ছায়া।
আমারও ঠিক সেইরকম মনে হয় বললেন, মিসেস অলিভার। বৃদ্ধা আয়া যে সব লোকের কথা তিনি মনে করেছিলেন তারা সত্যিই র্যাভেন্সক্রফটরা কিনা। কিন্তু সাহিত্যের ভোজসভায় সেই ভয়ঙ্কর মহিলাটি যা বলেছিলেন এইসব ঘটনার সঙ্গে তার কিছু মিল থাকতে পারে।
তিনি কী জানতে চেয়েছিলেন?
তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমি যেন আমার ধর্মর্কন্যার কাছ থেকে খোঁজ নিই তার মা তার বাবাকে খুন করেছিল না তার বাবা তার মাকে খুন করেছিল।
তিনি কি ভেবেছিলেন যে, মেয়েটি সে খবর জানে?
হ্যাঁ, মেয়ের জানার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। প্রকৃত সত্য তার কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। কিংবা তার কাছে সেটা অপ্রকাশিত থেকে গিয়েছিল। তারপর মেয়েটি অনেক চেষ্টা করেছিল জানতে কোন পরিস্থিতিতে দুটো জীবন শেষ হয়ে গেল আর কে কাকেই বা খুন করেছিল। যদিও সে সেটা কখনও প্রকাশ করবে না বা কাউকে কিছু বলবে না এ-ব্যাপারে। অথবা এ ব্যাপার নিয়ে কারোর সঙ্গে কোনোরকম আলোচনাও করবে না।
আপনি সেই যে মহিলার কথা বলেন এই সেই মিসেস
এখন তার নামটা ভুলে গেছি, হা মিসেস বারটন এরকম কোনো একটা নাম হবে। তার ছেলে একটি মেয়েকে ভালোবাসে এবং তারা এখন বিয়ে করবে বলে ভাবছে। তাই যদি হয় এখন আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন মেয়েটির মা কিংবা বাবার পরিবারে কোনো অপরাধী আত্মীয় ছিল কিনা। কারণ মিসেস বারটন নিশ্চয়ই চিন্তা করে থাকবেন যদি মেয়েটির মা তার বাবাকে খুন করে থাকে তাহলে মেয়েটিকে বিয়ে করা অবিবেচকের কাজ হবে। মিসেস অলিভার বললেন, কিছু মনে করবেন না আর বাবা যদি তার মাকে খুন করে থাকে?
আপনি বলতে চাইছেন তিনি ভেবেছিলেন-তার উত্তরাধিকারের ভাগীদার হবে একজন নারী? মিসেস অলিভার বললেন, ও ভালো কথা তিনি খুব একটা বুদ্ধিমতী নারী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন যে তিনি অনেক কিছুই জানেন, আদৌ তিনি কিছুই জানেন না। আমার অনুমান আপনিও যদি নারী হতেন তাহলে ঠিক এইভাবেই আপনিও ভাবতেন।
এটা একটা উল্লেখযোগ্য দিক বটে। পোয়ারো বললেন, আমি সেটা উপলব্ধি করতে পারি।
আরও একটা দিকের কথা আমি চিন্তা করেছি। এই দম্পতি একটা শিশুকে দত্তক নিয়েছিল। আমার মনে হয় তখন তাদের একটি শিশু মারা যায় এবং সেই কারণেই সেই দত্তক শিশুটিকে তারা সম্পূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরেন। তারপর একদিন তার নিজের মা তাকে ফেরত চায়। সেই ঝামেলা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল এবং আদালত শিশুটির ভার তাদের ওপর দিয়েছিল। আর তখনই নিজের মা ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছিল, পোয়ারো বললেন, এটাই আমি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি।
যেমন?
চার-চারটে পরচুল।
মিসেস অলিভার বললেন, আমি ভাবলাম এটা আপনাকে আগ্রহ জাগাবে। আমার মনে হয় না এর কোনো মানে আছে। আর অপর কাহিনি হল একজন মানসিক রোগী সে তার শিশুদের অথবা অকারণে অন্য শিশুকে হত্যা করেছিল। সেই হত্যার পিছনে কোনো যুক্তি আছে আমি ভাবতে পারছি না। আর এও বুঝতে পারছি না কেনই বা জেনারেল এবং লেডি র্যাভেন্সক্রফট নিজেদের হত্যা করতে গেলেন?
পোয়ারো বললেন, যদি ওদের মধ্যে কেউ একজন জড়িত থাকে?
তার মানে আপনি কি বলতে চান জেনারেল র্যাভেন্সক্রফট কাউকে হত্যা করেছিলেন, মানে একটি অবৈধ সন্তানকে যা ওঁর স্ত্রীর কিংবা নিজের ছিল? কিংবা লেডি র্যাভেন্সক্রফট তার স্বামীর ছেলেকে বা নিজের ছেলেকে হত্যা করেছিল? কিন্তু আমার মনে হয় এটা অতি নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে।
পোয়ারো বললেন, লোকের মনে কি ধারণা হতে পারে সাধারণতঃ তারা…।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন?
আমার অনুমান তারা ছিলেন স্নেহপ্রবণ দম্পতি। সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করত এবং তাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া বিবাদ ছিল না। কতক লোকের ধারণা অপারেশন হওয়া দূরের কথা তাঁদের মধ্যে কেউ একজন অসুস্থ ছিল এমন রেকর্ড পাওয়া যাবে না। এমনকি লন্ডনে গিয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ারও কোনো রেকর্ড নেই। সেই সময়ে অন্য কেউ যদি সেই বাড়িতে থাকত তদন্তের সময় পুলিশ সব কথা জানত এবং আমার সেই পুলিশ বন্ধুটি নিশ্চয় আমাকে জানাত। যে কারণেই হোক তাঁরা আর বেঁচে থাকতে চাননি। কিন্তু কারণ কী?
মিসেস অলিভার বললেন, আমি একটি দম্পতিকে জানতাম যারা ধরে নিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যদি জার্মানরা ইংলন্ডে আসে তারা তাদের হত্যা করবে। আমার মনে হয় এটা খুবই বোকামো। বাঁচতে গেলে তোমাকে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করতে হবে। তোমার মৃত্যুতে কারোর হয়তো ভালো হবে বা কারোর কোনো উপকার হবে তোমাকে সেটা বুঝতে হবে। আর আমি অবাক হয়ে যাই
আচ্ছা কেন অবাক হন বলুন তো?
আমি অবাক হই এই কারণে যে, তাহলে কি লেডি র্যাভেন্সক্রফট ও জেনারেলের মৃত্যুতে কারোর কিছু ভালো হয়েছে? তাদের মৃত্যুতে তাদের অর্থ ও সম্পত্তির কেউ উত্তরাধিকারী হয়েছে?
কেউ হয়তো তার জীবনে উন্নতি করতে চেয়েছিল। তাদের জীবনে এমন কিছু একটা ছিল যার কারণে তারা চায়নি ওঁদের ছেলেমেয়েরা কেউ সেটা জানুক? পোয়ারো একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তিনি বললেন, আপনার কী দোষ জানেন? আপনি এমন কিছু চিন্তা করেন মনে হয় যেন সেটা এখন ঘটেছে বা ঘটতে পারে। যেমন–কেন ওঁদের দুজনের মৃত্যুর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল? ওদের কোনো যন্ত্রণা ছিল না, বা ওঁরা অসুস্থ ছিলেন না অথবা ওঁরা অসুখীও ছিলেন না। তবে কেন একটা সুন্দর দিনে সন্ধ্যায় কুকুরকে নিয়ে পাহাড়ে বেড়োতে গিয়েছিলেন?
মিসেস অলিভার প্রশ্ন করলেন, এর সঙ্গে কুকুরের কী সম্পর্ক?
আমি একটু সময়ের জন্য অবাক হই। পর মুহূর্তে মনে প্রশ্ন আসে তবে কি ওঁরা কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ছিলেন অথবা কুকুরটা কি ফিরে এসেছিল? মিসেস অলিভার বললেন, আমার মনে হয় এই ব্যাপারটাও পরচুলের পর্যায়ে পড়ে। কারণ আমার একটা হাতি বলেছে কুকুরটা ছিল লেডি র্যাভেন্সক্রফটের অনুগত আবার অপর আর একটা হাতি বলেছে, কুকুরটা নাকি ওঁনাকে কামড়ে দিয়েছিল। পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সবাই সব সময় একই ব্যাপারে ফিরে আসে। সবাই মানুষ সম্পর্কে আরও আরও বেশি জানতে চায়। আর আপনিই বা কেমন করে জানবেন কারণ বহু বছরের ব্যবধানে আপনার কাছ থেকে সব মানুষ বিছিন্ন হয়ে গেছে। একবার কী দু-বার আপনিও সেটা করেছিলেন। কি করেননি? বললেন মিসেস অলিভার। একটা সমুদ্রের ধারে একজন শিল্পী গুলিবিদ্ধ হয়েছিল বা তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল। আপনি জানেন সেটা করা হয়েছিল আত্মরক্ষার জন্য বা ওইরকম কিছুর জন্য। আর এই কাজ কে করতে পারে আপনি সেটা খুঁজে বার করেছিলেন। আপনি যদিও কোনো লোককেই জানতেন না। আমি কোনো লোককেই জানতাম না ঠিকই কিন্তু অন্য লোকেদের মারফত তাদের সম্পর্কে আমি জানতে পারি।
মিসেস অলিভার বললেন, আমি তো সেটাই চেষ্টা করছি। সত্যি বলতে কী যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, যারা সত্যিকারের সব ঘটনা জানে আমি তাদেরই কাছে যথেষ্ট যেতে পারছি না। আপনার কি মনে হয় এর হাল সত্যি আমি ছেড়ে দেব? পোয়ারো বললেন, সেটা যদি আপনি করতে পারেন তাহলে সেটাই হবে আপনার বুদ্ধিমানের কাজ। আসলে কী হয় জানেন, এমন একটা সময় আসে মানুষ আর জ্ঞানী হতে চায় না। যেমন আমার খুব আগ্রহ আছে সেই দম্পতিদের ব্যাপারে। আমার ধারণা তাদের দুটো সন্তান আছে এবং খুব সুন্দর।
মিসেস অলিভার বললেন, ছেলেটির সম্পর্কে আমি জানি না এবং তার সঙ্গে কখনও মিলিত হইনি। আপনি কি আমার ধর্মকন্যাকে দেখতে চান? আমি ওকে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলতে পারি। হ্যাঁ আমার মনে হয় ওর সাথে আমার সাক্ষাৎ করা উচিত। তবে ও হয়তো আমার সাথে দেখা করতে চাইবে না। কিন্তু সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে আর সেটা হতে পারে খুব আগ্রহের। আমার আর একজনের সঙ্গেও দেখা করা দরকার।
সেই ব্যক্তিটি কে? সাহিত্যের ভোজসভার সেই ভয়ঙ্কর মহিলা যে নাকি আপনার খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু।
মিসেস অলিভার বললেন, মোটেই তিনি আমার বন্ধু নন। আমার কাছে এসেছিলেন এবং কথা বলেন এই পর্যন্ত।
আপনি কি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন না? হ্যাঁ খুব সহজেই, যদি তিনি এই কথা শোনেন সম্ভবত লাফিয়ে উঠবেন তিনি।
আমি ওঁকে অন্তত একবার দেখতে চাই, কারণ আমি তার কাছে জানতে চাইব যে, কেন তিনি সব খবর জানতে চান।
মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ আমার মনে হয় সেটা তাদের হতে পারে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সেই বৃদ্ধা আয়ার কথা আপনাকে বলেছিলাম তিনিও কিন্তু হাতিদের কথা বলেছিলেন, এবং এও বলেছিলেন যে, হাতিরা কখনও ভোলে না। সেই বিশ্রী কথাটা আমাকে তাড়া করে বেড়োয়। তাই হাতিদের কাছ থেকে বিশ্রাম পেলে খুশি হব। ওহো আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি। আপনাকে অতি অবশ্যই আরও হাতির খোঁজ করতে হবে। এবার আপনার পালা।
তাহলে আপনি এখন কি করবেন?
খুব সম্ভব আমি হংসের সন্ধান করব।
সেই হংসটিকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন?
সেটা একমাত্র আমিই মনে করতে পারি কারণ যার কথা আয়া আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো ছেলেদের সঙ্গে আমি খেলা করতাম এবং তাদেরই মধ্যে একজন আমাকে লেডি হস্তিনী বলত আর অপরজন সম্বোধন করত লেডি হংসী বলে। আমি যখন লেডি হংসী হতাম তখন মেঝের ওপর সাঁতার কাটার ভান করতাম এবং যখন আমি লেডি হস্তিনী তখন ওরা আমার পিঠে চড়ে বসত।
পোয়ারো বললেন, সেটা খুব ভালো জিনিস। হাতিরাই যথেষ্ট।
.
ডেসমন্ড
দু-দিন বাদে এরকুল চকোলেট পান করছিলেন এবং অনেকগুলো চিঠির মধ্যে একটা চিঠি নিয়ে দ্বিতীয়বার পড়তে শুরু করলেন। চিঠিতে লেখা ছিল–প্রিয় মঁসিয়ে পোয়ারো,
আমি আশঙ্কা করছি যে, এই চিঠিটা আপনার কাছে একটু অদ্ভুত ধরনের মনে হবে এবং আমার বিশ্বাস আপনার বন্ধুদের মধ্যে এমন একজন আছেন যার সাথে আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা তখন তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তার সাথে যদি আপনার দেখা হত মনে হয় কাজ হত আপনার। তার সেক্রেটারি বললেন, তিনি পূর্ব আফ্রিকায় গেছেন। তাহলে বেশ কিছুদিন তিনি ফিরছেন না। আমার ধারণা তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। আপনার সাথে আমার দেখা করার খুব দরকার কারণ আপনার কাছ থেকে কিছু উপদেশ নেওয়া আমার প্রয়োজন।
আমি জানতে পেরেছি মিসেস অলিভারের সঙ্গে আমার মার পরিচয় আছে। এবং একটা সাহিত্যের ভোজসভায় তিনি মায়ের সঙ্গে মিলিত হন। সুতরাং আপনি যদি সময় করে আমার সঙ্গে দেখা করেন আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আমি কিন্তু আপনার সুবিধামতো যে কোনো সময়ে দেখা করতে রাজি আছি। মিসেস অলিভারের সেক্রেটারি হাতির কথা বলেছিলেন। আমার মনে হয় এর সঙ্গে মিসেস অলিভারের পূর্ব আফ্রিকা যাওয়ার কোনো তাৎপর্য আছে। আমার এখন ভীষণ চিন্তা ও উদ্বেগ হচ্ছে। এই সময় যদি আপনি অনুমতি দেন আপনার সঙ্গে দেখা করার, তাহলে চিরকাল আপনাকে মনে রাখব।
আপনার বিশ্বস্ত
ডেসমন্ড বারটন কক্স
দ্বিতীয়বার চিঠিটা পড়ার পর এরকুল অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন, এ যেন হঠাৎই
কিছু যদি মনে করেন জর্জ, প্রশ্ন করে কী বললেন আপনি?
এরকুল পোয়ারো বললেন, মুখ ফসকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল। এমন এক একটা ঘটনা আছে যদি একবার কোনো মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে তার থেকে রেহাই পাওয়া খুব মুশকিল। আমার কাছে এখন সেটা হাতিদের প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।
তিনি তার সেক্রেটারি মিস লেমনকে ডেসমন্ড কক্স-এর চিঠিটা দিলেন এবং বললেন, এই চিঠির লোকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে।
তিনি তাকে বললেন, আমি এখন খুব ব্যস্ত নই। আগামীকাল সময় হতে পারে।
মিস লেমন তাকে মনে করিয়ে দিলেন যে এরমধ্যে দুটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা আছে। তাসত্ত্বেও তিনি জানালেন আগামীকাল তার যথেষ্ট সময় আছে এবং তাঁর কথা মতন সে যেন ব্যবস্থা করে। পশুশালা বা চিড়িয়াখানার ব্যাপারে কি কিছু করতে হবে?
পোয়ারো বললেন, তার দরকার নেই। তবে হাতির ব্যাপারে সে যেন কিছু কথা না বলে। কারণ হাতিরা বিরাট জন্তু। অনেকটা জায়গা দখল করে নেয়। তার সাথে আলোচনার সময় সেই প্রসঙ্গ যে উঠবেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জর্জ বলল, মিঃ ডেসমন্ড বারটন কক্স এসেছেন। পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন এবং কোনো কথা না বলে একটু সময় স্থির হয়ে রইলেন। তিনি হয়তো একটু নার্ভাস হলেন অথবা একটু অসুস্থতাবোধ হল। তবে বেশ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সেটা ঢাকলেন এবং হাতটা বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।
আপনি কি মিঃ এরকুল পোয়ারো?
পোয়ারো বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন, আর আপনার নাম তো ডেসমন্ড বারটন কক্স। আপনি এখানে কেন এসেছেন এবং আপনার জন্য আমি কী করতে পারি বলুন?
ডেসমন্ড বারটন কক্স বললেন, ব্যাখ্যা করা খুব মুশকিল, অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা যায় না, তবুও অনেক সময় আছে আমাদের হাতে। এখন বসুন। ডেসমন্ড সামনে বসা মানুষটির দিকে সন্দেহের চোখে তাকালো। তার চেহারা হল ডিমের মতো মাথা এবং বড় গোঁফ। তিনি যেমন মনে মনে আশা করেছিল ঠিক সেইরকম নয়।
আপনি একজন গোয়েন্দা তাই তো? মানে আমি বলতে চাইছি লোকেরা আপনার কাছে আসে তাদের কোনো ব্যাপারে তদন্তের জন্য।
পোয়ারো বললেন, আমার জীবনে এটা একটা কাজ বলে মনে করতে পারেন।
আমার মনে হয় আপনি আমার সম্বন্ধে খুব বেশি জানেন না এবং কেন এসেছি তাও নয়।
কিছু কিছু জানি সব নয়, পোয়ারো বললেন। আপনি বলতে চাইছেন মিসেস অলিভার আপনাকে কিছু বলেছেন?
তিনি আমাকে শুধু বলেছেন তার এক ধর্মকন্যার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার নাম মিস সিলিয়া র্যাভেন্সক্রফট। তাই তো?
হ্যাঁ সিলিয়া আমাকে বলেছে। আমার মনে হয় মিসেস অলিভার আমার মাকে বেশ ভালো করেই চেনেন।
না, আমার ধারণা তারা পরস্পর পরস্পরকে ভালোভাবে জানেন। মিসেস অলিভার বলেছিলেন আপনার মায়ের সঙ্গে একটা সাহিত্যের ভোজসভায় দেখা হয়েছিল। এবং তার সঙ্গে মাত্র কয়েকটা কথা হয়, আপনার মা একটা বিশেষ ব্যাপারে তাকে অনুরোধ করেছিলেন।
ছেলেটি দারুণ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, তাঁর সেটা করার কোনো অধিকার নেই। আবার বলল মায়ের–আমি বলতে চাই
পোয়ারো শুনে বললেন, বুঝেছি। মায়েরা সব সময় চিন্তা করেন তাদের সন্তানদের জন্য। কিন্তু সন্তানেরা তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কি আমি ঠিক বলিনি?
হ্যাঁ আপনি সত্যি কথাই বলেছেন। কিন্তু আমার মা এমন একটা ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চায় যেটার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই।
আপনি ও সিলিয়া র্যাভেন্সক্রফট দু-জনে খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু। আপনারা দু-জনে পরস্পরের খুবই কাছের মানুষ। মিসেস অলিভার আপনার মার কাছ থেকে শুনেছেন আপনারা বিয়ে করার কথা ভাবছেন।
আমি আপনাকে আবার মনে করিয়ে দিতে চাইছি, যে ব্যাপার নিয়ে আমার মার কোনো সম্পর্ক নেই সেই বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা উচিত নয় এবং চিন্তারও কোনো কারণ থাকতে পারে না।
মৃদু হেসে পোয়ারো বললেন, সব মায়েরাই একই রকমের হয়। আর আপনি বোধহয় আপনার মায়ের সঙ্গে খুব জড়িত।
ডেসমন্ড বলল, আমি তা বলব না। বরং আপনাকে আমি খোলাখুলি বলি উনি আমার সত্যিকারের মা নন।
তাই নাকি? এ কথা তো আমার জানা ছিল না।
ডেসমন্ড বলে আমি ওঁর দত্তকপুত্র। কারণ ওঁর একটি ছেলে ছিল এবং সে ছোটোবেলাতেই মারা যায়। তখন উনি দত্তক নিতে চান। এবং আমাকে দত্তক নেওয়া হয়। যদিও উনি আমাকে ওঁর ছেলের মতো করে মানুষ করেছিলেন কিন্তু সবসময় উনি বলেন আমি ওঁর ছেলে নই। আমাদের দুজনকে দেখতে একরকম নয় এবং চেহারার সঙ্গেও কোনো মিল নেই আর আমাদের চিন্তাধারাও কিন্তু এক নয়।
পোয়ারো বললেন, এখন বুঝলাম।
ডেসমন্ড বলল, আমি আপনাকে কী করতে বলব কিছুতেই আপনাকে বোঝাতে পারছি না।
আপনার মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এবং তার উত্তর খুঁজে বার করার জন্য আমার কাছে এসেছেন তাই তো?
হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়।
আপনি কতটুকু জানেন আর তার ঝামেলাই বা কীরকম আমি কিছুই জানি না, পোয়ারো বললেন। আপনার সম্পর্কে একটু আধটু জানি বিস্তারিতভাবে নয়। মিস র্যাভেন্সক্রফটের সঙ্গেও আমার দেখা হয়নি। ওঁর সাথে কিন্তু আমি দেখা করতে চাই।
হ্যাঁ, আমি ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য। ওর সঙ্গে আপনার কথা বলা ভালো।
বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছেন। আচ্ছা আপনি কি কোনো ব্যাপারে অসুখী বা অসুবিধায় পড়েছেন কোনো বিষয়ে? পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন।
না, না, তেমন কোনো অসুবিধায় পড়িনি। ব্যাপারটা কী ঘটেছে জানেন, অনেক বছর আগে সিলিয়া তখন ছোটো অথবা বলা যেতে পারে সে তখন স্কুলের মেয়ে। তখনই তার জীবনে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়। সে রকম ঘটনা যে কোনো সময়েই ঘটতে পারে। দু-জন অভিভাবক হতাশায় আত্মহত্যা করে বসেন। এই ব্যাপারে কেউ খুব বেশি জানে না। যা ঘটনা ঘটেছিল তা নিয়ে অন্য লোকদের ছেলেমেয়ের চিন্তার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আমি বলতে চাইছি এই বিষয় নিয়ে আমার মায়ের মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
পোয়ারো বললেন, কেউ কেউ এমন বেশি আগ্রহ দেখায়, যেমন কারোর জীবনের সফরে, যার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। এমন কি সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার বলেও গণ্য হতে পারে না।
কত বছর আগে এঘটনা শেষ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারে কেউ খুব বেশি জানেও না। অথচ আমার মা আজও এ ব্যাপারে তিনি খুঁটিনাটি সব কিছু তথ্য জানতে চান এবং এর মাধ্যম হল সিলিয়া। আর সিলিয়াকে এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে যে, তিনি জানেন না, ও আমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক কিনা।
আপনি? আপনি নিশ্চয়ই জানেন ওকে আপনি বিয়ে করতে চান। কি চান না?
হ্যাঁ, অবশ্যই আমি জানি। এবং ওকে বিয়ে করার জন্য আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু জানেন ও ভীষণ মুষড়ে পড়েছে। কারণ ও জানতে চায় কেন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল এবং ওর বিশ্বাস আমি সব কিছু জানি। এবং আরও মনে করে আমার মা এ-ব্যাপারে কিছু জানেন বা কিছু শুনে থাকবেন।
পোয়ারো বললেন, আপনার জন্য আমার যথেষ্ট সহানুভূতি আছে। আপনি বুদ্ধিমান যুবক এবং আপনি মেয়েটিকে বিয়ে করতে চান। এতে কোনো বাধার কারণ দেখতে পাচ্ছি না। অনেক বছর আগে যে ঘটনা ঘটেছিল তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নেই আর ছিলও না। এই ধরনের বেদনাদায়ক ঘটনার ব্যাখ্যা কেউ কখনও জীবনে পায় না।
সেটা ছিল একটা স্রেফ চুক্তি মাফিক আত্মহত্যা তার বেশি কিছু হতে পারে না। কিন্তু
আপনি কি তার কারণ জানতে চান?
হ্যাঁ, সেই রকমই। এই ব্যাপারে সিলিয়া খুব উদ্বিগ্ন। অবশ্যই আমার মাও উদ্বিগ্ন। এক্ষেত্রে কারোর কোনো দোষ বা ত্রুটি ছিল। কিন্তু মুশকিল হল এর বিন্দুবিসর্গ আমরা জানি না। বিশেষ করে আমার জানার কথা নয় কারণ সেই সময় আমি সেখানে ছিলাম না।
আপনি কি তখন জেনারেল আর লেডি র্যাভেন্সক্রফট এবং সিলিয়াকে চিনতেন না?
প্রায় আমার সারা জীবন ধরে আমি সিলিয়াকে জানি। আমার স্কুলের ছুটির সময় আমি আমার অভিভাবকের কাছে চলে আসতাম আর ওরা পাশের বাড়িতেই থাকত। সেইজন্য খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের আলাপ। আমরা পরস্পরকে পছন্দ করতাম এবং এক সঙ্গে থাকতাম। তারপর দীর্ঘ কয়েক বছর আর ওর সাথে দেখা হয়নি। ওর বাবা মা মালয়েতে থাকতেন আর আমার অভিভাবকেরাও। আমার ধারণা তারা আবার পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করতেন ওখানে। আপনাকে বলা হয়নি আমার বাবা মারা গেছেন। আমার মা যখন মালয়েতে ছিলেন তখন তিনি কিছু একটা শুনেছিলেন আর সেটা এখনও তিনি মনে রেখেছেন। ওঁদের সম্পর্কে গবেষণাও করছেন। তবে আমি নিশ্চিত তার চিন্তাধারা কখনই সত্য হতে পারে না। আর এরজন্য সিলিয়াকে উদ্বিগ্ন করে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর। তারজন্যই আমি জানতে চাই সত্যিকারের কী এমন ঘটনা ঘটেছিল যার জন্য ওঁরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলেন? এবং সিলিয়াও জানতে চায় কী ঘটেছিল এবং কেন ঘটেছিল আর কি ভাবেই বা।
পোয়ারো বললেন, আপনারা উভয়েই যে সেটা অনুভব করেন অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার মনে হয় আপনার থেকেও সিলিয়া বেশি উদ্বিগ্ন এবং ওর মনটা বিঘ্নিত। বর্তমানে এখন অতীতের সেই ঘটনা নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনারা উভয় উভয়কে বিয়ে করতে চান। তাহলে অতীতের সঙ্গে আপনার কিসের সম্পর্ক? ওর বাবা-মা চুক্তি মাফিক আত্মহত্যা করেছিলেন কিনা বা প্লেন দুঘর্টনায় মারা যাবার পর অপরজন আত্মহত্যা করলেন কিনা, এইসব বিষয় নিয়ে আপনাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। আর যদি বা ওঁদের বিবাহোত্তর জীবনে প্রেমঘটিত কোনো ঘটনা ঘটে থাকে এবং তার জন্য যদি তারা অসুখী হন এ নিয়ে কি আপনাদের কোনো উদ্বেগের কারণ ঘটতে পারে?
ডেসমন্ড বারটন কক্স বললেন, আপনি যা বললেন তা সুচিন্তিত মতামত এবং খুবই খাঁটি কথা। কিন্তু সিলিয়ার মনের মধ্যে কোনো ঘটনা একবার ঢুকলে ওর ভেতরটা তোলপাড় করে উঠলেও মুখে সেটা প্রকাশ করবে না। এবং তখন ও খুব কম কথা বলে।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আপনার কি একবারও মনে হয়নি যে, সত্যিকারের যে ঘটনা ঘটেছে তা জানা খুবই কষ্টকর। এবং যদি সেটা অসম্ভব কিছু হয়?
মানে আপনি বলতে চান, ওঁদের মধ্যে কে কাকে খুন করেছিলেন বা কেন খুন করেছিলেন এবং তারপর নিজে আত্মহত্যা করেছিলেন এই তো? অবশ্য যদি না অন্য কোনো ব্যাপার থেকে থাকে।
সেই অন্য ব্যাপারটা ঘটেছে অতীতে। এখন সেটা নিয়ে অহেতুক মাথা ঘামানোর কি কোনো দরকার আছে?
এটা কোনো ব্যাপারই হওয়া উচিত ছিল না যদি না আমার মা অহেতুক নাক না গলাতেন। সিলিয়া যে এ নিয়ে কোনোদিন কিছু ভেবেছে আমার মনে হয় না। কারণ এ-ঘটনা ঘটার সময় সে সুইজারল্যান্ডে স্কুলে ছিল। আর এব্যাপারে কেউ ওকে বিশেষ বলেওনি। আপনি নিশ্চয়ই এটা স্বীকার করবেন কৈশোর বয়সে যে ঘটনা ঘটে আর লোকেরা তাকে সে ব্যাপারে যা বুঝিয়ে থাকে সে সেটাকেই মেনে নেয়।
আপনারা তাহলে অসম্ভবকেই জানতে চাইছেন?
ডেসমন্ড বলল, আপনাকে আমি খোঁজ করতে বলেছি।
অনুসন্ধান চালাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বললেন পোয়ারো। প্রত্যেকেরই একটা কৌতূহল থাকে বিয়োগান্ত কোনো ঘটনা যার থেকে দুঃখ হতে পারে। আবার বিস্ময়ের কারণ ঘটতে পারে, কেউ হয়তো অসুস্থ হয়ে উঠতে পারে। মানুষের দুঃখ, বেদনা ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও যে কোনো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হল কৌতূহল জাগা। কিন্তু এত ঘটনার পরেও আমি বলব অতীতের স্মৃতি নতুন করে মনে করাটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর তার কোন প্রয়োজনই নেই। ডেসমণ্ড বলল কিন্তু দেখুন…
তাছাড়া তার কথার মাঝে বাধা দিয়ে পোয়ারো বলে উঠলেন, দীর্ঘ কয়েক বছর বাদে অতীতের সেই ঘটনার প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করা কীরকম কঠিন এবং অসম্ভব ব্যাপার এই বিষয়ে আপনি নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন?
সরাসরি প্রতিবাদ করে উঠে ডেসমন্ড বললেন, দুঃখিত, এক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। সেটা খুবই সম্ভব আমার মনে হয়।
খুব সম্ভব, একথা কেন আপনার মনে হল জানতে পারি কি? বললেন পোয়ারো।
কারণ—
সেই কারণটা কি আপনার জানা আছে?
আমার ধারণা এখনও এমন কিছু কিছু লোক আছে যারা সেই ঘটনার কথা জানে। এমন কিছু লোক আছে যারা আপনাকে কিছু বলার বলে মনে করলে তারা বলবে। তারা আমাকে কোনো কিছু বলবে না এবং সিলিয়াকেও না। আপনিই একমাত্র পারেন তাদের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিতে।
পোয়ারো বললেন, এটা আকর্ষণীয় বটে–
ডেসমন্ড বলল, অতীতের যা ঘটনা শুনেছি সবই ভাসাভাসা, কেউ একজন বলেছিলেন লেডি র্যাভেন্সক্রফট বেশ কয়েক বছর একটা মানসিক হাতপাতালে ছিলেন। আবার কেউ বলেন তিনি যখন তরুণী ছিলেন একটি শিশু মারা যায় বা এ-ধরনের কিছু হবে। সেই আঘাতই তাকে বিভ্রম করে তোলে।
আপনি নিশ্চয়ই এ-ঘটনা নিজের চোখে দেখেননি?
না, আমার মা বলেছেন, আমার মনে হয় তিনি খবরটা শুনেছিলেন মালয়েতে। সেখানকার লোকের মুখে গল্প শোনা।
আপনি জানতে চান সেগুলো সত্য না মিথ্যা ছিল?
যেহেতু বহু বছর আগেকার ঘটনা তাই জানি না কার কাছে যাব, কাকে জিজ্ঞেস করব। আর যতক্ষণ না আমরা সেই কারণটা খুঁজে বার করতে পারব সেই প্রশ্নটা থেকেই যাবে। কি ঘটেছিল আর কেনই বা ঘটেছিল।
পোয়ারো বললেন, আমি মনে করি অবশ্য সন্দেহও বলতে পারেন। সিলিয়া তার মায়ের অসুস্থতার প্রভাব তার মধ্যে প্রভাবিত হতে পারে না। এটা যতদিন বা যতক্ষণ নিঃসন্দেহ হচ্ছেন ততদিন বা ততক্ষণ পর্যন্ত সে আপনাকে বিয়ে করতে রাজী হবেন না। এই আপনি বলতে চাইছেন তো?
যেভাবেই হোক এটা তার মাথায় ঢুকে গেছে। আর সম্ভবত সেটা তার মাথায় ঢুকিয়েছে আমার মা, এবং আমার মা সেটা বিশ্বাস করেন। আমি মনে করি না শুধু খোগল্প ছাড়া এই বিশ্বাসের সত্যি কোনো কারণ আছে।
পোয়ারো বললেন, তদন্তের পক্ষে এটা খুব সহজ হবে বলে মনে করি না।
আমি কিন্তু আপনার সম্পর্কে অনেক প্রশংসা শুনেছি। যেমন আপনি কোনো ঘটনার ব্যাপারে খুব বুদ্ধির সঙ্গে সত্য উদ্ঘাটন করেন আবার লোকেদের আপনি প্রশ্ন করেন আবার তাদেরকে দিয়েই সত্য ঘটনা বলিয়ে নেন।
আপনি কাকে প্রশ্ন করতে বলেন, বলুন। আপনি মালয়ের লোকেদের কথা বলেছেন কিন্তু তাদের উল্লেখ আপনি কিন্তু করছেন না। আপনি সেই সব মহিলাদের কথা বলছেন যারা সেই সময় সৈনিক স্বামীদের কর্মক্ষেত্র মালয়ে থাকত।
আমার মনে হয় না সেগুলো কোনো কাজের হবে। যারা এই সব গল্প করত, আলোচনা করত, তারা নিশ্চয়ই ভুলে গিয়ে থাকবে যেহেতু তা অনেক দিনের আগের ঘটনা। খুব সম্ভব তারা সকলেই হয়তো মারা গেছেন। আমার আরও মনে হয় মা সব ভুল খবর সংগ্রহ করেছিলেন এবং তিনি যা শুনেছিলেন তার থেকেও বেশি তার নিজের মনগড়া কাহিনি তৈরি করেছিলেন।
আপনি কি এখনও মনে করেন আমি সমর্থ হলে
হ্যাঁ, ভালো কথা, আপনি বরং মালয়েতে গিয়ে কাউকে প্রশ্ন করুন। এখন বোধহয় সেইসব লোকেদের মধ্যে কেউই নেই।
তার মানে আপনি আমাকে নামগুলো দেবেন না?
না, না, সেইসব নামগুলো নয়, বললেন ডেসমন্ড।
তাহলে কি অন্য কোনো নাম আছে?
ঠিক আছে, আমার যা মনে আছে তাই বলি। আমার ধারণা দু-জন লোক সেই ঘটনার কথা জেনে থাকতে পারে। আর কেনই বা ঘটেছিল তা তারা জেনে থাকতে পারে কারণ তারা তখন সেখানে ছিল।
আপনি তাদের কাছে যেতে চান না?
হ্যাঁ আমার যাবার উপায় ছিল এবং আমি যেতেও পারতাম। কিন্তু আমার ধারণা তারা আমার কাছে মুখ খুলবে না। এমন কতকগুলো প্রশ্ন করার আছে যা আমি তাদের বলতে পারব না। সিলিয়াও পারবে বলে মনে হয় না। আমরা কি জানতে চাই তারা জেনে যাবে এবং তারা মনে করে আমাদের সেটা জানা উচিত নয়। তার মানে এই নয় যে তারা খারাপ লোক। হয়তো আমাদের ভালোর জন্য আসল ঘটনার কথা চেপে গেছে বা করে থাকবে।
পোয়ারো বললেন, আপনি বেশ গুছিয়ে কথা বলেন আর আপনার কথা শুনে আমার খুব আগ্রহ হয় এবং আমার অনুমান আপনার মনে নির্দিষ্ট কোনো ধারণা আছে। সিলিয়া কি আপনার সঙ্গে একমত?
আমি ওকে বেশি কিছু বলিনি। ও খুব ম্যাডি আর জেলির ভক্ত।
ম্যাডি আর জেলি সেটা কী?
ওগুলো নাম। আমার ব্যাখ্যা করা উচিত ছিল। সিলিয়া তখন খুব ছোটো। যখন আমি ওকে প্রথম দেখি। আপনাকে আমি আগেই বলেছি এবং মনে আছে নিশ্চয়ই ও আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকত। ওর একজন ফ্রেঞ্চ গভরনেস ছিল। তার নাম ছিল মাদমোয়াজেল। সে দেখতে ছিল খুব সুন্দর। আমরা ছোটোরা যখন খেলতাম সিলিয়া ও সঙ্গে থাকত। সিলিয়া তাকে ডাকত ম্যাডি বলে। তার অত বড়ো নাম সে ছোট করে দিয়েছিল। তারপর থেকে সারা পরিবার ওই ম্যাডি বলেই ডাকত।
–হ্যাঁ, দেখুন তিনি ফরাসি মহিলা বলে যতটুকু সে জানে ততটুকু আপনাকে বলবে এবং এ-ব্যাপারে অন্য কাউকে সে বলবে না।
আর অপর আর একটা মেয়ে যার কথা আপনি বলেছিলেন তার নাম?
জেলি। বুঝলেন ওই একই ধরনের। আমার অনুমান ম্যাডি সেখানে দুই কী তিন বছর থেকে পরে এই ফ্রান্সে অথবা সুইজারল্যান্ডে চলে যায়। তার পরে এই মেয়েটি আসে। আমরা তাকে ম্যাডি বলে ডাকতাম আর সিলিয়া বলতো জেলি, সে ছিল খুবই সুন্দরী এবং কৌতুকপ্রিয়া। আমরা সবাই তাকে ভালোবাসতাম। আর জেনারেল তো তার প্রতি খুব যত্ন নিতো। তারা দুজনে তাস খেলতো আরো অনেককিছু।
লেডি র্যাভেন্সক্রফট?
তারা পরস্পর পরস্পরের অনুগত ছিল। আর সেই কারণেই সে ফিরে আসে সেখান থেকে চলে যাবার পরও।
সে ফিরে এসেছিল?
হ্যাঁ, লেডি র্যাভেন্সক্রফট যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন জেলি তখন ফিরে এসেছিল কারণ তাকে দেখাশোনা করার জন্য এবং সঙ্গ দেবার জন্য। আমি বিশ্বাস করি এবং আমি নিশ্চিত সেই বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটার সময় সে সেখানেই ছিল। সত্যিকারের কি ঘটেছিল–সে সব জানে।
আপনি কি তার ঠিকানা জানেন? বা সে এখন কোথায় থাকে?
হ্যাঁ, আমি জানি সে কোথায় থাকে। তাদের দুজনের ঠিকানাই আমার কাছে আছে। আমি চিন্তা করে দেখেছি আপনি ওদের দুজনের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। আমি জানি অনেক কিছু জানার আছে।-ভেঙ্গে পড়ল সে এবার।
কয়েক মিনিটের জন্য পোয়ারো তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। পরে তিনি বললেন, হ্যাঁ এটা একটা সম্ভাবনা, অবশ্যই একটা সম্ভাবনা।