দ্য ট্র্যাজেডি অ্যাট মার্সডন ম্যানর

দ্য ট্র্যাজেডি অ্যাট মার্সডন ম্যানর 

দিন কয়েকের জন্য বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখলাম পোয়ারো তার সুটকেস গোছগাছ করছে। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার কোথাও বেরুচ্ছ নাকি? 

—অ, তুমি এসে গেছ। যাক ঠিক সময়েই এসে গেছ, নইলে আমাকে একাই যেতে হত। দেরি করো না, চটপট তোমার জিনিসপত্তর গুছিয়ে নাও। 

অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু যাচ্ছ কোথায় সেটা বলবে তো? 

পোয়ারো বলল, কুশনটা টেনে বসো, বলছি সবকিছু। অবশ্য তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। নর্দান ইউনিয়ন ইনসিওরেন্স কোম্পানি একটা ছোট্ট দায়িত্ব দিয়েছে। মিস্টার মালট্রাভার্সের মৃত্যু-সংক্রান্ত ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে হবে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ভদ্রলোক পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড মূল্যের একটা জীবন বীমা করেছিলেন। 

কুশনটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললাম, ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলো শুনি।

—মিস্টার মালট্রাভার্সের বাসভবনের নাম মার্সডন ম্যানর। গত বুধবার অর্থাৎ পরশু দিন সেখানে বাগানে ভদ্রলোককে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। স্থানীয় চিকিৎসক এবং পরে বীমা কোম্পানির চিকিৎসক মৃতদেহটি পরীক্ষা করে দেখেন। 

দু-জনেই একই মতোামতো ব্যক্ত করেন, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হল মৃত্যুর কারণ। এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই অবশ্য। 

এদিকে কয়েকটি গুজব শোনা যায় যে মিঃ মালট্রাভার্স দেনার দায়ে আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন। এসব বিচার করে নর্দান ইউনিয়নের ধারণা হয়েছে, ভদ্রলোকের মৃত্যু একটা আত্মহত্যার ঘটনা। সেই ক্ষেত্রে টাকা দেবার কোনো প্রশ্ন আসে না। এভাবে গোটা ব্যাপারটাই জটিল আকার ধারণ করে। 

মালট্রাভার্সের স্ত্রী যুবতী এবং আশ্চর্য সুন্দরী। লোকে বলাবলি করছে, যথাসর্বস্ব অর্থ দিয়ে তিনি তাঁর স্ত্রীর স্বার্থেই মোটা অঙ্কের অর্থের জীবন বীমা করেন এবং তার পরেই আত্মহত্যা করেন। 

এধরনের ঘটনা যে খুব অপরিচিত তা নয়। যাই হোক, নর্দান ইউনিয়নের পরিচালক আমার বন্ধু অ্যালফ্রেড রাইটের অনুরোধে আমাকে এই ঘটনার অনুসন্ধানের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। 

এ-ব্যাপারে কতটা কী করা সম্ভব হবে বুঝতে পারছি না। কেন না, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের ফলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা বিরল নয়। 

আর এভাবে হঠাৎ করে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে চিকিৎসকদের পক্ষে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা সম্ভবপর হয় না। যাই হোক, দায়িত্ব যখন নিয়েছি, চলো একবার অনুসন্ধান করে আসা যাক। 

.

গ্রেট ইস্টার্ন টেনে আমরা এসে নামলাম মার্সডন লীগ নামের ছোট্ট একটা স্টেশনে। মার্সডন ম্যানর স্টেশন থেকে মাইলখানেক দূরে। পোয়ারো বলল, স্থানীয় ডাক্তার র‍্যালফ বার্নাডের বাড়ি খুঁজে বার করতে হবে, এই পথটুকু হেঁটে গেলেই সুবিধা হবে। তাই পাকা সড়ক ধরে পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম আমরা। 

কিছুদূর আসার পর রাস্তার বাঁদিকে একটা সাজানোগোছানো বাংলো ধরনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল পোয়ারো। সামনে এক টুকরো ফুলের বাগান। বাগানের ফটকে পিতলের নামফলকে উৎকীর্ণ নামটা পড়ে বোঝা গেল এটা ডাঃ বার্নাডের বাড়ি। 

বিনা বাক্যব্যয়ে আমরা বাগান পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। 

সৌভাগ্যক্রমে ডাক্তার বার্নাডের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। রুগী দেখার সময়েই আমরা হাজির হয়েছিলাম, অবশ্য সেই মুহূর্তে কোনো রুগী ছিল না। 

ডাক্তার বার্নাড বেশ বয়স্ক মানুষ। হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল চেহারা। 

পোয়ারো নিজের পরিচয় দিয়ে এখানে আসার উদ্দেশ্য জানাল। ডাক্তার বার্নাড বললেন, এ-ধরনের ঘটনায় বীমা সংস্থা তো অনুসন্ধান করতেই পারে। বিশিষ্ট ধনী মিঃ মালট্রাভার্স নিশ্চয় অনেক টাকার বীমা করেছিলেন? 

পোয়ারো জানতে চাইল, উনি কি খুবই ধনী ছিলেন? 

ডাক্তার বললেন, দু-দুটো মোটরগাড়ি, অমন প্রাসাদতুল্য মার্সডন ম্যানরের মতো বাড়ি যাঁর, তাকে ধনী ব্যক্তি না বলে কী বলব? অবশ্য শুনেছি বাড়িটা নাকি অনেক সস্তায় কিনেছিলেন। 

—তাহলে তো মনে হয় ওঁর মৃত্যুতে খুবই ক্ষতি হল। 

—তা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে লাভবান হবেন ওঁর স্ত্রী। 

—আপনিই তো এঁদের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন? 

—না, ওঁরা রোমান ক্যাথলিক। তাছাড়া শুনেছি মিঃ মালট্রাভার্স বড়ো মাপের বৈজ্ঞানিক বা ওইরকমই কিছু একটা ছিলেন। সেই তুলনায় আমি নিতান্তই একজন ছোটো-খাটো ডাক্তার। আমার সঙ্গে… 

—কিন্তু আপনিই তো মিঃ মালট্রাভার্সের মৃতদেহ প্রথম পরীক্ষা করে দেখেছিলেন?

—তা করেছি বটে। ওদের বাগানের একজন মালি আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।

—আপনি গিয়ে কী দেখলেন, যদি দয়া করে বলেন— 

—আমি যখন পৌঁছই, তখনও পর্যন্ত মৃতদেহ বাগানের একপ্রান্তে উপুড় অবস্থায় পড়েছিল। পাখি মারার ছোট্ট বন্দুকটা পাশেই পড়েছিল। আকস্মিক রক্তক্ষরণের ফলেই ওঁর মৃত্যু হয় বলে আমার বিশ্বাস। 

—তাহলে, গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন না? 

—অসম্ভব! হত্যা বা আত্মহত্যা কোনোটাই নয়। মিঃ মালট্রাভার্সের দেহের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। দেখুন, এর বেশি আমার আর কিছু বলার নেই। 

ভদ্রলোকের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আমরা উঠে পড়লাম। ছোট্ট বাগানটা পার হয়ে রাস্তায় এসে নামলাম। থমথমে মুখে হাঁটছিল পোয়ারো। সহসা আপন মনে বলে উঠল, অসম্ভব! 

জিজ্ঞেস করলাম, কী অসম্ভব? 

–একজন যৌবনবতী রূপসী নারী যথারীতি উপস্থিত, অথচ তাঁর কোনো ভূমিকা থাকবে না…এটা খুবই অসঙ্গত মনে হচ্ছে আমার 

কিছুক্ষণের মধ্যেই ম্যানর ভবনে এসে পৌঁছলাম আমরা। কলিংবেল চাপতেই একজন পরিচারিকা এসে দরজা খুলল। পোয়ারো তার হাতে নিজের পরিচয়পত্র এবং বীমা সংস্থার চিঠিটা তুলে দিল। 

মিনিট দশেক পরে ফিরে এসে পরিচারিকা আমাদের বৈঠকখানায় নিয়ে বসাল। 

আরও কয়েক মিনিট পরে মিসেস মালট্রাভার্স ঘরে প্রবেশ করে আমাদের অভিবাদন জানালেন। 

দীর্ঘাঙ্গী মহিলা যথার্থই সুন্দরী। বয়স বড়ো জোর সাতাশ-আটাশ। যৌবনের রূপলাবণ্য যেন উথলে পড়ছে। 

দীর্ঘায়ত গভীর দুটি নীল চোখ। মুখের আদলটি এককথায় অতুলনীয়। 

প্রাথমিক সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর এই শোকার্ত পরিবেশে তাঁকে বিরক্ত করতে আসার জন্য পোয়ারো যথারীতি দুঃখ প্রকাশ করল। 

পোয়ারো পরে বলল, বুঝতেই পারছেন আপনার স্বামীর বিপুল পরিমাণ অর্থের জীবনবীমা করা ছিল। এই অবস্থায় তাঁর আকস্মিক মৃত্যু ঘটল। স্বভাবতই বীমা সংস্থা প্রতিটি ব্যাপারে সুনিশ্চিত হতে চায় 

ওদের হয়ে এই কেসটা আমাকেই দেখতে হচ্ছে। আপনার কাছে একটাই অনুরোধ, বুধবারের ঘটনার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিন। 

মিসেস মালট্রাভার্স বিষণ্ণ দৃষ্টি তুলে তাকালেন। বললেন, আমি সেই সময় চা ছাঁকছিলাম, বাগানের মালি ছুটে এসে খবরটা দিল। ওই প্ৰথম… 

বলতে বলতে অবরুদ্ধ কান্নায় মিসেস মালট্রাভার্সের কণ্ঠস্বর বুজে এলো। 

—উনি কি বাগানেই ছিলেন? 

–পাখি শিকারে বেরিয়ে ছিলেন। ওই সময়টা উনি সাধারণত ছোট্ট বন্দুকটা নিয়ে বাগানেই ঘুরে বেড়োতেন। 

—বন্দুকটা এখন কোথায়? 

—মনে হয় হলঘরেই আছে। 

—বলতে বলতে উনি বেরিয়ে গেলেন। একমিনিটের মধ্যেই বন্দুকটা নিয়ে ফিরে এলেন। পোয়ারো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর স্বগতভাবে বলল, দেখছি দুটি গুলি খরচ হয়েছে— 

বন্দুকটা ফিরিয়ে দিয়ে পোয়ারো ধন্যবাদ জানাল। পরে বলল, আপনাকে আর বিরক্ত করব না মাদাম। আচ্ছা, একটা জিজ্ঞাসা, আপনার স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলবেন? 

—এসব ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। 

–ধরুন এমন কোনো সূত্র, যেমন হঠাৎ করে কেন উনি এমন মোটা অঙ্কের জীবনবীমা করতে গেলেন? যদ্দূর মনে হয়, আগে কোনো বীমা নিশ্চয়ই উনি করেননি? 

মিসেস মালট্রাভার্স কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে পরে বললেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে মাত্ৰ এক বছর। এ-বাড়িতে এসে অবধি আমি লক্ষ্য করছি, সবসময় তিনি একটা মৃত্যু আশঙ্কায় ভুগছেন। 

আমি শুনেছি ইতিপূর্বে তাঁর একবার স্ট্রোক হয়েছিল। দ্বিতীয়বারে যে মৃত্যু অনিবার্য একথা তিনি প্রায়ই বলতেন। 

আমার ধারণা হয়তো এই কারণেই তিনি জীবন-বীমা করেছিলেন। অবশ্য আমি বহুবার চেষ্টা করেছি ওঁর মন থেকে এই অহেতুক উদ্বেগ দূর করতে। 

অশ্রুময়ী মিসেস মালট্রাভার্সের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। চলতে চলতে পোয়ারো হতাশ কণ্ঠে বলল, ন হে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না এখানে। চলো, লন্ডনেই ফেরা যাক। আচ্ছা…একটা অসামঞ্জস্য কি তোমার নজরে পড়েছে, হেস্টিংস? 

—অসামঞ্জস্য! কোথায়…তেমন – 

—অ, লক্ষ্য করনি বুঝি? দেখ, এভাবে কেউ তার জীবন বিলিয়ে দেবে…একটা স্বাভাবিক ঘটনা নয় মোটে। তার প্রমাণও রয়েছে যথেষ্ট। তাহলে কে এ কাজটা করল? 

হঠাৎ সুঠাম চেহারার স্বাস্থ্যবান এক তরুণ আমাদের অতিক্রম করে গেল। তার সুশ্রী মুখে রোদে-পোড়া তামাটে ভাব পলকের জন্য চোখে পড়ল। বুঝতে অসুবিধা হল না উষ্ণমণ্ডলের কোনো অঞ্চলে জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে। 

তরুণটি সরাসরি ম্যানর ভবনের বাগানে ঢুকে পড়ল। মালি শুকনো পাতা কুড়োচ্ছিল, ভদ্রলোককে দেখেই ত্রস্তে দাঁড়িয়ে পড়ল। 

পোয়ারো কোনো কথা না বলে দ্রুত পায়ে বাগানে গিয়ে ঢুকল। মালিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই তরুণ ভদ্রলোককে চেনো নাকি? 

মালি ধীর স্বরে জবাব দিল, স্যার, নামটা ঠিক মনে নেই। শুনেছিলাম হয়তো।

—উনি কি আগেও এখানে এসেছেন? 

—গত সপ্তাহে মঙ্গলবার বিকেলে এখানে প্রথম এলেন। 

—হেস্টিংস, চলো ওকে অনুসরণ করা যাক। 

সামনের মূর্তিটি সবে দরজা পার হয়ে বৈঠকখানায় প্রবেশ করেছে। আমরা দ্রুত পা চালিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দু-জনের কথাবার্তা আমাদের কানে এলো। 

—তুমি! স্তব্ধ বিস্ময়ে মিসেস মালট্রাভার্স যেন চমকে উঠলেন, স্পষ্ট বোঝা গেল।—আমি তো ভাবলাম তুমি আফ্রিকায় পাড়ি দিয়েছ। 

—হঠাৎ একটা খবর পেয়ে আটকে পড়লাম। স্কটল্যান্ডে আমার জ্যাঠামশাই মারা গেছেন। আমার জন্য বিপুল অর্থ রেখে গেছেন বলে আমার উকিল জানিয়েছেন। 

তাছাড়া কাগজে তোমার বিশ্রী দুঃসংবাদটা চোখে পড়ল। ভাবলাম, এসময় তোমার কাছে থাকা উচিত। 

এই সময় পোয়ারো ঘরের ভেতরে কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। দু-জনেই ঘুরে তাকালেন। পোয়ারো অনুনয়ের সুরে জানাল, ভুল করে ওর ছড়িটা ফেলে গেছে। আমি মুখ টিপে আপন মনে হাসলাম। 

মিসেস মালট্রাভার্স আমাদের সঙ্গে তরুণের পরিচয় করিয়ে দিলেন, – ইনি মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো, ক্যাপ্টেন ব্লেক। 

কথায় কথায় জানা গেল ক্যাপ্টেন ব্লেক গ্রামের ভেতরে অ্যাঙ্কার ইন-এ আপাতত উঠেছেন। 

পোয়ারোর ছড়িটা খোঁজাখুঁজি হল। যথারীতি কোথাও পাওয়া গেল না। পোয়ারো ক্ষমা প্রার্থনা করল। বিদায় নিয়ে আমরা আবার পথে নেমে এলাম। 

চলতে চলতে পোয়ারো বলল, না হে হেস্টিংস আর লন্ডনে ফেরা হল না। তরুণ ব্লেককে দেখে মিসেস মালট্রাভার্স যে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন তা তাঁর কথা শুনেই বোঝা গেল। তরুণকে দেখেও তোমার মনে হয়নি যে তার প্রতি তিনি খুবই অনুরক্ত? 

তাছাড়া দেখ, মিঃ মালট্রাভার্সের মৃত্যুর ঠিক আগের দিন মঙ্গলবার বিকেল থেকে তিনি এখানে রয়েছেন। 

এই পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন ব্লেকের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে দেখা কর্তব্য। পা চালিয়ে চলো—অ্যাঙ্কার ইন-এ গিয়ে অপেক্ষা করা যাক। 

অ্যাঙ্কার-ইন-এ আধঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হল না। ক্যাপ্টেন ব্লেক ফিরে এলেন। 

পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মঁসিয়ে ক্যাপ্টেন, আমরা আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। মিঃ মালট্রাভার্সের মৃত্যু-সংক্রান্ত কয়েকটা তথ্য আমাদের জানা দরকার। মিসেস মালট্রাভার্সকে এই পরিস্থিতিতে বিব্রত করা সঙ্গত মনে হল না। মনে হল, আপনি এ-ব্যাপারে আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারেন। 

ক্যাপ্টেন ব্লেক বললেন, আপনাকে সাহায্য করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব মঁসিয়ে পোয়ারো। তবে এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। মিসেস মালট্রাভার্স আমার অত্যন্ত পরিচিত। তবে মিঃ মালট্রাভার্সের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ হয়েছিল সম্প্রতি। 

—আপনি লন্ডনে ফিরেছেন কবে? 

—গত মঙ্গলবার বিকেলে। 

—ফিরেই কি এখানে চলে আসেন? 

–হ্যাঁ। বুধবার দুপুরেই টিলবারী থেকে আমার জাহাজ ছাড়বার কথা ছিল। তাই ভোরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একটা খবর পেয়ে থেকে যেতে হল। 

—আপনার তো পূর্ব আফ্রিকায় ফেরার কথা ছিল? 

—হ্যাঁ। যুদ্ধের সময় থেকে সেখানে রয়েছি। 

—মঙ্গলবার নৈশভোজে আপনাদের মধ্যে কী কী আলোচনা হয়েছিল যদি বলেন—

—সব কথা হয়তো মনে করতে পারব না। তবে সবই সাধারণ কথাবার্তা। পরিচিত লোকজনদের খোঁজখবর নেওয়া এসবই আর কী। 

তবে মিসেস মালট্রাভার্স পূর্ব আফ্রিকার জীবজন্তু সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলেন—আমি যথাসাধ্য জানবার চেষ্টা করেছি। 

পোয়ারো একমুহূর্ত কী চিন্তা করল। তারপর বলল, ধন্যবাদ মঁসিয়ে ক্যাপ্টেন। আপনাকে আর বেশি বিরক্ত করব না। আপনার অনুমতি নিয়ে ছোট্ট একটা পরীক্ষা করব। খুবই সাধারণ…এই ঘটনা সম্পর্কে যতটা আপনার জানা আছে সবই সচেতনভাবে আমাদের জানিয়েছেন। কিন্তু আপনার মনের অবচেতন স্তরের কয়েকটা খবর জানতে চাই। 

ক্যাপ্টেন ব্লেক তার কুর্সিতে নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, বেশ তো, কী করতে হবে বলুন।

—বিশেষ কিছু নয়। যেমন ধরুন, একটা শব্দ। আপনাকে বলব, আপনি আপনার পছন্দমতো প্রথম মনে যা আসবে অন্য একটা শব্দ বলে তার উত্তর দেবেন। 

—বুঝতে পেরেছি, বেশ শুরু করুন। 

—হেস্টিংস, তুমি একটা কাগজে শব্দগুলো টুকে নেবে। 

বলে পোয়ারো পকেট থেকে একটা ঘড়ি বার করে টেবিলের ওপরে রাখল। 

—তাহলে শুরু করা যাক—আমার প্রথম শব্দ হল—দিন। 

এক মুহূর্ত নীরবতার পর ক্যাপ্টেন ব্লেক জবাব দিলেন, রাত্রি। 

—নাম। 

—বার্নাড। 

— স্থান। 

–শ’।

—মঙ্গলবার। 

—নৈশভোজ। 

—যাত্রা। 

—জাহাজ। 

—দেশ। 

—উগাণ্ডা। 

—গল্প। 

—সিংহ। 

—পাখিমারা বন্দুক। 

—খামারবাড়ি। 

—গুলি। 

—আত্মহত্যা। 

—হাতি। 

—দাঁত। 

—টাকা। 

— উকিল। 

—ধন্যবাদ মঁসিয়ে ব্লেক। এখানেই ইতি টানছি। এবারে ফলাফলটা দেখা যাক। দেখি হেস্টিংস, তোমার কাগজটা দাও। 

আমি হতভম্বের মতো তাকিয়েছিলাম। এই সব অসংলগ্ন শব্দের মধ্যে থেকে পোয়ারো কোনো সূত্র আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে, কিছুই মাথায় ঢুকল না। 

আমার লেখা কাগজটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, কিছুই তো বোধগম্য হচ্ছে না। 

—হচ্ছে না, বেশ, বুঝিয়ে দিচ্ছি। মঁসিয়ে ব্লেকের উত্তরগুলো থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা গেল যে, কোনো কিছু গোপন করার মতো অপরাধবোধ তাঁর মধ্যে কাজ করেনি। তিনি সবকটি উত্তরই নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দিয়েছেন। 

দিন রাত্রি, নাম, স্থান এগুলি খুবই সাধারণ শব্দ। স্থানীয় চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ থাকতে পারে ভেবে আমি বার্নাড শব্দটি উচ্চারণ করেছিলাম। কিন্তু তাঁর উত্তর থেকে জানলাম, ডাক্তারের মুখও উনি দেখেননি। 

এরপর আমার মঙ্গলবার শব্দের উত্তরে তিনি বললেন—নৈশভোজ, কিন্তু যাত্রা আর দেশের উত্তরে জানালেন জাহাজ এবং উগাণ্ডা। এ থেকে বুঝতে পারলাম এই সমুদ্রযাত্রা তাঁর কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গল্পের জবাব দিতে গিয়ে সম্ভবত সেদিন নৈশভোজের টেবিলে বলা সিংহের কথাই প্রথম মনে পড়েছিল। 

পাখিমারা বন্দুক শব্দের জবাবেই একটা অপ্রত্যাশিত শব্দ পাওয়া গেল খামারবাড়ি। এরপর যখন বললাম গুলি, উনি উত্তর দিলেন আত্মহত্যা। এই সবকটি শব্দই পরস্পরের সঙ্গে সুসংলগ্ন। অর্থাৎ মঁসিয়ে ক্যাপ্টেনের জানা একটা ঘটনাই এগুলোর মধ্যে ধরা পড়েছে। 

ঘটনাটা নিশ্চয়ই এমন—একজন মানুষ খামারবাড়িতে তাঁর পাখিমারা বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আমার বিশ্বাস, এই গল্পটি উনি সেদিন নৈশভোজে বসে মালট্রাভার্স দম্পতিকে শুনিয়েছিলেন। 

মঁসিয়ে ব্লেককে জিজ্ঞেস করে দেখ, উনি হয়তো স্মরণ করতে পারবেন! 

সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাপ্টেন ব্লেক বললেন, আমার স্পষ্টই মনে আছে মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক তাঁর খামারবাড়িতে আত্মহত্যা করেছিলেন। পাখিমারা বন্দুক ছিল তাঁর সঙ্গে। মুখের মধ্যে নল পুরে দিয়ে তিনি নিজেই গুলি করেন। বুলেটটা সোজা মাথার মধ্যে গিয়ে বিঁধে থাকে। 

সেই অবস্থায় ঠোটে সামান্য রক্ত ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। ডাক্তাররা প্রথমে তাই কিছুই বুঝতে পারেননি। অবশ্য পরে…. 

—মিঃ মালট্রাভার্সের সঙ্গেও এই কাহিনির একটা মিল রয়েছে। ওঁর মৃতদেহের পাশেও একটা পাখিমারা বন্দুক পড়েছিল। 

ক্যাপ্টেন ব্লেক সকাতরে বলে উঠলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি বলতে চাইছেন যে আমার গল্প শুনেই মিঃ মালট্রাভার্স নিজেই…কিন্তু অসম্ভব…অসম্ভব- 

—আপনি দেখছি কিছুই জানেন না মঁসিয়ে ব্লেক। যেভাবেই হোক, ঘটনা তাই-ই ঘটেছে। ওহো লন্ডনে একটা জরুরি তার পাঠাবার ছিল…আপনারা বসুন…আমার মিনিট পনেরোর বেশি সময় লাগবে না। 

পোয়ারো ফোন করতে চলে গেল। কিন্তু ফিরে এলো পনেরো মিনিট নয় ঘণ্টাখানেক পরে। এতক্ষণ কার সঙ্গে কী কথা বলল বুঝতে পারলাম না। ঘড়িতে এখন ছটা বাজে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। 

কুর্সিতে বসতে বসতে বিষণ্ণ সুরে বলল, খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা হেস্টিংস। মিসেস মালট্রাভার্সকে খবরটা কীভাবে জানাব বুঝতে পারছি না। কোনো অসহায় নারী যদি জানতে পারেন তাঁর স্বামী আত্মহত্যা করেছেন আর সেই কারণে জীবন-বীমার একটি টাকাও তিনি পাবেন না, এ যে কত মর্মান্তিক তা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। 

আমি কামনা করছি, একটু সামলে ওঠার পর মিসেস মালট্রাভার্সকে মঁসিয়ে ব্লেক সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করবেন। 

.

অ্যাঙ্কার ইন থেকে বেরিয়ে আমরা সরাসরি চলে এলাম মিসেস মালট্রাভার্সের কাছে। পোয়ারো তার সিদ্ধান্তের কথা জানালে তিনি প্রথমে তা বিশ্বাসই করতে চাননি। 

পরে যখন নিশ্চিত হলেন, কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে আমাদের কিছুই করবার ছিল না। 

মিসেস মালট্রাভার্স খানিকটা সামলে ওঠা পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করণীয় রইল না। 

বিদায় নেবার আগে পোয়ারো শুষ্ক স্বরে বলল, মাদাম, একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি আপনাকে, মৃত্যু বলে কিছু নেই। 

ভারি হয়ে ওঠা চোখের পাতা দুটি মেলে তিনি সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এ-কথাার অর্থ? 

—প্রেত-আসরে আপনি কি কখনও কথা বলেছেন? 

—না, তেমন সুযোগ হয়নি, তবে শুনেছি প্রেতলোকের সঙ্গে মিডিয়মের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়। কেন, আপনি কি আত্মায় বিশ্বাস করেন? 

—কেবল বিশ্বাসই নয় মাদাম, অনেক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হবার সুযোগ আমার জীবনে হয়েছে। এই বাড়িটার সম্পর্কে আপনি কতদূর কী জানেন জানি না, তবে গ্রামের সকলেই এটা ভূতের বাড়ি বলে জানে। 

মিসেস মালট্রাভার্সের দুই চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। কয়েক মুহূর্ত তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না। 

এমনি সময়ে বাইরে থালাবাসনের বিকট ঝনঝন শব্দের সঙ্গে একটা আর্তনাদ উঠল। আমরা লাফিয়ে উঠলাম। পরিচারিকা হাঁপাতে হাঁপাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এলো। দু-চোখ কপালে তুলে বলতে লাগল, বাইরে বারান্দায় কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বেরিয়ে গেল। পরক্ষণেই ফিরে এসে বলল, কোথায় কেউ তো নেই! 

আতঙ্কে পরিচারিকার ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল। দম টানতে টানতে বলল, কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখলাম যে—ঠিক আমাদের মনিবের মতো- 

মিসেস মালট্রাভার্স অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন। ঝাঁপিয়ে পড়ে পোয়ারোর একটা হাত আঁকড়ে ধরে রুদ্ধনিঃশ্বাসে বলে উঠলেন—শুনতে পেয়েছেন… 

তিনটে টোকার শব্দ… ঠিক এভাবেই উনি দরজায় টোকা দিতেন। 

সবিস্ময়ে আমি জানলার দিকে তাকিয়ে বললাম—আমি তো কিছু শুনতে পেলাম না। অবশ্য ভয়ের অস্বস্তিকর অনুভূতি আমার মনেও জেগে উঠল। 

পরিচারিকাকে ভেতরের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। মিসেস মালট্রাভার্স অনুনয়ের সুরে বললেন, আপনারা দয়া করে এখুনি চলে যাবেন না। তাহলে ভয়ে আমি মরে যাব। 

রাতের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছিল। সারাদিনে ধকলও কম হয়নি। তবু মিসেস মালট্রাভার্সের অনুরোধে আমাদের বসতে হল। 

বাইরে জ্যোৎস্না ফুটফুট করছে। হাওয়ার মধ্যে গো-গো গোঙানির শব্দ। আমরা তিনজন বসে আছি নীরবে। 

নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন ক্রমশই ভূতুড়ে হয়ে উঠছে। রীতিমতো ছমছম করছে গা। একটা কথাই কেবল আমার বারবার মনে পড়ছে, অপঘাতে মৃত্যু হলে আত্মা কখনও শান্তি পায় না। একটা কুসংস্কার…কিন্তু… 

বিশ্রী ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে দরজার কপাট দুটো হঠাৎ খুলে গেল। মিসেস মালট্রাভার্স সজোরে আমার একটা হাত আঁকড়ে ধরলেন। 

পোয়ারো উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চাবি ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু ফিরে আসতে না আসতেই দরজাটা আবার ধরে ধীরে খুলে গেল। 

কিছু বুঝতে না পেরে স্তম্ভিত হয়ে রইলাম। মিসেস মালট্রাভার্স আর্তনাদ করে উঠলেন—মঁসিয়ে পোয়ারো…আমার স্বামীকে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম— 

—কোথায় মাদাম, আমি তো কিছুই দেখতে পাইনি। 

—না; না, মঁসিয়ে…আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম—আঃ, আঃ—একি— 

সহসা ঘরের আলো কমতে কমতে এক সময় দপ করে নিভে গেল। অন্ধকারে তিনটি টোকার শব্দ এবার স্পষ্ট শুনতে পেলাম। 

মর্মন্তুদ আর্তনাদ করে উঠলেন মিসেস মালট্রাভার্স। 

সেই মুহূর্তে আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম-দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একটি ছায়ামূর্তি… আমাদের দিকে মুখ ফেরানো। 

জ্যোৎস্নার ভূতুড়ে আলোতে পরিষ্কার দেখা গেল মূর্তির ঠোটে রক্তের দাগ…একটা হাত আমাদের দিকে ওঠানো। 

পোয়ারো আর আমি পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম। মিসেস মালট্রাভার্স অস্ফুট আর্তনাদ করে দু-হাতে মুখ ঢাকলেন। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নালোকে মনে হল ওঁর হাতে কিছু যেন চিকচিক করছে। 

সবিস্ময়ে আমি বলে উঠলাম, পোয়ারো, ওঁর ডান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখ। 

অসহ্য আতঙ্কে মিসেস মালট্রাভার্সের সর্ব শরীর থর থর করে কেঁপে উঠল। মুখ থেকে দু-হাত তুলে সহসা চিৎকার করে উঠলেন—একি রক্ত! হ্যাঁ রক্তই তো। খুন খুন—আমি ওকে খুন করেছি—আমি 

বলতে বলতে দু-হাতে মুখ চাপা দিয়ে আকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন, উনি যখন বোঝাচ্ছিলেন ওই ভদ্রলোক কী করে আত্মহত্যা করেছিল, তখন আমিই নিজে হাতে বন্দুকের চাবি টিপে দিয়েছি। 

উনি আবার ফিরে এসেছেন মঁসিয়ে! দোহাই আপনার-আমাকে বাঁচান—আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মিসেস মালট্রাভার্স। 

এমন সময় পোয়ারোর উচ্চকিত স্বর শোনা গেল—আলো— 

আশ্চর্য যেন যাদুমন্ত্র বলে দপ করে আলো জ্বলে উঠল। আমি হতভম্ব। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম পোয়ারোর চোখের দিকে। 

পোয়ারো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেতরে এসো এভারেৎ। তুমি আর হেস্টিংস দু-জনেই নিজের কানে শুনলে মিসেস মালট্রাভার্সের স্বীকারোক্তি। হেস্টিংস, ইনি হলেন বিখ্যাত অভিনেতা মঁসিয়ে এভারেৎ। এঁর সুনিপুণ অভিনয়ের ফলেই আমার পরিকল্পনা সার্থক হল। 

তোমাকে বলা হয়নি, সন্ধ্যাবেলা একেই ফোন করেছিলাম। মৃত মানুষের অভিনয় আর সাজসজ্জা একেবারে নিখুঁত হয়েছে। কী বলো হেস্টিংস– 

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম। বিহ্বল সপ্রশংস দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে রইলাম পোয়ারোর দিকে। 

পোয়ারো ফের বলতে শুরু করল, হেস্টিংস, আলো নিভে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি মিসেস মালট্রাভার্সের ডান হাতটা চেপে ধরেছিলাম। তুমি ভালোভাবে দেখলেই বুঝতে পারবে ওটা রক্ত নয়—লাল রঙ। 

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এই বিদঘুটে রহস্যের এখানেই ইতি পড়ল। এবারে চলো, স্টেশনের দিকে যাওয়া যাক—শেষ ট্রেনটা হয়তো যাবে। আমাদের কাজ আপাতত শেষ, এবারে যা করবার ইনস্পেক্টর জ্যাপই করবে। দলবল নিয়ে সে বাইরে অপেক্ষা করছে। 

.

আকাশের চাঁদ ততক্ষণে মেঘের তলায় চাপা পড়েছে। টিপ টিপ করে সামান্য বৃষ্টি পড়ছে। হাওয়ার মাতন আরও বেড়েছে। আমরা দু-জনই নির্বাক। মন ভারাক্রান্ত। হেঁটে চলেছি পাশাপাশি। 

গোটা ঘটনাটাই তখনও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। অথচ আমার নিজের চোখের সামনেই সমস্ত ঘটনা ঘটল। পোয়ারো যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, এই সত্যটা আমি আরও একবার প্রত্যক্ষ করলাম। 

চলতে চলতে একসময় পোয়ারো নিজেই কথা শুরু করল। হেস্টিংস, তুমি নিশ্চয় ভাবছ, এমন একটা অসম্ভব ব্যাপার কী করে আমি সম্ভব করে তুললাম, ভায়া, শেকল সামান্য একটা অসংগতি আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। 

স্থানীয় ডাক্তারের ধারণা ছিল, মৃত মালট্রাভার্স একজন বড়ো মাপের বৈজ্ঞানিক। একথা তিনি নিশ্চয় মিসেস মালট্রাভার্সের কাছ থেকে শুনেছেন। আমাদের সঙ্গে কথা বলবার সময় এসব কথার ধার দিয়েও যাননি। 

তারপর আরও দেখো, ক্যাপ্টেন ব্লেককে দেখে মিসেস মালট্রাভার্স সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কেন? 

এরপর আছে শব্দ প্রশ্নের ব্যাপারটা। তখন জানা গেল পরিষ্কারভাবেই যে, তরুণ ক্যাপ্টেন এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়। অথচ তিনি যে কাহিনী শুনিয়েছিলেন, তাই এখানে নিঃশব্দে পুনরাবৃত্ত হয়েছে। 

শব্দ-প্রশ্নের পর দুটো সম্ভাবনা আমার সামনে আসে। হয় মিঃ মালট্রাভার্স আত্মহত্যা করেছেন, নয়তো গল্পের অপর শ্রোতা তাঁর স্ত্রী গল্প-বর্ণিত পন্থার সুযোগ নিয়েছে। আমার সব চেয়ে বেশি সম্ভবপর এবং যুক্তিসংগত মনে হয় দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই। কেন না, আত্মহত্যার ঘটনা এমনভাবে ক্ষতচিহ্ন গোপন করে সম্ভবপর নয়। তাছাড়া, আত্মহত্যা করলে তাঁকে বন্দুকের চাবি টিপতে হত, পায়ের বুড়ো আঙুল চেপে। কিন্তু মৃত্যুর সময় পর্যন্ত মিঃ মালট্রাভার্সের পায়ে জুতো ছিল। 

এসব কারণেই ঘটনাটাকে স্বাভাবিক মৃত্যুর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা সম্ভব হয়নি। হত্যাকাণ্ড বলেই দৃঢ় ধারণা হয়। 

কিন্তু মুশকিল হল, আমার এই যুক্তির সমর্থনে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ ছিল না, নতুন করে পাওয়াও সম্ভব ছিল না। ফলে শেষ পর্যন্ত মাথা খাটিয়ে বিয়োগান্ত নাটকের অভিনয়ের ব্যবস্থা করতে হল। ফলাফল তো নিজের চোখেই দেখলে। 

আমি একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না পোয়ারোকে। মনে কোনো রকম দ্বিধা না রেখেই বললাম, কিন্তু পোয়ারো, হত্যার তো কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ পাওয়া যাচ্ছে না—মোডাস অপারেণ্ডি— 

—পাচ্ছ না, বেশ তাহলে গোড়া থেকেই শোন। মিসেস মালট্রাভার্স সুন্দরী তাতে কোনো সন্দেহ নেই, সেই সঙ্গে বুদ্ধিমতোীও। 

কিন্তু স্বভাবত খল এবং লোভী। অর্থের লোভেই বিয়ে করেছিলেন মিঃ মালট্রাভার্সকে এবং তাঁকে দিয়ে জীবনবীমা করাতে বাধ্য করান। তারপর শেষ কাজটার জন্য একটা মোক্ষম উপায় খুঁজতে থাকেন। 

এই পরিস্থিতিতেই আকস্মিকভাবে তরুণ ব্লেকের আবির্ভাব ঘটে। নৈশভোজের টেবিলে তার পরিবেশিত গল্পটা অবধারিতভাবে তাঁকে প্রভাবিত করে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গল্পের অনুসরণে পরিকল্পনা ছকে ফেলেন। 

পরদিন সকালেই ক্যাপ্টেন ব্লেকের সমুদ্রে পাড়ি দেবার কথা। নিশ্চিন্ত মনে বিকেলেই তিনি স্বামীকে নিয়ে বাগানে বেড়োতে যান। তখনই তিনি কথায় কথায় সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, একজন মানুষের পক্ষে ওই পদ্ধতিতে কখনও আত্মহত্যা করা সম্ভবপর নয়। 

স্বামী বেচারি ছিলেন সরল প্রকৃতির। তিনি স্ত্রীকে ব্যাপারটা বোঝাবার জন্য যথারীতি বন্দুকের নলটা মুখের মধ্যে রাখলেন। 

ঠিক সেই সুযোগেই মিঃ মালট্রাভার্সকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চোখের পলকে বন্দুকের চাবিটা টেনে দেন। ব্যস, নির্জনে, বাড়ির সকলের চোখের আড়ালে নিখুঁতভাবে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেন। ভায়া, এবার পরিষ্কার হয়েছে তো সব কিছু। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *