অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য চীফ ফ্ল্যাট

অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য চীফ ফ্ল্যাট 

পোয়ারোর প্রশংসা না করে উপায় নেই। ওর যুক্তি বিচার আর অনুসন্ধানের কাজ এমন সূক্ষ্ম পথ ধরে চলে যে তা এক কথায় অনবদ্য। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন অতি অনায়াসেই সে সত্যকে চোখের সামনে তুলে এনেছে। 

নিতান্ত তুচ্ছ ঘটনা থেকেও যে কী দুরন্ত কৌশলে ও সাংঘাতিক অপরাধের সূত্র তুলে আনতে পারে নিচের ঘটনাটি পড়লেই বোধগম্য হবে। 

পার্কার আমার এক পুরোনো বন্ধু। সেদিন সন্ধ্যাবেলা তার বাড়িতে আড্ডা মারছিলাম। আমি ছাড়াও সেদিন সেখানে জনাকয়েক অতিথি উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে এক দম্পতিকে সেদিনই প্রথম দেখলাম। 

তাঁরা হলেন মিঃ ও মিসেস রবিনসন। শুনলাম অল্প কিছুদিন আগেই তাঁদের সঙ্গে পার্কারের পরিচয় হয়েছে। 

আমার বন্ধু পার্কারের একটা বিশেষ নেশা হল ঘন ঘন বাড়ি পালটানো। নিত্যনতুন বাড়িতে থাকতে না পারলে যেন সে হাঁপিয়ে ওঠে। 

যুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত পার্কার কম করে আধ ডজন ফ্ল্যাট বা ছোটো বাড়ি ভাড়া নিয়েছে এবং ছেড়েছে। 

এক জায়গায় নিয়ে ভালো করে বসতে না বসতেই যদি ভালো বাড়ির সন্ধান পেয়ে যায় তো রাতারাতি বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে সেখানেই গিয়ে উঠবে। 

নানা জনে পার্কার সম্বন্ধে নানা কথা বললেও আমি মনে করি বাড়ি বদল করাটাই পার্কারের নেশা। অন্য অনেক মানুষের যেমন নানারকম নেশা থাকে। 

সেদিন চুটিয়ে নানা বিষয়ে গল্পগুজব চলছিল। আড্ডার যেমন রীতি, বিষয় থেকে বিষয়ান্তর হয়ে একসময় লন্ডন শহরের বাড়ি ভাড়ার সমস্যা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। 

এ-বিষয়ে অবধারিতভাবেই পার্কার সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ এবং করিৎকর্মা। নীরব শ্রোতা হয়ে তার অভিজ্ঞতার বিবরণ আমাদের শুনতে হল। 

পরপর অনেকেই নিজেদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার বিবরণ ব্যক্ত করল। সবার শেষে বললেন মিসেস রবিনসন। 

ভদ্রমহিলা সুন্দরী। বলার কায়দাটিও বেশ চিত্তাকর্ষক। তিনি মোলায়েম সুরে বললেন, ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়ার বরাত বলতে গেলে আমাদের। অনেক দিন হন্যে হয়ে খোঁজার পর বেশ বলার মতো একটা ফ্ল্যাট পেয়েছি আমরা মন্টেগু ম্যানসনে। 

—আরে ব্বাস, লাফিয়ে উঠল পার্কার, সে তো অনেক টাকার মামলা শুনেছি। 

—হ্যাঁ, অনেক টাকা। কিন্তু আমরা পেয়েছি একেবারে জলের দরে—বছরে মাত্র আশি পাউণ্ড। 

—আঁ—মন্টেগু ম্যানসনে, বলেন কী? ওই যে নাইটস ব্রিজের পাশে চকমেলান বাড়িটা, সেটার কথা বলছেন তো? 

—ঠিকই ধরেছেন। এই বাড়িতে বলেই তো বরাতের জোর বলে মনে করতে পারছি।

—তা ভাড়া কম হলেও, সেলামি নিশ্চয়ই দিতে হয়েছে প্রচুর? 

—মোটেই না। সেলামি বাবদ এক পয়সাও দিতে হয়নি। তবে আসবাবপত্রের খরচ সবই আমাদের নিজস্ব। 

পার্কারের চোখ কপালে ঠেকেছিল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, এ তো দেখছি একেবারে জগৎছাড়া ব্যাপার। তবে আসবাবপত্রে কিছু কম খরচ হবে না। 

মিসেস রবিনসন সহাস্য মুখে বললেন, মাত্র পঞ্চাশ পাউণ্ড, তাতেই চমৎকার সাজানো হয়েছে। 

—নাঃ, আর বলবেন না, আমার তাহলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমার সন্দেহ হচ্ছে, ওই ফ্ল্যাটের বর্তমান ভাড়াটেদের ঘাড়ে নিশ্চয় ভূত ভর করেছে। 

আড্ডার অন্যান্য বন্ধুরাও একবাক্যে পার্কারের কথাটা সমর্থন করল। কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল নিশ্চয় আছে। 

এবারে যেন মিসেস রবিনসন একটু অস্বস্তিতে পড়লেন। তাঁর সুচারু ভুরুজোড়ায় কুঞ্চন দেখা দিল। ধীরে ধীরে বললেন, খুবই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে; তাই বলছেন? আচ্ছা, ওটা ভূতের বাড়ি নয় তো? 

পার্কার বলল, না না, ভূতের বাড়ি বলে ওই বাড়ির কোনো বদনাম নেই। 

—নেই! মিসেস রবিনসন যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন হঠাৎ। মুহূর্ত পরেই ফের বললেন, তবে বাড়িটাতে আসার আগে এমন কতগুলো ঘটনা ঘটেছে যে আমার কেমন রহস্যময় মনে হয়েছে। 

এবারে আমি কৌতূহল বোধ করলাম। জানতে চাইলাম, যেমন—দু-একটা ঘটনা আমরা জানতে পারি? 

—এতক্ষণে আমাদের অপরাধ-বিশেষজ্ঞের টনক নড়েছে। আপনার সন্দেহের কথা বলে ফেলুন মিসেস রবিনসন। আমাদের হেস্টিংস একজন স্বনামধন্য রহস্যসন্ধানী – আপনার ভাবনাচিন্তা সব ওর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারেন। 

আমি খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলেও পার্কারের প্রশংসায় উৎফুল্লও হলাম। 

মিসেস রবিনসন বললেন, অদ্ভুত ঘটনা বলতে…ঠিক কেমন যেন….আসলে বাড়ি খুঁজে খুঁজে একেবারে হয়রান হয়ে পড়েছিলাম। 

শুনেছিলাম বাড়ির দালাল স্টার অ্যান্ড পল কেবল অভিজাত পল্লির দামি ফ্ল্যাটের খবর রাখে, তাই ওদের ওখানে কখনও যাইনি। কিন্তু হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত সেখানেই ঢুঁ মারতে হল। তবে ওরা যেসব ঘরের সন্ধান দিল সবেরই ভাড়া চারশো থেকে পাঁচশো পাউণ্ড, আবার প্রচুর সেলামি। 

হতাশ হয়ে যখন ফিরে আসছি, তখন ওরা জানাল আশি পাউণ্ডের একটা ফ্ল্যাট ছিল—অনেক লোককেই তারা সেখানে পাঠিয়েছে, তবে ভাড়া হয়ে গেছে বলে কেউ এসে তাদের জানিয়ে যায়নি। তাই খাতায় নামটা রয়ে গেছে। 

ওদের অফিসের একজন ক্লার্ক জানাল, অত সস্তার বাড়ি কি কখনও পড়ে থাকে, নিশ্চয় ভাড়া হয়ে গেছে। কোনো খবর না পাওয়ায় আমরাও অবশ্য অনেক লোককেই ওই বাঁড়ির সন্ধান দিয়ে গেছি। 

মিসেস রবিনসন খানিক দম নিয়ে ফের শুরু করলেন—ওদের কথা শুনে বুঝতে পারছিলাম, ওখানে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। তবু কেন যেন মনে হল, একবার দেখে আসাই যাক। যদি থাকে—একটা বাড়ির জন্য তখন আমাদের মরিয়া অবস্থা। 

একটা ট্যাক্সি ধরে আমরা তখুনি গিয়ে হাজির হলাম। চার নম্বর ফ্ল্যাটটা তিনতলায়। তাই আমরা লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এমন সময় দেখি আমার এক বান্ধবী—এলসি ফার্গুসন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। জানতাম তারাও অনেক দিন থেকে ফ্ল্যাট খুঁজছে। কিন্তু ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই কাছে এসে হেসে বলল, গিয়ে কোনো লাভ হবে না, ওটা আগেই ভাড়া হয়ে গেছে। 

এরপর আমার আর আশা-ভরসা কিছু রইল না। তবু জন টেনে নিয়ে গেল ওপরে। বলল, এসেছি যখন একবার দেখেই যাই। 

বুঝতেই পারছেন, আমাদের অবস্থা। বারবার হতাশ হয়েও কিছুতেই আশাও ছাড়তে পারছি না। লন্ডন শহরে একটা ফ্ল্যাট খুঁজে পাওয়া যে কী ঝকমারি ব্যাপার। 

ভাগ্যই হয়তো আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস করবেন না, গিয়ে শুনলাম ফ্ল্যাটটা আদৌ ভাড়াই হয়নি। 

বাড়ির পরিচারিকা আমাদের ফ্ল্যাটটা দেখিয়েও দিল। খুবই পছন্দ হয়ে গেল। তখুনি বাড়িওয়ালীর সঙ্গে দেখা করে সব পাকা করে ফেললাম। 

আগাম সহ আসবাবপত্রের জন্য পঞ্চাশ পাউন্ডও জমা দিয়ে দিলাম। আগামীকালই ওই ফ্ল্যাটের দখল নিচ্ছি আমরা। 

বেশ গর্বের হাসি মুখে নিয়ে কথা শেষ করলেন মিসেস রবিনসন। 

—মিসেস ফার্গুসন তাহলে ওরকম বললেন কেন? আমার দিকে তাকিয়ে পার্কার বলল, হেস্টিংস তোমার কী মনে হয়? 

আমি একটা বিখ্যাত উদ্ধৃতি আউড়ে সকৌতুকে বললাম, খুবই সাধারণ ব্যাপার পার্কার। বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রমহিলা ভুল ফ্ল্যাটে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন। 

—যথার্থ বলেছেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। রহস্যসন্ধানী বলেই অমন চট করে আসল ব্যাপারটা ধরতে পারলেন। 

মিসেস রবিনসন আমার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হলেন। আমি আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলাম। এই সময় এরকুল পোয়ারো যদি এখানে থাকত তবে আমার ব্যাপারে ওর একচোখো অভ্যাসটা দূর হত। মাঝে মাঝে এমন ভাব করে যেন আমি একেবারে নিষ্কর্মা। 

ঘটনাটা এমনই মজাদার মনে হয়েছিল আমার যে, পরদিন সকালেই পোয়ারোকে না জানিয়ে পারলাম না। তবে বেশ করে রঙ চড়িয়ে রীতিমতো একটা নকল সমস্যা হিসেবে তুলে ধরলাম। 

প্রথমে মনোযোগ দিয়ে পুরো ঘটনাটা শুনল। পরে কোনও অঞ্চলে কেমন ফ্ল্যাটের কীরকম ভাড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেসব জেনে নিল। 

কয়েক মিনিট আর কোনো কথা বলল না। দুম করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। ঠিক আছে হেস্টিংস কিছু মনে করো না, আমি একটু ঘুরে আসছি। 

কোথায় যাচ্ছে কী বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করবার সুযোগ পর্যন্ত দিল না। দুমদুম করে বেরিয়ে গেল। ঘণ্টাখানেক খালি ঘরে একা কাটল আমার। তারপর ফিরে এলো উত্তেজনায় টগবগ করতে করতে। 

টেবিলের সামনে গিয়ে ধীরে ধীরে ছড়িটা রাখল, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অতি যত্নের সঙ্গে টোকা দিয়ে টুপির পশমগুলো ঝাড়ল। তারপর আমার দিকে ফিরে সহজ গলায় বলল, এখন তো আমাদের হাতে বিশেষ কোনো কাজ নেই। অলস বসে থেকে সময় না কাটিয়ে একটা কাজ করা যাক এসো- 

—কী কাজ। জানতে চাইলাম। 

—তোমার বন্ধু মিসেস রবিনসনের অভাবিত কম ভাড়ার ওই ফ্ল্যাটবাড়িটার ব্যাপার।

—আমার কথাটাকে দেখছি তুমি মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছ না। 

—পাগল নাকি! গুরুত্ব দিচ্ছি বলেই তো বলছি। মিসেস রবিনসন যে ফ্ল্যাট নিয়েছেন, আমি বাড়ির দালালদের কাছে খোঁজখবর করে এইমাত্র জেনে এলাম, তার প্রকৃত ভাড়া মাসে কম করেও সাড়ে-তিনশো চারশো পাউন্ড হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে এক ভাড়াটে কিনা অন্য একজনকে মাত্র আশি পাউন্ডে ভাড়া দিয়ে দিল ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত ঠেকছে না? 

আমি এবারে উৎসাহিত হয়ে বললাম, এই ফ্ল্যাটে নির্ঘাত কোনো গোলমাল আছে। ভূতের বাড়ি হওয়াও বিচিত্র নয়, যদিও তেমন কোনো গুজব কানে আসেনি আমার। মিসেস রবিনসনের মনেও বেশ সন্দেহ দেখা দিয়েছে। 

—কিন্তু এটা কীরকম রসিকতা বুঝতে পারছি না, ওরই বন্ধু ওঁকে বললেন ফ্ল্যাটটা ভাড়া হয়ে গেছে, অথচ উনি ওপরে গিয়ে দেখেন ফ্ল্যাট দিব্যি খালি পড়ে আছে? 

—আমার মনে হচ্ছে ওঁর বন্ধু ভুল করে অন্য ফ্ল্যাটে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন। 

পোয়ারো শান্ত কণ্ঠে বলল, তোমার যুক্তিটা এ-ক্ষেত্রে কতটা সঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কেন না বাড়ির দালাল একের পর এক ওই ফ্ল্যাটটার জন্য পাঠিয়েছে, অমন অস্বাভাবিক সস্তা অথচ মিসেস রবিনসন যাওয়ামাত্রই খালি পেয়ে গেলেন। 

—সেই কারণেই তো বলছি, নিশ্চয়ই কোনো গণ্ডগোল আছে। 

—কিন্তু তোমার কাছে যা শুনলাম, তাতে তো মনে হল না মিসেস রবিনসন গণ্ডগোলের কিছু দেখেছেন। আশ্চর্য না হয়ে পারছি না হে। আচ্ছা, ভদ্রমহিলা তোমাকে সত্যি কথা বলেছেন তো? 

—না না, অতি চমৎকার মহিলা তিনি। 

—হ্যাঁ, তোমার গদগদ ভাব দেখেই তা বেশ বুঝতে পারছি। তাঁকে কেমন দেখতে একটু শোনাও তো শুনি। 

—বেশ লম্বা গড়ন, মুখশ্রীও সুন্দর। মাথায় চমৎকার সোনালি চুল—নীল চোখ, গায়ের রঙও উজ্জ্বল- 

—বেশ বেশ। তাঁর স্বামী ভদ্রলোকটি— 

—তিনিও ভালোই দেখতে। তবে সাধারণের মধ্যে একজন বলতে পারো। 

—গায়ের রঙ— 

—ফর্সা আর কালোর মাঝামাঝি হবে। 

—না হে হেস্টিংস, সোনালি চুলের ওপর তোমার এমনই দুর্বলতা যে ভদ্রলোকের প্রতি বুঝতে পারছি, নজর দেবারই সময় পাওনি। তা, তুমি বা পার্কার এই দম্পতির সম্পর্কে আর কী জান? 

আমি সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললাম, পার্কারের কাছে শুনেছি সদ্যই ওঁদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার। কিন্তু পোয়ারো তুমি কী ভাবছ- 

—ভাবনা চিন্তার কথা এখনও কিছু মনে হয়নি বন্ধু। ব্যাপারটা যে অদ্ভুত এটুকুই কেবল মনে হয়েছে। আর আকর্ষণীয় যা তা হয়তো ভদ্রমহিলার নামটুকু— 

—ভদ্রমহিলার নাম তো স্টেলা, কিন্তু ওর মধ্যে— 

পোয়ারো চোখেমুখে এমন ভাব ফুটিয়ে তুলল, মনে হল যেন খুব মজা পেয়েছে। বলল, স্টেলা মানে তারকা। তারকা মানেই তো বিখ্যাত— 

—ছেলেমানুষের মতো কি সব বকবক করছ- 

—হ্যাঁ ভায়া, তারকারা সামান্য নয় মোটে, রীতিমতো আলো দেয়। যাকগে, চলো বসে না থেকে মন্টেগু ম্যানসন থেকে এক চক্কর ঘুরে আসা যাক। 

হাতে কাজ কিছু ছিল না। বেরিয়ে পড়লাম পোয়ারোর সঙ্গে। 

.

বিরাট চকমেলানো ঝকঝকে প্রাসাদ মন্টেগু ম্যানসন। বাইরে গেটের সামনেই তকমা আঁটা একজন দারোয়ান বসে রোদ পোয়াচ্ছিল। পোয়ারো সরাসরি তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ ভাই, মিঃ এবং মিসেস রবিনসন এখানে থাকেন কিনা বলতে পার? 

দরোয়ান আমাদের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, দোতলায় চার নম্বর।

পোয়ারো বলল, ধন্যবাদ। এখানে ওঁরা কতদিন আছেন বলতে পার? 

—ছ-মাস। 

পোয়ারো সকৌতুকে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি দু-পা এগিয়ে গিয়ে দরোয়ানকে বললাম, তুমি নিশ্চয় ভুল করছ। কার কথা জিজ্ঞেস করছি বুঝতে পারছ তো? ওই যে লম্বা মতো ভদ্রমহিলা—সুন্দর সোনালি চুল মাথায় – 

দরোয়ান তেমনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ, তাঁর কথাই বলছি, ঠিক ছ-মাস আগেই ওঁরা এসেছেন—২৯শে সেপ্টেম্বর, সেন্ট মাইকেলের জন্মদিনে 

লোকটি আর কিছু বলার মতো উৎসাহ দেখাল না। উঠে ধীরে ধীরে হলঘরের দিকে চলে গেল। আমরা দু-জনও সরে এসে রাস্তায় নামলাম। 

পোয়ারো বলল, কী বুঝলে হেস্টিংস? তোমার সেই সুন্দরী চমৎকার মহিলাটি সত্যকথাই তোমাদের বলেছেন কি বলো? 

কী আর বলব আমি। নিঃশব্দে হেঁটে এসে গাড়িতে উঠলাম। পোয়ারো সোজা চলে এলো বাড়ির দালালদের অফিসে। আমি জানতে চাইলাম, এখানে কেন আবার? 

—মন্টেগু ম্যানসনে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া দরকার। যদ্দূর মনে হচ্ছে, খুব শিগগিরই এখানে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে চলেছে। 

পাঁচতলায় আট নম্বর ফ্ল্যাটটা খালি ছিল। দিব্যি সাজানো গোছানো। সপ্তায় দশ গিনি করে ভাড়া। বিনা বাক্যব্যয়ে পোয়ারো একমাসের জন্য ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়ে নিল। 

.

রাস্তায় বেরিয়ে এসে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পোয়ারো বলল, পয়সাকড়ি তো মন্দ রোজগার করছি না, একটা খেয়ালের জন্য স্বচ্ছন্দেই কিছু খরচ করা যেতে পারে। ভালো কথা, হ্যাঁ হেস্টিংস, তোমার তো একটা পিস্তল আছে, তাই না? 

পিস্তলের কথায় কিছুটা রোমাঞ্চিত হলাম। বললাম, হ্যাঁ, আছে। 

—এবারে সেটা কাজে লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। কী, উত্তেজনার গন্ধ পেয়ে নিশ্চয় পুলকিত হচ্ছে! 

.

পরদিন নতুন ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে গিয়ে আস্তানা নিলাম আমরা। চমৎকার সাজানো গোছানো। রবিনসনদের ফ্ল্যাটের দুটো তলা ওপরেই, সরাসরি মাথায়। 

পরদিন ছিল রবিবার। বিকেলে দু-জনে বসে গল্প করছি। এমন সময় দড়াম করে দরজা বন্ধ করার শব্দ হল কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে পোয়ারো আমাকে অনুসরণ করবার ইঙ্গিত করে সিঁড়ির মাথায় ছুটে গেল। ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বলল, দেখে তো নিচে তাকিয়ে, ওরাই রবিনসন তো? 

আমি সাবধানে রেলিং-এ সামান্য ঝুঁকে দেখে বললাম, হ্যাঁ, এরাই। 

—তাহলে একটু অপেক্ষা করা যাক। 

প্রায় মিনিট পঁচিশ পরে দেখা গেল এক যুবতী চমৎকার সাজগোজ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। এবারে পোয়ারো নিঃশব্দে ঘরে ফিরে এলো। 

–মনে হচ্ছে কত্তা-গিন্নির পর পরিচারিকাটিও বেরিয়ে গেল। ফ্ল্যাটটা নিশ্চয়ই এখন খালি। 

আমি অস্বস্তি বোধ করছিলাম। বললাম, তুমি কী করতে চাইছ বলো তো? 

পোয়ারো আমার কথার জবাব না দিয়ে দ্রুতপায়ে বাসনমাজার ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর জঞ্জাল নামাবার লিফটের দড়ি ধরে টানতে টানতে বলল, এই চলন্ত ডাস্টবিনে চড়ে আমরা নিচে নামব। আজ ছুটির দিন, ছুটি কাটাতে বেশির ভাগ লোকজনই বেরিয়ে পড়েছে। কেউ আমাদের দেখতে পাবে না। যারা ঘরে আছে রবিবারের লাঞ্চের পর তাদের সকলের চোখেও এখন ঢুলুনি। চলো কাজে নেমে পড়া যাক। 

জঞ্জাল ফেলার সেই দুর্গন্ধ লিফটে চড়ে বসল পোয়ারো। বাধ্য হয়ে আমাকেও উঠতে হল। তখনও পর্যন্ত বুঝতে পারছি না ওর উদ্দেশ্যটা কী। 

তবে রবিনসনের ফ্ল্যাটে ঢোকার মতোলব যে মাথায় চেপেছে তা বোঝা যাচ্ছে। তবু জিজ্ঞেস করলাম, ওদের ফ্ল্যাটে ঢুকবে নাকি তুমি? 

পোয়ারো অস্পষ্টভাবে জবাব দিল, আজ ঢুকতে নাও হতে পারে। 

দড়ি ধরে টেনে টেনে তিনতলায় নেমে এলাম আমরা। দেখা গেল বাসনমাজার ঘরের কাঠের দরজাটা খোলাই রয়েছে। 

পোয়ারো বলল, এ-দরজাটা দিনের বেলা কেউই বন্ধ করে না। রাতেও প্রায় সময়েই খোলা থাকে। আমাদের মতো যে কেউ এসে হাজির হতে পারে। যাকগে আমরা কাজটা তো আগে শেষ করি। 

বলতে বলতে কোটের ভেতরের পকেট থেকে পোয়ারো ঝটপট কয়েকটা যন্ত্রপাতি বার করে ফেলল। তারপর দক্ষ হাতে কাঠের দরজার চাবির ফুটোয় কীসব কায়দা করল। পলকের মধ্যেই কাজ শেষ করে যন্ত্রপাতিগুলো যথাস্থানে চালান করে দিল। কাজটা শেষ করতে তিন মিনিটের বেশি লাগল না। 

মৃদু স্বরে বলল, এবারে লিফটের দিক থেকে ঠেললেই দরজাটা খুলে যাবে। আমাদের কাজের সুবিধার জন্যই আগাম ব্যবস্থা করে রাখতে হল। 

আবার লিফটের দড়ি টেনে টেনে আমরা আমাদের ঘরে ফিরে এলাম। 

সোমবার দিন সকালেই বেরিয়ে গিয়েছিল পোয়ারো। সারাদিনটা আমার একাই কাটল। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এসে চেয়ারে এলিয়ে পড়ল। মুখ দেখে মনে হল, বেশ খুশিখুশি ভাব। ডেকে বলল, হেস্টিংস, তোমার বেশ পছন্দমতো একটা গল্প শোনাতে পারি, শুনবে নাকি? 

 —বেশ তো বলে যাও, আমি হেসে বললাম, তবে গল্পটা কোনো সত্য ঘটনা হলেই ভালো হয়।

—হ্যাঁ, সেরকমই। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইনসপেকটর আমাদের বন্ধু জ্যাপের দপ্তর থেকেই খবরগুলো সংগ্রহ করা। 

শোনো, মাস ছয়েক আগের কথা। আমেরিকার নৌ-বাহিনীর দপ্তর থেকে কিছু মূল্যবান কাগজপত্র খোয়া যায়। দলিলগুলোতে আমেরিকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য ছিল 

যে কোনো বিদেশী শক্তি, যেমন ধরো জাপান, এই দলিলগুলোর সন্ধান পেলে যে কোনো মূল্যে কিনে নিতে দেরি করবে না। 

দলিলগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ওই বিভাগেরই এক ইতালিয়ান কর্মী লুইগি ভালোদারনো ও উধাও হয়ে যায়। ফলে এই যুবকের ওপরেই পুলিশের সন্দেহ পড়ল। 

দু’দিন পরেই নিউইয়র্কের ইস্ট-সাইড অঞ্চলে লুইগি ভালদারনোর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। দলিলগুলো তার কাছে অবশ্য পাওয়া যায়নি। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দলিল চুরির ঘটনার কিছুদিন আগে থেকেই ভালদারনো এক যুবতীর কাছে যাতায়াত করত। যুবতীর নাম এলসা হাদোত। মেয়েটি ওয়াশিংটনে তার ভাইয়ের সঙ্গে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। 

অল্প কিছুদিন হল গায়িকা হিসেবে মেয়েটি আত্মপ্রকাশ করেছে। এছাড়া তার পূর্বপরিচয় সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় না। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ভালদারনোর মৃত্যুর প্রায় সঙ্গেই মেয়েটিও উধাও হয়ে যায়। 

স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ করা যেতে পারে যে, মেয়েটি কোনো আন্তর্জাতিক গুপ্তচর চক্রের চর। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ও পরিচয় নিয়ে নানারকম কুকর্ম করার কাজে লিপ্ত। আমেরিকার গোয়েন্দা দপ্তর এই যুবতীটিকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। 

সেইসঙ্গে তারা ওয়াশিংটনবাসী বিশিষ্ট জাপানি ভদ্রলোকদের ওপরেও নজর রেখে চলেছে। তাদের ধারণা কোনো না কোনো সময়ে এলসা হাদোতকে এই জাপানি ভদ্রলোকদের কারো কাছে আসতে হবে। 

ইতিমধ্যে জাপানি বিশিষ্ট ভদ্রলোকদের মধ্যে একজন হঠাৎ ইংলন্ডে চলে যায়। এই সমস্ত কিছু বিবেচনা করে ধারণা করা হচ্ছে এলসা হাদোতে বর্তমানে ইংলন্ডেই রয়েছে। 

এই পর্যন্ত বলে পোয়ারো দম নেবার জন্য একটু থামল। তারপর নিচু স্বরে বলল, সরকারি তরফ থেকে এলসা হাদোতের যে বর্ণনা পাওয়া গেছে তা হল, উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি, নীল চোখ, সোনালি চুল, খাড়া নাক, গায়ের রঙ ফরসা। আলাদা করে চিনে নেবার মতো বিশেষ কোনো চিহ্ন অবশ্য নেই। 

আমি রুদ্ধনিঃশব্দে বলে উঠলাম, মিসেস রবিনসন মনে হচ্ছে! 

স্মিত হেসে পোয়ারো বলল, অসম্ভব কিছু নয়। এবারে এদিককার কথা শোনো, আমি খবর পেলাম, আজ সকালে কালোমতোন একজন বিদেশী চার নম্বর ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আজ রাতটা খুবই মূল্যবান। ভায়া, রাতটা হয়তো আমার সঙ্গে নিচের ফ্ল্যাটেই তোমাকে কাটাতে হতে পারে। অবশ্য তোমার পিস্তলটাকেও সঙ্গে রাখতে হবে। 

রোমাঞ্চকর কিছুতে আমার উৎসাহের ঘাটতি হয় না। সোৎসাহে বললাম, কখন যাচ্ছি আমরা? 

পোয়ারো কয়েক সেকেন্ড নীরবে কী ভাবল। তারপর বলল, নাঃ, মাঝরাতের আগে কিছু ঘটবে বলে মনে হচ্ছে না। 

.

রাত বারোটার পরেই আমরা নিঃশব্দে এসে জঞ্জাল নামানোর লিফটে চড়লাম। তারপর দড়ি টেনে ধীরে ধীরে তিনতলায় নেমে এলাম। কাঠের দরজাটা সামান্য ঠেলতেই দিব্যি খুলে গেল, পোয়ারোর কায়দাকানুন বেশ কাজ দিল। 

আমরা চুপিসাড়ে চার নম্বর ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। হলঘরের দরজাটা খুলে রেখে দু-জনে রান্নাঘরে ঢুকে বসে রইলাম। 

এরকম অনিশ্চিত প্রতীক্ষায় কাল কাটানো যে কী যন্ত্রণাদায়ক, ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। আমার মনে হল ঘণ্টা আষ্টেক বসেছিলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম একঘণ্টা কুড়ি মিনিট সময় অপেক্ষা করেছিলাম। 

হঠাৎ কিছু একটা ঘষার ক্ষীণ শব্দ কানে এলো। হলঘরের দিক থেকেই শব্দটা এলো। পোয়ারো আমার গায়ে ঠেলা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। দু-জনে পা টিপেটিপে হলঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। 

পোয়ারো আমার কানে ফিসফিস করে বলল, মনে হল সদর দরজার তালা ভাঙ্গছে। আমার ইশারা পাবার আগে কিছু করবে না কিন্তু। তুমি পেছন থেকে জাপটে ধরবে। তবে সাবধান, লোকটার কাছে ছুরি থাকতে পারে। 

ঘষার শব্দটা হঠাৎ থেমে গেল। পরক্ষণেই কিছু একটা ছেঁড়ার শব্দ হল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সদর দরজার ওপারে একঝলক টর্চের আলো জ্বলেই নিভে গেল। 

আমরা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করছি। খুব আস্তে আস্তে এবারে দরজাটা খুলতে শুরু করল।

দেয়ালের সঙ্গে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা দু-জন। একটা লোক আমার গা ঘেঁষেই একরকম এগিয়ে গেল। ঘরের মেঝেয় টর্চের আলো ফেলল। 

সেই মুহূর্তে কানের পাশে পোয়ারোর গলা পেলাম, এবারে এগোও। 

শিকারী বেড়োলের মতো দু-জনেই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। চোখের পলকে পোয়ারো আগন্তুকের মাথা একটা চাদরে জড়িয়ে ফেলল। আমি সবলে তার কব্জি দুটো চেপে ধরলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিঃশব্দে কাজটা সমাধা হয়ে গেল। 

লোকটার হাতে একটা ছোরা ধরা ছিল বুঝতে পারছিলাম। কব্জিতে মোচড় দিতেই সেটা খসে পড়ল। পোয়ারো চাদরটা দিয়েই তার মুখ বেঁধে ফেলল। এই ফাঁকে আমি আমার পিস্তলটা বার করে লোকটার চোখের সামনে ধরলাম। 

পিস্তল দেখেই হয়তো লোকটা কোনোরকম বাধা দেবার চেষ্টা করল না। পোয়ারো তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে অতি দ্রুত কীসব বলল। 

দেখলাম লোকটা মাথা নাড়ল। বাইরে যাবার ইশারা করে নিজে আগে এগিয়ে গেল। মাঝখানে বন্দি আগন্তুক। পেছনে পিস্তল হাতে আমি, এভাবে আমি ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। 

রাস্তায় পা দিয়ে পোয়ারো আমাকে বলল, রাস্তার মোড়েই দেখতে পাবে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। ডেকে নিয়ে এসো। আর তোমার পিস্তলটা আমাকে দিয়ে যাও—ওটার আর এখন দরকার হবে না। 

শঙ্কিত হয়ে বললাম, এ ব্যাটা যদি পালাবার চেষ্টা করে? 

পোয়ারো বলল, না, পালাবে না। 

মোড়ের ওপাশে অপেক্ষমান ট্যাক্সিটা নিয়ে ফিরে এসে দেখি পোয়ারো লোকটার মুখ থেকে চাদরটা খুলে নিয়েছে। 

লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, এ তো জাপানি নয়। 

পোয়ারো বলল, না, এ ইতালীয়। 

ট্যাক্সিতে উঠে পোয়ারো ড্রাইভারকে সেন্ট জনস উডের একটা ঠিকানা বলল। মাঝরাতের নির্জন রাস্তা ধরে ট্যাক্সি ছুটে চলল। 

কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। তাছাড়া সব ঘটনাই কেমন ধাঁধার মতো লাগছিল। বন্দির সামনে পোয়ারোকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। তাই চুপচাপ বসে ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করতে লাগলাম। 

মিনিট দশেক বাদেই একটা ছোট্ট বাড়ির সামনে এসে নামলাম। 

একটা মাতাল সামনের রাস্তা ধরে টলতে টলতে এগিয়ে আসছিল। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো পোয়ারোর সঙ্গে প্রায় ধাক্কা খেলো। কী সব ফিসফিস করে বলল বুঝতে পারলাম না। এরপর তিনজনে মিলে বাড়ির সিঁড়িতে উঠে দাঁড়ালাম। আমাদের একপাশে সরে দাঁড়াতে বলে পোয়ারো কলিংবেলের বোতাম টিপল। 

পরপর দু-বার বোতাম টিপে সাড়াশব্দ না পেয়ে পোয়ারো জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগল। 

এবারে ঘুলঘুলি দিয়ে আলো দেখা গেল, সন্তর্পণে দরজাটা সামান্য ফাঁক হল। 

—এত রাতে এখানে কী চাই? 

বিরক্তিমিশ্রিত একটা পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল। 

পোয়ারো জবাব দিল, আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ, ডাক্তারবাবুকে ডাকতে এসেছি। 

—এখানে কোনো ডাক্তার নেই। বলতে বলতে লোকটি দরজা বন্ধ করতে গিয়ে আটকে গেল। 

পোয়ারো ততক্ষণে দরজার ফাঁকে পা গলিয়ে দিয়েছিল। 

—যদি আপনি না যান তাহলে কিন্তু আমি সারা রাত এখানে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা বাজাব আর কড়া নাড়ব। 

এবারে দরজাটা ফাঁক করে লোকটি বাইরে বেরিয়ে এলো। পরনে রাতের পোশাক, পায়ে চপ্পল। চারপাশে সন্দেহের দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে পোয়ারোকে গম্ভীর স্বরে বলল, আমার কথাটা শুনুন, মশাই— 

কথার মাঝখানেই পোয়ারো বলে উঠল, তাহলে পুলিশেই খবর দিই- 

বলে সিঁড়ি থেকে নেমে আসার ভান করল। অমনি লোকটি এগিয়ে এসে বলল, দোহাই আপনার, ও কাজ করবেন না। 

সেই মুহূর্তে পোয়ারো ছোট্ট একটা ঠেলা মেরে লোকটিকে বেমালুম সিঁড়ির নিচে ফেলে দিল। আর আমরা তিনজন সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দিলাম। 

পোয়ারো হলঘরের আলো জ্বেলে দিল। তারপর আমাকে টেনে নিয়ে পাশের ঘরটায় ঢুকল। ইতালিয়ানটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ওই জানালার পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ুন। বাধ্য ছেলের মতো লোকটি পোয়ারোর নির্দেশ পালন করল। 

মিনিট খানেকের মধ্যেই এক মহিলা দ্রুতপায়ে ঘরে এসে ঢুকল। তার লম্বা গড়ন, লালচে চুল। সুঠাম দেহবল্লরী জড়িয়ে আছে একটি জাপানী ধাঁচের অঙ্গরাখা। 

আমাদের দিকে চোখ পড়তেই ভয়ার্ত স্বরে মহিলাটি বলে উঠল, আপনারা কারা?

পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে বলল, ভয় নেই, আপনার স্বামীর ঠান্ডা লাগবার ভয় নেই। গরম রাত্রিবাস গায়ে রয়েছে, পায়েও চপ্পল দেখেছি। 

মহিলাটি কম্পিত স্বরে বলল, কে আপনি? আমাদের বাড়িতে ঢুকেছেন কেন? 

পোয়ারো কুর্নিশের ভঙ্গি করে বলল, খুবই দুঃখের বিষয় মাদাম। আপনার সঙ্গে এর আগে পরিচয়ের সুযোগ ঘটেনি। এখন কথা হল, আমাদের দলেরই একজন নিউইয়র্ক থেকে এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে। 

জানালার ভারি পর্দা সরিয়ে এবারে ইতালিয়ানটি বেরিয়ে এলো। আমি আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, আমার পিস্তলটা লোকটার হাতে। সর্বনাশ করেছে, পোয়ারো নিশ্চয়ই ভুল করে ট্যাক্সিতে ছেড়ে এসেছিল। 

মহিলাটি তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে ছুটে পালাবার চেষ্টা করল। দ্রুত পা বাড়িয়ে পোয়ারো দরজা আগলে দাঁড়াল। 

—ও আমাকে মেরে ফেলবে—ও আমাকে মেরে ফেলবে- 

আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল মহিলা। 

পিস্তল উঁচিয়ে ধরে ইতালিয়ানটি চিৎকরে করে উঠল, লুইগি ভালদারনোকে কে খুন করেছে? 

নিদারুণ আতঙ্ক হল দেখে, লোকটা পিস্তল একে একে আমাদের দিকে ঘোরাতে লাগল। ভয়ে পাথর হয়ে বলে উঠলাম, পোয়ারো তুমি কী ভুলই করলে। এখন যে আমাদের বেঘোরে মরতে হবে। 

পোয়ারো রীতিমতো ধমকে উঠল, বকবক না করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাক। তোমার ভয় নেই আমি না বলা পর্যন্ত আমাদের বন্ধুটি গুলি ছুঁড়বে না। 

ইতালিয়ানটি ক্রুর হেসে বলল, আপনি দেখছি একেবারে আঠারো আনা নিশ্চিত। 

এই সময় মহিলাটি ঝট করে পোয়ারোর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে উঠল, আপনি কী চান?

পোয়ারো নির্বিকার চিত্তে আবার কুর্নিশের ভঙ্গি করল। বলল, বুদ্ধিমতোী মিস এলসা হাদোত, আমার আগমনের কারণ বুঝতে পারছেন না, তা কি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? 

মুহূর্তের মধ্যে মহিলাটি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে, যেটাকে এতক্ষণ আমরা টেলিফোনের ঢাকনা ভেবেছি, একটানে সেটাকে হাতে তুলে নিল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, সেটা বেশ বড়োসড় কুচকুচে কালো একটা বিড়োল। 

পোয়ারোর দিকে বিড়োলটা এগিয়ে দিয়ে মহিলাটি বলল, এর চামড়ার নিচে ওটা সেলাই করা আছে। 

—বাঃ বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। বলে দরজা থেকে সরে গিয়ে পোয়ারো বলল, আপনি এখন যেতে পারেন, তবে মাদাম, নিউইয়র্ক থেকে আসা আপনার এই বন্ধুটিকে আমরা আপাতত আটকে রাখছি। 

—আহাম্মক! অত সহজ নয়। গর্জন করে উঠল ইতালিয়ানটি। সঙ্গে সঙ্গে মহিলার দিকে তাক করে পিস্তলের ঘোড়া টানল। আমিও সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। 

পিস্তলে কেবল কটমট কটমট শব্দ হল, কোনো গুলি বেরলো না। পোয়ারো সখেদে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খুবই দুঃখের কথা হেস্টিংস, তোমার এই পুরোনো বন্ধুর ওপর কোনোদিনই তুমি বিশ্বাস রাখতে পার না। আমার বন্ধুরা গুলিভরা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়োবে, এটা আমার কোনোদিনই পছন্দ না। 

ইতালিয়ানটি আক্রোশে ফুঁসছিল। পোয়ারো তার দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনার সুরে বলল, বৃথাই আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন। আমি আপনাকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচালাম, নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছেন। ওই সুন্দরীটিও পালাতে পারবে না। এই বাড়ির চারপাশেই নজর রাখা হয়েছে। ওরা সরাসরি পুলিশের হাতে গিয়ে পড়বে। নিশ্চয় এটা শুনে আনন্দ ও সান্ত্বনা পাচ্ছেন। আপনি এবারে এঘর থেকে যেতে পারেন—কিন্তু খুব সাবধান- 

লোকটা দরজার বাইরে চলে যেতেই পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে স্মিতমুখে বলল, বন্ধুবর হেস্টিংস, বুঝতে পারছি, আমার ওপর খুবই রেগে গেছ। কিন্তু বন্ধু, জলের মতো ব্যাপারটা যদি তুমি বুঝে উঠতে না পার, আমার কী দোষ বলো। 

মন্টেগু ম্যানসনের চার নম্বর ফ্ল্যাটের ব্যাপারটা গোড়া থেকেই ছিল পরিষ্কার। শয়ে শয়ে লোক এসেছে ভাড়া নেবার জন্য, কিন্তু একমাত্র ভাড়া পেল রবিনসনরা। কেন? অন্যদের থেকে ওদের বেছে নেবার মতো এমন কি ছিল যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্ল্যাট মঞ্জুর হয়ে গেল? যদি বলো ওদের চেহারা, তাহলে বলব, প্রথম দর্শনেই ভুলবার মতো আহামরি বা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাহলে বাকি রইল ওদের নাম। 

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, রবিনসন নামটাতে তো অস্বাভাবিকতা কিছু নেই, একেবারেই সাধারণ নাম। 

—হ্যাঁ, একেবারে ঠিক। আর এই পয়েন্টটাই আমি ধরেছিলাম। এলসা হাদোত তার ভাইকে নিয়ে নিউইয়র্কে থাকত। ভাই বা স্বামী যেই হোক না কেন, তাকে নিয়ে এখানে এসে মিঃ এবং মিসেস রবিনসন নাম নিয়ে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। হঠাৎ তারা খবর পেয়ে গেল, লুইগি ভালদারনো যে গুপ্তচর দলের সঙ্গে ছিল তারা তাদের পিছু নিয়েছে। মুশকিল আসানের জন্য ভেবেচিন্তে তারা একটা চমৎকার পথ বার করল। 

একটা ব্যাপার হল যে, ওই গুপ্তচর দলের কেউ তাদের দু-জনকে চিনত না। কাজেই একটা দিকে তারা নিশ্চিন্ত ছিল। তারা ঠিক করল নামমাত্র ভাড়ায় এমন কাউকে ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে দিতে হবে যার সঙ্গে তাদের নামের মিল রয়েছে। 

লন্ডন শহরে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক বাড়ি ভাড়ার জন্য ঘুরে ঘুরে হয়রান হচ্ছে। তাদের মধ্যে একজোড়া রবিনসনকে পেতে কিছুমাত্র কষ্ট হবার কথা নয়। নামটা যে অতি সাধারণ এবং সচরাচরই পাওয়া সম্ভব এবিষয়ে নিশ্চিত ছিল তারা। তারা আরও জানত, আজ হোক কাল হোক, গুপ্তচর দলের লোকেরা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্য একদিন নিশ্চয় তাদের ফ্ল্যাটে হানা দেবে। তাদের নাম এবং ঠিকানা দলের লোকদের অজানা ছিল না। ব্যস…সব ঘটনাই হিসেবমতো মিলে গেল। গুপ্তচর দলের প্রতিহিংসাও চরিতার্থ হল আর এলসা হাদোতও অল্পের জন্য আর একবার পরিত্রাণ পেয়ে গেল। 

এমন সময় বাইরের দরজায় জোর কড়া নাড়ার শব্দ হল। পোয়ারো বলল, মনে হচ্ছে জ্যাপ তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। 

পোয়ারোর পেছন পেছন হলঘরে ঢুকতে ঢুকতে জানতে চাইলেন, এই বাড়ির ঠিকানা পেলে কী করে তুমি? নিশ্চয় সেই প্রথম মিসেস রবিনসন যখন ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে আসে, তাদের পেছু নিয়েছিলে? 

—এতক্ষণে বুদ্ধি খুলছে দেখছি, চমৎকার। দাঁড়াও হেস্টিংস আগে দরজাটা খুলে দিই। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের জাঁদরেল ইনস্পেকটর আর এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। অমনি বিড়োালটা মিয়াও শব্দে ডেকে উঠল। দু-জনেই চমকে উঠলেন। পোয়ারো হেসে বলল, এ-বাড়ির পোষা বিড়োল। এই তো বসে আছে আমার কোলে। আচ্ছা, আমাদের বন্ধুদের স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো ত্রুটি রাখেননি তো? 

—সব কটা চিড়িয়াকেই খাঁচায় পোরা হয়েছে। কিন্তু আসল মালটা তো ওদের কারো কাছেই পাওয়া গেল না। 

পোয়ারো সে কথায় কান না দিয়ে বলল, আমি আর হেস্টিংস চলে যাবো বলে এই মাত্ৰ ভাবছিলাম। যাক এসে যখন পড়েছেন, যাবার আগে পোষা বিড়োলের স্বভাব এবং ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু অবহিত করে যাই। 

জ্যাপ হতভম্ব হয়ে বলে উঠল, এই সময় পোষা–আপনার মাথাটা কি একেবারেই খারাপ হয়ে গেল— 

নির্বিকার পোয়ারো বলতে শুরু করল, বিড়োল অত্যন্ত পয়া জীব জানেন তো। প্রাচীনকালে মিশরীয়রা বিড়োলের পুজো করত। বর্তমান কালেও কালো বিড়োাল কারোর সামনে দিয়ে রাস্তা পার হলে; সেটা সৌভাগ্যের চিহ্ন বলে গণ্য হয়ে থাকে। বন্ধুবর জ্যাপ, এই কালো বিড়োালটাও আজ আপনার সামনে দিয়ে পার হয়েছে। আমার ধারণা—এই পয়া কালো বিড়োলটার প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারছি না। 

জ্যাপের সঙ্গে যে লোকটি ঘরে ঢুকেছিল, সে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে পোয়ারোর হাত থেকে বিড়োলটাকে ছিনিয়ে নিল। 

জ্যাপ বলল, আপনাদের তো পরিচয় করিয়ে দিতেই ভুলে গেছি। মঁসিয়ে পোয়ারো, ইনি হলেন আমেরিকা গোয়েন্দা দপ্তরের মিঃ বার্ট। 

ততক্ষণে আমেরিকান গোয়েন্দার অভিজ্ঞ আঙুল বিড়োলটার গায়ে হাত বুলিয়ে আসল জিনিসটার সন্ধান পেয়ে গেছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভদ্রলোক যেন কথা হারিয়ে ফেললেন। 

মুহূর্তের মধ্যেই ধাতস্থ হলেন মিঃ বার্ট। পোয়ারোর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, মিঃ পোয়ারো, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *