ডাবল সিন

ডাবল সিন 

আমার গোয়েন্দা বন্ধু এরকুল পোয়ারো বেশ কিছুদিন হল কাজে ভীষণ ব্যস্ত। তাই আমার এখানেও সে আসতে পারছিল না। 

কাজের চাপ কিছুটা কম হওয়াতে সে সেদিন নিজেই আমার কাছে এসে হাজির হল।

আচ্ছা হেস্টিংস, আমার বন্ধু জোসেফ অ্যারনসের কথা তোমার মনে আছে। সেই যে যার থিয়েটারের এজেন্টের কারবার আছে, পোয়ারো আমার দিকে একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বলল। 

আমি চেনার ভান করে মাথা নাড়লাম। কেননা রাস্তার জমাদার থেকে শুরু করে অভিজাত সমাজের ডিউক, এদের মধ্যে পোয়ারোর কত বন্ধু যে ছড়িয়ে আছে তা মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। 

পোয়ারো খামটা আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা জোসেফ অ্যারনসের লেখা চিঠি, জোসেফ একটা ঝামেলায় পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। তাছাড়া অতীতে আমি ওর অনেক সাহায্য পেয়েছি তাই আমি ওর কাছে যাব বলে স্থির করেছি। তা তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে রাজি আছ। জোসেফ এখন চার্লক বেতে এসে উঠেছে। 

আমি বললাম, নিশ্চয়ই যাব। তাছাড়া চার্লক বেতে আমার আগে যাওয়া হয়নি। মনে হয় জায়গাটা সবদিক থেকে আমাদের পছন্দসই হবে। 

পোয়ারো বলল, সে তো ভালো কথা, কিন্তু চার্লক যেতে যেতে গেলে কীভাবে যেতে হবে তার খোঁজ খবর তো দরকার। ক-বার ট্রেন পালটাতে হবে ক-টায় ট্রেন ছাড়ে। তা তুমি কি এই দায়িত্বটা নেবে? 

আমি বললাম, এ আর এমন কী কাজ। হয়তো দু থেকে একবার ট্রেন পালটাতে হবে। আমরা থাকি ডিভনের দক্ষিণ উপকূলে আর চার্লক বেতে যেতে হলে যেতে হবে ডিভনের উত্তর উপকূলে। তা পুরোপুরি একদিন তো লাগবেই। 

যাই হোক আমি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম চার্লক বেতে যে সব ট্রেন যায় সেগুলো ভালো আর নির্ভরশীল ভদ্রলোকেরা নির্ভয়ে তাতে করে যেতে পারে। আর এও জানলাম যে মাঝপথে এক্সেটারে শুধু একবার ট্রেন পালটাতে হবে। 

খবরটা নিয়ে পোয়ারোকে দেব বলে যেই পা বাড়িয়েছি হঠাৎ মাঝপথে এক ভ্রমণ সংস্থার অফিসের সামনে একটা লেখা দেখে থমকে দাঁড়ালাম, তাতে লেখা : 

“আগামীকাল, চার্লক বেতে সপরিবারে পুরো দিনটা উপভোগ করে আসুন। ডিভন এলাকার কিছু সুরম্য দৃশ্যাবলী দেখতে যাবেন। যাত্রা শুরু সকাল সাড়ে আটটায়। ভিতরে অফিসে বিস্তারিত খোঁজ খবর নিন।” 

আমি ভিতরে গিয়ে চার্লক বেতে যাবার বিস্তারিত খোঁজ খবর নিলাম। পোয়ারোর কাছে যখন খবর দিতে গেলাম তখন আমার মনে এক উৎসবের আনন্দ, কিন্তু দুর্ভাগ্য পোয়ারো সেটা এতটুকুও অনুভব করল না। 

পোয়ারোকে বাসের খবরটা দিতে সে বলল, কিন্তু হেস্টিংস, তুমি ট্রেনের বদলে বাসে যেতে চাইছ কেন? বাসে টায়ার মাঝপথে ফেটে যেতে পারে কিন্তু ট্রেনে সে ঝামেলা নেই। আর ট্রেনের জানালা দিয়ে যে হাওয়া পাওয়া যায় তা বাস বা অন্য গাড়িতে পাওয়া যায় না। 

থাকগে বলো, চার্লক বেতে গিয়ে পৌঁছে যথেষ্ট সময় আমরা কি হাতে পাব? 

বুঝলাম চার্লক বেতে বাসে যেতে পোয়ারোর আর কোনো আপত্তি নেই। 

আমি বললাম, আমরা ডার্টমুরের পাশ দিয়ে যাব, লাঞ্চ খাব মংকহ্যাম্পটনে। চার্লক বেতে পৌঁছাব বিকেল চারটে। তারপর বাস ধরে বিকেল পাঁচটার আগে রওনা হব না। এখানে ফিরতে রাত দশটা ঠিক বাজবে। তাতে মনে হচ্ছে চার্লক বেতে আমাদের অন্তত একটা রাত কাটাতে হবে। 

তাহলে আমরা যে বাসে যাব সেই বাসে ফিরব না। পোয়ারো বলল, তাহলে তো আমাদের যাতায়াতের মোট ভাড়ার ওপর কিছু ছাড় পাওয়া উচিত। 

আমি বললাম, তা তো উচিত। কিন্তু সেটা কি পাওয়া যাবে? 

পোয়ারো বলল, তোমার জোর দেওয়া উচিত। 

আমি বললাম, দেখো পোয়ারো সঞ্চয়ী হওয়া ভালো তবে এতটা না যাতে ছোটো দেখায়। তুমি তো এখন গোয়েন্দাগিরি করে ভালোই রোজগার করো। 

পোয়ারো বলল, আমি কোটিপতি হলেও তাই করতাম, আমি ঠিক ততটাই দিতে রাজি যতটুকু ন্যায্য আর সঙ্গত। 

পোয়ারোর একগুঁয়েমির কাছে আমি হেরে গেলাম। আবার আমাকে সেই ভ্রমণ সংস্থার অফিসে ছুটতে হল। তারা তো ছাড় দিতে রাজি হলই না উলটে ওই একই বাসে ফেরার জন্য চাপ দিল। ভাগ্য ভালো এবারে আমি একা যাইনি পোয়ারো আমার সঙ্গে ছিল। 

বুকিং ক্লার্ককে আমরা বোঝাবার চেষ্টা করলাম আমরা যেদিন যাব সেদিন ফিরব না। সে বলল, তাহলে আপনাদের দু’জনকে ফেরাবার জন্য যদি চার্লক বেতে বাসকে একদিন বসিয়ে রাখতে হয় তাহলে তার জন্য বাড়তি ভাড়া দিতে আপনারা বাধ্য। 

এর পর আর কোনো বুদ্ধি পোয়ারোর মাথায় এল না। গাড়ি ভাড়ার টাকা সে আগাম মিটিয়ে দিল। 

ভ্রমণ সংস্থার অফিস থেকে বেরিয়ে পোয়ারো বলল, তোমরা ইংরেজরা নিজেদের ভালো ব্যাবসায়ী বলে জাহির করো কিন্তু টাকা পয়সা কীভাবে খরচ করতে হয় তা জানো না। 

আমি বললাম, তা এমন খোঁটা দেবার মানে? 

খোঁটা দিচ্ছি তার কারণ আমার সঙ্গে এতদিন থেকেও অনেক কিছুই তোমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে যায়। আমরা যখন বুকিং ক্লার্কের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন একজন কম বয়সি ছেলেকে লক্ষ্য করেছ? 

নিজের জেদ বজায় রাখতে বললাম, হ্যাঁ দেখেছি। তা তার মধ্যে এমন কি বৈশিষ্ট্য দেখলে যে তাকে মনে রাখতে হবে? 

ওই ছেলেটা চার্লক বেতে যাবার পুরো ভাড়া দিল কিন্তু বলল, মংকহ্যাম্পটনে নেমে যাবে অর্থাৎ পুরো ভাড়া দিয়ে মাঝপথে নামবে। বুকিং ক্লার্কের তো পোয়া বারো। এরকম যত যাত্রী আসবে ওদের কারবার তত ফুলে ফেঁপে উঠবে। তাই বললাম, তোমার ইংরেজরা খরচ কীভাবে করতে হয় তা জানো না। 

আমি হার স্বীকার করে বললাম, না ভাই পোয়ারো, এব্যাপারটা আমার চোখে পড়েনি। আসলে আমি তখন— 

পোয়ারো বলল, বুঝেছি বুঝেছি তুমি তখন একটি অল্প বয়সি মেয়ের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েছিলে, পোয়ারো মুচকি হেসে বলল, সে কিনা আমাদের পাশের সিটটাই ভাড়া করেছে। আমি তেরো আর চোদ্দ নম্বর সিট নিতে গেলে তুমি ভাবলে আমি ব্যাগরা দিচ্ছি। তাই তুমি তাড়াতাড়ি তিন আর চার নম্বর সিট বেছে নিলে। আসলে বয়স হলে এমনই হয়, পেটের আর চোখের খিদে বেড়ে যায়। তুমি আবার মিলিটারি থেকে রিটায়ার করেছ। তোমার ক্ষেত্রে এটা তো স্বাভাবিক। এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই। আমি এও জানি সারাটা পথ তুমি ওই রূপসীকে দেখতে দেখতে যাবে। 

পোয়ারো কৌতুক করলেও ধরা পড়ে আমি সত্যি লজ্জা পেলাম। 

আমি পোয়ারোকে ধমকের সুরে বললাম, তুমি চুপ করলে? 

পোয়ারো আবার কৌতুক করল, আহা একমাথা লালচে থোকা থোকা চুল। রহস্য যে লালচে চুলের মেয়েরা তোমায় কেন এত আকর্ষণ করে। ইস্ যৌবনের দিনগুলো কেন যে এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। 

আমি রাগ করে বললাম, তা তোমার ওই অল্প বয়সি ছেলেটার থেকে ওই রূপসী মেয়েটা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। 

পোয়ারো বলল, যাই বলো ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, ওই অল্প বয়সি ছেলেটা সম্পর্কে আমার কৌতূহল জেগেছিল। যা এখনও বজায় আছে। 

পোয়ারোর এই কথায় কিছু একটা শক্তপোক্ত অর্থ আছে বুঝলাম। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি একটু আগে তার মুখে যে কৌতুকের হালকা প্রলেপ পড়েছিল তা কোথায় উধাও হয়ে গেছে। আবার তার মুখে চোখে ফিরে এসেছে আমার বহুদিনের চেনা সেই গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারোর ছাপ। 

আমি বললাম, কী ব্যাপার বলো তো? তুমি কি বলতে চাইছ? 

পোয়ারো বলল, বন্ধু এখনই এত উত্তেজিত হয়ো না। আসলে কী হয়েছে জানো, ওই ছেলেটা তার ঠোঁটের ওপর একজোড়া গোঁফ গজানোর চেষ্টা করছে, সেটা আমার চোখ এড়ায়নি। আর ওর এই চেষ্টা যে বিফল হয়েছে তাও আমি লক্ষ্য করেছি। যাদের গোঁফ নেই তাদের এই চেষ্টাকে শিল্প বলা যায়। আর যারা এই শিল্পচর্চা করে তাদের সবার প্রতি আমার সহানুভূতি আছে। 

পোয়ারোকে আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না, ও কখন কোনো কথা গুরুত্বপূর্ণ-ভাবে বলে আর কখন হালকাভাবে বলে বোঝা কঠিন, তাই আর কোনো কথা না বলে চুপ করে গেলাম। 

বাকি পথটুকু বাড়ি ফেরার পরেও এই সম্বন্ধে পোয়ারো আর কোনো মন্তব্য করল না। পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশ পরিষ্কার নীল, কোথাও মেঘের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। 

পোয়ারো ভীষণ সাবধানী মানুষ। আকাশের অবস্থাকে তার বিশ্বাস নেই তাই সে গরম পোশাকের ওপর মোটা পশমি ম্যাকিন্টাস পড়ল। তার ওপর পেল্লাই একখানা ওভারকোট দুটো মাফলার দিয়ে মাথা, কান, গলা, ঢেকে তার ওপর চাপাল একটা পশমি টুপি। এখানেই শেষ নয় সঙ্গে নিল সর্দি আর জ্বরের বড়ির শিশি আর কয়েকটা বড়ি তখনই মুখে চালান করে দিল। 

আমরা কয়েকটা ছোটো ছোটো সুটকেশ সঙ্গে নিলাম। ভ্রমণ অফিসের সামনে গিয়ে দেখলাম নির্দিষ্ট বাসটি অনেক আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের জন্য তারা অপেক্ষা করছে। গতকালের সেই সুন্দরী যুবতী আর পোয়ারোর সেই গোঁফ শিল্পী ছোঁড়াটিও এসে হাজির। তাদের দু-জনের হাতে দুটো সুটকেশ। ড্রাইভার আমাদের হাত থেকে সুটকেসগুলো নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিল, আমরা বাসের ভিতর গিয়ে যে যার সিটে বসলাম। 

পোয়ারো আমাকে জানালার ধারে পাঠিয়ে দিল আর গতকাল যে রূপসী যুবতীকে নিয়ে আমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছিল নিজে দিব্যি তার সঙ্গে আড্ডায় জমে উঠল। 

খোলা জানালার হাওয়া খেতে খেতে আমার কানে ওদের কথার কিছু অংশ আসতে লাগল। 

মেয়েটির কথাবার্তার ধরন দেখে বুঝলাম তার বয়স খুবই কম, আঠারো কী উনিশ হবে। আর জানলাম মেয়েটি যাচ্ছে তার মাসির বাড়িতে। তার মাসি পেশায় ব্যাবসায়ী। বে মাউথে তাঁর একটা প্রাচীন আর দুর্লভ প্রত্ন বস্তু বিক্রির দোকান আছে। আর তাদের কথাবার্তার ফাঁকে জানলাম মেয়েটির নাম মেরী ডুরান্ট। 

মেরী তার ব্যাবসায়িক প্রয়োজনেই তার মাসির কাছে যাচ্ছে। মেরীর মাসির অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ সচ্ছল ছিল কিন্তু অকালে তাঁর বাবা মারা যাওয়ায় তিনি খুবই অসুবিধায় পড়েন। তখন তাঁর বাবা যে টাকা পয়সা রেখেছিল সেই দিয়ে আর তার ঘরে যে সব সাজানোর উপকরণ ছিল সেগুলো দিয়ে তার ব্যাবসা শুরু করেন। অসীম ধৈর্য, সততা আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে ভদ্রমহিলা অল্প সময়ে ব্যাবসায়ে প্রতিষ্ঠিত হন। মেরী তার মাসির সঙ্গে থাকতে থাকতে ব্যাবসার কাজকর্ম অনেকটাই শিখেছে। কিন্তু তার নিজের পছন্দ ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের গভর্নেসের পেশা। 

মেরীর সমস্ত কথা পোয়ারো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তারপর পোয়ারো বলল, তুমি যে পেশা গ্রহণ করতে চলেছ সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিন্ত যে এটা তোমাকে সাফল্য এনে দেবে। তুমি সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে তোমাকে আমি কিছু উপদেশ দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি। 

জেনে রাখবে এই দুনিয়াতে ভালো আর সৎ লোকের পাশাপাশি মন্দ আর অসৎ লোকের বাস। এই ধরো এই বাসেই তারা নানা রূপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাই কাউকে কখনও সন্দেহের উর্দ্ধে রেখো না। সব সময় সাবধানে থাকবে। 

আমি বুঝতে পারছিলাম না পোয়ারো কী আকারে ইঙ্গিতে আমাকেই বোঝাতে চাইছে! কেননা গতকাল আমি যে এই মেয়েটির প্রতি দুর্বলতা দেখিয়েছিলাম। পোয়ারোকে বিশ্বাস নেই, ও বন্ধুত্বের তোয়াক্কা না করেই কখন কী বলে দেবে ঠিক নেই। 

মেয়েটি চুপচাপ মুখ বুজে পোয়ারোর কথাগুলো গিলছে। পোয়ারো বলল, কে বলতে পারে আমি যে তোমাকে এতক্ষণ সাবধান করলাম, দেখা যাবে আমিই হয়তো তোমার এমন বিরাট একটা ক্ষতি করলাম তুমি স্বপ্নেও ভাবতে পারোনি। 

মেরী প্রথম থেকেই পোয়ারোর জ্ঞান হজম করছে। পোয়ারোর এই মন্তব্যে তার মুখের হাঁ আগের থেকে আরও একটু বড়ো হল। চোখ দুটোও আর বিস্ফারিত হল। 

আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এত জ্ঞান দেবার প্রয়োজনটাই বা কী? পোয়ারো এই বুড়ো বয়সে আবার এই নাতনির বয়সি মেয়েটার প্রেমে পড়ল না তো? নাকি আগে থেকে নিজের লাইন ক্লিয়ার করে রাখছে? আবার এও হতে পারে তার আসল উদ্দেশ্য আমাকে তাতানো। এরকম নানা প্রশ্ন আমার মনে জাগতে লাগল। 

বাস অনেকক্ষণ চলার পর মংকহ্যাম্পটনে এসে থামল। এখানেই আমাদের লাঞ্চ সেরে নিতে হবে। দেখা গেল বাস স্টপের গায়েই একটা রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে আমি, পোয়ারো আর মেরী একসঙ্গে লাঞ্চের জন্য বসলাম। সকলেই বলতে গেলে এখানে লাঞ্চ সারতে এসেছে। 

আমি বললাম, যাই বলো, ছুটির মেজাজটা এবার তৈরি হয়েছে। 

পোয়ারো বলল, তাহলে এতক্ষণে তোমার মুখ খোলার সময় হল। 

পোয়ারো চাইছিল আমি মেরীর সঙ্গে আড্ডায় জমে উঠি। কিন্তু ও আমায় যতই তাতাক আমি ওর ফাঁদে পা দেব না এটা আমার বেলজিয়াম গোয়েন্দা বন্ধু পোয়ারোকে বোঝাবার জন্য আর কোনো মন্তব্য না করে চুপ করে গেলাম। 

মেরী বলল, গরমের সময় সবাই এই এবারমাউথে বেড়াতে আসে তাই এই জায়গাটা এত নোংরা আর ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। আমার মাসির কাছে শুনেছি আগে এখানকার পরিবেশটাই অন্য রকম ছিল। আর এখন ভিড়ের চাপে আপনি ফুটপাত ধরে হাঁটতেও পারবেন না। 

পোয়ারো বলল, কিন্তু লোকের সমাগম না হলে ব্যাবসার কাজই বা চলবে কেমন করে?

মেরী বলল, তা আপনি এদিক থেকে ঠিক কথা বলেছেন। আমাদের কারবারে আবার লোকের ভিড় হয় না কারণ আমরা শুধু দামি আর দুর্লভ জিনিস বিক্রি করি। সস্তা আর খেলো জিনিস আমরা রাখি না। আমাদের খদ্দের ইংল্যান্ডের সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কোনো বিশেষ আমলের খাট, টেবিল, চেয়ার বা চীনা মাটির জিনিস কিনতে হলে তারা সরাসরি আমার মাসিকে খবর দেয়। মাসিও তাদের জানিয়ে দেয় কতদিনের মধ্যে জিনিসটা যোগাড় হবে আর কত দাম পড়বে। তবে একটু দেরি হলেও মাসি ঠিক জিনিসটা জোগাড় করে। এবারও মাসির হাতে এই রকম অর্ডার আছে। 

মেরীর কথা থেকে জানতে পারলাম মিঃ জে বেকার উড নামে এক জনৈক আমেরিকান খদ্দেরের সঙ্গে হালে মেরীর মাসি মিস এলিজাবেথ পেনের যোগাযোগ হয়েছে। মেরীর মাসি জানতে পেরেছেন যে এই মিঃ উড ঘর সাজানোর দুর্লভ প্রত্ন বস্তুর একজন সমঝদার ব্যক্তি। 

অল্প কিছুদিন আগে বাজারে কিছু মাল এসেছিল। মেরীর মাসি সেগুলো কিনে নিয়েছেন আর চিঠি লিখে মিঃ উডকে তার দাম জানিয়েছিলেন। সেই চিঠির উত্তরে মিঃ উড জানান তিনি চার্লক বেতে আসছেন। মিস পেন মানে মেরীর মাসি যদি অনুগ্রহ করে কোনো প্রতিনিধিকে সেখানে পাঠান জিনিস কেনার ব্যাপারে কথা বলার জন্য তাহলে খুব ভালো হয়। মিঃ উড জানান তিনি ন্যায্য দামে ওগুলো কিনে নিতে রাজি আছেন। 

মিঃ উডের চিঠি পেয়ে মিস পেনি তার বোনঝি মেরীকে চিঠিতে সব জানান। তাই মেরী চার্লক বেতে যাচ্ছে মাসির প্রতিনিধি হয়ে মিঃ উডের সঙ্গে দেখা করে জিনিস বিক্রির ব্যাপারে কথা বলতে। 

মাসি যে জিনিসগুলো কিনেছেন সেগুলো সত্যি খুবই সুন্দর। শিল্পীরা যাকে মিনিয়েচার বলে এগুলো ঠিক তাই, মাসি এগুলোর দাম চেয়েছে পাঁচশো পাউন্ড, মেরী বলল, বাঃ বাঃ এত দাম ভাবতে পারছি না! মিঃ উড এত দাম দিয়ে কিনবেন? 

পোয়ারো বলল, তোমার মাসি যে কারবার করে মনে হচ্ছে তোমার সেই সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। 

মেরী বলল, দেখুন এই সব ব্যাবসা করতে হলে শিখতে হয়। কিন্তু আমরা সেভাবে বড়ো হইনি। 

মেরী খোলা জানালার দিকে মুখ করে বসেছিল। কথা শেষ করে মেরী জানালার বাইরে তাকাল, লক্ষ্য করলাম ও বড়ো বড়ো চোখ করে কী যেন দেখছে। তারপর হঠাৎ কিছু না বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। তারপর কিছুক্ষণ বাদে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো। এসে এমনভাবে আমাদের দিকে তাকাল যেন না বলে চলে যাবার জন্য সে ক্ষমাপ্রার্থী। 

পোয়ারো বলল, হঠাৎ কি হল বলো তো এভাবে দৌড়ে বেরিয়ে গেলে? 

মেরী দুঃখিত হয়ে বলল, আমি এখান থেকে যেন দেখলাম কে যেন আমার সুটকেসটা বাস থেকে বের করে আনছে তাই ছুটে গেলাম। কিন্তু দেখলাম আমার সুটকেস আমার জায়গায় আছে। ওই লোকটার সুটকেসটা অনেকটা আমার মতো। কী কাণ্ড দেখুন মিছিমিছি একজনকে চোর ভাবলাম। 

মেরী কথাগুলো বলে নিজের মনেই হাসতে লাগল। 

পোয়ারো গম্ভীর হল। বলল, আচ্ছা যে লোকটাকে দেখে তুমি ছুটে গেলে তাকে দেখতে কেমন বলো তো? 

মেরী বলল, রোগা ছিপছিপে চেহারা। পরনে বাদামি রং-এর স্যুট। বেশ অল্প বয়সি কেননা গোঁফ তেমন গজায়নি। 

পোয়ারো মেরীকে থামিয়ে দিয়ে বলল, থাক বুঝেছি আর বলতে হবে না। 

আমার দিকে মুচকি হেসে পোয়ারো বলল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, মনে হচ্ছে গতকাল আমি যার রূপে আকৃষ্ট হয়েছিলাম এ সেই ছোঁড়া। আচ্ছা মেরী তুমি এই লোকটাকে আগে কখনও দেখেছ? 

মেরী বলল, না, কেন বলুন তো? 

পোয়ারো খুবই হালকাভাবে বলল, না তেমন কিছু নয়। ও নিয়ে তোমার চিন্তা করার কিছু নেই। 

পোয়ারোর চেয়ারে গা এলিয়ে এমনভাবে চুপ করে বসে রইল যেন সে ধ্যানে মগ্ন আশেপাশে কী হচ্ছে সে সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল নেই। মেরী আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। মেরীর একটা মন্তব্যে পোয়ারো ধ্যান ভাঙল। সে সোজা হয়ে বসে মেরীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বলতে চাইছ? 

মেরী বলল, তেমন কিছু না। আপনি এখানে আসার সময় মন্দ আর অসৎ লোকের কথা বলছিলেন না। আমার মাসির খদ্দের মিঃ উড সব সময় নগদে টাকা মেটায়। ওর কাছ থেকে পাঁচশো পাউন্ড নিয়ে ফেরার সময় যদি কোনো অসৎ লোকের কু-নজরে পড়ি সেই কথাই ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে বলছিলাম। 

পোয়ারোর মুখ দেখে বুঝলাম যে মেরীর কথাটা সে খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে নিয়েছে। 

পোয়ারো এই সম্বন্ধে আর কোনো কথা না বলে মেরীকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা চার্লক বেতে কম ভাড়ায় দু-একটা রাত ভদ্রলোকেরা কাটাতে পারে এমন কোনো হোটেল আছে? 

মেরী বলল, হ্যাঁ অ্যাংকর হোটেলে উঠতে পারেন। হোটেলটা ছোটো হলেও খাওয়া আর থাকার খরচ কম আর বেশ ভদ্রগোছের। 

পোয়ারো আমাকে বলল, ওহে হেস্টিংস, হোটেলের নামটা মনে রেখো। মনে হচ্ছে এখানেই উঠতে হবে। 

 মেরী জিজ্ঞাসা করল, তা আপনারা ওখানে ক-দিন থাকবেন? 

পোয়ারো বলল, বেশি নয় একটা রাত কাটাব। কিছু কাজ হাতে নিয়ে এসেছি সেটা সারতে হবে।

পোয়ারো হঠাৎ মেরীকে প্রশ্ন করল, আমার পেশা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা হয়? আমার চেহারা দেখে আমার সঙ্গে আলাপ করে তোমার কী মনে হয়? 

পোয়ারোর পেশা সম্পর্কে মেরীর কোনো ধারণাই তৈরি হয়নি। সে উলটো পালটা একটার পর একটা পেশার নাম উল্লেখ করতে লাগল। 

শেষ কালে মেরী খুব হুঁশিয়ার হয়ে একটা পেশার নাম করল। বলল, আপনি নিশ্চয়ই একজন পেশাদার জাদুকর। জাদুর খেলা দেখাতে চার্লক বেতে যাচ্ছেন। 

পোয়ারো গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল, বলল, কি বললে, আমি জাদুকর? তার মানে তুমি বলতে চাইছ আমি ফাঁকা টুপির ভিতর হাত ঢুকিয়ে একটার পর একটা জিনিস বার করে এনে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিই। না মেরী জাদুকর তার জাদুর খেলা দেখাতে গিয়ে একটার পর একটা জিনিস চোখের সামনে থেকে উধাও করে দেয়। আর আমার কাজ কি জানো, আমি খেলা দেখাতে গিয়ে সেই সব হারানো জিনিস আবার ফিরিয়ে আনি। 

মেরী ওর কথা কিছুই বুঝতে পারেনি আন্দাজ করে পোয়ারো চাপা গলায় মেরীকে বলল, আমার পেশাটা খুবই গোপনীয়। তোমায় বলছি তুমি আবার ভুল করে কাউকে বলে ফেলো না, আমি একজন গোয়েন্দা। 

পোয়ারো কথাটা বলেই যেমনভাবে চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিল সেইভাবে বসে পড়ল। মেরী পোয়ারোর মুখের দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে পোয়ারো যে গোয়েন্দা সেটা তখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। কিছুক্ষণ বাদে বাসের হর্ন বেজে উঠল আমরা বুঝলাম এবার আমাদের উঠতে হবে। 

মেরীর মতো একজন সুন্দরী রূপসী পাশে থাকায় লাঞ্চটা যে বেশ ভালো হল তা পোয়ারো স্বীকার করল। 

পোয়ারো বলল, ও রূপসী ঠিকই। কিন্তু ওর ঘটে একদমই বুদ্ধি বলে কোনো বস্তু নেই।

পোয়ারো বলল, রাগ কোরো না, মানছি ও খুবই রূপসী। মাথার থোকা থোকা লালচে বাদামি চুল ওকে আরও সুন্দরী করে তুলেছে। কিন্তু তুমি কী করে হলফ করে বলতে পারো ও একটা বোকা হবে না? 

আমি পোয়ারোকে জেরা করার ভঙ্গিতে বললাম, তুমিই বা ওর বোকামির কি প্রমাণ পেলে? 

পোয়ারো বলল, তুমি এটা নিশ্চয়ই মানবে যে আমি আর তুমি ওর কাছে অচেনা। অথচ ও আমাদের বিশ্বাস করে অনেক কথাই বলে ফেলেছে যা বলা অনুচিত। 

আমি বললাম, তুমি ব্যাপারটা ওইভাবে নিচ্ছ কেন। এমন হতে পারে ও হয়তো বুঝেছে আমাদের দু-জনকে সন্দেহ করার মতো কিছু নেই। 

পোয়ারো বলল, আমি তো তাদের বোকা বলব, যারা অচেনা লোককে সন্দেহের উর্দ্ধে রাখে। মেরী মন্তব্য করেছিল সঙ্গে পাঁচশো পাউন্ড থাকলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এই মুহূর্তে ওর কাছে কিন্তু পাঁচশো পাউন্ড আছে। 

আমি বললাম, সে তো নগদে নয়। শিল্পের পরিভাষায় যাকে বলে মিনিয়েচার সেই রকম কিছু দুর্লভ শিল্পসামগ্রী এখন মেরীর সুটকেসে আছে। পোয়ারো বলল, সে তো বুঝলাম বন্ধু কিন্তু আমাদের মতো দু-জন অচেনা লোককে তো ও এই কথাটা ফাঁস করে দিল। মেরীর মাসি নিশ্চয়ই এতে খুশি হবেন না। 

পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, তুমি কি এটা ভেবে দেখেছ, আমাদের অনুপস্থিতিতে বাসের মধ্যে থেকে দু-একটা সুটকেস সরিয়ে ফেলা কোনো চোর ছ্যাঁচোরের পক্ষে অসম্ভব হবে না। 

আমি বললাম, কী যে বলো। তেমন কিছু হলে কি সবার নজরে পড়বে না? 

পোয়ারো বলল, নজরে পড়লেও এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। কেননা কোনো একজন যাত্রী বাসের থেকে তার নিজের সুটকেস নামিয়ে আনছে সবাই ভাবত। 

আমি পোয়ারোকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা ওই ছোঁড়াটা বাস থেকে নিজের সুটকেস নামিয়ে ছিল তো? মনে হচ্ছে। তবুও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, ছেলেটা বাস থামার সঙ্গে তার সুটকেসটা নামায়নি কেন? আর এটা তোমার নজর এড়িয়ে গেছে যে ছেলেটা কিন্তু এখানে লাঞ্চ করেনি। 

আমি বললাম, মেরী যদি জানালার দিকে মুখ করে না বসত তাহলে ও লোকটাকে আদৌ দেখতে পেত না। 

পোয়ারো বলল, সুটকেসটা যেহেতু লোকটার নিজের ছিল তাই তাতে কিছু আসে যায় না। বাদ দাও তো। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা বড্ড বেশি মাথা ঘামাচ্ছি। 

বিকেল চারটে নাগাদ আমরা চার্লক বেতে এসে পৌঁছলাম। অ্যাংকর হোটেল খুঁজে পেতে তেমন অসুবিধা হল না। তবে হোটেল না বলে সেকেলে সরাইখানা বলাই ঠিক। মেরী ঠিকই বলেছিল আমরা যে ঘরটা ভাড়া নিলাম সেটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আর ভাড়াও বেশ কম।

আমরা সবে জামা কাপড় পালটেছি এমন সময় ঘটল একটা ঘটনা। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল মেরী ডুরান্ট। দু-চোখ তার জলে ভরা। 

মেরী বলল, আপনাদের বিরক্ত করার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু একটা খুবই খারাপ ঘটনা ঘটেছে। আচ্ছা আপনি তো গোয়েন্দা তাই না? 

পোয়ারো বলল, তুমি আগে বোসো, আর চোখের জল মুছে বল তোমার কী বিপদ হয়েছে?

মেরী রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে বলল, আমার সুটকেস থেকে সমস্ত মিনিয়েচারগুলো চুরি হয়ে গেছে। 

মেরী সুটকেসটা খুলে তার ভেতর থেকে কুমিরের চামড়া দিয়ে তৈরি একটা ব্যাগ টেনে আনল, বলল এর মধ্যেই ওগুলো ছিল। কিন্তু কখন ওগুলো উধাও হয়ে গেল। নিশ্চয়ই চুরি হয়েছে এখন আমি কী করব। আমি মেরীর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ঘাবড়ে যেয়ো না, আমার বন্ধু এরকুল পোয়ারো একজন নামি গোয়েন্দা কাজেই তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। 

মেরী অবাক হয়ে বলল, এরকুল পোয়ারো। মানে ইনি সেই বিখ্যাত বেলজিয়াম গোয়েন্দা, মঁসিয়ে পোয়ারো। 

পোয়ারো বলল, হ্যাঁ মা। আমিই সেই গোয়েন্দা। এখন তুমি ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দাও। দেখি আমি কী করতে পারি। আচ্ছা তুমি কী করে নিশ্চিত হলে যে ওটা চুরি হয়েছে? 

মেরী বলল, খুব সহজ। সুটকেসের দুটো তালাই যে ভাঙ্গা। 

পোয়ারো সুটকেসটা পরীক্ষা করে বলল, হ্যাঁ, তোমার আশঙ্কাই ঠিক, তালা ভেঙে ভিতর থেকে জিনিস চুরি করা হয়েছে। যাক তুমি আর এ নিয়ে ভেবো না, আমি তোমার কেস হাতে নিলাম। আর মিঃ উডের সঙ্গে আমিই যোগাযোগ করব। তুমি একটু বোসো আমি একটা টেলিফোন করে আসি। 

মেরীকে বসতে বলে আমরা হোটেলের একতলায় এলাম সেখানে পোয়ারো টেলিফোন ঘরে ঢুকে গেল, মিনিট পাঁচেক পর গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলো। 

পোয়ারো বলল, যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। মিঃ উড বললেন, এই মাত্র একজন মহিলা নিজেকে মিস পেন-এর প্রতিনিধিরূপে পরিচয় দিয়েছে আর ওই মিনিয়েচারগুলো তাকে দিয়ে পাঁচশো পাউন্ড নিয়ে গেছে। তার মানে আমরা হোটেলে ওঠার আগেই সব ঘটে গেছে। 

আমি বললাম, তাহলে এবার কী করবে? 

পোয়ারো বলল, প্রথমে পুলিশের কাছে যাব, তার পর মিঃ উডের সঙ্গে দেখা করব। এখন ওপরে চলো দেখি বোকা রূপসী কী করছে? 

ঘরে গিয়ে দেখি মেরী দু-হাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাচ্ছে। আমাদের পায়ের শব্দে সে মুখ তুলল। বলল, হে ভগবান এ কী করলে। মাসি তো কোনো কথাই শুনবে না। সব দোষ আমায় দিয়ে গালাগালি দেবেন? 

পোয়ারো বলল, খুব একটা অন্যায় কিছু করবেন না। কেন উনি পাঁচশো পাউন্ডের জিনিস সুটকেসে রেখে লাঞ্চ করতে গেলেন। তা চোর ব্যাটা তো সে সুযোগ নেবেই। আমি হলে শুধু গালাগালি দিতাম না, আমার তো হাত নিশপিশ করছে। পোয়ারো খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। 

পোয়ারো মুহূর্তে নিজেকে শান্ত করল, তারপর নিজের মনেই বলে উঠল, তবে এই কেসে দু-একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। ধরো ওই ডেসপ্যাচ বক্স, ওটা জোর করে কেন খোলা হয়েছিল বলো তো? 

আমি বললাম, কেন আবার, ওগুলো চুরি করার জন্য। 

কিন্তু সেটা কি খুব বোকার মতো কাজ হবে না? পোয়ারো নিজের মনে বলে উঠল, ধরো এমনও তো হতে পারে যে নিজের মালপত্র বের করার অছিলায় চোর লাঞ্চের সময় মেরীর সুটকেস খুলেছিল। জোর করে তালা খুলে সময় নষ্ট করার থেকে মেরীর সুটকেস খুলে ভেতর থেকে বন্ধ ডেসপ্যাচ বক্স বের করে নিজের সুটকেসে ঢুকিয়ে ফেলা নিশ্চয়ই চোরের পক্ষে বেশি সহজ হবে। 

কিন্তু মিনিয়েচারগুলো যে ওখানে আছে সে ব্যাপারে চোর কীভাবে নিশ্চিত হল। আমি বললাম। 

বুঝলাম পোয়ারো আমার এই মন্তব্যকে আদৌ গুরুত্ব দিচ্ছে না। 

ইতিমধ্যেই পোয়ারো মিঃ উডের সঙ্গে দেখা করার বন্দোবস্ত করেছিল। তাই সে কথা না বাড়িয়ে জামা-কাপড় পরতে লাগল। 

এই মিঃ উড লোকটিকে আমার একটুও ভালো লাগল না। সাধারণ ঘরোয়া পরিবেশে এমন জমকালো স্যুট পরেছিল তা খুবই বেমানান। তার ওপর ডান হাতের অনামিকায় এমন একটা ডিজাইনের হীরের আংটি আরও বেমানান। হঠাৎ বড়োলোক হলে তারা এমনই স্থূল রুচিসম্পন্ন হয় 

সব থেকে খারাপ হল ভদ্রলোক শান্তভাবে কথা বলতে পারেন না। সাধারণ কথাই খুব চেঁচিয়ে বলেন। আর মাঝে মাঝে চাপা গলায় এমন সব অশালীন শব্দ উচ্চারণ করছে বোঝা যায় উনি গালি দিচ্ছেন। 

মিঃ উডের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল উনি কোনো কিছু খোয়া গেছে এমন সন্দেহ আদৌ করছেন না। 

পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে মিঃ উড বললেন, সন্দেহ করতে যাবই বা কেন? ভদ্রমহিলা তো মিনিয়েচারগুলো ঠিকঠিক দিয়েছে। আর সত্যিই ওগুলো খুব চমৎকার 

পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি ওগুলোর দাম বাবদ যে টাকা দিয়েছেন তার নাম্বার টুকে রেখেছেন? 

মিঃ উড চেঁচিয়ে উঠল। না মশাই। আর নম্বর লিখতে যাবই বা কেন? আপনার কী যেন নাম বললেন, হ্যাঁ মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে কে অধিকার দিয়েছে আমাকে এত প্রশ্ন করার? পোয়ারো বলল, বুঝেছি আপনি আমাকে সহ্য করতে পারছেন না। কিন্তু যাবার আগে আর একটা প্রশ্ন করব দয়া করে যদি উত্তর দেন। যে ভদ্রমহিলা আপনার কাছে এসেছিলেন তাঁর চেহারা কেমন? তিনি কি অল্প বয়সি সুন্দরী? 

মিঃ উড বলল, কী? অল্প বয়সি সুন্দরী? একজন মাঝবয়সি মহিলা মাথার সব চুল পাকা, গায়ের রং ফ্যাকাসে। হ্যাঁ মহিলার ওপরের ঠোটে কিছু লোম আছে যা দেখলে গোঁফ বলে ভুল হবে। একে যদি আপনি সুন্দরী বলেন তাহলে বেশ তিনি সুন্দরী। 

মিঃ উডের ওখান থেকে চলে আসার সময় আমি পোয়ারাকে বললাম, কিছু শুনলে মহিলার ঠোঁটের ওপর গোঁফ ছিল। 

পোয়ারো বলল, হুঁ, শুনেছি। 

আমি বললাম, এই মিঃ উড লোকটা কিন্তু ভীষণ বিশ্রী আর বদ। 

পোয়ারো আমার কথায় সায় দিয়ে বলল, সে তো একশো বার। সাধারণ সভ্যতা ভদ্রতার জ্ঞানটুকুও নেই। 

আমি বললাম, আশা করি এবার চোরকে সনাক্ত করা আমাদের পক্ষে সহজ হবে।

পোয়ারো বলল, তুমি আমার সঙ্গে এতদিন থেকেও দিব্যি সহজ সরল রয়ে গেলে। অ্যালিবাই বলে একটা শব্দ আছে সেটা কি তোমার জানা নেই? 

আমি বললাম, তার মানে তুমি বলতে চাইছ অপরাধী বলে যাকে আমরা সন্দেহ করছি তারও একটা অ্যালিবাই থাকবে যখন সে বলবে ঘটনার সময় সে অন্য জায়গায় ছিল। 

পোয়ারো বলল, আমি তো তাই মনে করছি। 

আমি বললাম, তোমার এই এক দোষ, সহজ জিনিসকে কঠিন করে ভাবো। 

পোয়ারো মুচকি হেসে বলল, তা ঠিক বলেছ, ডালে বসা পাখির থেকে উড়ন্ত পাখিকে মারাই আমার বেশি পছন্দ। 

যাই হোক পোয়ারোর কথা পুরোপুরি মিলে গেল। বাসের সেই বাদামি স্যুট পড়া ছেলেটার নাম জানতে পারলাম মিঃ নর্টন কেইন। সে মংকহ্যাম্পটনে পৌঁছে সোজা জর্জ হোটেলে উঠেছিল। তার বিরুদ্ধে একটাই মাত্র অভিযোগ ছিল যে, সে আমরা যখন লাঞ্চ খেতে ব্যস্ত তখন মিস মেরী তাকে বাসে মালপত্র সরাতে দেখেছে। 

পোয়ারো গম্ভীরভাবে বলল, ওটা এমন কোনো সন্দেহজনক ঘটনা নয়। আর এই ব্যাপারে তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন কোরো না। 

আমি আবার একটু চাপ দিতেই পোয়ারো বলল, যে সে এখন নানা রকম গোঁফের কথা ভাবছে তাই আমিও যেন নিবিষ্ট মনে তাকে অনুসরণ করি। 

পোয়ারো সেদিন সন্ধ্যেটা তার বন্ধু জোসেফ অ্যারনসের সঙ্গে কাটাল। জানতে পারলাম পোয়ারো জোসেফের কাছ থেকে মিঃ উড সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছে। জোসেফ আর মিঃ উড একই হোটেলে আছেন, তাই মিঃ উড সম্পর্কে খবরাখবর দেওয়া জোসেফের পক্ষে খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তবে পোয়ারো জোসেফ-এর কাছ থেকে যতটুকু জেনেছে তা কোনোমতেই আমাকে জানায়নি। 

মেরীকে পুলিশের অনেক জেরার উত্তর দিতে হল। পরদিনই মেরী এবারমাউথে খুব ভোরের ট্রেন ধরে চলে গেল। দুপুরবেলা আমি পোয়ারো আর জোসেফ অ্যারনস একসঙ্গে লাঞ্চ সারলাম। পোয়ারো জোসেফকে জানাল থিয়েটার এজেন্টদের সমস্যার সমাধান সে করে দিয়েছে। 

পোয়ারো বলল, এবার তাহলে আমরা এবারমাউথে ফিরে যেতে পারি। কিন্তু এবার আর বাসে নয় ট্রেনে যাব 

আমি ঠাট্টা করে বললাম, তুমি কি বাসে পকেটমারের ভয় পাচ্ছ না কি আবার যদি কোনো সুন্দরী মহিলা এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে আমার খুব বিপদ হয়েছে। 

পোয়ারো বলল, তুমি ভুল করলে হেস্টিংস, ট্রেনেও এই দু-রকম ঘটনা ঘটতে পারে। আমি এবারমাউথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে চাইছি তার কারণ আমার কেসের তদন্ত আমি চালিয়ে যেতে চাই। 

আমি বললাম, তোমার কেস মানে? 

পোয়ারো বলল, কেন? মেরী ডুরান্ট আমার সাহায্যপ্রার্থী না? হ্যাঁ যদিও আমি এখানে এসেছি আমার এক পুরোনো বন্ধুর সমস্যার সমাধান করতে। তা বলে আমি এরকুল পোয়ারো একজন বিপদগ্রস্থ সুন্দরী যুবতীকে পথে বসিয়ে কেটে পড়তে পারি না। যদিও কেসটা এখন পুলিশের হাতে তবুও আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। 

আমরা এবারমাউথে যাবার আগে এই কেসের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা করলাম। 

পুলিশ অফিসার জানালেন মিঃ কেইন যাকে অপরাধী হিসাবে সন্দেহ করা হচ্ছে তার কথাবার্তা আচার-আচরণ সবই সন্দেহজনক। তাকে জেরা করতে সে আজেবাজে যে সব কথা বলছে তার কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। 

পুলিশ অফিসার আরও জানালেন যে, চুরিটা ঠিক কীভাবে হয়েছে তা তার সঠিক জানা নেই। তবে অনুমান করছে যে এমন হতে পারে ওর কোনো স্যাঙ্গাৎ আগে থেকেই তৈরি ছিল, তারা অন্য গাড়িতে করে খুব জোরে যাচ্ছিল সে সময় এই ব্যাটা মালটা হাতিয়ে কোনোভাবে চালান করে দেয়। পোয়ারো কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে চলে আসে। ফেরার পথে আমি পোয়ারাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পুলিশ অফিসারের অনুমান তোমার সঠিক বলে মনে হল? তোমার নিজের মতোামতো কী? 

পোয়ারো বলল, না, চুরি ওভাবে হয়নি। এটা আরও চালাকির সঙ্গে করা হয়েছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তা চালাকিটা কি আমাকে বলবে না? 

পোয়ারো বলল, না, এখনই নয়। তুমি তো জানো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমি সবকিছু গোপন রাখতে ভালোবাসি। 

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তা সমাধান হতে কি দেরি আছে? 

না, না, রহস্যের সমাধান খুবই শিগগির হবে। তুমি চিন্তা করো না হেস্টিংস, পোয়ারো বলল। 

সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ আমরা এবারমাউথে এসে পৌঁছালাম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমি আর পোয়ারো একটা দোকানের সামনে এলাম। দোকানের গায়ে সাইনবোর্ডে লেখা ‘এলিজাবেথ পেন’। 

দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা কলিং বেল বাজালাম বেশ কয়েকবার। কিছুক্ষণ বাদে দরজা খুলে দিল মেরী। সে আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেল। ওর চোখে-মুখে আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল। 

মেরী আমাদের খুব খুশির সঙ্গে বলল, আপনারা ভিতরে আসুন। আপনাদের সঙ্গে আমার মাসির পরিচয় করিয়ে দিই। 

পোয়ারো আর আমি একটা ঘরে এলাম, সেখানে একজন বয়স্ক মহিলা বসেছিলেন। তিনি আমাদের দেখে উঠে এলেন। মহিলার গায়ের রং গোলাপি আর সাদায় মেশানো। মাথার চুল সাদা ধপধপে, চোখের রং নীল। আমরা বুঝতেই পারলাম ইনি মেরীর মাসি। 

আমাদের সঙ্গে মিস পেনের পরিচয় করিয়ে দিল মেরী। 

মেরীর মাসি মিস পেন বিস্ময়ের সুরে বলল, ওঃ তাহলে ইনিই সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা মঁসিয়ে পোয়ারো! পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললেন, মেরীর মুখে আপনাদের কথা আমি শুনেছি। কিন্তু আপনারা এখানে আসবেন আমি ভাবতেই পারিনি। তাহলে আপনি আমাদের দয়া করে সাহায্য করুন। এখন আমাদের কী করা উচিত বলে দিন। 

পোয়ারো মিস পেনের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে মাথা নিচু করে বলল, আপনি কথা বলে আমার মতো লোককে মুগ্ধ করে দিলেন। সত্যি আপনার একটা আশ্চর্য গুণ আছে। কিন্তু তার সঙ্গে এও বলে রাখি আপনি যদি অল্প বয়স্ক ছেলেদের মতো গোঁফ রাখেন তাহলে আপনাকে দারুণ মানাবে। 

মেরীর মাসি মিস পেন পোয়ারোর কথা শুনে ঢোক গিলতে লাগল, কোনো কথা না ব’লে চুপ করে গেল। 

 পোয়ারো সরাসরি তাকে জেরা করার মতো বলল, আপনি কাল দোকান খোলেননি তাই না?

মেরীর মাসি আমতা আমতা করতে থাকল, বলল, আ…আমি গতকাল এখানেই ছিলাম। শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল বলে তাড়াতাড়ি বন্ধ করে বাড়ি চলে গেছিলাম। 

না মিস পেন, আপনি বাড়ি যাননি। পোয়ারো গলা চড়িয়ে বলল, আপনি ভেবেছিলেন একটু ঘুরে এলে শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে। তা মিস পেন চার্লক বেতের আবহাওয়া কেমন লাগল, আপনার শরীর ঠিক হয়ে গেছিল তো? 

মিস এলিজাবেথ পেনের মুখে আর কোনো কথা ফুটল না। তিনি মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো বসে রইলেন। 

পোয়ারো আমাকে নিয়ে দরজার কাছে চলে এলো। পিছন ফিরে বলল, আপনি কিন্তু আমার কাছে ধরা পড়ে গেছেন। তাহলে এই নাটক বন্ধ হওয়া উচিত। 

মেরী দরজার কাছেই ছিল। পোয়ারো এবার মেরীর উদ্দেশ্যে বলল, মামণি এখনও তোমার বয়স কম, দেখতেও সুন্দরী, তাই বলি সময় থাকতে এই বেইমানির কারবার থেকে সরে এসো। না-হলে পরে এমন ফাঁদে পড়বে যে তখন জেল তো হবেই তার সঙ্গে তোমার রূপ যৌবন সবই জলাঞ্জলি যাবে। আর তোমাকে একটা কথা বলে রাখি তোমার এমন অবস্থা হলে আমি সত্যিই খুবই দুঃখ পাব। 

পোয়ারো আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। 

রাস্তায় যেতে যেতে পোয়ারো বলল, আমার প্রথমেই একটু সন্দেহ হয়েছিল। বুকিং অফিসে যখন সেসময় টিকিট কাটতে যাই তখন থেকে। কেননা আমি লক্ষ্য করেছিলাম নটন যখন মংকহ্যাম্পটনের টিকিট কাটল মেরী তখন ওর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিল। অথচ মেরীর বয়সি মেয়েদের আকৃষ্ট করার মতো চেহারা বা ব্যক্তিত্ব কিছুই নর্টনের মধ্যে ছিল না। তারপর দেখো নর্টন মেরীর মালপত্র ঘাটছে এই দৃশ্য কেবল মাত্র মেরী একাই দেখতে পেল। আর মেয়েরা সাধারণত জানালার দিকের সীটে বসে না আর মেরী বসেছিল জানলার মুখোমুখি সিটে। তারপর কি করল, মেরী আমাদেরকে মাল চুরি হবার আষাঢ়ে গল্প শোনাল 

ডেসপ্যাচ বক্স বাইরে থেকে জোর করে খোলা হয়েছে এটা যে কোনো লোকের মনে সন্দেহ জাগায়। আমার মনেও তাই জেগেছিল তা তোমায় আমি আগেই বলেছি। 

এদিকে কী হল? মিঃ উড চুরি যাওয়া মালগুলোর পুরো দাম দিয়ে দিলেন। আবার কাকে দিলেন না মেরীর মাসি মিস পেনিকে যিনি এই কুকীর্তির আসল গুরু। তিনি যে ঠোঁটের ওপর গোঁফ লাগিয়ে মিঃ উডের কাছে টাকা আনতে যান সেটা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ। 

পোয়ারো বলল, তুমি এও জেনে রেখো, মিস পেন তার চুরি যাওয়া মিনিয়েচারগুলো ঠিকই ফেরত পাবে। আর সেগুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি করবে অর্থাৎ এক হাজার পাউণ্ড। 

আমি অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। 

পোয়ারো বলল, হেস্টিংস এতে এত অবাক হবার কিছু নেই। আমি গোপনে সব খবর নিয়েই সব জানতে পেরেছি। আর এও জেনেছি, মিস এলিজাবেথ পেনের কারবার এখন মন্দ যাচ্ছে। তাই তিনি বোনঝি মেরীকে সঙ্গে নিয়ে এই জাল জচ্চুরীর খেলায় মেতে উঠেছেন। 

আমি জানতে চাইলাম, তাহলে তুমি নর্টন কেইনকে তোমার সন্দেহের আওতায় আনোইনি? 

পোয়ারো বলল, কি করে নর্টন কেইনকে আমি সন্দেহ করব তুমিই বলো। 

আমি বললাম, কেন? 

কেন ওর গোঁফের চেহারা দেখোনি? পোয়ারো বলল, যারা অপরাধী হয় তাদের দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো থাকে তারা নকল দাড়ি গোঁফ ব্যবহার করে। তারা ভাবে মানানসই দাড়ি গোঁফ থাকলে লোকের সন্দেহ কম হয়। 

মেরীর মাসি কী করলেন? একেই তিনি বয়সের ভারে বেঁকে গেছেন তিনি পড়লেন হাঁট পর্যন্ত লম্বা বুট। লোশন মেখে গায়ের চামড়ার রং পালটালেন। ঠোটের ওপর লোম লাগিয়ে অল্প বয়সি যুবক সাজলেন। কিন্তু তার এই ছদ্মবেশ সঠিক হল না, তাই মিঃ উড-এর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন মেয়েদের মতো একটি ছেলে। আর তখনই আমি বুঝেছিলাম ওটা ছদ্মবেশ। আমি বললাম, তাহলে তুমি বলতে চাইছ মেরীর মাসি মিস পেন গতকাল চাৰ্লক বেতে গিয়েছিলেন? 

পোয়ারো বলল, আমার অটুট বিশ্বাস। এখান থেকে চার্লক বেতে যাবার ট্রেন ছাড়ে বেলা এগারোটায়। চার্লক বেতে গিয়ে পৌঁছায় দুপুর ঠিক দুটোয়। আবার চার্লক বেতে থেকে এখানে আসার ট্রেন ছাড়ে চারটে বেজে পাঁচ মিনিটে আর এবারমাউথে এসে পৌঁছায় সন্ধ্যে ছ’টা পনেরো মিনিটে। কাজেই ওই মিনিয়েচারগুলো আদৌ ডেসপ্যাচ বক্সে ছিল না। মাল প্যাক করার আগে ওগুলো কায়দা করে ভেতরে ঢোকানো ছিল। 

মেরী তার সুন্দর রূপ দেখিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে অনেককেই ভুলিয়েছে, এমন কি তোমাকে পর্যন্ত। কিন্তু সে একজনকে কিছুতেই ভোলাতে পারেনি, সে হল এরকুল পোয়ারো। আমি বললাম, তাহলে তুমি আমায় ঠকিয়েছে বলো, তুমি যে বললে তুমি একজন অচেনা লোককে সাহায্য করছ, তাহলে তা মিথ্যে। 

পোয়ারো বলল, দেখো আমি তোমাকে কোনো সময়ের জন্য ঠকাইনি। আর আমি সত্যি কথাই বলেছি যে আমি একজন অচেনা লোককে সাহায্য করছি। আমি যাকে বোঝাতে চেয়েছি উনি হলেন মিঃ উড। তিনি সত্যিই এখানে নতুন এসেছেন। 

কথা বলতে বলতে পোয়ারো রাগে ফেটে পড়ল। বলল, ওই জচ্চুরী আর বেইমানির কথা যখনই মনে এসেছে তখনই আমার শরীর চিড়বিড়ো করেছে মক্কেলকে বাঁচাবার জন্য। তুমি হয়তো বলবে মিঃ উড ঠিক সুবিধার লোক নয়। আমি কিন্তু এব্যাপারে তোমার সঙ্গে একমতো নই। বুঝলে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আমি আমার মক্কেলদের পাশে সব সময় আছি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *