৩. লমবার্ড ঘড়িটা দেখল

১১.

 লমবার্ড ঘড়িটা দেখল, সাড়ে নটা। ভাবল, নাঃ আর পড়ে থাকবো না। এবারে ওঠা দরকার।

সকালে ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা তার বরাবরকার অভ্যাস। ঘুম ভাঙলেও বালিশে মুখ এঁজে পড়ে থাকে।

দরজা খুলে বাইরে আসে সে। দেখে ব্লোরের ঘর বন্ধ। এগিয়ে এসে টোকা দেয়।

একটু পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ব্লোর। তাকে দেখে লমবার্ডের মনে হয়, একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে।

ঘুমঘুম চোখে ব্লোর বলে, কি ব্যাপার?

–কটা বাজে খেয়াল আছে?

ব্লোর ঘড়ি দেখে। লজ্জিত ভাবে বলে, সর্বনাশ পৌনে দশটা। আসলে মনটা বড্ড অবসন্ন তো।

লমবার্ড বলে, তোমাকে কেউ ডেকেছিল? রজার্স চা দিয়ে গেছে?

-কই না তো? রজার্স কোথায়? যেন চমকে ওঠে ব্লোর।  লমবার্ড বলে, ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে আমারও এই কথাই মনে হচ্ছে।

দেখা গেল রজার্স নিরুদ্দেশ। সে তার ছোট্ট ঘরে বা রান্না ঘরে নেই। উনুনে আগুনও দেয়নি।

খবরটা অন্যদেরও দেওয়া হল। এমিলি ও ওয়ারগ্রেভ ছাড়া সকলেই রজার্সের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।

রজার্সের ঘরে দেখা গেল, বিছানা এলোমেলো। শোবার পোশাকটা ঘরের বাঁ পাশে পড়ে রয়েছে। দাড়িকাটার সরঞ্জাম টেবিলের একপাশে রয়েছে।

ব্রাশটা ভেজা, বোঝা গেল, দাড়ি কামিয়ে সে নিচে নেমেছে। সকলেই একে একে খাওয়ার ঘরে পা দিলেন।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, বাঃ রজার্স দেখছি বেশ পরিবাটি করে ব্রেকফাস্ট টেবিল সাজিয়েছে।

ভেরা হঠাৎ বিচারপতির হাত চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে, দেখুন, পুতুল ছটা–

সকলেই সেদিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে রইল।

.

রজার্সের মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া গেল খানিক পরেই। রান্নার কাঠ কাটতে গিয়েছিল রান্নাঘরের পেছনে। একটা কাটারি হাতেই ধরা ছিল। পাশেই কিছু কেটে রাখা কাঠ। হাত কয়েক দূরে দেয়ালে হেলান দেওয়া রয়েছে একটা রক্তমাখা কুঠার।

রজার্সের ঘাড়ে গভীর ক্ষতচিহ্ন।

.

১২.

 এমিলি আর ভেরা মিলে সকালের খাওয়ার পাট কোন রকমে সমাধা করল। টিনের খাবার ছিল প্রচুর। তাই বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

রজার্সের ঘটনাটা নিয়ে আলোচনার পরে সকলে বসার ঘরে হাজির হয়েছেন। কেবল বাদ ছিলেন এমিলি।

তার শরীর গোলাচ্ছিল বলে খাবার ঘরের চেয়ারেই বসেছিলেন।

 ডাক্তার ওষুধ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এমিলি খেতে চাননি।

এমিলির খুব ঘুম পাচ্ছিল। মৃদু গুঞ্জনের শব্দ তার কানে গেল। তাকিয়ে দেখেন জানালার কাছে একটা মৌমাছি উড়ছে।

হঠাৎ এমিলির মনে হল, কেউ যেন ঘরে প্রবেশ করল। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলেও পারলেন না।

কিন্তু কে এলো? তার মনে হল, বিয়াত্রিচে যেন। তার সর্বাঙ্গ জলে ভেজা। ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে তা থেকে।

মৌমাছির গুঞ্জন শব্দটা যেন কাছে এগিয়ে আসছে। হুল ফুটিয়ে দেবে না তো?

.

বসার ঘরে সকলে এমিলির জন্যই অপেক্ষা করছিল। ভেরা তাকে ডাকতে যাবে বলে উঠে দাঁড়াল। ব্লোর তাকে বাধা দিয়ে বলল, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যিনি রয়েছেন তিনিই খাবার ঘরে বসে আছেন।

ডাক্তার বললেন, হঠাৎ একথা কেন বলছেন–

ব্লোর বলল, ওঁর বেশি বেশি ধর্মের ভাবটা আমার ভালো লাগে না। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গ্রামাফোনের অভিযোগ শোনার পর আমরা সবাই আমাদের নিজস্ব কথা খুলে জানিয়েছিলাম। কিন্তু উনি কিছু বলেন নি।

ভেরা বলে, পরে উনি আমাকে সব কথা খুলে বলেছেন।

তাই বলে সে সকলকে বিয়াত্রিচে টেলরের কথা জানায়।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বলেন, সব শোনার পর আর ওঁকে দোষারোপ করা যায় না। আচ্ছা ভেরা, তোমার কি মনে হয়েছিল, বিয়াত্রিচের মৃত্যুর জন্য মিস এমিলির মনে দুঃখ বা অনুতাপ ছিল?

-না।

ব্লোর ওয়ারগ্রেভকে বলে, ওই মহিলা সম্পর্কে কোন ব্যবস্থা নেবেন না? অসুস্থ দেখাচ্ছিল–

-ডাক্তারই যা ভাল বুঝবেন করবেন। চলুন, বরং খাওয়ার ঘরেই যাওয়া যাক।

 সকলে খাওয়ার ঘরে আসে।

এমিলি এখনো চেয়ারে বসে আছেন। কারোর পায়ের শব্দ তিনি শুনতে পাননি।

ব্লোর এমিলির দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই থমকে দাঁড়ায়। এ কী দেখছে সে?

এমিলির মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। দেহ প্রাণহীন।

সবার আগে কথা বললেন ওয়ারগ্রেভ, ধরা গলায় বললেন, আমাদের সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে মিস এমিলি চলে গেলেন।

ডাক্তার এমিলির দেহ ভাল করে পরীক্ষা করে দেখছেন। বললেন, ঘাড়ের কাছে কিসের একটা দাগ দেখা যাচ্ছে।

ভেরা ঝুঁকে পড়ে দেখে বলে, মনে হচ্ছে কোন পোকার কামড়ের দাগ।

ডাক্তার বললেন, না, না, পোকার কামড় নয়। ওটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের দাগ।

ওয়ারগ্রেভ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কি বলছেন আপনি? ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে করে ওকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, তাই। কোনরকমের সায়ানাইডই হওয়া সম্ভব। একই পটাসিয়াম মার্সটনকে দেওয়া হয়েছিল। ফলে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু ঘটেছে। আমাদের ডাক্তারি নাম অ্যাসফিকসিয়েশন।

হঠাৎ জানলার কাছে একটা গুঞ্জন শব্দ।

জানালার কাছে একটা মৌমাছি দেখা গেল।

 ভেরা সেদিকে তাকিয়ে বলে, মৌমাছি এই কাণ্ড ঘটায়নিতো?

ডাক্তার গম্ভীর স্বরে বললেন, মনে হচ্ছে ওটাকে হত্যাকারী কাজে লাগিয়েছে। সুচারু কাজ সন্দেহ নেই।

ভেরা হঠাৎ ডাক্তারকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা আপনি আসার সময় হাইপোডারমিকের সিরিঞ্জ সঙ্গে এনেছিলেন?

–হ্যাঁ। সব ডাক্তারের ব্যাগেই ওই সিরিঞ্জ থাকে।

সঙ্গে চারজোড়া চোখ ডাক্তারের দিকে ফেরে।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, কিছু যদি মনে করেন, দয়া করে আপনার সিরিঞ্জটা বার করে দেখাবেন? নিশ্চয়ই সেটা আপনার ব্যাগেই রয়েছে এখনো?

-আমার হাতব্যাগেই রয়েছে। সেটা আছে আমার ঘরে সুটকেসের ভেতরে।

–আপনার কথার সত্যতা আমরা যাচাই করতে চাইলে নিশ্চয় আপনার আপত্তি হবে না?

 –কোন আপত্তি নেই। তাহলে চলুন—

ডাক্তারের পেছন পেছন মিছিল করে সকলে ওপর তলায় তার ঘরে গিয়ে ঢোকে। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল, কিন্তু সিরিঞ্জ কোথাও পাওয়া গেল না।

–নিশ্চই চুরি করেছে কেউ। আমি হলপ করে বলতে পারি। ডাক্তার কর্কশ গলায় বলেন।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, আমরা পাঁচজন এই ঘরেই রয়েছি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এর মধ্যেই একজন হত্যাকারী। নিরপরাধ চারজন এবারে তার লক্ষ্য।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আচ্ছা ডাক্তার, আপনার কাছে একটা ওষুধের বাক্স আছে?

-হ্যাঁ। এই তো। ডাক্তার বাক্সটা এগিয়ে ধরলেন।

-আমার হাতে কিছু ঘুমের ওষুধ আছে। ঘুম না এলে খেতে হয়। তবে বেশি খেলে অনিবার্য মৃত্যু। লমবার্ড, তোমার কাছে তো একটা রিভলভার রয়েছে–

লমবার্ড জানায়, হ্যাঁ, আছে, তাতে কি?

-আমি বলতে চাইছি, ডাক্তারের ওষুধের বাক্স, আমার ঘুমের বড়ি এবং রিভলভার–এই ধরণের জিনিস যার কাছে যা আছে, সব একটা নিরাপদ জায়গায় রেখে দেওয়া উচিত।

লমবার্ড বলে, কিন্তু রিভলভার হাতছাড়া করলেই তো বিপদে পড়ে যাব।

-লমবার্ড, তুমি শক্তিমান যুবক। কিন্তু ব্লোরও যুবক, গায়েও তার যথেষ্ট শক্তি। আমি ডাক্তার ও ভেরা ওকে সাহায্য করলে তুমি বাধা দিয়ে পারবে না, বুঝতেই পারছ।

 লমবার্ড অগত্যা বলে, বেশ, কী করতে হবে বলুন?

–এই তো মাথায় বুদ্ধি ফিরেছে। তোমার রিভলভারটা কোথায়?

আমার ঘরে, খাটের পাশের টেবিলের ড্রয়ারে।

–বেশ। চল আমরা সকলে যাচ্ছি।

লমবার্ড দ্বিমত করল না। সকলে মিলে তার ঘরে হাজির হল। কিন্তু বিস্ময় সেখানেও অপেক্ষা করছিল। দেখা গেল যথাস্থানে রিভলভার নেই।

.

–এ তো দেখছি ভেল্কি। লমবার্ড হতবাক হয়ে যায়।

ওয়ারগ্রেভ বলেন, ভেরা তুমি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।

ভেরা বাইরে চলে গেলে লমবার্ডের শরীর তল্লাশি করা হলো। তারপর বাকি তিনজনও বাদ গেল না। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই কারোর কাছে পাওয়া গেল না।

এরপর ওয়ারগ্রেভ ভেরাকে ডাকলেন। সে এলে বললেন, তুমি কিছু মনে করো না। এই সময়ে আমি নিরুপায়। তোমার কাছে সাঁতারের পোশাক আছে?

-হ্যাঁ। –

-তাহলে, এই পোশাক বদলে তা পরে এসো।

ভেরা চলে যায়। একটু পরেই সাঁতারের পোশাক পরে ফিরে আসে।

ওয়ারগ্রেভ তাকে বললেন, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও, আমরা তোমার একটু পরীক্ষা করব।

ভেরার ঘরে কিছু পাওয়া গেল না। সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ভেরাও পোশাক পাল্টে সকলের সঙ্গে এসে যোগ দিল।

আবার সকলে বসার ঘরে।

ওয়ারগ্রেভ সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে আমাদের কারোর কাছেই জীবন হানিকর কিছু নেই। এখন এই ওষুধগুলো নিচের খাবার ঘরে বাসন রাখার সিন্দুকে রেখে দিতে হবে।

লমবার্ড ব্যঙ্গের সুরে বলে, সিন্দুকের চাবিটা কি এরপর আপনার কাছে থাকবে?

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লমবার্ডের দিকে তাকালেন। তারপর শান্তভাবে বললেন, তাহলে, চলুন নিচে যাওয়া যাক।

নিচে গেরস্থালির চাবি একটা হুকে সাজানো আছে। ওয়ারগ্রেভ একটা রিং তুলে আনলেন। তাতে দুটো চাবি। ওটা সিন্দুকের চাবি।

খুলবার জন্য দুটোই ব্যবহার করতে হয়। ওয়ারগ্রেভ সিন্দুক খুলে ওষুধগুলো রেখে চাবি ঘুরিয়ে আবার বন্ধ করে দিলেন।

তারপর একটা করে চাবি লমবার্ড ও ব্লোরকে দিয়ে তিনি বললেন, তোমরা একে অপরের কাছ থেকে চাবি কেড়ে নিতে পারবে না, দুজনেই শক্তিমান।

সিন্দুক ভাঙা সহজ কাজ হবে না, তাতে শব্দও হবে প্রচণ্ড। কাজেই ওষুধগুলো নিয়ে আর ভয়ের কোন কারণ নেই।

একটু থেমে ওয়ারগ্রেভ আবার বললেন, কিন্তু লম্বার্ডের রিভলভারটা কোথায় গেল সেটাই ভাবছি। আচ্ছা, ওটা তুমি শেষ কখন দেখেছিলে লমবার্ড?

লমবার্ড বলল, কাল রাতে শোবার সময়।

ব্লোর বলল, রিভলভারটা পাওয়া না গেলেও অন্য একটা জিনিস কোথায় আছে আমি বলতে পারি। আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।

ব্লোরকে অনুসরণ করে সকলে খাওয়ার ঘরের পেছনে এলো। ব্লোর আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল, জানলার নিচে ঘাসের ওপরে পড়ে রয়েছে সিরিঞ্জ ও একটা ভাঙ্গা পুতুল।

ব্লোর বলল, মিস এমিলিকে হত্যা করে হত্যাকারী ওগুলো ফেলে দিয়েছে।

ভেরা বলল, তাহলে খুঁজলে রিভলভারটাও পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। চলুন। দেখা যাক।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, চল তাহলে। তবে সবাই আমরা একসঙ্গে থাকব। এখন আলাদা ভাবে থাকা মানেই হত্যাকারীকে সুযোগ করে দেওয়া।

এরপর সকলে মিলে আঁতিপাতি করে খুঁজলেন, কিন্তু রিভলভার কোথাও পাওয়া গেল না।

.

১৩.

 অবশিষ্ট পাঁচটা মানুষ। কিন্তু মানসিকভাবে কেউই স্বস্তিতে নেই। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সন্দেহ করছে, কেন না, ওয়ারগ্রেভ বুঝিয়ে দিয়েছেন, খুনী তাদের মধ্যেই একজন। তবু বাঁচার চেষ্টায় তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত না থেকে পারছে না।

প্রকৃতিও আজ বড় অশান্ত। বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে। পাল্লা দিয়ে চলেছে ঝোড়ো হাওয়া।

থেকে থেকে দমকা হাওয়া বাড়িটার ওপর আছড়ে পড়ছে প্রচণ্ড আক্রোশে। যেন প্রাসাদোপম বাড়িটা গুঁড়িয়ে দেবে।

ওরা পাঁচজন, বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ, ডাঃ আরমস্ট্রং, ব্লোর, লমবার্ড ও ভেরা ঘরে বসে আছে খানিক দূরে দূরে।

এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, প্রত্যেকে যেন একটা আলাদা দ্বীপ।

 সকলেরই মনের মধ্যে একটা কথা কেবলই ঘুরে ফিরছে–খুনী আমাদের মধ্যেই একজন।

 দূরেদূরে বসে আছে, কিন্তু তাদের চোরা দৃষ্টি পরস্পরকে তীক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করছে। হাবভাব কতটা সন্দেহজনক তা জরীপ করবার চেষ্টা করে চলেছে।

সময় বয়ে চলে। হাওয়ার গজরানি আর শার্সির গায়ে বৃষ্টি আছড়ে পড়ার শব্দ ছাড়া এঘরে অন্য কোন শব্দ নেই।

ভেরা বলল, চা করে নিয়ে আসা যাক।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, মন্দ হয় না। কিন্তু তুমি একা যেয়ো না, আমরাও সঙ্গে যাব। চা টা আমাদের সামনেই করো।

পারস্পরিক এই সন্দেহের খোলামেলা প্রকাশকে এখন আর কেউ অপমানজনক বলে মনে করছে না। তাই ভেরা বলল, বেশ চলুন।

.

সন্ধ্যাবেলা আলো জ্বালতে গিয়ে দেখা গেল, আলো জ্বলছে না। রজার্স মারা যাবার পর আর ইঞ্জিনটা চালানো হয়নি।

লমবার্ড ইঞ্জিনটা চালাবার কথা বললে, ওয়ারগ্রেভ বললেন, এখন আর ঝামেলা করে কাজ নেই। রান্নাঘরে অনেক মোমবাতি আছে, তাই জ্বালানো হোক।

তাই করা হলো।

.

মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। ভেরার মাথাটা ভারি ভারি বোধ হচ্ছিল। শরীরও কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। স্নান করলে একটু স্বস্তিবোধ করবে ভেরার মনে হল।

সে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে প্লেটের ওপর বসিয়ে দোতলার ঘরে গেল। চারপাশে অন্ধকার। মোমবাতির সামান্য আলোয় অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে।

ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ভেরার মনে পড়ে গেল হুগোর কথা। তার হাত কেঁপে উঠলো। প্লেটটা পড়ে গেল, বাতি নিভে গেল।

কিছু বুঝতে না পেরে তীব্র আতঙ্কে ভেরা আর্তনাদ করে উঠল। তার মনে হল একটা ঠান্ডা হাত তার কপালে, গলায় গালে ….

ভেরার চিৎকার শুনে সকলে ওপরে ছুটে আসে। একটা করে জ্বলন্ত মোমবাতি সবার হাতে।

ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করলেন ভেরাকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানালেন, ভেরা বেঁচে আছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

ব্লোর নিচে গিয়ে একটু ব্র্যান্ডি নিয়ে আসে। ভেরাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেই বাধা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল–না, না, আমি কিছু খাবো না।

সেই সন্দেহ। যদি পানীয়ের সঙ্গে কিছু মেশানো থাকে। ব্লোর অপমান বোধ করলেও হাত সরিয়ে আনল।

 লমবার্ড বলল, একটা না-খোলা বোতল পাওয়া গেলে ভাল হতো, দেখছি–

বলে সে নিচে নেমে গেল। এত কাণ্ডের পরেও ভেরা যে বিচার শক্তি হারিয়ে ফেলেনি এতে সে খুশি।

ডাক্তার ভেরাকে সাবধানে তুলে ধরে কলের কাছে নিয়ে গেলেন। চোখে মুখে জল ছেটাল ভেরা। ওর সামনেই গ্লাস ধুয়ে জল দিলেন ডাক্তার। জলটুকু খেল সে। তারপর ডাক্তারের হাত ধরে ফিরে এসে খাটের ওপরে বসল।

ভেরা কেন ভয় পেয়েছিল তা জানা গেল। ঘরের সিলিং থেকে ঝুলছে একটা সামুদ্রিক লতা। কিন্তু ওটা আগে ওখানে ছিল না, সদ্য কেউ ঝুলিয়ে রেখে গেছে।

 লমবার্ড একটা আনকোরা ব্র্যান্ডির বোতল নিয়ে এল।

তা থেকে খানিকটা পান করে ভেরা সুস্থ বোধ করতে লাগল।

লমবার্ড বলল, খুনীর একটা চেষ্টা ব্যর্থ হল। ভেবেছিল এই দফায় ভয় পাইয়ে কাজ হাসিল করবে। আপনার মনের জোর আছে বলতে হবে।

ব্লোর যে গ্লাসে করে ব্র্যান্ডি এনেছিল, ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে সেটা পরীক্ষা করছিলেন। ব্লোর বলল, আপনি আমায় সন্দেহ করছেন–

আবার অপ্রিয় প্রসঙ্গ উঠে পড়েছে। ভেরা সেটা চাপা দেবার জন্য বলল, আমাদের বিচারপতিকে তো দেখতে পাচ্ছি না। তিনি কোথায়?

তখন সকলের খেয়াল হল। সত্যিই তো, তিনি নেই। ডাক্তার চিৎকার করে ডাকলেন–মিঃ ওয়ারগ্রেভ

কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আবার শুরু হল খোঁজার পালা। খাওয়ার ঘর, বসার ঘর, সিঁড়ি, বারান্দা সব খোঁজা হল।

শেষে তার ঘরে এসে সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ওয়ারগ্রেভ নিজের ঘরে একটা চেয়ারে বসে আছেন। তার মাথায় একটা পরচুলা, পরণে লাল সিল্কের গাউন।

ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে তাকে পরীক্ষা করলেন। ওয়ারগ্রেভ বেঁচে নেই জানালেন।

মাথার পরচুলাটা তুলে ফেলতেই দেখা গেল চকচকে টাকের মাঝখানে একটা লাল দাগ। ডাক্তার জানালেন, গুলির আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে।

ভেরা পরচুলাটা কুড়িয়ে নিল। সে চিনতে পারল। বললো, এটা দেখছি এমিলির হারিয়ে যাওয়া উলের গোলা দিয়ে তৈরি। আর গাউনটাও স্নানের ঘরের হারিয়ে যাওয়া পর্দার লাল সিল্কের কাপড়।

ব্লোর বলল, রিভলভারটা কেন সরানো হয়েছে, এবারে পরিষ্কার হল।

.

১৪.

 ওরা এবারে চারজন–ডাক্তার, ভেরা, ব্লোর এবং লমবার্ড। সকলে নিচের বসার ঘরে নেমে এলো।

রাতে মুখে তো কিছু দিতে হবে। তার ব্যবস্থা কি হবে। টিনের খাবার ছিল প্রচুর। তাই দিয়ে কোন রকমে চালিয়ে দেওয়া হল। কেউই বিশেষ মুখে তুলতে পারল না।

ব্লোর বলল, এবারে কার পালা কে জানে?

 ডাক্তার বললেন, আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।

 লমবার্ড বলল, ছাড়ুন তো ওসব কথা। বিচারপতিও তো ও-কথা বারবার বলেছেন, তিনি নিজেই কি রেহাই পেলেন? যা হবার হবে–ও নিয়ে আর ভাববার দরকার নেই।

ডাক্তার বললেন, সত্যি, ঘটনাটা এখনও অবিশ্বাস্য ঠেকছে।

 লমবার্ড বলল, খুনীর কৌশলগুলো অতি চমৎকার। মিস ভেরার চিৎকার শুনে আমরা ওপরে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, আর সেই সুযোগে সে কাজ হাসিল করে নিয়েছে।

ব্লোর বলল, কিন্তু গুলির শব্দ তো পাওয়া গেল না।

 লমবার্ড বলল, পাব কি করে? একদিকে চিৎকার, দৌড়োদৌড়ি, তার মধ্যে সমুদ্রের গর্জন মিলেমিশে সব একাকার হয়ে গেছে।

তাছাড়া আমাদের মনযোগও ছিল অন্য দিকে।

তারপর আর বেশি রাত করল না তারা। দোতলায় যে যার ঘরে শুতে চলে গেল একটা করে মোমবাতি নিয়ে।

সিঁড়ি দিয়ে তাদের ওপরে ওঠার দৃশ্যটা ছিল বড়ই করুণ। চারজনই পাশাপাশি উঠছে। পরস্পরের প্রতি সন্দেহ এমনই প্রবল যে কেউ কারো পেছনে যেতে রাজি নয়।

এভাবে ওপরে উঠে গিয়ে প্রায় একই সঙ্গে চার ঘরের চারটে দরজা বন্ধ করে তারা স্বস্তি বোধ করল।

.

লমবার্ড তার ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। খুঁটিয়ে দেখল নিজেকে। না, মুখে ভয়ের চিহ্ন নেই। নিজের মনে হাসল সে। এরপর শোবার পোশাক পরে বিছানা নিল।

হাত ঘড়িটা টেবিলে রাখল খুলে। কি মনে হতে ড্রয়ারটা টান দিয়ে খোলে। সঙ্গে সঙ্গে হতভম্ব হয়ে গেল সে। ড্রয়ারের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া রিভলভারটা রয়েছে।

.

ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে রাত বারোটা বাজল।

পুলিস অফিসার ব্লোর বিছানায় ছটফট করছে। ঘুম আসছে না। অন্ধকারের মধ্যে তার মনে পড়ে–যারা তাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে তাদের কথা।

হঠাৎ ব্লোরের মনে পড়ে যায় তার স্ত্রীর কথা–ল্যাণ্ডরের। গ্রামাফোন রেকর্ডে তার কথা বলেছে। ওদের একটা দশবছরের মেয়ে ছিল। কী হল তাদের?

হঠাৎ ব্লোর চমকে ওঠে। ঘড়িতে একটার ঘন্টা পড়ল। পরক্ষণেই কার পায়ের শব্দ। বারান্দায় যেন কেউ হাঁটছে।

কান পেতে শুনল ব্লোর। হ্যাঁ, কোন ভুল নেই–কে হাঁটাচলা করছে।

ব্লোরের কপালে ঘাম জমতে থাকে। সে বিছানা ছেড়ে এসে দরজায় কান পাতে। না, এখন আর শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

দরজা খুলে বাইরে বেরুবে কিনা ভাবছে ব্লোর। হঠাৎ তার মনে হল কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে।

শব্দটা তার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর আবার চলতে থাকে–সিঁড়িতে নামার শব্দ পায়। আর কোন আওয়াজ হয় না।

ব্লোর তার সিদ্ধান্ত স্থির করে নেয়। সে চটিজোড়া খুলে নেয়। পায়ে কেবল মোজা।

লোহার ল্যাম্প স্টান্ডটা হাতিয়ার হিসাবে মুঠি চেপে তুলে নেয়। তারপর নিঃশব্দে বারান্দায় বেরিয়ে আসে।

এখন বাতাস ধীর। মেঘও কেটে গেছে। আকাশে চাঁদের হাল্কা আলো। সেই আলোতে ব্লোর দেখতে পায় একটা ছায়ামূর্তি যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

ব্লোর দৌড়োতে গিয়েও সামলে নেয়। না, হত্যাকারীর ফাঁদে ধরা দেবে না।

এবারে সে ডাক্তারের ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দেয়। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায় না।

এরপর লম্বার্ডের দরজায় আঘাত করে। ভেতর থেকে সাড়া আসে, কে—

আমি ব্লোর।

–কি ব্যাপার বলো।

–ডাক্তার দেখছি তার ঘরে নেই।

–আসছি, অপেক্ষা করো।

এরপর ব্লোর ভেরার দরজায় মৃদু আঘাত করে। সাড়া পাওয়া গেল। পরিচয় জানিয়ে বলল, একমিনিট পরে আসছি।

লমবার্ড দরজা খুলে বারান্দায় বেরোয়। গায়ে রাতের পোশাক। হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। একটা হাত জ্যাকেটের পকেটে।

ব্লোর তাকে ডাক্তারের কথা বলে। দুজনে মিলে ডাক্তারের দরজায় আসে। টোকা দেয়, ডাকে। কোন সাড়া আসে না। এবারে দরজায় ধাক্কা দেয়। দরজা খুলে যায়। ঘরে কেউ নেই, ঘর ফাঁকা।

এবারে ওরা দুজন ভেরার দরজার সামনে আসে। ভেরা সাড়া দেয় কিন্তু দরজা খোলে না।

 লমবার্ড বলে, আমিও ডাক্তারকে খুঁজতে যাচ্ছি। যদি ডাক্তার এসে ডাকে আপনি দরজা খুলবেন না। যদি আমি ও ব্লোর একসঙ্গে এসে ডাকি তাহলেই কেবল দরজা খুলবেন।

এরপরে সে ব্লোরকে বলে, চলো ডাক্তারের সন্ধান করা যাক।

ব্লোর বলে, কিন্তু একটা কথা ভাবছি–

–কি কথা?

–রিভলভারটা ডাক্তারের কাছে থাকা অসম্ভব নয়।

লমবার্ড বলে, না, ওটা আমার কাছে আছে। রাতে শুতে যাবার আগে ড্রয়ারেই পেয়েছি। অস্ত্রটা সে ব্লোরকে দেখায়।

ব্লোর কেমন থমকে যায়। কিন্তু মনে মনে বলে, না, ওই অস্ত্রকে আমি ভয় করি না। ভয় রহস্য আর গুপ্তঘাতককে।

.

ভেরার আর ঘুম আসে না। সে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকে। সে ভাবে তবে কি ডাক্তারই হত্যাকারী?  লমবার্ড আর ব্লোর তাকে খুঁজতে গেছে। এই অবস্থায় তিনি কোন ছলনা করে দরজা খোলাবার চেষ্টা করতে পারেন। হয়তো বলবেন, ওরা দুজনেই মারা গেছে। কিংবা বাড়িতে আগুন লেগেছে?

ভেরা বিছানা থেকে নেমে দরজাটা একবার পরীক্ষা করল। তারপর জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। চোখে মুখে ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়া লাগে।

বুঝতে পারে, ভোর হতে বেশি দেরি নেই।

ভেরার দরজায় টোকা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে কথা ভেসে আসে আমি ব্লোর–আমি লমবার্ড।

দরজা খুলে ভেরা ওদের দুজনকে দেখতে পায়। পাজামা হাঁটু পর্যন্ত জলে ভেজা। দুজনকেই বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

ওরা হতাশভাবে জানায় ছোট্ট দ্বীপটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, কিন্তু ডাক্তারকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।

ভেরা বলল, তিনি হয়তো বাড়ির ভেতরেই কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন।

ব্লোর বলল, কোথাও দেখতে বাদ দেইনি আমরা। 

লমবার্ড বলে, আরও একটা খবর আছে—

কি?

–পুতুল মাত্র তিনটা আছে–মানে আমরা তিনজনই মাত্র বেঁচে আছি।

ভেরার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। অস্ফুট আর্তনাদের শব্দ করে সে।

.

১৫.

 আজ আকাশ নির্মেঘ নীল। ঝকঝকে রোদ। গত কদিনের আবহাওয়ার সঙ্গে আজ কোন মিলই নেই।

ওরা তিনজন–ভেরা,  লমবার্ড আর ব্লোর, সমুদ্রের ধারে বসে আছে। আজ, ওরা যেন খানিকটা হাল্কা, ভার মুক্ত বোধ করছে।

ডাক্তারের কথাই ভাবছিল তারা তিনজন।

 লমবার্ড বলে, প্রতিমুহূর্তের মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে গেছেন ডাক্তার। এভাবে বেঁচে থাকা মৃত্যুরও বাড়া।

ভেরা বলে, কিন্তু তিনি যে মারা গেছেন, এমন কোন প্রমাণ তো হাতে নেই।

–প্রমাণ সেই পুতুল। একটা উধাও।

–হ্যাঁ, অন্যদের ক্ষেত্রেও এরকমই হয়েছে। কিন্তু মৃতদেহটা উধাও হয়ে যাবে কেন?

–হয়তো হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল, ভাসতে ভাসতে দূরে চলে গেছে।

 লমবার্ড কর্কশ গলায় বলল, কিন্তু তাকে হত্যা করল কে? তুমি না আমি? তুমি তো আমাকে ডাকলে–আমি তোমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। এর মধ্যে ডাক্তারকে হত্যা করার, সময় কখন পেলাম।

তাছাড়া সমুদ্রে ফেলে দিতে হলে তো কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তার জন্য অনেক সময়ের দরকার।

ব্লোর বলে, ওসব হিসেব মিলবে না। আমি ভাবছি রিভলভারের কথা, ওটা সব সময় তোমার কাছেই ছিল।

–একদম বাজে কথা। আমাকে তো তোমরা তল্লাশি করেছিলে।

–তা করেছিলাম। তখন কোথাও হয়তো লুকিয়ে রেখেছিলে।

লমবার্ড উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, না, না–আমি বলছি কাল রাতে ওটা ড্রয়ারের মধ্যেই আবার পেয়েছি।

–তোমার কথাই যদি মেনে নিই তাহলে ওটা কে ফেরত দিল, কখন, কিভাবে ফেরত দিল, তা নিশ্চয় তুমি জান না।

–না।

–এখন ওটা তোমার কাছেই আছে তো?

–হ্যাঁ।

–তাহলে কি দাঁড়াল? আমার আর মিস ভেরার জীবন মরণ তোমার দয়ার ওপর নির্ভর করছে। তবে–

–বলো, তবে কি?

–ওষুধগুলো যেখানে আছে রিভলভারটাও যদি সেখানে রেখে দাও আর দুটো চাবি একটা করে আমাদের দুজনের কাছে থাকে–তবে তোমার কথা বিশ্বাস হতে পারে।

–অসম্ভব।

–অসম্ভব কেন? ব্লোর তীক্ষ্ম চোখে তাকায় লমবার্ডের দিকে।

–তোমার কথার অর্থ দাঁড়াচ্ছে আমিই তাহলে আওয়েন। যদি তাই হতাম তাহলে তো কাল রাতেই তোমাকে খতম করে দেবার সুযোগ ছিল।

এবারে ভেরা কথা বলে, মাথায় ঝুলছে মরণের খাঁড়া, আর আপনারা এখন ঝগড়া করছেন। ভাবুন কি করে আমরা বাঁচতে পারি।

ব্লোর আর  লমবার্ড কথা বন্ধ করে ভেরার দিকে তাকায়।

ভেরা আবার বলে, আমার কি মনে হচ্ছে জানেন, ডাক্তার মারা যাননি, কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন।

.

ব্লোর হাত ঘড়ি দেখে বলল, বেলা দুটো বাজে, লাঞ্চের কি হবে?

ভেরা বলে, আমি আর ওই বাড়িতে যাচ্ছি না।

–কিন্তু কিছু খাওয়া তো দরকার।

 লমবার্ড বলে, আমার এখন খাবার ইচ্ছা নেই। আমি এখানেই থাকব আপাতত।

ব্লোর ভেরার দিকে তাকিয়ে বলল কিন্তু–

ভেরা বুঝতে পারল ব্লোর কি বলতে চাইছে। সে বলল, আপনার অনুপস্থিতিতে লমবার্ড আমাকে গুলি করে মারবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।

ব্লোর বলল, আমি তা বলতে চাইনি। কথা হয়েছিল, আমরা সব সময় একসঙ্গে থাকবো। আমি সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম।

 লমবার্ড বলল, বেশ চল আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।

-না, তুমি থাকো, আমি যাচ্ছি। এই বলে ব্লোর বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

ভেরা ভয়ে ভয়ে বলল, উনি একটা ঝুঁকি নিলেন।

ঝুঁকির কিছু নেই। ডাক্তার ওর গায়ের জোরের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না।

–কিন্তু এই সমস্যার সমাধান কোথায়?

–একটু তলিয়ে ভাবুন। কাল রাতের কথা ভাবুন।

বলে  লমবার্ড একটু চুপ করে। তারপরে বলে, ব্লোর তার ঘরের সামনে প্রথম পায়ের শব্দ শুনেছে; তার পরে আমাকে ডেকেছে। আমার বিশ্বাস ডাক্তারকে হত্যা করার পরেই আমাকে, এসে ডেকেছে।

-তা কি করে সম্ভব?

–অতসব বলতে পারব না, আমার যা বিশ্বাস, সেই কথাই আমি বললাম। এটুকু জানি, ওর সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত।

ভেরা এবারে ভয় পেয়ে যায়।–যদি তাই হয়, আমাদের কি হবে?

-কি আবার হবে।

লমবার্ড রিভলভারটা বার করে ভেরাকে দেখায়। বলে, এটা দিয়েই মোকাবিলা করব।

রিভলভার দেখে ভেরা আরও ভয় পেয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, লম্বার্ডের কাছে দয়ার পাত্র। যে কোন মুহূর্তে তাকে শেষ করে দিতে পারে।

সে সজাগ হয়, লমবার্ডের মনের কথা সে জানে না। কি উদ্দেশ্যে সে তার কাছে বসে আছে তা-ও সে বুঝতে পারছে না। ভেরা তো তাকে থাকবার জন্য অনুরোধ করেনি।

ভেরাকে চুপ করে থাকতে দেখে  লমবার্ড তার মনের কথা অনুমান করতে পারে। বলে, আমার দ্বারা আপনার কোন ক্ষতি হবে না, এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন।

ভেরা করুণ হেসে বলে, বিশ্বাস না করে উপায় কি। তবে ব্লোরকে আপনি ভুল বুঝেছেন। আমার ধারণা ও ডাক্তারকে খুন করেনি।

তারপর সম্পূর্ণ পাল্টে যায় ভেরার গলার স্বর। নিচুস্বরে বলে, আচ্ছা, আপনার এমন মনে হয়, সবসময় কেউ আমাদের লক্ষ্য করছে?

-না, না, ওটা দুর্বল মনের চিন্তা।

ভেরা এবার চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। লমবার্ডের দিকে একটু এগিয়ে বসে। তারপর ফিসফিস করে বলে, এমন তো হতে পারে, এসব কিছুর পেছনে রয়েছে কোন মানুষের আত্মা। সে কারণই সবকিছু এমন নিখুঁত–

 লমবার্ড বলে, ওসব আত্মা বা অলৌকিক ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই।

–বিশ্বাস করেন না?

–না। কেন না, আমি ভাল করেই জানি, যা কিছু এখানে ঘটছে, সবের পেছনেই রয়েছে কোন মানুষ। আচ্ছা, এসব আত্মার ব্যাপার আপনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেন?

–করি বইকি।

 লমবার্ড এবারে মৃদু হাসল। বলল, সবই বিবেকের কাজ।

-মানে? যেন চমকে ওঠে ভেরা।

–না, বলছি বিবেকের কথা। আপনি তাহলে সেই শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলেন?

 ভেরা অকস্মাৎ চিৎকার করে ওঠে, না-না–ও বিষয়ে আপনি কী জানেন?

–তা ঠিক কিছুই জানি না। তবু অনুমান করতে পারছি আপনার মত একটি মেয়ে, হৃদয়ঘটিতে কোন ব্যাপার না থাকলে তো এমন কাণ্ড করা সম্ভব নয়?

ভেরা হাঁপাতে লাগল। হঠাৎ তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, হ্যাঁ ছিল।

 লমবার্ডের মনে কি ঈর্ষার ছায়া পড়ল? তার মুখ বিবর্ণ দেখালো কেন?

 ঠিক সেই সময় বাড়ির দিক থেকে একটা ভারি কিছু পড়ার শব্দ ভেসে এলো। সেই সঙ্গে একটা আর্তনাদের শব্দ।

চকিতে দুজনে উঠে দাঁড়ালো, পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো। লমবার্ড বলল, চলুন দেখা যাক–

ওদের জন্য এক মর্মান্তিক দৃশ্য অপেক্ষা করছিল। তবে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তাই আকস্মিকতার ধাক্কা ওরা নীরবেই সামলে নিতে পারল।

চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস করবার মত নয় এই দৃশ্য।

বারান্দার পূবদিকে ব্লোর মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দু হাত দুদিকে ছড়ানো। মাথাটা একেবারে গেঁৎলে গেছে।

কাছেই পড়ে আছে একখণ্ড ভারি পাথর। পরিষ্কারই বোঝা গেল, ওই পাথর দিয়েই আঘাত করা হয়েছে।

কিন্তু এই কাজ কে করল? ভেরা আর লমবার্ড তো ছিল সমুদ্রতীরে।

কোন সন্দেহ নেই এ কাজ ডাক্তারের। এখনো জীবিত থেকে লোকটি নিষ্ঠুরভাবে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

লমবার্ড দাঁত দাঁত চেপে বলল, যে করেই হোক ডাক্তারকে এবার খুঁজে বার করব। আমি চললাম।

কাঁদো কাঁদো ভেরা এবারে অদ্ভুত সম্বোধন করে বসল, পাগলামো করো না, লমবার্ড। খুনীর লক্ষ্য এবার আমরা দুজন। আমরা তাকে খুঁজতে বেরব এটাই তার ফাঁদ–না না–তুমি যেতে পারবে না।

লমবার্ড থমকে দাঁড়াল। বলল, তুমি বোধহয় ঠিকই বলছ। বেশ, চলো বাইরে যাই।

ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসল। এখন আর ওদের মধ্যে কোন ব্যবধান নেই। ভাগ্যই ওদের দুজনকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে।

লমবার্ড বলল, কাল আমরা এমন করে খুঁজলাম, ডাক্তার কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে বলো তো?

–কোথাও নিশ্চয় আছে। আর খুঁজতে গিয়ে কাজ নেই। মৃত্যু চারপাশেই ওত পেতে আছে।

লমবার্ড রিভলভারটা বার করে দেখাল। বলল, এটা এখনো আমার কাছে রয়েছে।

–অত বড়াই করো না  লমবার্ড। ব্লোরও কম হুঁশিয়ার ছিল না। তাই বলছি, আর খোঁজাখুঁজিতে গিয়ে কাজ নেই।

লমবার্ড ভেরার কথা অগ্রাহ্য করে না। সে তার পাশেই বসে থাকে।

ভেরা একসময় বলে, আজকের আবহাওয়া বড় চমৎকার। চাঁদের আলোয় সারারাত এখানেই কাটিয়ে দেব। তোমার ভাল লাগবে না?

লমবার্ড বলে, আপত্তি কি। চল, এখন একটু ঘুরে বেড়ানো যাক। অনেকক্ষণ একভাবে বসে আছি।

এরপর দুজনে একসঙ্গে হাত ধরে অনেকক্ষণ এদিক সেদিক বেড়াল।

বিকেলের সোনালী রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে। আর কিছু সময় পরেই সূর্য অস্ত যাবে।

টিলার নিচের দিকে সমুদ্রের দিকটায় কি চোখে পড়ল লম্বার্ডের। সে সেদিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

ভেরা জিজ্ঞেস করল, কথা বলছো না কেন? কি দেখছ ওদিকে অমন করে?

 লমবার্ড বলে, ওটা কি বল তো?

আঙুল তুলে দেখায় সে। ভেরা কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকে। পরে বলে, মনে হচ্ছে সামুদ্রিক লতাজাতীয় কিছু জলে ভাসছে।

–চলো, কাছে গিয়ে দেখা যাক। আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে।

ভেরা লমবার্ডকে হাত আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সেভাবেই বলল, যাবে তো চলো। আমার কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু মনে হচ্ছে না।

–তবু, দেখতে ক্ষতি কি?

কাছে গিয়ে দেখা গেল, ভাসমান বস্তুটা লতা বা শ্যাওলা জাতীয় কিছু নয়। একটা জামা জলে ভাসছে।

আরও একটু কাছে গিয়ে ভাল করে লক্ষ্য করল ওরা। তখন বুঝতে পারল, শুধু পোশাক নয়, একটা মানুষের মৃতদেহ–জলে ভাসছে।

লমবার্ড বলল, জোয়ারের টানে এপাড়ে এসে ভিড়েছে। চিনতে অসুবিধা হল না। ডাক্তার আরমস্ট্রং-এর মৃতদেহ।

.

১৬.

 লমবার্ড হেসে বলল, ব্যাপারটা মন্দ হল না, কি বলো ভেরা?

–কি ব্যাপার?

–এই যে তুমি আর আমি–এই দুজন ছাড়া দ্বীপে আর কেউ নেই।

ভেরার মুখ হঠাৎ কেমন কঠিন হয়ে উঠল। চোখের কোমল দৃষ্টি মুহূর্তে আগুন-ঝরা হয়ে উঠল। ও যেন আর মানবী নেই। এক কালনাগিনী।

লমবার্ড আবার বলে, কেবল তুমি আর আমি।

ভেরা অপাঙ্গে লম্বার্ডের দিকে তাকায়। নিজেকে ধিক্কার দেয় মনে মনে। এই লোকটাকে এত বিশ্বাস করছি কি করে? ওর মুখে ক্রমশই একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠছে। হাসছে, কিন্তু হাসিটা স্বাভাবিক নয়। কেমন পৈশাচিক ছাপ। তা না হলে ওই হাসি শুনে বুক কেঁপে উঠছে যেন?

ভেরার অন্তরাত্মা যেন বলে ওঠে, পালাও। পালাও—

মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে পাল্টে নেয় ভেরা।

চোখের চাউনি স্বাভাবিক হল।

মুখে ফুটে উঠল অপূর্ব লাবণ্য।

বুকে জমে উঠল যেন একরাশ মধু।

কোমল মধুর স্বরে ভেরা এগিয়ে যায় লম্বার্ডের দিকে। মোহিনী দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকায়।

–শোন। স্বেচ্ছায় ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় ভেরা। নিজেকে ধরা দেয়।

যে নারী আপনা থেকে নিজেকে এগিয়ে দেয়, তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে কোন পুরুষ? লমবার্ড দুহাত প্রসারিত করে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয় ভেরাকে। বলে, ডাক্তারের জন্য তোমার দুঃখ হচ্ছে না?

ভেরা প্রণয়িনীর স্বরে জবাব দেয়, হলেই বা কি করা যাবে।

–চলো দুজনে মিলে ওর দেহটা বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাই।

–ওই মৃত্যুপুরীতে?

–হ্যাঁ, মৃত্যুপুরীতে।

–না, ওখানে না।

–তাহলে চলো, জল থেকে একটা পাথরের ওপরে তুলে রাখা যাক।

–তা করা যেতে পারে।

ওরা এগিয়ে যায় জলে ভাসমান মৃতদেহটার দিকে। কিন্তু জলে ভিজে যে মৃতদেহ এমন ভারী হয়ে যায় তা ওদের জানা ছিল না।

লমবার্ডই টেনে পাড়ের দিকে আনল। ভেরা প্রাণপণে তাকে সাহায্য করল।

শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে একটা চড়াই বেয়ে ডাক্তারের মৃতদেহ লমবার্ড টিলার পাথরের কাছে বয়ে নিয়ে এল।

ভেরা, পা পিছলে যাবার ভয়ে সারাক্ষণ লমবার্ডকে জড়িয়ে ধরে রইল।

পাথরটার ফাঁকে ফাঁকে ছোট গাছ। কিছু ফুলও ফুটেছে। সেখানেই ডাক্তারের দেহ শুইয়ে দেওয়া হল।

প্রকৃতির পেতে রাখা বিছানাতেই চিরনিদ্রায় শুয়ে রইলেন ডাক্তার।

 লমবার্ড বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তার চওড়া বুক জোরে জোরে ওঠানামা করছে। কপালে গলার তলায় ঘাম জমেছে।

শেষ বেলার রোদ পড়ে ঘামের বিন্দু চিকচিক করছে।

 রুমাল দিয়ে মুখটা মোছা দরকার। লমবার্ড পকেটে হাত দিতে গিয়ে চমকে ওঠে।

রিভলভার তো পকেটে নেই। সর্বনাশ, পড়ে গেল নাকি জলে?

লমবার্ড ঘুরে দাঁড়ায়। অমনি চোখ পড়ে যায় অদূরে দাঁড়ানো ভেরার দিকে। তার হাতে উদ্যত রিভলভার।

এতক্ষণের মোহিনী আবার কালনাগিনীতে রূপ পাল্টে ফেলেছে। তার বুক ওঠানামা করছে, নিঃশ্বাসে যেন বিষ ছড়াচ্ছে।

চোয়াল দৃঢ় হল লমবার্ডের। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, তোমার ছলাকলার অর্থ এতক্ষণে বোঝা গেল। সত্যিই তুমি অদ্ভুত।

ভেরা কোন জবাব দেয় না। নিশানা অনড়। দৃষ্টি স্থির–লমবার্ডের মুখে। 

লমবার্ড গলার স্বর নরম করবার চেষ্টা করে, ভেরা রিভলভারটা ফিরিয়ে দাও।

–ফিরিয়ে দেব। নিষ্ঠুর হাসির উচ্ছ্বাস জাগে তার কণ্ঠে। কী ভয়ংকর সে হাসি। 

লমবার্ড ফের বলে, পাগলামি করো না, ভেরা। আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পার।

 ভেরা সেই নিষ্ঠুর হাসি হেসে উঠল ফের। তবে উচ্ছ্বাস কিছুটা স্তিমিত।

 গলগল করে ঘাম ঝরছে লম্বার্ডের শরীর বেয়ে। ঠোঁটও শুকিয়ে উঠেছে।

লমবার্ড ভেবে পায় না, কি করে এই উন্মাদ মেয়েটাকে বোঝাবে সে নিরপরাধ? একমাত্র সেই পারে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে।

তবে বুঝতে পারে, মিনতি করে আর কাজ হবে না। এই মেয়ে তার কোন কথা বিশ্বাস করবে না। সে ভাবল, যদি শক্তি প্রয়োগ করে কিছু করা যায়। সে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে।

পলকের জন্য বুঝি অন্যমনস্ক হয়েছিল ভেরা। সঙ্গে সঙ্গে লমবার্ড ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

–দাও রিভলবারটা।

–না

–দ্রুত দুপা পিছিয়ে যায় ভেরা; ট্রিগার টিপে দেয়। একটুও কাঁপে না তার হাত।

অস্ফুট একটা আর্তনাদ।  লমবার্ড মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে।

.

ভেরা তখন নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন। আর ভয়ের কারণ নেই। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। পৃথিবীটা যেন নতুন করে ভাল লাগছে।

ভেরা এখন একা। সারা দ্বীপে দ্বিতীয় কোন মানুষ নেই। আছে কেবল কটা মৃতদেহ।

কিন্তু, না সে আর ফিরে যাবে না। ভেরা এক পা দু পা করে এসে সমুদ্রের ধারে বসে পড়ল। আঃ। কী স্বস্তি।

.

কিছুক্ষণ পরেই সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার ক্রমশ ঘন হচ্ছে। উঠে দাঁড়ায় ভেরা।

একবার তাকায় বাড়িটার দিকে ফিরে। সে মন ঠিক করে নেয়। আর তো কোন ভয় নেই ওখানে। ছোট্ট ঘরটায় গিয়ে সে পরম স্বস্তিতে গা হাত পা এলিয়ে দিতে পারে।

দরজা এঁটে দিলে, সে সম্পূর্ণ একা। ভয়টা কিসের। বরং এই খোলামেলা জায়গাতে থাকতেই গা ছমছম করবে।

এতক্ষণ পরে খিদে অনুভব হয় তার। বুঝতে পারে সে ক্লান্ত। অবসন্ন। খাদ্য না হলেও বিশ্রাম তার দরকার।

ভেরা দূর সমুদ্রের দিকে একবার ফিরে তাকায়। আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে। কাল না হোক পরশু বোট নিশ্চয় আসবে।

যেদিনই বোট আসুক, সে এখন একা, তার কোন ভয় নেই।

ধীর পায়ে সমুদ্রের কাছ থেকে সরে এসে ভেরা একতলার বারান্দায় উঠে আসে। খাবার ঘরে ঢোকে। তাকিয়ে দেখে তিনটে পুতুল রয়েছে।

ভেরা এগিয়ে যায় সেদিকে। তিনটে কেন থাকবে–থাকবার তো কথা একটা। সবাই তো মৃত, বেঁচে আছে কেবল সে একা।

ভেরা আপন মনে বলে উঠল, তোরা শেষের হিসেব মেলাতে পারিসনি। থাকবে ওখানে একটা।

হাত বাড়িয়ে দুটো পুতুল তুলে নেয় সে। ছুঁড়ে ফেলে দেয় জানালা দিয়ে।

শেষ পুতুলটাকেও তুলে নেয় সে।

অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল ভেরা। পুতুলটাকে আদর করে গালে ছোঁয়াল, চুমু খেলো। তারপর বুকে চেপে ধরে গভীর নিঃশ্বাস নিল।

–চল আমার সঙ্গে।

ভেরা পুতুলটাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায়। ঘর খোলে, আবছা আলো। কোণে কোণে অন্ধকার। কাকে দেখতে পাচ্ছে ভেরা? কে? হুগো? লমবার্ড?

ভেরা চেঁচিয়ে ওঠে, কে–কে

সামনেই একটা দড়ি ঝুলছে। তলায় ফাস। তার নিচে একটা চেয়ার।

কি মনে করে ভেরা এগিয়ে যায় চেয়ারটার দিকে। উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ফাঁসটা গলায় পরে নেয়।

অকস্মাৎ খিল খিল করে হেসে ওঠে সে। উন্মাদ হয়ে হাসতে থাকে। চেয়ারটা হঠাৎ পায়ের কাছ থেকে সরে যায়।

পুতুলটা হাতেই ধরা ছিল। সেটা ছিটকে মেঝেয় পড়ে ভেঙ্গে যায়। শেষ পুতুল ছিল ওটা।

.

স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রধান কার্যালয়। কথা বলছেন দুজন। স্যার টমাস লেগ এবং ইনসপেক্টর মেন। টমাস হলেন সহকারী কমিশনার।

টমাস বললেন, একটা অবাস্তব ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। পরপর দশজন লোক মারা গেল একটা দ্বীপে, অথচ মৃতদেহ ছাড়া কোন জীবিত লোক সেখানে ছিল না। জবরদস্ত মাথাওয়ালা কোন মানুষের হাত ছিল এই কাণ্ডের পেছনে, তাতে সন্দেহ নেই।

মেন মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল, স্যার আমিও আপনার সঙ্গে একমত।

টমাস জানতে চান, ডাক্তারের রিপোর্ট থেকে কোন সূত্র পাওয়া গেছে?

–না স্যার।

এরপর মেন কেন কিভাবে কাকে হত্যা করা হয়েছে তার বিবরণ দেন।

ওয়ারগ্রেভ এবং  লমবার্ডকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গুলি লেগেছে একজনের মাথায়, অপরজনের বুকে।

বিষের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে দুজনকে। তারা হলেন মিস ব্রেনট এমিলি এবং মার্সটন।

রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নিলেন মেন। পরে বললেন, বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে মারা গেছে রজার্সের স্ত্রী। তার স্বামীর মৃত্যু ঘটে কুঠারের আঘাতে।

বিবরণ শুনতে শুনতে স্যার টমাস নড়েচড়ে বসেন। বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে ওঠে তার।

মেন বলে চলেন, ডগলাসের মাথার খুলি ভেঙ্গে গেছে। কোন ধারালো জিনিস দিয়ে তাকে পেছন থেকে আঘাত করা হয়েছিল। ভেরা ক্লেথর্নকে মৃত অবস্থায় কঁসির রজ্জুতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।

–আচ্ছা, ডেভনের সমুদ্রতীরের লোকেরা কি বলছে? টমাসের কপালে চিন্তার রেখা পড়ে।

–স্যার, ওরা কিছু জানে না। তাদের কাছ থেকে কেবল জানা গেছে, আওয়েন বলে এক ভদ্রলোক দ্বীপটার মালিক।

–তা, বেশ। দ্বীপটা কেনার পর সাজগোজের কাজ তো করতে হয়েছে? সেসব কে করেছিল?

–আকজাগ মরিস নামে একজন লোক।

এ সম্পর্কে তার কাছ থেকে কিছু জানা গেছে?

–উপায় ছিল না।

–মানে?

–সে মারা গেছে।

 –তার সম্বন্ধে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছিল?

–হ্যাঁ স্যার। লোকটা চোরাই কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে কখনো ধরা যায়নি।

-এই মরিস লোকটা কেবল কি ওসবই করত?

–না স্যার। এমনিতে ঠিকাদারি কাজ করত। তবে ওটা ছিল তার বাইরেকার খোলস।

–মরিস শেষ কবে ডেভান গিয়েছিল?

–এই হত্যাকাণ্ডের আগেই গিয়েছিল। স্থানীয় লোকজনদের সে বুঝিয়ে এসেছিল, মিঃ আওয়েনের কিছু বন্ধু এখানে এসে কিছুদিন থাকবেন। মিঃ আওয়েনের সঙ্গে তারা বাজি ধরেছেন, পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কিছুদিন বাস করা চলে। কাজেই দু-চারদিনের মধ্যে ওই দ্বীপ থেকে কোন সংকেত এলেও কিছু করার দরকার নেই। তারপর ওদের ব্যবস্থা মিঃ আওয়েনই করবেন।

–এসব কথা ওরা বিশ্বাস করেছিল?

–কেউ কিছু সন্দেহ করেনি স্যার। ভেবেছে এসব বড়লোকদের খেয়াল। আওয়েনের আগে যিনি ওই দ্বীপটার মালিক ছিলেন তিনিও প্রায়ই ওখানে পার্টি দিতেন। এক্ষেত্রেও তাই তারা সন্দেহ করার মত কিছু পায়নি।

একটু থেমে মেন ফের বললেন, যে লোকটা ওদের বোটে করে পৌঁছে দিয়েছিল তার কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল।

সে বলেছে, আগে যারা পার্টিতে আসত তারা ছিল পরস্পরের পরিচিত। কিন্তু এবারে যারা গিয়েছিল তারা একে অপরকে চিনত না। আর সকলেই অনেকটা শান্ত প্রকৃতির।

–ও কিছু করেছিল?

–দিন কয়েক পরে ওই দ্বীপ থেকে সাহায্য সংকেত পাওয়া যায়। তখন সে লোকজন জড়ো করে ওখানে উপস্থিত হয়। আর তার ফলেই আমরা এই লোমহর্ষক ঘটনাটি জানতে পারি।

–সাহায্য-সংকেত কবে পাওয়া গিয়েছিল?

–১৩ তারিখেই পেয়ে ছিল। কিন্তু সমুদ্র অশান্ত থাকায় সেদিন যেতে পারেনি। পরদিন সকালে আবার সংকেত পাওয়া যায়। সাহায্যকারীরা বিকেলে সেখানে গিয়েছিল।

-এই দলটা এখানে পৌঁছনোর আগেই হত্যাকারী সাঁতরে ডেভনে পৌঁছে পালিয়ে গেছে কিনা খবর নেওয়া হয়েছিল?

-সাঁতরে পালানো অসম্ভব ছিল স্যার। কেননা সমুদ্র ছিল অশান্ত।

 টমাসের মুখ ক্রমশই গম্ভীর হয়ে পড়ছিল। খানিকক্ষণ তিনি চুপ করে থেকে কি ভাবলেন। পরে বললেন, ওই গ্রামাফোনের ব্যাপারে কিছু জানা সম্ভব হয়েছে?

-হ্যাঁ স্যার।

–ওটা কিভাবে করা হয়েছিল?

করিয়েছিল মরিস। সিনেমা-থিয়েটারের কাজ করে এমন একটা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে।

-ওই রেকর্ডে যে অপরাধগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছিল?

–হ্যাঁ স্যার। রজার্স দম্পতি মিসেস ব্র্যাডি নামে এক ভদ্রমহিলার বাড়ি কাজ করতো। ওদের অবহেলাতেই নাকি তিনি মারা যান।

–এরপর আছে বিচারপতি ওয়ারগ্রেভের নাম।

-হ্যাঁ ওই নামটা আমি সেটন মামলায় শুনেছি। সে লোকটা দোষ করেছিল ঠিকই, তবে … যাক তারপর?

–ভেরা নামে একটি মেয়ে একবাড়িতে গভর্নেসের কাজ করতো। সেই বাড়ির ছোট্ট ছেলেটি সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায়। তাতে ভেরার কোন হাত ছিল না। মেয়েটি নিজের জীবন বিপন্ন করে তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল। মেয়েটিকে ওই বাড়ির সকলেই ভালবাসতো।

-তারপর?

ডাঃ আরমস্ট্রং-এর কথা বলছি। তার চেম্বার ছিল হার্লে স্ট্রীটে। মাঝারি বয়েস। তবে পসার জমেছিল ভাল।

তারই চেম্বারে অপারেশন টেবিলে একটি মেয়ে মারা যায়। তাতে অবশ্য ডাক্তারের কোন হাত ছিল না। সার্জেনদের হাতে এমন দু-চারটে কেসতো ঘটেই।

এরপর স্যার মিস এমিলি ব্রেনটের কথা বলছি। তার বাড়িতে কাজ করত অবিবাহিতা একটি মেয়ে। বিয়াত্রিচে টেলর তার নাম।

বিয়ের আগেই মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়েছিল। একথা জানতে পেরে গৃহকর্ত্রী তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। পরে মেয়েটি আত্মহত্যা করে।

মেয়েটিকে এই অবস্থায় তাড়িয়ে দেওয়াটা অমানবিক কাজ হয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আইনের চোখে মিস এমিলি কোন অপরাধ ওখানেই।

–যা দেখছি, তোমার ওই আওয়েন খুঁজে খুঁজে এমন কয়েকটি কেস বার করেছিল যারা আইনের চোখে অপরাধী হয়নি। মনে হচ্ছে, রহস্যের মূল সূত্রটা করেননি।

মেন আবার তার তালিকা থেকে বলতে শুরু করলেন, মাস্টান বলে যে ভদ্রলোক, তিনি জোরে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুটো বাচ্চাকে চাপা দিয়েছিলেন। সেজন্য অবশ্য তাকে অর্থদন্ড দিতে হয়েছিল।

এরপর হল জেনারেল ডগলাস। তার সার্ভিস রের্কড খুব ভাল। তার অধীনে কাজ করতে রিচমন্ড–সে একজন অফিসার। ফ্রান্সের যুদ্ধে সে মারা যায়। জেনারেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল খুব ভাল। যুদ্ধক্ষেত্রে তো কমান্ডিং অফিসারদের ভুলে অনেক প্রাণহানী ঘটে থাকে। রিচমন্ডের মৃত্যুও ছিল এমন একটা ঘটনা।

-হ্যাঁ, খুবই সম্ভব।

–এরপরে হল ব্লোর, সে এককালে পুলিসে কাজ করত।

–হ্যাঁ ওকে আমি চিনতাম, টমাস বলেন, খুব একটা কাজের ছিল না। তবে কায়দাকানুন করে কয়েকটা প্রমোশন বাগিয়েছিল। একটা রিপোর্টে খুব গোলমাল করে ফেলেছিল–ল্যান্ডুর কেস। তার ওপরেই তদারকির দায়িত্ব ছিল।

অনেকের ধারণা তদন্তে ফাঁক রেখেছিল ইচ্ছে করেই। যোগ্যতাও তো তেমন ছিল না। বেশ, তারপর বলে দাও।

মেন বলতে শুরু করল, পরের নামটি হল, ফিলিপ লমবার্ড। ডাকাবুকো ধরনের লোক ছিল। অনেক দেশ ঘুরেও ছিল। তবে কোন বেআইনী কাজের রিপোের্ট নেই।

-আচ্ছা, সেই মরিস লোকটা তো মারা গেছে বললে, তাই না?

–হ্যাঁ, স্যার। গত ৮ই আগস্ট। বেশি মাত্রায় ওষুধ খেয়েছিল।

–সেটা কি আত্মহত্যা?

–সেটা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।

টমাস গভীর স্বরে বললেন,ব্যাপারটা তো খুব জটিল দেখতে পাচ্ছি। একজন দুজন নয়, দশ-দশটা লোক খুন হল, অথচ কে তাদের খুন করল, কেন করল, সেসব কিছুই জানা যাচ্ছে না-ভারী আশ্চর্য ব্যাপার।

–স্যার, একটা কথা বলতে চাই

–স্বচ্ছন্দে,

–কে এই হত্যাকান্ডের নায়ক তা জানা না গেলেও হত্যার কারণটা অনুমান করা যায়। গ্রামাফোন রেকর্ডের কথা, নিহত ব্যক্তিদের নামধাম ইত্যাদি পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে, কোন এক ব্যক্তির মাথায় ন্যায় বিচার সম্পর্কে বাতিক চেপেছিল। তার সঙ্গে মিশেছিল জিঘাংসা বৃত্তি। কিছু কিছু লোকের অপরাদের কথা সে জানত অথচ আইনের চোখে তারা অপরাধী প্রতিপন্ন হয়নি। সেই থেকেই সে ঠিক করে নিয়েছিল নিজেই ঈশ্বর সাজবে। এ একধরনের পাগলামোও বলা চলে।

খুঁজে খুঁজে এমনি দশজনের নাম সে সংগ্রহ করেছিল, আইন যাদের শাস্তি দিতে পারেননি তবে এই দশজন সত্যিকারের অপরাধী কিনা, তা বিচার সাপেক্ষ।

-এবার মনে হয় রহস্যের সূত্রটা পাওয়া যাচ্ছে । হুঁ, তারপর?

–আওয়েন স্থির করেছিল, এই দশজন লোককে প্রাণদন্ড দেবে। তারপর সুপরিকল্পিতভাবে ওদের পান্না দ্বীপে এনে একে একে হত্যা করে উধাও হয়ে যায়।

–কিন্তু আওয়েন পালালো কিভাবে?

–এই ক্ষেত্রে আমরা দুটো সিদ্ধান্তে আসতে পারি।

–যেমন–

–হয় আওয়েন আদৌ দ্বীপে অনুপস্থিত ছিল, নয়তো নিহত দশজনের মধ্যে সে নিজেও একজন।

ওই দ্বীপে কি হয়েছিল, তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে অনেকেরই টুকটাক লেখা বা ডায়েরি পাওয়া গেছে। ভেরা, এমিলি ওয়ারগ্রেভ এবং ব্লোর এর বিভিন্ন লেখার মধ্যে কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

সেই অনুযায়ী মৃত্যুগুলো পরপর এভাবে ঘটে–মার্সটন, রজার্সের স্ত্রী, জেনারেল ডগলাস রজার্স, এমিলি ব্রেনট এবং ওয়ারগ্রেভ।

মেন একটু থামল। মাথা নত করে কি ভাবল। পরক্ষণে বলল ভেরা তার ডায়েরিতে লিখেছে, ডাক্তারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লমবার্ড আর বোর সেই রাতে তাকে খুঁজতে বের হয়।

ব্লোরও তার নোটবইতে লিখেছে, ডাক্তার নিরুদ্দেশ। এরপর এসম্পর্কে কেউ আর কোন কথা লেখেননি।

এখন স্যার, ডাক্তার যে এই তিনজনকে হত্যা করে নিজে জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে তা বলা যাবে না। কেন না, ডাক্তারকে জল থেকে তুলে আনা হয়েছে এবং টিলার ওপরে রাখা হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে কেউ তখনো বেঁচেছিল।

ব্লোর আর ভেরাকে হত্যা করার পর লমবার্ড আত্মহত্যা করেছে–এরকম ভাবাও সম্ভব হচ্ছে না কারণ তাহলে রিভলভারটা তার কাছে পাওয়া যেত। সেটা পাওয়া গেছে ওয়ারগ্রেভের ঘরে।

-আচ্ছা, সেটাতে কোন ছাপ পাওয়া গেছে?

হা স্যার, ভেরার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।

–গন্ডগোল তো মিটছে না দেখছি।

–গন্ডগোল আরও একক্ষেত্রেও পাওয়া যাচ্ছে। যদি ধরা যায় ভেরা লমবার্ডকে গুলি করে হত্যা করার পর ব্লোরকে পাথর ছুঁড়ে নিহত করেছে। কিন্তু তার পরই সূত্র ছিঁড়ে যাচ্ছে।

ভেরার পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে একটা চেয়ারে অথচ সে চেয়ারটা তার পায়ের নিচে ছিল না। চেয়ারটা পাওয়া গেছে ঘরের এক কোণে।

–এ কী করে সম্ভব?

–আমারও জিজ্ঞাসা সেটাই। যাই হোক, সবশেষে ব্লোরের কথা বলছি। যদি ধরে নিই সে  লমবার্ডকে গুলি করে হত্যা করে এবং পরে ভেরাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে নিজে আত্মহত্যা করেছে, তাহলে গোলমাল থাকছে।

–কি রকম?

–সে মারা গেছে একটা পাথরের আঘাতে, সেটা ছুঁড়ে মারা হয়েছিল পেছন দিক থেকে। তাহলে পাথরটা কে ছুঁড়ে মারল?

-হ্যাঁ, ঠিক কথা।

–সব মিলিয়ে ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে এরকম, আওয়েন দশজনকে হত্যা করে নিজে ওই দ্বীপে ছিল। তারপর তার আর কোন হদিশ পাওয়া যায়নি। ডেভনের লোকদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রথম, সাহায্য-সঙ্কেত পাবার পর থেকে উদ্ধারকারী দল পৌঁছবার আগে পর্যন্ত ওখান থেকে পালায়নি।

এই পরিস্থিতিতে পান্না দ্বীপের মৃত্যু-রহস্যের সমাধান আদৌ সম্ভব নয়। এই ঘটনা রহস্যাবৃতই থেকে যাবে।

-আমিও ভেবে পাচ্ছি না, কে এই রহস্যের নায়ক?

.

গ্রন্থিমোচন

 একটা মাছধরার জালে মাছের সঙ্গে একটা কাচের বোতল পাওয়া গিয়েছিল। বোতলের ছিপি খুলে তার মধ্যে একটা লেখা পাওয়া গিয়েছিল। জাহাজের মালিক সেই লেখা কাগজ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়। নিচে সেই লেখাটা দেওয়া হল।

.

আমার এই স্বীকারোক্তি সমুদ্রে ভাসিয়ে দিচ্ছি। যদি এটা কারোর হাতে পড়ে ভাল নইলে হয়তো ঢেউয়ের ধাক্কায় পাথরে লেগে ভেঙ্গে সমুদ্রে ভেসে যাবে।

অবশ্য তাহলে মন্দ হয় না।

ছেলেবেলা থেকেই একটা নিষ্ঠুরতা আমার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল। অকারণে পোকামাকড়দের কষ্ট দিতে আমার ভাল লাগত।

বড় হয়ে এই ভাবটার প্রকাশভঙ্গী পাল্টে ছিল। তখন আমার মধ্যে সজাগ হয়েছে। ন্যায়বোধ। ভাল এবং মন্দকে বিচার করতে শিখেছি।

নিরপরাধ পেত সহানুভূতি। আর অপরাধীর প্রতি হতাম নির্দয়। ছেলেবেলার নিষ্ঠুরতা বা জিঘাংসা মিশে থাকত এই নির্দয়তার মধ্যে।

ভাগ্যক্রমে, ন্যায়নীতি এবং দণ্ডনীতি দুই সমানভাবে প্রয়োগ করবার অধিকার আমি পেয়ে গিয়েছিলাম, অর্থাৎ আমার হাতে ছিল বিচারের দণ্ড! আমার যাবতীয় কার্যকলাপ ছিল আইনের আঙিনাকে ঘিরে।

আইনশাস্ত্র সম্পর্কে আমার গভীর জ্ঞানের প্রশংসা সকলে করলেও, অনেকে নিষ্ঠুর জজ বলেও কটাক্ষ করত আমাকে। কথাটার মধ্যে অবশ্যই সভ্যতা ছিল। কোন নিরপরাধী আমার কাছে কখনো সাজা পায়নি।

তার বিরুদ্ধে যত প্রমাণই দাঁড় করানো হোক না কেন, আইনের সূক্ষ্মবিচারে তাকে আমি মুক্ত করে এনেছি।

আবার প্রকৃত অপরাধী, আমার হাতে কখনো রেহাই পায়নি। আমি তার উপযুক্ত দণ্ডবিধান করেছিনের মামলারভাবে বেকসুর খাল

সেটনের মামলাটার কথাই ধরা যাক। সে নিজে তার বক্তব্য সুন্দরভাবে পেশ করেছিল। তার কৌসুলীও সুন্দরভাবে কেস সাজিয়ে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছে। সকলেরই ধারণা ছিল সেটন বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে।

কিন্তু আইনের চুলচেরা বিচারে আমি তাকে চরম সাজা দিয়েছি। প্রথমে এই মামলা নিয়ে কিছু সমালোচনা হলেও পরে এই মামলা ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে উৎকৃষ্ট বিচারের নিদর্শন হিসেবে।

একসময় এজলাস থেকে অবসর নিলাম। এদিকে স্বাস্থ্যও ভাল যাচ্ছিল না। বুঝতে পারছিলাম আমার সময় ফুরিয়ে আসছে।

একদিন এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি কথা প্রসঙ্গে জানালেন, অনেক মানুষই এমন কিছু অপরাধ করে, আইন তাকে সেজন্য সাজা দিতে পারে না, তখনই তিনি রজার্স দম্পতির ঘটনাটা বললেন।

এক ভদ্রমহিলার বাড়িতে তারা কাজ করতো। ওরা তার সেবা-যত্ন করত। সেই মহিলা। কৃতজ্ঞতার বশে ওদের নামে উইল করে গেছেন, রজার্স দম্পতি তা জানতে পেরেছিল।

স্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারটা অনিশ্চিত। এতদিন তারা অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। সুযোগের অপেক্ষায় রইল।

ভদ্রমহিলা অসুস্থ হলে তাকে বিশেষ ধরনের একটা ওষুধ খাওয়াতে হতো। একবার অসুস্থতার সময়ে তারা তাকে তা খাওয়ালো না। ফলে তিনি মারা যান।

রজার্স দম্পতির অপরাধ কিন্তু লোকে বুঝতে পারল না। ওরা ব্যস্তভাবে ডাক্তারের কাছে ছুটোছুটি করেছে, তাদের ব্যাকুলতা, কান্না ইত্যাদি দেখে কেউই তাদের সন্দেহ করতে পারল না।

এই ঘটনা শোনার পর আমার ভেতরের নীতিবোধ এবং জিঘাংসা প্রবৃত্তি একই সঙ্গে যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

ঠিক করলাম, আইন যাদের সাজা দিতে পারেনি, আমি এমন লোকদের খুঁজে বার করবো। নিজের হাতেই তাদের শাস্তিবিধান করব।

পদমর্যাদায় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠায় গণ্যমান্য এমন বহুলোকের সঙ্গেই আমার আলাপ-পরিচয় ছিল। তাদের কাছ থেকে গোটা দশেক ঘটনা আমি বার করে নিলাম।

কি করে এই ঘটনাগুলো সংগ্রহ করলাম তা বোঝাবার জন্য দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

একদিন এক প্রৌঢ়া নার্সের সঙ্গে মদ্যপানের অপকারিতা বিষয়ে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি এক ডাক্তারের কথা জানালেন।

এই ভদ্রলোক একদিন মদ্যপ অবস্থায় এক রোগীকে অপারেশন করেন। অপারেশনের ত্রুটির জন্য রুগীটি মারা যায়।

ভদ্রমহিলা অসতর্ক মুহূর্তে সেই ডাক্তারের পরিচয় প্রকাশ করে ফেলেন। সেই ডাক্তারই হলেন আরমস্ট্রং। তার চেম্বার হার্লে স্ট্রিটে।

একদিন এক ক্লাবে দুই ফৌজি অফিসারের সঙ্গে আলাপ হয়। তাদের কাছ থেকে জেনারেল ডগলাসের কাহিনী জানতে পারি।

এক প্রাক্তন সহকর্মী জানিয়েছিলেন ফিলিপ লমবার্ডের কাহিনী।

ব্রেনট এমিলি ছিলেন নীতিবাগিশ মহিলা। সেই জন্য অন্তঃসত্ত্বা বিয়াত্রিচে টেলারকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেননি।

আমাদের সমাজে এমন বহু ধনী ব্যক্তি রয়েছেন যারা অর্থের জোরে যা কিছু করে বেড়ান। আইন বা নীতির তোয়াক্কা করেন না।

এমনি একজন হলেন অ্যান্টনি মার্সটন। এদের কাছে সাধারণ মানুষের মূল্য কানাকড়িও নয়।

কাজে বা দায়িত্বে অবহেলাকে আমি গুরুতর অপরাধ মনে না করে পারি না। আমি তাদের ক্ষমা করতে পারি না। ল্যাণ্ডর মামলা প্রসঙ্গে এমন একজনের নাম শুনেছিলাম, তিনি হলেন পুলিস ইনসপেক্টর ব্লোর।

একবার আমেরিকা যাবার পথে জাহাজে আলাপ হয়েছিল ভেরার প্রেমিক হুগোর সঙ্গে। সে একটু বেশি মদ খেয়ে ফেলেছিল, সেই অবস্থায় ভেরার সবকথা আমাকে জানায়। ভেরাকে। সে আজো ভালবাসে। কিন্তু তার অপরাধকে কোনদিনই ক্ষমা করতে পারবে না।

আমার তালিকার দশম অপরাধী হল মরিস। সে নানাপ্রকার নিষিদ্ধ কাজ করত। চোরাইমালের কাজটাই প্রধান।

লোকের চোখে ফাঁকি দেবার জন্য ঠিকাদারির আড়াল নিয়েছিল। পুলিস সঠিক প্রমাণের অভাবে তাকে কোনদিন ধরতে পারেনি।

নামগুলো সংগ্রহ হবার পর, একটা পরিচ্ছন্ন পরিকল্পনা ছকে ফেললাম। সেই মত পান্না দ্বীপটা কিনে ফেললাম। তারপর মরিসকে দিয়ে সাজানো-গোছানোর কাজটাও করিয়ে নিলাম। এরপর হাত দিলাম আসল কাজে। অনেক ভেবেচিন্তে সুকৌশলে ওদের দশজনকে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করে ফেললাম। ওরা সকলে রাজি হবে কিনা, এব্যাপারে আশঙ্কা ছিল। তা দূর হল ওদের সায় পেয়ে।

প্রথম ধাপে সফল হওয়ায় বেশ স্বস্তিবোধ করলাম।

পান্না দ্বীপে একই দিনে অর্থাৎ ৮ই আগস্ট হাজির হবার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এই দলে আমিও ছিলাম।

হাতের কাছেই ছিল মরিস, আইনের চোখে ফাঁকি-দেওয়া অপরাধী। পান্না দ্বীপে যাবার আগে তার ব্যবস্থাটা করতে হল।

পান্না দ্বীপে যাবার আগের দিন মরিস আমার কাছে এসেছিল। আমি জানতাম সে প্রায়ই বদহজমে ভোগে।

তার অতিশয় কুশলকামী আমি, এমন ভান করতে হল আমাকে। জানালাম, আমি যে ওষুধ খেয়ে বদহজমের রোগমুক্ত হয়েছি, সেটা খেলে সে-ও উপকার পেতে পারে।

আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে ওষুধের নামটা লিখে দেবার জন্য অনুরোধ জানাল।

আমি আগেই তার জন্য একটা কড়া ঘুমের ক্যাপসুল কিনে এনে রেখেছিলাম। ড্রয়ার হাতড়ে সেটা বার করে তার হাতে দিয়ে ভাল মানুষের মত জানালাম, একটা আমার কাছে ছিল, এটা সে খেতে পারে।

রাতে শুতে যাবার আগে ক্যাপসুলটা খেতে হবে সে-কথাও মরিসকে জানিয়ে দিলাম।

আমি জানি সে আমার নির্দেশমতোই ক্যাপসুলটা খেয়েছিল এবং সে-রাতের ঘুমই তার শেষ ঘুম হয়েছিল।

পান্না দ্বীপে যাবার পর ঠিক করলাম যাদের অপরাধ গুরুতর, তাদেরই আগে সরিয়ে দিতে হবে। আর মৃত্যুর আগে যাতে ভয় ও মানসিক যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত হয়, সে ব্যবস্থাও করতে হবে।

মার্সটন টাকার গরমে তার অপরাধের কথা ভুলে থাকবার চেষ্টা করত। তাই প্রথমেই গেল সে।

এরপর গেল রজার্সের স্ত্রী। যদিও স্বামীর নির্দেশেই সে সবকিছু করতে বাধ্য হয়েছিল।

রজার্সের স্ত্রী ও মার্সটনের মৃত্যুযন্ত্রণা কম ছিল।

গ্রামোফোন রেকর্ড চলবার সময় সকলে যখন অন্যমনস্ক বিভ্রান্ত অবস্থায় ছিল, সেই সময় মার্সটনের পানপাত্রে সায়ানাইড মিশিয়ে দিলাম। চুমুক দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হল।

গ্রামোফোনের অভিযোগ শুনে রজার্সের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য ব্র্যাণ্ডি নিয়ে আসে রজার্স। সকলের অলক্ষ্যে তাতে বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলাম।

তখনো পর্যন্ত মৃত্যুর ব্যাপারে কারো মনে তেমন বিভীষিকা জাগেনি। কাজেই কেউই কিছু সন্দেহ করতে পারল না।

জেনারেল ডগলাসের মৃত্যুটাও আকস্মিকভাবে ঘটিয়েছিলাম, তিনি বিশেষ কষ্ট পাননি। সমুদ্রতীরে আমি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কিছুই টের পাননি। বারান্দা থেকে সতর্কভাবেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম, অন্যরা কেউ বুঝতেই পারেনি।

দ্রুতহাতে কাজটা শেষ করেই আবার বারান্দায় ফিরে এসেছিলাম।

১০ই আগস্ট সকালে অভ্যাসমত দাড়ি কামিয়ে রজার্স নিচে গিয়ে রান্নাঘরের কাজে হাত লাগায়। কাঠ দরকার হওয়ায় কাটারী দিয়ে কিছু কাঠ কাটল। সেই সময় নিঃশব্দে পেছন থেকে গিয়ে কুঠারের এক আঘাতে তাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।

সকলে যখন রজার্সের খোঁজে ছুটোছুটি করছে, আমি কঁক বুঝে লম্বার্ডের ঘরে গিয়ে তার রিভলবারটা নিয়ে এলাম। সেটা কোথায় রাখতো আমি জানতাম।

প্রাতরাশের টেবিলে এমিলির কফিতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। খুব সাবধানতার সঙ্গে একাজটা আমাকে করতে হয়েছিল।

কফি পান করেই তিনি আধা অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সেই অবস্থায় তাকে একলা পেয়ে ইনজেকশন দিয়ে তার শরীরে কড়া সায়ানাইড সলিউশন ঢুকিয়ে দিলাম।

এই ঘটনাকে অন্যরূপ দেবার উদ্দেশ্যে আমাকে দুটো মৌমাছির সাহায্য নিতে হয়েছিল। এব্যবস্থা আমি আগেই করে রেখেছিলাম।

এতগুলো মৃত্যুর পর পরামর্শের ছলে সকলের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিলাম। আমার আমন্ত্রিত অতিথিরা পরস্পরকে সন্দেহ করতে শুরু করল।

এই সূত্রেই ঘর তল্লাশী হল। রজার্সের রিভলভার পাওয়া গেল না। সেটা যাতে খুঁজে পাওয়া না যায় সেজন্য আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম নতুন বিস্কুটের টিনের মধ্যে। লেবেল লাগানো ছিল বলে কেউ সেদিকে ফিরেও তাকায়নি।

এরপর এই হত্যা-নাটকের এক বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা করলাম।

ডাক্তারের মনোভাব আমি জানতাম। পরপর কয়েকটা ঘটনায় তার ভূমিকা অনেকেরই সন্দেহ উদ্রেক করেছিল।

সেই অবস্থায় তাকে জানালাম হত্যাকারীকে ধরার জন্য একটা পরিকল্পনা করেছি, তার সাহায্য আমার দরকার।

ডাক্তার এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তখন তাকে জানালাম, পর পর মৃত্যুর ঘটনাতো ঘটেই চলেছে। এরপর আমি মারা গেছি এমন ভাবে পড়ে থাকব। কেউ সন্দেহ করবে না। আপনি আমাকে পরীক্ষা করে মৃত বলে ঘোষণা করবেন। আপনি বললে আর কেউ সন্দেহ করবে না।

তিনি কিছুমাত্র সন্দেহ করলেন না। তাকে তখন পরিকল্পনাটা খুলে জানালাম।

পরিকল্পনা মত সেদিন সন্ধ্যায় আলো জ্বলল না। মোমবাতি জ্বালানো হল। ভেরাকে ওপরতলায় ভয় দেখাবার ব্যবস্থা করে রাখা ছিল। সে চেঁচামেচি জুড়তেই সকলে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আমি সেই সময় আমার ঘরে গিয়ে মরার ভান করে পড়ে রইলাম। যথারীতি ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করে মৃত বলে ঘোষণা করলেন।

সেই রাতেই দুটোর সময় চুপিচুপি ডেকে ডাক্তারকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেলাম। জরুরী পরামর্শ আছে বলে তাকে সমুদ্রের ধারে টিলার আড়ালে নিয়ে গেলাম।

সেখানে আলোচনার ফাঁকে সজোরে ধাক্কা মেরে ডাক্তারকে টিলার ওপর থেকে নিচে ফেলে দিলাম।

বাড়িতে ফিরে এসে ফের ডাক্তারের ঘরে গেলাম। বেরুবার সময় একটু শব্দ করলাম ইচ্ছে করেই।

ব্লোর ভাবল, ডাক্তার বাইরে গেলেন। আমি সিঁড়ির তলায় লুকিয়ে পড়েছিলাম। ব্লোর আর  লমবার্ড যখন ডাক্তারকে খুঁজতে বাইরে গেল, আমি ফের আমার ঘরে গিয়ে মৃতের ভূমিকা গ্রহণ করি।

তার আগে অবশ্য লম্বার্ডের ঘরের ড্রয়ারে তার রিভলভারটা রেখে আসি।

এরপর বাকি রইল তিনজন। ভেরা,  লমবার্ড এবং ব্লোর। এদের তিনজনের মনেই ভয় আতঙ্ক, অবিশ্বাস।

ভেরা আর  লমবার্ড বাড়িতে যেতে চাইল না। ব্লোর একাই ফিরে গেল।

আমি পাথর নিয়ে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কাছাকাছি আসতেই ছুঁড়ে মারলাম। বুড়ো বয়সেও নিশানা এতটুকু ফসকায়নি, আশ্চর্য। ব্লোর শেষ হয়ে গেল।

এরপর আমার চোখের সামনেই বুদ্ধিমতী ভেরা লমবার্ডকে গুলি করে মারল। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তীব্র হয়ে উঠেছিল।

এবারে ভেরা একা হয়ে গেল। সমস্ত দ্বীপে সে একা জীবিত মানুষ।

তার একমাত্র প্রতিবেশী কতগুলো মৃতদেহ। এই পরিস্থিতি এবং তার নিজের মনের পাপ-হুঁগোর প্রতি প্রতারণা, হুগোর ভাইপোর হত্যা এবং সর্বশেষ লমবার্ডকে হত্যা–সব মিলেমিশে তার মনের ওপর প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল।

শেষ দৃশ্যটা পরিকল্পনা মত সাজিয়ে রেখেছিলাম। ভেরা প্রত্যাশিতভাবেই আত্মহত্যায় প্রবৃত্ত হল। আমি তার পায়ের নিচ থেকে চেয়ারটা নিয়ে দেয়ালের কাছে সরিয়ে রাখলাম।

.

আমার এই স্বীকারোক্তি কাচের বোতলে ভরে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। বোতলের মুখ ছিপি আটকে সীল করে দেব।

গতকালই ওরা তিনজন, লমবার্ড, ভেরা আর ব্লোর দ্বীপ থেকে সাহায্য সঙ্কেত পাঠিয়েছিল। উপকূল থেকে সাহায্যকারী দল চলে আসার আগেই আমাকে বাকি কাজটুকু শেষ করতে হবে।

আমার পঁসিনে চশমার কর্ডটা সাধারণ সুতো নয়। ইলাস্টিক। এই কর্ডটা যাতে বাইরে থাকে সেভাবে চশমাটা শক্ত খাপে ভরে রাখতে হবে।

আমার বিছানা থেকে দরজার দূরত্ব খুবই সামান্য। দরজার হাতলের সঙ্গে কার্ডটা অলতোভাবে লাগানো থাকবে।

আমি বিছানায় গিয়ে শোব। চশমার খাপটা রাখব আমার পায়ের তলায়। আর ইলাস্টিক কর্ডটার সঙ্গে রিভলবারটা বেঁধে নেবো।

রিভলভারে রয়েছে ভেরার হাতের ছাপ। রুমাল জড়িয়ে ওটা ধরব। তারপর মাথা লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপে দেব।

যে ঘটনাটা ঘটবে তা দাঁড়াবে এরকম–আমার হাত এলিয়ে পড়বে। সেই ঝাঁকুনিতে দরজার হাতল থেকে কর্ডটা খসে পড়বে, আর কর্ডের টানে রিভলভার ছিটকে দরজার কাছে গিয়ে পড়বে, রুমালটা খাটের কাছাকাছি পড়ে থাকব।

নিখুঁত শিল্পসম্মত একটা মৃত্যু। এটা যে একটা আত্মহত্যার ঘটনা তা কেউই বুঝতে পারবে না।

আমার মৃত্যুর যে বিবরণ ভেরা এবং আরো কজনের ডায়েরীতে লেখা আছে, তার সঙ্গে এই মৃত্যুর কোন অমিল থাকবে না।

পুলিস যথেষ্ট বিলম্বেই সজাগ হবার সুযোগ পাবে। কিন্তু তারা কি পান্না দ্বীপের হত্যা রহস্যের কোন কিনারা করতে পারবে?

তবে একটা সূত্র তাদের জন্য রয়েছে। যে দশজন লোক এই দ্বীপে এসেছিল, তাদের মধ্যে, একজন ছিল সম্পূর্ণ নিরপরাধ। আর সেই হল বাকি নজনের হত্যার নায়ক।

এই কথায় কোন মিথ্যা নেই। অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।

উদ্ধারকারী দল এবং পুলিস সহ কিছু কৌতূহলী মানুষজন যখন এই দ্বীপে আসবে তখন তারা পাবে দশটা মৃতদেহ আর দশটা ভাঙ্গা পুতুল।

আমার বিশ্বাস পুলিস এই রহস্যের কিনারা করতে ব্যর্থ হবে। পান্না দ্বীপের হত্যারহস্য রহস্যময় হয়েই থেকে যাবে।

–লরেন্স ওয়ারগ্রেভ