২.১ দীর্ঘছায়া

দ্বিতীয় অধ্যায়
দীর্ঘছায়া

সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে এবং পোয়ারা মন্তব্যগুলো মিলিয়ে দেখলেন।

 পোয়ারোর দিকে সুপারিনটেন্ডেন্ট তাকালেন। তখন তার চোখ দুটি পিটপিট করছিল। জর্জ হুইস্কি এবং সোডা রাখল। আর পোয়ারোর সামনে রাখল রক্তবর্ণের পানীয় গ্লাস।

সুপারিনটেন্ডেন্ট আগ্রহ প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলেন আপনার পানীয় কী?

পোয়ারো প্রত্যুত্তরে বলল, কালো আঙুরের সিরাপ। সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে বললেন, খুব ভালো। প্রত্যেকেরই একটি নিজস্ব স্বাদ থাকে, গ্যারওয়ে তার পানীয়তে চুমুক দিয়ে বললেন, এ যে দেখছি আত্মহত্যার রিপোর্ট?

সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে বললেন, এছাড়া আর কী হতে পারে? আর এটাই তো আপনি জানতে চেয়েছিলেন। বলে তিনি মাথাটা দোলালেন। আপনাকে বেশি ব্যথা দেওয়ার জন্য আমি খুবই দুঃখিত বললেন পোয়ারো। কিপলিং-এর গল্পের মতো আমি জন্তু জানোয়ার অথবা শিশু ভালোবাসি। তৃপ্তিহীন এক কৌতূহলে ভুগছি আমি। গ্যারওয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তৃপ্তিহীন কৌতূহল? কিপলিং খুব সুন্দর গল্প লিখেছেন। আর তার লেখার উপাদানও আমি জানি। এবং সেগুলো থেকে আরও জানতে পারি যে, মানুষ একবার যদি জাহাজ ধ্বংসী টর্পেডোবাহী রণপোতের চারপাশে ছোটো খাটো একটা ট্যুর দেয়, তখন দেখা যাবে অনেক বেশি কিছু সঞ্চয় করতে পারে সে, তার জ্ঞানের ভাণ্ডার একজন রয়্যাল নেভির টপ ইঞ্জিনিয়ারের থেকেও বেশি।

এরকুল পোয়ারো বললেন, আমি সব কিছু জানি না। তাই আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, জানতে হবে। তাই আমার আশঙ্কা প্রশ্নের একটা দীর্ঘ তালিকা আমি আপনার কাছে পাঠিয়েছি।

গ্যারওয়ে বললেন, আমাকে কী বিহ্বল করেছে জানেন? একটা জিনিস থেকে আর একটায় আপনার লাফানোর ভঙ্গিটা। মানসিক রোগের চিকিৎসকের যদি রিপোর্ট হয় তাহলে টাকাটা কীভাবে এলো? বা কেই বা টাকাটা পেল। অথবা কেউ কি এই টাকা আশা করেছিল, পায়নি? বিশেষ করে মেয়েদের চুল পরিচর্যার সরঞ্জাম, পরচুল, অবশ্যই পরচুল যোগানদারের নাম প্রসঙ্গক্রমে এগুলো এসে পড়ে।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এসব জিনিসগুলো জানেন? আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ওগুলো আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে ফেলে।

খুব ভালো কথা, এটা একটা ধাঁধার মতো। এবং এ-বিষয়ে আমরা পূর্ণ মন্তব্য করেছি। এর কোনোটাই যদিও ভালো বলে মনে হয়নি আমাদের। তবুও ফাইলগুলো রেখে দিয়েছে যদি কেউ সেখানে এসে দেখতে চায় সেই জন্য। এই বলে টেবিলের ওপর একটা কাগজ রাখলেন তিনি।

এখানে যে হেয়ার ড্রেসারের ঠিকানা আছে সেটা ব্ৰন্ড স্ট্রিট। খুব ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠান। সেটার নাম হল ইউজিন এ্যান্ড রোসেনটেল। পরে তারা অন্য জায়গায় চলে যায়। তবে এই প্রতিষ্ঠান কিন্তু স্লোয়েন স্ট্রিটে তাদের ব্যাবসা চালাতে থাকে। কয়েক বছর আগে তাদের দুজন সহকারী অবসর নিয়েছে। তারা কিন্তু তখন প্রধান সহকারী হিসাবে তাদের খরিদ্দারদের সেবা করতে। লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট ছিলেন তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। রোসেনটেল এখন নিজেকে হেয়ার স্টাইলিস্ট হিসাবে পরিচয় দেয় এবং সে এখন থাকে সেলটেবহ্যামে। আমার যৌবনকালে সবাই একই রকম বলত যে, একই লোক আলাদা টুপি।

পোয়ারো বললেন, আ-হা!

গ্যারওয়ে প্রশ্ন করলেন, আ-হা কেন?

এরকুল পোয়ারো বললেন, এক্ষুনি আপনি একটা মতলব আমাকে উপহার দিয়েছেন। আর কী অদ্ভুত ভাবেই না একজনের মাথায় এই মতলবটা আমি।

গ্যারওয়ে বললেন, আপনার মাথায় অনেকগুলো মতলব দানা বেঁধেছে আর সেটা। অনেক অসুবিধার মধ্যে একটা আপনার আর দরকার নেই। আমি পারিবারিক ইতিহাস থেকে যতদূর সম্ভব অনুসন্ধান করে দেখেছি যে সেখানে বেশি কিছুই নেই। অ্যালিস্টেয়ার র‍্যাভেন্সক্রফট ছিলেন স্কটিশ। বাবা ছিলেন যাজক আর দুজন কাকা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। উভয়ই বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন মার্গারেট প্রেস্টন গ্রেকে। খুব ভালো বংশের মেয়ে ছিল সে। পারিবারিক কোনো কলঙ্ক ছিল না। জানি না আপনি কোথা থেকে এই খবর সংগ্রহ করেছেন। তবে আপনার ধারণা ঠিক তিনি ছিলেন তার যমজ বোনের একজন। এবং ডোরোথি ও মার্গারেট প্রেস্টন গ্রে-র ডাক নাম ছিল ডলি এবং মলি। প্রেস্টন গ্রে থাকতেন সাসেক্স-এ ব্যাটারস গ্রীনে। যমজ দুই বোনের একই দিনে তাদের প্রথম দাঁত ওঠে। এবং একই দিনে তাদের জ্বর হত । আর তারা পোশাক পরত একই রকম। একই দিনে তাদের দুজনের বিয়ে হয়েছিল এবং উভয়েরই স্বামী সেনাবাহিনীতে কাজ করত। পারিবারিক চিকিৎসক কয়েক বছর আগে মারা যান। অতএব তাদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনো খবর তার কাছ থেকে সংগ্রহ করার আর কোনো উপায় নেই। ছোটোবেলা একজনের মাধ্যমে একটা বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।

লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর?

না, অন্যজনের। ক্যাপ্টেন জ্যারাকে তিনি বিয়ে করেন এবং তাদের দুটি সন্তানও হয়। ছেলেটি ছিল ছোট এবং চার বছরের। ঠেলাগাড়ি বা ওই জাতীয় কোনো একটা গাড়ির ধাক্কা লাগে ছেলেটির মাথায় তাতে সে পুকুরে পড়ে যায় এবং জলে ডুবে মারা যায়। ভদ্রমহিলার অপর মেয়েটি ন-বছরের, সে নাকি তার ছোটো ভাইকে পুকুরে ঠেলে ফেলে দেয়। এক সঙ্গে তারা খেলছিল এবং খেলতে খেলতে তারা ঝগড়া করে। কিন্তু এর মধ্যে সন্দেহ করার মতো কিছু ছিল না। আবার কিছু লোক বলে যে মা নিজেই নাকি সেই নিষ্ঠুর কাজটা করেছিলেন। রেগে গিয়ে মেয়েটির মাথায় আঘাত করেন। আবার কেউ একজন বলে পাশের বাড়ির এক মহিলা নাকি ছেলেটির মাথায় আঘাত করেছিল। কিন্তু তাই বলে আপনি যেন মনে করবেন না। এ খবর আপনার মনে আগ্রহ জাগাতে পারে। মায়ের বোন আর তার স্বামী চুক্তি করে আত্মহত্যা করার সঙ্গে এ-ঘটনার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে।

পোয়ারো বললেন, না, সেরকম কিছু বলে মনে হচ্ছে না। তবে যে কেউ এর পিছনের ঘটনা জানার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে।

গ্যারওয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমি যেমন রয়েছি যে, প্রত্যেককেই অতীতের দিকে তাকাতে হবে। কিন্তু আমি এক্ষেত্রে বলতে পারি না যে, আমরা অতীতের কথা ভেবে দেখেছি কিনা। কারণ এসব ঘটনা ঘটেছিল আত্মহত্যা করার কয়েক বছর আগে। সেই সময় এ-ঘটনার জের থাকে আইনের দিক থেকে কিছু চলেছিল।

হ্যাঁ, কেসটা আমি দেখেছি, এবং খবরের কাগজের বিবরণও আমি পড়েছি। তবে এ ব্যাপারে একটা সন্দেহ অবশ্যই থেকে যায়। এ-ঘটনায় ছেলেটির মা ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তার ফলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেই স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি আর কখনও ফিরে আসতে পারেননি।

আচ্ছা তারা কি ভেবেছিল সেই নিষ্ঠুর কাজটা তিনিই করেছিলেন?

হ্যাঁ, তার চিকিৎসক সেইরকমই ভেবেছিলেন। প্রত্যক্ষ সাক্ষী বলতে যা বোঝায় তা কিছুই ছিল না। ভদ্রমহিলা বলেছিলেন তিনি নাকি জানালা দিয়ে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখেছিলেন। যে, তাঁর বড়ো মেয়ে ছেলেটিকে আঘাত করে পুকুরে ঠেলে ফেলে দেয়। আমার মনে হয় না সেই জবানবন্দি তারা বিশ্বাস করেছিল।

আমার মনে হয় মানসিক রোগের কোনো চিকিৎসকের সাক্ষ্য থাকতে পারে। কি পারে না?

হ্যাঁ, কোনো হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে যেতে হয় তাকে। তিনি নিশ্চয়ই ছিলেন মানসিক রোগী, বেশ কিছুদিন তাকে চিকিৎসা করতে হয়। আমার অনুমান লন্ডনের সেন্ট এ্যান্ড্রাস হাসপাতালে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে তার চিকিৎসা হয় এবং শেষে তাকে সুস্থ বলে ঘোষণা করা হয়। এবং বছর তিনেক বাদে তার পরিবারের সঙ্গে সাধারণ জীবনযাপন করার জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তিনি কি তখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন?

আমার অনুমান তিনি সব সময়ই স্নায়বিক রোগিণী ছিলেন।

সেই আত্মহত্যার ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন তিনি? নাকি তিনি র‍্যাভেন্সক্রফটদের সঙ্গেই থাকতেন?

না, সেই ঘটনার সপ্তাহ তিনেক আগে তিনি মারা যান। তবে মারা যাবার সময় তিনি তাদের সঙ্গে ওভারক্লিসে ছিলেন। ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়োতেন তিনি, তা বেশ কয়েক বছর ধরে এই রোগে তিনি ভুগছিলেন। আবার এক এক সময় তিনি ঘুমের পিল খেতেন এবং এর ফলে ঘুমের ঘোরে রাতে এক এক সময় বাড়ির ভেতর ঘুরে বেড়াতেন। আবার কখনও কখনও বাড়ির বাইরেও চলে যেতেন। তখন কারো ক্ষেপ থাকত না। এইভাবেই তিনি পাহাড়ের ওপর পড়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। পরের দিন পর্যন্ত তাঁর সন্ধান পাননি। তার বোন লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট এই ঘটনায় দারুণভাবে মুষড়ে পড়েন, তারা পরস্পর খুব অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর বোনের সেই আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি এত বেশি আঘাত পেয়েছিলেন যে তাঁকে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।

আচ্ছা সেই দুঘর্টনাটাই কি কয়েক সপ্তাহ পরে র‍্যাভেন্সক্রফটদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছিল?

সে রকম কোনো অনুমান কখনও করা হয়নি।

 আপনি বললেন যে যমজ সন্তানদের জীবনে সর্বক্ষেত্রে একইরকম ঘটনা ঘটে থাকে। তাহলে সেই সূত্র ধরলে বলতে হয় যে, র‍্যাভেন্সক্র নিজেই নিজেকে হত্যা করে থাকবেন হয়তো, কারণ তিনি ছিলেন যমজ বোনের একজন। আর তারপর তার স্বামী নিজেকে দোষী ভেবে আত্মহত্যা করে ছিলেন হয়তো।

গ্যারওয়ে বললেন পোয়ারোকে, আপনার মনে অনেকগুলো ধারণা কাজ করছে। অ্যালিস্টেয়ার র‍্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গে তার শালির কোনো গোপন সম্পর্ক থাকতেই পারে । কারণ সেরকম কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ শোনা যায়নি কারোর কাছ থেকে।

টেলিফোন বেজে উঠতে পোয়ারো উঠে দাঁড়ায় এবং বলেন মিসেস অলিভারের ফোন।

তিনি বললেন যে মঁসিয়ে পোয়ারো, আগামী কাল সিলিয়া আমার এখানে আসছে। পরে সেই ভয়ঙ্কর মহিলাটির আসার কথা। আপনি কি তাহলে চা কিংবা কোরার আমন্ত্রণ রাখতে পারবেন? আর আপনি এইরকমই তো চাইছিলেন তাই না?

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ ঠিক এইরকমটাই চাইছিলাম। মিসেস অলিভার বললেন, আমি একটি পুরোনো যুদ্ধের ঘোড়ার সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছি। জুলিয়া কারস্টেয়ার্স তার খোঁজ আমাকে দিয়েছেন আমার ধারণা। তিনি ভুল নাম পেয়েছেন। তবে আমার মনে হয় তিনি তার সঠিক ঠিকানা পেয়েছেন।

.

 এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করল সিলিয়া

পোয়ারো বললেন, ম্যাডাম স্যার হুগো ফস্টারের সঙ্গে কেমন বেড়ালেন?

আমার মনে হয় জুলিয়া তার নাম ভুল দিয়েছেন, তাঁর নামের শুরু ফস্টার নয় ফথার গিল।

তাহলে আপনি কি বলেন হাতিরা সব সময় নাম মনে রাখার ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য?

হাতির ব্যাপার আমি শেষ করে ফেলেছি সুতরাং হাতির কথা আর বলবেন না।

তাহলে আপনার সেই যুদ্ধের ঘোড়া?

বয়স্ক পোমানা ঘোড়া খবরের ব্যাপারে একেবারে অযোগ্য। কিছু লোক বলত বারনেট যারা তারা তাকে ওই নামে ডাকত। মালয়তে একটা দুঘর্টনায় তিনি তার ছেলেকে হত্যা করেছিলেন। তা বলে সেটা র‍্যাভেন্সক্রফটের খুন হওয়ার ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আবার বলছি, হাতিদের ব্যাপারটা আমি শেষ করে ফেলেছি-ম্যাডাম আপনি বেশ আপনার ধারণা ভালোভাবেই বজায় রেখেছেন।

আধ ঘন্টার ভেতর সিলিয়া এখানে আসছে। আমি ওকে বলেছি এ-ব্যাপারে আপনি আমাকে বেশ ভালোভাবেই সাহায্য করেছেন। ও কেবল আপনার সঙ্গেই দেখা করুক আপনি। কি তাই চান?

পোয়ারো বললেন, না, আপনি যেভাবে আয়োজন করেছেন সেইভাবেই ওকে পেতে চাই।

আমার মনে হয় ও বেশিক্ষণ থাকবে না। ও যদি ঘন্টাখানেকও থাকে আমরা সেই সময় প্রয়োজনীয় আলোচনা সেরে ফেলব। তারপর তো মিসেস বারটন কক্স আসছেন।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ সেটা খুব আকর্ষণ ও কৌতূহল্লোদ্দীপক হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিসেস অলিভার এবং বললেন, আমাদের আরও বেশি উপাদান পেতে হবে এবং আরও বেশি খবর সংগ্রহ করতে হবে তাই না?

পোয়ারো প্রত্যুত্তরে বললেন, হ্যাঁ, আমরা জানি না আমরা কি চাইছি। আমরা এখনও পর্যন্ত যা জেনেছি তা হল এক বিবাহিত দম্পতি যাঁরা সুখ ও শান্তিতে বাস করছিলেন। হঠাৎ তারা আত্মহত্যা করতে গেলেন। কিন্তু এই আত্মহত্যার কারণ কি দেখাব? অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি। আবার পূর্ব-পশ্চিমে, ডাইনে-বাঁয়ে পিছিয়েও এসেছি।

 মিসেস অলিভার বললেন, ঠিক বলেছেন। অনেক অনেক জায়গায় আমরা গেছি। কেবল উত্তর মেরুতে এখনও পর্যন্ত যাইনি।

পোয়ারো বললেন, উত্তর মেরুতে যেমন যাইনি তেমন দক্ষিণ মেরুতেও নয়।

সেখানে কী আছে আর আমাদের খোঁজার পালা কখন শেষে হবে?

আমাদের অনেক কিছু জানার আছে এবং অনেক কিছু পাওয়ার আছে। আমাদের খোঁজার পালা শেষ কবে বলতে পারি না। তবে একটা খালি তালিকা তৈরি করেছি আপনি কি সেটা পড়বেন?

 মিসেস অলিভার তার পাশে এসে বসলেন এবং কাচের ওপর দিয়ে পড়তে থাকলেন সেটা।

পরচুল, তিনি প্রশ্ন করলেন প্রথমেই পরচুল কেন?

পোয়ারো বললেন, চার-চারটে পরচুল। খুবই আকর্ষণীয় আর এর সমাধান খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার।

আমার অনুমান যে দোকান থেকে উনি ওগুলো কিনেছিলেন, সেই দোকান বোধহয় উঠে গেছে। এখন পরচুলের ব্যবহার কমে গেছে। শুধু বিদেশে বেড়োতে যাওয়ার সময় লোকেরা ব্যবহার করে। কারণ ভ্রমণে ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

পোয়ারো বললেন, শুধু পরচুলের জন্য আমার মনে আগ্রহ জাগে। তা ছাড়া অন্য অনেক কাহিনি আছে যেমন তাদের পরিবারে মানসিক বিপর্যয়ের খবর বা যমজ বোনর গল্প। মানসিক দিক দিয়ে তিনি খুবই বিপর্যস্ত ছিলেন এবং তিনি তার জীবনের বহু বছর মানসিক হাসপাতালে ছিলেন।

 সেটা কোনো সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে বলে আমার মনে হয় না। আমি বলতে চাই, বললেন মিসেস অলিভার, সেই মেয়েটি এসে ওঁদের দুজনকে গুলি করে থাকবে হয়তো। তবে আমি এর কারণ কী তা খুঁজে পাচ্ছি না।

 পোয়ারো বললেন, না, সেই রিভলবারের ওপর শুধু জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট আর তার স্ত্রীর হাতের ছাপ ছিল বলে জেনেছি। মালয়তে একটি শিশুকে হয় খুন করা হয় নয় আক্রমণ করা হয়। এবং সেই কাজটা করেছিল সম্ভবত লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটের যমজ বোন। সম্পূর্ণ অন্য এক নারী, একজন আয়া কিংবা একজন চাকর। আর একটা ব্যাপার হল অর্থ, আপনি নিশ্চয়ই অর্থের ব্যাপার একটু আধটু জানেন।

একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মিসেস অলিভার এখানে টাকা এলো কোথা থেকে।

পোয়ারো বললেন, টাকা এখানে আসেনি এবং সেটা যথেষ্ট আগ্রহের কারণ। টাকা স্বাভাবিকভাবেই আসে। আত্মহত্যার জন্য টাকা আসতে পারে আবার ওই কারণে টাকা খোয়াও যেতে পারে। সেখানে কোথাও বেশি পরিমাণ টাকা থাকার খবর পাওয়া যায়নি। হ্যাঁ তবে প্রেম-ঘটিত অনেক কাহিনি শুনতে পাওয়া যায় অর্থাৎ স্বামীর প্রতি অন্য নারীর আকর্ষণ আবার স্ত্রীর প্রতি অন্য পুরুষের আসক্তি। এই আকর্ষণবোধ বা আসক্তি সেটা এক তরফেই হোক বা অপর তরফেই হোক না কেন সেটা আত্মহত্যা বা খুনের পর্যায়ে গড়াতে পারে। অথচ এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। আর এই মুহূর্তে যে প্রসঙ্গে কথা বলছি সেটা অত্যন্ত আগ্রহপূর্ণ। সুতরাং সেই কারণেই আমি উদ্বিগ্ন হয়ে মিসেস বারটন কক্সের জন্য অপেক্ষা করছি।

সেই ভয়ঙ্কর মহিলাকে কেন যে আপনি গুরুত্ব দিতে চান আমি ঠিক বুঝতে পারি না। উনি যা করেছেন সেটা হল পরের ব্যাপারে নাক গলানো। আবার উনি আমাকে দিয়ে অনুসন্ধান চালাতে চান। আচ্ছা তিনি কেন আপনাকে দিয়ে অনুসন্ধানের কাজ চালাতে চাইছেন? আমার কাছে এটা কেমন যেন মনে হচ্ছে। দেখুন এটা এমন একটা ব্যাপার যা যে কোনো মানুষকেই খুঁজে বার করতে হবে। আর তিনিই হচ্ছেন যোগসূত্র।

 যোগসূত্র?

 হ্যাঁ, আমরা জানি না আসল সেই যোগসূত্রটা কী? আর সেটা কোথায়? অথবা সেটা কেমন? আমরা প্রত্যেকে জানি সেই আত্মহত্যার ব্যাপারে তিনি বেশি করে জানতে চান। আর যোগসূত্র হিসাবে তিনি আপনার ধমকন্যা সিলিয়া আর সেই ছেলেটিকে একত্রিত করতে চাইতেন।

আপনি তাহলে বলতে চান ছেলেটি ওঁর ছিল না?

পোয়ারো বললেন, সে ছিল একজন দত্তক পুত্র। একটি ছেলেকে তিনি দত্তকে নেন কারণ তাঁর নিজের ছেলে মারা গিয়েছিল।

ওঁর নিজের শিশু মারা গেছে? কী করে? কেন? এবং কখন?

এসব প্রশ্ন আমি নিজেই নিজেকে করেছি। উনি একটা যোগসূত্র হতে পারেন। যেমন কোনো প্রতিহিংসা নেওয়ার একটা ঘৃণা থেকে, অথবা কোনো প্রেমঘটিত ব্যাপার থেকে। হ্যাঁ ওঁর সম্পর্কে আমাকে মনঃস্থির করতেই হবে এবং যে ভাবেই হোক ওঁর সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে। আমি অপারগ, তাই সাহায্য করতে পারবো না। কিন্তু তাও চিন্তা করি যে, সেটা খুবই জরুরি।

বাড়ির কলিং বেলটা সেই সময় বেজে উঠল এবং মিসেস অলিভার পাশের ঘরে চলে গেলেন।

তিনি বললেন, এ বোধহয় সিলিয়া এলো, আপনি কিন্তু এ-ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ ঠিকই, তবে আশাকরি মেয়েটার দিক থেকে ও আমাকে নিরাশা করবে না।

কয়েক মিনিট বাদে মিসেস অলিভার সিলিয়াকে নিয়ে এলেন। মেয়েটির চোখে মুখে প্রচণ্ড সন্দেহ।

মেয়েটি বলল, আমি জানি না। যদি আমি–এরকুল পোয়ারোর দিকে তাকালো মেয়েটি এবং সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেলেন।

মিসেস অলিভার বললেন, তোমাকে এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই যিনি আমাকে সাহায্য করছেন। আশাকরি তোমাকেও উনি সাহায্য করবেন। তুমি যা জানতে চাইছ সেটার খোঁজ করতেই তিনি এখন ব্যস্ত। সত্য উদঘাটনে উনি একজন বিশেষ পারদর্শী। ইনি হলেন মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।

 ভীষণ সন্দেহের চোখে সিলিয়া তাকাল পোয়ারোর দিকে। তার চেহারা হচ্ছে ডিম্বাকৃতি মাথা, প্রকাণ্ড গোঁফ এবং ছোটো খাটো চেহারা।

সেই সন্দেহের সুরেই সিলিয়া বলল, আমার মনে হয় ওঁর নাম আমি শুনেছি।

পোয়ারো দৃঢ়স্বরে বলতে চেষ্টা করছিলেন আমার নাম অনেক লোকই শুনেছে। কিন্তু তিনি বললেন, না কারণ বহু লোক তার নাম শুনেছেন কিন্তু তারাই এখন নীরব।

আমি নিজের সম্পর্কে কিছু বলব আপনাকে তাই বসুন মাদামোয়াজেল। আমি যখন কোনো তদন্ত শুরু করি তার শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাই। আমি সত্য উদ্ঘাটন করব আর আপনি সেই সত্যকেই জানতে চান এবং সেই উপলব্ধিটাই আমি আপনার মনে জাগিয়ে তুলতে চাই। আমি এর বিভিন্ন দিক আপনার সামনে তুলে ধরতে পারি যা আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি। তাই যদি মনে করেন তাহলে আমাকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।

পোয়ারো মেয়েটির দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন। সিলিয়া চেয়ারে বসে আগ্রহের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, আপনার কি মনে হয় না সত্যকে আমি পরোয়া করতে চাই?

পোয়ারো বললেন, আমার ধারণা হয়তো সেই সত্য একটা আঘাত অথবা একটা দুঃখ হতে পারে। আবার এও হতে পারে যে আপনি বলতে পারেন, কেন আমি এগুলো থেকে মুক্ত হতে পারব না? আপনি হয়তো বলতে পারেন কেন আমি জানতে চাইব? এটা এমন একটা বেদনাদায়ক উপলব্ধি যে ব্যাপারে আমি আশাব্যঞ্জক কিছুই করতে পারি না। মা-বাবার আত্মহত্যার ঘটনা আমি স্বীকার করি এবং তাদের আমি ভালোবাসতাম মা বাবাকে ভালোবাসা নিশ্চয়ই কিছু ক্ষতিকর নয়?

আজকাল কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা বিবেচনা করতে হবে বলে মনে হয় বললেন মিসেস অলিভার, তবে আমরা বলতে পারি এটা একটা বিশ্বাসের নতুন অধ্যায়।

সিলিয়া বললেন, এমন একটা পরিস্থিতিতে বাস করছি যে, অবাক হয়ে শুধু ভাবছি লোকদের কথা এই ব্যাপারটাকে নিয়ে নানান রকমের কথা বলে বিশেষ করে আমাকে যখন করুণার চোখে দেখে। বলতে পারেন কেন আমি তাদের করুণার পাত্র হব? সেই সঙ্গে কৌতূহলও, আমি বলতে চাইছি লোকেদের ধারণার ব্যাপারে। যে সব লোকের সঙ্গে আপনার সর্বদা দেখা হচ্ছে, কিংবা যে সব লোকেদের আপনি জানেন অথবা যে সব লোক আপনার পরিবারদের জানে, এরকম জীবন আমি চাই না। আমি সত্যকে জানতে চাই, সত্য যতই নিষ্ঠুর, এবং নির্মম হোক আমি সেই সত্যর মোকাবিলা করতে পার এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দয়া করে আমাকে অন্তত কিছু বলুন।

 একটা আলাদা প্রশ্নের দিকে মোড় নিলেন সিলিয়া যা আগে ওর মনের মধ্যে ছিল। এখন সেটা প্রকাশের অপেক্ষায়, তিনি বললেন, ডেসমন্ডকে আপনি দেখেছেন? আপনার সঙ্গে সে দেখা করতে এসেছিল। সে কিন্তু আমাকে বলেছে যে, আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

হ্যাঁ সে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আপনি কি তাকে সেটা করতে বলেননি?

সে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

আর তিনি যদি জিজ্ঞেস করতেন তাহলে?

জানি না। সেটা করতে নিষেধ করা উচিত ছিল কিনা। এবং কোনো কারণেই যে তার সেটা করা উচিত নয় এ কথাটাও তাকে বলা উচিত ছিল কিনা তাও আমি জানি না। আবার এ-ব্যাপারে তাকে উৎসাহিত করা উচিত ছিল কিনা তাও জানি না।

একটা প্রশ্ন আমি আপনাকে করতে চাই মাদমোয়াজেল, যদি একটা স্পষ্ট ব্যাপার আপনার মনে জেগে থাকে যা আমার চিন্তার কারণ হয়েছে, সেটা অন্য কিছু থেকে অনেক বেশি জরুরি কিনা আমি জানতে চাই। সেটা কী?

একটু আগে আপনি বললেন ডেসমন্ড আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। এবং যে কারণে আমার কাছে ওঁর আসা তার জন্য উনি খুবই উদগ্রীব। এখন সেটা খুব জরুরি ব্যাপার। যদি আপনি আর ডেসমন্ড সত্যিই বিয়ে করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ আজকাল তরুণ তরুণীরা চিন্তা করে না দুটি জীবনের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করার তাগিদের কোনো বালাই তাদের মধ্যে নেই। সেই রকম একটা জীবনে কি আপনারা প্রবেশ করতে চান? আপনার বাবা মার মৃত্যু আত্মহত্যা বা অন্য ধরনের কোনো কিছু কিনা তাতে আপনার কিংবা ডেসমন্ডের কী আসে যায় বলুন?

সেটা একেবারে অন্য ধরণের মৃত্যু বা সেটা–আপনার কি মনে হয় এ ব্যাপারে?

সেরকম কিছু একটা হতেও পারে। এবং সেটা বিশ্বাস করার মতো কারণ আছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটা ব্যাপার আছে যার থেকে মনে হতে পারে এটা আত্মহত্যা নয়। আবার পুলিশের মতো দেখতে গেলে-সাক্ষ্য প্রমাণ দেখে শুনে তাঁরা মতামত দিয়েছে যে, জোড়া আত্মহত্যা ছাড়া অন্য আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু এর কারণ তারা কখনওই জানতে পারেনি। আপনিও তো তাই মনে করেন?

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ আমিও তাই মনে করি, আমি বলতে চাইছি সব কিছু দেখে শুনে অথবা সেগুলো সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে কিংবা যে দিক দিয়েই আপনি বিচার করুন না কেন এখনও আপনি ওঁদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে পারেননি, এর কারণ আপনি জানেন না তো তাই না?

না, না, সে ব্যাপারে আমি এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে আমার ধারণা কী জানেন, সেটা জানা খুবই বেদনাদায়ক হতে পারে। আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করব আচ্ছা বলুন তো অতীত কি পতিতই? আমি একজন যুবকেৰ কথা ভাবি অবশ্য সেও আমার কথা ভাবে, আমরা একসঙ্গে ভবিষ্যৎ জীবন কাটাব বলে ঠিক করেছি। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন সিলিয়া, আচ্ছা সে কি আপনাকে বলেছে যে, সে একজন দত্তক পুত্র?

হ্যাঁ উনি তাই বলেছেন।

তাহলেই দেখুন, একটা কি কোনো ব্যাপার হতে পারে ওই ভদ্রমহিলার? কেন তিনি এখানে আসতে যাবেন মিসেস অলিভারকে চিন্তায় ফেলার জন্য? কিংবা তিনি কেন চেষ্টা করবেন তাকে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করার জন্য আমার বাবা-মার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ কী? আর তিনি যখন ডেসমন্ডের নিজের মা নন?

ডেসমন্ড কি তাকে তোয়াক্কা করে?

সিলিয়া বললেন, না, তবে আমি বলতে পারি খুব সম্ভব ওঁকে অপছন্দই করে ও। আমার অনুমান ওর এই মনোভাব সব সময়ের জন্যই।

ওঁর জন্য অনেক অর্থ খরচ করেছেন যেমন স্কুলের, পোশাকের জন্য এবং অন্য আরও খরচ বাবদ। তাহলে কি আপনি মনে করেন ডেসমন্ডের ভালো মন্দ দেখতে চান না উনি?

আমি তা মনে করি না। আমার মনে হয় আর একটি ছেলে ওঁর মতে পুত্রের জায়গায় আসুক উনি তাই চান। কারণ ওঁর একটি ছেলে ছিল। একটা দুঘর্টনায় সে মারা যায়। আর সেই কারণেই তিনি কাউকে দত্তক হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। ওঁর স্বামী কিছু দিন হল মারা গেছে। এই সব দিনগুলি কাটানো এত কষ্টকর

আমি সব জানি, আমি একটা খবর জানতে চাই।

 ওই ভদ্রমহিলা বা ডেসমন্ডের ব্যাপারে তো?

হ্যাঁ ডেসমণ্ডের, আচ্ছা উনি ওঁর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পান?

আপনি যা বলতে চাইছেন তা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে আমার অনুমান ও আমার ভার নিতে পারবে না। যদিও একটি স্ত্রীর ভরণপোষণের ভার নেওয়ার ক্ষমতা যথেষ্ট আছে। ওকে যখন দত্তক নেওয়া হয় তখন ওর ভরণপোষণের জন্য কিছু অর্থের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যথেষ্টই ভালো অর্থ ছিল সেটা। ভাগ্য বা সেরকম কিছু আমি ভাবি না।

কেন, তিনি কি কিছু দাবিয়ে রাখতে পারেন না?

কী বললেন আপনি? ও আমাকে বিয়ে করলে টাকার যোগান বন্ধ করে দেবেন উনি? আমার মনে হয় না সেরকম কোনো কিছু তিনি করতে পারেন। আমার ধারণা উকিলরা বা ওর দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা যারা করেছিলেন মানে দত্তক নেওয়ার সোসাইটির কথা বলছি, তারা তখনই সব কিছু ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমি আরও একটা প্রশ্ন করব যার উত্তর শুধু আপনিই জানেন। অবশ্য মিসেস বারটন কক্সও জানতে পারেন, সেটা হল ডেসমন্ডের আসল মা কে ছিলেন?

এ ব্যাপারে ওঁর নাক গলানো সেটাই কি একটা কারণ? আপনি কি তাই মনে করেন? এই যেমন আপনি বললেন কে এই ডেসমন্ড অথবা কার ছেলে এই সব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যই কি ওঁর এত আগ্রহ?

না, বলছি তো না। এসবের আমি কিছুই জানি না। তবে আমার মনে হয় ও কারোর অবৈধ সন্তান। কারণ এই ধরনের ছেলেমেয়েদেরই তো দত্তক নেওয়া হয় তাই নয় কি? উনি হয়তো ওর আসল মা বা বাবার সম্পর্কে কিছু জানতে পারেন বা সেরকম কিছু। তবে উনি যদি জানেন ও ওকে কিছু বলেননি। আমি অন্তত জেনেছি কতকগুলি আজে বাজে ছেলে ভোলোনো কথা উনি বলেছিলেন যেমন কাউকে দত্তক নিতে গেলে যা করতে হয়।

আমার অনুমান কোনো সোসাইটি হয়তো বলে থাকবে যে, এইভাবে খবরটা আপনি বলতে পারেন কিংবা ডেসমন্ড কি জানেন কোনো রক্তের সম্পর্কের কথা?

আমার মনে হয় না ডেসমন্ড জানে। কিন্তু আমার এও মনে হয় না যে, তার জন্য ওর কোনো চিন্তার কারণ আছে। সেরকম চিন্তাগ্রস্ত ছেলে ও নয়ই।

আপনি হয়তো জানেন, মিসেস বারটন কক্স আপনাদের একজন পারিবারিক বন্ধু ছিলেন, হয় মার অথবা বাবার? আপনি কি কখনও ওঁনার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন? যখন আপনি ছেলেবেলায় আপনার নিজের বাড়িতে ছিলেন?

আমার তা মনে হয় না। কারণ ডেসমন্ডের মা মিসেস বারটন কক্স মালয়তে গিয়েছিলেন। সম্ভবত ওঁর স্বামী সেখানেই মারা যান। এবং ওঁরা যখন বিদেশে ছিলেন সেই সময় ডেসমন্ডকে ইংল্যান্ডের স্কুলে পাঠানো হয়। এবং ছুটির সময় ওঁর কোনো খুড়তুতো অথবা মাসতুতো ভাই কিংবা কোনো পরিচিতজন তাদের বাড়িতে ওকে নিয়ে যেত। এবং এইভাবেই আমরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। আমি সব সময়তেই ওকে মনে রেখেছি। গাছে ওঠার খুব ওস্তাদ ছিল এবং ও আমাকে পাখির বাসা আর পাখির ডিমের ব্যাপারে শিখিয়ে ছিল। আমি একজন বড়ো নায়কের পূজারিণী বলতে পারেন। তাই পরে আবার যখন দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বভাবতই আমরা পরস্পর উভয়ই আরো কাছে এসে পড়ি। আমরা দুজনেই আলোচনা করি যে, আমরা ছেলেবেলায় কোথায় ছিলাম। তারপর ও একদিন আমার নাম জিজ্ঞেস করে। ও বলেছিল আমি কেবল তোমার খ্রিস্টান নামটা জানি। তখন আমরা দুজনে অনেক কথাই মনে করার চেষ্টা করি। আপনি হয়তো বলতে পারেন এর ফলে আগের থেকে আমরা দু-জন আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। বলতে গেলে ওর সম্পর্কে সব কিছু আমি জানি না। কিন্তু আমি জানতে চাই। এমন একটা ব্যাপার যা সত্যি সত্যি ঘটেছিল যাতে আপনি জড়িয়ে পড়তে পারেন আর সেটা যদি আপনি না জানেন আপনি ঘর বাঁধবেন কী করে? জীবনে আপনি কিই বা করতে যাবেন?

 সুতরাং আপনি বলছেন আমি যেন আমার তদন্তের কাজ চালিয়ে যাই।

হ্যাঁ তাতে যদি কোনো ফুল হয়। যদিও আমি আর ডেসমন্ড যে ভাবে কিছু তথ্য অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি সে ভাবে নয় কিন্তু। কারণ তাতে আমরা খুব একটা সফল হইনি। সুতরাং এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় সেটা সত্যিকারের জীবনের কাহিনি হতে পারে না। এটা মৃত্যুর কাহিনি অথবা দুটি মৃত্যুর ঘটনা সেটাই বলা যেতে পারে। যখন জোড়া আত্মহত্যা তখন যে কেউ ধরে নিতে পারে সেটা মৃত্যুর খবর। শেক্সপীয়ার বা অন্য কোথাও লেখা সেই উক্তির কথা মনে পড়ে আর মৃত্যুর ক্ষেত্রে সেটা ভাগ করা যায় না। হ্যাঁ আপনি চালিয়ে যান। পোয়ারোর দিকে ফিরলেন সিলিয়া এবং বললেন, অনুসন্ধান চালিয়ে যান। আপনি যদি মনে করেন আপনার তদন্তের ফলাফল সরাসরি আমাকে বলতে পারেন অথবা মিসেস অলিভারকেও বলতে পারেন। তারপর সিলিয়া মিসেস অলিভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ধর্ম মা, আপনাকে আমি আতঙ্কিত করতে চাই না কিন্তু আমি সরাসরি ঘোড়ার মুখ থেকে কথাটা শুনতে চাই। আমার কথাটা বোধহয় রূঢ় হয়ে গেল কিন্তু বিশ্বাস করুন আঁসিয়ে পোয়ারো আমি ওভাবে বলতে চাইনি।

না, পোয়ারো বললেন, আমি ঘোড়ার মুখ হতে চাই।

আপনি কি মনে করেন আপনি সফল হতে পারবেন?

আমার বিশ্বাস আমি পারব।

আর সব সময়েই সেটা সত্য হয়ে থাকে তাই তো?

 পোয়ারো বললেন, সাধারণত সেটা সত্য হয়েই থাকে। তার বেশি আমি কিছু বলতে পারব না।

মিসেস বারটন কক্স

দরজা পর্যন্ত সিলিয়াকে এগিয়ে দিয়ে এসে মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটির সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

পোয়ারো বললেন, কৌতূহল জাগাল একটি মেয়ে। খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্না মেয়ে। আমি যদি সেইভাবে ওকে খাড়া করতে চাই তাহলে অবশ্যই বলব ও বিশেষ একজন, কোনো একজন নয়।

 হ্যাঁ সেটা খুবই সত্য, বললেন মিসেস অলিভার। আমি চাই আপনি কিছু বলুন।

কার সম্পর্কে, মেয়েটির সম্পর্কে কি? সত্যি কথা কি জানেন, ওকে আমি খুব একটা ভালো জানি না। ধর্মসন্তান সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু জানতে পারেন না। তাদের সম্পর্কে বেশি গভীরে প্রবেশ করা যায় না, আর তাছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না।

আমি ওর কথা বলতে বলিনি। ওর মার কথা বলুন।

 ও তাই বলুন।

আপনি কি ওর মাকে জানতেন?

 ওঁর সম্পর্কে আপনি কী জানতে চান বলুন?

আপনার কি ওঁকে মনে আছে? কী রকম মহিলা ছিলেন উনি?

আপনাকে একটা কথা বলি। কোনো ব্যাপারে কেউ অতীতের কোনো লোককে পুরোপুরি ভুলতে পারে না এবং ভুলতে পারে না সেই অতীতের স্মৃতিটাকে।

আচ্ছা বলতে পারেন আপনার মনে কী রকম রেখাপাত তিনি করেছিলেন?

 মিসেস অলিভার বললেন, সুন্দরী ছিলেন তিনি তবে তেরো চোদ্দ বছর বয়সের কিশোরীর মতন নয়, তখন ওঁর দেহে অনেক চর্বি ও মেদ জমে গিয়েছিল। আমার মনে হয় আমাদের সকলেরই সেরকম হয়ে থাকে।

 ওঁর মধ্যে ব্যক্তিত্ব ছিলো?

সেটা মনে করা খুব কঠিন ব্যাপার। কারণ উনি আমার একমাত্র বন্ধু বা অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন না। আমরা তখন অনেকেই একসঙ্গে মেলামেশা করতাম, তা আপনি বলতে পারেন আমাদের সবার ধ্যান ধারণা এবং পছন্দ-অপছন্দ প্রায় সবারই একরকম ছিল। টেনিস খেলায় আমাদের খুব আগ্রহ ছিল। এবং আমরা অপেরায় যেতে ভালোবাসতাম। আমাদের একটা সাধারণ ধারণার কথা আপনাকে শোনালাম।

মলি প্রেস্টন-গ্রে। এটাই কি ওঁর নাম ছিল। আপনাদের দুজনেরই কি বয়ফ্রেণ্ড ছিল?

আমার মনে হয় একটা অথবা দুটো হবে। তা অবশ্য পপ গায়কদের জন্য নয়। বিভিন্ন ধরনের বিখ্যাত অভিনেতারা।

 মলি অথবা মার্গারেট প্রেস্টন গ্রের কথা বেশি করে বলুন। এই মেয়েটি আপনাকে তার। কথা জানিয়েছিলেন পরে।

না, আমার ধারণা তিনি তা করেননি, কারণ ওঁরা সেরকম নন। তবে আমার মনে হয় এই মেয়েটির থেকে মলি আরও বেশি ভাবপ্রবণ।

আমার শোনা কথা ওঁরা নাকি যমজ বোন?

 না, তিনি তা ছিলেন না, প্রায় একই বয়সের বলে তিনি হয়তো তা হতে পারতেন। কিন্তু, তবে আমার অনুমান তিনি ইংলন্ডের একেবারের অন্য এক জায়গার মেয়ে। তবে আমি নিশ্চিত নই। তবে আপনার মতো আমারও মনে হয়েছিল ডলি আর মলি যমজ বোন, একবার কী দু-বার বিশেষ উপলক্ষ্যে ডলির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। এক সময় ওঁকে অবশ্যই মলির মতো দেখাত। যমজ বোনেরা বড়ো হতে থাকলে তাদের নামের সঙ্গে চুলের বাঁধুনি ভিন্ন রকম করা হত। ওদের চুলের স্টাইল ছিল তাই ভিন্ন রকমের। এর ফলে ওদের চিহ্নিত করা সুবিধা হত। আমার মনে হয় তার বোন ডলির অনুরক্ত ছিল, কিন্তু তার ব্যাপারে বেশি কথা বলতেন না তিনি। তখন যা আমার মনে হয়নি এখন আমার মনে হয় তার বোনের সঙ্গে হয়তো একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকবে। তিনি একবার কী দুবার অসুস্থ হয়েছিলেন এবং চিকিৎসার জন্য কোথাও গিয়েছিলেন। একবার তো আমি অবাক হয়েছিলাম তিনি কি পঙ্গু হয়ে গেছেন? একবার এক কাকিমা ওঁকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে যান কারণ তাঁর স্বাস্থ্য ভালো করে ভোলার জন্য। আমি ঠিক অনুভব করেছিলাম মলি তার অনুরক্ত ছিলেন। এবং যে কোনো ভাবে তাকে রক্ষা করার ইচ্ছা ছিল। এর থেকে কি আপনি কিছু অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন? অথবা এর থেকে কি কিছু আন্দাজ করতে পারলেন?

মোটেই নয় বললেন এরকুল পোয়ারো।

অন্য সময়ে দেখেছি তার সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চাইতেন না, শুধু তিনি তার মা ও বাবার কথা বলতেন। তিনি খুব প্রিয় ছিলেন তাদের আবার ওঁদেরও তিনি খুব ভালোবাসতেন। তার মা একবার প্যারিসে এসেছিলেন। তিনি তাকে বাইরে বেড়োতে নিয়ে গিয়েছিলেন, খুব একটা সুন্দরী ছিলেন না, কিন্তু চমৎকার শান্ত ও নরম প্রকৃতির মহিলা ছিলেন।

ও তাই বুঝি! আপনার কাছে আমাদের সাহায্য করার মতো কিছুই নেই? তার কোনো বয়ফ্রেন্ডও ছিল না?

মিসেস অলিভার বললেন, এখনকার মতো আমাদের সময়ে এত বয়ফ্রেন্ডের চল ছিল না। আমার অনুমান মলি তার অভিভাবকদের সঙ্গে বিদেশে কোথাও চলে যান। তবে ভারতে নয়, খুব সম্ভব ইজিপ্টে। আমার ধারণা ওঁরা ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসে ছিলেন। একসময় তাঁরা সুইডেনে ছিলেন। তারপর বারমুডা অথবা ওয়েস্ট ইন্ডিজে। আমার মনে হয় ভদ্রলোক গভর্নর বা সেই রকম কিছু ছিলেন। সেটা কিন্তু কেউ মনে রাখতে পারে না। মলির গানের শিক্ষকের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল, তবে আমার মনে হয় এখনকার বয়ফ্রেন্ডের তুলনায় কম ঝামেলার ব্যাপার ছিল সেটা। মানে আমি বোঝাতে চাইছি প্রতিদিন গান শেখাতে আসার আগে ওঁর জন্য প্রতীক্ষা করার মধ্যে আলাদা একটা রোমান্স ছিল, ছিল আলাদা উন্মাদনা। আপনার কাছে তারা একটু আলাদা ধরনের ছিলেন। যে কেউ তাঁদের জন্য রাতে স্বপ্ন দেখতেন। যার জন্য আমার প্রিয় মঁসিয়ে এ্যাডলফ যখন কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তার জীবন রক্ষা করার জন্য আমি রক্ত দান করেছিলাম। এক সময় আমি প্রায় স্থির করে ফেলি যে আমি নার্স হব। যে কোনো মুহূর্তে বারটন কক্স এসে পড়তে পারেন। আপনাকে দেখে এখন শুধু ভাবছি তার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে?

ঘড়ির দিকে তাকালেন পোয়ারো।

এক্ষুনি তাকে আমরা দেখতে পাব।

প্রথমে কি আমাদের বলার মতো কিছু আছে?

কয়েকটা ব্যাপারে আমাদের চিন্তা করতে হবে।

আমি বলছি একটা কী দুটো ব্যাপারে আমরা তদন্ত করতে পারি। যেমন আপনার জন্য বলব হাতি তদন্ত আর আমার জন্য হাতির প্রতীক রূপে অভিনয় করা।

 মিসেস অলিভার বললেন, এটা একটা দারুণ বিস্ময়কর ব্যাপার। আমি আপনাকে আগেই বলেছি যে আমি হাতির কাজ করেছি!

 আঃ কিন্তু হাতিরা আপনার হয়ে কাজ করে যে বললেন এরকুল পোয়ারো।

সামনের দরজার ঘণ্টা আবার শোনা গেল এবং পোয়ারো এবং মিসেস অলিভার পরস্পরের দিকে তাকালেন। মিসেস অলিভার বললেন, বেশ। আমি যাই। একটু পরেই মিসেস অলিভার মিসেস বারটন কক্সকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

মিসেস বারটন কক্স বললেন, কী সুন্দর আপনার ফ্ল্যাট! আপনার মূল্যবান সময় থেকে খরচ করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। যদিও আমি নিশ্চিত আপনিই বলেছেন আমাকে আসার জন্য। পাশে বসা এরকুল পোয়ারোর দিকে তাকালেন এবং তার মুখের ওপর এক অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পেলেন। আবার পর মুহূর্তেই তার দৃষ্টি গেল জানালার সামনে বোধগ্রস্ত পিয়ানোর ওপর। মিসেস অলিভার মনে করলেন যে, মিসেস বারটন কক্স হয়তো ভাবছেন এরকুল পোয়ারো বুঝি একজন পিয়ানো গায়ক। এই ভুল ধারণা দ্রুত কাটিয়ে তোলার জন্য তিনি তৎপর হয়ে উঠলেন।

পরিচয় করে দেওয়ার জন্য উঠলেন এবং বললেন, ইনি হচ্ছে মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো। পোয়ারো এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন।

আমার মনে হয় একমাত্র উনিই পারবেন কোনো না কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে। সেদিন আমার ধর্মকন্যা সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট-এর ব্যাপারে আপনি জানতে চাইছিলেন আমার কাছে।

আপনার কি দয়া আপনি আমাকে মনে রেখেছেন। আমি আশা করব সত্যিকারের কী  ঘটেছিল সে ব্যাপারে আপনি আমাকে একটু আলোকপাত করতে পারবেন।

 মিসেস অলিভার বললেন, আমার আশঙ্কা, আমি খুব বেশি সফল হতে পারিনি। সেই জন্যই মঁসিয়ে পোয়ারোকে আমি বলেছি আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য। এ-ব্যাপারে উনি একজন বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। এটা এমন একটা বেদনাদায়ক ঘটনা যা ঘটেছিল আজ থেকে অনেক বছর আগে।

মিসে বারটন কক্স বললেন, তা অবশ্য ঠিক। এখনও ওঁর চোখে একটা সন্দেহ যেন ঘোরাফেরা করছে।

মিসেস অলিভার প্রশ্ন করলেন : এখন বলুন কী চান? চায়ের সময় অনেক আগেই চলে গেছে। সুতরাং এক গ্লাস শেরি? অথবা আপনার পছন্দসই কোনো ককটেল জাতীয় কিছু?

ওঃ! এক গ্লাস শেরি।

পোয়ারোকে জিজ্ঞেস করলেন, কী খাবেন আপনি?

পোয়ারো বললেন, আমিও শেরি।

হাঁফ ছেড়ে যেন যেন বাঁচলেন মিসেস অলিভার। পোয়ারো যে তার প্রিয় ড্রিঙ্কস চাননি তার জন্য মনে মনে ধন্যবাদ জানালেন। কারণ তিনি যদি তার প্রিয় ড্রিঙ্কস চাইতেন, তিনি দিতে পারতেন না। তার ভাড়ায় এই মুহূর্তে সেটা ছিল না। পোয়ারোকে আমি আগেই বলে রেখেছি আপনি যে ব্যাপারে তদন্ত করতে চান।

মিসেস বারটন কক্স বললেন, হ্যাঁ। তার মুখ দেখে কিন্তু মনে হল তার সন্দেহ এখনও যায়নি কারণ পোয়ালোর পারদর্শিতার জন্য।

পোয়ারোকে বললেন তিনি, এই সব তরুণদের আজকাল বোঝা খুবই মুশকিল। যেমন আমার ছেলের কথাই ধরুন। ও ভীষণ ভালো ছেলে এবং আমাদের বিরাট আশা যে, ভবিষ্যতে সে উন্নতি করবে। সম্ভবত মিসেস অলিভার আপনাকে বলেছেন। ওঁর ধর্মকন্যা সিলিয়া অবশ্য এ-খবরটা সবই জানে। সে খুব সুন্দর মেয়ে। এই বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও প্রায়ই দেখা যায় সেটা বেশিদিন টেকে না, এটা ওদের কৈশোর প্রেম। অনেক বছর আগের কথা সব না হলেও কিছু জানা আমার জরুরি অন্তত আগের লোকদের সম্পর্কে। যদিও আমি জানি সিলিয়ার জন্ম বৃত্তান্ত ভালো কিন্তু সেখানে এমন একটা বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে যায়। আমার মনে হয় বলতে পারেন বিশ্বাস ও এটা একটা আপোষে আত্মহত্যা। কী এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল যাতে তাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল। সে সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কেউ আলোকপাত করতে পারেনি। এমন কোনো বন্ধু নেই আমার যাদের সাথে র‍্যাভেন্সক্রফটের বন্ধুত্ব তাদের থেকে সেই আত্মহত্যার ব্যাপারে জানতে পারি। তাই আমার পক্ষে ধারণা করা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। আমি জানি সিলিয়া খুবই ভালো মেয়ে। কিন্তু যে কেউ ওদের পরিবারের ব্যাপারে জানতে চাইবে আর অনেক বেশি করে। আর সেটাই তো স্বাভাবিক নয় কি?

 আমার বন্ধু মিসেস অলিভারের কাছে আমি আমি জানতে পারি আপনি একটা বিশেষ ঘটনার ব্যাপারে আমার কাছে জানতে চান। আর সেই ঘটনাটা হল প্রকৃতপক্ষে সেই আত্মহত্যা ঠিক কীভাবে ঘটেছিল–মানে

 মিসেস অলিভার দৃঢ়স্বরে বললেন, সেই যে আপনি জানতে চেয়েছিলেন যে, সিলিয়ার বাবা তার মাকে গুলি করে পরে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিলেন না সিলিয়ার মা তার বাবাকে গুলি করে পরে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিল।

মিসেস বারটন কক্স বললেন, আমি মনে করি এর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা তফাত থেকে যায়।

খুব মূল্যবান যুক্তি, বললেন পোয়ারো এবং তাঁর বলার ধরনটা শুনে মনে হল খুব একটা উৎসাহব্যাঞ্জক নয়। ও হো, এর পশ্চাদপটে একটা ভাবাবেগ আছে আর সেই ভাবাবেগের ঘটনাই তাদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। আপনি নিশ্চয়ই এটা মানবেন সব বিয়েতেই যে কেউ সন্তানের কথা চিন্তা করে থাকে। মানে আমি বলতে চাইছি বংশ পরম্পরাক্রমে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পুনাবৃত্তি যাতে ঘটে। আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারি পরিবেশের থেকেও সেটা অনেক বেশি কিছু। এবং সেটা একটা চরিত্র গঠনের দিকে ঠেলে দেয় তাতে একটা বেশ ঝুঁকিও থাকে যা কেউ নিতে চায় না।

 পোয়ারো বললেন, সত্য সেই ঝুঁকি যারা নেয় সিদ্ধান্ত তাদেরই নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। যেমন আপনার ছেলে আর এই তরুণী মেয়েটি, সেটা হবে তাদের পছন্দ।

আমি জানি, অভিভাবকদের কখনওই পছন্দ করার অনুমতি দেওয়া হয় না। শুধু তাই নয় তাদের উপদেশও দিতে দেওয়া হয় না। কিন্তু এ-ব্যাপারে আমি কিছু জানতে চাই এবং সেটা জানার জন্য আমি খুব আগ্রহী। আপনি যদি কোনো তদন্তের ভার নেন তাহলে আমার কথাটা আপনি মাথায় রাখবেন। আমি একজন নির্বোধ মা, এবং আমার পুত্রের জন্য আমি খুব বেশি চিন্তিত। বোধহয় সব মায়েদেরই একরকম অবস্থা হয়। একদিকে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে একটু হাসলেন তিনি। শেরির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, এ-ব্যাপারে আপনি চিন্তা করবেন আর আমিও আপনাকে জানাব। সম্ভবত ঠিক যে ব্যাপারে আমি চিন্তিত সেটা জানাব আপনাকে।

তারপরেই তিনি তার হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন, ওহো, আমার আর একটা সাক্ষাৎকারে খুব দেরি হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার জন্য সত্যিই খুব দুঃখিত মিসেস অলিভার। কিন্তু কী জানেন, আজকাল বিকালের দিকে ট্যাক্সি পাওয়া খুব মুশকিল ব্যাপার, একটার পর একটা ট্যাক্সিচালক মাথা ঘুরিয়ে সোজা চলে যায়। আমার অনুমান আপনার ঠিকানা মিসেস অলিভারের কাছে। তাই তো আছে না?

পোয়ারো বললেন, আমি আপনাকে আমার ঠিকানা দিচ্ছি। এই বলে তিনি তার পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে তাঁর হাতে তুলে দিলেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ কার্ডে লেখা মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো, আচ্ছা আপনি কি ফরাসি? কি ঠিক তাই তো?

আমি বেলজিয়ান, বললেন পোয়ারো।

ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি এখন ঠিক বুঝতে পারছি। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব আনন্দ পেলাম, ওহো আমাকে তাড়াতাড়ি যেতেই হবে।

মিসেস অলিভারের সঙ্গে করমর্দন করে হাত বাড়িয়ে দিলেন পোয়ারোর দিকে, এবং তার সঙ্গে করমর্দন করে তিনি খুব তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আচ্ছা ওঁর এভাবে চলে যাওয়ার ব্যাপারে আপনার কী রকম মনে হয়? প্রশ্ন করলেন, মিসেস অলিভার। পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি। আপনিই বলুন, আপনি কী মনে করেন?

মিসেস অলিভার বললেন, উনি যেন পালিয়ে বাঁচলেন যেভাবেই হোক আপনি ওঁকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ আমার মনে হয় আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, বললেন পোয়ারো।

উনি চান সিলিয়ার কাছ থেকে গোপন কিছু, যা ওর জানা আছে, আমি জেনে নিই। কিন্তু উনি চান না সত্যিকারের যথাযথ তদন্ত হোক। উনি কি তা চান? আমার মনে হয় না। এটা অত্যন্ত আকর্ষণপূর্ণ।

আপনার কি মনে হয় যে উনি যথেষ্ট অবস্থাপূর্ণ, বললেন পোয়ারো।

মিসেস অলিভার বললেন, ওঁর দামি দামি পোশাক এবং বিলাসবহুল ফ্ল্যাট দেখলে আমার তো তাই বলা উচিত। উনি ফ্যাশান প্রিয় তেজস্বী মহিলা এবং তিনি অনেক কমিটির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং ওঁর সম্পর্কে তেমন কোনো সন্দেহ জাগার কারণ দেখছি না। তবে কিছু ব্যক্তিকে আমি ওঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ ওঁকে খুব বেশি পছন্দ করে না। কিন্তু উনি নিজেকে জনদরদি মহিলা হিসাবে জাহির করার চেষ্টা করেন। আবার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। এ-ধরনের আরও অনেক কাজের সঙ্গে উনি জড়িত।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, তবে ওঁর ত্রুটিটা কোথায়? আপনার কি মনে হয় ওঁর মধ্যে কোনো ত্রুটি আছে? অথবা স্রেফ ওঁকে পছন্দ করেন না আমার মতো?

আমার মনে হয় এমন একটা কিছু আছে যা তিনি প্রকাশ্যে টেনে আনতে চান না, বললেন পোয়ারো। আর আপনি সেটা খুঁজে বার করতে চান?

অবশ্য যদি আমি পারি, পোয়ারো বললেন, হয়তো সেটা খুব একটা সহজ হবে না কারণ উনি এখন পালিয়ে যাওয়ার মতলবে আছেন। আমি ওঁকে যে প্রশ্ন করতে যাব সবে ভাবছিলাম উনি বোধহয় সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন তাই ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি এবং বললেন, ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহের অবকাশ আছে। জানেন তো প্রত্যেককে অতীতে ফিরে যেতে হবে এবং এমন কি একটা ভাবনার পরেও।

কি বললেন আপনি, আবার অতীতে ফিরে যেতে হবে?

হ্যাঁ, এমন একটা অতীতে ফিরে যেতে হবে যেখানে একটার বেশি ঘটনার কথা জানতে পারা যাবে। সেখানে এমন একটা কিছু আছে যা প্রত্যেককে জানতে হবে। কী ঘটেছিল সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসার আগে ঠিক কত বছর আগে এ ঘটনা ঘটেছিল সেখানে আমাদের ফিরে যেতে হবে, ওভারক্লিফ নামে একটি বাড়িতে বছর পনেরো কুড়ি আগে নিশ্চয়ই এ ঘটনা ঘটেছিল? প্রত্যেককেই আবার সেখানে ফিরে যেতে হবে।

ঠিক আছে, তাই হবে। এখন আপনার তালিকায় কী আছে বলুন, এখন কি করতে হবে? বললেন মিসে অলিভার।

পুলিশের রেকর্ড থেকে কতকগুলি জিনিসের নাম শুনেছি, যেগুলি সেই বাড়ি থেকে পাওয়া গিয়েছিল যেমন চারটে পরচুল, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে? মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ মনে পড়ছে, আপনি বলেছিলেন প্রয়োজনের তুলনায় চারটে পরচুল অত্যন্ত বেশি।

 পোয়ারো বললেন, একটু বেশি বলে আমার মনে হয়েছিল। আমি একজন ডাক্তারের ঠিকানা পেয়েছি। মনে হয় সেটা খুব কাজের হবে।

ডাক্তার? তাহলে কি আপনি সেই পারিবারিক ডাক্তারের কথা বলতে চাইছেন?

না, না। পারিবারিক ডাক্তার নয়, আমি সেই ডাক্তারকে বোঝাতে চাইছি যে সেই শিশুটির দুর্ঘটনাজনিত আকস্মিক মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সেই শিশুটিকে হয় তার বড়ো বোন অথবা অন্য কেউ ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিয়ে থাকবে।

আপনি কি তার মাকে ইঙ্গিত করছেন?

মাও হতে পারে আবার অন্য কেউ হতে পারে, যে তখন বাড়িতে ছিল। যেখানে সেই ঘটনা ঘটেছিল ইংল্যান্ডের সেই জায়গা আমি জানি, সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারোওয়ে ও আমার সাংবাদিক বন্ধুদের মাধ্যমে যারা এই কেসের ব্যাপারে আগ্রহী তারাই সেই ডাক্তারের খোঁজ পেতে সমর্থ হয়েছেন।

আপনি যাচ্ছেন তার সঙ্গে দেখা করতে? এখন তিনি নিশ্চয়ই খুব বুড়িয়ে গেছেন?

না, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাব না। আমি তার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাব, কারণ তার ছেলে মানসিক রোগের একজন স্পেশালিস্ট। আমার নাম তার কাছে সুপারিশ করা আছে। অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারেও সেই সময় তদন্ত হয়েছিল। হয়তো তিনি কিছু উল্লেখযোগ্য খবর দিতে পারেন।

অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপার বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন?

এ-ব্যাপারে আমাকে কতকগুলো জিনিস খুঁজে বার করতে হবে। এবং সেগুলোর মধ্যে একটা অপরাধ কর্ম-সংক্রান্ত হতে পারে। কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের দেখতে হবে অর্থের কার লোকসান এবং কে লাভবান হতে পারে। সুতরাং প্রত্যেককেই সেটা খুঁজে বার করতে হবে।

 হ্যাঁ ভালো কথা, র‍্যাভেন্সক্রফটদের কেসে তারা সেটা খুঁজে বার করে থাকবে নিশ্চয়ই।

সেটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয় সব দিক থেকে। ওঁরা উভয়েই উইল করে গেছেন, স্ত্রী তার অর্থ রেখে গেছেন স্বামীর জন্য এবং স্বামী তার অর্থ রেখে গেছেন স্ত্রীর জন্য। কিন্তু তাঁরা কেউই উপকৃত হতে পারেননি কারণ দু-জনেই মৃত। সুতরাং এর ফলে দেখা যাচ্ছে এতে লাভবান হয়েছে ওঁদের কন্যা সিলিয়া এবং পুত্র এডওয়ার্ড। এবং আমি আরও জেনেছি যে, এই এডওয়ার্ড এখন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কোনো সন্তানই সেই ঘটনার সময় সেখানে ছিল না, বা সেই অপ্রিয় কাজটা তারা করতে পারে বলে মনে হয় না। সুতরাং সেটা কোনো কাজের হবে না।

না, সেটা ঠিক সত্য নয়, আরও খানিকটা পিছিয়ে যেতে হবে আমাদের অতীতের দিকে এবং দেখতে হবে সেখানে কোথাও অর্থ সংক্রান্ত মোটিভ আছে কিনা–আমরা বলতে পারি এটা একটা অর্থপূর্ণ–দয়া করে এ-ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। তার জন্য আমার সত্যিকারের কোনো গুণ নেই। মিসেস অলিভার বললেন, হাতির ব্যাপারে আমি যা বলেছিলাম সেটা বরং মোটামুটি ভালো যুক্তি হতে পারে।

পরচুলার ব্যাপারে আপনি যদি একটু মাথা ঘামান তাহলে সব থেকে ভালো হয় অন্তত আমার ধারণা তাই।

পরচুলা?

পুলিশের রিপোর্টে দেখা যায় পরচুলগুলো যে দোকান থেকে কেনা হয় লন্ডনের স্ট্রিটে হেয়ার ড্রেসার ফার্মটা ছিল খুব বিলাসবহুল। পরে সেই দোকান বন্ধ হয়ে তাদের ব্যাবসা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই দোকান চালাত দুজন মূল অংশীদার। তবে সেই নতুন ফার্মটাও কিছুদিন বাদে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে প্রধান ফিটার ও হেয়ার ড্রেসারের ঠিকানা আমি সংগ্রহ করেছি। তাই আমার অনুমান যদি কোনো মহিলা এব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয় তবে একটা না একটা ফল পাওয়া যেতে পারে।

মিসেস অলিভার বললেন, সেই মহিলাটি কি আমি?

হ্যাঁ আপনিই।

ঠিক আছে। আমাকে কী করতে হবে এখন বলুন?

সেলটেনহ্যামের একটা ঠিকানায় আপনাকে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে আপনি দেখতে পাবেন মেয়েদের চুলের সরঞ্জাম তৈরি করে মাদাম রোসেনটেলকে। এখন সে আর যুবতী নেই। তবে আধুনিক ফ্যাশনের চুলের সরঞ্জাম তৈরি করতে তার জুড়ি নেই। সে এমন একজনকে বিয়ে করেছে যার পেশা তারই মতো। পুরুষদের মাথায় টাক পরে যাওয়ার সমস্যার সমাধান করতে সে বিশেষ পারদর্শী।

 এই কাজ আপনি আমাকে দিচ্ছেন? এ-ব্যাপারে সে কি কিছু মনে রাখতে পারে? আপনি কী মনে করেন? বললেন মিসেস অলিভার।

এরকুল পোয়ারো বললেন, হাতিরা মনে রাখে।

সেই ডাক্তার যার কথা আপনি বললেন। আপনি কি তার কাছে খোঁজ করতে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ একটা ব্যাপার

আপনি কি মনে করেন তিনি মনে রেখেছেন?

পোয়ারো বললেন, খুব বেশি নয়। তবে আমার মনে হয় এটা সম্ভব, কারণ একটা দুর্ঘটনার কথা তিনি হয়তো শুনে থাকবেন। সেটা খুব আগ্রহের, কেস হিস্ট্রিতে রেকর্ড আছে নিশ্চয়ই বুঝলেন।

আপনি কি যমজ বোনের কথা বলছেন?

হ্যাঁ, তাকে নিয়ে দুটি দুর্ঘটনার কথা যতদূর মনে হয় আপনি শুনেছেন। একবার তিনি যখন যুবতী মা ছিলেন কান্ট্রিতে। ঠিকানাটা যতদূর মনে হয় হ্যাঁটারস গ্রীনে আর দ্বিতীয়বার তিনি যখন মালয়তে ছিলেন। প্রতিবারেই শিশুর মৃত্যুর কারণ হচ্ছে দুর্ঘটনা। সেই ব্যাপারে হয়তো আমি কিছু জানতে পারি

 তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যেহেতু তারা যমজ ছিলেন, মলির মানসিক রোগ ছিল আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। তিনি মোটেই সেরকম ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্নেহপ্রবণ ও আবেগপ্রবণ এবং দেখতে ছিলেন সুন্দর। তিনি ছিলেন এক ভয়ঙ্কর চমৎকার লোক।

হ্যাঁ ঠিকই। দেখলে সেই রকমই মনে হয়, আর তিনি খুব সুখীও বটে। আপনি কি মনে করেন?

হ্যাঁ তিনি ছিলেন একজন সুখী ব্যক্তি। ওঁর পরবর্তী জীবনের কিছুই জানা নেই কারণ তিনি তখন বিদেশে ছিলেন। তবে কোনো উপলক্ষ্যে ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম বা ওঁর কাছ থেকে চিঠি পেতাম। সব সময় মনে হত উনি খুবই সুখে ছিলেন?

সেই যমজ বোনের ব্যাপারে আপনি সত্যিই কিছু জানেন না? না, তবে আমার মনে হয় তিনি ছিলেন–খোলাখুলি বলতে গেলে এক ধরনের সংস্থায় তিনি ছিলেন, মলিকে খুব কম উপলক্ষে আমি দেখেছি। সেই মলির বিয়েতেই ওঁকে দেখতে পাইনি আমি। এমন কি ওঁর সহচরী হিসাবেও না।

সেটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার।

এর মধ্যে থেকে আপনি কী বার করতে যাচ্ছেন আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না।

 পোয়ারো বললেন, স্রেফ একটা খবর।

.

ডাঃ উইলবি

 পোয়ারো ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া এবং টিপস দিয়ে পকেট থেকে ছোটো নোট বইটা বের করে আর একবার ঠিকানাটা মিলিয়ে নিলেন। কারণ ঠিক জায়গায় এসছেন কিনা দেখার জন্য। ডাঃ উইলবিকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিটা পকেট থেকে বার করলেন এবং সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন। তারপর বেল টিপলেন, দরজা খুলে দেখেন একজন পুরুষ পরিচালক। পোয়ারো নাম বললেন, সেই শুনে সে বলল তাকে, ডাঃ উইলবি তার জন্য অপেক্ষা করছেন। যে ঘরে পোয়ারো ঢুকলেন সেটা একটা ছোটো ঘর। তার চারিদিকে তুক সেলিফ। আসবাব বলতে দুটি আরাম কেদারা। হাতলের ওপর দুটি গ্লাস, একটা কারুকার্য করা সুরাপাত্র সমেত ট্রে। ডাঃ উইলবি দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। তার বয়স বছর পঞ্চাশ-ষাট আর চেহারা পাতলা রোগাটে, কপাল চওড়া, কালো চুল এবং ধূসর চোখ। তিনি করমর্দন করলেন এবং পকেট থেকে চিঠিটা বার করে তাঁর হাতে দিলেন পোয়ারো।

তাঁর হাত থেকে চিঠিটা নিলেন ডাক্তার এবং খুলে পড়লেন। তারপর সেটা একপাশে রেখে খুব আগ্রহের সঙ্গে পোয়ারোর দিকে তাকালেন।

সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারোওয়ে আমাকে আগেই বলেছিলেন। আর তাছাড়া হোম অফিস থেকে আমার একজন বন্ধুও অনুরোধ করেছে আপনার এই আগ্রহের ব্যাপারে আমি যেন সাধ্যমতো সাহায্য করি।

 আমাকে অনুগ্রহ করার জন্য, আপনাকে অনুরোধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বললেন পোয়ারো। কিন্তু তারও একটা কারণ আছে যা আমার কাছে জরুরি বলে মনে হয়েছে।

এত বছর বাদে হঠাৎ এত জরুরি বলে মনে হচ্ছে কেন?

আপনি যদি একটা বিশেষ ব্যাপারে ঠিক ঠিক খেয়াল করতে পারেন তাহলে আপনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন সেটা সত্যিই জরুরি কিনা?

 ওরা সেটা করেছে কিনা আমি বলতে পারব না। আমার আগ্রহ এই কারণে যে, স্পেশাল ব্রাঞ্চে এই পেশায় বেশ কয়েক বছর ছিলাম।

এসবের ওপর আপনার বাবার কর্তৃত্ব ছিল সুবিদিত।

হ্যাঁ, তাই ছিলেন তিনি, সেটা একটা বিরাট আগ্রহের ব্যাপার ছিল তাঁর জীবনে। তার মতবাদ ছিল অনেক। তার মধ্যে কিছু মতবাদ গর্বের সঙ্গে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আর বাকি, মতবাদ প্রমাণিত হয়েছে হতাশাব্যাঞ্জক। আমি লক্ষ্য করেছি একটা ভয়ের ব্যাপারে আপনি বিশেষ আগ্রহী।

একজন মহিলা, তাঁর নাম ডরোথি প্রেস্টন-গ্রে।

সেই সময় আমি যুবক ছিলাম এবং তখন আমি আমার বাবার পেশায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম, যদিও আমার মানসিক বিশ্লেষণ সব সময় বাবার মতবাদের সঙ্গে মিল হত না। এবং যে কাজ তিনি করেছিলেন সেটা ছিল সারা জাগানোর মতো কৌতূহল। এবং যৌথভাবে আমি যে কাজ করেছিলাম সেটা আমাকে খুব আগ্রহ জাগায়, ডরোথি প্রেস্টন গ্রে-র ব্যাপারে আপনার বিশেষ আগ্রহ কেন আমি জানি, কারণ তিনি প্রেস্টন গ্রে থাকলেও পরে মিসেস গ্যারো হন।

 পোয়ারো বললেন, আমি জেনেছি তিনি ছিলেন যমজের একজন।

হ্যাঁ, সেই সময় আমার বাবার গবেষণার ক্ষেত্র নির্বাচিত ছিল যমজদের জীবন নিয়ে। যেমন যে সব যমজ সন্তানরা একই পরিবেশে বড়ো হয়েছে, আবার যারা বিভিন্ন পরিবেশে বড়ো হয়েছে, তাদের নিয়ে গবেষণা করা। তারা কতকাল দুজনে একই রকম থাকে বা তাঁদের দু-জনের জীবনে একইরকম ঘটনা ঘটে কিনা এই সব বিষয় নিয়ে ছিল গবেষণা করা, দু-জন বোন বা দু-জন ভাই যারা খুব কম সময়ই একসঙ্গে কাটিয়েছে তাদের জীবনে বিস্ময়করভাবে একই সময় একই ঘটনা ঘটে কিনা সেটাও দেখার বিষয় ছিল। যাই হোক আমি শুনেছি এ-ব্যাপারে আপনার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই।

না বললেন পোয়ারো, বরং বলা যেতে পারে আমার আগ্রহের কারণ একটি শিশুর দুর্ঘটনার ব্যাপারে। হ্যাঁ তা হতে পারে, আমার মনে হয় ঘটনাটা মায়ের খুব ভালো জায়গায় লোকেরা বাস করত। ক্যাম্বরলি থেকে খুব দূরে নয়, মিসেস গ্যারো ছিলেন বিধবা এবং তাঁর দুটি সন্তান ছিল। সম্প্রতি তাঁর স্বামী একটা দুর্ঘটনায় মারা যান। যার ফলে তিনি

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত?

না, সেরকম কিছু ভাবা যায় না ওঁর সম্পর্কে। তার স্বামী মারা যাওয়ায় তিনি গভীরভাবে শক পেয়েছিলেন এবং তাঁর মনে হয়েছিল তিনি বিরাট কিছু হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর চিকিৎসকের মতে তার স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো ছিল না, কিন্তু তিনি যেভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন সেটা তার চিকিৎসক ভালো মনে মেনে নিতে পারেননি। এর ফলে মনে হয় তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তবে যাই হোক উনি আমার বাবার সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে চান এবং রোগিণীকে নিজের চোখে দেখে আসার জন্য সেখানে যেতে বলেন, তিনি তার অবস্থা দেখে খুবই উৎসাহিত বোধ করেন এবং এও মনে করেন তার বিপদেরও সম্ভাবনা আছে। সুতরাং তাকে যদি একটা নার্সিংহোমে রেখে চিকিৎসা করা যায় বেশ ভালো হয়। এমন কি সেই শিশুর মৃত্যুর পরও তার অবস্থা একই রকম ছিল। ওঁর দুটি সন্তান ছিল। মিসেস গ্যারোর মতে ঘটনাটা যা ঘটেছিল তা হল-বড়ো মেয়ে তার থেকে বছর চার পাঁচের ছোটো ভাইকে আক্রমণ করে। একটা কোদাল দিয়ে তাকে আঘাত করে এবং কৃত্রিম সাজানো পুকুরে জলে ডুবে মারা যায়। পেরামবুলেটার থেকে ছোটো ভাই বা বোনকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিতে দেখা যায়। তার কারণ ঈর্ষা এবং তারা ভাবে এডওয়ার্ড বা ডোলান্ড অথবা যে নামই হোক না কেন সে যদি পৃথিবীতে না থাকে তার মার কষ্ট কিছুটা দূর হবে। অথবা ভাই বা বোন না থাকলে তার পক্ষে খুব ভালো হয়। এরকম ঘটনা ছোটো ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রায়ই ঘটে থাকতে দেখা যায়। এসবই ঈর্ষা থেকে সৃষ্টি হয়। এই কেসে নির্দিষ্ট কোনো কারণ বা সাক্ষ্য প্রমাণ নেই। মেয়েটি কিন্তু তার ভায়ের জন্ম হওয়াতে ক্রুদ্ধ হয়নি।

অপরপক্ষে দেখা যায় মিসেস গ্যারো এই দ্বিতীয় সন্তানটিকে জন্ম দিতে চাননি। কিন্তু তার স্বামী আসন্ন দ্বিতীয় সন্তানের জন্য খুশি হয়েছিলেন। গর্ভপাতের জন্য তিনি দু-জন ডাক্তার দেখান। কিন্তু গর্ভপাত করতে পারেননি কারণ তখন তা ছিল বেআইনি। তখন আরও শোনা যায় যে একজন চাকর এবং একটি ছেলে এসে বলল, একজন মহিলা নাকি তার ছেলেকে আক্রমণ করে। সেটি কিন্তু কন্যা সন্তান ছিল না। আবার তখন জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিল তিনি ছিলেন তার মিস্ট্রে। তিনি বললেন, আমার ধারণা সেই সময় তিনি কী করছিলেন তা তিনি জানতেন না কারণ তাঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন। বিচারে বলা হয় সেটা ছিল একটা দুর্ঘটনা এবং ছেলেমেয়েরা তখন একসঙ্গে খেলছিল। সুতরাং কেসট এইভাবে পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু আমার বাবা যখন কেসটা নিয়ে মিসেস গ্যারোর সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাঁকে সহানুভূতি জানিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেন, আবার কয়েকটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একদম নিশ্চিত হন তখন যা ঘটেছিল তার জন্য তিনিই দায়ী। অতএব তার পরামর্শমতো মিসেস গ্যারোর মানসিক চিকিৎসার দরকার ছিল।

আপনারা বাবা সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন যে, সেই ঘটনার জন্য তিনিই দায়ী ছিলেন?

হ্যাঁ। সেই সময় এই সব রোগের চিকিৎসার জন্য একটা স্কুল ছিল। সেটা খুব জনপ্রিয় ছিল আর সেই স্কুলের প্রতি আমার বাবার বিশ্বাস ছিল। এখানে চিকিৎসা পর মানুষ তার স্বাভাবিক জীবন আবার করতে পারে। তবে তার প্রতি আত্মীয়স্বজন এবং বাড়ির লোকের সুনজর রাখা উচিত এবং দেখা উচিত যে, তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে কিনা, আমি মনে করি এর ফলে বহু ক্ষেত্রে সাফল্য আসতে পারে আবার অনেক ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনক হতে পারে। যে সব রুগিরা ভালো হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে এবং পরে অসুখটা আবার দেখা দেয় এর ফলে তখনই বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে থাকে। একটা কেসে আমার বাবা খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং সেই কেসটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই বন্ধুর সঙ্গে যে মহিলাটি বাস করতে এসেছিলেন তিনি কি আগে তাঁর সঙ্গে বসবাস করতেন? প্রায় সব কিছুই সুখে শান্তিতে চলছিল। হঠাৎ পাঁচ কী ছয় মাস পর তিনি ডাক্তারকে ডেকে পাঠান এবং ডাক্তার এলে মহিলা তাকে বললেন, আপনাকে ওপর তলায় নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছি কারণ আমি যা করেছি তা দেখে আপনি ক্রুদ্ধ হবেন। এবং পুলিশকে খবর দেবেন। এই অপ্রিয় কাজটা করতে আমাকে হুকুম করা হয়েছিল। হিলডিকয়ার চোখে আমি শয়তানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলাম। সেইজন্যই এই নিষ্ঠুর কাজটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি জেনে গিয়েছিলাম, ওকে খুন করতেই হবে। এবং আমি জানতাম সেটা ঘটবেই। একটা চেয়ারের ওপর মহিলাটি মৃত অবস্থায় বসেছিলেন। তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় মৃত্যুর পর তার চোখ দুটির ওপরও আক্রমণ করা হয়েছিল। তাকে একটা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে সে। মারা যায় কিন্তু তার মধ্যে কোনো অপরাধবোধের চিহ্ন ছিল না। কারণ তার ওপর যে আদেশ অর্পিত হয়েছিল সেটা পালন করা ছিল তাঁর কর্তব্য। শয়তানকে ধ্বংস করাই ছিল তার কর্তব্য।

 পোয়ারো মাথা নাড়লেন খুব দুঃখের সঙ্গে।

ডাক্তার বলেই চললেন যে, ডরোথি প্রেস্টন গ্রে মাঝারি ধরনের মানসিক রুগি ছিলেন। তাকে যদি কারোর তত্ত্বাবধানে রাখা যেত তাহলেই তিনি ছিলেন নিরাপদ। তবে আমি বলতে পারি সাধারণত গ্রহণযোগ্য ছিল না সেই সময়। আমার বাবাও তখন এ-ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার কথা ঠিক বলে মনে করেননি। নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে বছরখানেক থেকে তিনি আবার আগের মতো হয়ে যান। তাঁর সঙ্গে থাকত একজন নার্স, যদিও তিনি নিজেকে একজন পরিচারিকা হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চাইতেন তার কাছে। তিনি আবার নতুন করে বন্ধুত্ব পাতালেন এবং কিছুদিন পরে তিনি বিদেশে চলে যান।

হ্যাঁ, তিনি মালয়তে যান তার যমজ বোনের সঙ্গে থাকবেন বলে।

আবার সেখানে আর একটি বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছিল তাই না?

হ্যাঁ। একজন প্রতিবেশীর শিশু আক্রান্ত হয়। প্রথমে মনে করা হয়েছিল শিশুটির আম্মা তাকে আক্রমণ করেছিল। পরে আবার গ্রামের এক চাকরকে সন্দেহ করা হয় কিন্তু আবার দেখা যায় যে কোনো মানসিক কারণেই হোক, নিশ্চিন্তে বলা যেতে পারে শিশুটির প্রতি সেই আক্রমণের জন্য মিসেস গ্যারোই দোষী ছিলেন। আমার মনে হয় সেই জেনারেলের নামটা আমি ভুলে গেছি–

র‍্যাভেন্সক্রফট? বললেন পোয়ারো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট তাকে ফেরত পাঠাতে রাজী হন এবং সেখানে চিকিৎসা আবার শুরু হয় তার। আচ্ছা এসব খবরই কি আপনি জানতে চেয়েছিলেন?

 পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ। এটা একটা আংশিক খবর যা আমি ও আপনি আগেই শুনেছি। আমি যেটা আপনাকে বলতে চাই তা হল যমজ বোনেদের ব্যাপারে। অপর যমজ বোন মার্গারেট প্রেস্টন গ্রের ব্যাপার কী? শত হলেও তিনি ছিলেন জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট-এর স্ত্রী। আচ্ছা তিনিও কি সেই একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন?

 ডাক্তারি রিপোর্টে তাঁর সম্পর্কে কখনও কোনো অসুখের খবর পাওয়া যায়নি। কারণ তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার বাবা তাঁর বাড়িতে একবার কী দুবার গিয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে কথাও বলেছেন। তার ব্যাপারে বাবা খুব আগ্রহী ছিলেন। কারণ তিনি দেখেছেন যমজ সন্তানদের মধ্যে যদি কারোর অসুখ করে বা মানসিক বিপর্যয় ঘটে তখন অপর যমজ শিশুটিরও সেই রোগ বা অন্য কোনো অসুখ হতে বাধ্য। অথচ সেই সময় স্বামী স্ত্রী দু-জনেই আন্তরিকতা ও আনুগত্যের মনোভাব নিয়ে তারা তাদের জীবনযাত্রা শুরু করেছিলেন।

আপনি বললেন, কেবল জীবন শুরু করেছিলেন। এ কথার অর্থ কী?

একটা বিশেষ উপলক্ষ্যে দুই যমজ সন্তানের মধ্যে বিদ্বেষের প্রশ্ন উঠতে পারে। আবার প্রথমে দু-জনের মধ্যে গভীর ভালোবাসার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু পরে কোনো একটা ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরের ব্যাপারে হিংসার পাত্র হয়ে উঠতে পারে। এবং সেই কারণটার উৎস হল দু-জনের মধ্যে ভাবাবেগের অভাববোধ। এবং সেই ধরনের কোনো ঘটনা থেকেই সৃষ্টি হতে পারে বিদ্বেষের।

 আমার অনুমান এক্ষেত্রে সেটা ঘটতে পারে। জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট সেই সময় ছিলেন যুবক ও সুপুরুষ। আর পেশাগত মর্যাদাও ছিল অনেক উঁচুতে। আমার ধারণা তিনি ডরোথি প্রেস্টন গ্রেকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। যমজ দুই বোনের মধ্যে সুন্দরী ছিলেন তিনি। তিনিও জেনারেলের প্রেমে পড়ে যান। এরই মধ্যে অপর এক যমজ বোন মার্গারেটের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি মার্গারেটকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এবং জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া মাত্র তাকে বিয়ে করেন। ডলি যে তার বোনের বিয়েতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন সেটা বোঝা যায় যে, তখন তিনি মরিয়া হয়ে এ্যালিয়েস্টার র‍্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গে প্রেম চালিয়ে যেতে থাকেন। সেই সঙ্গে জেনারেলের কাছে তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তার রাগ, বিদ্বেষ কাটিয়ে উঠে অন্য আর একজনকে বিয়ে করেন এবং তাদের সুখী দম্পতি বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু প্রায়ই র‍্যাভেন্সক্রফটের কাছে গিয়ে থাকতেন, শুধু মালয়েতে নয় বিদেশের অন্য আর এক দেশেও জেনারেলের কর্মস্থলে গিয়ে থাকতেন তিনি। সেই সময় তিনি যথেষ্ট সুস্থ ছিলেন। তাঁর মধ্যে পাগলামোর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। আমার বিশ্বাস এবং বাবাও সব সময় বলতেন লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট তার যমজ বোনের প্রতি আগের মতোই অনুরক্ত ছিলেন। এমন কি আমার আরও মনে হয় ডলির চেয়েও মলি তার যমজ বোনকে মাঝে মাঝে দেখতে চাইতেন। কিন্তু জেনারেল সেটা চাইতেন না। আমার ধারণা এর পিছনে অবশ্যই কোনো কারণ ছিল। আর সেই কারণটা হল ডলির উপস্থিতিতে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া। পুরোনো প্রেমের কথা মনে পড়লে ডলি হয়তো জেনারেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। আর জেনারেলের পক্ষে সেটা বরদাস্ত করা খুবই কষ্টকর বলে মনে হত। যদিও আমার অনুমান যে, তার স্ত্রীর মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তার প্রতি তার যমজ বোনের আগের মতো সেই ঈর্ষা বা ক্রোধের মনোভাব আর নেই।

আমি শুনেছি র‍্যাভেন্সক্রক্টদের আত্মহত্যা করার তিন সপ্তাহ আগে মিসেস গ্যারো তাঁদের কাছে এসেছিলেন।

 হ্যাঁ সেটা খুবই সত্য। তাঁর নিজের সেই বেদনাদায়ক মৃত্যুও ঘটেছিল তখন। ঘুমের মধ্যে প্রায়ই তিনি হেঁটে বেড়োতেন। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়েন আর চলে আসেন সেই উঁচু পাহাড়ে এবং সেই পাহাড়ে থেকেই পড়ে যান মিসেস গ্যারো। পরের দিন সকালে পাহাড়ের খাদে তাকে পাওয়া যায়। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু তার জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। কিন্তু আমি বলতে চাই সম্ভবত আপনিও যেটা জানতে চান, পরবর্তীকালে এক সুখী দম্পতির আত্মহত্যার কারণ সেটা কখনওই হতে পারে না। বোন অথবা শালির মৃত্যু কখনওই কাউকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিতে পারে না। জোড়া আত্মহত্যার ক্ষেত্রে তো নয়ই।

পোয়ারো বললেন, যদি না সম্ভব তার বোনের মৃত্যুর জন্য মার্গারেট দায়ী হবেন।

 ডাঃ উইলবি বললেন, আপনি নিশ্চয়ই সেটা অনুমান করছেন না–

তাঁর কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন পোয়ারো তার কাছে–আপনি কি বলতে পারেন ঘুমন্ত অবস্থায় ভ্রমণরত বোনকে মার্গারেট অনুসরণ করেননি? আর মার্গারেটই হাত দিয়ে ডরোথিকে রাতের অন্ধকারে পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেননি?

উত্তেজিত হয়ে ডাঃ উইলবি তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠেন এবং বলেন, আপনার এই ধারণা কখনই আমি মেনে নিতে পারছি না।

 পোয়ারো বললেন, কিন্তু লোকেদের ধারণা এ-ব্যাপারে কেউ কিছুই জানে না।

.

ইউজিন এবং রোসেনটেল হেয়ার স্টাইলিস্ট এবং বিউটিশিয়ান

মিসেস অলিভার সেলটেনহ্যামের চারিদিকে তাকালেন এবং ভাবলেন এর আগে সেলটেনহ্যামে তিনি কখনও আসেননি। এখানকার জায়গা কত সুন্দর আর বাড়িগুলো কত চমৎকার। তার মনে হল এগুলোই আসল সত্যিকারের বসবাস করার উপযোগী বাড়ি।

 এখানে এসে তাঁর মনে পড়ে যায় যে তার কয়েকজন পরিচিত লোক আছে যেমন তার কাকিমা, মাসিমা অথবা তার আত্মীয়স্বজন। তারা যাদের চিনতেন এই সেলটেনহ্যামেই থাকত। তারা এখন অবসরপ্রাপ্ত। আর্মির অথবা নেভির।

হাতে বেশি সময় থাকলে বিদেশের এই জায়গাটায় বিশ্রাম নেওয়ার পক্ষে খুব ভালো, ইংরেজ মনোভাবাপন্ন লোকেরা এখানে বাস করে। আর এখানকার লোকেদের পছন্দও ভালো এবং তাদের কথাবার্তা বেশ মার্জিত ও আনন্দদায়ক। কতকগুলি দোকানের দিকে তাকিয়ে তিনি একটা দোকান দেখতে পেলেন যেটা তিনি খুঁজছিলেন। দোকানের নাম–দ্যা রোজ গ্রীন হেয়ার ড্রেসিং সেলুন। ভিতরে ঢুকে তিনি দেখলেন চার কী পাঁচজন লোক চুলের পরিচর্যা করছে। বেশ মোটা গোল চেহারার একজন যুবতী তার দিকে এগিয়ে এলো খোঁজ নেওয়ার জন্য। মিসেস অলিভার বললেন, যে, মিসেস রোসেনটেল বলেছেন আজ সকালে এলে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। আমার চুলের ব্যাপারে আমি এখানে আসিনি। আমি তার সঙ্গে একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাই। আমার সঙ্গে টেলিফোনে তার কথা হয়েছে এবং তিনি বলেছেন সাড়ে এগারোটার সময় এলে তিনি আমার জন্য কিছু সময় ব্যয় করতে পারেন।

ও আচ্ছা, মেয়েটি বলল। আমার মনে হয় ম্যাডাম একজনের জন্য অপেক্ষা করছেন।

একটা ছোটো প্যাসেজ দিয়ে তাঁকে সঙ্গে করে একটা সুইং ডোরের সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। সুইং ডোরের নিচে ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল এবং ভিতরে তাঁরা ঢুকলেন। মোটা গোল চেহারার মেয়েটি দরজায় নক করে বলল একজন মহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, কী যেন নাম বলেছিলেন আপনি?

মিসেস অলিভার।

 তিনি ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরটা যেন একটা শোরুম মনে হল। ওয়াল পেপারের ওপর গোলাপ এবং গোলাপের সূক্ষ্ম ডালপালা ঘরে শোভা পাচ্ছিল। তার বয়সি বা বেশ কয়েক বছরের বেশি হবে, সেই সময় সবে সকালের কফি খাচ্ছিলেন।

মিসেস অলিভার বললেন, আপনি কি মিসেস রোসেনটেল?

হ্যাঁ।

আমার অপেক্ষায় ছিলেন?

কী ব্যাপার যে, আপনি এখানে এসেছেন তা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। কারণ আজকাল টেলিফোনের লাইন খুব খারাপ। ঠিক আছে কোনো ব্যাপার নয় আমি আপনাকে আধ ঘণ্টা সময় দিতে পারি। আচ্ছা কফি আপনার চলবে?

না, মিসেস অলিভার ধন্যবাদ জানালেন। আমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় আমি আপনাকে আটকিয়ে রাখব না। আমি আপনার কাছে এমন কতকগুলো কথা জানতে চাই যেগুলো জানি না আপনি সেগুলো মনে রেখেছেন কিনা। আমি শুনেছি এই হেয়ারড্রেসিং-এর ব্যাবসা আপনার দীর্ঘদিনের।

হ্যাঁ। এখন আমি নিজের হাতে এইসব কাজ আর করি না। ওই মেয়েগুলোর ওপর সব ভার দিয়ে দিয়েছি।

এখনও তো আপনি লোকেদের উপদেশ দেন?

মিসেস রোসেনটেল হাসলেন এবং বললেন, তা অবশ্য করি। তার সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মুখ এবং সুবিন্যস্ত বাদামি চুল।

আপনি কী ব্যাপারে এখানে এসেছেন এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

আমি আপনাকে পরচুলের ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই?

এখন তো খুব বেশি পরচুল আমরা তৈরি করি না।

লন্ডনে তো আপনাদের ব্যাবসা ছিল?

হ্যাঁ প্রথমে বন্ড স্ট্রিটে তারপর সেটা স্লোয়েন স্ট্রিটে স্থানান্তরিত করা হয়। সেইসব কান্ট্রিতে আমাদের বড়ো ভালো সময় কেটেছিল। তবে আমি আর আমার স্বামী এখানেও সন্তুষ্ট। এখানে আমরা ছোটো একটা ব্যাবসা চালাচ্ছি। তবে পরচুলের কাজ আমরা আজকাল আর বেশি করি না। তাহলেও আমার স্বামী এখনও পরচুলের সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। টাকওয়ালা পুরুষদের পরচুলের ডিজাইন উনি তৈরি করে দেন। আপনি জানেন বোধহয় পরচুল অনেক পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে। কোনো বয়স্ক লোক যদি পরচুল মাথায় দিয়ে বয়েস কমাতে পারে তাতে তার পক্ষে কাজ যোগাড় করতে বিশেষ সুবিধা হয়ে থাকে। মিসেস অলিভার বললেন, আমি যথেষ্ট অনুমান করতে পারি।

 গল্প করার ছলে বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা কিছুক্ষণ বলে চলেন মিসেস অলিভার, আর মনে মনে ভাবতে থাকেন কী ভাবে কাজের কথাটা শুরু করা যায়।

 হঠাৎ মিসেস রোসেনটেল বলে উঠলেন–আপনি তো অ্যারিয়াডন অলিভার, ঔপন্যাসিক? তাই না?

মিসেস অলিভার অবাক হয়ে গেলেন তার কথা শুনে, কোনো রকমে সেই অবাক হওয়া ভাবটা কাটিয়ে উঠে তিনি বললেন, নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে লজ্জা বোধ হয়। বলতে পারেন এটা আমার স্বভাবজাত অভ্যাস উপন্যাস লেখাটা।

 আপনার অনেক বই আমি পড়েছি। চমৎকার সব বই। আমি আপনার একজন ভক্ত। এখন আপনি বসুন, আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

বেশ ভালো কথা। আমি পরচুলের প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। এটা এমন একটা ঘটনার কথা যা অনেক অনেক বছর আগে ঘটেছিল। এ-ব্যাপারে আপনার কোনো কিছু মনে নাও থাকতে পারে।

আমি অবাক হচ্ছি বহু বছর আগের ব্যাপার নিয়ে আপনি কথা বলতে চাইছেন কেন?

না, ঠিক তা নয়। আমার এক বন্ধু একজন মহিলার প্রসঙ্গে, তার সঙ্গে স্কুলে পড়তাম। তারপর তার বিয়ে হয়ে যায় এবং তিনি মালয়েতে চলে যান। পরে ইংলন্ডে ফিরে আসেন এবং সেখানে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায় তাঁদের পরিবারে। একটা কথা আমি এখনও চিন্তা করছি যে ব্যাপারে লোকেরাও বিস্মিত তার অতগুলো পরচুল রাখার কি প্রয়োজন ছিল? আমার অনুমান সব কটি পরচুল আপনারা যোগান দিয়েছিলেন।

ওহো, সে এক ট্রাজেডি। তার নাম কি যেন ছিল? আমি যতদূর জানি তার নাম ছিল প্রেস্টন-গ্রে। তবে পরে তাঁর নাম হয়েছিল র‍্যাভেন্সক্রক্ট, হ্যাঁ লেডি র‍্যাভেন্সটকে আমি জানি, আমি তাকে ভালোভাবেই মনে রেখেছি, কি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। তাঁর স্বামী ছিলেন কর্ণেল বা জেনারেল পদমর্যাদাসম্পন্ন একজন। তারা তখন অবসর নিয়েছেন এবং বাস করছিলেন কান্ট্রি নামটা কী যেন ঠিক মনে পড়ছে না ভুলে গেছি এখন।

 মিসেস অলিভার বললেন, সেখানে বোধহয় একজোড়া খুন হয়ে থাকবে।

হ্যাঁ, আমার মনে আছে সেই ঘটনা। তখন খবরের কাগজে পড়েছিলাম এবং লোকের মুখেও বলতে শুনেছিলাম। ওঁদের দুজনের ছবি খবরের কাগজে দেখেছিলাম। যদিও আমি কখনও সামনে সামনে জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফটকে দেখিনি তবে তার স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম। ঘটনাটা খুবই দুঃখের বলে মনে হয়েছিল। শুনেছিলাম ওঁরা নাকি আবিষ্কার করেন যে মিসেস র‍্যাভেন্সটের ক্যান্সার হয়েছিল। এবং সেই রোগ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সব কিছুই তারা করেছিলেন। আমার অনুমান তেমন আশাপ্রদ কিছু হয়নি বলেই বোধ হয় এমন একটা বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেই জোড়া আত্মহত্যার বিস্তারিত বিবরণ আমি জানতে পারিনি।

আমিও জানি না, বললেন মিসেস অলিভার।

 কিন্তু এ-ব্যাপারে আপনাকে কী বলতে পারি বলুন?

 আপনি তাকে পরচুল যোগান দিয়েছিলেন। পুলিশ তখন ভেবেছিল যে কোনো লোকেরই চারটে পরচুল থাকতে পারে, তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু তার পরিচিতরা বা লোকেরা সেই যুক্তিটা ঠিক মেনে নিতে পারেনি।

মিসেস রোসেনটেল বললেন, তা ঠিক। বেশির ভাগ লোকের দুটো পরচুল থাকে, একটা সার্ভিসিং-এর জন্য যখন আমাদের কাছে পাঠানো হয় তখন অপরটা ব্যবহার করা হয়। আপনার কি সে কথা মনে আছে যে, লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট যে দুটো বাড়তি পরচুল অর্ডার দিয়েছিলেন?

নিজে অর্ডার দিতে তিনি আসেননি, আমার যতদূর মনে হয় তখন তিনি হাসপাতালে ছিলেন এবং একজন ফরাসি যুবতী এসেছিলেন। আমার মনে পড়ছে এ ফরাসি যুবতী একবার কী দুবার লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটের সঙ্গে এসেছিলেন। খুব ভালো মেয়ে ছিল সে এবং খুব পরিষ্কার ইংরিজি বলত। তিনি কেন বাড়তি দুটো পরচুল চান তার সুন্দর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিল মেয়েটি। পরচুলের মাপ, রঙ এবং স্টাইলের বিবরণ দিয়ে অর্ডার দিয়েছিল সে, সেই ঘটনার কথা এখন আর ঠিক মনে করতে পারি না। তবে একটা ঘটনার কথা ছাড়া, সেটা একমাস বা তার থেকেও বেশি হবে। খবরের কাগজে সেই আত্মহত্যার ঘটনার কথা জানেন। আমার আশঙ্কা এই খবরে তিনি এমন মুষড়ে পড়েন এবং তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন যে তিনি আর বেঁচে থাকবেন না। আর তার স্বামীও মনে করেন তাকে ছাড়া তিনি বেঁচে থাকবেন কী করে?

দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়লেন এবং জিজ্ঞেস করলেন মিসেস অলিভার, সেগুলো কি বিভিন্ন ধরনের পরচুল ছিল?

হ্যাঁ চারটে পরচুলের মধ্যে একটাতে ছিল ধূসর রঙের দাগ, দ্বিতীয়টা ছিল খুবই সুন্দর। তৃতীয়টা ছিল সন্ধ্যার সময় ব্যবহারের জন্য আর শেষেরটা ছিল ঘন কোঁকড়ানো। সবকটা পরচুলই টুপির নিচে পড়লে চুল অবিন্যস্ত হয় না এবং ভারি সুন্দর দেখায়। লেডি র‍্যাভেন্সটকে আর দেখা যাবে না কোনোদিন, ভাবতেই বড়ো দুঃখ লাগছে। তার অসুখ ছাড়াও তার বোনের মৃত্যুর জন্য তিনি খুব অসুখী ছিলেন কারণ আপনি জানেন হয়তো ওঁরা দুজন যমজ বোন ছিলেন।

মিসেস রোসেনটেল বললেন, আগে সব সময়ই ওঁকে সুখী মহিলা দেখাত।

দু-জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং মিসেস অলিভার প্রসঙ্গ পালটালেন।

আপনার কি ধারণা পরচুল আমার কার্যকর বলে মনে হবে? প্রশ্ন করলেন তিনি।

অভিজ্ঞ হেয়ার ড্রেসার মিসেস রোসেনটেল মিসেস অলিভারের মাথায় হাত দিলেন এবং বললেন, আপনাকে পরচুল ব্যবহার করতে পরামর্শ দেব না–কারণ আপনার মাথায় অনেক চুল আছে এবং বেশ ঘন। আমার অনুমান–তিনি একটু হেসে বললেন, এতেই আপনি আপনার জীবনটা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করেন তাই না?

 আমি দেখছি আপনি সব জানেন এবং খুব চালাক আপনি। খুব সত্যি কথা, এই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে আমি বেশ উপভোগ করে থাকি। যা সত্যিই মজার ব্যাপার।

জীবনটাকে আপনি চুটিয়ে উপভোগ করেন তাই না? হ্যাঁ নিশ্চয়ই করি বৈকি। তবে আমার মনে হয় এটা এমন একটা অনুভূতি যা কেউ জানতে পারে না পরে কী হবে।

মিসেস রোসেনটেল বললেন, তবু সেই অনুভূতি ঠিক এমনি যে, অনেক মানুষই চিন্তা থেকে কখনও বিরত হয় না।