০৬.
মিস ব্ল্যাকলককে সবকথা জানালেন ক্র্যাডক। তার ইঙ্গিতও বুঝতে অসুবিধা হল না।
ধীর শান্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, গোটা ব্যাপারটাই বদলে যাচ্ছে দেখছি। কিন্তু আমাদের চোখের আড়ালে দরজায় এমন কারচুপি কে করল বুঝতে তো পারছি না।
ব্যাপারটা নিশ্চয় পরিষ্কার হয়েছে আপনার কাছে। সেদিন যখন আলো নিভে গিয়েছিল, যে কেউ গা ঢাকা দিয়ে এই দরজা দিয়ে রুডি সার্জের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে পারত, আর আপনাকে গুলি করাও তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না।
–হ্যাঁ, কারো চোখে পড়া সম্ভব ছিল না। বললেন মিস ব্ল্যাকক।
–হ্যাঁ। আলো নিভে যেতেই সকলে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়ে কথা বলতে শুরু করে। এরপর তাদের চোখে এসে পড়ে টর্চের জোরাল আলো।
–মনে করতে পারছি সবই। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করেন যে আমার পড়শীদের মধ্যে কেউ চুপিসারে বেরিয়ে এসে আমাকে খুনের চেষ্টা করেছিল? কিন্তু কেন খুন করতে চাইবে আমাকে? সেটাই তো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
–এর উত্তর তো একমাত্র আপনিই জানেন মিস ব্ল্যাকলক।
–কিন্তু, বিশ্বাস করুন, ইনসপেক্টর, সত্যিই আমি জানি না।
–কিন্তু আমাদের সে কথাটাই জানতে হবে। বেশ, একটু আলোচনা করে দেখা যাক। আপনি মারা গেলে আপনার টাকাকড়ি কে পাবেন?
মিস ব্ল্যাকলক একমুহূর্ত ইতস্তত করলেন। পরে বললেন, প্যাট্রিক আর জুলিয়া। আর বানি পাবে বাড়ির আসবাবপত্র আর সামান্য মাসোহারা। আসলে আমার মূলধন খুবই সামান্য। তার জন্য আমার খুন হবার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অবাস্তব।
যাইহোক, যেটুকুই আছে, তা আপার বোনপো আর বোনঝি পাচ্ছেন।
–আপনি বলতে চাইছেন ওরা আমাকে খুনের পরিকল্পনা করবে? এ আমি কখনোই বিশ্বাস করি না। তারা এমন কিছু অনটনে পড়েনি।
–তাদের আর্থিক অবস্থার কথা আপনি জানেন?
–ওরা যা বলেছে, তাই জানি। তবে ওদের সন্দেহ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
একমুহূর্ত থেমে তিনি ফের বললেন, আমি খুন হওয়ার পর্যায়ে আসতে পারি, হয়তো একদিন, তবে এখন নয়।
ক্র্যাডক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মিস ব্ল্যাকলকের দিকে। বললেন, আপনার একথার অর্থ মিস ব্ল্যাকলক?
-আমি বলতে চাইছি, হয়তো শিগগিরই আমি অনেক টাকার মালিক হতে পারি।
ব্যাপারটা খুলে বলবেন?
-বলব অবশ্যই। আপনি হয়ত জানেন না যে আমি কুড়ি বছর একজন বিখ্যাত ধনী ব্যক্তির সেক্রেটারি ছিলাম। র্যাণ্ডাল গোয়েডলারের নাম নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। ১৯৩৮ সালে তিনি মারা যান।
ক্র্যাডক বললেন, হ্যাঁ একজন, দুঃসাহসিক বিনিয়োগকারী বলে অর্থনৈতিক জগতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কোটিপতি মানুষ।
–কেবল কোটিপতি বললে সামান্যই বলা হবে। কেন না বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থের পরিমাণ ওঠা নামা করত। নতুন ঝুঁকিতে অর্থ বিনিয়োগ করা, বলতে পারেন তার নেশার মত ছিল।
যাইহোক, ধনী অবস্থাতেই তিনি মারা যান। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই ট্রাস্টের মাধ্যমে তার জীবদ্দশাতেই সব স্ত্রীকে দিয়ে যান। আর তাঁর মৃত্যুর পর সবেরই মালিক হব আমি।
একটা খবর ক্র্যাডকের স্মরণে এলো–শিরোনাম ছিল এরকম, বিশ্বস্ত সেক্রেটারির বিপুল সৌভাগ্যবা এরকম কিছু।
মিস ব্ল্যাকলক বলে চললেন, এ ঘটনা বছর বারো আগের। সেই সময় মিসেস গোয়েডলারকে খুন করার একটা মোটিভ আমার থাকতে পারত।
–মাপ করবেন, মিঃ গোয়েডলার তাঁর সম্পত্তি এভাবে দান করলেন, এটা তার স্ত্রীর মেনে নিয়েছিলেন?
আপনি অনেকটা রেখেঢেকেই বললেন, বললেন মিস ব্ল্যাকলক, আপনি বলতে চাইছেন, আমার সঙ্গে মিঃ গোয়েডলারের কোন গূঢ় সম্পর্ক ছিল কিনা। না, তেমন সম্পর্ক ছিল না। তিনি স্ত্রী বেলকে মৃত্যু পর্যন্ত গভীরভাবে ভালবাসতেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কৃতজ্ঞতা থেকেই তিনি ওই উইল করেছিলেন।
ইনসপেক্টর, মানুষের অবস্থা সবসময় এক রকম থাকে না। মিঃ গোয়েডলারও প্রথম দিকে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে ছিলেন। সেই সময় আমি তাকে একটু সাহায্য করেছিলাম। খুবই সামান্য মাত্র কয়েক হাজার টাকা।
স্বভাববশে অত্যন্ত ঝুঁকির কাজেই তিনি আমার সেই সামান্য পুঁজি লাগিয়েছিলেন। আর একসপ্তাহ পরেই তিনি অবিশ্বাস্য ধনী হয়ে যান।
অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে যেন তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন মিস ব্ল্যাকলক। পরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
–সেই দিনগুলি কী উত্তেজনাময় আর উপভোগ্যই ছিল। এরপর আমার বাবা মারা গেলেন। আমার এক পঙ্গু বোন ছিল। সে খুবই অসহায় হয়ে পড়ল। আমাকে তাই সব ছেড়ে তাকে দেখার জন্য যেতে হল। এর একবছর পরেই মিঃ গোয়েডলার মারা যান।
কাজের সময় যথেষ্ট টাকা পেতাম আমি। তাই তিনি আমাকে কিছু দিয়ে যাবেন আশা করিনি। যখন শুনলাম তার স্ত্রী বেন মারা গেলে সব সম্পত্তি আমিই পাব, খুবই আনন্দ হয়েছিল।
র্যাণ্ডালের স্ত্রী ছিল রোগেভোগা, বেশিদিন বাঁচার আশা ছিল না। সে খুবই চমৎকার মানুষ আমাকে পছন্দ করত। আমার ধারণা, সব জেনে সে খুবই খুশি হয়েছে।
বেন এখন থাকে স্কটল্যাণ্ডে। যুদ্ধের আগে আমার বোনকে নিয়ে সুইজারল্যাণ্ডে এক স্বাস্থ্যনিবাসে গিয়েছিলাম। সেখনেই সে মারা যায়।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেই মিস ব্ল্যাকলক। পরে বললেন, মাত্র এক বছর আগে আমি ইংলণ্ডে এসেছি।
গভীর মনোযোগের সঙ্গে তার কথা শুনছিলেন ক্র্যাডক, এবারে বললেন, আপনি বললেন খুব শিগগিরই ধনী হতে পারেন–কত শিগগির মনে করেন আপনি?
–বোনকে যে নার্স দেখাশোনা করে তার কাছ থেকে শুনেছি, বোনের শরীর খুবই জীর্ণ হয়ে পড়েছে। হয়তো কয়েক সপ্তাহ আর বেঁচে থাকবে। কিন্তু ওই বিপুল পরিমাণ অর্থের কোন সার্থকতা আমার কাছে নেই। আমার সরল জীবনযাত্রার জন্য যেটুকু দরকার তা আমার আছে। আমার বয়সও হয়েছে। তবু আমাকে যদি প্যাট্রিক আর জুলিয়া খুন করতে চায় তাদের এখনও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
-কিন্তু, একটা প্রশ্ন মিস ব্ল্যাকলক, মিসেস গোয়েডলারের আগে যদি আপনি মারা যান তাহলে কি হবে?
–এ নিয়ে কখনও ভাবিনি…তবে সম্ভবত পিপ আর এমাই সব পাবে
ক্র্যাডক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন। মিস ব্ল্যাকলক হেসে বললেন, পিপ আর এমা কে বুঝতে পারছেন না, তাই না?
আমার ধারণা, মিসেস গোয়েডলারের আগে আমার মৃত্যু হলে সব অর্থের আইনত উত্তরাধিকারী হবে মিঃ গোয়েডলারের একমাত্র বোন সোনিয়ার দুই ছেলেমেয়ে। ওরা যমজ ভাইবোন।
গোয়েডলারের সঙ্গে বোনের সুসম্পর্ক ছিল না। সোনিয়া যাকে বিয়ে করেছিল, গোয়েডলার তাকে পছন্দ করতেন না। লোকটিকে প্রতারক আর শঠ বলেই তিনি মনে করতেন।
–সে কি সত্যিই তাই ছিল?
–গোয়েডলার লোকচরিত্র ভাল বুঝতেন। তিনি ভুল করেননি নিশ্চয়ই। ভদ্রলোক একজন গ্রীক বা রোমানিয় ছিল, নামটা…হা মনে পড়েছে–ডিমিট্রি স্ট্যামফরডিস।
–ওই লোককে বিয়ে করার জন্যই র্যাণ্ডাল গোয়েডলার তার উইলে বোনকে বঞ্চিত করেছিলেন?
গোয়েডলার আগেই বোনকে প্রচুর অর্থ দিয়েছিলেন, তবে সেই অর্থে তার স্বামীর হাত দেবার সুযোগ ছিল না।
যাই হোক, আমার ধারণা গোয়েডলারের উকিল তাকে পরামর্শ দিয়েছিল। আমার আগে মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারী হিসেবে অন্য কারও নাম দেওয়া দরকার। গোয়েডলার তখন হয়তো অনিচ্ছার সঙ্গেই সোনিয়ার সন্তানদের নাম করেন।
–পিপ আর এমা সেই বোনেরই সন্তান?
-হ্যাঁ। আমার স্মরণ আছে, সোনিয়া বেলকে একবার চিঠিতে জানিয়েছিল তার দাদাকে জানাবার জন্য যে তার যমজ সন্তান হয়েছে। তাদের নাম পিপ আর এমা। এরপর সে আর চিঠি দেয়নি। তবে এসম্পর্কে যদি খোঁজখবর নিতে চান তাহলে আপনাকে বেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আমার ধারণা সে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।
ক্র্যাডককে চিন্তিত দেখাল। তিনি বললেন, তাহলে এটা পরিষ্কার হচ্ছে যে আপনি খুন হলে এমন দুজন রয়েছে যারা বিপুল অর্থের মালিক হতে পারে। অর্থাৎ আপনাকে খুন করার মোটিভ রয়েছে। যে ঘটনা ঘটে গেছে তার সঙ্গে দুজন ভাইবোনের জড়িত থাকার সম্ভাবনা পাওয়া যাচ্ছে। তাদের বয়স এখন কত হতে পারে?
দাঁড়ান, হিসেবে করে দেখতে হবে…১৯২২ ঠিক মনে করতে পারছি না…যাই হোক পঁচিশ ছাব্বিশ ধরে নিতে পারেন।
–আমার মনে হয়, সেদিন গুলি ছোঁড়া হয়েছিল আপনাকে মারার জন্যই। সৌভাগ্যক্রমে আপনি বেঁচে গেছেন। তবে সে বা তারা আবারও একবার চেষ্টা করবে। সে কারণেই আপনাকে আমি সতর্ক করে দিতে চাই।
.
ফিলিপিয়া হেমসকে সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে সুন্দরী বলেই মনে হল ইনসপেক্টর ক্র্যাডকের। মাথা জুড়ে হাল্কা ধূসর সোনালী চুল, তীক্ষ্ণ চিবুক ও ঠোঁট। নীলাভ চোখ। আঁটোসাঁটো চেহারা।
একগুচ্ছ চুল মুখের ওপর থেকে সরিয়ে ফিলিপিয়া বলল, বলুন, ইনসপেক্টর?
চাঁচাছোলা আবেগহীন গলা। উদ্বেগ বা ভয়ের লেশমাত্র নেই।
-আমি দুঃখিত, কাজের সময় আপনাকে বিরক্ত করতেহচ্ছে। অবশ্য, লিটল প্যাডকসের বাইরেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। এখন কথা হচ্ছে, আজ সকালে এমন কিছু কথা শুনলাম যার সঙ্গে আপনি জড়িত।
ফিলিপিয়া কৌতূহলী হল। ভ্রূ তুলে তাকাল।
-আপনি বলেছিলেন ওই রুডি সার্জ আপনার অপরিচিত?
-হ্যাঁ, বলেছিলাম।
–তাকে কি আপনি সেদিনই প্রথম দেখেন?
–হ্যাঁ, সেইদিনই। আগে তাকে কখনও দেখিনি।
–আপনি কি লিটল প্যাডকসের সামার হাউসে কোন সময় তার সঙ্গে কথা বলেননি?
–সামারহাউস?
ক্র্যাডকের মনে হল ফিলিপিয়ার কণ্ঠস্বর সামান্য কেঁপে উঠল।
-হ্যাঁ, মিসেস হেমস।
–একথা আপনাকে কে বলেছে?
–রুডি সার্জকে আপনি বলেছিলেন, সে কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে আপনি দেখিয়ে দেবেন–সময়টা বলেছিলেন সোওয়া ছয়টা–এমন কথাও আমি শুনেছি। আমরা জেনেছি সার্জও ওই সময় বাসে করে এসেছিল।
ক্র্যাডকের কথা শেষ হতেই মিসেস ফিলিপা হেমস হেসে উঠল।
–আপনাকে এসব কথা কে বলেছে আমি আন্দাজ করতে পারছি। এসব কথা অত্যন্ত ঈর্ষাপীড়িত, সত্যতা বিন্দুমাত্র নেই। আমি বুঝি না মিৎসি কেন আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না।
-এসব কথা সত্যি নয় আপনি বলছেন?
–একেবারেই না। আমি রুডি সার্জকে আগে কখনও দেখিনি। তাছাড়া যেদিন সকালে সে আসে, আমি বাড়ির কাছাকাছিও ছিলাম না। এখানে কাজ করছিলাম।
ক্র্যাডক শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কোনদিন সকালে?
জবাব দিতে গিয়ে ইনসপেক্টরের চোখের দিকে তাকাল ফিলিপা। একটু থমকে গেল। পরে বলল, প্রতিদিন সকালে। এখান থেকে একটার আগে কোথাও যাই না। মিৎসি কি বলেছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। সবাই জানে ও মিথ্যা কথা বলে।
ফেরার পথে ক্র্যাডক সার্জেন্ট ফ্লেচারকে বললেন, এই দুই তরুণীর কার কথা তোমার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়?
ফ্লেচার বলল, দুজনের কথাই পরস্পরবিরোধী। তবে ওই বিদেশী মেয়েটা যে মিথ্যা কথা বলে একথা এখানে প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে। তাছাড়া এটাও বোঝা যাচ্ছে ও মিসেস হেমসকে যে কোন কারণেই হোক হিংসা করে।
–তুমি বলতে চাইছে, মিসেস হেমসকেই বিশ্বাস করা উচিত?
–আপনার হয়তো অন্য কিছু ভাবনা থাকতে পারে, স্যর।
ক্র্যাডকের অবশ্য তেমন কিছু ভাবনা ছিল না। সেদিন সামার হাউসে রুডি সার্জের সঙ্গে মিসেস হেমসের আদৌ সাক্ষাৎ ঘটেছিল কিনা তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
তবে এটুকু পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন, তিনি যখন সামার হাউস কথাটা বলে উঠেছিলেন, তার গলার স্বর কেঁপে গিয়েছিল। তিনি তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে।
ক্র্যাডক স্থির করলেন, এই দুই তরুণীর ব্যাপারেই তিনি খোলা মন রাখবেন।
.
মিস মারপল ভিকারেজের বাগানে একটা ডেক চেয়ারে বসে উল বুনছিলেন। সম্পূর্ণ একা। তাকে ওভাবে দেখে ক্র্যাডক সজাগ হলেন। বললেন, আপনার এখানে আসা উচিত হয়নি মিস মারপল।
মুখ তুলে তাকালেন তিনি। বললেন, আপনি কি বলতে চাইছেন আমি জানি। আপনি অত্যন্ত বিবেচক। হাঞ্চের বাবা আমাদের সেন্ট মেরী গির্জার ভাইকার ছিলেন। তার মা আমার বহু দিনের বন্ধু। তাই মেডেনহ্যাম এলে আমাকে এখানে কদিন কাটিয়ে যেতে হয়।
-সেটা ভাল ব্যাপার, বললেন ক্র্যাডক, কিন্তু আপনি বাইরের দিকে চোখ কান না দিয়ে পারেন না, সেটাই শঙ্কার কারণ।
প্রত্যুত্তরে সামান্য হাসলেন মিস মারপল।
এরপর ক্র্যাডক র্যাণ্ডাল গোয়েডলার আর পিপ ও এমার কথা জানালেন মিস মারপলকে।
পঁচিশ বছর আগের কথা, মিস ব্ল্যাকলক তাদের শেষ কবে দেখেছিলেন, এখন তাদের কেমন হয়েছে দেখতে কিছুই জানার উপার নেই। তাছাড়া কেবল দুটো ডাক নাম–ইউরোপের কোথায় তাদের পাওয়া যাবে? তবে অবশ্য এমন হওয়াও সম্ভব তারা এই চিপিং ক্লেগহনেই রয়েছে।
স্থির হয়ে সব শুনলেন মিস মারপল। পরে শান্তস্বরে বললেন, আপনার হয়ে আমি কি এদের খুঁজে বার করতে পারি?
–কিন্তু, মিস মারপল
–আপনার ভাবিত হবার কোন কারণ নেই। খুবই সহজ কাজ। আমি তো আর সরকারী লোক নই, কাজেই আমার কাজ কারোর নজরেই আসবে না। কোথাও কোন গোলমাল থাকলে, কারুর সতর্ক হবার মত কারণও থাকবে না।
-আমি স্কটল্যাণ্ড যাচ্ছ। ওখানেই আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি ওদের সম্পর্কে জানতে পারব। মিসেস গোয়েডলার নিশ্চয় পিপ আর এমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারবেন।
–সেটা আরও ভাল কাজ, বললেন মিস মারপল, মিস ব্ল্যাকলককে আশাকরি আপনি সতর্ক করে দিয়েছেন?
-হ্যাঁ, তাঁকে পরিষ্কার ভাবেই সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আর আমাদের একজন লোককেও রেখে যাব সব দিকে নজর রাখার জন্য।
একটু থেমে আবার বললেন, আর আপনাকেও সতর্ক করে দিয়ে যাচ্ছি।
–আপনি নিশ্চিত থাকুন ইনসপেক্টর, বললেন মিস মারপল, নিজেকে আমি ভালই সামলাতে পারব।
.
০৭.
সেদিন মিসেস হারসন মিস মারপলকে নিয়ে লিটল প্যাডকসে এলেন চা খেতে। মিস মারপল এই প্রথম মিস লেটিসিয়া ব্ল্যাকলককে দেখলেন।
মিস ব্ল্যাকলক একটু আনমনাই ছিলেন। সারাক্ষণ চোরের ব্যাপারটাই তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তা প্রকাশও করলেন তিনি।
–চোখ আর হুক এ দুয়ের কাছে চোরেরা জব্দ, মিস মারপল বললেন, দরজার শিকলটা ঠিক ভাবে দেবেন কেবল।
–কিন্তু আমার এখানে কেন চোর আসবে, চুরি করবার মত তো কিছু নেই।
-হাঞ্চ আমাকে সবই বলেছে, এখানে ডাকাতির ব্যাপারটা খুবই ভয়ানক ছিল। বললেন মিস মারপল।
উঃ, আমরা সকলেই খুব ভয় পেয়েছিলাম। এমন অভিজ্ঞতা আগে কারো হয়নি।
–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে লোকটা ব্যর্থ হয়। সে নিজেকেও গুলি করে। কিন্তু সে ঢুকেছিল কি ভাবে?
দরজাগুলো নিশ্চয়ই আমরা সে ভাবে বন্ধ করিনি। বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–ওহো, লেটি, বলে উঠলেন মিস বানার, তোমাকে বলা হয়নি, ইনসপেক্টর আজ সকালে এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছেন।
উনি দ্বিতীয় দরজাটা খোলার কথা বলছিলেন। বললাম, ওটা কখনো ভোলা হয় না, বন্ধ আছে। তিনি চাবি খুঁজে নিয়ে দরজাটা খুলেছিলেন। আর বললেন, দরজার কবজায় তেল দেওয়া হয়েছে। উনি একথা কেন বললেন বুঝতে পারছি না।
মিস ব্ল্যাকলক তার বান্ধবীকে থামতে ইঙ্গিত করছিলেন। সেটা দেরিতে বুঝতে পেরে মিস বানার বিস্মিত ভাবে থেমে গেলেন।
ব্যাপারটা সামাল দেবার জন্য মিস ব্ল্যাকলক বললেন, উনি যখন পরীক্ষা করছিলেন, তখন তুমি বুঝি সেখানে ছিলে। ইনসপেক্টর ক্র্যাডক চান না, এটা নিয়ে আলোচনা হয়। বুঝতে পারছেন তো মিসেস হারসন?
–নিশ্চয়ই, না, না, আমরা কোন কথা প্রকাশ করব না, কি বল জেন মাসি?
–চিপিং ক্লেগহর্নের মত ছোট জায়গায় কোন গোপনীয়তা রক্ষা করাও কঠিন। বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–ঠিকই বলেছেন, বললেন মিস মারপল, বাড়ির চাকরবাকররাই বাইরে কথা ছড়িয়ে বেড়ায়।
–ব্যাপারটা আমি এবারে বুঝলাম, হাঞ্চ বলে উঠলেন, ওই দরজাটা খোলা সম্ভব হলে নিশ্চয় কেউ অন্ধকারে চুপিসারে ঢুকে ছিনতাই করতে পারত। বন্ধ ছিল বলে হয়নি। রয়্যাল স্পা হোটেলের সেই লোকটার কথা আমিও শুনেছি।
–ঘটনাটা তাহলে এই ঘরেই ঘটেছিল, বললেন মিস মারপল, কি ঘটেছিল সেদিন? খুবই আগ্রহ হচ্ছে জানতে।
সঙ্গে সঙ্গেই মিস বানার আর হাঞ্চ একই সঙ্গে নানা গোলমেলে বর্ণনা দিয়ে গেলেন। দু-এক ক্ষেত্রে তাদের ভুল সংশোধনও করে দিলেন মিস ব্ল্যাকলক।
সকলের কথাবার্তার মধ্যে প্যাট্রিক এসেও যোগ দিল। সে ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য তার লেটি মাসীকে খিলানের কাছে কোণের দিকে দাঁড় করিয়ে নিজে রুডি সার্জের অভিনয় করে দেখাল। দেয়ালের গায়ে বুলেটের গর্তগুলোও দেখানো হল।
-ওহ, নেহাৎ ভাগ্য আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে মিস ব্ল্যাকলক। শ্বাসরুদ্ধ স্বরে বললেন মিস মারপল।
–অতিথিদের জন্য আমি সবে সিগারেটের বাক্সটা নিতে যাচ্ছিলাম।
টেবিলের ওপরে রুপোর বাক্সটা দেখিয়ে বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
-ধূমপানের সময় লোকজন বড্ড বেখেয়ালি হয়ে পড়ে, সেটাই মারাত্মক ব্যাপার। দেখুন, এত সুন্দর টেবিলটাতে কি বিশ্রী দাগ পড়েছে। এ বরদাস্ত করা যায় না। বললেন মিস মারপল।
আমার ভাল লাগা জিনিস দু-পাঁচটাই ঘরে আছে–এসবের সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িত।
–ওহ, স্মৃতির অ্যালবাম। স্মৃতি সততই সুখের। ঘরের আসবাবের মত ফটোগ্রাফের ব্যাপারও তাই। আজকাল ওসব আর দেখতে পাই না লোকের ঘরে। আমার ভাইপো ভাইঝিদের পর্যন্ত, একেবারে বাচ্চা বয়সের ছবি রেখে দিয়েছি।
-ওহ, ছবির কথায় মনে পড়ে গেল, আমার তিন বছর বয়সের একটা বিচ্ছিরি ছবি তোমার কাছে আছে জেন মাসী। হাঞ্চ বলল।
প্যাট্রিককে উদ্দেশ্য করে মিস মারপল বললেন, আমার মনে হয় আপনার মাসীর কাছে আপনাদেরও অনেক ছবি আছে।
প্যাট্রিক তাকাল মিস ব্ল্যাকলকের দিকে। বলল, আমরা অনেক দূর সম্পর্কের।
–তোর বাচ্চা বয়সের একটা ছবি এলিনর মনে হয় আমাকে পাঠিয়েছিল। মিস ব্ল্যাকক বললেন, তবে সেটা আর নেই, এখন খুবই খারাপ লাগছে। ও চিঠি না লিখলে তো তোদের কথাও জানতে পারতাম না।
-আজকাল পারিবারিক বন্ধন ক্রমশই কেমন শিথিল হয়ে আসছে। আগেকার দিনের মত পারিবারিক মেলামেশাও আর নেই। বললেন মিস মারপল।
–প্যাট আর জুলিয়ার মাকে শেষ দেখেছিলাম ত্রিশ বছর আগে একটা বিয়ের সময়। ও খুব সুন্দরী ছিল। বললেন মিস ব্ল্যাকক।
–সেদিন, লেটি মাসী মনে আছে, তোমার একটা পুরনো অ্যালবাম দেখছিলাম। কেবল টুপি আর টুপি। বলল জুলিয়া।
মিস ব্ল্যাকলক আতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
.
ফিরে আসার মুখে হাঞ্চ বলল, জেন মাসী, ওটা তুমি ইচ্ছে করেই করেছিলে, তাই না? ওই ফটোগ্রাফের কথাটা।
-হ্যাঁ। বোঝা গেল মিস ব্ল্যাকলক তার দুই তরুণ বোনপো বোনঝিকে আগে চিনতেন না, দেখেননি কথাটা ইনসপেক্টর ক্র্যাডককে জানাতে হবে।
.
লিটল প্যাডকসের বাড়িটা আজ সার্জেন্ট ফ্লেচারের এক্তিয়ারে চলে এসেছিল। তার ওপর বাড়ি সামলানোর দায়িত্ব চাপিয়ে সকালেই মিস ব্ল্যাকলক মিস বানারকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন।
মিৎসির আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সেও এগারোটা নাগাদ বাসে চেপে মেডেনহ্যাম ওয়েলসে চলে গেল।
ফ্লেচার এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। দ্রুত কাজে নেমে পড়লেন।
তেল লাগানো দরজাটা আবার দেখলেন। যেই তেল লাগিয়ে থাকুক, এই পথেই সে আলো নিভে যাবার পর চুপিচুপি ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মিৎসি ছাড়া এ দরজা আর কারো ব্যবহার করার দরকার হওয়ার কথা নয়।
পড়শীদের মধ্যে কারো পক্ষে বাড়ির লোকের অলক্ষ্যে দরজায় তেল দেওয়া সম্ভব নয়। বাড়িতে যারা আছে–প্যাট্রিক, জুলিয়া, ফিলিপিয়া হেমস আর ডোরা বানার এদের মধ্যেই কারোর কাজ।
বাড়িটা আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখলেন ফ্লেচার। কিন্তু কোথাও কোন গোপনীয়তা তার নজরে পড়ল না।
ফিলিপিয়া হেমসের ঘরে কেবল পাওয়া গেল ছোট একটা ছেলের ছবি, কিছু সাধারণ চিঠি। দক্ষিণ ফ্রান্সে তোলা কিছু ছবি ছিল জুলিয়ার ঘরে। প্যাট্রিকের ঘরেও ছিল কয়েকটা ছবি–তার নৌবাহিনীতে কাজ করবার সময়ের।
মিস ডোরা বানারের ঘরে ছিল তার ব্যক্তিগত সাধারণ কিছু জিনিস।
এমন সময় নিচের সিঁড়িতে শব্দ হল। কেউ উঠে আসছে সম্ভবত ফ্লেচার সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত ওপরে উঠে গিয়ে নিচে তাকালেন।
দেখা গেল মিসেস সোয়েটেনহ্যাম হল ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে এলেন। ড্রইংরুমের দিকে তাকালেন।
ফ্লেচার এবারে একটু শব্দ করে এগিয়ে এলেন।-ওহ, মিসেস সোয়েটেনহ্যাম
উঃ। বড় চমকে গিয়েছিলাম। বললেন মিসেস সোয়েটেনহ্যাম, ভাবলাম আবার চোর এল বুঝি।
ফ্লেচার নিচে নেমে এলেন।
-আমি মিস ব্ল্যাকলকের জন্য কিছু নাসপাতি এনেছিলাম, ড্রইংরুমের টেবিলে রেখেছি। ফ্লেচারের কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ্য করে তিনি আবার বললেন, আমি ওই পাশের দরজা দিয়ে ঢুকেছি। এখানে আমরা সবাই সকলের বাড়িতে ঢুকি সার্জেন্ট। এই দরজা কেউ অন্ধকার হবার আগে বন্ধ করি না।
মিসেস সোয়েটেনহ্যাম এর পর চলে গেলেন। কিন্তু সার্জেন্ট ফ্লেচারের সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল।
তিনি ভেবেছিলেন, বাড়ির লোক ছাড়া দরজায় অন্য কারো তেল লাগানো সম্ভব নয়। কিন্তু এখন বুঝতে পারলেন, বাড়িতে যখন কেউ থাকে না সে সময় যে কেউই এ কাজটা করতে পারে।
কর্নেল ইস্টারব্রুকের বাড়িতে হুলুস্থুলু বেঁধে গেল। তিনি চিৎকার করে ডাকলেন, লরা–কি বলছ ডার্লিং। মিসেস ইটারব্রুক এগিয়ে এলেন।
-আমার রিভলভারটা তোমাকে দেখিয়েছিলাম মনে আছে?
–বিচ্ছিরি সেই কালো জিনিসটা–হ্যাঁ, দেখিয়েছিলে, কি হয়েছে?
–ড্রয়ারে রাখা ছিল, দেখেছিলে তো?
–হ্যাঁ তাইতো।
–কিন্তু সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি কোথাও সরিয়ে রাখনি তো?
–ওহ না–না, ওই সাংঘাতিক জিনিসে হাত দিতে আমার ভয় করে।
–ওই বুড়ি–কি যেন নাম, সে কিছু করেনি তো?
–মিসেস বাট? না, না, ও ধরবে কেন?
–তাহলে,…তোমাকে কবে দেখিয়েছিলাম বলতো? মনে আছে?
আগের সপ্তাহেই তো, ড্রয়ার খুলেছিলে তখন দেখিয়ে বলেছিলেন হুনদের জিনিস।–হ্যাঁ হ্যাঁ–ঠিক একসপ্তাহ আগে। তারিখটা মনে নেই?
-তারিখ–আমরা ছবি দেখতে যাচ্ছিলাম–শেষে যাওয়া হল না-হা শনিবারেই তো-৩০ তারিখে। ভাল ভাবে মনে পড়েছে এবারে, মিস ব্ল্যাকলকের বাড়ির সেই ডাকাতির ঘটনার ঠিক পরের দিন। আগের দিনের গুলি চালানোর কথায় রিভলভারের কথা মনে পড়ল।
-আহ, বাঁচা গেল। কর্নেল ব্রুক বললেন।
–ওকথা কেন বলছ আন্টি?
-বুঝতে পারছ না, ওই ঘটনার আগে যদি রিভলভারটা হারাত তাহলে ওই সুইস ছোকরা হাতিয়েছে বলেই মনে হত।
–কিন্তু সে তোমার রিভলভারের কথা জানল কি করে?
–ওসব লোক সব খবর রাখে। আসলে ওটার জন্য কোন লাইসেন্স নিইনি। যুদ্ধ শেষ হলে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।
–তাই বলো।
–কিন্তু জিনিসটা গেল কোথায় বলতো?
-তাহলে মিসেস বাটকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখব। ওই ডাকাতির ঘটনার পর হয়তো ভেবেছেন বাড়িতে একটা রিভলভার রাখা উচিত
–তাকে জিজ্ঞেস করে কাজ নেই, তার মনে লাগবে। অত বড় বাড়িতে থাকেন—
বলে অন্য কাজে মন দিলেন কর্নেল ইস্টারব্রুক।
.
০৮.
ভিকারেজের গেট থেকে বেরিয়ে মিস মারপল গলি ধরে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে চললেন। তার হাতে রেভারেণ্ড জুলিয়ান হারমনের শক্ত বেতের ছড়ি।
শীতের সকালের ঠাণ্ডা ঠেকাতে অনেকেই ব্লুবার্ড কাফেতে এসে কফির কাপ নিয়ে বসেছেন মিস মারপলও সেখানে এসে ঢুকলেন।
একটা টেবিলে বসতে যেতেই মিস ডোরা বানারের কণ্ঠস্বর তার কানে এলো।
সুপ্রভাত মিস মারপল। চলে আসুন এপাশে, একাই আছি।
–ধন্যবাদ।
মিস মারপল এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন।
দুই বৃদ্ধার মধ্যে এর পর কিছুক্ষণ যে সব কথাবার্তা হল তার বিষয় ছিল গেঁটে বাত, নিউরাইটিস ইত্যাদি।
কাফের একটা মেয়ে তাদের কফি আর কেক পরিবেশন করে গেল।
এখানকার কেক খুব ভাল হয়। বললেন মিস বানার।
–সেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাগানে কাজ করছিল যে মেয়েটি-ভারি মিষ্টি দেখতে, কি যেন নাম
-হ্যাঁ, ফিলিপা হেমস–ভাল মেয়ে, আমাদের বাড়িতেই থাকে।
-এক কর্নেল হেমসকে আমি জানতাম, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন, ওরই বাবা হয়তো।
মেয়েটি হল মিসেস হেমস, বিধবা। ওর স্বামী ইতালিয়ন, কোথায় মারা যায়, আপনার কর্নেল হেমস তার বাবা হতে পারেন।
–ওই মেয়েটির মনে হয় রোমান্স গড়ে উঠেছে ওই লম্বা চেহারার তরুণটির সঙ্গে
–কার কথা বলছেন!
চশমাপরা তরুণটির কথা বলছি।
-ওহ বুঝেছি, এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম। আস্তে, ওপাশে কোণের দিকে ওর মা রয়েছে–মিসেস সোয়েটেনহ্যাম। ফিলিপাকে ও ভালবাসে বলছেন?
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মাথা নাড়লেন মিস মারপল।
–আপনি মিস ব্ল্যাকলকের স্কুলজীবনের বন্ধু শুনে আমার খুব ভাল লেগেছিল। এমন কেউ কাছে থাকলে ফেলে আসা জীবনের মধুর ছোওয়া পাওয়া যায়।
–ওর তুলনা হয় না, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিস বানার, মিস ব্ল্যাকলকের মত এমন বন্ধুবৎসল খুব কম লোকই হয়। এমন সুন্দর মেয়ে জীবনকে এত ভালবেসেছে, কিন্তু সবই কেমন দুঃখময়
–সত্যিই জীবন বড় দুঃখের। সহানুভূতির সুরে বললে মিস মারপল।
–দুঃখের আঘাত সহ্য করার শক্তি ওর অপরিসীম। তার জীবনে ভাল কিছু এলে সে তারই যোগ্য।
মিস ব্ল্যাকলকের ভবিষ্যতের প্রাচুর্যের কথা ভেবেই যে মিস বানার কথাটা বলছেন বুঝতে পারলেন মিস মারপল।
-হ্যাঁ অর্থ মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলে। বললেন মিস মারপল।
মিস বানার কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। অতীতের ফেলে আসা দিনগুলিতে বুঝি ফিরে গিয়েছিল তার মন।
কেমন গভীর স্বরে বললেন, মিনচেস্টার হাসপাতালের সাহায্যের একটা খবর বেরিয়েছিল কাগজে। তাতে লেটির নাম দেখেছিলাম। ও ছিল বিরাট ধনী গোয়েডলারের সেক্রেটারি। দেখতে তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু জানতাম খুব দৃঢ় চরিত্রের মেয়ে ছিল ভাবলাম, আমার কথা হয়তো মনে আছে তাহলে ওর কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। সবার কাছে তো তা চাওয়া যায় না। তাছাড়া স্কুলের বন্ধুদের কে আর অত মনে রাখে
মিস ডোরা বানারের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এসেছিল। চোখে অশ্রু টলমল করছে।
–চিঠি লিখলাম। আশ্চর্য, লেটি এসে আমাকে নিয়ে গেল। বলল বাড়িঘর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, সাহায্য করার জন্য ওর একজন দরকার। কী দয়ার্দ্র মন, আর সহানুভূতি। পুরনো দিনের কথা কিছুই ভুলে যায়নি।
এই যে এখন…মাঝে মাঝে কেমন সব গোলমাল করে ফেলি…সবকিছু আগের মত মনে রাখতে পারি না। কিন্তু ধৈর্য রক্ষা করে ও সব সহ্য করে। ভাব করে যেন সত্যিই আমি ওকে সাহায্য করছি। এছাড়া সত্যিকার দয়া আর কি হতে পারে।
-হ্যাঁ, তাই তো। শান্ত স্বরে বললেন মিস মারপল।
লিটল প্যাডকস আসার পর খুব চিন্তা হত, ব্ল্যাকলকের কিছু হলে আমার কি হবে। এক অদ্ভুত ভাবনা।
লেটি বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল, তাই একদিন আমাকে ডেকে বলল, আমার জন্য কিছু মাসোহারার ব্যবস্থা করে রেখেছে। সেই সঙ্গে বাড়ির আসবাবপত্রগুলোও আমারই থাকবে।
হঠাৎ চুপ করে যান মিস ডোরা বানার। পরে বলেন, লেটির জন্য বড় কষ্ট হয় আমার। দুনিয়াটাকে একদম জানে না ও। বড় বেশিরকম বিশ্বাস করে ফেলে সবাইকে। এই সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ ওর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। স্বচ্ছল হওয়ায়, ও মানুষের ভেতরটা নিয়ে, অত বেশি মাথা ঘামায় না।
একটু থেমে আবার তিনি বললেন, ওই প্যাট্রিক, পয়সার টানাটানি বলে অন্তত দুবার এর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে।
কথা শেষ করেই মিস বানার সামনে ঝুঁকে বসলেন। বললেন, কাউকে বলবেন না, একটা কথা আপনাকে বলছি, সেদিনের ওই রহস্যময় ঘটনাটার সঙ্গে আমার মনে হয় প্যাট্রিক জড়িত। ও কিংবা জুলিয়া সুইস লোকটাকে চিনত। এসব কথা লেটিকে বলতে সাহস পাইনি আমি।
বেশি অদ্ভুত লাগে কি জানেন, ওরা তারই বোনপো-বোনঝি। লোকটা যে নিজেকে গুলি করেছে, আমার মনে হয় প্যাট্রিকই মতলবটা তাকে দিয়েছিল।
সব ব্যাপারটা যখন ভাবি, আমার কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। দরজাটা নিয়েই এখন পড়েছে সবাই। আমিও ভেবেছি। ইনসপেক্টর তো বললেন দরজায় নাকি তেল দেওয়া হয়েছে। আমি দেখেছিলাম–সেদিন প্যাট্রিককে ঝোপের মধ্যে দেখেছিলাম। হাতে একটা কাপ আর পালক ছিল, কাপটা তেল মাখার। দাঁড়িয়ে কিছু করছিল। আমাকে দেখতে পেয়েই অপরাধীর মত মুখ করে চমকে উঠে বলে উঠেছিল, ওটা কি দেখছিল। আমি ওর মিথ্যাকথা ধরতে পেরেছিলাম ঝোপের মধ্যে কাপটা যাবে কি করে?
আর একদিন জুলিয়ার সঙ্গে ওকে ঝগড়া করতে শুনেছিলাম। কি সব কালোবাজারিতে না কিসের সঙ্গে জড়িত না থাকার জন্য জুলিয়াকে শাসাচ্ছিল। জানেন, আমার ধারণা, প্যাট্রিকই ড্রইংরুমের ল্যাম্পটা নিয়ে কিছু করছিল যার জন্য আলো নিভে যায়।
ঠিক এমনি সময়েই দরজা খুলে ব্লুবার্ডে ঢুকলেন হাঞ্চ হারমন। টেবিলে ওদের দেখতে পেয়েই সোল্লাসে এগিয়ে এলেন।
-হ্যাল্লো, কফি কি সবই শেষ করে ফেলেছ?
–এসো, এককাপ নাও। খুশি হয়ে বললেন মিস মারপল।
-আপনারা বসুন। আমাকে একবার কেমিস্টের দোকানে যেতে হবে কটা অ্যাসপিরিনের জন্য।
বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন মিস ডোরা বানার।
-তোমাদের কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল? জিজ্ঞেস করলেন হাঞ্চ।
–সেদিনের সেই ঘটনার কথাই হচ্ছিল–অনেকেই তো রয়েছে সন্দেহ করার মতন বললেন মিস মারপল।
–সন্দেহ করার মত? হাতে গুণে বলা যায়, শোন, এই ভোর বানার, প্যাট্রিক সিমন্স, মিসেস সোয়েটেনহ্যাম আর এডমণ্ড আর ফিলিপিয়া হেমস, কর্নেল আর ইস্টারব্রুক। এছাড়া আমাকেও ইচ্ছে করলে এদের মধ্যে ফেলতে পার।
একটু থেমে হাঞ্চ ফের বললেন, তবে তুমি ঠিকই বলেছিলে, মিসেস ইস্টারব্রুকের মিস ব্ল্যাকলককে খুন করার কারণ আছে মনে হয় না।
-তা হতে পারে না। কোন কারণ নেই।
–খুনটা কে করেছে, তুমি বুঝতে পেরেছ, জেন মাসি?
অন্যমনস্কভাবে মিস মারপল বললেন, কিছুই জানি না…সময় বড় কম…খুবই কম… ।
কম মানে?
–সেই বৃদ্ধা মহিলা, যিনি স্কটল্যাণ্ডে আছেন যে কোন সময় মারা যেতে পারেন।
-তুমি তাহলে, অবাক হয়ে বলল হাঞ্চ, বিশ্বাস কর পিপ আর এমা বলে সত্যিই কেউ আছে? ওরাই তাহলে বলছ কাজটা করেছিল?
করেছিল, আবারও চেষ্টা করতে পারে। কাউকে খুন করার চেষ্টা করে কেউ ব্যর্থ হলে সে বসে থাকে না আবারও চেষ্টা করে। বিশেষ করে যদি বুঝতে পারে, কেউ সন্দেহ করেনি। বললেন মিস মারপল।
একটু কি চিন্তা করল হাঞ্চ। পরে মিস মারপলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, যদি পিপ আর এমারই এই কাজ হয়, তাহলে দুজন আছে যাদের সন্দেহ করা যেতে পারে। ওদের কথা ভেবেছ–প্যাট্রিক আর জুলিয়া। এরাও দুই ভাইবোন, বয়সটাও প্রায় একই।
-না হাঞ্চ, হাসলেন মিস মারপল, হিসেব অত সহজে মিলবে না। নানান ফ্যাকরা রয়েছে। তাছাড়া সরাসরি টাকা পাবার মালিক না হলেও তাদের মাও আছেন। ত্রিশ বছর আগে মিস ব্ল্যাকলক তাকে দেখেছেন, এখন দেখলেও তাকে চিনবেন কিনা সন্দেহ। আর সেই খারাপ লোকটি পিপ-এমার বাবাও রয়েছেন।উনি তো বিদেশী।
-তাতে কি, সেই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান কর্নেলের ভূমিকায় তার অভিনয় করতে অসুবিধা কোথায়?
-তুমি তাহলে এদিক থেকেই এখন ভাবছ?
–যেখানে অনেক টাকার প্রশ্ন জড়িত সেখানে অনেক অভাবিত কাণ্ডই ঘটতে পারে। টাকার জন্য মানুষ কি না করতে পারে।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আমিও তাই ভাবি। কিন্তু এরা শেষ পর্যন্ত আদৌ লাভবান হয় কিনা সন্দেহ।
-সেটা বুঝবার মত অবস্থা তাদের থাকে না। হাঞ্চ বললেন, কিন্তু টাকাওয়ালা মানুষের কত কি কাজ করার সুযোগ থাকে। আমার তো নানা পরিকল্পনা মাথায় আসে–অসহায় স্ত্রীলোকদের জন্য বৃদ্ধাবাস, অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রম…
মিস মারপল হাঞ্চের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কোন মন্তব্য করলেন না।
–তবে এটা ঠিক জেন মাসী, এজন্য আমি কাউকে খুন করতে পারব না। কেননা ত জানি, সবাই বেঁচেবর্তে থাকতে চায়–সব প্রাণীই বাঁচতে চায়। আমি কোনও কিছুর জন্য কাউকে খুন করব না।
.
০৯.
মিসেস গোয়েডলার-লণ্ডনের অভিজাত এলাকায় তার চমৎকার বাড়ি রয়েছে, জমিদারী হ্যাঁন্সসায়ারে, দক্ষিণ ফ্রান্সেও রয়েছে একটা ভিলা। এই বৃদ্ধা, এখন স্কটল্যাণ্ডে শয্যাশায়ী হয়ে মৃত্যুর দিন গুনছেন। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও নিশ্চয় তার যোগাযোগ নেই।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই রাতটা ট্রেনে কাটিয়ে দিয়েছেন ডিকেটটিভ ইনসপেক্টর ক্র্যাডক।
হাইল্যাণ্ডসের একটা ছোট স্টেশনে তার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছিল। সেই গাড়িতে চেপে তিনি এসে পৌঁছলেন ধূসর রঙের পুরনো আমলের একটা বাড়ির সামনে।
দেখলে মনে হয় বিগত অতীত যেন এখানে সজীব হয়ে আছে।
একজন বয়স্ক বাটলার তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নান সেরে পোশাক পাল্টে তিনি নিজেকে চাঙা করে নিলেন। বিরাট একটা ঘরে তাকে প্রাতরাশের জন্য নিয়ে আসা হল।
প্রাতরাশের পর তার সঙ্গে দেখা করতে এল নার্সের পোশাক পরা সপ্রতিভ এক মহিলা। তিনি তার নাম বললেন মিস ম্যাকলয়েড বলে।
তিনি জানালেন, রোগিণী ইনসপেক্টর ক্র্যাডকের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উৎসুক হয়ে আছেন।
ক্র্যাডক বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সিস্টার কোন ভাবেই আমি তার উত্তেজনার কারণ ঘটাব না।
-তবুও আপনাকে আমার জানিয়ে দেওয়া উচিত, মিসেস গোয়েডলারকে দেখে আপনার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলেই মনে হবে। তিনি কথাও বলবেন স্বাভাবিকভাবেই। কথা বলতে ভালও বাসেন। তবে হঠাৎ করেই শক্তি ফুরিয়ে যাবে; নির্জীব হয়ে পড়বেন। আপনি সেই মুহূর্তেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে জানাবেন।
এখন সারাক্ষণই তাকে মরফিয়া দিয়ে রাখা হয়। আপনার আসার সংবাদ পেয়েই আজকের দিনের জন্য তাকে জোরালো উত্তেজক ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। ওষুধের ক্রিয়া যতক্ষণ আছে ততক্ষণ তিনি সজীবই থাকবেন। ওষুধের ক্রিয়া শেষ হয়ে এলেই নির্জীব হয়ে পড়বেন।
–হ্যাঁ, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি, সিস্টার। বর্তমানে মিসেস গোয়েডলারের স্বাস্থ্য কেমন চলছে দয়া করে যদি জানান ।
-এককথায় বলতে পারেন, তিনি মৃত্যুপথযাত্রী। বড়জোর সপ্তাহ কয়েক বেঁচে থাকতে পারেন। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছার বলেই এখনো টিকে রয়েছেন, নইলে অনেক আগেই তার জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার কথা। অসীম জীবনীশক্তি।
সিস্টার ক্র্যাডককে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে এক শয্যায় এক বৃদ্ধা মহিলা শায়িত। ক্র্যাডককে দেখে মনে হল মিস ব্ল্যাকলকের চেয়ে বয়স বেশ কয়েক বছর বেশিই হবে। অসুস্থতার জন্য বয়স আরও বেশি বলে মনে হয়। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন থাকলেও মিষ্ট ভাবটি অমলিন রয়েছে। ক্র্যাডককে দেখে চোখের তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার।
-কেমন আছে লেটিসিয়া ব্ল্যাকলক, শুনলাম, ওই আক্রমণে খুব বেশি আহত হয়নি। ব্যাপারটা খুবই কৌতূহলজনক। বললেন মিসেস গোয়েডলার।
–সৌভাগ্যবশত বড় আঘাত থেকে বেঁচে গেছেন। এখন ভালই আছেন। তিনি আপনাকে তার ভালবাসা জানিয়েছেন। বললেন ক্র্যাডক।
–শেষবার দেখেছি, বহুকাল হয়ে গেল। বড়দিনে একটা করে কার্ডের মাধ্যমেই কেবল যোগাযোগটা রয়েছে। শার্লটের মৃত্যুর পর যখন ইংলণ্ডে আসে, আমি তাকে এখানে আসার কথা বলেছিলাম। চিরকালই ব্লাকির বিচারবুদ্ধি প্রখর…আমাকে জানিয়েছে, এতবছর পরে ব্যাপারটা খুব বেদনাদায়ক হবে। খুব সত্যকথা বলেছিল ও।
নিজের কথা বলার আগে ক্র্যাডক বৃদ্ধাকে তার কথা বলে যেতে দিলেন। যদি এর মধ্য দিয়ে মিঃ গোয়েডলার ও মিস ব্ল্যাকলকের সম্পর্কটা উদ্ধার করা যায়।
মিসেস গোয়েডলার বলতে লাগলেন, পুলিসের কেউ এখানে বড় একটা আসে না। টাকার ব্যাপারটাই মনে হয় আপনার কাছে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে? আমার মৃত্যুর পরে ব্ল্যাকিই সব পাবে, র্যাণ্ডাল এরকমই ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। আমি তো চিরকালই রোগভোগা মানুষ। ডাক্তার লেগেই ছিল। তাই আমি ওর পরে বেঁচে থাকব র্যাণ্ডাল কখনই ভাবেনি। ব্ল্যাক বেশ শক্তপোক্ত চেহারার ছিল, অসুখবিসুখে কখনও ভোগেনি।
একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, নিজের জন্য আমি কোন দুঃখবোধ করিনি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, যে কোন সময় আমার আয়ুর মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে–স্বামীর আগেই আমি বিদায় নেব। কিন্তু, দেখতেই তো পাচ্ছেন…
ক্র্যাডক এই সুযোগে নিজের কথায় এলেন।–আপনার স্বামী এই সব টাকা মিস ব্ল্যাকলককে
-হ্যাঁ, কেন দিয়ে গেলেন? আপনি পুলিসের লোক, নিশ্চয়ই ভেবেছেন, এর মধ্যে কোন গোপন ভালবাসার ব্যাপার ছিল? আসলে কিন্তু তা নয়। ব্ল্যাকি অন্য ধাতের মেয়ে। নারীসুলভ দুর্বলতা বা অনুভূতি ওর ছিল না। এরকম নারীর সঙ্গে কোন পুরুষের ভালবাসার সম্পর্ক হওয়া অসম্ভব। তাছাড়া দেখতেও সুরূপা ছিল না। নারীজীবনের অনেক কিছু থেকেই ও বঞ্চিত ছিল।
মজা কি জানেন, র্যাণ্ডাল সবসময়ই ব্ল্যাকিকে তার ছোটভাই বলেই ভাবত। তার বিচার বুদ্ধির ওপর খুব নির্ভর করত। বহুবার ব্ল্যাকি তাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে।
–শুনেছি একবার অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছিলেন।
–হ্যাঁ, তবে সেটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। আরও বেশি কিছু তার কাছ থেকে র্যাণ্ডাল পেয়েছে। র্যাণ্ডালকে সবসময় ব্ল্যাকি সঠিক পথে রাখত। নিজেও সে কখনও অসৎ পথে হাঁটেনি। তার চরিত্র অসাধারণ। প্রশংসা না করে থাকা যায় না।
ব্ল্যাকির জীবনের শুরুটা ছিল খুবই দুঃখবহ। বাবা ছিলেন গ্রামের সাধারণ এক ডাক্তার। ও লণ্ডনে চলে এসেছিল। পড়াশোনা করে চার্টারড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়। তার বোন শার্লট ছিল পঙ্গু। মৃত্যুর পর বোনটি অসহায় হয়ে পড়লে তাকে দেখাশোনা করার জন্যও চলে যায়।
–সেটা আপনার স্বামীর মৃত্যুর কতদিন আগে?
–তা বছর কয়েক আগে। ব্ল্যাকি আমাদের প্রতিষ্ঠানে থাকার সময়েই র্যাণ্ডাল উইল করেছিল। সে উইল আর পাল্টায়নি। কোথাও দানধ্যান করার কথা মনে করেনি। বলেছিল, আমাদের আপনার জন বলতে তো কেউ নেই। ব্ল্যাকিই এসব পাক, সে বুদ্ধিমতী, তাহলে অনেকটাই বাড়াতে পারবে।
দম নেবার জন্য একটু থামলেন মিসেস গোয়েডলার। তারপর বললেন, ঝুঁকি নেয়ার ব্যাপারটা র্যাণ্ডালের কাছে ছিল নেশার মত। ব্ল্যাকির মনটাও ছিল তারই মত। আর এই পুরুষসুলভ ব্যাপারগুলো করতে গিয়ে ভালবাসা সংসার সন্তান জীবনের এই মাধুর্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
কথা শেষ করে আবেশমাখা দৃষ্টিতে তিনি ক্র্যাডকের দিকে তাকালেন। আত্মমগ্নভাবে বললেন, আজ আমি আশক্ত পঙ্গু, কিন্তু একদিন জীবনের সবকিছুই পেয়েছিলাম। যাকে ভালবাসতাম তাকেই বিয়ে করেছিলাম। সন্তানও কোলে পেয়েছিলাম দুটো বছরের জন্য। আমি সকলের ভালবাসাও পেয়েছি–আমি ভাগ্যবতী।
ক্র্যাডক তার প্রশ্নটি আবার মিসেস গোয়েডলারকে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন।
–আপনার স্বামী তার সব অর্থ মিস ব্ল্যাকলককে দিয়ে গেছেন। কিন্তু, তার তো নিজের এক বোন ছিল?
–হ্যাঁ। আপনি সোনিয়ার কথা বলছেন, কিন্তু বহু বছর আগেই দুই ভাই বোনে ঝগড়া হয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল।
–বোধহয় তিনি বোনের বিয়েটা মেনে নেননি?
-ঠিক বলেছেন। সোনিয়ার স্বামীর নাম দিমিট্রি স্ট্যামফোরডিস। কিন্তু র্যাণ্ডাল তাকে একদম সহ্য করত না। বলত সে শঠ, প্রতারক। কিন্তু সোনিয়া তাকেই ভালবেসেছিল আর বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে ফেলেছিল। সোনিয়ার তখন পঁচিশ বছর বয়স। নিজের ভাল মন্দ বোধ তার ভালই জন্মেছিল।
আমিও বিশ্বাস করতাম লোকটা ভাল ছিল না। শুনেছি তার পুলিসের খাতায় নামও ছিল। র্যাণ্ডাল ভাবত তার নামও আসল ছিল না। কিন্তু সে মেয়েদের কাছে ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। আর সোনিয়াকেও খুব ভালবাসত। তাই আমি বলতাম, সে যাকে ভালবেসেছে কেন তাকে বিয়ে করবে না। সে খুব সুন্দরী ছিল। তার প্রচুর অর্থও ছিল। তাদের সুখী না হবার কোন কারণ ছিল না।
-ভাইবোনের ঝগড়া কোনদিনই মেটেনি?
–না। তাদের আর কোনদিন বনিবনা হয়নি। বিয়ের পরই ভাইয়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক মিটিয়ে দিয়ে সোনিয়া চলে গিয়েছিল।
আঠারো মাস পরে বুদাপেস্ট থেকে তার একটা চিঠি পাই। ও লিখেছিল, র্যাণ্ডালকে জানাতে যে সে খুব সুখী আর সবেমাত্র তার যমজ সন্তান হয়েছে। তার চিঠিতে কোন ঠিকানা ছিল না।
–সোনিয়া আপনাকে তার সন্তানদের নাম জানিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, পিপ আর এমা।
–তারপর?
–ও চিঠিতে জানিয়েছিল স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় চলে যাচ্ছে। র্যাণ্ডালকে জানিয়েছিলাম। ও বলেছিল ওই লোকটাকে বিয়ে করার জন্য সোনিয়াকে একদিন অনুতাপ করতে হবে। ব্যস। তারপর ওই পর্বের ওখানেই ইতি পড়েছিল। ওদের আর কোন খবর পাইনি।
পরে একসময় উইলের প্রসঙ্গ তুলে আমিই র্যাণ্ডালকে বলেছিলাম, মানুষের জীবনের কথা কিছুই বলা যায় না। দুর্ঘটনাতেও অকাল মৃত্যু হয় মানুষের। ব্ল্যাকি তখন টগবগে ঘোড়ার মত; কিন্তু দৈবাৎ যদি আমার আগে মারা যায়? কথাটা এভাবে ও ভাবেনি, তাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছি, তাহলে আর কি হবে, আর কেউ নেই। আমি বলেছিলাম, সোনিয়াকে তুমি না হয় বঞ্চিত করতে পার, কিন্তু পিপ আর এমা তো কোন দোষ করেনি। তুমি সবকিছু ওর সন্তানদের দাও। হয়তো পরে আরও কেউ হতে পারে। ও প্রথমে অমত করলেও পরে আমার। কথামতই কাজ করেছিল। কিন্তু ওরা যে কোথায় কোন দেশে আছে কিছুই জানি না।
আদৌ বেঁচে আছে কিনা তাই বা কে বলবে। যদি–ক্র্যাডকের চোখের ওপর দৃষ্টি ফেললেন মিসেস গোয়েডলার। শান্ত স্বরে বললেন, ব্ল্যাকি বড় ভাল…ওর কোন ক্ষতি না হয় দেখবেন।
কথা থেমে গেল তার। কেমন ঝিমিয়ে পড়লেন। চোখে মুখে ক্লান্তির ছায়া পড়ল।
ক্র্যাডক বুঝতে পেরে বললেন, আপনি ক্লান্ত, আমি এখন যাচ্ছি-
-শিথিল ভাবে মাথা নোয়ালেন মিসেস গোয়েডলার। ফিসফিস স্বরে বললেন, ম্যাককে পাঠিয়ে দিন। বড্ড ক্লান্তি লাগছে…দেখবেন…ওরা যেন…ব্ল্যাকির ক্ষতি করতে না পারে।…আমার মৃত্যু হওয়ার আগে পর্যন্ত ওর বড় বিপদ…ওকে দেখবেন
–আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব মিসেস গোয়েডলার।
ক্র্যাডক দরজার কাছে এসেই সিস্টার ম্যাকলেল্যাণ্ডকে দেখতে পেলেন। বিচলিত স্বরে বললেন, আশা করি ওঁর কোন ক্ষতি হয়নি।
–মনে হয় না। এমনই হয়।
-একটা কথা কিন্তু জানা হল না, বললেন ক্র্যাডক, পুরনো কোন ফটো ওঁর কাছে আছে। কিনা–
সিস্টার বাধা দিয়ে বললেন, দুঃখিত ইনসপেক্টর, সবই নষ্ট হয়ে গেছে। যুদ্ধের সময় লণ্ডনের বাড়িতে বোমার আগুনে সবই পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট হয়ে যায় বলে মিসেস গোয়েডলার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।
.
তার এই ভ্রমণ শেষ করে ক্র্যাডক অনেকটাই আশান্বিত হলেন। একটা ছক তার চোখের সামনে পরিষ্কার ফুটে উঠল।
মিসেস গোয়েডলার যাই অনুমান করে থাকুন, এক ভাই আর এক বোন ইউরোপের কোথাও হয়ত বড় হয়েছে। তাদের মা সোনিয়া অর্থবতী ছিলেন। কিন্তু তার স্বামী দু-ভাইবোনের জন্মদাতা পিতার অপরাধী হিসেবে পুলিসের খাতায় নাম ছিল। একদিন হয়তো কপর্দকশূন্য অবস্থায় তারা ইংলণ্ডে এসেছিল। ভাইবোন সবার আগে এখানে যা করতে চাইবে তা হল, ধনী কোন আত্মীয় আছে কিনা তার খোঁজ করা।
সামারসেট হাউসে গিয়ে মিসেস ব্ল্যাকলকের কথা জানতে পারা তাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। সেই সূত্রে র্যাণ্ডাল গোয়েডলারের বিধবা স্ত্রীর খোঁজ পেয়ে যেতে পারে তারা। যখন ওরা বুঝতে পারবে লোটেসিয়া ব্ল্যাকলক তার আগে মারা গেলে তাদের অর্থের অভাব চিরদিনের মত মিটে যেতে পারে…তারপর…তারপর…তারা একা অথবা একসঙ্গে…চিপিং ক্লেগহর্নে তাদের থাকা কি একেবারেই অসম্ভব?..
.
১০.
লিটল প্যাডকসের রান্না ঘরে মিৎসি কাজ করছিল। মিস ব্ল্যাকলক ঘরে ঢুকে বললেন, মিৎসি, আজ মিসেস বানারের জন্মদিন, কয়েকজন লোক আসবেন।
-তাই বুঝি! মিৎসির ভ্রূ উঁচু হল।
–তোমার সেই ছোট বিশেষ কেক বানাবে; যেরকম সুন্দর করে বানাও।
–কিন্তু সেই কেক বানাতে হলে আমার যে চকোলেট, বেশি মাখন আর চিনি চাই।
-আমেরিকা থেকে মাখনের যে টিন এসেছে সেখান থেকে নিতে পার। আর কিসমিস বড়দিনের জন্য রাখা আছে, চকোলেট আর চিনিও দরকার মত নিয়ে নিও।
-তাহলে দারুণ কেক বানিয়ে দেব। ওপরে চকোলেট লাগিয়ে দেখবেন শুভ কামনা লিখে দেব।
মিৎসির মুখ উজ্জ্বল হতে হতে আবার অন্ধকার হয়ে গেল।
–কিন্তু আমায় ওই কেককে মিঃ প্যাট্রিক বলেন মধুর মরণ। আমার কেকের ওরকম নাম একদম সহ্য হয় না।
মিৎসিকে সান্ত্বনা দিয়ে মিস ব্ল্যাক বললেন, এটা বলে ও তোমার কেকের প্রশংসাই করে মিৎসি। তোমার ওই কেক প্যাট্রিকের খুব প্রিয়।
–কিন্তু ওই মরা কথাটা ভাল লাগে না।
রান্না ঘর থেকে বাইরে এসে মিসেস ডোরা বানারের সঙ্গে দেখা হলো তার। তিনি হেসে বললেন। জান লেটি, রেমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম ফোন করেছিল। ও বিকেলে উপহার হিসেবে আমার জন্য একবোতল মধু নিয়ে আসবে। আর মিস হিঞ্চক্লিফ? বলেছেন আমার জন্য ডিম নিয়ে আসবেন।
–তোমার জন্মদিন উপলক্ষে চমৎকার সব হচ্ছে ডোরা। মধু, ডিম, তারপর জুলিয়া দিচ্ছে
–তোমার এই সুন্দর ব্রুচটাও তো রয়েছে।
গর্বিত আনন্দে বুকে ঝোলানো হীরের হারটা হাত দিয়ে দেখালেন মিসেস ডোরা বানার।
–গহনাটা তোমার পছন্দ হয়েছে বলে আমার ভাল লাগল।
বিকেলে সকলে ডাইনিং রুমের টেবিলে সাজানো ভাল জিনিসগুলো সানন্দে সকলে সদ্ব্যবহার করলেন। সকলেই কামনা জানালেন এমন জন্মদিন বারবার আসুক।
প্যাট্রিক একবার অবশ্য মিৎসির তৈরি জন্মদিনের কেকটাকে সোল্লাসে মধুর মরণ বলবার চেষ্টা করেছিল। মিস ব্ল্যাকলক তাকে চোখের শাসনে চুপ করিয়ে দিয়েছেন।
সকলে ড্রইংরুমে ফিরে আসার পর মিসেস হিঞ্চক্লিফ মিস ব্ল্যাকলককে বললেন, জেন মাসী এল না?
–না, কেন? বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–একজন লোককে দেখলাম মুরগীর খাঁচার কাছে ঘুরঘুর করছে, সৈনিকের মত সুন্দর চেহারা।
জুলিয়া বলল, উনি আমাদের ডিটেকটিভ। ঘুরে ঘুরে বাড়ির ওপর নজর রাখছেন। লেটি পিসির জন্যই।
–পুলিস কি এখনো সন্তুষ্ট হতে পারেনি? বললেন মিসেস ইস্টারব্রুক।
–পুলিস সন্তুষ্ট নয়, সেই কারণেই ইনকোয়েস্ট পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন কর্নেল ইস্টারব্রুক।
-আসলে আমাদের সবার ওপরই পুলিসের নজর রয়েছে। বলল এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম।
–ওসব খারাপ কথা মিঃ সোয়েটেনহ্যাম, বললেন মিসেস ডোরা বানার, এখানকার কেউ আমার প্রিয় লেটির ক্ষতি চায় না আমি জানি।
জুলিয়া প্যাট্রিককে ফিসফিস করে কিছু বলল।
–কি ব্যাপার, তুমি কি কোন ভাবনায় পড়েছ ফিলিপা? বললেন মিসেস ব্ল্যাকল।
–ভাবনা? কেন? বিস্মিত হল ফিলিপা হেমস।
–কিছু হয়েছে নাকি? ইদানীং দেখছি কেমন আনমনা।
–ওহ, না, মিস ব্ল্যাকলক।
–যাক…ভাবছিলাম তুমি আর প্যাট্রিক বুঝি–তোমাদের দুজনকে খুব মেলামেশা করতে দেখছি তো
–প্যাট্রিক?
-হ্যাঁ। দেখ প্যাট্রিক আমার আত্মীয় বটে, কিন্তু তবু বলছি ভাল স্বামী হবার উপযুক্ততা তার নেই।
–আমি বিয়ে করব না। কঠিন স্বরে বলল ফিলিপিয়া।
-তোমার বয়স কম, বিয়েটা দেখে বুঝে করার সুযোগ পাবে। ও প্রসঙ্গ এখন থাক। আর কোন যেমন টাকাকড়ি–কোন অসুবিধা নেই তো?
-না, মিস ব্ল্যাকলক। আমি ভাল আছি।
ছেলেদের লেখাপড়ার ব্যাপারে তোমার ভাবনা থাকা স্বাভাবিক, আমি বুঝতে পারি। তাই একটা কথা বলছি শোন, কদিন আগে মিলচেষ্টারে আমার উকিল বেডিংফেণ্ডের কাছে গিয়েছিলাম। একটা নতুন উইল করবার কথা কদিন থেকে মনে হচ্ছিল–নানান কথা চিন্তা করেই। আমি ব্যবস্থা করেছি ফিলিপা, বনির মাসোহারা ছাড়া বাকি সবকিছুই তুমি পাবে।
ফিলিপা যেন ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, আমি তা চাই না…কেন…আমি কেন নেব… তাছাড়া…প্যাট্রিক আর জুলিয়া রয়েছে…ওরা আপনার আত্মীয়।
দূর সম্পর্কের। আমার টাকায় ওদের কোন দাবী নেই। অদ্ভুত স্বরে বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–তবু আমি চাই না।
-তোমাকে আমার ভাল লেগেছে ফিলিপা, বনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তোমার ছেলে রয়েছে। অবশ্য আমি মারা গেলে খুব বেশি কিছু পাবে না…আবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অন্য রকমও হয়ে যেতে পারে। মিসেস হারমন আর মিস মারপল এখানে আসতে পারেননি, ভালই হয়েছে। দুজনেরই ছোঁক ছোঁক করা স্বভাব। সবেতেই বাঁকা চোখ।
একসময় গৃহকর্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে জন্মদিনের পার্টি শেষ হল।
শেষ অতিথি বিদায় নেবার কিছুক্ষণ পরে মিসেস ডোরা বানার বললেন তার ভয়ানক মাথা ধরেছে। প্যাট্রিক বলল, ও কিছু না, কেকের জন্য অমন হয়েছে, আমারও পেট কেমন করছে।
–সারাদিন উত্তেজনার মধ্যে কাটল–এবার একটু শুয়ে পড়িগে। কটা অ্যাসপিরিন খেয়ে ঘুমুবার চেষ্টা করব।
-হ্যাঁ, সেটাই ভাল। বললেন মিস ব্ল্যাককক।
মিস বানার ওপরে উঠে গেলেন। কিন্তু একটু পরেই আবার নিচে নেমে এলেন।
-কি হল বনি। জিজ্ঞেস করলেন মিস ব্ল্যাকলক।
–আমার অ্যাসপিরিনগুলো কোথায় রেখেছি, খুঁজে পাচ্ছি না।
-তাহলে আমার বোতল থেকে নিয়ে নাও, বিছানার কাছে আছে। বললেন মিস ব্ল্যাকল।
–আমার ড্রেসিংটেবিলের ওপরেও আছে। ফিলিপিয়া হেমস বলল।
–ধন্যবাদ। দেখি আমারটা পাই কিনা। একটা নতুন বোতল।
–কথাটা বলতে বলতে মিসেস ডোরা বানার আবার ওপরে চলে গেলেন।
-সারা দিনটা ধকলে গেছে। বেচারী কাল না আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। বললেন মিসেস ব্ল্যাকক। ফিলিপার বিস্মিত ভীত দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল মিস ব্ল্যাকলকের মুখের ওপরে।
–কিন্তু…কিন্তু আপনি মারা যাচ্ছেন না। বলল সে।
–হ্যাঁ, ঠেকাতে পারব যদি উপযুক্ত সাবধানতা নিতে পারি। ভাবলেই বুঝতে পারবে। কথা শেষ করেই মিস ব্ল্যাকলক ঘর ছেড়ে হঠাৎ চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরেই ড্রইংরুমে ঢুকল জুলিয়া। ওর চোখ ঝকঝক করছিল।
-তোমাকে যেমন ভেবেছিলাম, দেখছি তুমি তা নও ফিলিপিয়া। খেলা বেশ ভালই খেলেছ, কি বল?
-তুমি তাহলে শুনেছ?
–আমাকে শোনাতে চাওয়া হয়েছিল বলেই শুনেছি।
–এ কথার মানে?
–ভালই বুঝতে পারছ তুমি। লেটি মাসী বোকা নয়, তুমিও জাল ভালই বিছিয়েছ।
–ওহ জুলিয়া…আমি এসব কখনো ভাবিনি।
-কেন ভাববে না। টাকা কার না দরকার। তবে ভুলে যেও না, লেটি মাসীর কিছু হলে সবার সন্দেহ তোমার ওপরেই পড়বে।
–তা কখনোই হবে না। তাকে এখন মারলে খুবই বোকামি হবে–
-তুমি দেখছি মিসেস গোয়েডলার স্কটল্যাণ্ডে মরতে বসেছেন সে খবর ঠিকই রাখ। অবাক করলে ফিলিপিয়া।
–তোমাকে আর প্যাট্রিককে আমি বঞ্চিত করতে চাই না। আর্তস্বরে বলে উঠল ফিলিপিয়া।
–কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।