টুপেনসের মনে ক্ষীণ সন্দেহ জেগেছিল, কার্ল ভন দিনিম বেটির অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেল ঘটনার কথা শুনে সকলের মতো সে-ও হতচকিত।
মেজর ব্লেচলি এগিয়ে এসে মিসেস স্প্রটকে বললেন, আপনি শান্ত হয়ে বসুন। এক চুমুক ব্রাণ্ডি খেয়ে চাঙা হয়ে নিন, আমি এখুনি থানার সঙ্গে যোগাযোগ করছি।
মিসেস স্প্রট তাকে বাধা দিয়ে মৃদুকণ্ঠে বলেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি ঘর থেকে আসছি–
কথা শেষ না করেই তিনি একছুটে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলেন। মিনিট দুই পরেই আবার তাকে সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল। লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছেন।
মেজর ব্লেচলি থানায় ফোন করবেন বলে সবে রিসিভার তুলেছিলেন। ঝড়ের বেগে ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরলেন মিসেস স্প্রট।
মেজর ব্লেচলিকে হকচকিয়ে দিয়ে এক ঝটকায় রিসিভারটা কেড়ে নিয়ে শঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ফোন করবেন না–মেজর, পুলিশকে জানাবেন না
বলতে বলতে থপ করে একটা কুশনের ওপরে বসে পড়লেন। জ্ঞান হারালেন মিসেস স্প্রট।
সকলেই অস্থির হয়ে ছুটে এলেন তার কাছে। মিনিট দুই অচৈতন্য থাকার পর সংজ্ঞা ফিরে পেলেন মিসেস স্প্রট। মিসেস ক্লে ধরাধরি করে তাকে সোজা করে বসিয়ে দেন।
মিসেস স্প্রটের চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। কাঁপা হাতে একখণ্ড কাগজ তিনি এগিয়ে ধরেন।
–বেটিকে খোঁজার সময় মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, তখন দেখার সময় পাইনি। আমার সন্দেহ হতে ছুটে গেলাম এখন। একখণ্ড পাথর মুড়ে কেউ আমার জানালা গলে ছুঁড়ে দিয়েছিল সম্ভবত, লেখাটা পড়ে দেখুন
সকলেই এগিয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। টমি মিসেস ক্লের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে চোখের সামনেই মেলে ধরল।
বড় বড় অক্ষরে লেখা চিরকুট। লেখার ধাঁচে বিদেশী ছাপ স্পষ্ট।
আপনার শিশুটি আমাদের কাছে নিরাপদেই থাকবে। অযথা পুলিশের কাছে গিয়ে আপনার সন্তানের প্রাণ বিপন্ন করবেন না। গোপনীয়তা রক্ষা করবেন। পরে আমাদের নির্দেশ পাবেন, সেই মতো কাজ করবেন। অন্যথা করলে শিশুটি খুন হবে। ধন্যবাদ
চিঠির নিচে কোনো স্বাক্ষর নেই। কেবল আড়াআড়ি দুটো হাড়ের ওপর মানুষের খুলির ছবি আঁকা।
–বেটি–আমার বেটি–
থেকে থেকে কঁকিয়ে উঠছেন মিসেস স্প্রট। নানাজনে নানারকম মন্তব্য করতে লাগলেন। পরামর্শের গুঞ্জনও শোনা যেতে লাগল। সহসা জোরালো গলায় বলে উঠলেন মেজর ব্লেচলি, চুপ করুন তো সকলে। ওসব ছেলেমানুষি হুমকিতে ভয় পেলে চলে না। আমরা এখুনি পুলিশে ফোন করব।
বলতে বলতে সশব্দে রিসিভার তুলে নিলেন মেজর।
ভীত বিহ্বল মিসেস স্প্রট দু-হাতে আঁকড়ে ধরে আগের মতোই বাধা দিলেন মেজরকে।
-না, টেলিফোন করবেন না, ওরা আমার মেয়েকে খুন করবে।
–বোকার মতো কথা বলবেন না, ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলেন মেজর, ওদের সে সাহস হবে না।
-না, আপনাকে ফোন করতে দেব না। এবারে স্বরে দৃঢ়তা প্রকাশ পেল মিসেস স্প্রটের, আমি ওর মা, পুলিশকে কিছু বলতে হয় আমি বলব।
মিসেস স্প্রটের বক্তব্য অপমানকর হলেও মেজর গায়ে মাখলেন না। মিসেস স্প্রটকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।
আপনি আপনার সন্তানের জন্য বিচলিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি, এখনই আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।
টমি পাশে দাঁড়িয়েছিল। মেজর তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মিঃ মিয়াদো আপনার মতামত কী?
টমি ঘাড় নেড়ে নীরবে মেজরকে সমর্থন জানাল।
মিঃ ক্লেও একই মতামত ব্যক্ত করলেন, ঘটনাটা পুলিশকে জানানোই কর্তব্য।
-কিন্তু না-পুলিশে জানাবেন না–ওরা বেটিকে মেরে ফেলবে।
কথা শেষ করে কাতর দৃষ্টি মেলে মিসেস ক্লে তাকালেন টুপেনসের দিকে।
পরে মেজরকে বললেন, আপনি কেবল পুরুষদেরই মতামত নিচ্ছেন, মেয়েদের কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন না।
সকলের দৃষ্টি পড়ে টুপেনসের ওপরে। সে মিনমিনে গলায় বলে, মিসেস স্প্রট ঠিক কথাই বলছেন।
মুখে একথা বললেও টুপেনস বুঝতে পারছিল এই মুহূর্তে পুলিশে খবর দেওয়াই কর্তব্য।
ঘরের অন্যান্য মহিলারাও টুপেনসের বক্তব্য সমর্থন করলেন।
মিসেস পেরিনা এতক্ষণ ছিলেন না। সেই মুহূর্তে এসে সবকিছু শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মন্তব্য করলেন, পুলিশ কি করবে, সব কাজেই ওরা সমান অপদার্থ। পারেন তো নিজেরাই বাচ্চাটাকে খুঁজে বার করুন।
মিসেস পেরিনার ব্যক্তিত্বই শেষ পর্যন্ত কার্যকরী হল। বেটিকে খুঁজতে বেরোনোই সাব্যস্ত হল।
পরামর্শ চলল। টমি ও মেজর ব্লেচলির পরামর্শে স্মাগলার্স রেস্ট-এ কমাণ্ডার হেডককে খবর পাঠানো হল।
হেডকের একটা গাড়ি আছে। তার ওপর তিনি অভিজ্ঞ বলশালী মানুষ। তার সাহায্য সবদিক থেকেই কাজে লাগবে।
মিসেস স্প্রট বললেন, উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে আমিও থাকব।
.
বেটিকে খুঁজতে বেরবার জন্য তৈরি হলেন হেডক, মেজর ব্লেচলি এবং টমি। মহিলাদের মধ্যে মিসেস স্প্রটকে নিয়ে দুজন। অপরজন হল টুপেনস।
উদ্ধারকারী দলের নেতা হলেন হেডক। তারই ছোটো সাদা রং-এর গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে উঠে পড়লেন সকলে। পেছনে রইলেন মহিলারা। দলের মধ্যে একমাত্র টুপেনসই সেই বিদেশিনী মহিলাকে চেনে।
গাড়িতে ওঠার পরে আচমকা একটা ছোটো পিস্তল টমির চোখের সামনে তুলে ধরল। চমকে উঠে বিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল টুপেনস।
–মেজর ব্লেচলির পিস্তল, চাপা স্বরে বললেন মিসেস স্প্রট, দরকার লাগতে পারে ভেবে ওর ঘরে ঢুকে নিয়ে এলাম।
এমন একটা অপ্রত্যাশিত সংবাদে অতিমাত্রায় বিস্মিত হল টুপেনস। অন্যের পিস্তল হাতিয়ে নিয়ে এসেছেন মহিলা এ একেবারে অকল্পনীয় ব্যাপার।
উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ ধরে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে কমাণ্ডার হেডকের গাড়ি। সোজা স্টেশনে এসে থামল। নানান জনকে জিজ্ঞেস করা হল।
বেঁটে মতন একটি লোকের কাছে কার্যকরী সংবাদ পাওয়া গেল। লোকটি নিজে থেকেই এগিয়ে এসে জানাল, আপনার একটা বাচ্চা মেয়েকে খুঁজছেন তো? কিছুক্ষণ আগে আমি তাকে দেখেছি, এরনেস ক্লিক রোডে একজন বিদেশিনী মহিলার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। বাচ্চাটার গায়ে ছিল সবুজ ফ্রক।
একেবারে নির্ভুল হদিশ। হেডক গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন সঙ্গে সঙ্গে।
-কী রোড বললেন–এরেনস ক্লিক? কোনো দিক দিয়ে গেলে সুবিধা হবে বলুন তো।
বেঁটে লোকটি বলল, রাস্তাটা শহরের বিপরীত দিকে। এসপ্লানেড ধরে পুরোনো শহর পার হয়ে যেতে হবে। পাহাড়ি পথ ধরে সোজা ওপরে
লোকটির কথা শেষ হবার আগেই গাড়ি চলতে শুরু করল।
ঝড়ের গতিতে ছুটে কিছুক্ষণে মধ্যেই গাড়ি পৌঁছে গেল এরনেস ক্লিক রোডের খাড়াই পথের প্রান্তে।
খাড়াই এবং সংকীর্ণ পথ হেডকের গতি রোধ করতে পারল না। অবিশ্বাস্য দক্ষতায় তিনি গাড়িটাকে তুলে নিয়ে এলেন এই পথের মাথায়।
এর পরেই শুরু হয়েছে ঢালুপথ। তার শেষ হয়েছে হোয়াইট হেভেন বেতে।
জায়গাটা আগাছা আর ঘাসে ঢাকা হলেও এখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। বড় বড় পাথরের চাই আশপাশে থাকলেও দৃষ্টি বাধা পায় না।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন ব্লেচলি। চারপাশে দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি বললেন, এই বিস্তীর্ণ এলাকায় মেয়েমানুষটাকে খুঁজে বার করা কষ্টকর হবে।
হেডক বললেন, কোনো দিকেই তো কিছু নজরে আসছে না।
গাড়িতে ফিরে গিয়ে একটা দূরবিন নিয়ে এলেন তিনি। সেটা চোখে লাগিয়ে চারপাশ জরিপ করতে শুরু করলেন।
দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একজায়গায় এসে স্থির হয়ে গেলেন। দূরে দুটো চলমান বিন্দু লেন্সে ধরা পড়ল
-ওই তো–দেখতে পেয়েছি–পরিষ্কার দেখাচ্ছে।
প্রবল উত্তেজনায় ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন হেডক। অন্য সকলেও ছুটে এলেন। এরপর দক্ষ হেডকের গাড়ির শব্দে নিঝুম পাহাড়ি পথ জেগে উঠতে লাগল।
ঝড়ের গতি গাড়ির চলমান চাকায়। বহু দূরে প্রায়-অদৃশ্য চলমান বিন্দু দুটো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল।
হ্যাঁ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এবারে…এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা–তার হাত ধরে ছোট্ট বেটি হাঁটছে, কখনও লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
অনিবার্য উত্তেজনায় সকলের হাত থেকে থেকে মুঠি পাকাচ্ছে–দাঁতে দাঁত চেপে বসেছে।
উত্তেজনা চাপতে না পেরেই সম্ভবত মিসেস স্প্রট আচমকা চিৎকার করে ওঠেন।
সেই চিৎকারের শব্দ কানে যেতেই সামনের স্ত্রীলোকটি আকৃষ্ট হয়ে পেছনে ঘাড় ঘোরালো।
ধাবমান গাড়িটিকে দেখতে পেয়েই মুহূর্তের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর একঝটকায় বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটতে শুরু করল।
মেয়েমানুষটি বুদ্ধিমতী। সোজা ছুটল না। গাড়ি যাতে তাকে অনুসরণ করতে না পারে সেজন্য এঁকেবেঁকে ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের কাঁধের কাছে চলে যায়।
উন্মাদের মতো গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মিসেস স্প্রট সামনে ছুটতে লাগলেন। অন্য সকলে ছুটতে লাগলেন তার পেছনে।
বেটিকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিদেশিনী। দুর্বোধ্য ভাষায় গালি দিচ্ছে সক্রোধে।
–হুঁশিয়ার, পেছন থেকে চিৎকার করে ওঠেন হেডক, বাচ্চাটাকে পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে ওই মেয়েছেলেটা
সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভয়ে উদ্বেগে জড়সড়। কী জানি কী হয়। সত্যি যদি মেয়েছেলেটা ভয় পেয়ে বেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
হেডক পকেট থেকে পিস্তল বের করে চিৎকার করে উঠলেন, বাচ্চাটাকে নামিয়ে দাও, নইলে আমি গুলি করব।
বিদেশিনীর মুখে দুর্বোধ্য হাসির ঝিলিক খেলে গেল। সে আরও নিবিড়ভাবে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বেটিকে। গুলি করার সুযোগ সে রাখতে চায় না।
হেডক থমকে যান। স্তিমিত কণ্ঠে বলার চেষ্টা করেন, আমি কিন্তু গুলি চালাব…
ঠিক সেই মুহূর্তে গুলির শব্দ হল গুড়ুম
চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকান সকলে। দেখা গেল মিসেস স্প্রটের হাতে পিস্তল ধরা–
সামনের স্ত্রীলোকটি ততক্ষণে বেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেই পাহাড়ের ওপরে আছড়ে পড়ল। থর থর করে কাঁপছে তার শরীর। সকলে এগিয়ে যায় তার দিকে।
হাঁটু গেড়ে বসল টমি। তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে বিদেশিনী। একসময় মাথাটা হেলে পড়ল একপাশে। মাথায় রক্ত। বুলেট কপাল ভেদ করে গেছে।
পেছন থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে বেটিকে কোলে তুলে নিলেন মিসেস স্প্রট।
–আমার বেটি। ওঃ ভগবান, তোমার কোনো আঘাত লাগেনি।
মৃতার নিথর মুখের দিকে চোখ পড়তেই স্তিমিত হয়ে আসে তার কণ্ঠস্বর। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করেন, আমি–আমি খুন করেছি।
-এখন ওসব ভাববেন না। আপনি বেটিকে সামলান। বলল টুপেনস।
হেডক বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, তাজ্জব ব্যাপার, আমি সাহস পেতাম না। কিন্তু আনাড়ি হাতে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করলেন মিসেস স্প্রট। সত্যিই বিস্ময়কর
–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে বাচ্চাটার ক্ষতি হয়নি। বলল টুপেনস।
.
একজন অপরিচিতার মৃত্যুর ঘটনা হলেও, ঘটনাটা মৃত্যুর। হেডক পুলিশে খবর দিয়েছিলেন। টানাপোড়েন বিশেষ হল না। কেবল সাক্ষী দিতে হয়েছে টমি ও টুপেনসকে।
যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও পুলিশি তৎপরতায় কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল, নিহত মহিলা একজন পোলিশ উদ্বাস্তু। নাম ভান্দা পলোনস্কা। পুনর্বাসন দপ্তরে কাজ করত সে। ধনী আত্মীয়স্বজনের অভাব নেই তার।
মৃতদেহ সনাক্ত করেছেন মিসেস ক্যালফন্ট। তিনি জানালেন, মৃতার মাথায় কিছুদিন থেকেই গোলমাল দেখা দিয়েছিল। পোলান্ডে নির্মম অত্যাচারে চোখের সামনেই সন্তানকে মরতে দেখেছে। তাতেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। তবু তাকে এখানে একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল। গত সপ্তাহে কাউকে কিছু না জানিয়ে সে হঠাৎ উদ্বাস্তু শিবির থেকে পালিয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকারকে সে মন থেকে ঘৃণা করত।…
এই অনভিপ্রেত ঘটনায় মিসেস স্প্রটের স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছিল। তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তার চোখ বেয়ে দরদর ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
–আমি একজনকে খুন করে ফেলেছি–কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না…এত বড়ো একটা অপরাধ আমি করে ফেললাম…বেটিকে ও পাহাড়ের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল…ওকে বাঁচাবার জন্যই…
অফিসার প্রশ্ন করলেন, আপনি কি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার জানেন?
–একদম না। খেলনা বন্দুক ছাড়া কখনও বড়ো কিছু হাতে নিইনি।
-বিস্ময়কর। নিতান্ত আনাড়ি হাতেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন আপনি। মৃতাকে চিনতেন আপনি?
-না, কোনোদিন দেখিনি আগে তাকে।
তার স্বীকারোক্তি থেকে জানা গেল, পোলিশ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি একসময় কিছু উলের জামা বুনে পাঠিয়েছিলেন। ওসব জামা থেকেই সম্ভবত পলোনস্কা মিসেস স্প্রটের নতুন ঠিকানাটা উদ্ধার করে থাকবে।
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত পুলিশি বিচারে রেহাই পেয়ে গেলেন মিসেস স্প্রট। তারপর এই নিস্তরঙ্গ ঘটনার স্মৃতি দুদিনেই সময়ের বুকে ঝাপসা হয়ে গেল।
.
ইঙ্গ-ফরাসি সম্মিলিত বাহিনী ডানক্রিক থেকে পালাতে শুরু করেছে। প্যারির পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। জার্মান বাহিনীর রণকৌশল ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে মিত্রবাহিনীর সমস্ত প্রয়াস।
এমনি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে গোপনে নির্জনে মিলিত হয়েছে টমি ও টুপেনস।
যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিপর্যয়ের বিষয়ে চিন্তিতভাবেই।
টমি বলল, আমি নিঃসন্দেহ, এই বিপর্যয়ের পেছনে কাজ করেছে এক বিরাট অন্তর্দেশীয় চক্রান্ত।
–আমি তোমার সঙ্গে একমত, চিন্তিতভাবে বলল টুপেনস, কিন্তু সরকার কী করবে, উপযুক্ত প্রমাণ তো দরকার। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে চক্রান্ত দমন করতে গেলে তা হবে স্বেচ্ছাচারিতা।
-হ্যাঁ, চক্রের নায়ক-নায়িকাদের চিহ্নিত করাটাই হল আসল কাজ। এখানে তবু কিছুটা করতে পেরেছি।
–এখানে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল টুপেনস।
–কার্ল ভন দিনিম ও পলোনস্কার পরিচয় আমরা জানতে পেরেছি।
–ওরা যৌথভাবে কাজ করছিল, আমার ধারণা।
–হ্যাঁ।
–কিন্তু, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। বেটিকে এভাবে অপহরণের চেষ্টা করল কেন?
টমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার কাছেও ব্যাপারটা একটা ধাঁধা হয়ে আছে।
টুপেনস নিশ্চুপ থেকে কী চিন্তা করল। পরে বলল, আমার কী মনে হয় জান, মিসেস স্প্রট সম্ভবত নিজেও জানেন না যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ তার জ্ঞাত রয়েছে। কিংবা তিনি তেমন কিছু বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেটা উদ্ধার করার উদ্দেশ্যেই বেটিকে টোপ করতে চেয়েছিল এজেন্টরা।
–হ্যাঁ, এটা একটা কারণ হতে পারে, বলল টমি, এমন একটা হুঁশিয়ারি লেখা চিঠি তো তিনি পেয়েছিলেন।
টুপেনস চিন্তিতভাবে বলল, মিসেস স্প্রটকে সামনে রেখে একটা ভালো ফঁদ পাতা যেত যদি ভদ্রমহিলা একটু ধীরস্থির চিন্তাশীল হতেন। ওরকম অগভীর মনের মানুষকে নিয়ে কোনো গুরুতর কাজের পরিকল্পনা নেওয়া যায় না। কথা বা ব্যবহারের কোনো লাগাম থাকে না।
-তবে পুলিশের সঙ্গে কথা বলার সময় বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন।
–হ্যাঁ।
–তারপর কী রকম দুম করে পিস্তল চালিয়ে বসলেন, বল, আমি হলে পারতাম না।
-একেবারেই আনাড়ি। আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে সামান্যমাত্ৰ ধারণা থাকলে কেউ ওইভাবে দুম করে ট্রিগার টিপতে পারে না।
খানিক বিরতি নিয়ে টুপেনস ফের বলল, ওই পোলিশ মহিলাকে প্রথম যেদিন দেখি, মুখটা কেমন চেনা মনে হয়েছিল। কিন্তু মনে করতে পারিনি।
–আগে কখনও দেখেছিলে মনে হচ্ছে?
–ঠিক বুঝতে পারছি না।
-একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ, মিসেস পেরিনার চেহারার সঙ্গে তার মেয়ে শীলার কিন্তু কোনো মিল নেই।
-ওভাবে খেয়াল করিনি। আচ্ছা, মিসেস স্প্রটের ঘরে পাথরে মুড়ে ওই চিরকুটটা কে ফেলতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
বেটি চুরি যাবার পরে ঘরে গিয়ে উনি ওটা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?
–আমার ধারণা মিসেস পেরিনাই কাজটা করেছেন।
–তার মানে তুমি বলতে চাইছ, ওই জার্মান যুবক আর পোলনস্কার সঙ্গে মিসেস পেরিনারও যোগসাজস রয়েছে?
–আপাতত সেরকমই মনে হচ্ছে। মেজর যখন ব্যাপারটা পুলিশে জানাবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছেন ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখ, মিসেস পেরিনা ছুটে এসে কেমন গোটা ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করলেন। পুলিশের ধারে কাছেই ঘেঁষতে দেন না—
–তাহলে কি মিসেস পেরিনাই M?
–আমার বিশ্বাস। তুমি কী ভাবছ?
–আমি M নয় N-এর গন্ধ পাচ্ছি। এবং আমার নজর মেজর ব্লেচলির ওপর।
.
টুপেনস তীব্র চমকে মুখ তুলে তাকাল, উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে ঘরে ঢুকেছে শীলা। মুখ বিষণ্ণ। কিন্তু চোখ জ্বলছে।
-কী হয়েছে শীলা? উদ্বেগের স্বর ধ্বনিত হল টুপেনসের কণ্ঠে।
–এই মাত্র পুলিশ কার্লকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল।
–সে কী!
ঘটনাটা অজানা নয় টুপেনসের। খানিক আগেই জানালা পথে পুলিশের গাড়ি তার নজরে পড়েছে। তাছাড়া কারণটাও তার জানা। তবু উদ্বিগ্ন হবার ভান করল।
–আমি এখন কী করব? কার্লকে কি আমি আর দেখতে পাব না? আকুল স্বরে জানতে চাইল শীলা।
–অত ভাবছ কেন, শীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল টুপেনস, বুঝতেই তো পারছ, এখন যুদ্ধের সময়, আর কার্ল একজন বিদেশী, কিছু দিনের জন্য হয়তো তাকে আটকে রাখবে, এছাড়া কিছু নয়–
–কিন্তু পুলিশ যে ওর ঘর সার্চ করছে?
–তাতে কী, কিছু যদি পাওয়া না যায়—
কিছুই পাবে না তাঁরা। আপনার কি মনে হয়?
–আমি ঠিক জানি না, তুমি হয়তো জানতে পার।
–আমি! ক্ষুব্ধ দৃষ্টি টুপেনসের মুখের ওপর ফেলল শীলা।
আগের কথার জের টেনে টুপেনস ফের বলল, কিছু পাওয়া না গেলে ও নিরাপদই থাকবে।
-মা বললেন, মিথ্যা মামলা জুড়ে দিতে পারে পুলিশ।
-তোমার মা ভুল বলেছেন। এরকম কাজ তারা করবে না। তুমি নিশ্চিত থাকতে পার–তবে কি জান, জেনেশুনে তোমার অতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া ঠিক হয়নি।
–আপনি কার্লকে পছন্দ করেন না? আপনি কী ভাবছেন কাল
–অসম্ভব নয় শীলা। কার্ল তার জন্মভূমির হয়ে কাজ করতেই পারে
নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে প্রতিবাদ জানিয়ে শীলা বলে উঠল, না, কখনওই নয়, আমি কার্লকে জানি। ও তার বিজ্ঞানের গবেষণা নিয়েই ডুবে ছিল। এই সুযোগ পাওয়ার জন্য ও ইংলন্ডের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল।
এখানে উদ্বাস্তু হয়ে এলেও তার আত্মসম্মানজ্ঞান ছিল প্রখর। নিজের দেশের প্রতিও মমত্ব ছিল। কিন্তু নাৎসীদের ঘৃণা করত মন থেকে। স্বপ্ন দেখত নাৎসীমুক্ত স্বাধীন জার্মানির।
-হ্যাঁ, ওরকমই বলত সে বলল টুপেনস।
–সে কারণেই কি আপনার ধারণা কার্ল একজন গুপ্তচর?
–সম্ভাবনার কথাই বলছি আমি।
উঠে দাঁড়াল শীলা। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, আমার বিশ্বাস ছিল আপনি অন্যদের থেকে আলাদা, তাই আপনার সাহায্য চাইতে এসেছিলাম। আমি দুঃখিত।
শীলার কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে উঠল, কোনো রকমে বলল, আমি জানি কার্লকে ওরা আর বাইরে আসতে দেবে না, একদিন গুলি করে মারবে ঠিক।
.
–বেটিকে অপহরণ করার একটা কারণ আমি খুঁজে বের করেছি।
টমিকে বলল টুপেনস।
–শুনি তোমার যুক্তিটা কী? উদ্গ্রীব হল টমি।
-একদিন দুপুরে আমার ঘরে ঢুকেছিল বেটি, তোমাকে বলেছিলাম, নিশ্চয় মনে আছে, উল লেস জড়ো করে একগ্লাস জলে ফেলে ঘুটছিল…বাচ্চারা যা দেখে তাই অনুকরণ করবার চেষ্টা করে। নিশ্চয়ই ও কোনো দিন কার্লকে ওভাবে রাসায়নিক তরলে কাগজ ফেলে অদৃশ্য লেখা উদ্ধার করতে দেখেছিল। বেটি তো ইদানীং কথা বলতেও শিখেছে। বাচ্চাটাকে তাই সে বিপজ্জনক ভেবেছিল আর তারই ইঙ্গিত পেয়ে পোলিশ মহিলাটি বেটিকে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল।
.
যুদ্ধের অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। ফ্রান্সের ভাগ্যাকাশে চরম সংকট ঘনায়মান। ফরাসি উপকূলভূমি গেস্টাপোেদের অধিকারে চলে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে তারা ইংলন্ড অভিমুখে অভিযান করতে পারে। চতুর্দিকে হতাশা আর আতঙ্ক।
কার্ল ভন দিনিমকে কবজা করা গেছে, টমি বলল, কিন্তু গুপ্তচক্রের আসল মাথাটিই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
–হ্যাঁ–মিসেস পেরিনা-সমস্ত কর্মকাণ্ডের নেত্রী। নাগাল ধরা সহজ হবে না। বলল টুপেনস।
–আর শীলা?
–না, না, ও এসবের মধ্যে নেই।
–তুমি নিশ্চিত?
–হ্যাঁ।
–তাহলে নিজে বেঁচে যাবে। প্রেমিককে হারিয়েছে, এবারে মাকে হারাবে। কষ্ট হয় দুর্ভাগা মেয়েটির জন্য। বলল টমি।
–আমাদের কী করার আছে বল।
–কিন্তু আমাদের ধারণা যদি ভুল হয়? অর্থাৎ M বা N যদি অন্য কেউ হয়?
–পরের কথা এখন ভেবে কী লাভ। আপাতত মিসেস পেরিনার ওপরে নজর রাখাই আমাদের কর্তব্য। পরে যদি ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়, তখন করণীয় ভাবা যাবে।
–আমাদের পুরোনো অনুগত কর্মী অ্যালবার্টকে তুমি এ-ব্যাপারে কাজে লাগাতে পার।
–তোমার বলার আগেই আমি তার কথা ভেবেছি। তাকে খবরও পাঠিয়েছি। কিন্তু তুমি কতদূর কী করলে?
–আমি…আপাতত গলফ ক্লাবে যাতায়াত করছি।
.
যৌবনে টমি ও টুপেনস যখন দুর্বার ছিল, যৌথভাবে বহু দুঃসাহসিক কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে, অ্যালবার্ট সহযোগী হিসেবে তাদের পাশে থেকেছে।
সেই হাসিখুশি বুদ্ধিমান যুবক এখন যৌবনোত্তীর্ণ। শরীরে মেদ জমেছে। দেখতে ভারিক্কি হলেও মনটি আগের মতোই সতেজ আছে।
এতদিন পরে আবার তাকে ডেকে এনে টমি ও টুপেনস একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বে নিয়োগ করল…
.
গলফ মাঠে কমাণ্ডার হেডক আর টমি। একটা জোরালো শট হাঁকড়াবার পর টমি জিজ্ঞেস করল, ব্লেচলির সঙ্গে আপনার অনেক দিনের পরিচয়?
হেডকও কম যান না। অধিকতর জোরালো শটে বাজিমাত করলেন। মুখময় হাসি ছড়িয়ে বললেন, ব্লেচলির কথা বলছেন? গত শরতে এখানে এসেছে–তার সঙ্গে আমার জানাশোনা এই নমাস হল।
–উনি আপনার বন্ধুদের বন্ধু–এরকম বলেছিলেন।
মিথ্যা হলেও জোরের সঙ্গেই মন্তব্যটা উচ্চারণ করল টমি।
–এরকম বলেছিলাম? থমকে যান হেডক, না, না, তা কী করে হয়? এই গলফ ক্লাবেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়? কিন্তু ও-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
মানুষটাকে কেমন রহস্যময় মনে হয়, তাই না?
অবাক চোখে তাকান হেডক। তরল হেসে বলেন, ধ্যাৎ, কিসের রহস্য ওর মধ্যে?
স্টিক ঘুরিয়ে আর একটা সুন্দর শট নিল টমি। হেডক নিজের স্টিক বাগিয়ে ধরলেন। বললেন, বুড়ো ব্লেচলি সোজাসাপ্টা সৈনিক মাত্র। তাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে কেন আপনার?
–আসলে এই এলাকায় হঠাৎই এসে উদয় হয়েছেন তোতার অতীত সম্পর্কে কেউই কিছু জানে না।
খেলা চলল আরও কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত জিত হল কমাণ্ডারের। সাফল্যের আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে বললেন, ব্লেচলি আগে রাগবিশায়রে ছিল।
–আপনি ঠিক জানেন?
জবাব দিতে গিয়েও থমকে গেলেন কমাণ্ডার। দ্বিধাজড়িত স্বরে বললেন, না–মানে ঠিক নিশ্চিত নই। তবে, ঠিকই, একটু কেমন যেন।
দুজনে হেঁটে এসে দুটো চেয়ার নিয়ে পাশাপাশি বসলেন।
–আমিও তাই বলতে চাইছি।
টমি তীক্ষ্ণ চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকে হেডককে।
–আপনার কথা শুনে মনে পড়ল, চোখ পিটপিট করে বলতে থাকেন হেডক, ব্লেচলিকে আগে থেকে চেনে এমন কাউকে এখানে নজরে পড়েনি। ওর সম্পর্কে কিছু কানে এসেছে নাকি?
-না, সেসব কিছু নয়।
–আমাকে গোপন করার কিছু নেই মিয়াদো। এখানে সকলেই আমার কাছে আসে, সবকথাই কানে আসে।
–সেটা জানি বলেই তো আপনার অভিমত জানতে চেয়েছি।
হেডক নড়েচড়ে বসলেন। তার চোখে পিটপিটানি ঘন হল।
–ব্লেচলি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? ওকে জার্মান বলে সন্দেহ করলে কিন্তু ডাহা ভুল হবে। আমার মতোই একজন খাঁটি ইংরেজ ব্লেচলি।
-না, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
জার্মানদের ও মন থেকে ঘৃণা করে। দেখেছেন তো কার্লকে দেখলেই কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠত…স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে কালের বিষয়ে আমি জেনেছি। সবাই জানত সে গ্যাস সম্পর্কে গবেষণা করছে, আসলে তার আসল মতলব ছিল এখানকার জলের ট্যাঙ্কটাকে বিষাক্ত করে তোলা।
টমি যেন স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কিছু। নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, না, ব্লেচলি সম্পর্কে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।
–আমারও তাই অভিমত। বলেন হেডক।
আলোচনার এখানেই ইতি পড়ল। গলফ ময়দানে ততক্ষণে অনেক খেলোয়াড় জমায়েত হয়েছে। আর-এক প্রস্থ খেলার জন্য হেডক আর টমিও উঠে পড়ল।
স্টিক হাতে নিতে নিতে হেডক বললেন, একদিন আমার এখানে আসুন। ব্লেচলি সম্পর্কে একটা গুজব এখানে চালু আছে, আপনাকে শোনাব।
.
স্মাগলার্স রেস্ট-এ হেডকের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে পরিতৃপ্ত হল টমি। খাদ্য ও পরিবেশনের পরিপাটি, ঝকঝকে টেবিলপত্র বিশেষভাবে তাকে চমৎকৃত করল। হেডক ভাগ্যবান, তার পাঁচক-পরিবেশক কর্মচারীটি অতিশয় নিপুণ।
চেহারায় যেমন পরিপাটি, তেমনি চমক লাগানো আদবকায়দা। লন্ডনে প্রথম শ্রেণির রেস্তেরাঁর ওয়েটারও তার কাছে হার মানবে।
বিয়ারের বোতলে চুমুক দিতে দিতে টমি হেডকের কর্মচারীটির পঞ্চমুখে প্রশংসা করল।
এপেলডোরের সত্যিই তুলনা হয় না, সহাস্যে মন্তব্য করলেন হেডক, ভাগ্যে এরকম কাজের লোক পাওয়া যায়।
–সন্ধান পেলেন কোথায়? জানতে চাইল টমি।
বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। নামিদামি হোটেলে কাজ করে এসেছে।
এভাবে কথাবার্তা চলতে চলতেই অনিবার্যভাবে মেজর ব্লেচলির প্রসঙ্গ উঠল। কিন্তু দেখা গেল, হেডক আজ আর তেমন উৎসাহী নন। তিনি বরং মুখর হয়ে উঠলেন ইংলন্ডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে।
হেডক বললেন, আমি ভেবে পাই না লিহাম্পটনের মতো এমন একটি সমুদ্র-নিকটবর্তী স্থান কী করে এমন অরক্ষিত রাখা হয়।
জার্মান ডুবোজাহাজ যে কোনো সময় এখানে এসে হানা দিতে পারে। আকাশ থেকে ছত্রীবাহিনী নামিয়ে দিতেও কোনো বাধা নেই।
টমি হেডকের আক্ষেপ শুনে যেতে থাকে। আর এপেলডোরের নীরব আনাগোনা লক্ষ্য করতে থাকে।
এক সময় সে টেবিলে হুইস্কির বোতল সাজিয়ে দিয়ে যায়। তীক্ষ্ণ নজরে টমি তার মুখের দিকে তাকায়। মাথাভর্তি চুল, নীল চোখ। দেখলে ওয়েটার বলে মনে হয় না। চালচলনও অন্যরকম।
সন্দেহ দেখা দেয় টমির মনে। ছদ্মবেশে কেউ হেডককে প্রতারিত করছে না তো?
হেডক সমানে বকবক করে চলেছেন।
এদিকে জার্মানির গুপ্তচরবাহিনী কোথায় না ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের আশপাশেই তাদের নিঃশ্বাস টের পাওয়া যাচ্ছে। সব সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।…ধরা পড়েছে দু-একটা ক্কচিৎ কখনও।
প্রসঙ্গটাকে হাতছাড়া করল না টমি। হেডকের কথায় সুর মেলাল, আমাদের মাথামোটা পুলিশদেরও যা জিজ্ঞাসাবাদের বহর। কোনো স্পাইকে আটক করেই দুম করে জিজ্ঞেস করে বসে, তুমি কে হে? এম না এন?
টমির মুখ থেকে উচ্চারিত কথা যেন মুহূর্তে ঘরের ভেতরে ভূমিকম্প ঘটিয়ে দেয়।
ওয়েটারের হাত থেকে সোডার বোতল ও খানিকটা মিষ্টি রস ছড়িয়ে পড়ে। লোকটি মাথা নিচু করে দুঃখ প্রকাশ করে, আমি দুঃখিত স্যার।
টমি লক্ষ করে লোকটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে।
হেডক হই-হই করে ধমকে ওঠেন। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। কপালে ঘামের রেখা। ফুটে ওঠে।
টমির জামায় হাতে মিষ্টি রস ছলকে পড়েছিল। হেডক বললেন, আসুন বাথরুমে হাতটা ধুয়ে ফেলবেন।
টমিকে বাথরুম অবধি পৌঁছে দিয়ে গজগজ করতে থাকেন, এমন অপদার্থ..লাফঝাঁপ ছাড়া কাজ করতে পারে না…
.
বাথরুমে ঢুকে হাত জামা পরিষ্কার করে নিতে থাকে টমি।
হেডক বাইরে দাঁড়ানো। তার তর্জনগর্জন এখনও শেষ হয়নি।
-বুঝলেন মিয়াদো, মেজাজ চড়ে গেলে আমার আর হুশ থাকে না। ভাগ্যে এপেলডোরের মতন কাজের নোক পেয়েছি।
সামান্য ভুলচুক সকলেরই হতে পারে…কিন্তু আমি একেবারে বরদাস্ত করতে পারি না। এপেলভোর অবশ্য আমার মেজাজ বুঝতে পারে…তাই রক্ষে।
বেসিনে হাত ধুয়ে বিপরীত দিকের ভোয়ালেতে হাত মুছবার জন্য এগুতে গিয়েই…একটু বুঝি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল…খেয়াল করেনি টমি…বাথরুম পরিষ্কার করবার জন্য একখণ্ড সাবান আর একটা ভোয়ালে ফেলে রাখা ছিল…সেই সাবানের ওপরেই পা চাপিয়ে দিল।
মুহূর্ত মধ্যে যেন প্রলয় ঘটে গেল বাথরুমের ছোট্ট পরিসরে। পিছল মেঝেয় সাবানের টুকরোটি টমিকে যেন উড়িয়ে নিয়ে চলল।
এক-পা শূন্যে আর এক-পা দিয়ে কোনো রকমে চলন্ত দেহের ভারসাম্য ঠেকিয়ে… বেসামাল অবস্থায় টমি গিয়ে ধাক্কা মারল দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটা ছোট্ট কেবিনে।
সঙ্গে সঙ্গে কেবিনের ঢাকনা সরে গেল…অমনি এক ভোজবাজি।
টমির চোখ বিস্ফারিত হল। চোখের সামনে দেখতে পেল…ছোট্ট একটা কুঠুরি…আর তাতে রয়েছে ওয়ারলেসের যন্ত্রপাতি, ট্রান্সমিটার…
.
বাইরে হেডকের বকবকানি ততক্ষণে থেমে গেছে। টমির বিলম্ব হচ্ছে দেখে এগিয়ে এসে বাথরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিয়েছেন।
চোখের সামনে ছোট্ট দৃশ্যটাই টমির বোপোদয় ঘটিয়ে দিয়েছে। নিজের মনেই বলে উঠেছে, ছ্যা ছ্যা…কি আহম্মক আমি..লোকটাকে আমি এতদিন ইংরেজ ভেবে এসেছি..কখনও বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি।
অমন বিশাল চোয়াল…চড়া মেজাজ ধমকধামক সবেতেই জার্মান ছাপ স্পষ্ট। তার ওপরে অমন ফিটফাট চেহারার একজন অনুচর…ওয়েটারের ছদ্মবেশে…এই জন্যই M বা N নাম শুনেই অমন চমকে উঠেছিল দু-জনেই…
নেহাত দৈব বশেই রহস্যটা ধরা পড়ল। এর আগে দু-বার পাখি খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে। নাৎসী এজেন্ট হানকে এখানে পাঠানো হয়েছিল প্রথমে। তারপর তাকে সরিয়ে মঞ্চে হাজির হয়েছে দেশপ্রেমিক কমাণ্ডার হেডক।
পুরো ভুয়ো নাম–জলজ্যান্ত N। নিশ্চিন্তে এমন একটা নিরাপদ স্থানে ডেরা বেঁধে এ দেশের ভাগ্য নিয়ে খেলা জুড়েছে। সান্স সৌচিকে বানিয়েছে দ্বিতীয় শিবির…সহযোগী অফিসাররা কিলবিল করছে সেখানে।…
সাবানে পা পিছলে ছোট্ট কেবিনে ধাক্কা খেয়ে মিনিটখানেকের মধ্যেই টমির মনে এতসব কথা বিজবিজ করে উঠল।
সোজা হয়ে সামলে দাঁড়াবার পরেই খেয়াল হল শত্রুর শিবিরে মাথা গলিয়ে দিয়েছে সে, সামলে চলতে না পারলে মহা বিপদ।
সে বুঝতে পারল…তাকে এখান থেকে নিরাপদে বাইরে বেরুতে হলে মোটা মাথার এক ইংরেজের অভিনয় বজায় রাখতে হবে। এছাড়া বাঁচার পথ নেই। সে যে কিছু দেখতে পেয়েছে তা বুঝতে দেওয়া চলবে না।
টমি মাথা তুলে দেখতে পেল বাথরুমের দরজার মাথায় যেন শূন্যে ঝুলছে হেডকের হিংস্র মুখ… নিষ্পলক চোখ জোড়া তার ওপরে নিবদ্ধ।
গোবেচরার মতো হেসে উঠল টমি। হেডক পালটা অট্টহাসি হেসে বলে উঠলেন, আরে আরে মিয়াদো, আপনি দেখছি বাথরুমে একেবারে ব্যালে নাচ জুড়েছেন। হায় হায়…চলে আসুন…অন্য ঘরে যাওয়া যাক।
টমি সামলেসুমলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। তার শরীরের সমস্ত পেশী টানটান হয়ে উঠেছে। ইন্দ্রিয়গ্রাম সজাগ। শত্ৰুপুরী থেকে যেভাবেই হোক তাকে নিরাপদে বাইরে যেতে হবে।
হেডক স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলছেন। নিজের বসার ঘরে নিয়ে এলেন টমিকে। তারপর নিজের হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
শুনুন মিয়াদো, অন্তরঙ্গ সুরে বললেন হেডক, বসুন এখানে, আপনাকে নিভৃতে কয়েকটা কথা বলবার আছে।
টমির পাশে আসন নিয়ে ফের বলতে থাকেন, এসব কথা বাইরের কাউকে বলা চলে না…তবু…আপনাকে বিশ্বাস করি বলে বলছি…আশা করি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন।
–অবশ্যই, টমি সতর্ক কণ্ঠে বলে, আপনি নির্ভয়ে বলুন।
-হ্যাঁ, বলছি। আমার আসল পরিচয় এখানে কেউই জানে না। আসলে আমি হচ্ছি সিক্রেট সার্ভিসের লোক। ডিপার্টমেন্টে আমার গোপন নাম M. I. 42B. x… এমন নাম আগে শুনেছেন?
–শুনিনি। এখন আগ্রহ হচ্ছে…
–বলছি শুনুন। কিন্তু হুঁশিয়ার…কেউ যেন ঘুণাক্ষরে টের না পায়। তাহলে গোটা পরিকল্পনাটাই ভণ্ডুল হয়ে যাবে।
বুঝতে পারছি। আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন…
এরপর হেডক ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানার বিবরণ শোনাতে লাগলেন। আর এক বোকা ইংরেজের ভূমিকা নিয়ে টমি শুনে যেতে লাগল মুখ হাঁ করে।
হাবভাবে এখন হেডক পুরোদস্তুর একজন ব্রিটিশ নাবিক…কিন্তু তার জোরালো চোয়াল, কপালের গড়ন, নাক, গলার স্বর সবেতেই জার্মানসুলভ ছাপ লক্ষ করতে লাগল টমি।
.
রোমাঞ্চকর সব তথ্যের বিবরণ শুনে হাঁপিয়ে উঠল টমি। একসময় উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, আজ এখানেই থাক কমাণ্ডার, অনেক দেরি হয়ে গেল। কাল না হয় বাকিটা শোনা যাবে।
আর মনে মনে জপছে টমি, একবার এখান থেকে বেরুতে পারলে হয়।
টমি শুভরাত্রি জানিয়ে নিজেই দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো…হলঘরে এসে এপেলডোরের সঙ্গে চোখাচোখি হল। আগামী দিনের প্রাতঃরাশ গোছগাছ করছে ট্রের ওপর।
.
নিঃঝুম চারপাশ। স্মাগলার্স রেস্ট-এর আওতা ছেড়ে নিরাপদেই বেরিয়ে এলো টমি। রাস্তায় কাদের কথা বলার শব্দ কানে এলো।
মুখোমুখি হতে চিনতে পারল টমি। পথচারী দু-জনই পরিচিত। হেডকেরও আলাপ আছে এদের সঙ্গে। টমি কথা বলতে বলতে চলতে লাগল তাদের সঙ্গে।
মুক্তির নিঃশ্বাস যে কত আরামপ্রদ বুঝতে পারছে এতক্ষণে টমি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছেন হেডক। তার দরজা বন্ধ করার শব্দও কানে এসেছে। জার্মান স্পাইরা যে এত বোকা হয় জানা ছিল না টমির। স্রেফ বোকা বানিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে।
যুদ্ধ নিয়েই এখন আলোচনা সর্বত্র। ওরা তিনজনও জার্মানির ইংলন্ড আক্রমণের সম্ভাব্যতা নিয়ে মতামত বিনিময় করছে। ব্রিটিশ নৌবহর প্রস্তুত হয়েই রয়েছে…জার্মানরা চ্যানেল পার হবার সময়ই বুঝতে পারবে যুদ্ধ কাকে বলে। তবে এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাশিয়ার ওপর।…
সান্স সৌচির বাগানের দরজার সামনে পৌঁছে গেল সে। গোটা পরিবেশটা যেন ঘুমে ঢলে পড়েছে।
সঙ্গীদের শুভরাত্রি জানিয়ে দরজা ঠেলে বাগানে ঢুকল টমি। মনে মুক্তির আনন্দ…অনাবিল স্ফূর্তি।
রডোডেনড্রন ঝোপটাকে পাশ কাটাতে গিয়ে ঈষৎ মাথা হেঁট করল টমি। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আচমকা ভারি কিছু একটা তার মাথার পেছন দিকে প্রচণ্ড আঘাত করল।
অস্ফুট আর্তনাদ করে শূন্যে লাফিয়ে উঠল টমি। তারপরই টাল খেয়ে দেহটা সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল।
চোখের ওপর যেন কেউ এক বোতল কালি ঢেলে দিল। যন্ত্রণায় মুখ কুঞ্চিত হল।
সংজ্ঞা হারাল টমি।
.
সান্স সৌচির হলঘরে ব্রিজ খেলায় মজে গেছেন চার মহিলা। মিসেস স্প্রট, মিসেস ব্লেনকিনসপ, মিসেস ক্লে এবং মিস মিল্টন।
ইতিমধ্যে খেলা ছেড়ে মিসেস ম্প্রটকে কয়েক মিনিটের জন্য টেলিফোন ধরবার জন্য উঠতে হয়েছিল। ফিরে এসেছিলেন একরকম দৌড়ে। আসনে বসে ঘন ঘন শ্বাস টেনেছেন।
এর কিছুক্ষণ পরেই উসখুস করে উঠলেন মিসেস ক্লে।
–আমায় একটু উঠতে হবে ভাই। মিঃ ক্লে বাগানে পায়চারি করেছেন…ঠান্ডা লাগিয়ে বসবেন…একপলক দেখে আসি…কিছু মনে করবেন না…বাগান থেকে কেমন একটা বিশ্রী আওয়াজ পেলাম…কী করছেন কে জানে…।
বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
এই সময় মিস মিল্টন বলে উঠলেন, শীলাকে দেখতে পেলাম না এবেলা
মিসেস স্প্রট জবাব দিলেন, সিনেমায় গেছে।
–মিসেস পেরিনাও কি সঙ্গে গেছেন? জানতে চাইল টুপেনস।
–ঘরেই তো থাকবেন বলেছিলেন, বললেন মিস মিল্টন, কী সব হিসেবপত্র ঠিক করতে হবে। বেচারি…টাকার হিসেব-নিকেশ নিয়ে জীবনের আমোদআহ্লাদ খুইয়ে বসে আছেন…
সন্ধ্যার পর তো মনে হল একবার বেরিয়েছিলেন, বললেন মিসেস স্প্রট, আমি ফোন করতে গেলাম যখন, সেইমাত্র ফিরলেন।
মিস মিল্টন বলে উঠলেন, তাহলে গিয়েছিলেন কোথাও। সিনেমায় যাননি নিশ্চয়ই.. তাহলে এত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারতেন না।
মিসেস স্প্রট বললেন, মাথায় তো টুপি চোখে পড়ল না। মাথার চুল সব কেমন এলোমেলো হয়ে ছিল। খুব হাঁপাচ্ছিলেন।
দেখে মনে হল কোথাও থেকে ছুটে আসছেন। আমাকে দেখেও কোনো কথা বললেন না, সরাসরি ওপরে উঠে গেলেন।
এই সময় মিসেস ক্লে ফিরে এলেন। নিজের আসনে বসতে বসতে বললেন, মিঃ ক্লে ঠিকই আছেন, বাগানে ঘুরে বেড়োচ্ছেন।
আবার তাস বাটা হল। আর ঠিক সেই সময়েই ঘরে এসে ঢুকলেন মিসেস পেরিনা।
–বেরিয়ে ফিরলেন? হাসিমুখে জানতে চাইলেন মিস মিল্টন।
–আমি বেড়োতে যাইনি তো? তীক্ষ্ণস্বরে বললেন মিস পেরিনা।
–না, মিসেস স্প্রট বলছিলেন কিনা, আপনি সন্ধ্যাবেলা বেরিয়েছিলেন—
ও, মিনিটখানেকের জন্য বেরিয়েছিলাম। আবহাওয়াটা কেমন দেখতে।
মেজাজ যে সরিফ নেই মিসেস পেরিনার রুক্ষস্বরের জবাব থেকেই পরিষ্কার বোঝা গেল।
–আজ আবহাওয়া চমৎকার, বললেন মিসেস ক্লে, মিঃ ক্লে আজ মনের আনন্দে গোটা বাগান ঘুরে বেড়োচ্ছন।
–এ সময়ে বাগানে এত ঘোরাঘুরি কেন, তীব্রস্বরে বললেন মিসেস পেরিনা, যুদ্ধের সময়, যে কোনো মুহূর্তে একটা বোঝা এসে পড়তে পারে। বলতে বলতে তিনি ক্ষিপ্রগতিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
আচমকা অমন বোমার কথা শুনে সকলেই হকচকিয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলার মেজাজ হঠাৎ এমন চড়ে গেল কেন কেউই বুঝতে পারলেন না।
–একেবারে মিলিটারি মেজাজ। বললেন মিসেস ক্লে।
নেশা করে এসেছেন নিশ্চয়। মন্তব্য করলেন মিসেস স্প্রট।
–ব্রিজ নিয়ে বসেছেন…ওঃ দারুণ!
মুখময় হাসি ছড়িয়ে আবির্ভূত হলেন মিসেস ওরুরকি।
–আপনার হাতে ওটা কী? সাগ্রহে জানতে চাইলেন মিসেস স্প্রট।
-ও এটা, হাতুড়ি, বাগানে পড়েছিল। কেউ নিশ্চয় ভুল করে ফেলে রেখে এসেছিল, তাই নিয়ে এলাম।
-বাগানে আবার হাতুড়ি ফেলে রেখে এলো কে? অবাক হলেন মিসেস স্প্রট।
–আমিও তাই ভাবছি। বললেন মিসেস ওরুরকি।
মেজর ব্লেচলি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। তিনিও একটু পরেই ফিরলেন। তার প্রায় পেছনেই ঘরে ঢুকলেন মিঃ ক্লে।
হলঘর আবার জমজমাট হয়ে উঠল।
.
খবরটা একসময় সকলেই জেনে গেল…সাল সৌচির অন্যতম বাসিন্দা মিঃ মিয়াদো সন্ধ্যা থেকেই রহস্যজনক ভাবে উধাও।
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত টুপেনস। তবে টমির এই আকস্মিক অন্তর্ধানে আশান্বিত সে। টমি নিশ্চয় মিসেস পেরিনা কিংবা সমগোত্রের কাউকে অনুসরণ করতে গিয়ে মূল ঘাঁটির সন্ধান পেয়ে গেছে। কাজ সমাধা হলে যথাসময়ে ফিরে আসবে।
মিসেস পেরিনা যারপরনাই বিব্রত। দিন কয়েক আগেই ঘটে গেছে বেটিকে নিয়ে একটা দুঃখজনক ঘটনা।
সান্স সৌচির বাসিন্দাদের চাপে পড়ে পুলিশে ফোন করলেন মিসেস পেরিনা।
মেজর ব্লেচলি কৌতুকের হাসি মুখে মেখে ঘন ঘন আড়চোখে তাকাতে লাগলেন বিধবা মিসেস ব্লেনকিনসপের মুখের দিকে। মহিলার ভাবান্তরটা উপভোগ করতে উন্মুখ তিনি।
একটা অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের সম্ভাবনার আশা দেখতে পেলেও টুপেনস কিন্তু নিশ্চেষ্ট থাকল না। তড়িঘড়ি দেখা করল মিঃ গ্রান্টের সঙ্গে।
টমির কোনো খবর রাখেন না মিঃ গ্রান্ট। বললেন, অস্থির হবেন না। পরবর্তী ঘটনার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।
তবে মিসেস পেরিনা যে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত নন সেই আভাস তিনি দিলেন। তবে এটা জানালেন যে, টুপেনস সেদিন দুপুরে টেলিফোনে আড়ি পেতে যে চতুর্থ কথাটি উদ্ধার করেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ তিনি খবর পেয়েছেন, আগামী মাসের চার তারিখে যাতে ইংলন্ড আক্রমণ করা যায় সেভাবে নাৎসীরা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এরপর অ্যালবার্টকেও টমির নিখোঁজ হবার সংবাদটা জানিয়ে দিল টুপেনস।
এই সময় অভাবিত ভাবেই এন্টনি মার্সর্ডন নামে এক তরুণের সঙ্গে তার আলাপ হয়ে গেল। ছেলেটি বেরেসফোর্ড দম্পতিকে চেনে বলে জানাল।
এক সময় টমির কাছ থেকে কিছু কাজও নাকি পেয়েছিল। টুপেনসের কাছেও করবার মতো কাজ চাইল সে।
টুপেনস তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে দিয়ে চারদিকে সতর্ক নজর রাখার কথা বলে দিল। আরও বলল, জরুরি কোনো সংবাদ থাকলে যেন সান্স সৌচির ঠিকানায় সংকেত-পূর্ণ চিঠি লিখে জানায়।
.
জ্ঞান ফিরলেও সঙ্গে সঙ্গেই চোখ খুলতে পারল না টমি। চোখের পাতা অসম্ভব ভারি হয়ে আছে। সমস্ত শরীরে অসহ্য ব্যথা।
নড়াচড়া করবার ক্ষমতাও নেই, হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঠোঁটের ওপর ব্যাণ্ডেজ সাঁটা–কোনো আওয়াজ বের করবার উপায় নেই।
একসময়-চোখ তুলে ঘন নিরেট অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না টমি। বুঝতে পারল, পাথুরে মেঝেতে পড়ে আছে।
নিজের মনেই হাসল টমি। হাবাগোবার অভিনয় করেও পার পাওয়া গেল না। বিপদের গ্রাসে পড়ে গেছে। এখন ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি হাতড়ে বার করতে হবে।
শরীরে ব্যথা…পেটে খিদের মোচড়…হাত-পা বাঁধা…নিজের অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে
মনে পড়ে গেল ধুরন্ধর হেডক…বাথরুম…ওয়ারলেস..জার্মান ওয়েটার…তারপর সান্স সৌচির বাগানে মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত…
হ্যাঁ আঘাত, অসম্ভব নিরেট কিছুর আঘাত…কিন্তু এই আঘাত কার পক্ষে করা সম্ভব? হেডক তো স্মাগলার্স রেস্ট-এই রয়ে গেল…তার দরজা বন্ধ করার শব্দ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
সেই জার্মান পরিচারকটি কী? কিন্তু সে তো বাড়ির মধ্যেই ছিল। হলঘরে খাবারের ট্রে সাজাচ্ছিল।…কোনো সূত্রই উদ্ধার করতে সমর্থ হল না টমি।
অন্ধকারের বুক চিরে একফালি আলো চোখে পড়ল। ছোট্ট কোনো ঘুলঘুলিই হবে নিশ্চয়…ভাবল টমি।…ঘরের মেঝেয় পড়ে আছে সে…কিন্তু ঘরটা কোথায়?
আচমকা এক ঝটকায় কপাট খুলে গেল। একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল এপেলডোর। সেটা একপাশে বসিয়ে দিয়ে একে একে নিয়ে এলো জলের জাগ, গ্লাস আর চিজ সহ কিছু রুটি।
রুটিন কাজের মতো জিনিসগুলো যথাস্থানে রেখে টমির ঠোঁটের ব্যাণ্ডেজ খুলতে লাগল।
–মুখে টু শব্দ না করে খাবারটা খেয়ে নাও। চেল্লাবার চেষ্টা করলে আবার ব্যাণ্ডেজ সেঁটে দেব।
লোকটা খাবার তুলে তুলে টমিকে খাইয়ে দিল। যথারীতি নীরবে।
খাওয়া শেষ হলে টমি বলল, তোমাদের ব্যাপার স্যাপার কি বলো তো?
এপেলভোর নীরব।
-আমি হেডকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
লোকটা টমির মুখে আবার প্লাস্টার এঁটে দিল। তারপর উঠে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
কয়েক মিনিট পরেই হেডক উপস্থিত হল। পেছনে সহচর এপেলডোর।
টমির মুখ থেকে প্লাস্টার ব্যাণ্ডেজ খুলে নেওয়া হল। হাতপায়ের বাঁধনও আলগা হল। ধীরে ধীরে উঠে বসল টমি।
-চেঁচাবার চেষ্টা করলে খুলি উড়িয়ে দেব।
উদ্যত পিস্তল হাতে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল হেডক।
টমি কিন্তু সুর চড়িয়েই প্রথম কথাটা বলল, মতলবটা কী শুনি, আমাকে এভাবে অপহরণ করা হল কেন?
–অযথা বকবক করো না। আমার সঙ্গে চালাকি করে পার পাবে না, তোমার আসল পরিচয় আমি জানি…
টমি কিছু বলতে চায়। কিন্তু ধমকে তাকে থামিয়ে দেয় হেডক।
-একদম চুপ। তোমার মিথ্যের ঝুরি শোনার মতো সময় আমাদের নেই। তোমাকে নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই…এখান থেকে তুমি বাইরে বেরুতে পারছ না।
পুলিশ কিন্তু বসে থাকবে না–আমি যখন নিরুদ্দেশ
হিংস্র হয়ে ওঠে হেডকের মুখ। চোখ জ্বলে ওঠে।
–পুলিশ তো আজ বিকেলেই এসেছিল। অফিসার দু-জন আমার ঘনিষ্ঠ। তাদের দূরতম কল্পনাতেও ছিল না যে তুমি এ বাড়িতেই অন্ধকুঠুরিতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছ।
–পুলিশ আমাকে ঠিক এখান থেকে খুঁজে বার করবে।
-পুলিশ আর তোমার নাগাল পাচ্ছে না, আজ রাতের মধ্যেই হাপিস হয়ে যাচ্ছ তুমি। একটা ছোট্ট বোট এসে পৌঁছবার কথা আছে, তোমার প্রাণহীন দেহটা তার মধ্যে করেই সাগরে পাচার হয়ে যাবে। কাকপক্ষীতেও তোমার হদিশ পাবে না।
টমি বিলক্ষণ বুঝতে পারল দুর্ভেদ্য ফাঁদেই আটকা পড়েছে সে। নির্বিঘ্নেই এরা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবে। কিন্তু টুপেনস যদি নিরাপদ থাকে তাহলে এরা বেশিদূর এগুবার সুযোগ পাবে না।…কিন্তু তার কী হবে? গোয়েন্দা বিভাগ কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? টুপেনস নিশ্চয়ই এতক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে তার সন্ধানে।
সান্স সৌচি থেকে নিরাপদেই বেরিয়ে গিয়েছিল সে। দু-জন পরিচিত পথচারী তার সাক্ষী রয়েছে। এর পরও কি হেডক আর তার স্মাগলার্স রেস্ট নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে না?
হেডক একসময় বিদায় নিল। তবে যাবার আগে ফের আগের মতোই টমিকে বেঁধে রেখে গেছে। বন্ধন দশায় না থাকলে ঘুলঘুলির ক্ষীণ আলোর উৎস লক্ষ্য করে চিৎকার করতে পারত টমি।
সে অনুমান করতে পেরেছিল রাস্তার ধারে কোনো চোর-কুঠুরিতেই তাকে আটকে রাখা হয়েছে। চিৎকার করতে পারলে বাইরে কারো না কারো কানে ঠিক পৌঁছত। কিন্তু মুখে প্লাস্টার ব্যাণ্ডেজ নিয়ে এখন নিরুপায় পড়ে থাকতে হবে তাকে।
কিন্তু নিশ্চেষ্ট থাকলে চলবে না। টমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল যদি দড়ি বা ব্যাণ্ডেজ আলগা করা যায়।
আধঘণ্টা ধরে হাঁচড়পাঁচড় করেও ব্যর্থ হল টমি। হাঁপিয়ে গেল সে। অন্ধকার প্রকোষ্ঠের বাইরের অবস্থাটা ধারণায় আনবার চেষ্টা করতে লাগল।
এতক্ষণে বেলা পড়ে এসেছে সম্ভবত। হেডক হয়তো গলফ ময়দানে ভিড়েছে। হয়তো তার জন্য কাঁদুনি গাইছে সকলের কাছে। ছদ্ম উদ্বেগ মুখে মেখে প্রতারিত করছে সকলকে।
উৎকর্ণ হয়েছিল টমি। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়েছিল। সহসা তার কানে ধরা পড়ে কারো কণ্ঠস্বর। কে যেন এই ঘরের সংলগ্ন পথে গান গাইছে। ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে কণ্ঠস্বর। গান গাইতে গাইতে লোকটি পথ বেয়ে চলে যাচ্ছে।
বহুকালের পরিচিত গান-গলার স্বরও যেন চেনা মনে হল টমির।
তার মনে পড়ল ১৯১৪ সালে টুপেনসকে খুঁজে বার করার জন্য এই গান সে নিজেই গেয়েছিল। তার সেই অভিযান ব্যর্থ হয়নি।
কার পক্ষে এই ইঙ্গিতপূর্ণ গান গাওয়া সম্ভব হতে পারে?…একমাত্র অ্যালবার্টের পক্ষেই সম্ভব। এ কৌশল তাদের বহুচর্চিত।
টমি সজাগ হল। অ্যালবার্ট তাহলে হাতের নাগালেই তো রয়েছে।
কিন্তু আওয়াজ করে তার মনোযোগ আকর্ষণ করবে সে পথ বন্ধ …কিন্তু অ্যালবার্টকে তার উপস্থিতি তো জানানো দরকার।
এক মুহূর্ত চিন্তা করল টমি। পরক্ষণেই প্রবল বেগে নাসিকা গর্জন আরম্ভ হল তার। মুখ বন্ধ হলেও নাসিকা সক্রিয় হতে তো বাধা নেই। অ্যালবার্ট নিশ্চয়ই এই সংকেতের অর্থ উদ্ধার করতে পারবে।
.
জার্মান এজেন্টদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল ছিল অ্যালবার্ট। তাই টমির নিরুদ্দেশের সংবাদ পেয়েই সে তার পরিকল্পনা ছকে ফেলল।
জার্মান সিক্রেট সার্ভিসকে যে ভাবে তোক ঠেকাতে হবে। নাৎসীদের সাফল্য মানেই তো ফ্রান্সের বিপর্যয়।
টমি সম্পর্কে শেষ সংবাদ হল সে স্মাগলার্স রেস্ট-এ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিল। তারপর রাতে সান্স সৌচিতে ফিরেও এসেছিল।
অ্যালবার্ট প্রথমে সান্স সৌচির প্রবেশ পথ, বাগান পর্যবেক্ষণ করল। কিন্তু সন্দেহ করার মতো কিছু নজরে পড়ল না।
স্মাগলার্স রেস্টের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল সে। মস্ত বাড়িটা যেন ঝিম মেরে আছে। বাইরে থেকে ভেতরের ব্যাপার কিছু আঁচ করার উপায় নেই।
বাড়িটার পাশ ঘেঁসেই সরু পায়ে-চলা পথ। সেই পথেই পা ফেলল অ্যালবার্ট। আর শুরু করল চড়া সুরে সেই পরিচিত গান।
স্মাগলার্স রেস্টের সাদা দরজার কাছাকাছি এসে আবার খানিকটা পিছিয়ে যায় অ্যালবার্ট।
দরজা খুলে গেল। একটা গাড়ি বেরিয়ে এসে বড়ো রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল।
গাড়িতে বসা বিশালদেহী লোকটিকে চোখে পড়তেই অ্যালবার্ট মাথা নাড়ল। মনে মনে বলল, এই তাহলে কমাণ্ডার হেডেক। লোকটা গলফ খেলার সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছে–তার মানে গলফ ময়দানে যাচ্ছে।
অ্যালবার্ট নিজের মনে গানের সুর ভাঁজছে। আড়চোখের দৃষ্টি বাড়ির দরজার দিকে।
একটা লোক বেরিয়ে এলো দরজা ঠেলে…পাহাড়ি পথ ধরে চলে গেল।
অ্যালবার্ট এবার দ্রুতপায়ে বাড়িটার চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগল–গলায় গানের সুর।
বাগানের একপাশে খোঁয়াড় মতো একটা ঘর। অ্যালবার্ট ঘুরতে ঘুরতে সেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।
সহসা গান থেমে গেল..সবিক্রমে যেন কারুর নাসিকা গর্জন করছে। কিন্তু এমনভাবে গর্জনধ্বনি ওঠানামা করছে কেন–কোনো জন্তু নয়তো? নাকি কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
সতর্ক নজরে চকিতে চারপাশটা দেখে নিল অ্যালবার্ট। ব্যাঙের মতো লাফিয়ে গিয়ে দাঁড়াল খোঁয়াড় ঘরে জানালার সামনে।
না; কোনো সন্দেহ নেই…তার সঙ্কেতপূর্ণ গানেরই প্রত্যুত্তর এটা…অ্যালবার্ট হাত বাড়িয়ে একটুকরো কাগজ ভেতরে ফেলে দিল।