১৬.
আর্চডিকন ব্রাবাজন। গোল্ডেনবোরের লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছিলেন মিস মারপলের সঙ্গে দেখা করবেন বলে।
মিস মারপল দেখেই চিনতে পারলেন। এই পাদ্রীকেই স্মৃতিবাসরে দেখেছিলেন।
প্রাথমিক আলাপ পরিচয় সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর দুজন পাশাপাশি চেয়ারে বসলেন।
–আপনার কাছে আমি সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ, বললেন ব্রাবাজন, ক্যারিসটাউনের হাসপাতাল হয়ে এসেছি আমি। এলিজাবেথ টেম্পল আমার এক পুরনো বন্ধু ছিলেন। মেট্রন জানালেন, মৃত্যুর আগে এলিজাবেথ আপনার সঙ্গেই শেষবারের মত কথা বলেছেন।
–হ্যাঁ। আমাকে ডেকে পাঠানোতে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। বললেন মিস মারপল। ভ্রমণের সময়েই তার সঙ্গে দেখা হয়।
–তিনি আমার সঙ্গেই দেখা করতে আসছিলেন। আমি ফিলমিনস্টারে বাস করি–আপনাদের কোচ আগামী পরশুদিন সেখানে পৌঁছবে। তিনি আমার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা বলতে চেয়েছিলেন।
বুঝতে পেরেছি। বললেন মিস মারপল, আমার ভেরিটি নামে একটি মেয়ের সম্পর্কে কথা বলছিলাম।
-হ্যাঁ, ভেরিটি হান্ট। বেশ কয়েক বছর আগেই সে মারা গেছে। আপনি জানতেন? বললেন আর্চডিকন।
-হ্যাঁ। ভেরিটি মিঃ র্যাফায়েলের ছেলের সঙ্গে বিয়ের জন্য বাগদত্তা ছিল। আপনি কি তার সম্পর্কে কোন খবর দিতে পারেন?
আর্চডিকন গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলেন মিস মারপলকে। পরে বললেন, আপনি মনে হচ্ছে কোন ভাবে এর সঙ্গে জড়িত।
-হ্যাঁ জড়িত। মিঃ র্যাফায়েলের মৃত্যুকালীন ইচ্ছা অনুযায়ীই আমি মাইকেলের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে বেরিয়েছি।
এক মিনিট নীরব হয়ে রইলেন বৃদ্ধ আর্চডিকন।
–এলিজাবেথ আমার কাছে যা জানবার জন্য আসছিলেন, আপনাকে তা জানাতে কোন বাধা নেই। ধীরে ধীরে বললেন আর্চডিকন, ওই দুই তরুণ-তরুণী পরস্পরকে বিবাহ করবে স্থির করেছিল। আমি ওদের দুজনকেই চিনতাম। ওরা আমার কাছেই এসেছিল।
–আপনি তাদের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন? জানতে চাইলেন মিস মারপল।
-হ্যাঁ। ওরা গোপনে আমার কাছে এসেছিল। কেননা ক্লোটিলডা-ব্র্যাডবেরি স্কট ওদের মেলামেশা বন্ধ করতে চেয়েছিল। মাইকেল র্যাফায়েল অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। সে ছিল পথভ্রষ্ট। মেয়েদের সঙ্গে তার ব্যবহার খুবই খারাপ ছিল।
এতসব সত্ত্বেও আমি তাদের বিয়ে দিতে রাজি হই। ভেরিটি আমাকে বলেছিল, সে মাইকেলের স্বভাব ভালই জানে। তার বিশ্বাস ছিল তাকে সে ভাল হতে সাহায্য করতে পারবে।
যাইহোক, তাদের বিয়ের দিনক্ষণ সবই স্থির হয়ে গিয়েছিল। ভেরিটি তার বিয়ের কথা কাউকে জানাতে চাইনি। সম্ভবত সে ছেলেটির হাত ধরে পালাতে চেয়েছিল। সে জানতে ক্লোটিলডা কিছুতেই মাইকেলের সঙ্গে তার বিয়েটা মেনে নিতে চাইবেন না। অবশ্য এটাও সত্যি, মাইকেল কোন দিক দিয়েই ভেরিটির যোগ্য ছিল না। ক্লোটিলডা সেকথা অনেকবার ভেরিটিকে বলেও ছিলেন।
-তারপর কি হল বলুন। বললেন মিস মারপল।
–নির্দিষ্ট দিনে আমি প্রস্তুত হয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছি–কিন্তু তারা এলো না। কোন সংবাদও আমাকে পাঠালো না। সবকিছু স্থির করে কেন এল না, আমি তার কিছুই জানতে পারলাম না।
এলিজাবেথের দুঃসংবাদটা পাবার পর এখানে এসে মেট্রনের কাছে আপনার কথা শুনে আমার মনে হল, তিনি মৃত্যুর আগে আপনাকে কিছু বলে গেছেন।
-তাহলে এসব কথাবার্তার জন্যই মনে হয় তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছিলেন–যেটা ছিল তাঁর কাছে তীর্থযাত্রার মত। বললেন মিস মারপল।
–আমারও তাই বিশ্বাস। ভেরিটির বিয়েতে বাধা দেবার মত ছিলেন ক্লোটিলডা আর অ্যানথিয়া ব্র্যাডবেরি স্কট। ভেরিটি তার স্কুলের শিক্ষিকা এলিজাবেথের প্রতিও খুবই অনুরক্ত ছিল। ব্র্যাডবেরি স্কট বোনেদের কিছু জানাতে না পারলেও আমার মনে হয় ভেরিটি এলিজাবেথকে কিছু খবর দিতে পারে বা লিখে থাকতে পারে।
-আমারও তাই ধারণা। বললেন মিস মারপল। মিস টেম্পল নিজেই আমাকে বলেছেন যে তিনি জানতেন ভেরিটি মাইকেলকে বিয়ে করতে চলেছে। কিন্তু কেন বিয়ে করেনি, আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জবাব দিয়েছিলেন সে মারা গিয়েছিল।
কিন্তু, আর্চডিকন বললেন, আমি বিশ্বাস করি না ভেরিটি বা মাইকেল নিজে থেকে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে আলাদা হয়ে যায়। মাইকেলের চরিত্র সম্পর্কে যদি ভেরিটির মনে কোন দ্বিধা উপস্থিত হত তাহলে সে নিশ্চয় আমাকে জানিয়ে দিত। সে ছিল চমৎকার মেয়ে।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আমার ভয় হয়, একটা মাত্র ব্যাপারই ঘটে থাকতে পারে।
–মৃত্যু? বললেন মিস মারপল।
–হ্যাঁ। মৃত্যু। থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন আর্চডিকন।
–ভালবাসা!
আর্চডিকন চোখ তুলে তাকালেন মিস মারপলের মুখের দিকে।
–আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? বললেন তিনি।
–এই কথাটা মিস টেম্পল আমাকে বলেছিলেন। বললেন মিস মারপল। বলেছিলেন, ভালবাসাই পৃথিবীর সবচেয়ে ভীতিকর শব্দ।
-মনে হচ্ছে বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি। মাথা দুলিয়ে বললেন আর্চডিকন। সেই চিরাচরিত জেকিল আর হাইড। বিযুক্ত ব্যক্তিত্ব। মাইকেল র্যাফায়েল–মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ–ওর মধ্যে দুটি সত্ত্বা ছিল। সে ভেরিটিকে খুন করেছিল।…একদিন হয়তো সব জানা যাবে।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন আর্চডিকন। ব্রাবাজন।
–তাহলে এই আপনার বিশ্বাস? আমিও অবশ্য তাই মনে করি। বললেন মিস মারপল।
–কিন্তু তারপর?
–এখনও তা জানি না। আমার ধারণা আসলে কি ঘটেছিল মিস টেম্পল তা জানতে শুরু করেছিলেন বা জানতেন।
এরপর আত্মগতভাবেই তিনি বলে ওঠেন–ভালোবাসা–ভালোবাসা–বড় ভয়ঙ্কর এক
.
১৭.
পরদিন সকালে ভ্রমণ দলের কোচ গোল্ডেনবোরের সামনে এসে থেমেছে। মিস মারপল নিচে নেমে একে একে ভ্রমণসঙ্গীদের বিদায় জানালেন।
সকলেই চলে গেলেন। ওই দলের কেবল এমলিন প্রাইস আর যোয়ানা। ইতিমধ্যে তারা দুজন খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যোয়ানা তাই অজুহাত খাড়া করে তার পিসি মিসেস রাইজেল পোর্টারের কাছ থেকে ছাড়ান নিয়েছে।
সকলে কোচে উঠে গেলেন, মিস মারপল প্রফেসর ওয়ানস্টেডের দিকে তাকালেন।
–আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই। বললেন মিস মারপল।
তারা হোটেলের কোণের দিকে চলে এলেন।
–বাকি সকলের সঙ্গে কোচে চলে গেলেই মনে হয় ভাল করতেন আপনি। অবশ্য আমি আপনার ওপর নজর রাখতে পারব। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।
-না। তার দরকার হবে না।
–কোন ধারণা কি পেয়েছেন?
মনে হয় পেয়েছি। আর এমন কিছু ব্যাপার আছে তাতে আপনার সাহায্য দরকার। কারণ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে।
-হ্যাঁ। কিন্তু আমাকে কি করতে হবে?
মিস মারপল একটা ঠিকানা লেখা কাগজ ব্যাগ থেকে বার করে প্রফেসরের দিকে এগিয়ে দিলেন।
–একটা নামকরা দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান। সকলে এখানে শিশুদের আর মেয়েদের পোশাক, কোট, পুলওভার ইত্যাদি পাঠিয়ে থাকে। দুদিন আগে এখানকার ডাকঘর থেকে পাঠানো একটা পার্সেল সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে হবে আপনাকে।
–কে পাঠিয়েছিল সেটা?
–পার্সেলটা গিয়েছিল অ্যানথিয়া ব্রাডবেরি স্কটের কাছ থেকে।
–আপনি তাকে সেটা নিয়ে যেতে বলেছিলেন?
–না। গোল্ডেনবারের বাগানে সেদিন আমি আর আপনি বসে কথা বলার সময় তাকে পার্সেলটা নিয়ে যেতে দেখেছিলাম।
-হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কিন্তু ওই পার্সেলের সঙ্গে
–ধীরে বন্ধু ধীরে। আমি পরে ডাকঘরে গিয়ে মিথ্যে করে গল্প ফেঁদে সদাশয়া পোস্ট মিসট্রেসের কাছ থেকে ঠিকানাটা সংগ্রহ করে এনেছিলাম। অবশ্য জানি পার্সেলে প্রেরকের ভুয়ো নামঠিকানাই দেওয়া থাকবে।
প্রফেসর ওয়ানস্টেড ঠিকানা লেখা কাগজটা নিলেন।
–ঠিক আছে। স্বচ্ছন্দেই এটা করা যাবে। আপনি আশা করছেন এই পার্সেল আপনাকে সাহায্য করতে পারে?
–হ্যাঁ। এর ভেতরের জিনিসগুলো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে আপনাকে কিছু এখনই বলতে চাইছি না।
–বেশ, আর কিছু?
হ্যাঁ। এব্যাপারে যিনি ভারপ্রাপ্ত তাঁকে আগে থেকে একটু সতর্ক করে রাখা দরকার–একটা মৃতদেহ হয়তো আবিষ্কার হতে পারে
আমরা যেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি তার সঙ্গে জড়িত? সেই দশ বছর আগেকার ঘটনা–
-হ্যাঁ, বললেন মিস মারপল, এব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমি জানি সেটা কোথায় আছে।
–আশ্চর্য! কার দেহ
–যে মেয়েটি একই সঙ্গে উধাও হয়ে আর ফিরে আসেনি–নোরা ব্রড। কোন বিশেষ জায়গায় তার দেহটা রয়েছে বলে আমার ধারণা।
–কিন্তু তাহলে তো দেখছি আপনি খুবই বিপজ্জনক পথের মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার এখানে থেকে যাওয়াই উচিত–আমার ওপর নজর রাখার জন্য।
-না, তার দরকার হবে না। আপনাকে লণ্ডনে গিয়ে দশ বছর পুরনো হয়ে যাওয়া কিছু জিনিস আবার চালু করে তুলতে হবে।
–কিন্তু…এই পরিস্থিতিতে যে কোন মুহূর্তে আপনার বিপদ ঘটতে পারে–কোন এক বিশেষ ব্যক্তি কি আপনার সন্দেহের আওতায় রয়েছে?
-মনে হয় একজন সম্পর্কে কিছু কিছু জানি। সেকারণেই আমাকে এখানে থাকতে হবে। তবে আমার মতো বৃদ্ধার বিশেষ কোন বিপদের আশঙ্কা তার কাছ থেকে নেই।
–তাহলে এখন আপনি কি করতে চাইছেন? উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চাইলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।
–ভেরিটি হান্টের মৃত্যু ও এলিজাবেথ টেম্পলের মৃত্যুর মধ্যে একটা যোগসূত্র আমি খুঁজে পেয়েছি। মিঃ র্যাফায়েল এই উদ্দেশ্যেই যে আমাকে ম্যানর হাউসে পাঠিয়েছিলেন তা আমার কাছে এখন স্পষ্ট। এখন আমি অপেক্ষা করছি একজন মানুষের কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য। সেজন্যই আমার এখানে থাকা। আপনি আর দেরি করবেন না–তাহলে এই ট্রেনটা ধরতে পারবেন না।
–বেশ আর কি বলব–নিজের সম্পর্কে সাবধান থাকবেন।
এইসময় লাউঞ্জের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মিস কুক ও মিস ব্যারো।
প্রফেসর ওয়ানস্টেড ও মিস মারপল অবাক হলেন তাঁদের দেখে।
কোচের সঙ্গে তাঁদেরও যাবার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মত বদল করেছেন জানালেন তারা। দু-একদিন থেকে স্থানীয় কিছু দর্শনীয় দেখে যাবার ইচ্ছা তাদের। আপাতত গোল্ডেনবোরেই থাকবেন।
প্রফেসর ওয়ানস্টেড সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে ট্রেন ধরতে চলে গেলেন। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে মিস মারপল বললেন, বড় দয়ালু মানুষ। আমি ওঁর কোন আত্মীয় নই…তবু আমার জন্য এত ভাবেন–
-হ্যাঁ এমন হয়, মিস কুক বললেন, কাল আমরা গ্রোভে সেন্ট মার্টিন গির্জা দেখতে যাব-আশাকরি আপনি আমাদের সঙ্গী হবেন?
–আপনাদের সদাশয়তার জন্য ধন্যবাদ। শরীর কোনরকম বাধা না দিলে যেতে পারি।
.
১৮.
মধ্যাহ্নভোজের পর মিস মারপল বারান্দায় বসে কফি পান করছিলেন।
এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন অ্যানথিয়া ব্র্যাডবেরি স্কটের দীর্ঘ কৃশ মূর্তি সিঁড়ি বেয়ে উঠে তার দিকে এগিয়ে আসছে। খুব বাস্তবতার সঙ্গেই হাঁপাতে হাঁপাতে আসছিল মেয়েটি।
–ওঃ মিস মারপল, আপনি এখানে। আপনি কোচে সকলের সঙ্গে যাননি জানতে পেরে ক্লোটিলডা আর ল্যাভিনিয়া আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দিল। যে কদিন এখানে আছেন, আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। আমরা সবাই খুশি হব।
-ওঃ আপনারা বড়ই সদাশয়। আপনাদের সবকিছুই সুন্দর।
–আমি আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছি–এখুনি চলুন আমার সঙ্গে।
মিস মারপল আর আপত্তি করলেন না। তিনি তো এরকমই একটা আমন্ত্রণের প্রতীক্ষা করবেন বলে এখানে থেকে গিয়েছিলেন।
কুলির মাথায় সুটকেস চাপিয়ে দিয়ে তিনি অ্যানথিয়ার সঙ্গে আবার ম্যানর হাউসে এসে উঠলেন।
অন্য দুই বোন বসার ঘরেই ছিল। মিস মারপল তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
তার মাথায় নানান চিন্তা জট পাকাচ্ছিল। ক্লোটিলডা মেয়েটিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। ভেরিটির নাম উচ্চারিত হলেই তাঁর চোখে জলের ধারা নেমে আসে।
যাকে তিনি এতো ভালবাসতেন তাকে তার পক্ষে কি মারা সম্ভব?
অ্যানথিয়ার চালচলন গতিবিধিও সন্দেহজনক। সে পার্সেলটা নিয়ে ডাকঘরে গিয়েছিল। তার চোখের দৃষ্টি-বারবার পেছনে ফিরে তাকানো–এসবই অদ্ভুত। ও কি ভয় পেয়েছে, কোন কিছু সম্পর্কে ভয়? নাকি বোনেদের সম্পর্কে ভীত?
তারাও কি তাই? অ্যানথিয়া কি বলে বা করে বসে এই ভেবে তারাও কি ভীত?
ইতিমধ্যে মিসেস গ্লাইন চা নিয়ে এসেছিলেন! চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে মিস মারপলের মনে পড়ল মিস কুক আর মিস ব্যারোর কথা। তারা এখন কি করছে? মিস কুক সেন্ট মেরী মিডে গিয়ে তাকে দেখে এসেছিল…অথচ পরে তা অস্বীকার করে।
চা পান শেষ হলে মিসেস গ্লাইন চায়ের ট্রে নিয়ে উঠে গেল। অ্যানথিয়াও বাগানে চলে গেল। ঘরে রইলেন কেবল মিসেস মারপল আর মিস ক্লোটিলডা।
কথা শুরু করলেন মিস মারপল–আপনি আর্চডিকন ব্রাবাজনকে চেনেন মনে হয়?
–ও হ্যাঁ। গতকাল তিনি গির্জায় এসেছিলেন।
–তিনি পরে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য হোটেলে এসেছিলেন। মিস টেম্পলের খোঁজে হাসপাতালেও তিনি গিয়েছিলেন। বললেন মিস মারুপল।
–কি ঘটেছিল এ সম্পর্কে তিনি কোন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন?
–তেমন কিছু না। মিসেস পোর্টারের ভাইঝি কাউকে পাথর ঠেলতে দেখেছিল এটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার ধারণা ওরা অদ্ভুত এক কাহিনী বলেছে।
এই সময় মিসেস গ্লাইন ঘরে ঢুকলেন।–কি অদ্ভুত কাহিনী
–আমরা পাহাড়ের দুর্ঘটনার কথা বলছিলাম। বললেন ক্লোটিলডা। ভেরিটির মৃত্যুর পর থেকেই জায়গাটার আবহাওয়া কেমন ছমছমে হয়ে উঠেছে। একটা ছায়া…আপনি অনুভব করছেন মিস মারপল?
এই সময় একগুচ্ছ লিলিফুল হাতে নিয়ে অ্যানথিয়া বাগান থেকে ঘরে ঢুকল।
–অন্ত্যেষ্টির ফুল…এগুলো জলে ভিজিয়ে রাখব। বলল অ্যানথিয়া।
–ওসব করো না অ্যানাথিয়া-ওটা ঠিক নয়। বললেন ক্লোটিলডা।
মিসেস গ্লাইন অ্যানথিয়াকে অনুসরণ করে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।
–ও মাঝে মাঝে কেমন হয়ে যায়…হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত। বললেন ক্লোটিলডা, আমারও যেন কেমন বোধ হয় মাঝে মাঝে, ভেবেছি বাড়ি বিক্রি করে চলে যাব।
–হ্যাঁ, দুঃখের স্মৃতি নিয়ে বাস করা—
ও আমার মেয়ের মতই ছিল…আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুও…ওই মানসিক রোগগ্রস্ত ছেলেটিই—
মিঃ র্যাফায়েলের ছেলে মাইকেল?
-হ্যাঁ। ভাবতে পারিনি অমন ফুলের মত নিষ্পাপ ভেরিটি ওই বদ ছেলের প্রেমে পড়বে। অনেক বারণ করেছিলাম, কিছুতেই শুনতে চায়নি।
-ভেরিটি তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল? বললেন মিস মারপল।
–না, অতদূর গড়ায়নি মনে হয়। ছেলেটা তো এসব ভাবতেই পারে না।
–ওহ বড়ই মর্মান্তিক।
–আমার পক্ষে সবচেয়ে মারাত্মক হয়েছিল মৃতদেহ সনাক্ত করা। মর্গে গিয়ে…উঃ কী ভয়ঙ্কর
মিস ক্লোটিলডা আতঙ্কে ভয়ে চোখ বুজলেন।
একটু পরে চোখ খুলে বললেন, অ্যানথিয়াও আমার ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল সেই সময়।
–অ্যানথিয়া-কেন? বললেন মিস মারপল।
–ও কেমন ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ ভেরিটিকে ঘৃণা করতে শুরু করে। নিজের বোন…তবু মাঝে মাঝে মনে হয়…আমাদের একটা কথাবলা টিয়াকেও একবার গলা ছিঁড়ে মেরে ফেলেছিল। উঃ…উঃ…ভাবতে পারি না।
-ওসব কথা থাক মিস ক্লোটিলডা। বেদনার্ত স্বরে বললেন মিস মারপল।
-ভেরিটি এভাবে মারা গেলো বলে অন্য মেয়েরা অবশ্য ছেলেটির হাত থেকে বেঁচে গেল…যাবজ্জীবন কারাবাস হয়েছে তার। অবশ্য মানসিক রোগগ্রস্ত হিসাবেই তাকে দেখা উচিত ছিল।
কথা শেষ করে চোখ মুছতে মুছতে ক্লোটিলডা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ল্যাভিনিয়া গ্লাইন ঘরে ঢুকল। বললেন, ক্লোটিলডা সেই মেয়েটির মৃত্যুর পর থেকে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। ভেরিটিকে দারুণ ভালবাসত ও।
-উনি আপনাদের ছোট বোনটির জন্যেও চিন্তিত মনে হয়।
–অ্যানথিয়া? কে…জানালার কাছে কে গেল? চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ল্যাভিনিয়া।
-ওঃ আমাদের ক্ষমা করবেন, ঘরে ঢুকলেন দুই মূর্তি, মিস কুক আর মিস ব্যারো, মিস মারপল, আমরা আপনাকেই বলতে এসেছিলাম গির্জা দেখতে যাওয়া হয়নি আমাদের।…ঘণ্টা বাজলেও কাউকে বেরতে না দেখে ঢুকে পড়েছিলাম আমরা।
ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে কথা শেষ করে মিসেস গ্লাইনের দিকে তাকালেন মিস ব্যারো।
-বসুন, একটু শেরী আনছি বলে মিসেস গ্লাইন উঠে গেলেন।
একটু পরেই তিনি ফিরে এলেন শেরী নিয়ে। সঙ্গে এল অ্যানথিয়া। বললেন, মিস টেম্পলের ব্যাপারটা কি হবে বুঝতে পারছি না।
মিস ব্যারো বললেন, পুলিস ওই পাথরটার ব্যাপার নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। ওটা কেউ ঠেলে দিয়েছিল না, আপনা থেকেই পড়েছিল।
-পাথর কে ঠেলতে যাবে, বললেন মিস কুক, তবে কোন গুণ্ডা বা বিদেশী কেউ হলেও হতে পারে।
–কোচের সহযাত্রীদের কেউ বলতে চাইছেন? বললেন মিস মারপল।
-না, না, তা ঠিক বলিনি, ক্লোটিলডা বললেন, মিস মারপল, সম্ভাবনার কথাই আমি ভাবছিলাম।
–অনেক সম্ভাবনার কথাই ভাবা যায়। অ্যানথিয়া বলে উঠল, এমনও হতে পারে মিস টেম্পল একজন অপরাধী। কেউ তাকে অনুসরণ করে এসেছিল হয়তো।
–অসম্ভব, ক্লোটিলডা বললেন, তিনি একজন বিখ্যাত শিক্ষয়িত্রী। তাকে কে অনুসরণ করবে?
মনে হয় মিস মারপল কিছু ধারণা দিতে পারবেন, বললেন মিসেস গ্লাইন।
–আমার ধারণা, বললেন মিস মারপল, সত্যি কথা বলত কি, আসলে ওরা কাউকেই দেখেনি।
–মানে বলছেন, ওরা যা বলছে, তা ঠিক নয়? বলল অ্যানথিয়া।
–হ্যাঁ। আসলে অল্প বয়স তো, ওই বয়সে মজা করার একটা প্রবণতা থাকে। তাই করতে চেয়ে থাকবে—
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। ক্লোটিলডা বললেন, হতে পারে, বিচিত্র নয়।
–দুজনে মিলেই ব্যাপারটা করে থাকবে। মিস কুক বললেন।
-হ্যাঁ, ওরা দুজনে একই কাহিনী বলেছে, বললেন মিস মারপল, মিস টেম্পলকে হত্যা করার উদ্দেশ্য হয়তো তাদের ছিল না, পাথরটা গড়িয়ে দিয়ে মজা দেখতে চেয়েছিল হয়তো। আমার এরকমই মনে হয়।
–এরকম হওয়া অসম্ভব না। তবে আগে ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। ক্লোটিলডা বলল।
মিস কুক উঠে দাঁড়ালেন। মিস মারপলের উদ্দেশ্যে বললেন, এবারে ওঠা যাক, গোল্ডেনবোরে ফিরতে হবে। মিস মারপল
-ওহো, আপনারা জানেন না, বললেন মিস মারপল, মিস ব্র্যাডবেরি স্কট একটা রাত তাদের সঙ্গে কাটিয়ে যাবার অনুরোধ করেছেন আমাকে।
-খুব ভাল কথা। আপনার পক্ষে ভালই হবে।
ক্লোটিলডা বললেন, আপনারাও আসুন না, নৈশ ভোজের পরে কফি পান করবেন আমাদের সঙ্গে।
মিস কুক সহাস্যে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং যথাসময়ে আতিথ্য গ্রহণ করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সকলকে বিদায় জানালেন।
.
–মিস কুক আর মিস ব্যাপোর কথা বলছি, ওরা থেকে গেলেন কেন বুঝলাম না। নৈশ ভোজের টেবিলে মিস মারপলকে বললেন অ্যানথিয়া।
-ওদের নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা থেকে থাকবে। বললেন মিস মারপল।
পরিকল্পনা কেন? জানতে চাইলেন মিসেস গ্লাইন।
–খুনের ব্যাপারটাতে ওরা আগ্রহী হয়ে পড়েছেন বলছেন? মিসেস গ্লাইন।
–কেন নয়, অ্যানথিয়া বলল, খুন অবশ্যই। কেউ নিশ্চয়ই ঘৃণা করত, সুযোগ পেয়ে
-ঘৃণার জের কি এতবছর থাকে? বললেন মিস মারপল। এটা ঘৃণা নয়–ঘৃণার চেয়েও যা জোরালো তা হল ভালবাসা।
অ্যানথিয়া বলল, মিস কুক বা মিস ব্যারো এদের দুজনকে আপনার সন্দেহ হয়?
–না, না, ওরা এমন হতে পারেন না। বললেন মিসেস গ্লাইন।
কিন্তু ওদের কেমন রহস্যময় মনে হয়। অ্যানথিয়া বলল।
ক্লোটিলডা তাকে সমর্থন জানিয়ে বলল, আমারও যেন কেমন মনে হয় ওদের।
ঠিক সেই সময়েই, রাত তখন ৮:৪৫, অতিথিরা উপস্থিত হলেন। তারা আসন গ্রহণ করলে ক্লোটিলডা কাপে কফি ঢেলে ওদের পরিবেশন করলেন। পরে এককাপ মিস মারপলকে দিলেন।
মিস মারপলের দিকে ঝুঁকে মিস কুক নিচুস্বরে বললেন, এত রাতে, মাপ করবেন মিস মারপল, ঠিক মতো ঘুম হবে না। এ কফি আপনার পান করা উচিত না।
–তাই বলছেন, বললেন মিস মারপল, কিন্তু আমি তো এসময় কফি পান করি।
-কিন্তু এ খুব কড়া কফি। বলে মিস কুক, মিস মারপলের দিকে তাকালেন। দুজনের চোখাচোখি হল।
–আপনার কথা বুঝতে পেরেছি, বললেন মিস মারপল, তারপর কাপটা সামান্য সরিয়ে দিলেন, বললেন আর্চডিকন মেয়েটিকে, খুবই স্নেহ করতেন। তার কোন ছবি নেই?
-হ্যাঁ, আছে।
ক্লোটিলডা উঠে গিয়ে ওপরের ডেস্ক খুলে একটা ফোটোগ্রাফ এনে মিস মারপলের হাতে দিলেন।
এই ভেরিটি।
-বেচারি মেয়েটা; কি সুন্দর দেখতে। বললেন মিস মারপল। দেখা হলে তিনি হাত বাড়িয়ে ছবিটা ক্লোটিলডার হাতে দিতে গেলেন। সেই সময় ক্লোটিলডার হাতের ধাক্কা লেগে কফির কাপটা মেঝেয় ছিটকে পড়ল।
–ওহ্, কুঁকড়ে গেলেন মিস মারপল, কাপটা ফেলে দিলাম।
-না, আমার হাত লেগেই পড়ল, ক্লোটিলডা বলল, কড়া কফি বরং থাক, আপনাকে এককাপ দুধ দিচ্ছি।
-দুধ পান করা যেতে পারে। ঘুমটাও ভাল হবে তাহলে। বললেন মিস মারপল।
নানান প্রসঙ্গের আলোচনায় সকলে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটলেন। একসময় মিস কুক আর মিস ব্যারো ব্যস্তভাবে বিদায় নিলেন। কিন্তু কিছু একটা ফেলে গিয়েছিলেন। আবার ফিরে এসে সেটা নিয়ে গেলেন।
ক্লোটিলডা মিস মারপলকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। পরে তার জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসে টেবিলে রাখলেন।
-ওহ, আপনাদের আতিথেয়তার কথা কখনো ভুলব না। বললেন মিস মারপল।
–মিঃ র্যাফায়েল যে চিঠিতে আমাদের সেভাবেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। সব দিকেই তার সতর্ক নজর ছিল। বললেন ক্লোটিলডা।
–হ্যাঁ, তিনি খুবই বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। বললেন মিস মারপল।
তাকে শুভরাত্রি জানাবার আগে ক্লোটিলডা জিজ্ঞেস করলেন, সকালে কি এখানেই আপনার প্রাতঃরাশ পাঠিয়ে দেব?
-না, তার দরকার নেই, বললেন মিস মারপল, আমি নিচেই নামব-বাগানটা চমৎকার, ওই ফুলে ঢাকা ঢিবিটা ঘুরে ঘুরে দেখতে ভাল লাগবে। ঠিক আছে, শুভরাত্রি মিস ব্র্যাডবেরি স্কট।
প্রাচীন জমিদার বাড়ির দেয়াল ঘড়িতে রাত দুটোর ঘোষণা শুনতে পেলেন মিস মারপল। ঝিম ধরা অন্ধকারে সব ডুবে আছে।
ঢং ঢং শব্দে রাত তিনটের ঘোষণা হল। বাইরে হালকা পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। দরজাটাও যেন ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছিল। মিস মারপল বিছানায় উঠে বসলেন। সুইচ টিপে ঘরের আলো জ্বালালেন।
দেখা গেল ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন ক্লোটিলডা।
-ওহ, মিস ব্র্যাডবেরি স্কট, বলে উঠলেন মিস মারপল, কিছু বলবেন?
–আপনার কিছু দরকার কিনা জানতে এসেছিলাম।
ক্লোটিলডার মুখ থমথমে, বিষণ্ণ, গোলাপি দীর্ঘ পোশাকে শরীর আবৃত। তার দিকে তাকিয়ে মিস মারপলের মনে হল, যেন বিষাদের প্রতিমূর্তি।
-ওহ, ধন্যবাদ, আমার কিছু চাই না। দুধটা আমি পান করিনি।
–কি আশ্চর্য, কেন? অবাক হল ক্লোটিলডা। সে বিছানার পাশে এগিয়ে গেল।
–ওটা পান করা ঠিক হবে না, মনে হল। বললেন মিস মারপল।
–ঠিক হবে না–আপনার একথার অর্থ?
ক্লোটিলডার কণ্ঠস্বর, চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেল। মিস মারপল ধীরে ধীরে বললেন, আমি কি বলছি, আপনার বুঝতে না পারার কথা নয় মিস ব্র্যাডবেরি স্কট।
–ওহো, দুধটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই, আমি এখুনি গরম দুধ নিয়ে আসছি। ক্লোটিলডা দুধের গ্লাসটা তুলে নিলেন।
–মিছে আর কেন কষ্ট করবে। আমি ওই দুধ পান করতে পারি না, বুঝতেই পারছেন।
–অদ্ভুত সব কথা বলছেন। এভাবে কথা বলছেন কেন? কে আপনি?
–আমি, মৃদু হাসলেন মিস মারপল, আমি হচ্ছি নিয়তি।
–নিয়তি? একথার মানে?
–আমার ধারণা, মানেটা আপনার অজানা নয়। আপনি শিক্ষিত মহিলা। দেরি হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু নিয়তি নেমে আসে।
–আপনি
-হ্যাঁ, আমি বলছি একটি সুন্দরী ফুটফুটে মেয়ের কথা, যাকে আপনি নিজের হাতে মেরেছিলেন।
-কী বলছেন? কাকে আমি মেরেছিলাম?
–আপনার প্রিয় ভেরিটির কথা বলছি আমি।
–তাকে আমি মারব কেন?
কারণ আপনি ভেরিটিকে ভালবাসতেন। বড় ভয়ানক সে ভালবাসা। ওই চার অক্ষরের শব্দটি সম্পর্কে এরকম কথাই কদিন আগে আপনি আমাকে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। অন্য এক ভালবাসা মেয়েটির জীবনেও এসেছিল, একটি তরুণকে ভালবেসেছিল সে, চেয়েছিল নারীর স্বাভাবিক জীবন। অবশ্য যাকে বিয়ে করে ঘরসংসার পাতবার স্বপ্ন সে দেখেছিল, সেই ছেলেটি ভাল ছিল না।
ক্লোটিলডা যন্ত্রচালিতের মত এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসলেন। অপলক চোখে মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তাহলে সবই জেনেছেন–
-হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি।
–অস্বীকার করব না, আপনার কথা সবই সত্যি। কিন্তু সত্যি-মিথ্যেয়, আজ আর কি এসে যায়?
–ঠিকই বলেছেন, এতে কিছু যাবে আসবে না।
–কিন্তু আপনি যদি বুঝতেন, কী নিদারুণ যন্ত্রণা আমি সয়েছি। বুকের সবটুকু ভালবাসা স্নেহ উজাড় করে দিয়েছিলাম যাকে, এক অযোগ্য অপদার্থ মানুষের কাছে হারাতে বসেছিলাম তাকে–এ যে কী অসহ্য যন্ত্রণা
–আমি অনুভব করতে পারছি
–আমি তা হতে দিতে চাইনি–আমি পারি না–
-হ্যাঁ, আমি জানি, তারা বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আপনি তাকে খুন করেন। ভালবাসতেন বলেই আপনি তা করেছিলেন।
-আপনি বিশ্বাস করেন একথা? যাকে অন্তর উজাড় করে ভালবেসেছি তার মাথা এভাবে চূর্ণ করে খুন করা সম্ভব?
–আমি জানি, আপনাকে তা করতে হয়নি।
–তাহলে বলছেন কেন আমি খুন করেছি?
–আপনি ভেরিটির মাথা চূর্ণ করেননি। সেটা হয়েছে অন্য মেয়ের। ভেরিটি এখনো এখানে বাগানেই আছে। আমার ধারণা তাকে কফি বা দুধের সঙ্গে বেশিমাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন। সে মারা গেলে, বাগানের কাচঘরের নিচেই ইট পাথরের তলায় চাপা দিয়েছিলেন। তারপর সেখানে লাগানো হয় পলিগোনাম। বছর বছর সেই গাছের ফুলেই ঢেকে থাকে কাচঘর। এভাবেই ভেরিটিকে আপনি আপনার কাছে রেখে দিয়েছেন।
–মূর্খ! বাইরে গিয়ে এ কাহিনী বলার সুযোগ আপনাকে আমি দেব না।
–তা জানি, আপনার অনেক কম বয়স, আমার চেয়ে শক্তিও অনেক বেশি। আর
–আর কি?
-আপনার এখন হিতাহিত জ্ঞান থাকার কথা নয়। আপনি থেমে থাকতে পারেন না। দুদুটো মেয়েকে খুন করেছেন। যাকে ভালবাসতেন তাকে আর অন্য একজনকে।
সে একটা বাজে নোংরা মেয়ে। কিন্তু নোরা ব্রডকে আমি খুন করেছি আপনি জানলেন কি করে?
ওকে যেভাবে মেরেছেন, ভেরিটিকে সেভাবে মাথা গুঁড়িয়ে দিয়ে মারা আপনার পক্ষে সম্ভব হত না। ঘটনাক্রমে, ওই সময়েই মেয়েটি হারিয়ে গিয়েছিল। তাকে যখন পাওয়া গেল, তার দেহে ছিল ভেরিটির পোশাক। আপনি তাকে ভেরিটি বলে সনাক্ত করলেন। লোকে তাই জানল। কিন্তু আপনি জানতেন মৃতদেহটা ছিল নোরা ব্রডেরই, ভেরিটির নয়। হ্যাঁ, আপনি জানতেন।
–এসব আমি করতে চাইব কেন?
–কারণ, যে ছেলেটি ভেরিটিকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল, আপনি চেয়েছিলেন, খুনের অপরাধে তাকে সাজা দিতে। নোরার মৃতদেহ আপনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। তার মুখ বিকৃত করেছিলেন যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। তার গায়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন ভেরিটির পোশাক, পাশে রেখেছিলেন তার ব্যাগ, বালা। তারপর আপনি তাকে সনাক্ত করেন ভেরিটি বলে।
একটু থামলেন মিস মারপল। পরে বললেন, তৃতীয় খুনটা আপনি করেছেন একসপ্তাহ আগে। বেচারা মিস এলিজাবেথ টেম্পল। তিনি এ অঞ্চলে আসায় আপনি ভয় পেয়েছিলেন। আপনার ভয় ছিল, ভেরিটি তাকে কিছু জানিয়ে থাকতে পারে। তাই আর্চডিকন ব্রাবাজনের সঙ্গে যাতে মিস টেম্পলের সাক্ষাৎ হয় আপনি তা চাননি। পাছে সত্য উদঘাটিত হয়ে পড়ে। এই সম্ভাবনা বন্ধ করার জন্য আপনাকে কেবল একটা পাথর ঠেলে দিতে হয়েছিল। সেই শক্তি আপনার যথেষ্ট আছে।
-আপনার উপযুক্ত ব্যবস্থা করার মত শক্তিও আমার আছে। কর্কশ কণ্ঠে বললেন ক্লোটিলডা।
-তা মনে হয় আপনি পারবেন না। নিরাসক্ত গলায় বললেন মিস মারপল।
–পারব না…একটা দুর্বল বুড়ি..আপনাকে কেউ বাঁচাতে আসবে না এখানে।
–আমি সত্য পথের পথিক-আমাকে রক্ষা করবার জন্য তৈরি রয়েছে দেবদূত।
–দেবদূত। হিংস্র হাসি হাসলেন ক্লোটিলডা, দাঁড়িয়ে উঠে বিছানার দিকে এগোলেন।
–আমার রক্ষাকারী সম্ভবতঃ দুজন দেবদূত। বললেন মিস মারপল, মিঃ র্যাফায়েল তার কাজে কোন ত্রুটি রাখতেন না।
কথা শেষ করে তিনি বালিশের নিচে থেকে বের করে আনলেন একটা ছোট্ট বাঁশি। ঠোঁটের মাঝখানে রেখে ফুঁ দিলেন। সেই তীব্র জোরালো শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন মিস ব্যারো। বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মত ঘুরে দাঁড়ালেন ক্লোটিলডা। সেই মুহূর্তে দেয়ালের পাশে বড় আলমারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন মিস কুক। তাদের অন্য মানুষ মনে হচ্ছিল। সেই সন্ধ্যার সামাজিক ব্যবহারের ছিটেফোঁটাও তাদের হাবভাবে ছিল না।
–দুজন দেবদূত, বললেন মিস মারপল, মিঃ র্যাফায়েল তার যোগ্য কাজই করে গেছেন।
.
লণ্ডনের একটা সরকারী ভবন। সেই ঘরে উপস্থিত রয়েছেন প্রফেসার ওয়ানস্টেড ও মিস মারপল ছাড়াও একজন সরকারী উকিল, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সহকারী কমিশনার স্যার জেমস লয়েড, মেন্সটোন জেলের অধ্যক্ষ স্যার আন্ডু ম্যাকনীল এবং স্বরাষ্ট্র সচিব স্বয়ং।
প্রফেসর ওয়ানস্টেড মিস মারপলের উদ্দেশ্যে বললেন, ওই দুজন বেসরকারী মহিলা গোয়েন্দা যে আপনাকে রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত হয়েছেন, আপনি কখন বুঝতে পারলেন?
–গতকাল সন্ধ্যার আগে আমার কোন ধারণা ছিল না, বললেন মিস মারপল, মিস কুক সেন্টমেরী মিডে এসেছিলেন। কোচে তাকে অন্য বেশে দেখেই মনে হয়েছিল, আমাকে দেখে মনে রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আমার রক্ষক কি শত্রুপক্ষের কেউ তা নিয়ে ধাঁধায় ছিলাম। গতকাল সন্ধ্যাতেই আমি নিশ্চিত হলাম, যখন তিনি ক্লোটিলডার আনা কফি পান না করার ইঙ্গিত করলেন আমাকে। তার কৌশল ছিল অনবদ্য। তারপর বিদায় নেওয়ার সময় করমর্দন করার ফাঁকে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে যান একটা বাঁশি। ওটা গোপনে বালিশের তলায় রেখে দিই। মিস ব্র্যাডবেরি স্কট যাতে কিছু সন্দেহ করতে না পারে তার জন্য যথাযোগ্য সৌজন্য বজায় রাখি। তার দেওয়া দুধের গ্লাস গ্রহণ করি। কিন্তু ওই দুধ পান করা যে বিপজ্জনক তা জানতাম। তাই স্পর্শ করিনি।
–কিন্তু দরজা খোলা রেখেছিলেন কেন? জানতে চাইলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।
–আমি জানতাম দুধটা পান করার পর আমি কি অবস্থায় আছি তা জানার জন্য মিস ব্র্যাডবেরি স্কট একটু পরেই আসবেন। তাই দরজা বন্ধ করিনি। আমি তার কথা শুনতে চাইছিলাম।
–মিস কুক যে আলমারির ভেতরে লুকিয়ে আছেন, আপনি তা জানতেন?
–একদম না। তাকে দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হই।
–ওই দুজন বাড়িতে আছেন, আপনি জানতেন?
–বাঁশিটা পাবার পর বুঝতে পেরেছিলাম তারা কাছাকাছি থাকবেন। বাড়ির সবাই যখন শুতে যান সেই সময় সম্ভবত তারা ভেতরে ঢোকেন।
-ওহ, এই অবস্থায় মারাত্মক ঝুঁকি আপনি নিয়েছিলেন, মিস মারপল।
–আমি বাধ্য ছিলাম। কারণ আমি সত্য উদঘাটনে বদ্ধপরিকর ছিলাম।
-ডাকঘরের ওই পার্সেলটার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। ওর ভেতরে পুরুষদের উপযোগী লালকালো ডোরাকাটা একটা গলাবন্ধ জাম্পার ছিল। কিন্তু পার্সেলটার কথা আপনি ভেবেছিলেন কেন?
–ওরকম একটা জাম্পারের কথা যোয়ানা আর এমলিন বলেছিল। ওদের নজরে পড়েছিল। ওরকম রঙচঙে জিনিস সহজে ফেলা যায়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তাই জানতাম পোশাকটা কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যাবে না। ওটা নাগালের বাইরে সরিয়ে দেবার সহজ পথ ছিল ডাক মারফত কোন দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেওয়া। কোথায় পাঠানো হয়েছে সেই ঠিকানাটা আমি জানতাম না।
–ঠিকানাটা পেলেন কি ভাবে?
–ডাকঘর থেকে। তবে একটু কৌশল করতে হয়েছিল। পোস্টমিস্ট্রেস ভালমানুষ ছিলেন। তাকে জানালাম ঠিকানাটা ভুল লিখে ফেলেছি। বয়স হয়েছে, মনে রাখতে পারি না সব। তিনি আমাকে ঠিকানাটা জানাল।
-একেবারে পাকা অভিনেত্রীর মত কাজ, বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড, কিন্তু একটা কথা, দশ বছর আগে যে ঘটনা ঘটল, তার হদিশ আপনি পেলেন কি ভাবে?
এরকম একটা তথ্য ছাড়া কাজে জড়িত হওয়ায় প্রথমে খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু মিঃ র্যাফায়েল বিচক্ষণ ব্যক্তি, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছিল তার প্রতিটি কাজে। তিনি এমন ব্যবস্থা করেছিলেন। তার সরবরাহ করা তথ্য প্যাকেটের মাধ্যমে মাঝেমাঝেই আমি পেয়ে গেছি। তাতে আমার পথ সহজ হয়েছে।
–কোথাও বাধার মুখে পড়তে হয়নি?
-না, তেমন কিছু ঘটেনি। তবে মিস এলিজাবেথ টেম্পলের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত মূল ঘটনার কোন আভাসই পাইনি। তার সঙ্গে আলাপ হবার পরেই বুঝতে পারি আমাকে একটা গ্রন্থি মোচন করতে হবে। সেই গ্রন্থিতে রয়েছে একজন হত্যাকারী আর একজন মিথ্যার শিকার।
ওয়েস্ট ইণ্ডিজে মিঃ র্যাফায়েলের সঙ্গে আমার যোগাযোগের সূত্র ছিল একটা খুন। সেই খুন আর খুনীকে কেন্দ্র করেই আমরা একসঙ্গে মিলিত হই। সেই সুবাদেই, আমি বুঝতে পারি এখানেও নিশ্চয়ই কেউ খুন হয়েছে আর অন্যায় ভাবে সাজা পাচ্ছে কেউ।
মিস টেম্পল আমাকে জানিয়েছিলেন, একটি মেয়েকে তিনি চিনতেন, সে মিঃ র্যাফায়েলের ছেলেকে বিয়ে করতে বাগদত্তা ছিল। কিন্তু তারা বিয়ে করবার আগেই মেয়েটি মারা যায়।
আমি জানতে চাইলাম, কিভাবে মারা যায় মেয়েটি। তিনি উত্তরে কেবল বলেছিলেন, ভালবাসা। তার কথার সঠিক অর্থ তখন আমি ধরতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম বিয়ে করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। তিনি আরও একটা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা আমাকে বলেছিলেন। বলেছিলেন তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছেন। পরে জানতে পেরেছিলাম আসলে তিনি কোন জায়গায় কার কাছে যাচ্ছিলেন। আর্চডিকন ব্রাবাজন সম্পর্কে কোন ধারণাই আমার ছিল না।
যাইহোক, কোচের যাত্রীদের মধ্যে খুনী হিসেবে সন্দেহভাজন কাউকে মনে হয়নি। তবে নজর রেখেছিলাম দুই তরুণ-তরুণীর ওপর। তারা হল যোয়ানা আর এমলিন প্রাইস।
–মিস এলিজাবেথ টেম্পলের মৃত্যুর আগে আর কোন ঘটনা ঘটেনি?
–হ্যাঁ, ঘটেছে। আমার ম্যানর হাউসে অতিথি হওয়া। সে ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন মিঃ র্যাফায়েল। ওখানেই তার পরবর্তী নির্দেশ পাওয়া যাবে, এমন ধারণা হয়েছিল আমার। কিন্তু জানতাম না যে খোদ অকুস্থলেই আমাকে পৌঁছে দিয়েছেন মিঃ র্যাফায়েল।
ম্যানর হাউসে গিয়ে সাক্ষাৎ পেলাম তিন বোনের। প্রাচীন আমলের জমিদার ভবন, তার পরিবেশ, বাগান সব মিলিয়ে কেমন একটা গা শিরশিরানো অবস্থা হল আমার। মনে হল বাড়ির আনাচে-কানাচে যেন ভয় জমাট বেঁধে আছে।
তিন বোনের মধ্যে ক্লোটিলডার ওপরেই আমার প্রথমে নজর পড়ল। যথার্থ ব্যক্তিত্বময়ী চরিত্র। বোনদের মধ্যে বৈশিষ্টপূর্ণ। মনে হল খুন করার মতো মানসিক জোর যদি কারোর থাকে, তিন জনের মধ্যে এরই থাকা সম্ভব। যদিও, খুন বা খুনীর বিষয়ে স্পষ্ট কোন ধারণাই এখনো পর্যন্ত আমার ছিল না।
অ্যানথিয়াকে দেখে মনে হল, সারাক্ষণ সে কেমন ভীত হয়ে রয়েছে। থেকে থেকে পেছন ফিরে তাকায়–যেন পেছনে কারো পদশব্দ শুনে চমকে উঠছে।
দ্বিতীয় দিনে তাকে নিয়ে বাগানে গেলাম। কাচঘরের ধ্বংসস্তূপের ওপরে পলিগোনামের লতা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই লতা এমনই অদ্ভুত যে দ্রুত বেড়ে উঠে সবকিছু গ্রাস করে ফেলে।
স্তূপের কাছে গিয়ে আনথিয়া কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তার চোখেমুখের ভীত ভাব আমার চোখ এড়াল না। সবই কেমন রহস্যময় হয়ে উঠতে লাগল–আমিও আগ্রহী হয়ে উঠতে লাগলাম।
ইতিমধ্যে ঘটল সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এলিজাবেথ টেম্পল মারা গেলেন। তার পরেই আমার চোখের ওপর থেকে যেন প্রহেলিকার যবনিকা সরে গেল। আমি বুঝতে পারলাম তিনটে খুন হয়েছে।
মিঃ র্যাফায়েলের ছেলের কথা শুনলাম। ভেরিটি হান্ট নামের মেয়েটাকে সে খুন করেছে, সেকথা সকলেই জানে। একমাত্র আর্চডিকন ব্রাবাজন জানতেন ওরা দুজন পরস্পরকে ভালবাসত। সেই ভালবাসার পরিণতি খুন হতে পারে না। কিন্তু খুনের কারণ তিনিও ভেবে পাননি।
এলিজাবেথ টেম্পলের সেই আশ্চর্য কথাটি-ভেরিটির মৃত্যুর কারণ ভালবাসা আমাকে পথ দেখিয়ে দিল এবারে। ভালবাসা–মেয়েটির প্রতি ক্লোটিলডার সর্বগ্রাসী ভালবাসাই খুনের ঘটনার মূল কারণ, বুঝতে পারলাম।
ভেরিটি এই উন্মত্ত ভালবাসার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চাইছিল। পুরুষের ভালবাসা, সংসার সন্তান তার কাম্য ছিল। মাইকেলকে বিয়ে করার সংকল্পের কথা সম্ভবত সে তার প্রাক্তন শিক্ষয়িত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল।
আর্চডিকন ব্রাবাজন ওদের নির্দিষ্ট করা সময়ে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ভেরিটি এলো না। মাইকেলও জানতে পারল না কিছু। অনুমান করতে পারি, ভেরিটির হাতের লেখা নকল করে তাকে হয়তো জানানো হয়েছিল, সে শেষ মুহূর্তে মন পরিবর্তন করেছে।
ক্লোটিলডা মেয়েটিকে ছেলেটির কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার উন্মত্ত ভালবাসা তাকে বুঝিয়েছিল, ওরকম একটি বদ স্বভাবের ছেলের কাছ থেকে মেয়েটিকে বাঁচাতে হলে তাকে খুন করেই তা করতে হবে। তিনি তাকে তার অজান্তে পানীয়ের সঙ্গে বিষপান করান। তারপর তার মৃতদেহটা কাচঘরের ইট পাথরের তলায় কবর দিয়ে দেন।
–অন্য বোনেরা কি কিছুই সন্দেহ করেনি?
–বোনেদের মধ্যে মিসেস গ্লাইন তখন ওখানে ছিলেন না। অ্যানথিয়া ছিল, সে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও একেবারে কিছু আন্দাজ করতে পারেনি তা নয়। ক্লোটিলডার ধ্বংস্তূপ সম্পর্কে হঠাৎ আগ্রহ বৃদ্ধি, পলিগোনাম লতা লাগানো, তারপর অ্যানথিয়া কাচঘর তৈরি করার কথা বললে অসন্তোষ প্রকাশ করা–এসব তাকে সন্দিহান করে তুলেছিল।
এরপর ক্লোটিলডা নোরা ব্রড নামের মেয়েটির দিকে হাত বাড়াল। পিকনিকের নাম করে তাকে একদিন গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করেন। তারপর মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দেহটা প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে নালায় ফেলে আসে। আর গুজব ছড়াতে থাকে ভেরিটিকে সর্বশেষ দেখা গেছে, মাইকেলের গাড়ি করে যেতে।
অ্যানথিয়া বুঝতে পেরেছিল, সে যে কিছু কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে ক্লোটিলডা তা জেনেছে। তাই সে সারাক্ষণ ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত, ক্লোটিলডা আবার কি করে বসে। হাওয়ার শব্দে থেকে থেকে পেছন ফিরে তাকানোর অদ্ভুত এক মানসিকতার রোগী হয়ে উঠেছিল সে। আমার ধারণা.সে-ও রেহাই পেত না। তাকেও একদিন মরতে হতো। হয়তো বিষপ্রয়োগেই। একইভাবে ক্লোটিলডা আবার কোন একটা অজুহাত রটনা করে দিত।
প্রফেসর ওয়ানস্টেড বললেন, সেই পুরনো থিওরি, অপরাধ অপরাধকে টেনে আনে। আচ্ছা, সে রাতে আর কি হয়েছিল জানেন?
ক্লোটিলডার কথা বলছেন? দুধের গ্লাস হাতে নিয়েই তো তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। দুধটা কি উনি পান করেছিলেন?
-হ্যাঁ। ওতে যে বিষ মেশানো থাকতে পারে কেউ ভাবেনি। তাই বাধাও দেয়নি।
বিষ মেশানো দুধ পান করেই শেষ পর্যন্ত তাকেও পালাতে হল। তার পক্ষে এই পরিণতিই স্বাভাবিক ছিল। দশবছর ধরে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছেন তিনি। ভালবাসার দাহ–শেষ পর্যন্ত নিজেই নিজের ওপর প্রতিশোধ নিলেন। বেচারি ভেরিটি নারীর স্বাভাবিক ও সাধারণ চাওয়া স্বামী সংসার সে চেয়েছিল, কিন্তু পেল না। তার সব চাওয়া-পাওয়া সমাহিত হয়ে রইল কাচঘরের ধ্বংসস্তূপের নিচে–এ দুঃখ সওয়া যায় না।
বত্রিশ বছরের যুবক মাইকেল র্যাফায়েলের সঙ্গে মিস মারপলের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।
-মাইকেল, ইনি মিস মারপল, তোমার ব্যাপারে ইনিই সবকিছু করেছেন।
–সুদর্শন তরুণ মুখ তুলে তাকাল। স্মিত হাসল।
–ওঃ, হ্যাঁ, নামটা শুনেছি। অনেক ঝামেলা সয়েছেন আপনি, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
প্রফেসর ওয়ানডেকে উদ্দেশ্য করে বলল সে, শুনেছি, ওরা নাকি আমাকে ছেড়ে দেবার কথা ভাবছে?
–হ্যাঁ, বললেন ওয়ানস্টেড, তুমি শিগগিরই মুক্তি পাবে।
–এবার তুমি স্বাধীনভাবে নিজের জীবন তৈরি করার সুযোগ পাবে, স্নেহার্দ কণ্ঠে বললেন মিস মারপল, সবকিছুই করেছেন তোমার বাবা।
–আমার বাবা? তিনি কি আমার সম্পর্কে ভেবেছিলেন?
–হ্যাঁ। বললেন মিস মারপল, মৃত্যুশয্যায় থেকেও তিনি চেয়েছিলেন তুমি যাতে অন্যায়ের শিকার না হও। তিনি নিজেও ন্যায়বান মানুষ ছিলেন। আমাকে চিঠিতে সেকথাই লিখেছিলেন।
মাইকেল অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকল শুভ্রকেশ বৃদ্ধার মুখের দিকে।
–বিদায়, তোমার জন্য অন্তরের শুভকামনা রইল।
.
অদ্ভুত মহিলা। যেমন বলেছিলেন, কাচঘরের মেঝের নিচে মৃতদেহটা পাওয়া গেছে। মিঃ সুস্টার বললেন।
–উনি আসবেন এখনই। বললেন মিঃ ব্রডরিব।
–সবই কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। বললেন মিঃ সুস্টার।
এই সময় ঘরে ঢুকলেন মিস মারপল। ওরা দুজন তাকে অভ্যর্থনা জানালেন।
–আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
–আমি আমার শর্ত পালন করতে পেরেছি, এটাই আমার আনন্দ, বললেন মিস মারপল।
–মিঃ র্যাফায়েলের নির্দেশ অনুযায়ী এবারে বিশ হাজার পাউণ্ড আপনার–ওটা কি আপনার ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেব? বললেন মিঃ ব্রডরিব।
–তাই করুন। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন মিস মারপল।