১. টর্পেডোর আঘাত

সিক্রেট অ্যাডভারসরী

পূর্বকথা

০১.

৭ই মে, ১৯১৫ খ্রিঃ, সময় বেলা দুটো। টর্পেডোর আঘাতে বিধ্বস্ত লুসিটোনিয়া। ক্রমশ ডুবছে জাহাজ, লাইফবোট নামানো হয়েছে, শিশু আর স্ত্রীলোকদের সারবেঁধে দাঁড় করানো হয়েছে। সমস্ত আবহাওয়া ভারী হয়ে উঠেছে কান্নার রোলে।

একটি মেয়ে একটু আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধীর গম্ভীর মূর্তি। চোখেমুখে ভয়ের লেশ নেই।

দীর্ঘ বলিষ্ঠ একটি পুরুষমূর্তি পেছনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি চমকে ঘুরে দাঁড়াল। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের মধ্যে আগেই তাকে চোখে পড়েছে মেয়েটির।

–আপনি কি আমেরিকান?

–হ্যাঁ।

–কিছু মনে করবেন না, দেশকে ভালোবাসেন নিশ্চয়ই?

 মেয়েটির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। ভদ্রলোককে দারুণ উত্তেজিত বলে মনে হল তার।

নিশ্চয়ই। এ প্রশ্ন কেন?

-মেয়েদের কোনো একজনকে বিশ্বাস করতেই হবে আমাকে। কারণ মেয়ে আর শিশুদেরই বাঁচার সুযোগ রয়েছে।

-বলুন

–দেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ নিয়ে চলেছি আমি। এগুলো খোয়া গেলে যুদ্ধে মিত্রপক্ষের বিপর্যয় হতে পারে। আপনার কাছে রক্ষা পেতে পারে তাই

মেয়েটি হাত বাড়াল।

-কিন্তু একটা কথা, এগুলো বহন করার ঝুঁকি আছে, আমাকে কেউ অনুসরণ করে থাকতে পারে। আপনার সাহস আছে তো?

মেয়েটি হাসল, আমি ঠিক পারব। আমাকে বেছে নিয়েছেন বলে আমি গর্বিত। পরে কাগজগুলো কি করব?

টাইমস পত্রিকায় নজর রাখবেন, ব্যক্তিগত কলমে বিজ্ঞাপন দেব। তিন দিনের মধ্যে বিজ্ঞাপন না পেলে এই প্যাকেটটা আমেরিকার দূতাবাসে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের হাতে দেবেন। আপনি নিজে যাবেন।

মেয়েটি প্যাকেটটা হাতের মধ্যে আঁকড়ে ধরল। তার চোখের পাতা কেঁপে উঠল।

–তাহলে বিদায়। আপনার যাত্রা শুভ হোক। ভদ্রলোক মেয়েটির হাত ধরলেন।

 ইতিমধ্যে লুসিটোনিয়া সাগর জলে আরও কিছুটা নিমজ্জিত হয়েছে। কড়া নির্দেশ শুনে মেয়েটি বোটের দিকে এগিয়ে গেল।

.

ডোভার স্ট্রিটের পাতাল রেলে ঢোকার মুখেই ওদের দেখা হয়ে গেল।

-হায় ঈশ্বর, কয়েক শতাব্দী পরে তোমার দেখা পেলাম।

তরুণ টমি তার ছেলেবেলার বন্ধু তরুণী টুপেনসকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলো।

-এসো কোথাও বসা যাক।

ডোভার স্ট্রিট ধরে পিকাডেলি হয়ে ওরা লায়ন্সে এলো।

-তুমি কবে ছাড়া পেলে? টুপেনস আগ্রহী হল।

রেস্তোরাঁর দোতলায় উঠে ওরা একটা টেবিল দখল করে মুখোমুখি বসল। হলের সব টেবিলেই লোক। একটানা একটা গুঞ্জনের মধ্যে টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে।

–আজ অদ্ভুত একটা নাম কানে এলোজেন ফিন। দুই ছোকরা আলোচনা করছিল। বলল টমি।

ওরা যে যার খরচে চা টোস্ট আর বনের অর্ডার দিল।

সদ্য যুবক টমি, মাথায় একরাশ লাল চুল। খেলোয়াড়সুলভ স্বাস্থ্য, মিষ্টি মুখ। কিন্তু পরনের বাদামী স্যুটের জীর্ণ দশা।

টুপেনসের যাবতীয় সৌন্দর্য তার বুদ্ধিদীপ্ত বড় দুটি চোখে। ধূসর চোখে যেন রহস্য মাখানো। তার গায়ে একটা পুরনো স্কার্ট।

চায়ে চুমুক দিয়ে টমি বলল, ১৯১৬ তে হাসপাতাল ছাড়ার পর আজ প্রথম তোমার দেখা পেলাম।

টুপেনসের বিষয়ে দুয়েকটি কথা এখানে বলা দরকার। সে মিসেনডেল সাফোকের আর্চডিকন কার্ডলের মেয়ে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সে সর্ব কনিষ্ঠ। যুদ্ধ শুরু হলে সে লন্ডনে এসে সামরিক অফিসারদের হাসপাতালে কাজ নেয়।

এখানে একবছর কাজে নিযুক্ত ছিল আর সেই সময়েই ছেলেবেলার বন্ধু লেঃ টমাস বেরেসফোর্ড মানে আমাদের টমির সঙ্গে তার দেখা হয়। বছরের মাথায় যুদ্ধ বিরতি হলে টুপেনসকে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হয়।

-এক চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়ে আর এক চাকরি খুঁজে চলেছি। এই হলো আমার কথা। এবারে তোমার কথা বল।

কথা শেষ করে শূন্য কাপ নামিয়ে রাখল টুপেনস।

–আমি-ফ্রান্স থেকে আমাকে পাঠানো হল মেসোপটেমিয়ায়। দ্বিতীয়বার আহত হলাম। আবার হাসপাতালবাস। পরে মিশরে আটকে পড়লাম। ছাঁটাই হয়েছি দশ মাস হল। হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি। টাকা পেলে ব্যবসার কথা ভাবা যেত।

–টাকাওয়ালা কোনো আত্মীয় নেই?

–এক শাঁসালো বুড়ো কাকা আছেন। দত্তক নিতে চেয়েছিলেন।

–হ্যাঁ, শুনেছিলাম তোমার মায়ের জন্যেই রাজি হওনি।

–আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। বাবার সঙ্গে বনিবনা ছিল না বলে আলাদা থাকতেন। মা মারা গেছেন।

–তুমি বড় ভালো ছেলে টমি, আর বড় দুঃখীও।

–এই হল আমার কথা। একটা কাজ না হলে তো আর পারা যাচ্ছে না।

-আমারও মরিয়া অবস্থা। কিন্তু বাড়িতে ফিরে বাবাকে বিব্রত করার ইচ্ছা নেই। অথচ বুঝতেই তো পারছ, বাঁচার খরচ কিরকম–

-আমিও টাকার চিন্তাই করছি। বলল টমি।

–চিন্তা করে দেখেছি, টাকা পাওয়ার তিনটে পথ। কারও কাছ থেকে পাওয়া, টাকাকে বিয়ে করা আর রোজগার করা। অল্প বয়সে ভাবতাম টাকাকেই বিয়ে করব। কিন্তু কোনো বড়লোক পেলাম না। তোমার তো দিব্যি পুরুষালী চেহারা, সহজেই কারো সঙ্গে আলাপ জমাতে পার। বলল টুপেনস।

-চেষ্টা করিনি কখনো।

-একটা কাজ করা যাক টমি, আমাদের টাকা করতে হবে, কিন্তু নিয়মের মধ্যে থেকে আমরা ব্যর্থ। এবারে একটু নিয়মের বাইরে চলে দেখা যাক–বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে।

-কিন্তু শুরু করবে কিভাবে? আগ্রহী হল টমি।

–সেটাই তো সমস্যা।

ঠোঁটকামড়ে টুপেনস একমুহূর্ত চিন্তা করল। পরে বলল, টমি, এসো দুজনে মিলে একটা অংশীদারী ব্যবসা গড়ে তোলা যাক। কাগজ পেন্সিল বার কর–

বার কয়েক কাটাকুটি করার পর টুপেনস একটা বিজ্ঞাপনের খসড়া দাঁড়া করাল। পড়ে। শোনাল টমিকে–অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় দুজন তরুণকে কাজের জন্য পাওয়া যাচ্ছে। যেকোনো কাজ। মাইনে ভালো চাই।

টাইমস পত্রিকাতেই দেওয়া সাব্যস্ত হল। পাঁচ শিলিং খরচের অর্ধেক সহ বিজ্ঞাপনটা টমির হাতে গুঁজে দিল টুপেনস। বলল, এভাবেই শুরু করে দেখা যাক।

হস্টেলে ফেরার জন্য দুজনেই উঠে পড়ল।

–আবার কোথায় দেখা হচ্ছে?

 –পিকাডেলি টিউব স্টেশনে–কাল বেলা বারোটা।

পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা দুজন দু দিকে চলতে শুরু করল।

.

০২.

 সেন্ট জেমস চার্চের মাঝামাঝি পৌঁছতেই টুপেনস কানের কাছে কার গলার শব্দ শুনতে পেল।

–মাপ করবেন, একটু কথা বলতে পারি?

ঘুরে দাঁড়াল সে। বিরাট চেহারার একটা লোক, ভারি চোয়াল, পরিষ্কার করে কামানো। ধূর্ততা মাখানো চোখ।

–আপনাদের কথাবার্তা কিছু কানে এসেছে। আমি হয়তো আপনাদের সাহায্য করতে পারি।

-সেজন্যই অনুসরণ করছেন?

লোকটা পকেট থেকে একখানা কার্ড বের করে টুপেনসের হাতে দিল। মিঃ এডওয়ার্ড হুইটিংটন, এসথোনিয়া গ্লাসওয়ারি কোং।

–আপনার প্রস্তাব

–আগামীকাল বেলা এগারোটায় যদি দেখা করেন, আলোচনা করা যাবে।

–এগারোটায়, ঠিক আছে।

–ধন্যবাদ, শুভ সন্ধ্যা।

হাতের কার্ডটা আর একবার দেখল টুপেনস। তাহলে অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয়ে গেল। কিন্তু লোকটার হাবভাব সন্দেহজনক। টুপেনস নিজেকে রক্ষা করতে জানে, ভাবল সে।

একটা ডাকঘরে ঢুকে টমিকে ক্লাবের ঠিকানায় টেলিগ্রাম করল।–বিজ্ঞাপন দিও না। কাল সব জানাবো।

নিজের হস্টেলে ফিরে চলল সে।

.

পরদিন যথাসময়েই এসখোনিয়া কোম্পানির অফিসে পৌঁছল টুপেনস। মধ্যবয়স্ক এক কেরানী তাকে মিঃ হুইটিংটনের ঘরে পৌঁছে দিল।

-ওহ, এসে গেছেন, বসুন।

একটা ডেস্কের পেছনে বসে আছেন মিঃ হুইটিংটন। সামনে প্রচুর কাগজপত্র। অফিসের সাজসজ্জায় কোনো গোলমাল নেই।

সামনের চেয়ারে বসল টুপেনস।

–কাজের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। চমৎকার একটা কাজ–সব খরচ আর ১০০ পাউন্ড, ওতে চলবে?

-কাজটা কি ধরনের? সতর্ক কণ্ঠে বলল টুপেনস।

–একটা ভ্রমণ–প্যারীতে একটা স্কুলে।

 –কোনো বোর্ডিং কি?

–হ্যাঁ, অ্যাভেনিউ দ্য নিউলিতে মাদাম কলম্বিয়ার বোর্ডিং।

–কত দিনের জন্য?

–ধরুন মাস তিনেক।

 –আর কিছু শর্ত?

–তেমন কিছুই না। আমার আত্মীয় হিসেবে যাবেন, তবে কোনো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবেন না–আপনার নিজেকে গোপন রাখতে হবে। প্যারীতে বেশ আনন্দেই কাটাতে পারবেন। তাহলে এই

শর্তগুলো বিদঘুটে। আমার জন্য টাকা খরচ করবেন কেন বুঝতে পারছি না।

–বেশ, বুঝিয়ে দিচ্ছি, শান্ত কণ্ঠে বললেন মিঃ হুইটিংটন; বুদ্ধি আছে, অভিনয় করতে পারে আর বেশি প্রশ্ন করবে না এমন কোনো মেয়ের জন্যই আমি টাকা খরচ করতে চাইছি।

–বেশ, কিন্তু মিঃ বেরেসফোর্ডের কি হবে?

 –তিনি কে?

 –আমার অংশীদার, গতকাল যাকে সঙ্গে দেখেছেন।

–আমি দুঃখিত, তার প্রয়োজন হবে না।

 –আমি দুঃখিত, মিঃ হুইটিংটন। যা করবার আমরা যৌথভাবেই করতে চাই। সুপ্রভাত।

 –ওহ, একমিনিট, দেখি কিছু করা যায় কিনা।

গতকাল টমির মুখে শোনা নামটা হঠাৎ কি কারণে মনে ভেসে উঠল। টুপেনস অস্ফুটে উচ্চারণ করে ফেলল, জেন ফিন।

আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে খোলসটা খুলে পড়ল হুইটিংটনের। মুখ লাল হয়ে কপালের শিরা ফুলে উঠল। চোখে হিংস্র দৃষ্টি। হিসহিস শব্দে বললেন, এতক্ষণ তাহলে খেলা করছিলেন? কে ফাস করল কথাটা, রিটা?

টুপেনস নড়েচড়ে বসল। নিজের উপস্থিত বুদ্ধির ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। কিছু বুঝতে না পারলেও সে বলল, রিটা আমার সম্বন্ধে কিছুই জানে না।

–আপনি জানেন, তাই ওই নামটা শুনিয়েছেন।

–ওটা তো আমার নামও হতে পারে।

-বাজে কথা রাখুন, খিঁচিয়ে উঠলেন মিঃ হুইটিংটন, কতখানি জেনেছেন–ব্ল্যাকমেল, অ্যাঁ, কত টাকা চান?

–আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন মিঃ হুইটিংটন।

–বাজে কথা না বলে আসল কথায় আসুন। কত চান?

–আমি টাকার জন্য অতটা লালায়িত নই।

–আপনি ভালো খেলোয়াড়, বুঝতে পারছি। অথচ শান্ত ভীরু মেয়েই বোধ হয়েছিল আমার। কিছুতেই স্বীকার করছেন না আপনি কতটা জেনেছেন।

-স্বীকার করছি, একটা নামই আমার জানা।

–বুঝতে পারছি, মুখ খুলেছে রিটা। ওহহ, এসো ভেতরে—

কেরানী ভেতরে ঢুকে একটুকরো কাগজ এগিয়ে দিল।

 এই টেলিফোন বার্তা এই মাত্র পেলাম।

 মিঃ হুইটিংটনের ভ্রু কুঁচকে গেল। চকিতে টুপেনসকে দেখে নিলেন।

–ঠিক আছে ব্রাউন–আমি দেখছি।

 কেরানী চলে গেলে টুপেনসের দিকে তাকিয়ে মিঃ হুইটিংটন বললেন, ঠিক আছে, আগামী কাল ঠিক এই সময়ে আসুন–বাকি কথা হবে। আর এই নিন, কাজ চলার মতো আপাততঃ পঞ্চাশ পাউন্ড।

নোটগুলো হাত বাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল টুপেনস।

সুপ্রভাত মিঃ হুইটিংটন, আবার দেখা হবে।

–আবার দেখা হবে, বিদায়।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে টুপেনস ঘড়িতে দেখল, বারোটা বাজতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি আছে।

কড়কড়ে পঞ্চাশ পাউন্ডের মালিক সে এখন। ভাবল, টমিকে চমকে দেবে। একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ল।

.

টিউব স্টেশনে ট্যাক্সি থামতেই টমিকে চোখে পড়ল। বিস্মিত টমি এগিয়ে এসে দরজা খুলতে সাহায্য করল।

ট্যাক্সি বিদায় করে দুষ্টু হাসি হাসল টুপেনস। টমিকে আরও কিছুটা হতভম্ব করার জন্য সে লাঞ্চ সারবার জন্য তাকে নিয়ে রিজে ঢুকল।

–এসব কি হচ্ছে টুপেনস। আমার মাথা ঘুরছে।

 –আমি টাকা পেয়েছি

-কি করেছো? ব্যাঙ্ক ডাকাতি?

টুপেনস নিরিবিলিতে বসে সব কথা খুলে জানালো। সব শেষে বলল, জেন ফিন নামটা কেন যে মুখে এসে গেল–

টমি খানিকটা ধাতস্থ হল। জিজ্ঞেস করল, যে দুজনকে দেখলে, তারা কি রকম দেখতে?

–হুইটিংটন লোকটার চেহারা বিরাট, গোঁফ দাড়ি কামানো। অন্যটিকে লক্ষ্য করিনি। তবে নামটা অদ্ভুত।

-বুঝলাম। কিন্তু গায়ে পড়ে বিপদ ডেকে আনলে, বলল টমি; লোকটা এরপর তোমার কাছে অনেক কিছু জানতে চাইবে।

খাওয়া শেষ করে কফি নিয়ে বসলো ওরা। টুপেনস বলল, আমি সেটাই ভাবছি। জেন ফিন–এর সব কিছু জানতে হবে। আর জানতে হবে হুইটিংটনের ভেতর দিয়েই। কিন্তু লোকটা আমাকে চেনে, তোমাকে চিনতে পারবে না।

–আবার কি মতলব আঁটছ?

–শোন, মাথায় এসেছে, কাল আমি একা যাব, তুমি বাইরে কাছাকাছিই কোথাও থাকবে। লোকটা বেরিয়ে এলে তুমি তার পেছন নেবে।

.

পরদিন নির্দিষ্ট সময় বাড়িটাতে ঢুকে পরক্ষণেই হতাশ মুখে বেরিয়ে আসতে হল টুপেনসকে।

টমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াল।

-কি হল, বেরিয়ে এলে যে?

–অফিসটা বন্ধ। কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

 একজন কেরানী গুটিগুটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।

–আপনি গ্লাসওয়্যার কোম্পানির খোঁজ করছিলেন?

–হ্যাঁ। জবাব দিল টুপেনস।

–গতকাল বিকেল থেকে বন্ধ। নাকি কোম্পানি তুলে দেওয়া হয়েছে। বলল লোকটি।

লোকটির কাছ থেকে হুইটিংটনের ঠিকানাও পাওয়া গেল না। দুজনে চিন্তিতভাবে পথে নামল।

–পঞ্চাশ পাউন্ড, দুষ্টু হেসে বলল টমি, এবারে কি করবে?

–আমি ভাবতেই পারিনি, চিন্তিতভাবে বলল টুপেনস, কিন্তু এখানেই শেষ নয়, সবে মাত্র শুরু।

–কিসের শুরু?

–ওরা যখন পালিয়ে গেছে, বোঝা যাচ্ছে জেন ফিনের ব্যাপারটা গুরুতর। এর তল খুঁজে বার করবো–ঠিক বইয়ের গোয়েন্দার মতো।

আজই একটা বিজ্ঞাপন কাগজের অফিসে জমা দিয়ে আসবে। বয়ানটা হবে : জেন ফিন সম্পর্কে যে কোনো সংবাদ চাই। যোগাযোগ-ওয়াই. এ.

.

পরদিন বৃহস্পতিবারেই বিজ্ঞাপনটা ছাপা হল। শুক্রবার দিনে ওরা সকাল দশটায় ন্যাশনাল গ্যালারিতে মিলিত হল।

কথা হয়েছিল, কোনো চিঠি এলে টমি একা খুলবে না। টমি শপথ রক্ষা করেছে। সে দুটো চিঠি টুপেনসের হাতে তুলে দিল।

মাত্র দুটো–বিজ্ঞাপনের টাকাগুলোই নষ্ট হল।

টুপেনস প্রথম চিঠিটা খুলে পড়ল :

প্রিয় মহাশয়,
আজকের কাগজে আপনার বিজ্ঞাপন দেখলাম। আপনাদের হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারি। আগামীকাল ওপরের ঠিকানায় বেলা এগারোটায় দেখা করবেন।–
আপনার বিশ্বস্ত,
এ. কার্টার

ঠিকানাটাও পড়ল টুপেনস : ২৭, কারশ্যালটন গার্ডেনস। গ্লসেস্টার রোডের দিকেই তো জায়গাটা। টিউবেই যাওয়া যাবে।

দ্বিতীয় চিঠিটা খুলল টুপেনস। বলল, শোন পড়ছি–ওহ, এটা রিজ থেকে এসেছে,

প্রিয় মহাশয়,
আপনার বিজ্ঞাপনের উত্তরে মধ্যাহ্নভোজের আগে দেখা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
আপনার বিশ্বস্ত
জুলিয়াস পি. হার্সিমার

–কোনো আমেরিকান কোটিপতি হবে। বিনা পয়সায় লাঞ্চটা ভালোই হবে মনে হচ্ছে। বলল টমি।

কারশ্যালটন গার্ডেনস জায়গাটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। ২৭ নং ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে ঘন্টা বাজাতেই পরিচারিকা দরজা খুলে দিল। মিঃ কার্টারের কথা বলতে সে তাদের নিচের লাইব্রেরী ঘরে নিয়ে বসাল।

এক মিনিট পরেই একজন দীর্ঘকায় গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ঘরে ঢুকলেন। ভঙ্গীটা ক্লান্ত, লক্ষ্য করল টুপেনস।

–মিঃ ওয়াই. এ.-দুজনেই বসুন।

ভদ্রলোক বসলেন, ওরাও আসন গ্রহণ করল।

–আপনি জানিয়েছিলেন, জেন ফিন সম্বন্ধে আমাদের কিছু জানাতে পারেন।

-ও হ্যাঁ, জেন ফিন, কিন্তু কথা হল, আপনারা তার সম্পর্কে কি জানেন? বললেন মিঃ কার্টার।

–আমরা জানতে এসেছি। ঢোঁক গিলে বলল টুপেনস।

–টাকা খরচ করে যখন বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, তখন তার সম্পর্কে নিশ্চয় কিছু জানেন। তাহলে বলুন…

–সেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় স্যার।

টুপেনস টমিকে সাক্ষী মানল।

টমি তাকে সমর্থন না করে মিঃ কার্টারকে লক্ষ্য করে বলল, যেটুকু জানি আপনাকে বলতে পারি স্যার। দেখেই আপনাকে চিনেছি। গোয়েন্দা বিভাগে যখন ছিলাম ফ্রান্সে আপনাকে দেখি, আপনি

তৎক্ষণাৎ হাত তুলে বাধা দিলেন মিঃ কার্টার। বললেন, কোনো নাম নয়। এখানে আমি মিঃ কার্টার। এটা আমার বোনের বাড়ি, বেসরকারী ভাবে কাজ করার সময় এখানে থাকতে পাই। তোমাদের তুমি বলেই সম্বোধন করছি। নাও, এবারে বলে যাও।

 টুপেনস একপলক টমিকে দেখেছিল। পরে গোড়া থেকে তাদের অ্যাডভেঞ্চার সংগঠন গঠন করা পর্যন্ত সব কথাই খুলে জানাল।

-তোমরা তাহলে অ্যাডভেঞ্চার চাইছ? অদ্ভুত। তাহলে আমার হয়েই কাজ কর। আমি ভাগ্য বিশ্বাস করি। তোমরা হয়তো সফল হতে পার। সবই বেসরকারী, বুঝলে, খরচখরচা আর মোটামুটি কিছু পাবে।

টুপেনস আগ্রহভাবে জিজ্ঞেস করল, আমাদের তাহলে করণীয় কি হবে?

–জেন ফিনকে খুঁজে বার করবে।

–কিন্তু জেন ফিন কে?

-হ্যাঁ, এটা তোমাদের জানা দরকার। বেশ শোন। ব্যাপারটা গোপন কূটনীতি বিষয়ক। ১৯১৫ সালে আমেরিকায় একটা গোপন চুক্তির দলিলের খসড়া করা হয়। এটা বিভিন্ন প্রতিনিধির সই করার কথা, তাই ডেনভারস নামের বিশেষ দূত মারফত ইংলন্ডে পাঠানো হয়। ব্যাপারটা গোপন থাকারই কথা ছিল, কিন্তু কেউ ফাঁস করে দিয়েছিল।

ডেনভারস লুসিটোনিয়া জাহাজে ইংলণ্ড রওনা হয়েছিল। কিন্তু পথে টর্পেডোর আঘাতে জাহাজটিকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

তেলা কাগজের মোড়কে দলিলটা রাখা ছিল। কিন্তু ডেনভারসের ভাসমান মৃতদেহ পাওয়া গেলেও প্যাকেটটা পাওয়া যায়নি।

খবর আছে, টর্পেডোর আঘাতে বিধ্বস্ত জাহাজ থেকে নৌকো নামানোর ফাঁকে ডেনভারসকে এক আমেরিকান তরুণীর সঙ্গে কথা বলতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তাকে ওর হাতে কিছু দিতে দেখা যায়নি।

আমার ধারণা যদি কেউ ওটা ডেনভারসের কাছ থেকে আগেই ছিনিয়ে নিয়ে না থাকে। তাহলে কোনো মেয়ের পক্ষেই ওটা বাঁচিয়ে আনা সম্ভব। যদি তাই হয়, তাহলে মেয়েটি কাগজগুলো কি করল?

আমেরিকা থেকে জানা গেছে, ডেনভারসকে অনুসরণ করা হয়েছিল। শত্রুপক্ষের সঙ্গে মেয়েটির যোগাযোগ ছিল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অথবা এমনও হতে পারে, তাকে অনুসরণ করে কাগজপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

আমরা মেয়েটির খোঁজ নিয়েছি। তার নাম জেন ফিন। জাহাজের জীবিতদের তালিকাতে তার নাম ছিল। সে একজন অনাথা।

পশ্চিমে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করত। তার পাসপোর্ট ছিল প্যারীর। এক হাসপাতালে কাজ নিয়ে সে যাচ্ছিল।

ইংলন্ডে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটি উধাও হয়ে যায়। আমরা কোথাও তার হদিশ করতে পারিনি।

সেই খসড়া চুক্তি আর কার্যকর করা যায়নি। ফলে যুদ্ধ কূটনীতি অন্যদিকে মোড় নিল। জেন ফিনের প্রসঙ্গও একদিন চাপা পড়ে গেল।

–তাহলে এখন আবার তার নাম উঠল কেন? জানতে চাইল টমি।

-কারণ পাঁচ বছর আগের সেই খসড়া চুক্তিটি। যদি সেটা নষ্ট করা না হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইংলন্ডের পক্ষে তা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে। আবার একটা যুদ্ধই হয়তো অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

কোনো শ্রমিকদল ক্ষমতায় এলে তাদের পক্ষেও ওটা ক্ষতিকর হবে। তোমরা শুনে থাকবে, বর্তমানে যে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, তার পেছনে কলকাঠি নাড়ছেবলশেভিকরা। তারা এদেশে বিপ্লব ঘটাবার জন্য আঁটঘাট বাঁধছে।

বলশেভিকরা পাইকারী হারে এদেশে সোনা নিয়ে আসছে। সমস্ত কিছুর পেছনেই কাজ করছে একটা মানুষের মাথা।

বলশেভিকদের শ্রমিক আন্দোলনের হোতা ওই লোকটাকে আমরা জানি না। তবে তাকে ব্রাউন নামে উল্লেখ করা হয়।

যুদ্ধের সময়ে অঢেল টাকা খরচ করে সেই শান্তির প্রচার করেছে। অনেক জায়গায় তার নিজস্ব গুপ্তচর রয়েছে।

–এদেশের নাগরিক কোনো জার্মান হতে পারে। টমি বলল।

–আমার ধারণা, জার্মান সমর্থক কোনো ইংরেজই হবে। তবে তার আসল পরিচয় কেউ জানে না। অনেক অনুসন্ধান করেও তাকে প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকায় পাওয়া যায়নি।

–মিঃ হুইটিংটনের কেরানীর নামও ছিল ব্রাউন, মনে পড়ছে। বলল টুপেনস।

–ভালো ভাবে লক্ষ্য করিনি, তবে অসাধারণ কিছু নয়।

–মিঃ ব্রাউনের ওরকমই চেহারা। হুইটিংটন তোমাকে টাকা দিয়ে কাল আসতে, বলেছিল–সবই মিঃ ব্রাউনের নির্দেশ। যাইহোক, এত কিছু বলার উদ্দেশ্য; লোকটার গুরুত্ব তোমাদের বোঝানো। তোমাদের কাজ করতে হবে এই লোকের বিরুদ্ধে সতর্কতার সঙ্গে। তোমাদের কোনো বিপদ হোক, আমি চাই না।

–আমাদের কিছু হবে না। বলল টুপেনস।

মিঃ কার্টার হেসে বললেন, বাকি অংশটা শুনে রাখো। বিপ্লবী সমর্থকেরা খসড়া কাগজটা পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। যদিও তারা এটা তাদের হাতে আছে বলে ধাপ্পা দেবার চেষ্টা করেছে।

তারা যে আমাদের কাছ থেকেই মেয়েটির খবর নেওয়ার চেষ্টা করছে তোমার কথাতেই বোঝা যাচ্ছে। তারা জেন ফিনের খোঁজ করছে। হয়তো শেষ পর্যন্ত নিজেদের কাউকে জেন ফিন বলে দাঁড় করাবে। জানাবে প্যারীর কোনো গোপন আবাসে সে আছে। এভাবে কৌশলে তারা আসল খবর বার করার চেষ্টা করবে।

–আমাকে কি তাহলে সেই উদ্দেশ্যেই প্যারীতে পাঠাতে চেয়েছিল?

 মিঃ কার্টার হেসে মাথা ঝাঁকালেন।

-স্যার, আর কোনো সূত্র দিতে পারেন? বলল টমি।

–ওই পর্যন্তই। আমার লোকেরা ব্যর্থ হয়েছে। ভাগ্যই হয়তো তোমাদের এতে টেনে এনেছে। হুঁশয়ার হয়ে কাজ করবে।

টুপেন উঠে দাঁড়াল।

-যাবার আগে, একটা বিষয় পরিষ্কার করে নিতে চাই। মিঃ কার্টার, আপনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা কি হবে?

–উক্ত বিষয়ে খবর এবং যুক্তিসঙ্গত টাকা। তবে একটা কথা, পুলিসের ঝামেলায় পড়লে কোনো সাহায্য করতে পারব না। টাকাকড়ি সরাসরি আমার কাছেই চাইবে। বছরে তিনশ পাউন্ড করে দুজনেই পাবে, চলবে?

-আমরা খুশি স্যার।

–তোমাদের দুজনকেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

.

কাজের মতো একটা কাজ পাওয়া গেছে। খুশি মনেই ওরা বেরিয়ে এলো।

–এবারে জুলিয়াস পি. হার্সিমার। বলল টমি। –

-ইচ্ছে করেই কার্টারকে কথাটা চেপে গেছি। একটা ট্যাক্সি নাও। বলল টুপেনস।

.

খোঁজ করে মিঃ হার্সিমারের সুইটে প্রবেশ করল ওরা।

 সবল, শক্ত কাঠামোর একজন আমেরিকান। বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। মুখখানা সুন্দর। সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের বসালেন তিনি।

–জেন ফিন আমার পিসির মেয়ে, তার সম্পর্কে যা জানেন বলুন! বললেন মিঃ হার্সিমার।

 –আপনি তাহলে জানেন সে কোথায়? বলল টুপেনস।

–না। আপনারা কি জানেন বলুন।

–খবর জানার জন্যই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম।

–আমার ধারণা হয়েছিল, ওর অতীত জানতে চাইবেন। এখন ও কোথায় আপনারা তা জানেন।

–আমরা আপনার বোনকে অপহরণ করিনি। আমাদের লাগানো হয়েছে তাকে খোঁজার জন্যেই।

–বেশ, বলে যান, বললেন মিঃ হার্সিমার।

টমি গোড়া থেকে জেন ফিনের অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত এবং বেসরকারী ভাবে তাদের জড়িয়ে পড়া সবিস্তারে জানালো। পরে বলল, আপনার কাছ থেকে তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই।

-দেখুন, জেন ফিন আমার পিসতুত বোন বটে, আমি তাকে জীবনে দেখিনি।

–সেকী? অবাক হয়ে বলল টমি।

-হ্যাঁ, এটাই সত্যিকথা। আমরা পিসী পশ্চিমের এক স্কুলশিক্ষক অ্যামস কিনকে বিয়ে করবেন স্থির করেন। বাবা জানতে পেরে ক্ষেপে জান, জানিয়ে দেন একাজ করলে তাকে এক সেন্টও দেওয়া হবে না। পিসী গ্রাহ্য করলেন না। পশ্চিমে চলে গেলেন।

তেল আর ইস্পাতের ব্যবসা থেকে বাবা প্রচুর টাকা রোজগার করেন। গতবছর তিনি মারা। গেছেন। এখন সবই আমার।

আমি জেন পিসীর খোঁজ নিতে লাগলাম। জানতে পারলাম জেন পিসি আর অ্যামস কিন মারা গেছেন। তারা তাদের এক মেয়ে জেনকে রেখে গেছেন। সে লুসিটোনিয়া জাহাজে প্যারী ফিরছিল, টর্পেডোর আঘাতে জাহাজ ডুবে যায়, কিন্তু জেন বেঁচে যায়। তবে তার খোঁজ কেউ জানে না।

আমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ও অ্যাডমিরালটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আজ সকালেই ইয়ার্ড থেকে একজন এসে জেনের ছবি নিয়ে যায়। প্যারীর পুলিসের সঙ্গেও এবারে যোগাযোগ করব।

–তাহলে তো জেন ফিনকে খোঁজার ব্যাপারে আমরা একসঙ্গেই কাজ করতে পারি। বলল টুপেনস।

খানিক পরে ওরা রেস্তোরাঁয় গেল লাঞ্চ সারবার জন্য। সেখানে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে ইনসপেক্টর জ্যাপ এলেন হার্সিমারের সঙ্গে দেখা করতে।

-সকালে তো একজন এসেছিলেন, তাকেই সব বলেছি। জেনের ছবিটা যেন হারিয়ে না ফেলে দেখবেন; ওর একটাই ছবি। ওর কলেজের প্রিন্সিপালের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। এর নেগেটিভ নষ্ট হয়ে গেছে।

জ্যাপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছবি নিয়ে গেছে? যে এসেছিলেন তার নাম জানেন?

–হ্যাঁ, ইনসপেক্টর ব্রাউন। খুবই সাধারণ দেখতে।

সাংঘাতিক ব্যাপারটা তখনই জানা গেল জ্যাপের কাছে। ব্রাউন নামে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে কোনো ইনসপেক্টর নেই। জেনের একমাত্র ছবিটি চিরকালের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেটা হাতিয়েছেন মিঃ ব্রাউন।

-আর পুলিসের ওপর নির্ভর করে থাকা ঠিক হবে না। আমরা তিনজনে মিলেই ব্যাপারটা দেখব আসুন। বললেন হার্সিমার।

অতঃপর এক তরুণ আমেরিকান আর দুই তরুণ অ্যাডভেঞ্চারারের মধ্যে নিবিড় সমঝোতা গড়ে উঠলো। টুপেনস তাদের সব কথা নতুন বন্ধুকে খুলে জানাল। তারা জেন ফিনের একমাত্র আত্মীয়ের সঙ্গে থাকার জন্য রিজেই উঠে এল।

পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করতে বসল টুপেনস।

–রিজে যখন উঠে আসতেই হল, এবারে কিছু একটা করতে হবে টমি।

 –কি করবে ভাবছ। বলল টমি।

কাজে লাগাবার মতো আপাততঃ দুটো সূত্র আমাদের হাতে আছে। প্রথম হল, দলের হুইটিংটন লোকটাকে চিনি।

-কিন্তু লোকটা তত বেপাত্তা।

–পিকাডেলি সার্কাসে সকলকেই আসতে হয়, এখানে নজর রাখলে একদিন ঠিক চোখে পড়ে যাবে। বলল টুপেনস।

–আর দ্বিতীয় সূত্রটা?

–হুইটিংটনই যে নামটা করেছিল–রিটা। এবারে আর বিজ্ঞাপন নয়–বুদ্ধি দিয়ে তাকে খুঁজে বার করব। ডেনভারসকে অনুসরণ করা হয়েছিল, মনে আছে তো? আমার ধারণা কোনো সুন্দরী যুবতী তার ওপরে নজর রেখেছিল। আর সে বেঁচে গিয়েছিল।

–লুসিটোনিয়ায় যারা বেঁচে গিয়েছিল তাদের তালিকা আমি সংগ্রহ করেছি।

–বাঃ চমৎকার। আনন্দ প্রকাশ করল টুপেনস, তাহলে লন্ডনের ঠিকানাগুলো দেখে রিটা নামটা খুঁজে বার করতে হবে।

.

টমির নোট বইতে টুকে নেওয়া নামগুলোর প্রথমে ছিল মিসেস এডগার হিথ, লরেন্স, গ্লেনশাওয়ার রোড, এন, ওয়াই। লাঞ্চের আগে সেখানে ওরা টু মারল, হ্যাঁম্পস্টেড বরো কাউন্সিলের লোক বলে পরিচয় দিয়ে, জেনে নিল মিসেস এডগার হিথের পুরো নাম মিসেস এলিনর জেন।

এরপর দ্বিতীয় নামটি দেখে ওরা উপস্থিত হল ২০ নং কার্ক লেনে সাউথ অডলে ম্যানসনে।

আগের বারের কায়দাতেই ভোটার তালিকা মেলাবার ভঙ্গিতে খাতা বার করে নিয়ে দোতলায় উঠে ঘণ্টা বাজাল টমি।

দরজা খুলল একজন পরিচারিকা। টমি খাতায় চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, আমরা বরো কাউন্সিল থেকে আসছি, ভোটের ব্যাপার। এখানে যিনি থাকেন তাঁর নাম?

–মার্গারেট।

–কিন্তু আমাদের কাছে নাম রয়েছে রিটা ভ্যান্ডেমেয়ার।

–হ্যাঁ, ওটাই ওনার নাম।

 –ঠিক আছে, ধন্যবাদ।

টমি সরে এসে উত্তেজনায় টুপেনসের হাত চেপে ধরে দ্রুত লিফটের কাছে সরে এলো। এমন সময় ওপরে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। আর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। টুপেনস টমিকে নিয়ে অন্ধকারে সরে গেল। ফিসফিস করে বলল, গলার স্বর শুনে চিনতে পেরেছি; হুইটিংটন। অন্য জনকে চিনি না। আমাকে চিনে ফেলবে, তুমি ওদের অনুসরণ কর।

.

রাস্তায় নেমে হুইটিংটন আর তার সঙ্গী মেফেয়ার স্ট্রিট বরাবর হাঁটতে লাগল। একটু দূর থেকে টমি ওদের অনুসরণ করতে লাগল।

এরপর অক্সফোর্ড স্ট্রিট, বণ্ড স্ট্রিট…একটা রেস্তোরাঁ…লোকদুটো যে টেবিলে বসল, খানিক দূরেই বসল টমি।

দ্বিতীয় লোকটি বেটেখাটো, বেখাপ্পা মুখ। ক্ষুদে চঞ্চল চোখ। হয় রুশ নয় পোল।

কফি নিয়ে বসে টমি ওদের কথাবার্তা শুনবার চেষ্টা করতে লাগল। হুইটিংটন তার সঙ্গীকে বোরিস নামে ডাকছিল।

আয়ার্ল্যান্ড, প্রচার, মিঃ ব্রাউন শব্দগুলো কয়েকবার শোনা গেল। কিন্তু জেন ফির নাম কেউ উচ্চারণ করল না।

রেস্তোরাঁ থেকে বাইরে বেরিয়ে হুইটিংটন সঙ্গীকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে ওয়াটার্ল স্টেশনে এল। হুইটিংটন প্ল্যাটফর্মে নেমে বোর্নমাউথের একটা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কাটল। পেছনে পেছনে টমিও তাই করল।

বোরিস বলল, ট্রেনের এখনো আধঘণ্টা দেরি। আগেই এসে পড়েছ।

টমি বুঝতে পারল, হুইটিংটন একাই যাচ্ছে। বোরিস লন্ডনেই থাকছে।

ওরা প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছে। এই ফাঁকে পাশের একটা টেলিফোন বুথে ঢুকল টমি।

-হ্যাঁ হার্সিমার, এখুনি ওয়াটালুতে চলে এসো। হুইটিংটন আর একজনকে অনুসরণ করছি। গাড়ি ছাড়ার দুমিনিট আগেই হার্সিমার টমির সঙ্গে মিলিত হল। টিকিট কাটার পর পকেটে আর টাকা ছিল না। টমি কিছু টাকা চেয়ে নিল। টিকিটটা হার্সিমারকে দিল, হুইটিংটনকে দেখিয়ে দিল।

এবারে উঠে পড়। ওকে অনুসরণ কর। ট্রে

ন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল। টমি দেখতে পেল বোরিস এগিয়ে যাচ্ছে। সে পেছু নিল।

ওয়াটার্লু ছেড়ে পিকাডেলি হয়ে শ্যাপটবেরী অ্যাভেনিউ ছাড়িয়ে সোহোর দিকের একটা কানা গলির ভেতরে ঢুকে পড়ল বোরিস। টমি পেছনে লেগে আছে।

শেষ পর্যন্ত ধুলো ময়লায় নোংরা, একটা নির্জন জায়গায় চলে এলো টমি। আশপাশে পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি। এমনি একটা বিপজ্জনক বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠল বোরিস। দরজায় অদ্ভুত শব্দ করল। একজন দরজাটা খুলল। দুজনে দুচারটে কথা বলল, ভেতরে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করে দিল।

বোরিসের বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল না টমি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজায় বোরিসের মতোই শব্দ করল।

দরজাটা খুলল একটা লোক। তার কোঁকড়া চুল, শয়তানের মতো মুখ।

–কাকে চাই?

–মিঃ ব্রাউন। কিছু না ভেবেই বলে ফেলল টমি।

–ওপরে, বাঁদিকে দ্বিতীয় দরজা।

লোকটা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল।

.

বাড়িটা যত জীর্ণ, ততোধিক সিঁড়িটা। চারপাশে আবর্জনা। সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলল টমি। সিঁড়ির বাঁক ঘোরার মুখে দেখতে পেল নিচের লোকটা পেছনের একটা ঘরে ঢুকে গেল। সে নিঃসন্দেহ হলো–এখনো কেউ সন্দেহ করেনি। মিঃ ব্রাউনের নামটাই এবাড়িতে রক্ষাকবচ।

সিঁড়ির শেষে বারান্দা। দু পাশে ঘর। একটা ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে। এটাই বাঁদিকের দ্বিতীয় ঘর।

কোনো সংকেত জানা নেই তাই ওই ঘরে ঢোকার সাহস করল না টমি। নিচের লোকটা দলের সবাইকে চেনে না বলেই কিছু সন্দেহ করেনি। টমি উল্টোদিকের ছেঁড়া ভেলভেটের আড়ালে আত্মগোপন করল।

নিচের দরজায় শব্দ হল হঠাৎ। পর্দার ফাঁকে চোখ রাখল টমি। একটা অপরাধী চেহারার লোক উঠে আসছে।

উল্টো দিকের দরজায় সাংকেতিক শব্দ করল লোকটা। ভেতর থেকে কিছু বলল। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

চকিতে চোখে পড়ল–বিরাট টেবিল ঘিরে চার পাঁচজন বসে আছে। একেবারে সামনে বসেছিল নাবিকের মতো ছুঁচলো দাড়িওয়ালা একজন লোক। জার্মান বলেই মনে হল। সে জিজ্ঞেস করল, আপনার নম্বর, কমরেড?

-চোদ্দ, স্যার।

–ঠিক আছে।

 দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আরও কেউ আসতে পারে অনুমান করে জায়গা ছেড়ে নড়ল না। টমি।

কয়েক মিনিট পরেই আবার নিচের দরজায় শব্দ। যে লোকটি ওপরে উঠে এলো, সে আয়াল্যান্ডের সিনফিন। একই ভাবে দরজায় টোকা দিয়ে নম্বর বলে ভেতরে ঢুকে গেল।

এর পরও পর পর দুজন ঢুকল। একজনের চেহারা কেরানীর মত, দ্বিতীয় জন স্রেফ শ্রমিক।

সবশেষে যে এলো তার চেহারা ও পোশাকে কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভাব। উঁচু চোয়াল দেখেই বোঝা গেল নোকটা শ্লাভ।

দরজায় টোকা দিল, কিন্তু অভ্যর্থনা পেল অন্যরকম। টমি অবাক হল। দাড়িওয়ালা জার্মান লোকটা সহ সকলেই উঠে দাঁড়াল।

দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতর থেকে টুকরো কথা ভেসে আসছে। সন্তর্পণে এগিয়ে দরজায় কান পাতল। কিন্তু কিছু বোধগম্য হল না।

টমি হাল ছাড়ল না। সামনে টানা দরজা। কয়েক পা এগিয়ে দ্বিতীয় দরজায় কান পাতল, হাতল ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকল। দরজা বন্ধ করল।

একটা ধুলো মলিন ঘর। ভাঙ্গা আসবাব। দু ঘরের মাঝে দরজা। আস্তে আস্তে খিল খুলল, পাল্লা ফাঁক করল।

সামনেই মখমলের পর্দা ঝোলোনো–তাকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। টমি কান পেতে নিশ্চিন্তে কথা শুনতে লাগল।

কর্মসমিতির দলীয় সভা। খনি শ্রমিকদের সিদ্ধান্তের ওর আলোচনা। নেতাদের সিদ্ধান্ত ২৯ তারিখ রেলপথ অবরোধ…হাঙ্গামা সামলাবার গোলাবারুদ প্রস্তুত…এরপর ধর্মঘট…সবার শেষে এলো দলিলের প্রসঙ্গ…একজন মেয়ে উধাও…

কিন্তু এরপর আর কিছুই শুনতে পেল না টমি। মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত…চোখে অন্ধকার দেখল টমি।

.

০৩.

 টুপেনস সহজ বুদ্ধিতেই বুঝতে পারল, লোক দুজন তিনতলার ফ্ল্যাট থেকেই এসেছে। আর ওই রিটা নামটাই বলে দিচ্ছে জেন ফিনকে কারা অপহরণ করেছে।

টমি বেরিয়ে যেতেই কর্তব্য স্থির করে নিল টুপেনস। হলের দিকে এগিয়ে লিফট বয়ের সঙ্গে কথা বলল।

ছোট ছেলেদের সহজেই আপন করে নিতে পারে টুপেনস। সে ছেলেটির নাম জেনে নিল। অ্যালবার্ট। তার গোয়েন্দা উপন্যাসের দিকে ঝোঁক বোঝা গেল পকেটে পেনি সিরিজের একটা বই দেখে।

নিজেকে আমেরিকান গোয়েন্দা দপ্তরের সদস্য পরিচয় দিয়ে অ্যালবার্টের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিতে বেশি দেরি হল না। তাদের কথোপকথন ছিল এরকম–

–আপনি কি কোনো খুনীকে খুঁজছেন?

–হ্যাঁ, ২০ নম্বর ফ্ল্যাট–তার নাম ভ্যান্ডেমেয়ার। আমেরিকায় নাম রেডি রিটা। ডাকাতি।

 –উরেব্বাস। আমিও তাই বলছিল, উনি ভালো নন।

–অ্যানি কে?

–২০ নম্বরের কাজের মেয়ে। আজই চলে যাচ্ছে। কতবার বলেছে, ওকে একদিন ঠিক পুলিসে ধরবে।

-ওকে পান্না পরতে দেখেছ?

–পান্না, মানে সবুজ পাথর?

–হ্যাঁ, অনেক দাম। ওই জন্যেই তো এসেছি। তবে এখনো প্রমাণ হয়নি, কাউকে এখন কিছু বলবে না।

-না, বলবো না।

–অ্যানি চলে যাচ্ছে কেন?

–ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি।

–তাহলে কাজটা আমি করব। শোন, তুমি বলবে, অ্যানির জায়গায় তোমার এক আত্মীয় কাজ করবে। কি বলতে হবে বুঝতে পেরেছ?

-খুব পেরেছি। আপনি এলে দারুণ হবে।

-তুমি বলবে, আমি এখনই কাজে আসতে পারি। আমাকে জানাবে, কাল এগারোটায় আসব।

-গোয়েন্দাগিরি খুব মজার কাজ, তাই না?

–দারুণ মজার, তোমাকেও সঙ্গে নেব।

সাউথ ম্যানসন থেকে বেরিয়ে সোজা রিজে ফিরে এলো টুপেনস। মিঃ কার্টারকে একটা চিঠি লিখে দিল।

ডিনারের আগে পর্যন্ত টমি বা হার্সিমার কেউ ফিরল না। একটু চিন্তা হল। একাই ডিনার খেল সে।

সকালে মিঃ কার্টারের একটা চিঠি পেল। কাজের অগ্রগতির খবর জেনে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে আরো একবার সম্ভাব্য বিপদের আভাস দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন।

বেলা দশটা পর্যন্ত টমির জন্য অপেক্ষা করল সে। দশটা তিরিশে একটা ট্রাঙ্কে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ট্যাক্সি ধরে প্যাডিংটন এলো।

স্টেশনে ক্লোকরুমে ট্রাঙ্কটা রেখে বাস ধরল। সাউথ অ্যালে ম্যানসনে যখন ঢুকল তখন এগারোটা বেজে দশ মিনিট।

এখানে আসবে বলে বেশবাসের সামান্য বদল ঘটিয়েছিল টুপেনস। চুলের গোছা বদলে বেঁধেছে, ভ্রূ এঁকেছে অন্যভাবে। হুইটিংটন যাতে চিনতে না পারে।

অ্যালবার্টকে দিয়েই বেশ যাচাই করে নিল। প্রথমে চিনতেই পারেনি।

–সব ঠিক আছে মিস। বলেছি, আপনার কথা এক বন্ধুর কাছে শুনেছি। অ্যানি আজ পর্যন্ত আছে। বলেছে আপনাকে সব বলে যাবে।

অ্যালবার্টকে পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে ২০ নম্বরে গিয়ে ঘন্টা বাজাল।

 অ্যানিই দরজা খুলে দিল, নতুন কাজের লোক বুঝতে পেরে ফিসফিস করে কিছু বলল।

 বিরাট বারান্দা পার হয়ে একটা ঘরে টুপেনসকে নিয়ে এলো অ্যানি।

কঠিন অথচ সুন্দর চেহারার মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারকে দেখে সে বুঝতে পারল, সহজে একে বোকা বানানো যাবে না।

তাকে বসতে বলে গৃহকর্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, পার্লার মেড খুঁজছি কি করে জানলে?

-এক বন্ধুর কাছে। এখানকার লিফট বয়ের চেনা।

–আগে কোথায় কাজ করেছ?

এসব অনুসন্ধানের জবাবে মনিবকে সন্তুষ্ট করার মতো জবাব তৈরি করেই এসেছিল টুপেনস। সুতরাং সে কাজে বহাল হয়ে গেল। বাড়ির কাজের জায়গায় সে নাম নিল, প্রুডেন্স কপার।

মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের অনুমতি পেয়ে প্যাডিংটন থেকে নিজের ট্রাঙ্ক নিয়ে আসার জন্য রওনা হয়ে গেল সে।

.

বাড়ির কাজে আর্চডিকনের মেয়ের দক্ষতা কিছু কম ছিল না। সব কাজই সে চটপট বুঝে নিয়ে সারতে লাগল।

মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার ডিনারে একজন অতিথিকে বলেছিলেন। টুপেনস সেভাবেই টেবিল সাজিয়ে রাখল।

রাত আটটার পরে অতিথি এলো। সে দেখে চিনতে পারল, টমি যাদের অনুসরণ করেছিল তার দ্বিতীয় জন। ভ্যান্ডেমেয়ার তাকে বোরিস ইভানোভিচ বলে সম্বোধন করলেন।

টমির কথা ভেবে টুপেনস বিচলিত হয়ে উঠল। ফিরেছে কিনা কে জানে।

ডিনার শেষ হল। টুপেনস পরিবেশনের সময় আগাগোড়া কান খাড়া রেখেছে।

দুজনে একটা ছোট ঘরে ঢুকল। কফি আর পানীয় নিয়ে যখন সে ঢুকল বোরিসকে বলতে শুনল, একে তো ভালোই মনে হচ্ছে। আগেরটি বিপজ্জনক ছিল। তবে নজর রেখো।

মেয়েটা হলের ছেলের পরিচিত। তুমি বড় বেশি ভয় পাও বোরিস। আমাদের বন্ধু মিঃ ব্রাউনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক আছে, আমাকে দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না।

-অত নিশ্চিত হয়ো না রিটা।

টুপেনস বেরিয়ে এলে ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সে অস্থিরতা বোধ করল। দ্রুতপায়ে মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের ঘরের কাছে গেল।

জানালার নিচে দাঁড়িয়ে ভেতরের কথা শুনতে লাগল।

–রিটা, পিল এজারটনের সঙ্গে অত মাখামাখি বন্ধ কর। লোকটা লন্ডনের নাম করা কে. সি.। তাছাড়া আইনবিদ। তুমি বুদ্ধিমতী, আমার কথা বুঝতে পারবে, ওকে ছেড়ে দাও।–আমি সবই বুঝি। কিন্তু তোমার মতো ভীতু নই।

–তুমি গোঁয়ার্তুমি করছ। ঝাঁঝের সঙ্গে বলল বোরিস। এরকম হলে ব্যাপারটা আমাদেরই হাতে নিতে হবে।

-ভুলে যেও না বোরিস, আমি একমাত্র মিঃ ব্রাউনের কাছ থেকেই হুকুম নিই। পিল এজারটনের আকর্ষণের কারণ আমার অজানা নয়।

তুমি সুন্দরী, এই তো? পিল এজারটন অপরাধীর গন্ধ পান, একথা সকলেই জানে। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারা তোমার কর্ম নয়।

বেশ তো সেয়ানে সেয়ানে খেলা জমবে ভালো। তাছাড়া লোকটার অনেক টাকা, আমার চাই টাকা, জানতো।

রিটা, তোমার টাকার লালসা বড় ভয়াবহ। নিজের আত্মাকেও বিক্রি করতে পার। ভয় হয়, কোনো দিন আমাদেরই না বিক্রি করে দাও।

–কোটিপতি ছাড়া সেই পরিমাণ দাম কে দিতে পারবে?

–তাহলে ঠিকই ধরেছি।

–মূর্খ, ঠাট্টা বোঝার মতো মগজও খুইয়েছ।

–ঠাট্টা হলে ভালো।

–আর ঝগড়া নয়, বোরিস

.

পরদিন সকালেও টমির কোনো সংবাদ জানতে পারল না টুপেনস। খুবই মুষড়ে পড়ল। ওর কিছু হয়নি তো? একবার বেরুতে পারলে খবর নেওয়া যেত।

সৌভাগ্যক্রমে সুযোগ এসে গেল। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার তাকে ডেকে বললেন, প্রুডেন্স, রাতে বাড়িতে খাচ্ছি না। তুমি ইচ্ছে করলে ওবেলায় ছুটি নিতে পার।

-ধন্যবাদ মাদাম।

খানিক পরেই লক্ষণীয় চেহারার এক আগন্তুকের আবির্ভাব হল। বিরাট চেহারা মানুষটার। পরিষ্কার কামানো মুখ। আকর্ষণীয় দৃঢ়তা। দেখলেই কোনো আইনজ্ঞ বা অভিনেতা বলে সন্দেহ হয়।

ঘণ্টা শুনে দরজা খুলতেই ভদ্রলোক নাম বললেন, স্যার জেমস পিল এজারটন। টমি বুঝতে পারল, এই সেই বিখ্যাত কে. সি.। ও শুনেছে, ইনি ভবিষ্যতে একদিন ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।

মিনিট পনেরো মাত্র গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে কথা বললেন এজারটন। সেই সময়টা টুপেনস রান্নাঘরেই কাটাল।

পনেরো মিনিট পরে অতিথিকে এগিয়ে দিতে গেল টুপেনস। দোরগোড়ায় ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকে দেখলেন।

বাড়ির কাজে নতুন, তাই না?

 টুপেনস অবাক হয়ে চোখ তুলল।

নিশ্চয় অনটন। জায়গাটা ভালো মনে হচ্ছে?

–খুব ভালো, ধন্যবাদ স্যার।

–কিন্তু আরো ভালো জায়গা আছে, বদলে নেয়ার ক্ষতি নেই।

–আপনি স্যার

–তুমি বুদ্ধিমতী, তাই এটা আমার সামান্য উপদেশ।

 দরজা বন্ধ করল টুপেনস। খুব চিন্তিত হয়ে রান্নাঘরে ফিরল।

.

বিকেলে প্রথমেই রিজে গেল টুপেনস। টমি ফেরেনি। সব জানিয়ে এবং টমিকে খুঁজতে সাহায্য চেয়ে সে মিঃ কার্টারকে চিঠি লিখল। সঙ্গে সঙ্গেই হার্সিমার ঘরে ঢুকল।

-কি ব্যাপার টুপেনস, বুধবার থেকে বেরেসফোর্ডের পাত্তা নেই?

–কোনো খবরই পাওনি? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল টুপেনস।

–কোনো খবর না। বুধবার ওয়াটালুতে ছাড়াছাড়ি হয়। আমাকে ফোন করেছিল।

জুলিয়াস, আমাকে সব কথা খুলে বল।

–নিশ্চয়ই, শোন বলছি। ওর টেলিফোন পেয়ে স্টেশনে পৌঁছতেই দুজনকে দেখিয়ে বলল, বিরাট চেহারার লোকটাকে অনুসরণ কর, হুইটিংটন। বোর্নমাউথের একটা টিকিট ধরিয়ে দিল হাতে। সে অন্য লোকটার পেছনে যাবে বলল। আমি হুইটিংটনের সঙ্গে গেলাম।

বোর্নমাউথ পৌঁছে সে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে পৌঁছে একটা ঘর নিল। আমিও তাই করলাম।

 ডিনারের পর, রাত নটায় ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল হুইটিংটন। আমিও রইলাম পেছন পেছন।

শহরের বাইরে একটা জায়গায় গাড়ি ছেড়ে আধঘণ্টা হেঁটে একটা টিলার ধারে এল, আশপাশে বেশ কয়েকটি ভিলা, আর বাড়ি।

নির্জন পথ, অন্ধকার রাত। বৃষ্টিও পড়ছিল। পেছন থেকে আমি টের পেলাম। একটা বড় বাড়িতে ঘন্টা বাজিয়ে হুইটিংটন ঢুকে পড়ল।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। সব দরজা, জানালা বন্ধ। কেবল দোতলায় একটা ঘরে আলো জ্বলছে। জানালা দিয়ে দেখা গেল। লাগোয়া একটা গাছ। অধৈর্য হয়ে সেই গাছে চড়লাম। জানালা দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেলাম, আমার দিকে মুখ করে একটা টেবিলের সামনে বসে আছে হুইটিংটন।

হাসপাতালের নার্সের পোশাক পরা একজনের সঙ্গে কথা বলছে। নার্সের মুখ দেখতে পাইনি। সে কোনো কথা বলছিল না।

কথা বলে শেষ করে হুইটিংটন উঠে দাঁড়াল। নার্স সম্ভবতঃ বৃষ্টি পড়ছে কিনা দেখতে জানালায় এসে বাইরে তাকালো। আমি কেমন ঘাবড়ে গেলাম, আর অমনি মচাৎ করে ডাল ভেঙ্গে নিচে পড়লাম।

–ওহ, জুলিয়াস, একেবারে বইয়ের গল্পের মতো। তারপর?

তারপর আর কি, যখন জ্ঞান হল, দেখি বিছানায় শুয়ে আছি পাশে একজন নার্স। চেয়ারে বসে আছেন চশমা পরা কালো দাড়িওয়ালা একজন ডাক্তার। পরে জেনেছি ইনি হলেন ডাঃ হল।

ডাঃ আমাকে আশ্বাস জানিয়ে বললেন পা সামান্য মচকে গেছে। দুদিনেই সেরে উঠব। নতুন লাগানো কিছু গাছের ওপরে পড়েছিলাম বলে অঘটন থেকে বেঁচে গেছি।

ডাক্তারের বাড়িতেই তার ব্যক্তিগত নার্সিংহোম। কেন গাছে উঠেছিলাম, সেই কারণ তাকে জানাতে হল। খোলাখুলিই জিজ্ঞেস করলাম, জেন ফিন নামে কোনো মেয়ে চিকিৎসার জন্য তার কাছে এসেছে কিনা। তাকে খুঁজতেই আমি গাছে উঠেছিলাম। ডাঃ হল নামটা চিনতে পারলেন না।

আমি পরে বললাম, আমার এক পুরনো বন্ধুকে দেখলাম নার্সের সঙ্গে কথা বলতে। হুইটিংটনকে তিনি চিনতে পারলেন। বললেন সে তার বোন এডিথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। নার্স এডিথের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ডাঃ জানালেন, সে একজন রোগিণীকে নিয়ে রাতেই চলে গেছে। ওখান থেকেই বেরেসফোর্ডকে চিঠি লিখলাম তারপর ফিরে এলাম। আমার ঘটনা এই।

–কিন্তু টমির কি হতে পারে বলতো?

–সেই বিদেশী লোকটার পেছনেই হয়তো লেগে রয়েছে।

–লোকটার নাম আমি জানতে পেরেছি বোরিস। সে মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের সঙ্গে গতরাতে ডিনার খেয়েছিল। ওহহ, তুমি তো ওই নামটা জান না, তোমাকে বলা হয়নি।

তারপর গত দুদিনের সব ঘটনা টুপেনস হাসিমারকে জানাল।

-শুনতে ভালো লাগছে। কিন্তু টুপেনস প্রতি পদক্ষেপে বিপদ। ওরা সব খুনে লোক বুঝতে পারছি।

-সে নিয়ে ভাবি না। দেখ, আমি কার্টারকে সব জানিয়ে চিঠি লিখেছি। এখন তুমি বল, টমির জন্য কি করা যায়।

–বোরিসকে অনুসরণ করতে হবে। তুমি আমাকে চিনিয়ে দেবে কেবল।

–আজকের একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি বলে টুপেনস স্যার জেমস পিল এজারটনের সব কথা হার্সিমারকে জানাল। শেষে বলল, মানুষটাকে খুব দয়ালু বলেই মনে হল। আইনের প্যাচালো ভাষাতেই আমাকে সাবধান করে দিলেন। ওঁর কাছে গিয়ে সবকথা জানালে কেমন হয়?

কোনো সাহায্য করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া আমাদের ব্যাপারে আবার কোনো আইনজ্ঞকে ডাকা কেন?

–কিন্তু তার কাছে একবার যেতেই হবে।

.

০৪.

 শুক্রবার শনিবার দুটো দিন পথ চেয়ে কেটে গেল। মিঃ কাটার চিঠি দিয়ে জানালেন, তিনি আগেই সতর্ক করেছেন, এখন টমির জন্য কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

হার্সিমার বোরিসের অপেক্ষা করে রয়েছে। সে আর আসেনি।

টুপেনস অস্থির হয়ে উঠল। সে স্যার জেমস পিল এজারটনের ঠিকানা টেলিফোন গাইড থেকে দেখে নিল। তার উপদেশের সূত্র ধরেই সে ভ্যান্ডেমেয়ারের বিষয়ে জানতে চাইতে পারে। হয়তো টমির বিষয়ে কিছু সূত্র মিলতে পারে।

হার্সিমারকে বলে কয়ে রাজি করিয়ে শনিবারে টুপেনস কার্লটন হাউস টেরেস রওনা হল।

বাটলার তাদের লাইব্রেরি ঘরে নিয়ে এলো। ঘর ভর্তি বই। বেশির ভাগই অপরাধ তত্ত্বের বিষয়ে। বিরাট ডেস্কের পাশে বসেছিলেন স্যার জেমস।

-ওহ, তুমি? মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের কিছু খবর এনেছ?

টুপেনস নিজের আসল নাম জানাল, হার্সিমারের পরিচয় দিল। পরে কোনোরকম ভূমিকা না করেই বলল, সেদিন মনে হল আপনি আমাকে মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার সম্পর্কে সাবধান করতে চেয়েছিলেন। ওখানকার কাজ কি আমার ছেড়ে দেওয়া উচিত?

–তোমার মত কোনো ছোট মেয়ের পক্ষে জায়গাটা ঠিক মনে হয়নি। তারই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলাম।

-বুঝেছি। আমি তো জেনেশুনেই তার ওখানে কাজ নিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছে, সব কথা আপনাকে খুলে জানানো উচিত।

–হ্যাঁ, বল, আমি জানতে চাই। টুপেনস আগাগোড়া সবকথা বলে গেল। স্যার জেমস মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।

–তোমার কাহিনীর অনেকটাই আমার জানা। জেন ফিন সম্বন্ধে আমার নিজেরও আগ্রহ রয়েছে। তোমরা অসাধারণ কাজ করেছ। কিন্তু সব জেনেশুনে এরকম কাজে তোমাদের লাগানো ওই কার্টার নামের ভদ্রলোকের উচিত হয়নি।

–টমির কি হয়েছে বলে আপনি মনে করছেন? জানতে চাইল টুপেনস।

-হুম। আজ রাতেই কদিন ছুটি কাটাতে আমার স্কটল্যান্ডে যাবার কথা। এখন দেখছি টমি ছোকরার খোঁজখবর নিতে হবে। যা বুঝতে পারছি, ও খুবই খারাপ জায়গায় মাথা গলিয়েছে। যদি সে বেঁচে থাকে, তাহলে অনেক দরকারী খবর সে দিতে পারবে। কাজেই যেভাবেই হোক তাকে খুঁজে বার করতেই হবে।

স্যার জেমসের সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে টুপেনস উৎসাহিত হল। সাগ্রহে জানতে চাইল, –কিন্তু ওর খবর কি করে আমরা পেতে পারি?

–টমির খবর দিতে পারে একজনই, সে হল মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার।

 –কিন্তু তিনি কিছুতেই বলবেন না।

–মোচড় দিতে হবে। সে অস্ত্র আমার কাছে আছে। তাতেও না হলে ঘুষের পথ আছে।

হাসিমার বলল, যতটাকা লাগে আমি দিতে পারি। দরকার হলে দশ লক্ষ ডলার–এছাড়াও আপনার ফি হিসেবে যা দরকার–

স্যার জেমস চোখ তুলে তাকালেন। বললেন, আমি তোমাদের বন্ধু, কাজেই ফি-এর প্রশ্ন নেই মিঃ হার্সিমার। আমি কোনো বেসরকারি গোয়েন্দা নই।

হার্সিমার ক্ষমা প্রার্থনা করে বলল, টাকার জন্য কোনো কাজ আটকে থাকছে শুনলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। জেনের খবরের জন্য মোটা টাকা ঘোষণা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আপত্তি করেছে।

–সম্ভবতঃ ওরা ঠিকই করেছে। যাইহোক, টুপেনস, আজ রাতে মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার ডিনার বাইরে করছেন কিনা জানো?

–বাইরে করবেন।

–তাহলে আমি দশটায় যাবো। তুমি কটায় ফিরছ?

–নয়টা-দশটা হবে।

–খুব সেয়ানা মহিলা। সন্দেহ করবে। তুমি যাবে সাড়ে নটায়, আমি দশটায়। মিঃ হার্সিমার নিচে একটা ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করতে পারেন। তাহলে এই ব্যবস্থাই রইলো।

স্যার জেমসের সঙ্গে করমর্দন করে ওরা বাইরে এলো। গাড়ি নিয়ে হার্সিমার নিজে চলে গেল। টুপেনস হাউড পার্কের কাছাকাছি নেমে গেল।

খানিকক্ষণ সে এপাশ ওপাশ ঘুরল। কিন্তু ম্যানসনে ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত কাছাকাছি চলে এলো। একটা জোরালো শিসের শব্দ করল। শুনতে পেয়ে অ্যালবার্ট বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর কাছে ছুটে এলো।

–মিস, রেডি রিটা, সেই আসামী চলে যাচ্ছেন। আমাকে ট্যাক্সি ডেকে দিতে বলেছেন।

টুপেনস চমকে উঠল। সে অ্যালবার্টের হাত চেপে ধরল।

–ওকে যেভাবেই হোক আটকাতে হবে। তুমি না বললে কিছু জানতেই পারতাম না। তুমি রাস্তার কোনো টেলিফোন থেকে এখুনি রিজে হাসিমারকে জানাও। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার পালাবার চেষ্টা করছেন বলবে। ওকে না পেলে নম্বর দেখে নিয়ে স্যার জেমস পিল এজারটনকে ফোন করবে। তাড়াতাড়ি কর।

–আপনি কিছু ভাববেন না মিস।

ম্যানসনে ঢুকে কুড়ি নম্বরে বেল টিপল টুপেনস। দরজা খুলে দিলেন মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার।

–তুমি এখনই ফিরে এলে?

–ভয়ানক দাঁতের যন্ত্রণা হচ্ছে মাদাম।

–আহা। তাহলে গিয়ে শুয়ে পড়।

–না, বরং রান্না ঘরেই যাই।

রাঁধুনিকে বাইরে পাঠিয়েছি। তোমার শুয়ে পড়া উচিত।

হঠাৎ টুপেনস চমকে গেল। মাথার পাশে ঠান্ডা ইস্পাতের কঠিন স্পর্শ।

–ক্ষুদে গুপ্তচর! আমাকে বোকা বানাবে ভেবেছিলে। চিৎকার করবার চেষ্টা করলে কুকুরের মতো গুলি করে মারব। আমার ঘরে এগোও

দাঁতে দাঁত চেপে বললেন মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার। তার হিংস্র মুখের দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠল টুপেনসের। শোবার ঘরে না ঢুকে উপায় নেই। পিস্তল কপালে ঠেকানো।

সমস্ত ঘর লণ্ডভণ্ড। একপাশে একটা সুটকেস। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি।

টুপেনস কোনো রকমে সাহস জুগিয়ে বলল, আমাকে আপনি গুলি করবেন?

বাঁচার সাধ থাকলে নড়বে না। যা বলব, মুখবুজে করবে। তুমি আমাকে ঠকিয়েছে। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার নাগালের মধ্যে রিভলবারটা রাখলেন। একটা বোতলের ছিপি খুলে খানিকটা তরল পদার্থ গ্লাসে ঢাললেন।

–এটা খেলেই তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।

–আমাকে বিষ খাইয়ে মারতে চাইছেন?

–না, আমি পুলিসের তাড়ায় থাকতে চাই না। এটা খেলেই ঘুমিয়ে পড়বে

–টুপেনস বুঝতে পারল, তাকে বিষ খেয়েই মরতে হবে। সে মরিয়া হয়ে মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পাগলের মত ভঁর স্কার্ট আঁকড়ে ধরল।

–এটা বিষ আমি জানি। আপনি আমাকে বিষ খেতে বলবেন না। বরং গুলি করে মারুন।

 –ক্ষুদে গুপ্তচর, কোথায় মাথা গলিয়েছ বুঝতে পারনি। ওঠো বলছি।

 টুপেনস সেভাবেই রইল। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার গ্লাসটা ওর ঠোঁটে চেপে ধরলেন।

–খেয়ে ফেলল এটা

–ওটা বিষ, আমি খাব না।

–বোকামি করো না। তুমি মরবে না।

টুপেনস উঠে দাঁড়ালো। কাঁপা হাতে গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে তুলে ধরল।

–লক্ষ্মী মেয়ের মতো খেয়ে ফেলো।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার মুহূর্তের জন্য অসতর্ক হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে গ্লাসের সমস্ত তরল তার চোখেমুখে এসে পড়ল।

লাফিয়ে পড়ে টুপেনস রিভলবারটা তুলে নিয়ে গৃহকর্ত্রীর দিকে তাক করল।

-এবার আপনি আমার হাতে। ভেবেছিলেন ভয়ে চামচিকে হয়ে যাব।

 মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের মুখ লাল হয়ে উঠল। প্রবল ক্রোধ সামলে নিলেন।

-চেয়ার টেনে নিয়ে বসুন। আমার কথার ঠিক ঠিক জবাব দেবেন। অনেক টাকা পাবেন।

–টাকা

–হ্যাঁ, টাকা। অনেক টাকা–এক লক্ষ পাউন্ড।

–টাকার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব? কিন্তু অত টাকা তুমি কোথায় পাবে?

–আমার এক বন্ধুর আছে। তিনি আমেরিকান।

–তোমার বন্ধু কি জানতে চান?

–জেন ফিন কোথায়?

–তা জানানো যাবে, অসুবিধে হবে না।

তাছাড়া আমার এক বন্ধু–আপনার বন্ধু বোরিসের হাতে, তার কিছু হয়েছে।

তার নাম কি?

–টমি বেরেসফোর্ড।

 –ওরকম নাম শুনিনি। বোরিসকে জিজ্ঞেস করব।

–আর একটা কথা, মিঃ ব্রাউন কে?

 চকিতে মুখভাব পাল্টে গেল মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের। চোখে কাতর দৃষ্টি।

–ব্রাউন কে আমরা কেউ জানি না।

–আপনি জানেন, আমি জানি।

–হ্যাঁ জানি। কিন্তু আমার নাম প্রকাশ করা হবে না, শপথ করো।

শপথ করছি। সে ধরা পড়লে আপনার আর ভয় কি।

–সে কি কোনো দিন ধরা পড়বে! কিন্তু টাকা

 টাকা নিশ্চিত। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সে বন্ধু এসে পড়বে।

 অকস্মাৎ আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার।

–ও কিসের শব্দ?

–কোনো শব্দ শুনিনি।

–কিন্তু আমার কথা কেউ শুনে ফেলতে পারে।

–এখানে তেমন কেউ নেই।

–তুমি জানো না, দেয়ালেরও কান আছে। আমার ভয় করছে

 সহসা একটা আর্তনাদ করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। হাত তুলে টুপেনসের মাথার ওপর দিয়ে কিছু ইঙ্গিত করতে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞান হারালেন।

টুপেনস ঘুরে দাঁড়িয়ে স্যার জেমস পিল এজারটন আর হার্সিমারকে দেখতে পেল।

.

মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে খানিক শুশ্রূষা করলে তার জ্ঞান ফিরে এল। খানিকটা ব্র্যাণ্ডি পান করে ধীরে ধীরে উঠে বসলেন।

-আমার হার্টে যন্ত্রণা হচ্ছে। কথা বলা উচিত হবে না।

সকলে খানিকটা তফাতে সরে এলো। টুপেনস সবকিছু খুলে বলল।

 হার্সিমার বলল, টাকা না পেলে কিছু বলবেন না।

–আমাদের দেখেই আতঙ্কে হার্টে চোট লেগেছে। মিঃ ব্রাউনের আতঙ্ক। সকাল পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। বললেন স্যার জেমস।

–সুচতুর অভিনেত্রী; সবটা ধাপ্পাও হতে পারে। আমাদের ফ্ল্যাট ছেড়ে যাওয়া উচিত হবে না।

শোবার ঘরেই দরজায় তালা আটকে ফেলে রাখা হল মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারকে। সকলে স্থির করল, রাতটা বসার ঘরে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেবে।

এই ঘরও এলোমেলো হয়ে আছে। স্যার জেমস বললেন, ব্রাউনের ভয়েই পালাতে চেয়েছিলেন বোঝা যাচ্ছে।

মহাধড়িবাজ লোক। আমাকে ধাপ্পা দিয়ে জেনের ছবিটা হাতিয়েছে। জেনকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে স্যার জেমস? বলল হার্সিমার।

–অনুমান করতে পারি, বোর্নমাউথ নার্সিংহোমে ছিল সে–আপনার রাতের সেই অ্যাডভেঞ্চারের জায়গায়। বললেন স্যার জেমস।

–কিন্তু আমি জানতে চেয়েছিলাম।

 –সেখান তার জেন ফিন নাম ছিল না নিশ্চয়ই।

–ডাক্তারও এর মধ্যে থাকতে পারে। বলল টুপেনস।

–না, তিনি খাঁটি লোক, আমি তাকে জানি। বললেন স্যার জেমস।

 সহসা শিউরে উঠল টুপেনস। চিৎকার করে বলল, আমার কেমন অনুভব হচ্ছে মিঃ ব্রাউন এই ফ্ল্যাটেরই কোথাও রয়েছেন। আমার মন বলছে।

.

সকালে চারজনের জন্য চা করে নিয়ে এলো টুপেনস। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের ঘরের তালা খুলে দিল হার্সিমার। চা নিয়ে ঘরে ঢুকে ডাকতে গিয়েই বিস্ময়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল টুপেনস। বাকি দুজন ছুটে এলো, মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার ঘুমের মধ্যেই মারা গেছেন।

মিঃ ব্রাউনের পরিচয় প্রকাশ করতে গিয়ে প্রাণ হারালেন মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার। কিন্তু কিভাবে, তা আমাদের জানতে হবে।

ঘরে সবকিছু খুঁজে দেখা হল, যদি কিছু সূত্র পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না।

দশ মিনিটের মধ্যেই একজন ডাক্তার এলেন। ঘরে ঢুকেই বললেন, ঘরে ক্লোরালের গন্ধ, কোথায় আছে দেখুন।

মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার যে বোতল থেকে গ্লাসে তরল ঢেলেছিলেন, তার তিন ভাগই পূর্ণ ছিল টুপেনসের মনে পড়ল। দেখা গেল এখন সেটা শূন্য।

.

ডাক্তারের ঝামেলা স্যার জেমসই কৌশলে সামলালেন। ডাক্তার জানলেন, ভুল বশতঃ বেশিমাত্রায় ক্লোরাল মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার পান করেছিলেন।

স্যার জেমস জানালেন, মহিলার আত্মীয়স্বজনকে তারা চেনেন না। বিদেশে যাবেন শুনে তারা দেখা করতে এসেছিলেন।

কিছুক্ষণ পরেই একজন নার্স এসে পৌঁছল। সকলে সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

.

–আর তো কোনো পথ রইল না। এবার আমরা কি করব? হতাশকণ্ঠে বলল হার্সিমার।

–মেট্রোপোলে যেতে হবে আমাদের। ডাঃ হল আমাদের সাহায্য করতে পারেন।

 বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যেই সকলে ডাঃ হলের সঙ্গে মিলিত হলেন।

ডাঃ হল হার্সিমারকে চিনতে পারলেন। টুপেনসের পরিচয় তাঁকে জানানো হল। স্যার জেমস বললেন, আমরা একটি তরুণীর সন্ধান করছি। খবর আছে, বোর্নমাউথে আপনার চিকিৎসাধীনে সে কোনো সময়ে ছিল। একটা মামলার প্রয়োজনেই এসব কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।

–আপনাকে সাধ্যমত সাহায্য করব, বললেন ডাঃ হল, মিঃ হার্সিমারও একটি তরুণীর কথা জানতে চেয়েছিলেন।

-বুঝতেই পারছেন, বললেন স্যার জেমস, এক্ষেত্রে নামটা মূল্যহীন। আচ্ছা, মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার নামে কোনো মহিলার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?

–২০ সাউথ অ্যালে ম্যানসনের সেই সুন্দরী মহিলা তো?

–হ্যাঁ। তিনি গতরাতে মারা গেছেন; বেশি মাত্রায় ক্লোরাল খেয়েছিলেন।

–খুবই দুঃখের কথা।

–তিনি কি তার অল্পবয়সী কোনো আত্মীয়াকে, আপনার কাছে রেখে গেছেন?

–মেয়েটির কি নাম?

–তার ভাইঝি হতে পারেন, জেনেট ভ্যান্ডেমেয়ার।

–কবে তাকে আনেন?

–সম্ভবত ১৯১৫ সালের জুন-জুলাইতে।

-হ্যাঁ, বললেন ডাঃ হল। তার স্মৃতিভ্রংশ ঘটেছে। ১৯১৫ সালের ৭ই মের আগের কোনো কথাই স্মরণ করতে পারছে না। খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, স্যার জেমস। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের কাছে শুনেছি লুসিটোনিয়া নামে যে যাত্রীবাহী জাহাজটাকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মেয়েটি তার যাত্রী ছিল।

-কতটুকু সে স্মরণ করতে পারছে?

–জীবিত যাত্রীদের সঙ্গে তীরে পৌঁছনো পর্যন্ত। কোথা থেকে এসেছে, তার নাম কি, এসব কিছুই বলতে পারছে না।

স্মৃতিশক্তি কি আর ফিরে আসবে না?

–আসবে, তবে সময়সাপেক্ষ। স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত লাগলে এমন হয়ে থাকে। ওকে অন্য কারো কাছে দিতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার রাজি হননি।

-আপনি জেনকে আনতে বলুন, বলল হার্সিমার, এবারে আমি চেষ্টা করে দেখি।

–কিন্তু মিঃ হাসিমার, মিস ভ্যান্ডেমেয়ার তো এখন আমার চিকিৎসায় নেই।

–সে আপনার এখানে নেই?

-না। আপনি যেদিন এখানে গাছ থেকে পড়লেন, গত বুধবার, তাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

-সেদিন সন্ধ্যায়?

রাতের ট্রেনে। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের কাছ থেকে জরুরী খবর আসার পরেই নার্স তাকে নিয়ে রওনা হয়ে যায়।

-সেই নার্স এডিথ?

–হ্যাঁ। কি হয়েছে মেয়েটির?

–সেটাই খবর নিতে হবে, বললেন স্যার জেমস, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ডাঃ হল।

বিদায় নিয়ে সকলে বাইরে এলো। টুপেনস বলল, জেনের ব্যাপরটা আবার অনিশ্চিত হয়ে গেল। টমিরও কোনো খবর নেই।

তবু আশা ছাড়লে চলবে না, বললেন স্যার জেমস, আমাকে স্কটল্যান্ড যেতেই হচ্ছে। এদিককার খবরাখবর আমাকে জানিও।

-কিন্তু আপনি চলে গেলে

 টুপেনসের হাত ধরে স্যার জেমস বললেন, ভেঙ্গে পড়ো না, ছুটির দিনের সময়ও কাজের সময়।

ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্যার জেমস চলে গেলেন।

.

গাড়িতে যেতে যেতে হার্সিমার টুপেনসকে বলল, জেনকে ফিরে পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। ভাবছি আমেরিকাতেই ফিরে যাব।

–আমার টমিকে খুঁজে বার করতেই হবে। চিন্তিতভাবে বলল টুপেনস।

 আরো কিছু কথাবার্তা হলো ওদের মধ্যে। টুপেনস বুঝতে পারল, হার্সিমার জেনের আশা ছেড়েই দিয়েছে।

টমি আর টুপেনস দুজনে নিছকই বন্ধু, প্রেমিক প্রেমিকা নয়, জানতে পেরে হার্সিমার তাকে বিয়ের প্রস্তাব করল।

–তোমাকে আমার খুবই পছন্দ টুপেনস।

–আমাকে ভাবতে হবে জুলিয়াস।

–বেশ আগামীকাল পর্যন্ত ভেবে আমাকে জানিও।

 রিজে পৌঁছে, যে যার ঘরে চলে গেল। টমির ছবিটা তুলে নিল টুপেনস। সহসা মুখ চেপে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

কিছু পরে একটা কাগজে কিছু লিখে খামে পুরে হার্সিমারের ঘরে গেল সে। তাকে না পেয়ে চিঠিটা রেখে বেরিয়ে এলো।

একটা ছেলেকে তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।

–আপনার টেলিগ্রাম, মিস।

টেলিগ্রামটা পড়েই টুপেনস চিৎকার করে উঠল। ওটা টমির টেলিগ্রাম।

.

০৫.

 মাথায় একটা যন্ত্রণা নিয়ে টমি জ্ঞান ফিরে পেল। ধীরে ধীরে চোখ মেলল। তারপর উঠে বসল।

দাড়িওয়ালা জার্মান লোকটি গ্লাসে ব্র্যাণ্ডি এগিয়ে দিল। ওটা খেয়ে চাঙা হল সে। যে ঘরে সভা বসেছিল সেখানেই একটা সোফাতে শুয়েছিল টমি। তার একপাশে জার্মান লোকটি, অন্য পাশে নিচের দরজার সেই শয়তানমুখো লোকটা। ও শুনতে পেল, জার্মান লোকটা তাকে কনরাড বলে সম্বোধন করছে। বোরিসও আছে।

টমি নিজের অবস্থাটা একপলকে বুঝে নিল। মাথা ঠিক রেখে বলা কওয়া করতে হবে।

-তুমি গুপ্তচর হয়ে আমাদের ডেরায় ঢুকেছ। তোমাকে মেরে ফেলা হবে, কিছু বলার আছে? বলল জার্মান লোকটি।

–তাহলে জ্ঞান ফেরালেন কেন? খুন করে ফেললেই হতো। বলল টমি।

জবাব দিতে একটু ইতস্ততঃ করল জার্মান লোকটি। সেই সুযোগে টমি ফের বলল, আমি কোথা থেকে এসেছি, কতটা জেনেছি, আমাকে খুন করলে এসব তো জানা যাবে না।

বোরিস চেঁচিয়ে উঠল, তোমাকে আর সুযোগ দেব না। ওকে এখুনি খুন কর।

-দরজায় কনরাড ছিল, বলল টমি, তাকে সংকেত বলেই আমি ভেতরে ঢুকেছিলাম, বুঝতে পারছেন না।

জার্মান লোকটা বলল, ঠিকই বলেছ। তাহলে তোমার মুখ থেকে কথা আদায় করতে হবে। বোরিস এ বিদ্যেয় ওস্তাদ।

-আমাকে খুন না করলে বলতে পারি সবই।

বোরিস ঘুসি পাকিয়ে এগিয়ে এসে বলল, কোনো দর কষাকষি চলবে না।

–এমন কিছু আমি জানি, যা নিয়ে দর কষাকষি করতে পারি।

–কি জান তুমি। চিৎকার করে উঠল জার্মান লোকটি।

 –ডেনভারস…আমেরিকা থেকে লুসিটোনিয়া জাহাজে যে খসড়া

–ওগুলো তোমার কাছে?

জার্মান লোকটা ছিটকে ঝুঁকে পড়ল টমির ওপর।

–আমার কাছে নয়, তবে কোথায় আছে আন্দাজ করতে পারি। আর তা কেবল আমিই জানি। সব বলতে পারি আমার জীবন আর মুক্তির বদলে।

জার্মান লোকটির হুকুমে তখনই টমিকে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ওর হাতপায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হল।

জার্মান লোকটি পাশের চেয়ারে বসে বলল, তোমার শর্তে আমরা রাজি, কিন্তু আগে কাগজগুলো হাতে পাওয়া চাই।

–আমার সঙ্গে একজনকে কনরাড যাবে।

 –তুমি এখানেই থাকবে। তোমার চিঠি নিয়ে একজন যাবে।

–কিন্তু মেয়েটাকে যে দেখতেই হবে।

–মেয়েটা? কোনো মেয়ে?

–জেন ফিন।

–সে কিছু বলতে পারবে না, নিশ্চয়ই জানো।

–তাহলেও একবার তার মুখোমুখি হব। কিছু বলতে বলব না।

–তাহলে দেখা করতে চাও কেন?

–তুমি কিছুই জানো না, বুঝতে পারছি, ধাপ্পা দিচ্ছ। বলল কনরাড।

–আপনাদের সবকথা অবশ্যই জানি না। তবে এমন কিছু জানি যা আপনারা জানেন না। ডেনভারস লোকটা ধূর্ত

-ডেনভারস? বুঝতে পারছি। কনরাড, ওকে ওপরে নিয়ে যাও। জার্মান লোকটি বলল।

–কিন্তু মেয়েটির ব্যাপার কি হবে?

–সেটা ঠিক করবেন মিঃ ব্রাউন।

টমিকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরের একটা ছোট্ট ঘরে নিয়ে এল কনরাড। গ্যাসের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ঘরটা ছোট, ধুলোয় ভরা। কোনো জানলা নেই। টমি দেখতে পেল দেয়ালে চারখানা ছবি ঝুলছে।

টমি চুপচাপ বসে ভাবতে লাগল, ভাগ্য ভালো হলে এবারে সে মিঃ ব্রাউনকে দেখতে পাবে, জেন ফিনকেও। তার পরে কি হবে–তা নিয়ে ভাববার একটা চেষ্টা করতে লাগল।