মিঃ গোবির রিপোর্ট
পোয়ারোর নির্দেশে ঘরে এসে মিঃ গোবি তার চেয়ারে বসলেন। তিনি তার চার পাশে একবার দেখে নিলেন নির্দিষ্ট কোনো ফার্নিচার বা ঘরের কোনো জিনিসের উদ্দেশ্যে তাকে বলতে হবে। এবং তিনি অন্য দিনের মতো ইলেকট্রিক ফায়ারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। মিঃ গোবির জানা ছিল না যে, কোনো মানুষের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে হয়। তিনি সব সময় নির্বাচন করেন হয় রেডিয়েটের, টেলিভিসন সেট, ঘড়ি প্রভৃতি নয়তো কার্পেট কিংবা মাটি। তিনি ব্রীফকেস খুলে কিছু কাগজ বার করলেন।
আমার জন্য আপনি কি কিছু এনেছেন? বললেন পোয়ারো।
মিঃ গোবি বললেন, হ্যাঁ নানা ধরনের বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করে এনেছি।
সারা লন্ডনে এমন কি সারা ইংলন্ডে বিখ্যাত মিঃ গোবি। কারণ খবরের ব্যাপারে তিনি একজন বিরাট সংগ্রাহক। এই অতি আশ্চর্য কাজটা তিনি যে কী করে করেন কেউ সেটা জানে না। তার কর্মচারীর সংখ্যাও কম। তার পা-দুটো সম্পর্কে একক সময়ে অভিযোগ করে থাকেন তাদের যে রকম ব্যবহার করা উচিত তা তারা ঠিক সেরকম করে না। কিন্তু তার সাফল্য আজও মানুষকে অবাক করে দেয়। মিসেস বারটন কক্স, গীর্জায় তত্ত্বাবধায়ক কর্মচারীর মতন তিনি ঘোষণা করলেন তৃতীয় স্তবক, চতুর্থ অধ্যায়, ইসিয়া বই।
আবার তিনি বললেন, মিসেস বারটন কক্স বিয়ে করেন মিঃ সিসিল অন্তবারিকে। তার বিরাট বোতাম তৈরির কারখানা ছিল এবং তিনি ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আবার রাজধানীতে প্রবেশ করেছেন লিটল স্ট্যান্স মেয়ারের এম. পি. মাত্র চার বছর তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। তারপরই একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। আবার কিছুদিন পরেই তার একমাত্র পুত্র আর একটি দুর্ঘটনায় মারা যায়। মিঃ অন্তবারির এস্টেটের উত্তরাধিকারিণী হন তার স্ত্রী। কিন্তু যতটা আশা করা হয়েছিল ঠিক ততটা নয় কারণ কয়েক বছর হল তাদের ব্যাবসা খুব ভালো চলছিল না। মিস ক্যাথলিন ফেন নামে এক মহিলার জন্যও বেশ মোটা টাকা তিনি রেখে যান। তার সঙ্গে মনে হয় মিঃ অন্তবারির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মিসেস বারটন কক্স তার রাজনৈতিক জীবন চালিয়ে যান। বছর তিনেক বাদে তিনি একটি শিশুকে দত্তক নেন। এবং এই শিশুটি ছিল মিস ক্যাথলিন ফেনের পুত্র। মিস্ ক্যাথলিন দাবি করেন তার পুত্র আসলে মৃত মিঃ অন্তবারিরই ছেলে। এই খবরটা আমার অনুসন্ধানের যে সূত্র ধরে পেয়েছে যে কোনো কারণেই হোক তা গ্রহণীয় নয় বললেন মিঃ গোবি। আরও অনেক পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতেন মিস ফেন এবং তারা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও উদারনৈতিক। সবাই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার জন্য উচিত মূল্যই দিয়েছে। আমার মনে হয় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা আমি আপনাকে পরিবেশন করলাম।
এরকুল পোয়ারো বললেন, বলে যান আপনি।
মিসেস অন্তবারি, তখন তিনি ওই পদবিটাই ধারণ করতেন। তিনি সেই শিশুটিকে দত্তক হিসাবে নিতে রাজী হয়ে যান। এর কিছু দিন বাদে মেজর বারটন কক্সকে তিনি বিয়ে করেন। মিস ক্যাথলিন ফেন তখন সফল অভিনেত্রী ও পপ সঙ্গীত শিল্পী হয়ে প্রচুর অর্থের অধিকারিণী হন। তিনি মিসেস বারটন কক্সকে চিঠি লিখে জানান যে, তিনি সেই দত্তক পুত্রটিকে ফেরত নিতে চান। কিন্তু মিসেস বারটন কক্স দত্তক শিশুটিকে ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। আমি আরও জানতে পারি, মালয়েতে থাকাকালীন সময় মেজর বারটন কক্স নিহত হন। তবে তিনি তার জন্য প্রচুর অর্থ রেখে যান। আরও একটা খবর আমি পেয়েছি, মিস ক্যাথলিন ফেন যিনি আঠারো মাস আগে হয়তো মারা যান। মারা যাবার সময় তিনি একটা উইল করে যান। তার অর্জিত সমস্ত অর্থ তাঁর প্রকৃত পুত্র ডেসমন্ড, এখন যে ডেসমন্ড বারটন কক্স নামে পরিচিত তার নামে রেখে যান।
তিনি অত্যন্ত উদার, বললেন পোয়ারো। মিস ফেন কীসে মারা যান?
আমি যা খবর পেয়েছি তা হল তিনি লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
আর ছেলেটি তার মায়ের সমস্ত অর্থের উত্তরাধিকারী হয়?
টাকাটা একটা ট্রাস্টের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ডেসমন্ডের যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হবে তখন সেই মোটা টাকার অর্থ ও পাবে।
আর মিসেস বারটন কক্স?
তিনি তার অর্থ বিনিয়োগে সুখী নন। কারণ তাঁর জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট অর্থ থাকলেও সেটা খুব একটা বেশি নয়।
পোয়ারো তাকে প্রশ্ন করলেন, ডেসমন্ড কি কোনো উইল করেছে?
মিঃ গোবি বললেন, সেটা আমি এখনও জানতে পারিনি। তবে সেটা খুঁজে বার করার উপায় আমার জানা আছে। আর যদি জানতে পারি তবে সময় একটুকুও নষ্ট না করে আপনাকে জানিয়ে দেব।
বিদায় নেবার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
প্রায় দেড় ঘন্টা বাদে আবার টেলিফোন বেজে উঠল। পোয়ারো একটা কাগজের সিটে নোট করছিলেন। যখন তখন লেখা কাটাকাটি করছিলেন আবার নতুন করে লিখছিলেন। টেলিফোনটা বেজে উঠতেই রিসিভারটা তুলে নিয়ে কান পেতে শুনলেন।
ধন্যবাদ, তিনি বললেন। হ্যাঁ কাজটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল-তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এক এক সময়ে আমি বুঝতে পারি না যে, আপনি এসবের মোকাবিলা কী করে করেন–হ্যাঁ ব্যাপারাটা এখন পরিষ্কার। এটার এমন একটা অর্থ যার অর্থ আগে বোঝা যায়নি-হ্যাঁ-আমি জেনেছি–আমি শুনেছি–আপনি নিশ্চিত এটাই কেস। হা হা সে জানে যে সে দত্তক পুত্র–কিন্তু তাকে কখনও বলা হয়নি, কে তার আসল মা ছিল–হ্যাঁ হ্যাঁ তাই বুঝি–খুব ভাল–অন্য পয়েন্টটা। তো আপনি পরিস্কার করে দেবেন বলেছেন? আচ্ছা ধন্যবাদ।
রিসিভারটা রেখে আবার তিনি লেখায় মন দিলেন। আধঘণ্টা বাদে আবার টেলিফোন বেজে উঠলো। এবং আর একবার রিসিভারটা তিনি তুলে নিলেন।
দূরভাষে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর বুঝতে অসুবিধা হল না পোয়ারোর। সেলটেনহ্যাম থেকে আমি ফিরে এসেছি।
আপনি এর মধ্যে ফিরে এসেছেন? মিসেস রোসেনটেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে তো?
হ্যাঁ চমৎকার উনি। আপনি ঠিকই বলেছেন যে, উনি আর একটা হস্তিনী।
মানে?
মানে আমি বলতে চাইছি মলি র্যাভেন্সটকে তিনি মনে রেখেছেন।
তাঁর পরচুলগুলোর কথাও তিনি মনে রেখেছেন তো?
হ্যাঁ।
অবসরপ্রাপ্ত হেয়ার ড্রেসার পরচুল সম্পর্কে তাকে কী বলেছেন তা সংক্ষেপে তিনি বললেন।
পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ ঠিক, সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে ঠিক একই কথা আমাকে বলেছেন। কোঁকড়ানো, সন্ধ্যার সময় ব্যবহার করার মতো, ঘন আর দুটি সাধারণ মোট চারটি। পুলিশ সেই চারটে পরচুলই পেয়েছিল। তাহলে আপনাকে আমি যা বললাম তা দেখছি আপনি আগেই জেনে গেছেন?
না, তার থেকেও বেশি কিছু আপনি আমাকে বলেছেন। লেডি র্যাভেন্সক্রফট বাড়তি দুটি পরচুল পেয়েছিলেন। আগের দুটোর সঙ্গে যোগ করার জন্য যা তার আগেই সংগ্রহ করা ছিল। এবং এই নতুন দুটির সংযোজন ঘটেছিল সেই বেদনাদায়ক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটার প্রায় তিন থেকে ছয় সপ্তাহ আগে। বেশ কৌতূহল জাগায় তাই না?
মিসেস অলিভার বললেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক, আমি বোঝাতে চাইছি ওই মহিলাটি সব ব্যাপারেই ভয়ঙ্কর ক্ষতি করতে পারেন। নকল চুল সেটা আবার যদি বিন্যস্ত আর পরিষ্কার করে নেওয়া যায়, বা সেটা যদি পুড়ে জ্বলে যায়, অথবা রঙ করা হয় এবং সব ভুল রঙ করা হয় সেটা আপনি কিছুতেই বুঝতে পারবেন না। অবশ্যই আপনাকে দুটি নতুন পরচুল পেতে হবে অথবা বদল করতে হবে। সেটা কেন যে আপনাকে এত উত্তেজিত করে তুলছে কিন্তু তার কোনো কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি না।
পোয়ারো বললেন, ঠিক উত্তেজিত হওয়া নয়। এটা একটা পয়েন্ট। আরও একটা আকর্ষণীয় পয়েন্ট হল যা আপনি এইমাত্র বাড়তি খবর দিলেন। সেটা হল ফরাসি লেডিটি। যিনি সেই বাড়তি দুটি চুল সেখানে থেকে এনেছিলেন। ম্যাচ করানোর জন্য কি?
হ্যাঁ তার সঙ্গিনী বা সেরকম কিছু হবে বলে আমি শুনেছি। সেই সময় লেডি র্যাভেন্সক্রফট হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ছিলেন এবং তাঁর স্বাস্থ্যও ভালো ছিল না আর নিজে সেখানে গিয়ে পছন্দ করার মতো অবস্থা তখন তার ছিল না।
তাই বুঝি?
সেই জন্য বুঝি সেই ফরাসি সঙ্গীনীটি এসেছিল?
সেই সঙ্গিনীটির নাম জানতে পেরেছিলেন?
না। আমার মনে হয় না মিসেস রোসেনটেল সেটা বলেছিলেন এবং আমার মনে হয় না তিনি জানতেন। আমার ধারণা লেডি র্যাভেন্সক্রফট ফোনে সব ব্যবস্থা করেছিলেন আর সেই ফরাসি মহিলাটি পরচুল দুটি দোকান থেকে এনেছিল।
ভালো কথা, বললেন পোয়ারো। এ-খবরটা আমার পরবর্তী পদক্ষেপে সাহায্য করবে।
মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী জানলেন? আর আপনি কিছু করতে পারলেন নাকি? একটু রাগ করে পোয়ারো বললেন, আমি দেখছি আপনি সব সময়ই সন্দেহপ্রবণ। আপনার ধারণা আমি কিছু করি না, শুধু চেয়ারে বসে থাকি আর বিশ্রাম করি।
মিসেস অলিভার স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, এখনও আমি মনে করি আপনি চেয়ারে শুধু বসে থাকেন আর ভাবেন। তার সঙ্গে এও বললেন, আপনি কখনও বাইরে যান না এবং বাইরের কাজ কিছুই করেন না।
আমি মনে করি অদূর ভবিষ্যতে আমি বাইরে যাব এবং কাজ করব। চ্যানেলও আমি অতিক্রম করতে পারি তবে নৌকায় নয় মনে হয় প্লেনে করে। আশাকরি সেটা আপনাকে খুশি করবে। বললেন পোয়ারো।
মিসেস অলিভার বললেন, আপনি কি আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যেতে চান?
পোয়ারো বললেন, আমার মনে হয় এ-ব্যাপারে আমার একলা যাওয়াই উচিত।
আপনি সত্যি যাবেন?
হ্যাঁ নিশ্চয়। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে যাব। এবং আমার সঙ্গে আপনিও খুশি হবেন ম্যাডাম।
মিসেস অলিভারের সঙ্গে কথা শেষ করলেন এবং নোট বুক থেকে একটা ফোনের নম্বর নিয়ে তিনি ডায়াল করলেন। কারণ একজনের সঙ্গে কথা বলা এই মুহূর্তে তার খুব জরুরি ছিল।
প্রিয় সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে। আমি এরকুল পোয়ারো কথা বলছি। আমি আপনাকে খুব কি বিরক্ত করলাম? তবে আশাকরি এই মুহূর্তে আপনি খুব ব্যস্ত নন!
সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে বললেন, না, না আমি ব্যস্ত নই। আমি এখন গোলাপ গাছের আগাছাগুলো কাটছিলাম এই পর্যন্ত
একটা ছোট্ট ব্যাপারে আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই।
আমাদের জোড়া আত্মহত্যার সমস্যার ব্যাপারে। হ্যাঁ মনে আছে নিশ্চয়ই আপনার যে, আপনি বলেছিলেন ওঁদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল। সেই কুকুরটা সেদিন ওঁদের সঙ্গে বেড়োতে গিয়েছিল। এ-খবরটা অবশ্য আপনি জানতে পারেন।
হ্যাঁ, একটা কুকুরের কথা বলেছিলাম, আমার মনে হয় হাউসকিপার কিংবা অন্য কেউ বলে থাকবে। সে বলে থাকবে অন্য দিনের মতো সেদিনও সেই কুকুরটা তাঁদের সঙ্গে বেড়োতে গিয়েছিল।
লেডি র্যাভেন্সটের মৃতদেহ পরীক্ষা করে যখন দেখা হয় তখন তার দেহে কি কুকুরের কামড়ানোর দাগ পাওয়া গিয়েছিল? সম্প্রতি কামড়ানোর দাগ হলেও চলবে, তবে আমি সেদিনের কামড়ানোর কথা বলছি না।
আপনি কিন্তু একটা অশুভ প্রশ্ন করছেন। আপনি এবিষয়ে না বললে একথা আমার কখনই মনে পড়ত না। হ্যাঁ বেশ কয়েকটা ক্ষত চিহ্ন ছিল তবে খুব একটা খারাপ নয়। সেই হাউসকিপারটি বলেছিল যে লেডি র্যাভেন্সক্রফটকে বেশ কয়েকবার কামড়েছিল যদিও মারাত্মকভাবে কিছু নয়। দেখুন পোয়ারো আপনি হয়তো জলাতঙ্কের কথা মনে করছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েই মারা গেছেন। তাই বলছি সেপটিক, বা বিষক্রিয়া অথবা টিটেনাসের সম্ভাবনার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।
পোয়ারো বললেন, কুকুরটাকে কিন্তু আমি মোটেই কোনো দোষ দিচ্ছি না। শুধু এ-ব্যাপারে আমি কিছু জানতে চাইছিলাম।
এক সপ্তাহ কিংবা দুই সপ্তাহ আগে একবার কুকুরের কামড়ানোর ঘটনা ঘটেছিল। তবে ইনজেকশন বা সে ধরনের কোনো কেস এ-ক্ষেত্রে ছিল না। সুপারিনটেন্ডেন্ট বলে চলেন, সেই কুকুরটা যেটা মরে গিয়েছিল। এটা কোথা থেকে এসেছিল জানি না কিন্তু?
কিন্তু এক্ষেত্রে কুকুরটি তো আর মরে যায়নি, বললেন পোয়ারো তবে সেই কুকুরটিকে আমায় জানতে হবে। খুব সম্ভব কুকুরটি অন্তত বুদ্ধিমান, সুপারিনটেন্ডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন এবং বিড়োবিড়ো করে মনে মনে বলে উঠলেন পোয়ারো, বুদ্ধিমান কুকুর, সম্ভবত পুলিশের থেকেও।
.
পোয়ারোর প্রস্থানের ঘোষণা
একজন অতিথি হিসাবে মিস লিভিংস্টোনকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই দরজা বন্ধ করে পোয়ারো মিসেস অলিভারের পাশে এসে বসলেন এবং বললেন, আমি চলে যাচ্ছি।
পোয়ারোর কোনো খবর দেওয়ার পদ্ধতি দেখে মিসেস অলিভার কেমন যেন অবাক হয়ে যান। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী করতে যাচ্ছেন?
আমি চলে যাচ্ছি। তবে প্লেনে করে জেনেভায় যাচ্ছি। আপনার কথা শুনে ঠিক মনে হচ্ছে। আপনি হয় ইউ, এন, ও. অথবা ইউনেস্কো কিংবা ওই ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের কেউ।
এটা স্রেফ একটা ব্যক্তিগত সফর বলতে পারেন।
জেনেভায় আপনি কি কোনো হাতির সন্ধান পেয়েছেন?
আপনি ওইভাবে দেখছেন, হয়তো ওদের দুজনের মধ্যে দু-জন–
মিসেস অলিভার বললেন, আমি কিন্তু এর বেশি আর কিছুর সন্ধান পাইনি। এবং তাও জানি না আর বেশি খবর পাওয়ার জন্য কোথায় যে আমাকে যেতে হবে।
আপনি যে বলেছিলেন আপনার ধর্মকন্যা সিলিয়ার একটি ছোটো ভাই ছিল?
হ্যাঁ তার নাম এডওয়ার্ড। মনে আছে একবার কী দুবার তাকে স্কুলে যেতে দেখেছিলাম তাও অনেক বছর আগে। সে এখন কোথায় আছে জানেন?
আমার ধারণা কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথবা সেখানে ইনজিনিয়ারিং কোর্স নিচ্ছে, আপনি কি সেখানে যেতে চান? এবং ব্যাপারটা তার কাছ থেকে জানতে চান?
না, এই মুহূর্তে নয়। আমি শুধু জানতে চাই সে এখন কোথায়? কারণ আমি শুনেছি সেই আত্মহত্যার সময় সে বাড়িতে সেসময় ছিল না।
আপনি কি একটু সময়ের জন্য ভাবছেন না যে সে এ কাজ করতে পারে? এবং তার বাবা মাকে গুলি করতে পারে? আমি জানি সেই বয়সে কখনও কখনও ছেলেরা সেরকম কিছু একটা করতে পারে।
কিন্তু সে তো সেই সময় বাড়িতে ছিল না, বললেন পোয়ারো। সে খবর আমি আমার পুলিশি রিপোর্ট থেকে ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছি।
আপনি আর কোনো আকর্ষণীয় কিছু পেয়েছেন? কারণ আপনাকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে।
আমি উত্তেজিত ঠিকই। আমি কয়েকটা ঘটনার কথা জানতে পেরেছি যা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি এবং তার ওপর আলোকপাত করতে পারে।
ঠিক আছে বলুন না কীসের ওপর আলোকপাত করতে পারে?
এখন আমি বুঝতে পারছি মিসেস বারটন কক্স কেন র্যাভেন্সদের আত্মহত্যার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার জন্য আপনার কাছে আবেদন করেছিলেন?
আপনি বলতে চাইছেন পরের ব্যাপারে নাক গলানোর মতো মহিলা তিনি নন?
না। আমার ধারণা এর পিছনে কোনো মোটিভ থাকতে পারে আর সেটা হল কোথা থেকে টাকা আসতে পারে?
টাকা? এর সঙ্গে টাকার কী সম্পর্ক? আর তার নিজেরই তো প্রচুর টাকা আছে তাই না?
হ্যাঁ তার জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট টাকা আছে। তার দত্তক পুত্রকে তিনি নিজের ছেলে বলে মনে করেন। সে শুধু জানে তাকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। কোনো পরিবার থেকে সে এসেছে যদিও সে কিছুই জানে না। হয়তো তার মার পীড়াপীড়িতে একটা নির্দিষ্ট বয়সে সে উইল করে থাকবে। অথবা মিসেস বারটন কক্সের বন্ধুরা তাকে ইঙ্গিত দিয়ে থাকবে। কিংবা কোনো উঁকি যার সঙ্গে পরামর্শ করে থাকবেন। ছেলেটিও হয়তো সেই বয়সে এসে পৌঁছে ভেবে থাকবে, তারও সব কিছু তার মায়ের জন্য রেখে যাওয়া উচিত আর সেই সময় সম্ভবত তার অর্থ উত্তরাধিকার হওয়ার মতো অন্য কেউ তার ছিল না।
কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আত্মহত্যার বিস্তারিত খবর নিতে চাওয়ার মধ্যে কী সম্পর্ক থাকতে পারে?
আপনি বুঝতে পারছেন না? মিসেস বারটন কক্স তার ছেলেকে বিয়েতে উৎসাহ দিতে চাইছেন না। ডেসমন্ডের একটি মেয়ে বন্ধু আছে। ভবিষ্যতে সে যদি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় যেমন এখন বহু যুবকেরা করে থাকে। আর তারা এ-ব্যাপারে না-পারে অপেক্ষা করতে না-পারে চিন্তা করতে। এবং সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে যে ডেসমন্ড যে অর্থ রেখে যাবে তিনি সেটার উত্তরাধিকারিণী হতে পারছেন না, কারণ ছেলেটি বিয়ে করা মাত্র আগের উইল বাতিল হয়ে যাবে এবং যদি সে তার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করে সে তখন তার নতুন উইলে তার সব কিছু তাকে দিয়ে যাবে, তার পালিতা মাকে নয়।
ও তাই জন্য আপনি মনে করেন মিসেস বারটন কক্স সেটা চান না?
হ্যাঁ ঠিক তাই, তিনি এমন কিছু একটা খুঁজে বার করতে চান যা তাকে সেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে নিরুৎসাহ করতে পারে। আমার অনুমান তিনি আশা করেন এবং বিশ্বাসও করেন সিলিয়ার মা তার বাবাকে হত্যা করেছে। পরে সে নিজে নিজেকে গুলি করে। এমনকি মেয়েটির বাবা যদি তার মাকে হত্যা করে থাকে তবু সেটাও নিরুৎসাহের কারণ হতে পারে। এই বয়সে ছেলেটির ওপর এ-ব্যাপারটা প্রভাব ফেলতে পারে।
আপনি কি তার মানে বলতে চান মেয়েটির বাবা অথবা মা যদি খুনি হন তাহলে মেয়েটির মধ্যেও খুন করার প্রবণতা থাকবে?
স্বাভাবিকভাবে তা না হলেও ওটা একটা ধারণা হতে পারে বলে আমার মনে হয়।
কিন্তু ছেলেটি তো বড়োলোক নয়? একজন দত্তক পুত্র?
ছেলেটি তার মার সত্যিকারের নাম কি জানে না এবং তিনি যে কে তাও সে জানে না। কিন্তু তার অভিনেত্রী ও পপ সঙ্গীত শিল্পী মা মৃত্যুর আগে প্রচুর অর্থ করে যান এবং এক সময় তিনি তাঁর ছেলেকে ফেরতও চান। কিন্তু মিসেস বারটন কক্স সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। তাই আমার অনুমান তিনি তখন এই ছেলেটির কথা চিন্তা করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, তার সমস্ত অর্থ তাকে দিয়ে যাবেন। এবং ছেলেটি তার পঁচিশ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সেই অর্থের উত্তরাধিকারী হবে। আর সেই সময় পর্যন্ত তাঁর সব অর্থ একটা ট্রাস্টের কাছে গচ্ছিত রাখা থাকবে। অতএব মিসেস বারটন কক্স এখন অবশ্যই চাইতেন না যে, তার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করুক। বরং তিনি কেবল চাইবেন তার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করুক সেযার ওপর তার প্রভাব থাকতে পারে।
হ্যাঁ। এটা আমার কাছে খুব যুক্তিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে, তিনি মোটেই একজন ভালো মহিলা নন। তাই তো?
না, বললেন পোয়ারো। আমি তাকে খুব ভালো মহিলা বলে মনে করি না।
বেশি মেলামেশা করলে যদি আপনি তার স্বরূপ জেনে ফেলেন আর সেই কারণেই তিনি চান না যে আপনি তার সঙ্গে দেখা করেন।
তাই হবে হয়তো, বললেন পোয়ারো।
আর কিছু আপনি জানতে পেরেছেন?
হ্যাঁ মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে কয়েকটা ছোটোখাটো ব্যাপারে সুপারিনটেন্ডেন্ট আমাকে ফোন করেছিলেন। সেই ফোনের উত্তরে আমি তাকে একটা প্রশ্ন করি। প্রত্যুত্তরে তিনি আমাকে বলেন যে, বয়স্ক হাউসকিপার চোখে ভালো দেখতে পান না।
পোয়ারো বললেন, হতে পারে। এই বলে তিনি তাঁর ঘড়ির দিকে তাকালেন। তিনি আবার ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, আমার এখন যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি চললাম।
আপনি কি এখন প্লেন ধরার পথে?
না, আমার প্লেন কাল সকালের আগে ছাড়ছে না। কিন্তু একটা জায়গায় আজই যেতে হচ্ছে কারণ সেই জায়গাটা আমার নিজের চোখে দেখতে হবে।
কৌতূহলের সঙ্গে মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী দেখতে চান সেখানে?
খুব একটা বেশি কিছু দেখার অথবা অনুভব করার মতো কিছু নেই। ঠিক কথাটা হল উপলব্ধি করা এবং বোঝবার চেষ্টা করা। আমি কি অনুভব করতে পারি।
.
ছোট্ট নাটিকা
চার্চইয়ার্ডের গেটের ভেতরে দিয়ে একটা পথ ধরে এগিয়ে চললেন এরকুল পোয়ারো। শেওলা পড়া দেওয়ালের সামনে একসময় থামলেন। কয়েক মিনিটের জন্য একটা কবরের দিকে তাকালেন। তারপর তিনি তাকালেন অদূর সমুদ্রের দিকে। তিনি তার দৃষ্টি আবার ফিরিয়ে নিলেন কবরের দিকে। বন্য ফুলের একটা গুচ্ছ হয়তো কোনো বাচ্চা ছেলে রেখে দিয়ে থাকবে। কিন্তু পোয়ারো মনে করেন এটা কোনো বাচ্চা ছেলে ফেলে রেখে যেতে পারে না। কবরের ওপর লেখা অক্ষরগুলো তিনি পড়লেন।
এদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে
ডরোথি গ্যারো
মৃত্যু : ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৬০
এবং
মার্গারেট র্যাভেন্সক্রফট
মৃত্যু : ৩রা অক্টোবর ১৯৬০। ওপরে মহিলার বোন এবং এ্যালিয়েস্টার র্যাভেন্সক্রফট।
মৃত্যু : ৩রা অক্টোবর ১৯৬০ ওঁর স্বামীর মৃত্যুতেও ওঁরা বিচ্ছিন্ন হননি।
আমাদের অসঙ্গতভাবে হস্তক্ষেপের জন্য ক্ষমা করবেন আমাদের। যেন আমরা ক্ষমা করি তাদের যারা অসঙ্গতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে–
প্রভু, আমাদের ওপর দয়া করুন।
যিশু আমাদের ওপর দয়া করুন।
প্রভু, আমাদের ওপর দয়া করুন।
কিছুক্ষণের জন্য সেখানে দাঁড়ালেন। তারপর চাচঁইয়ার্ড ছেড়ে এসে ফুটপাথ ধরে হেঁটে চললেন যে পথ গিয়ে মিশেছিল সেই পাহাড়ে বা পাহাড়ের কোণ বরাবর। তিনি আবার তাকালেন সমুদ্রের দিকে আপন মনে বলে উঠলেন
আমি এখন নিশ্চিত হয়ে গেছি সেদিন কী ঘটেছিল আর কেনই বা সেটা ঘটেছিল। এবং সেই বেদনাদায়ক ঘটনার দুঃখবোধ আমি বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। এই দীর্ঘ পথ সবাইকে পরিক্রম করতে হয়। আমার শেষেতেই আমার শুরু, আবার কেউ বলে আমার শুরুতেই আমার দুঃখদায়ক ঘটনা দিয়ে শেষ। সেই সুইস মেয়েটি নিশ্চয়ই সব জানে। ও আমাকে বলবে কি? ছেলেটির বিশ্বাস অন্তত ওদের খাতিরে বলবে। সেই মেয়েটি ও সেই ছেলেটির জন্য। এবং ওরা সেটা না জানা পর্যন্ত এ ওকে গ্রহণ করতে পারে না। আর গ্রহণ করতে পারে না ওদের জীবনকে।
.
ম্যাডি এবং জেলি
মাথাটা নিচু করে পোয়ারো বললেন, মাদমোয়াজেল রাউজেল।
মাদমোয়াজেল রাউজেল তার হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। বয়স প্রায় পঞ্চাশ হবে। একটু উদ্ধত। ওঁর নিজস্ব একটা পথ আছে। তিনি বুদ্ধিমতী, বুদ্ধিজীবী এবং সন্তুষ্ট, পোয়ারো ভাবলেন। পোয়ারোর মনে হল তিনি একইসঙ্গে জীবনের আনন্দ এবং দুঃখবোধ অনুভব করছেন।
রাউজেল বললেন, আমি আপনার নাম শুনেছি। এ দেশে আর ফ্রান্সে আপনার অনেক বন্ধু আছে জানেন। আপনার জন্য আমি কী করতে পারব জানি না। আপনার চিঠিতে আপনি যেটা ব্যাখ্যা করেছেন সেটা কোনো অতীতের ব্যাপার তাই না? যে ঘটনাটা ঘটে গেছে সেই ঘটনার ক্ল আপনি জানতে চান যা আজ থেকে অনেক বছর আগে ঘটেছিল। বসুন আপনি। আপনি ক্লান্ত আর টেবিলের ওপর সুরাপাত্র রয়েছে একটু পান করে জিরিয়ে নিন। পোয়ারোর মনে হল ভদ্রমহিলা বেশ অতিথিপরায়ণা, কারণ কোনো ব্যস্ততা নেই বা কোনো চিন্তা নেই। অথচ বেশ মিশুকে।
একটা সময়ে আপনি এক পরিবারে গভর্নেস ছিলেন এবং সেই ঘটনা যখন ঘটেছিল আপনি যুবতী ছিলেন। আর আমি দেখেছি সেই পরিবারে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে ছিল এবং তাদের বাবা আর্মিতে জেনারেল পদে উন্নতি লাভ করেছিলেন।
সেই পরিবারে কিন্তু একটি বোনও ছিল।
হ্যাঁ আমার মনে আছে। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখন তিনি সেখানে ছিলেন না। আমার অনুমান তিনি একটু জটিল প্রকৃতির ছিলেন এবং তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। তিনি যেন চিকিৎসার জন্য কোথায় গিয়েছিলেন।
আচ্ছা আপনি কি তাদের স্মৃশ্চিয়ান নামগুলো জানেন?
মার্গারেট বলে একজনের নাম মনে হয়। আর একজনের নাম এখন আমার আর মনে নেই।
তিনি বললেন, ডরোথি।
হ্যাঁ। যার সঙ্গে আমার খুব একটা পরিচয় ছিল না। তবে তারা পরস্পরের ছোট্ট নাম ধরে ডাকাডাকি করত। মলি আর ডলি। আর সেটা জানেন তো তাঁরা ছিলেন যমজ বোন। একই রকম দেখতে ছিলেন দু-জনে এবং দুজনেই দেখতে খুব সুন্দরী ছিলেন।
আচ্ছা তারা পরস্পর পরস্পরকে ভালোও বাসতেন তাই তো?
হ্যাঁ, তাঁরা পরস্পর পরস্পরের অনুরক্ত ছিলেন। আমি যে দুটি ছেলেমেয়েদের পড়াতে যেতাম তাদের নাম প্রেস্টন গ্রে ছিল। ডরোথি প্রেস্টন গ্রে একজন মেজরকে বিয়ে করেছিলেন। এখন নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। মার্গারেটের বিবাহিত নামটা কী ছিল যেন
পোয়ারো বললেন, র্যাভেন্সক্রফট।
হ্যাঁ হ্যাঁ। অদ্ভুত নামগুলো। কিছুতেই মনে রাখা যায় না। মার্গারেট প্রেস্টন গ্রে এখানকার একটা মহিলা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওঁর বিয়ের পর মাদাম বেনয়টকে চিঠি লেখেন এবং বলেন যদি কোনো গভর্নের্স তার জানা থাকে তিনি যেন ওঁর কাছে পাঠিয়ে দেন। আর তখন আমাকে সুপারিশ করা হয়। এবং সেই সূত্র ধরেই আমি সেখানে যাই। আমার শুধু অপর বোনের সঙ্গেই কথা হত। কারণ আমার কার্যকলাপের সময় তিনি সেখানে থাকতেন। মেয়েটির তখন বয়স ছিল ছয় কিংবা সাত আর তার নাম দেওয়া হয়েছিল শেক্সপিয়ার থেকে। নাম ছিল রোজালিণ্ড বা সিলিয়া। আর ছেলেটির বয়স ছিল মাত্র তিন বা চার তার নাম ছিল এডওয়ার্ড। সে ছিল খুব দুষ্টু তবে চেহারা ছিল মিষ্টি। তাদের সঙ্গে আমি বেশ সুখেই ছিলাম।
আমি শুনেছি আপনাকে পেয়ে তারাও খুব সুখে ছিল।
ওদের সাথে একাত্ব হয়ে গিয়েছিলাম আমি, বললেন, মাদমোয়াজেল।
আমার বিশ্বাস ওরা আপনাকে ম্যাডি বলে ডাকতো। এই কথা শুনে হাসলেন তিনি।
ওরা যে আমাকে ওই নামে ডাকত আমিও তা খুব পছন্দ করতাম। সেটা আমাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেত।
আচ্ছা আপনি কি ডেসমন্ড বারটন কক্স নামে কোনো ছেলেকে চেনেন?
হ্যাঁ মনে আছে। ছেলেটি হয় ওদের পাশের বাড়ি নয় তার পরের বাড়িতে থাকত। যেখানে অনেক প্রতিবেশী ছিল। আমাদের আর তাদের ছেলেমেয়েরা সবাই একসঙ্গে খেলাধুলা করত।
আপনি কি সেখানে অনেক দিন ছিলেন মাদমোয়াজেল?
না, আমি সেখানে মাত্র তিন থেকে চার বছর ছিলাম। আমার মা অসুস্থ হওয়ার জন্য এবং তাঁকে সেবা শুশ্রূষা করবার জন্য আমি দেশে ফিরে আসি। সেখানে ফিরে যাওয়ার দেড় কী দু বছর পরেই তিনি মারা যান। তারপর আমি নিজেই বয়স্কা মহিলাদের বিভিন্ন ভাষা শেখানোর জন্য একটা প্রতিষ্ঠান খুলি। যদিও এক কী দু-বছর সেই দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলাম কিন্তু ইংলন্ডে আর যাইনি।
জেনারেল র্যাভেন্সক্রফট এবং তার স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল বলে কি আপনার মনে হয়?
অন্তত খুশি ছিলেন তারা। তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও খুব প্রিয় ছিলেন এবং তিনিও ওদের খুব ভালোবাসতেন। এক কথায় বলা যায় ওঁরা দু-জন যেন পূর্ণ কবিতা। যার মধ্যে সুর আছে, ছন্দ আছে। সুতরাং তাদের বিয়েটা যে সফল তা বলা যায়।
আপনি বলছেন লেডি র্যাভেন্সক্রষ্ট তার যমজ বোনের প্রতি অনুগত ছিলেন।
আমি সেই যমজ বোনটার কথা ভাবছিলাম। সেই জন্যই বোধহয় কেন জানি না ভদ্রমহিলাকে দেখেই একটা দুঃখবোধ অনুভব করি। তিনি ছিলেন ঈর্ষাপরায়ণ মহিলা। আমি জেনেছি একসময় তিনি মনে করতেন তিনি যেন জেনারেল র্যাভেন্সক্রফট-এর বাগদত্তা। জেনারেল প্রথমে তার প্রেমে পড়ে যান এবং পরে সব প্রেম ও ভালোবাসা ঘুরে যায় যমজ বোনের দিকে। আমি মনে করি জেনারেলের এই পরিবর্তন খুব সৌভাগ্যের কথা। কারণ মলি র্যাভেন্সক্রফট সুন্দরী ও মিষ্টি স্বভাবের মহিলা ছিলেন। আর ডলির ব্যাপারে আমি দেখেছি তিনি কখনও তার বোনকে আদর করছেন ও ভালোবাসছেন আবার কখনও ঘৃণা করছেন ও ঈর্ষা প্রকাশ করছেন। তার ঈর্ষা এত বেশি ছিল যে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যমজ বোনের ছেলেমেয়েদের আর স্নেহ করবেন না। তবে আমার মনে হয় এ-ব্যাপারে আরও বেশি ভালো করে বলতে পারবে মাদমোয়াজেল মিউহোরাট। তিনি এখন লওসেনে থাকেন। আমি চলে আসার দেড় কী দু-বছর পর র্যাভেন্সক্রফটদের কাছে তিনি যান। বেশ কয়েক বছর সেখানে ছিলেন। আমার বিশ্বাস সিলিয়া যখন বিদেশে তিনি তখন লেডি র্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গিনী হয়ে আবার ফিরে আসেন। তাঁর ঠিকানা আমার কাছে আছে।
আমি সেখানেও যাব, বললেন পোয়ারো।
উনি অনেক কিছুই জানেন, যা আমি আবার জানি না। তিনি একজন সুন্দর এবং বিশ্বাসযোগ্য মহিলা। সেই ভয়ঙ্কর বেদনাদায়ক ঘটনাটায় যা ঘটেছিল কেউ যদি কিছু জেনে থাকে তাহলে কেবলমাত্র তিনিই জানবেন সেই দুর্ঘটনার ব্যাপারে। তিনি আমাকে কখনও কিছু বলেননি আর আপনাকেও বলবে বলে মনে হয় না। তিনি বলতেও পারেন আবার নাও বলতে পারেন কারণ তিনি বড়ো চাপা স্বভাবের মেয়ে।
মাদমোয়াজেলের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়েছিলেন পোয়ারো, মাদমোয়াজেল রাউজেল সম্পর্কে তার ধারণা ভালো হয়েছিল। রাউজেলের মতো অত উদ্ধত তিনি নন। যে মহিলাটি তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য তার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তার তুলনায়। তিনি ভাবলেন তার থেকে কম করে দশ বছরের ছোটো হবেন এবং তার অভিব্যক্তি একেবারে আলাদা ধরনের। যে চোখ দিয়ে তিনি আপনাকে দেখেন আবার সেই চোখ দিয়েই নিজেই আপনার সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সঙ্গে সঙ্গে। এবং যখনি আপনাকে আহ্বান জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করবেন তখন তার চোখের দৃষ্টি হয়ে যাবে শান্ত ও প্রতীক্ষারত। তবে অযথা তিনি নরম মনোভাব দেখাবেন না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটির সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেওয়া কম উল্লেখযোগ্য নয়। মাদামোয়াজেল, আমি এরকুল পোয়ারো।
জানি, আমি আপনাকে আজ, অথবা আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করে আছি।
আপনি কি আমার চিঠি পেয়েছেন?
না, তবে সন্দেহ নেই। সেটা এখনও তাকেই পড়ে আছে। অন্য একজনের কাছ থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছি।
সিলিয়া র্যাভেন্সক্রফট কি চিঠিটা দিয়েছে?
না, চিঠিটা দিয়েছে সিলিয়ার এক বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একজন যুবক তাকে আমরা যেমন করেই মনে করি না কেন তার নাম ডেসমন্ড বারটন কক্স। আমার এখানে যে আপনি আসবেন খবরটা আগে দিয়ে সে আমাকে প্রস্তুত করে রেখেছে।
ও তাই বুঝি! ছেলেটি তো খুব বুদ্ধিমান। আর একটুও সে সময় নষ্ট করেনি বলে মনে হয় এবং তার প্রয়োজনটা খুব জরুরি মনে করে আমি চলে এলাম আপনার সঙ্গে দেখা করতে।
আমি জেনেছি একটা গোলমালের কথা এবং সেই গোলমাল সে মেটাতে চায়। চায় সমাধান করতে এবং সিলিয়াও তাই চায়। তারা কিন্তু মনে করে যে, আপনি তাদের সাহায্য করতে পারেন, কি পারেন না?
আর হ্যাঁ তারাও মনে করে আপনিও আমাকে সাহায্য করতে পারেন।
তারা কিন্তু পরস্পরকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়।
কিন্তু তাদের বিয়ের পথে একটা বাধা হয়ে আছে।
আমার মনে হয় ডেসমন্ডের মা। সেই রকম কথাই ছেলেটি আমাকে বলেছে।
সিলিয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে যে কারণে ভদ্রমহিলা তার ছেলের সঙ্গে এই মেয়েটির বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছেন না।
আহা, সেই বেদনাদায়ক ঘটনার জন্য?
হ্যাঁ, সেই বিয়োগান্ত ঘটনার জন্যই। ডেসমন্ডের মা সিলিয়ার ধর্মমাকে অনুরোধ করেছেন কিছু বলার জন্য যে, কোন পরিস্থিতিতে সেই জোড়া আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল?
মাদামোয়াজেল মিউহোরাট বললেন, তার কোনো মানে হয় না। তারপর তিনি পোয়ারোকে বসতে বললেন। আচ্ছা সিলিয়া তার ধর্মমাকে কিছুই বলতে পারেনি নিশ্চয়ই? মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভার তো ঔপন্যাসিক তাই তো? হ্যাঁ, আমার মনে আছে সিলিয়া এ-ব্যাপারে তাকে কিছু খবরই দিতে পারে না কারণ সে নিজেই তো কিছু খবর পায়নি।
যখন দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল তখন মেয়েটি সেখানে ছিল না। আর কেউই এ-ব্যাপারে তাকে কিছুই বলেননি, তাই না?
হ্যাঁ ঠিক তাই, তখন মনে করা হয়েছিল কিছু না বলাই ভালো।
এই সিদ্ধান্ত আপনি মনোনীত করেন, না কি করেন না?
এ-ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল। খুব কঠিন ব্যাপার। সত্যি কথা বলতে কী এতদিন পরেও আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারিনি। এবং সিলিয়াও কখনও চিন্তিত হয়নি এ-ব্যাপারে। আমি বলতে চাইছি তার কখনও মনে হয়নি কেন বা কীভাবে সেটা ঘটেছিল? সবাই যেমন প্লেন বা মোটর দুর্ঘটনা মেনে নেয় সিলিয়াও ঠিক তেমনভাবে দুর্ঘটনাটা মেনে নিয়েছিল। বিদেশে সে অনেক বছর একটা মহিলা বোর্ডিং-এ একা কাটায়।
আমার ধারণা মাদমোয়াজেল মিউহহারাট, সেটা আপনি চালাতেন তাই না?
হ্যাঁ। সম্প্রতি আমি অবসর নিয়েছি আর আমার একজন সহকর্মিণী সেটা এখন চালাচ্ছে। সেই সময় সিলিয়াকে আমার কাছে পাঠানো হয় এবং বলা হয় আমি যেন একটা ভালো জায়গা খুঁজে দিই যেখানে থেকে ও পড়াশুনা করতে পারবে। তার জন্য আমি অনেক জায়গায় সুপারিশ করতে পারতাম কিন্তু তাকে আমি আমার কাছেই রেখে দিই।
আচ্ছা সিলিয়া আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি।
না। সেই দুর্ঘটনাটা ঘটনার অনেক আগের ঘটনা এটা। ওহো আচ্ছা, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
সেই দুর্ঘটনা ঘটার কয়েক সপ্তাহ আগে সিলিয়া এখানে এসেছিল। এবং তখন আমি এখানে ছিলাম না কারণ জেনারেল ও লেডি র্যাভেন্সক্রফটদের কাছে আমি ছিলাম। তখন আমি সিলিয়ার গভর্নের্স থেকে লেডি র্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গিনী হিসাবে থাকতাম এবং সিলিয়া তখন বোর্ডিং স্কুলে ছিল। হঠাৎ তখন ব্যবস্থা করা হল যে, সিলিয়াকে সুইজারল্যান্ডে পাঠানো হবে, সেখান থেকে সে তার পড়াশুনা শেষ করব।
আমার মনে হয় লেডি র্যাভেন্সক্রফট-এর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। তাই না?
না, মারাত্মক তেমন কিছু নয়। স্নায়ু দুর্বলতায় তিনি ভুগতেন। আর তা ছাড়া তার মনে নানান দুশ্চিন্তা ছিল।
আপনি কি মেয়েটির সঙ্গে ছিলেন?
এক বোন লওসেনে যার সঙ্গে আমি থাকতাম সেই সিলিয়াকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সে সেখানে পড়াশুনা শুরু করে এবং আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকে। এবং আমি তিন কী চার সপ্তাহ বাদে সেখানে আবার ফিরে যাই।
আচ্ছা আপনি তো সেই দুর্ঘটনার সময় ওভারক্লিফে ছিলেন তাই না?
হ্যাঁ আমি ওভারক্লিফেই ছিলাম। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো জেনারেল এবং লেডি র্যাভেন্সক্রফট বেড়োতে যান কিন্তু দুঃখের কথা সেদিন তারা আর ফিরে আসেননি। গুলিবিদ্ধ হয়ে তাদের মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এবং রিভলবারটা তাদের মাঝখানে পড়েছিল। তবে তাদের মধ্যে কে সব শেষে মারা যান সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ বা চিহ্ন পাওয়া যায়নি। দু-জনের দেহতেই গুলিবিদ্ধের ক্ষতস্থান দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং এক্ষেত্রে নিশ্চিত সমাধান হল একজোড়া আত্মহত্যা।
সে ব্যাপারে আপনার মনে কোনো রহস্যে সন্দেহ দানা বাঁধেনি?
পুলিশ যখন কোনো কারণ দেখতে পায়নি তখন আমিও সেটা বিশ্বাস করে নিই।
অস্ফুট স্বরে পোয়ারো বললেন, আহ!
কিছু মনে করবেন না। আপনি কি কিছু বললেন? প্রশ্ন করলেন মাদমোয়াজেল মিউহোরাট।
কিছু নয়। একটা কিছু আর যার ওপর আমি প্রতিফলিত করলাম।
মেয়েটির দিকে পোয়ারো তাকালেন। তিনি দেখলেন চাপা ঠোঁটে দৃঢ়তার চিহ্ন। ধূসর চোখ এবং ভাবলেশহীন মুখ। তবে নিজেকে সংযত করার একটা প্রয়াস দেখা গেল তার মধ্যে।
অতএব আপনি তাহলে এর থেকে বেশি আর কিছু বলতে পারবেন না?
আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কত দিনের আগের ঘটনা। সুতরাং আর কিছু বলার থাকতে পারে না।
সেই সময় আপনার নিশ্চয়ই বেশ ভালো মনে ছিল?
হ্যাঁ ওরকম একটা দুঃখজনক ঘটনা কেউ কখনও পুরোপুরি ভুলতে পারে না।
আর আপনি এবিষয়ে একমত যে এর বেশি কিছু থাকলেও সিলিয়াকে বলা উচিত নয়?
কেন? আপনাকে তো আমি বলেছি এর বেশি কোনো খবর আমার জানা নেই।
সেই দুঃখজনক ঘটনা ঘটার আগে বেশ কিছু সময় যেমন চার কিংবা পাঁচ আবার ছয়ও হতে পারে আপনি ওভারক্লিফে ছিলেন, না?
তার থেকেও বেশি, আগে আমি সেখানে সিলিয়ার গভর্নের্স হিসাবে ছিলাম। সেই সময় সিলিয়া বিদেশের স্কুলে চলে গেলো এবং আমি চলে আসি লেডি র্যাভেন্সটকে সাহায্য করতে।
সেই সময় লেডি র্যাভেন্সক্রফটের যমজ বোন তো থাকতেন তাঁদের সঙ্গে তাই না?
হ্যাঁ, বিশেষ চিকিৎসার জন্য সেই সময় কিছুদিনের জন্য সেখানকার হাসপাতালে ছিলেন। একটু সুস্থ হওয়াতে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসকের অভিমত হল সেই সময় যদি সে বাড়ির পরিবেশ এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে থাকেন তাহলে তার সাধারণ জীবন অনেক ভালোভাবে কাটাতে পারবেন। সেই সময় সিলিয়া ছিল স্কুলে। তাই লেডি র্যাভেন্সক্রফট ভেবেছিলেন তার বোনকে নিয়ে এসে রাখলে তাকে একটু দেখাশুনা করতে পারবেন।
তারা দুই বোন পরস্পরের প্রিয় ছিল?
সেটা জানা খুবই মুশকিল, মাদমোয়াজেল মিউহহারাট বললেন। পোয়ারো যেন তার মনে একটা আগ্রহ জাগাল। জানেন তো আমি এত বেশি অবাক হয়েছিলাম যে, সে কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। তারা ছিলেন যমজ বোন। তারা দুজনেই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এবং তাদের দুজনের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মিল ছিল আবার এমন কতকগুলো পথ ছিল যেখানে তাদের মধ্যে একদম কোনো মিল ছিল না।
আপনি যা মনে করতে চাইছেন তা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন আমি তাহলে খুশী হবো।
সেই বেদনাদায়ক ঘটনার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি বলব আজকাল কেউ কেউ এইরকম মত প্রকাশ করে থাকে যে, মানসিক ভারসাম্য হারানোর পিছনে কিছু শারীরিক কারণও থেকে থাকে। আমার বিশ্বাস চিকিৎসকরা স্বীকার করবেন যে, যমজ ছেলেমেয়েদের জন্ম হয় একটা বিরাট একাত্মবোধ নিয়ে। পৃথিবীতে তাদের মধ্যে দৈহিক বিচ্ছিন্নতা ঘটলেও অন্য সব কিছুতেই তারা অভিন্ন, একই মনোভাবাপন্ন এবং তাদের আচার ব্যবহার, শিক্ষা-দীক্ষা পছন্দ-অপছন্দ চরিত্র পর্যন্ত একই রকম হয়ে থাকে যতই তারা ভিন্ন পরিবেশে বড়ো হোক। এবং এমনও দেখা যায় প্রায় একই সময়ে একই ঘটনা ঘটে থাকে তাদের জীবনে যে যেখানেই থাকুক না কেন। যেমন দুটি বোন। একজন ফ্রান্সে অপর জন ইংলন্ডে থাকেন। আবার তাদের দু-জনেরই কুকুর একই জাতের আর একই দিনে তারা সেটা পছন্দ করেছিল এবং এও দেখা যাবে প্রায় একই ধরনের পুরুষকে তারা বিয়ে করেছে আবার এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। একটা আকস্মিক পরিবর্তন বিদ্বেষের পর্যায় বলা যেতে পারে, যা এক বোন আর একজনের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে। তারা পরস্পর যেন পরস্পরের একই ধারা মানতে চায় না, অর্থাৎ আগে তাদের মধ্যে যে সব মিল ছিল তা আর রাখতে চায় না দু-জনের কেউ। এবং সেই মনোভাব একটা ভয়ঙ্কর পরিণতি এনে দেয় দু-জনের জীবনে।
পোয়ারো বললেন, সে কথা আমি শুনেছি এবং নিজের চোখে একটি কী দুটি ঘটনা ঘটতে দেখেছি। ভালোবাসা বিদ্বেষে পরিণত হয় সহজে। যাকে তুমি গভীরভাবে ভালোবাস তাকেই আবার তুমি ভয়ঙ্করভাবে ঘৃণাও করতে পারো।
আপনি সেটা জানেন? বললেন মাদমোয়াজেল মিউহোরাট। হ্যাঁ, আমি সেটা দেখেছি শুধু একবার নয়। বহুবার, লেডি র্যাভেন্সক্রফট-এর বোন ছিলেন ঠিক সেই রকম।
কিন্তু আমার মনে হয় যদিও প্রায় সব দিক থেকে দৈহিক গঠন, চেহারা একই রকম তবে মুখের অভিব্যক্তি ছিল একেবারে অন্য ধরনের। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর মনোভাবাপন্ন এবং লেডি র্যাভেন্সক্রফট ছিলেন ঠিক তার উলটো। মনে হয় জীবনের শুরুতে গর্ভাবস্থায় তার এক সন্তানের মৃত্যু হয়। তিনি আর একটা সন্তান কামনা করেছিলেন এবং কখনও তার আর সন্তান হয়নি। তাই শিশুদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিরূপ।
এবং তাতেই সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গিয়েছিল তাই না, বললেন পোয়ারো।
আপনাকে কেউ সে কথা বলেছে নাকি?
দুই বোন যখন মালয়েতে ছিলেন এবং যারা তাদের দুজনকেই ভালোভাবে জানতেন তাদের মুখ থেকেই শুনেছি। সেখানে লেডি র্যাভেন্সক্রফট তার স্বামী ও বোনের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় ছিলেন। ডলি তাদের সঙ্গে থাকতে আসেন। এবং সেখানে একটি শিশুর দুর্ঘটনা ঘটে। এ-ব্যাপারে ধরে নেওয়া হয়েছিল ডলিই দায়ী। কিন্তু সেটা প্রমাণ করা যায়নি। কিন্তু আমি শুনেছি মলির স্বামী তার শালিকাকে ইংলন্ডে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। আর একবার তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
হ্যাঁ, যা ঘটেছিল এটা একটা ভালো নজির। আর আমার নিজের জ্ঞানে আমি সেটা জানতে পারিনি।
আমার মনে হয় এমন কতকগুলো ঘটনা আছে যা আপনি আপনার নিজের জ্ঞান দিয়ে উপলব্ধি করেছেন।
যদি তাই হয় যে সব ঘটনা একবার গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো খুঁচিয়ে টেনে না বার করাই উচিত।
সেদিন ওভারক্লিফে আর কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। যেমন একজোড়া আত্মহত্যা বা একটা খুনও হতে পারে অথবা আর অনেক কিছু হতে পারে। যা ঘটনা ঘটেছিল আপনাকে কি তাই তাই বলা হয়েছিল। কিন্তু একটা ছোট্ট কথা, যা আপনি এইমাত্র বললেন যে, যা ঘটেছিল আপনি সেটা জানেন এবং আপনার এই কথা থেকেই কি আমি মনে করে নিতে পারি যে, আপনি জানেন সম্ভবত কী ঘটেছিল বা অথবা ঘটতে শুরু করেছিল? সেই ঘটনার কিছু আগে সিলিয়া যখন সুইজারল্যান্ডে ছিল এবং আপনি তখন ওভারক্লিফেই ছিলেন। আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করব আর সেই প্রশ্নটা হল, সেই যমজ বোনেদের ক্ষেত্রে জেনারেল র্যাভেন্সক্রফট-এর মনোভাব কী ছিল।
আপনি কী বলতে চাইছেন আমি বুঝেছি।
এই প্রথম তার স্বভাব একটু পালটালো। আগের সেই সতর্ক ভাব আর নেই। ঝুঁকে পড়ে পোয়ারোর সঙ্গে এমন সহজভাবে কথা বললেন যে, কিছু বলতে পেরে নিজেকে অনেকটা হালকা বলে মনে করছেন।
ওঁরা দুই বোনই সুন্দরী ছিলেন। লোকের মুখ থেকে যা শুনেছিলাম তা হল জেনারেল র্যাভেন্সক্র প্রথমে ডলির প্রেমে পড়েন। ডলি ছিলেন মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। কিন্তু তিনি ছিলেন অতিরিক্ত আকর্ষণীয় এবং যৌন আকর্ষণ ছিল দেহ-মনে। জেনারেল তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। কিন্তু তারপর আর বলতে পারব না জেনারেল তার কোনো চরিত্রের দোষ ত্রুটি দেখতে পেয়েছিলেন কিনা। এমন কিছু ঘৃণ্য জাতীয় খুঁজে পেয়েছিলেন যা তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। জেনারেল তার মধ্যে পাগলামির সূচনা দেখতে পান এবং বিপদের সম্ভাবনা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই কি তার কাছ থেকে সরে এসে তার বোন মলির প্রতি সব প্রেম, ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন? হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত তিনি মলির প্রেমে পড়ে যান এবং তাকে বিয়ে করেন।
আপনি তাহলে বোঝাতে চাইছেন যে, উনি দুই বোনকেই ভালোবাসতেন। একই সময়ে তা বলে নয়। আলাদা আলাদা সময়ে। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার ভালোবাসা ছিল খাঁটি ও অকৃত্রিম।
হ্যাঁ, জেনারেল মলির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ওঁরা পরস্পর পরস্পরকে সমানভাবে বিশ্বাস করতেন এবং জেনারেল ছিলেন ভালোবাসার যোগ্য ব্যক্তি।
পোয়ারো হঠাৎ বলে উঠলেন, কিছু মনে করবেন না আমার মনে হয় তার সঙ্গে আপনারও ভালোবাসা ছিল।
আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি যে আপনি কী করে সাহস পেলেন এমন কথা বলার?
হ্যাঁ, একথা বলার সাহস আমার যথেষ্টই আছে। কিন্তু তা বলে আমি একথা বলছি না যে, আপনাদের মধ্যে প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার ছিল। আমি শুধু বলছি তাকে আপনি ভালোবাসতেন।
হ্যাঁ, তাকে আমি ভালোবাসতাম, আপনি যে অর্থে বলছেন আমি সেই অর্থেই বলছি এখনও তাকে আমি ভালোবাসি। এবং তাতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমার ওপর তাঁর আস্থা ছিল এবং তিনি আমাকে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তাই বলে তার সঙ্গে প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার ছিল না। আপনি কাউকে ভালোবাসতে পারেন এবং তার হয়ে কাজ করতে পারেন। কিন্তু তার কাছ থেকে ভালোবাসা আশা করবেন না। আমার মধ্যে আছে আস্থা, সহানুভূতি এবং বিশ্বাস–বললেন, জেলি মিউহোরাট।
তার জীবনে সেই ভয়ঙ্কর অবস্থায় আপনার সাধ্যমতো অনেক করেছিলেন। আমি জানি এমন কয়েকটা ব্যাপার আছে যা আপনি আমার কাছে লুকাচ্ছেন। তাহলে বরং আমিই আপনাকে বলব সেই ব্যাপারগুলো কি ছিল। বিভিন্ন খবরের উৎস থেকে এবং আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসার আগে পর্যন্ত যা যা খবর আমি শুনেছি তার কিছু কিছু আমি জানি। অন্যদের কাছ থেকে আমি শুনেছি শুধু যারা মলিকে নয় তারা ডলিকেও জানত। এবং ডলির ব্যাপারে আমিও কিছু জানি। তাঁর জীবনের দুঃখ, বেদনা এবং অসুখী এমনকি বিদ্বেষভাব এ-সবেরই মূল কারণ হল ব্যর্থ প্রেম। এই ব্যর্থতার জন্য নিশ্চয়ই তাঁর পরিবারের কেউ একজন দায়ী। যদি শোনা যায় তিনি যাকে ভালোবাসতেন সেই মানুষটি যদি বিয়ে করেন তারই বোনকে তাহলে আপনিই বলুন তার মানসিক অবস্থা তখন কী হতে পারে। হয়তো সেই কারণেই তিনি তাকে সহ্য করতে পারতেন না, ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মলি র্যাভেন্সক্রফট কি তার বোনকে পছন্দ করতেন? অথবা তিনি কি তাকে ঘৃণা করতেন?
জেলি বললেন, ওহো না, তিনি তার বোনকে খুবই ভালোবাসতেন। তিনি সব সময় চাইতেন তার বোন তার কাছে থাকুক। তিনি বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর বোনকে, কারণ তিনি জানতেন বোনের মানসিক রোগটা যদি আবার দেখা যায় তাহলে বিপদ হতে পারে। আপনি আগেই বলেছেন যে, শিশুদের তিনি একদম সহ্য করতে পারতেন না। তার এই অদ্ভুত মানসিকতাই তাঁকে যন্ত্রণায় অতিষ্ট করে তুলত।
আপনি কি তাহলে বোঝাতে চাইছেন যে, সিলিয়াকে তিনি অপছন্দ করতেন?
না, সিলিয়াকে নয় ছোটো ভাই এডওয়ার্ডকে। দুবার দুর্ঘটনায় বিপদের মুখোমুখি হয়েছিল এডওয়ার্ড। আমি জানি এডওয়ার্ড যখন স্কুলে ফিরে যায় তখন মলি খুবই খুশি হয়েছিলেন। সে তখন ছিল খুবই ছোটো অর্থাৎ বয়স তখন তার আট কিংবা নয়।
পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ আমি বুঝতে পারি। কিন্তু ধরুন এখন যদি আমি মাথায় ব্যবহার করার জন্য পরচুলের কথা আলোচনা করি? একজন মহিলার পক্ষে চারটে পরচুলের ঠিক মতন ব্যবস্থা করা অস্বাভাবিক নয় কি? এবং আমি এও জানি যখন তার আরও বাড়তি দুটো পরচুলের প্রয়োজন হল তখন একজন ফরাসি লেডিকে লন্ডনে একটা হেয়ার ড্রেসিংসপে লেডি র্যাভেন্সক্রক্ট পাঠান, এবং দুটো পরচুলের অর্ডার দেন। সেখানে একটা কুকুর ছিল এবং সেই দুর্ঘটনার দিন জেনারেল আর লেডি র্যাভেন্সটের সঙ্গে কুকুরটা বেড়োতে গিয়েছিল। বেশ কিছু দিন আগে কুকুরটা লেডি র্যাভেন্সক্রফটকে কামড়ে ছিল।
কুকুরদের কখনই বিশ্বাস করা উচিত নয়। হ্যাঁ এটা আমি জানি, বললেন জেলি।
আমি কী বলব সেদিন কী ঘটেছিল বা তার আগেই বা কী ঘটেছিল!
আচ্ছা আপনার কথা যদি আমি না শুনি?
আপনি হয়তো বলবেন আমি যা অনুমান করি তা মিথ্যে, কিন্তু আমার মনে হয় না আপনি তা বলবেন। আমি আপনাকে বলছি এখানে এখন কিসের প্রয়োজন–তা হল সত্য। একটি মেয়ে আর একটি ছেলে যারা পরস্পর পরস্পরের যত্ন নেয়, ভাবে এবং চিন্তা করে। তারা তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীত কারণ যা ঘটেছে তা যদি সত্য হয় আর সেটা সত্য না হলেও মা কিংবা বাবার কৃতকর্মের প্রভাব কি তাদের ছেলে মেয়েদের ওপর পড়তে পারে? আমি ভাবছি মেয়েটির কথা। একটি অবাধ্য মেয়ে উদ্ধত মেয়ে বা বেপরোয়া মেয়ে একটু সুখের জন্য এবং সাহসের জন্য, কিন্তু প্রয়োজন বোধ করছে–সব মানুষই চায় নিরাপত্তা বোধ। আতঙ্কিত ভাব না থাকলেও তবু তারা মুখোমুখি হতে পারে। এবং মোকাবিলা করতে পারে। সাহসের সঙ্গে তারা সেটা গ্রহণ করে মোকাবিলা করে। এবং সেই সাহস আসবে আপনার জীবন থেকে। সেই ছেলেটিকে মেয়েটি ভালোবাসে। সেও তাকে প্রচণ্ডভাবে চায় আমার কথা আপনি শুনবেন নাকি? জেলি মিউহোরাট হ্যাঁ বললেন। আমি মনে করি আপনি অনেক ভালো বোঝেন? আমার ধারণা যা তার থেকেও বেশি আপনি জানেন সুতরাং আপনি বলুন আমি শুনব।
.
কোর্ট অফ এনকোয়ারি
যেখানে জেনারেল এবং লেডি র্যাভেন্সক্রফটের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল এবং একজন মহিলা ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। ঠিক সেখানে আর একবার পাহাড়ের ওপর উঠলেন এবং নিচের দিকে তাকালেন। সুপারিনটেন্ডেন্টের প্রশ্ন কেন এসব ঘটনাগুলো ঘটেছে? কেন? এটা কোনো পথে নিয়ে গেছে?
প্রথম হয় একটা দুর্ঘটনা। তার তিন সপ্তাহ পরে হয় একজোড়া আত্মহত্যা। এটা কি পুরোন পাপের লম্বা ছায়া যার পরিসমাপ্তি বড়ো বেদনাদায়ক। এবং যার শুরু হয়েছিল আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে। দুটি ছেলেমেয়ে সত্য জানতে চায় এবং দুটো লোক সেই সত্যটা জানে। তাই আজ এখানে মানুষের একটা সভা হবে। সরু গলির পথ ধরে একটা বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন এরকুল পোয়ারো। যার নাম ছিল-ওভারফ্লিফ। তিনি দেখলেন বাড়িটার সামনে একটা গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। বিশাল বাড়ি এবং সম্পূর্ণ খালি, এই সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য হাউজ এজেন্টের একটা বোর্ড ঝোলোনো রয়েছে। দুটি লোকের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য এগিয়ে গেলেন তিনি। ওরা তার দিকে এগিয়ে আসছিল। তাদের একজন হল ডেসমন্ড বারটন কক্স আর অপরজন হল সিলিয়া র্যাভেন্সক্রফট।
ডেসমণ্ড বললেন, হাউজ এজেন্টের কাছ থেকে একটা অর্ডার পেয়েছি। বাড়ির ভিতরে ঢাকার দরকার হতে পারে বলে চাবিও পেয়েছি। কিন্তু পাঁচ বছরে দু-বার হাত বদল হয়েছে। এই বাড়িটা। সুতরাং মনে হয় না সেখানে আর কিছু দেখার আছে। কি আপনার মনে হয় কিছু থাকতে পারে?
সিলিয়া বলল, আমার মনে হয় না কারণ ওটা অনেক লোকের হাত ঘুরে গেছে। প্রথম ক্রেতাকে তারা আর্চার বলে ডাকতেন, দ্বিতীয় ক্রেতাকে ফ্যালেফি বলত। তারা দুজনেই রয়েছে, জায়গাটা খুব নির্জন। এখন শেষে ক্রেতা আবার বাড়িটা বিক্রী করতে চাইছে, হয়তো কেউ তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ডেসমন্ড প্রশ্ন করলেন আচ্ছা ওই ভূতুড়ে বাড়িতে আপনার বিশ্বাস আছে?
সিলিয়া বলল, সত্যি বলছি আমি মনে করি না, কিন্তু আমার মনে হয় এটা–একটা ঘটনা এবাড়ির থেকেই তো ঘটেছিল। আর সেই হিসাবে এই বাড়িটার একটা গুরুত্ব আছে এবং এখানকার সব কিছু
পোয়ারো বললেন, আমার তা কিন্তু মনে হয় না। কারণ এখানে এক সময়ে দুঃখ ছিল, মৃত্যু ছিল আর এখানে তখন ভালোবাসাও ছিল।
সেই সময় রাস্তা দিয়ে একটা ট্যাক্সিকে আসতে দেখা গেল।
সিলিয়া বললেন, আমার মনে হয় মিসেস অলিভার হয়তো এলেন। কারণ উনি বলেছিলেন ট্রেনে আসবেন এবং স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরে নেবেন।
মিসেস অলিভার এবং তাঁর সঙ্গিনী ট্যাক্সি থেকে নামলেন। পোয়ারো জানতেন সেই মহিলাটি আসবেন তাই তাকে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন না। তিনি শুধু সিলিয়াকে লক্ষ্য করছিলেন তার প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্য।
সিলিয়া সেই মহিলাটিকে দেখে আনন্দে লাফিয়ে তাঁর কাছে ছুটে গেলেন। ওহো সত্যিই আপনি আমাদের সেই জেলি? আপনাকে দেখে আমি কী যে আনন্দ পেলাম তা আপনাকে বোঝাতে পারব না। আপনি যে এখানে আসছেন তাও জানতাম না।
মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো আমাকে আসতে বলেছিলেন।
সিলিয়া বললেন, তাই বুঝি? কিন্তু আমি জানি না
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। এদিকে মুখ ঘোরাতেই তিনি দেখলেন তাঁর পাশে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তুমি ডেসমন্ড না?
হ্যাঁ। জেলি নামে ওঁকে ডাকতে পারি কিনা সেটা জানার জন্য আমি চিঠি দিয়েছিলাম মাদমোয়াজেল মিউহোরাটকে।
জেলি বললেন, তোমরা দু-জনেই ও নামে আমাকে ডাকতে পারো। এখানে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হল কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমি তা আশা করি।
সিলিয়া বললেন, আমরা দুজনেই জানতে চাই ডেসমন্ড ভেবেছে আপনি অন্তত আমাদের কিছু বলতে পারেন।
জেলি প্রত্যুত্তরে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো আমরা সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং অনুরোধ করেছিলেন আজ এখানে আসার জন্য।
সিলিয়া মিসেস অলিভারের একটা হাত ধরে বললেন, আপনিও এখানে আসুন কারণ আপনি মঁসিয়ে পোয়াবোর সহযোগিতা পেয়েছেন এবং আপনি নিজেও কিছু তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। তার জন্য কেসটা আপনি হাতে নিয়েছেন, কি নিয়েছেন তো?
মিসেস অলিভার বললেন, লোকেরা আমাকে বলেছে। সেসব লোককে মনে রাখতে বলেছিলাম সেই ঘটনার কথা তাদের মধ্যে কয়েকজন ঠিকই মনে রেখেছে। আবার কয়েকজন মনে রাখতে গিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছে। আর সেটাই হল বড়ো বিভ্রান্তিকর। তবে সিয়ে পোয়ারো বললেন, সেটা কোনো ব্যাপার হবে না।
পোয়ারো বললেন, না। জনশ্রুতি কি সেটা জানাও জরুরী। ধরুন একজনের কাছ থেকে আপনি ঘটনার কথা জানলেন, যদি সেটা সঠিক ঘটনা নাও হয় তবুও আপনি শুনবেন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ম্যাডাম, আপনাকে আমি যেভাবে বুঝিয়েছি এরা সেইসব লোকগুলো যাদের আপনি এক একটা হাতি বলে বর্ণনা করেছেন তাদের কাছ থেকে কিন্তু আপনি কিছু না কিছু জেনেছেন নিশ্চয়ই। এখন সেগুলোকে ভালোভাবে বুঝে উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত নিন। এই কথা বলে পোয়ারো হাসলেন।
হাতি? বললেন মাদমোয়াজেল জেলি।
পোয়ারো বললেন, উনি এই রকমই আখ্যা দিয়ে থাকেন।
মিসেস অলিভার ব্যাখ্যা করে বললেন, হাতিরা মনে রাখতে পারে। এই রকম একটা প্রবাদ আমি চালু করেছি। হাতিদের মতো মানুষও অনেকদিন আগের ঘটনার কথা মনে রাখতে পারে। তবে সব মানুষ নয়। এইভাবে আমি অনেক খবর সংগ্রহ করেছি। এবং এই খবরগুলো একত্রে করে মঁসিয়ে পোয়ারোর হাতে দিয়ে দিয়েছি। উনি যদি ডাক্তার হতেন তাহলে বলতাম রোগ নির্ণয় করতে।
পোয়ারো বললেন, অনেকদিন আগে কী ঘটেছিল তার যথা সম্ভব বিবরণ নিয়ে আমি একটা তালিকা তৈরি করেছি। আর এই তালিকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি আপনাদের পড়ে শোনাব আর দেখব আপনারা এসবের সঙ্গে জড়িত কিনা। অথবা আপনাদের কাছে এর কোনো গুরুত্ব আছে কিনা। হয়তো আপনাদের কাছে মামুলি বলে মনে হতে পারে।
সিলিয়া বললেন, সবাই জানতে চায় সেটা কি আত্মহত্যা বা খুনের ঘটনা? যদি ধরা হয় খুন হয়েছে তাহলে কি বাইরের কেউ আমার মা ও বাবাকে খুন করেছে? কোনো কারণে হয়তো তাদের গুলি করা হয়েছে। এই খুনের পিছনে কোনো মোটিভ থাকলেও থাকতে পারে যা আমরা জানি না। আমার সব সময়ে মনে হয় সেই ঘটনার পিছনে একটা কিছু অবশ্যই আছে যেটা খুঁজে বার করা খুবই মুশকিল
পোয়ারো বললেন, আমরা এখানেই থাকব। এখন বাড়ির ভিতর যাওয়ার দরকার নেই। যেহেতু অন্য লোকেরা এখানে বাস করে গেছে সেহেতু এখানকার আবহাওয়া অন্য রকমের। আমাদের এখানে কোর্ট অফ এনকোয়ারির কাজ শেষ হওয়ার পর যদি আমরা মনে করি তবে আমরা ভিতরে যাব।
ডেসমন্ড বললেন, তাহলে এটা কি কোর্ট অব এনকোয়ারির কাজ?
হ্যাঁ, সেদিন এখানে কী ঘটেছিল তা জানার জন্যই এই কোর্ট অফ এনকোয়ারি।
দুটোর মধ্যে যে কোনো একটা অবশ্যই সত্য, বললেন সিলিয়া।
আমি বলব যে, দুটোই সত্য। আমার ধারণা আমরা এখানে এসেছি কেবল একটা খুনের বা আত্মহত্যার ব্যাপার নয় একটা বেদনাদায়ক ঘটনাও আছে–এখানে দুটো মানুষের ট্র্যাজেডি, যাঁরা পরস্পরকে ভালোবাসতেন এবং প্রেমের জন্য যারা জীবন বিসর্জন দিলেন। ভালোবাসার ট্র্যাজেডি যে সবসময় রোমিও এবং জুলিয়েটের মতো হবে তা নয়, প্রেম ও ভালোবাসার দুঃখ বেদনা এবং ব্যর্থতার জন্য মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার একচেটিয়া অধিকার শুধুমাত্র যুবক যুবতীদের। কিন্তু প্রেমের বলির সামিল বয়স্করাও হতে পারে, এর মধ্যে তার থেকেও আরও বেশি কিছু থাকতে পারে।
আপনি কী বলতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, সিলিয়া বললেন।
এখনও সময় হয়নি।
সিলিয়া আবার প্রশ্ন করলেন, আমি কি বুঝতে পারব?
পোয়ারো বললেন, আমার তাই মনে হয়। আমি আপনাদের বলব কী করে সেই ঘটনাটা ঘটেছে। এবং সেটা ঘটলই বা কি করে? প্রথম ব্যাপারটার ব্যাখ্যা সাক্ষ্য প্রমাণ নেই, পুলিশি রেকর্ড নেই। এমন কতকগুলো জিনিস আছে যা সাক্ষ্য প্রমাণের দরকার হয় না। যেমন মৃত মার্গারেট র্যাভেন্সক্রফট-এর ব্যবহৃত চারটি পরচুলের কথা। এবং একটু জোর দিয়ে পুনরায় বললেন, চার-চারটি পরচুল। সব সময়েই তিনি পরচুল ব্যবহার করতেন না, বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহার করতেন। যেমন বাইরে বেড়োতে গেলে, সান্ধ্যভ্রমণের সময়। কারণ বাইরে বেরোলে চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পোয়ারা বললেন, সেই বিশেষ দিনে এরকম একটা ফ্যাশনের চল ছিল। সাধারণত মানুষ বাইরে বেড়াতে গেলে একটা কিংবা দুটো চুল নিয়ে যেতো। কিন্তু তার কাছে ছিল চারটে পরচুল। আমার প্রশ্ন হল তার চারটে পরচুলের প্রয়োজন হল কেন? আমি যাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার মাথায় যে টাক পড়ার প্রবণতা ছিল তা কিন্তু নয়। সেই বয়সে অন্য মহিলাদের মতোই ভালো রকমের চুল ছিল তার মাথায়। পরে জেনেছি একটা পরচুলে ধূসর রঙের দাগ ছড়িয়ে ছিল আর একটি ছিল কোঁকড়ানো, এবং অপর পরচুলটি তিনি তার মৃত্যুর দিন ব্যবহার করেছিলেন।
সিলিয়া জিজ্ঞেস করলেন, কোনোভাবে সেটা কি অর্থপূর্ণ হতে পারে? চারটের মধ্যে থেকে যে কোনো একটা পছন্দ করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে ওই বিশেষ পরচুলটি–
পুলিসের কাছে হাউজকিপার বলেছিল যে, তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে তিনি ওই বিশেষ পরচুলটি ব্যবহার করতেন।
আমি কিন্তু এর কোনো অর্থ খুঁজি পাচ্ছি না। সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারোওয়ে আমাকে একটা কথা বলেছিলেন–একই লোক, অন্য ধরনের টুপি, তার সেই উক্তিটা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।
সিলিয়া কিন্তু সেই আগের কথার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, আমি কিন্তু এর কোনো অর্থ দেখতে পাচ্ছি না।
পোয়ারো আরও বললেন, একটা কুকুরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কুকুর! কুকুর কী করেছিল?
সেই কুকুরটা মিসেস র্যাভেন্সক্রফটকে কামড়ে দিয়েছিল, সেই কুকুরটা কিন্তু তার খুব প্রিয়। এবং অনুরক্ত ছিল। জীবনের শেষ কয়েক সপ্তাহ কুকুরটা তাকে বেশ কয়েকবার আক্রমণ করে।
ডেসমন্ড এবার প্রশ্ন করলেন, তাহলে আপনি কি মনে করেন তিনি যে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন কুকুরটা টের পেয়েছিল?
পোয়ারো বলেন, না, সেই কুকুরটা এমন কিছু জানত যা অন্য কেউ জানত না, সেই হাউজকিপার যে প্রায়ই অন্ধ ছিল এবং কানে কম শুনত সে নাকি একজন মহিলাকে মলি র্যাভেন্সটের পোশাক পরে থাকতে দেখেছিল এবং সেই প্রিয় পরচুলটি তার মাথায় লাগাতে দেখেছিল। এই ব্যাপারে হাউজকিপার বলেছিল তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে তার মিস্ট্রেসকে কেমন যেন অন্য রকমের মহিলা বলে মনে হয়েছিল। একই লোক এবং অন্য ধরনের টুপি গ্যারোওয়ের সেই কথাটা মনে পড়ে যায় এবং নতুন একটা ভাবনার জন্ম হয়। যেমন একই পরচুল অথচ অন্য একজন মহিলা। কুকুরটি তার নাক দিয়ে বুঝেছিল এটা অন্য এক মহিলা যাকে সে ভালোবাসে তা সে নয়। এ সেই মহিলা যাকে সে অপছন্দ করত। আমার মনে হয় সেই মহিলা মলি র্যাভেন্সক্রফট ছিলেন না। কিন্তু কে হতে পারেন তিনি? তবে কি ধরে নেওয়া যায় তিনি ডলি ছিলেন? সেই যমজ বোন?
সিলিয়া প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন, সেটা অসম্ভব।
না, সেটা অসম্ভব কিছু নয়। তারা ছিলেন যমজ বোন। মিসেস অলিভার আমাকে একটা কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই কথাটা তিনি শুনেছিলেন অন্য লোকের কাছ থেকে যারা ব্যাভেন্সক্রফটদের জানতেন। সেই কথাটা হল লেডি র্যাভেন্সক্রফট সেই সময় কিছুদিনের জন্য হাসপাতালে ছিলেন। খুব সম্ভব তিনি জেনে গিয়েছিলেন যে তার ক্যান্সার হয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় বোঝা যায় তার সেরকম কিছুই হয়নি। এরপর তার ও তার যমজ বোনের ইতিহাস জানতে পারি। তারা উভয়ই পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাদের সব কিছুই ছিল একইরকম, একই সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়া বা প্রায় একই সময়ে দু-জনের বিবাহ করা, সম্ভবত দুই যমজ বোনের মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আনার জন্য এবং যাতে করে তৃতীয় ব্যক্তি তাদের পরিচয় বুঝতে পারেন যে, কে ডলি বা কে মলি সেই জন্য একই ফ্যাশন এবং একই কায়দা না করে ওঁরা ঠিক বিপরীত ফ্যাশনে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। আর তাছাড়া তাদের জীবনের শেষ দিকে এ ওকে অপছন্দ করার একটা মানসিকতাও গড়ে উঠেছিল। জেনারেল র্যাভেন্সক্রফট প্রথমে ডরোথি প্রেস্টন-গ্রের প্রেমে পড়েন, যমজ বোনের সেই ছিল বড়ো। কিন্তু কিছুদিন পরে সেই প্রেমের পাত্রী বদল হয়ে যায়। অর্থাৎ ডলির পরিবর্তে মলিকে ভালোবাসতে শুরু করেন। এবার তাকেই বিয়ে করেন এবং যেটা স্বাভাবিক যে দুই যমজ বোনের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হল। তাই এর ব্যাখ্যা হিসাবে আমার অনেক কিছুই মনে হয়েছে। ডরোথি হল একটা ট্র্যাজিক চরিত্র। সব সময়ে মানসিক দিক থেকে অস্বস্তিতে থাকতেন তিনি। কি কারণে কে জানে যা আজও অজানা। সেই ছোটোবেলা থেকে তিনি শিশুদের পছন্দ করতেন না। আবার এক সময় একটি শিশু হত্যার জন্য তিনিই দায়ী হয়ে পড়েন। অবশ্য সেটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ ছিল, এবং সেই কারণেই সেই চিকিৎসক তাকে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য সুপারিশ করেন এবং বেশ কয়েকবছর তাকে মানসিক হাসপাতালে থাকতে হয়। এর কিছুদিন পর তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। র্যাভেন্সক্রফট যখন মালয়েতে ছিলেন তখন তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। আর সেখানেই আগের একটা দুর্ঘটনা ঘটে। প্রমাণ না থাকলেও প্রতিবেশী সেই শিশুটির মৃত্যুর জন্য ডরোথিই দায়ী ছিলেন, জেনারেল তখন ডরোথিকে ইংলন্ডে নিয়ে আসেন এবং তাকে মানসিক চিৎকৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি আবার ভালো হয়ে ওঠেন। এবার মার্গারেট বিশ্বাস করলেন তার যমজ বোন চিরদিনের মতো সুস্থ হয়ে উঠেছে এবং তার দিকে সব সময় নজর রাখার জন্য তার কাছে নিয়ে আসলেন। তাতে জেনারেলের সম্মতি ছিল আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ তিনি জানতেন জন্ম থেকে এধরনের রোগ চিরদিনের মতো নির্মূল হয় না। তার সব সময় আশঙ্কা ছিল ডলির দিক থেকে যদি আবার বিপদের সূচনা হয় এই ভয়ে।
ডেসমন্ড প্রশ্ন করলেন, তাহলে আপনি বলতে চাইছেন তিনিই র্যাভেন্সক্রফটদের গুলি করেছিলেন?
পোয়ারো বললেন, না, সেটা আমার সমাধান নয়। আমার ধারণা কী জানেন, ডরোথি তার বোন মার্গারেটকে হত্যা করেছিলেন। একদিন তারা দুজনে একসঙ্গে পাহাড়ের ওপর বেড়োতে যান। এবং মার্গারেটের অজান্তে ডরোথি ধাক্কা দিয়ে তাকে পাহাড় থেকে ফেলে দেন কারণ ব্যর্থ প্রেম। জীবনের হতাশা থেকে ডরোথি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল, মার্গারেটের প্রতি তার হিংসা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ জন্মায়। অবচেতন মনে মার্গারেটকে হত্যা করে বসেন। আমার অনুমান বাইরের একজন মানুষ এঘটনার কথা জানতেন। আমার ধারণা মাদমোয়াজেল, আপনি জানেন সেই ঘটনার সময় সেখানে কে ছিলেন?
জেলি মিউহোরাট বললেন, আমি জানি, আমি সেই সময় এখানে ছিলাম। তাদের সেই ছোট্ট ছেলে এডওয়ার্ডকে জখম করার পর থেকেই ডলির ব্যাপারে সব সময়ই তাদের চিন্তা হয়। এডওয়ার্ডকে লন্ডনে ফেরত পাঠানো হয় আর আমি এবং সিলিয়া সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাই, দুই বোন একসঙ্গে বেড়াতে গেল। একজন ফিরল না অথচ ডলি ফিরে এলো। তাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। ভিতরে এসে চায়ের টেবিলে বসে পড়লেন আর তখনই দেখলেন ডলির হাতে রক্তের দাগ। জেনারেল তাকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কোথাও পড়ে গিয়েছিলেন কিনা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি লাফিয়ে উঠলেন এবং বললেন, গোলাপ গাছের কাঁটায় হাতটা একটু কেটে গেছে। আর সেই জন্য ওই ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত পড়ছে। পাহাড়ের গায়ে কোনো গোলাপ গাছ থাকে না। সম্পূর্ণ বোকার মতো কথা বলার ফলে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি, পাহাড়ের গায়ে হলুদ রঙের এক প্রকার কাটা গাছ হয়, তা উনি ওই গাছের কথা বলতেন আমরা না হয় মেনে নিতাম। একটা কিছু চিন্তা করতে করতে বাড়ির থেকে বেরুলেন জেনারেল। আমিও তার সঙ্গে গেলাম। তিনি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলেন, মলির নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে, ওখানে গিয়ে দেখলাম মলি পাহাড়ের নিচে খাদেতে একটা পাথরের ওপর পড়ে আছে। তার দেহ ক্ষত বিক্ষত তখনও তিনি মারা যাননি। তখন মাথায় আসছিল না ঠিক কি করব আমরা। ডাক্তার ডেকে আনা অবশ্যই দরকার। ঠিক সেই মুহূর্তে তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, হ্যাঁ ডলিই একাজ করেছে। সত্যিই সে জানত না সে কী করতে যাচ্ছে। ওর এই কাজের জন্য কোনো রকম শাস্তি যেন ও না পায়। এবং কেউ যেন জানতে না পারে কী নিষ্ঠুর কাজ ও করেছে। অথবা কেন করেছে। ওর কোনো দোষ আমি দেখতে পাচ্ছি না। তোমায় আমাকে কথা দিতেই হবে যে তুমি ওর সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবে। ডাক্তার ডেকে কোনো লাভ হবে না, কারণ সময় আর নেই। আমি জানি মৃত্যুর মুখোমুখি এসে উপস্থিত হয়েছি। তোমাকে আবার বলছি তুমি কথা দাও আমার বোনকে রক্ষা করবে, আমাকে হত্যা করার জন্য ওর বিচারের ব্যবস্থা তুমি করবে না।
আমাকে কোথাও লুকিয়ে রাখো কারণ কেউ যাতে দেখতে না পায়। আর জেলি তুমিও তো আমাকে খুব ভালোবাসো। আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছ এবং আমার শরীরের যত্ন নেবার চেষ্টা করেছ, আর আমার ছেলে মেয়েদেরও তুমি ভালোবাসো। সুতরাং তোমাকেও দেখতে হবে যেন ডলি রক্ষা পায় এই অপরাধ থেকে। এই হল সেদিনের প্রকৃত ঘটনা।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, তারপর আপনারা কী করলেন? আমার মনে হল এরই মধ্যে
হ্যাঁ তিনি মারা যান। তাঁর সেই কথাগুলো ছিল শেষে অনুরোধ। ওঁর মৃতদেহকে লুকিয়ে রাখতে ওঁকে সাহায্য করলাম। আমরা ওকে ধরাধরি করে নিয়ে এলাম যেখানে পাথরের নুড়ি পড়েছিল। এবং তা দিয়ে আমরা ঢেকে রাখার চেষ্টা করলাম এছাড়া অন্য কোনো পথ আর খোলা ছিল না। ফেরার পথে বার বার অ্যালিয়েস্টার বলতে থাকেন, ওর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি। এবং কথা আমাকে রাখতেই হবে। তবে আমি জানি না কীভাবে সেটা রাখব। ডলি তখন বাড়িতেই ছিল। উনি তখন বেপরোয়া। তিনি বলে চললেন যে, বেশ কয়েক বছর থেকে আমি জানতাম মলি একটা শয়তান ছাড়া কিছু নয়। সে তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। এবং বাধ্য করেছিল তোমাকে বিয়ে করতে। ওরা এখন আমাকে নিয়ে কী করবে? আমি আর মুখ বুজে থাকব না। ওরা বলবে মলির খুনের জন্য আমি দায়ী। আমি এই কাজের জন্য খুশি নই। আমাকে এই নিষ্ঠুর কাজটা করতে হয়েছে, আমি রক্ত দেখতে চেয়েছিলাম বলে। কিন্তু মলির মৃত্যু দেখার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারিনি। পালিয়ে এসেছি। আমি নিশ্চিত ও করবেই। আমি শুধু চেয়েছি যে, তুমি যেন ওকে দেখতে না পাও।
এ যে দেখছি ভয়ঙ্কর, বীভৎস এবং নিষ্ঠুর কাহিনি, বললেন ডেসমন্ড।
সিলিয়া বললেন, হ্যাঁ বীভৎস তো বটেই তবে জেনে রাখা ভালো তাই না? আমি জানি তিনি খুব মিষ্টি সুন্দর স্বভাবের মেয়ে ছিলেন আর তার মধ্যে শয়তানের কোনো চিহ্ন ছিল না। সারাজীবন ধরে আমার মা খুব ভালো মহিলা ছিলেন। এখন আমি বুঝতে পারি বাবা কেন ডলিকে বিয়ে করতে চাননি। সেই সময় বাবা হয়তো বুঝেছিলেন যে, ডলির মধ্যে ভুল ত্রুটি আছে।
জেলি বললেন, আমরা আশা করেছিলাম মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরে রাতের অন্ধকারে সেটা সরিয়ে এমন জায়গায় রাখা হবে যাতে লোকে দেখে বুঝতে পারে ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় থেকে সমুদ্রে পড়ে গেছেন। অ্যালিয়েস্টার বললেন, আমি মলির কাছে শপথ নিয়েছি। আর ওঁর কথা মতো কাজ করব। ডলিকে বাঁচানোর একটা উপায় আছে যে, ডলিকে ওর ভূমিকা পালন করতে হবে। আমি জানি না সে ওটা করতে সমর্থ কিনা। মৃতদেহটা ডরোথির আর ও যে মলি সেটা ওকে অভিনয় করতে হবে। ডরোথি ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ে উঠে যায় এবং ওখান থেকে পড়ে সে মারা যায়। আর ডলিকে নিয়ে দূরে একটা কটেজে কিছুদিন একসঙ্গে থাকি। তারপর অ্যালিয়েস্টার বলতে থাকেন, ডলির আকস্মিক মৃত্যুর শোক সামলাতে না পেরে মলি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই তিনি তাকে হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন? এদিকে একদিন ডলিকে ফিরিয়ে নিয়ে আমি মলির ভূমিকায় মলির পোশাক আর পরচুল পড়িয়ে। কোকড়ানো চুলের পরচুল ওর আসল মুখের চেহারাটা চাপা দিয়ে দেয়। বৃদ্ধ হাউজকিপার চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। যমজ বোনের ক্ষেত্রে যা হয় ডলি ও মলিকে দেখতে একই রকম ছিল তাই সহজে সবাই ডলিকে মলির ভূমিকায় গ্রহণ করে নিল। তার জন্য কোনো প্রকার সন্দেহ প্রকাশ করেনি। ডলি এমনিতে ছিল গম্ভীর এবং অন্যমনস্কতা ফুটে উঠত। এই ভাবটা মলির তখনকার ভূমিকায় সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিল এবং লোকে ভাবলো বোনের মৃত্যুর শোকটা মলি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
সিলিয়া আশ্চর্য হয়ে বললেন, উনিই বা কী করে মানিয়ে নিলেন নিজেকে মলির ভূমিকায়? নিশ্চয়ই সেটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল।
না, ওঁর কাছে সেটা খুব একটা অসুবিধা বলে মনে হয়নি। উনি যা চেয়েছিলেন সেটাই তো পেয়েছিলেন। অ্যালিয়েস্টারকে তিনি পেয়েছিলেন–কিন্তু অ্যালিয়েস্টার তিনি কী করে সহ্য করলেন? তিনি আমাকে বলেছিলেন কেন আর কীভাবে এই ব্যবস্থাটা সহ্য করে নিলেন।
তিনি আমাকে বলেছিলেন কেন এবং কীভাবে সহ্য করলেন যেদিন উনি আমার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন, সেইদিন তিনি তার মনের কথা আমাকে বলেছিলেন।
তিনি বলেন একটা কাজ করতে শুধু বাকি আছে। মার্গারেটকে শপথ করে বলেছিলাম পুলিশের হাতে ডলিকে ধরিয়ে দেব না। যাতে কখনও কেউ জানতে না পারে ডলি একজন খুনি। এবং ছেলেমেয়েরাও যাতে জানতে না পারে যে তাদের মাসি খুনি।
আমি আর থাকতে না পেরে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলে ফেললাম, আপনি সেটা করবেন কী করে? উত্তরে তিনি বলেন, আমি যা করতে যাচ্ছি সে ব্যাপারে তোমারও জেনে রাখা উচিত।
তিনি বলেন ডলি যাতে বেঁচে না থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে কারণ সে নিজের মুখে বলেছে রক্ত দেখতে ও ভালোবাসে। রক্তের স্বাদ যখন ও পেয়েছে তখন একটার পর একটা খুন ও করবেই। সে কয়েকটা জীবন নষ্ট করবে। বেঁচে থাকার মতো সে উপযুক্ত নয়। আমি যে কারণে সেই অপ্রিয় কাজটা করতে যাচ্ছি আমার নিজের জীবন দিয়েও সেই নিষ্ঠুর কাজটা আমাকে করতেই হবে, ডলির সঙ্গে স্বামী স্ত্রীর মতন আর মাত্র কয়েকটা সপ্তাহ বেঁচে থাকব। তারপর আর একটা বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটবে। তিনি কি বোঝাতে চেয়েছিলেন তা আমি বুঝতে পারিনি–আমি তাকে জিজ্ঞেস করি আর একটা দুর্ঘটনা? আবার ঘুমের ঘোরে হাঁটা। সে আবার কী? তার উত্তরে তিনি বলেন, না, সবাই যা জানবে তা হল আমি আর মলি দু-জনেই আত্মহত্যা করেছি। আমার মনে হয় না কারণটা কেউ জানতে পারবে, তারা হয়তো মনে করতে পারে মলির ক্যান্সার হয়েছে শুনে স্বভাবতই সে আত্মহত্যা করতে পারে কিংবা আমিও সেটা ভাবতে পারি। এই সব ধারণাগুলো লোকেদের মাথায় আসলে তখন তারা ধরে নেবে হয়তো আমরা জীবনের মানে খুঁজতে না পেরে আপোষে দু-জনে মিলে আত্মহত্যা করে থাকব।
দেখো জেলি আমাকে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। তুমি সত্যিকারের আমাকে, মলিকে আর আমাদের ছেলেমেয়েকে ভালোবাসো। আর ডলিকে যদি মরতেই হয় আমাকেই তাহলে এই কাজটা করতে হবে, আমি প্রথমে তাকে গুলি করব এবং পরে নিজেকে নিজে গুলি করব। রিভলবারে তার হাতের ছাপ থাকবে কারণ সে সেটা খুব বেশি ব্যবহার করেনি। ঘাতক হব আমি। একটা কথা তোমাকে বলে যেতে চাই যে আমি এখনও দুজনকেই ভালোবাসি। তিনি বললেন, মলি আমার প্রাণ, আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি, আর ডলির প্রতি আমার করুণা হয়। এবং সব সময়ে মনে হয় ওর জন্মই বোধহয় এইজন্য। তিনি আবার বললেন, সব সময়ে এই কথাগুলি মনে রেখো। জেলি উঠে সিলিয়ার কাছে এসে দাঁড়াল এবং বলল, প্রকৃত সত্য কি তা তো জানলে। তোমার বাবার কাছে শপথ করেছিলাম যে একথা তোমাদের কখনও জানাব না অথবা তোমরা জানতে পারবে না। আমি কল্পনাও করতে পারিনি তোমাদের কাছে বা অন্য কারোর কাছে সেদিনের সেই দুঃখজনক ঘটনার প্রকৃত তথ্য বলব। আমি আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। কারণ মঁসিয়ে পোয়ারো আমাকে অন্যরকম ভাবতে শিখিয়েছেন। এটা একটা এমন বীভৎস কাহিনি
সিলিয়া বললেন, আপনার মনের অবস্থা কেমন আমি বেশ বুঝতে পারছি। আপনি আপনার কথা রক্ষার ক্ষেত্রে ঠিকই করেছিলেন কিন্তু এই বিষয়ে জেনে মনের দিক থেকে কতটা হালকা হলাম। এখন মনে হচ্ছে বিরাট বোঝা আমার ওপর থেকে নেমে গেল–
ডেসমন্ড বললেন, আমরা দুজনেই এই ঘটনা জেনে গেলাম। আমরা কিন্তু কিছু মনে করব না। তবে এটা অবশ্যই একটা বেদনাদায়ক ঘটনা কারণ দু-জন মানুষের একটা সত্যিকারের ট্র্যাজেডি। ওঁরা কিন্তু কেউ কাউকে খুন করেনি। তারা পরস্পর-পরস্পরকে ভালোবাসতেন, একজন খুন হয়েছিলেন আর অপরজন ঘাতকের কাজ করেছেন, কারণ খুনিকে সরিয়ে দিয়ে মানবিকতার খাতিরে যাতে ছেলেমেয়েদের দুঃখ ভোগ করতে না হয়। যদি তিনি কিছু ভুল করে থাকেন কেউ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু আমি মনে করি না যে সত্যি কোনো ভুল হয়েছিল।
সিলিয়া বললেন, তিনি ছিলেন ভয়াবহ প্রকৃতির মহিলা। আমি যখন শিশু ছিলাম তাকে দেখলেই ভীষণ ভয় পেতাম এবং তখন জানতাম না কেন ভয় পাই। তবে এখন বুঝতে পারি কেন তখন ভয় পেতাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার বাবা ছিলেন খুব সাহসী পুরুষ, তিনি যা করেছেন খুব সাহসের সঙ্গেই করেছেন এবং আমার মা করতে বলেছিলেন বলেই করেছিলেন। বাবা তার যমজ বোনকে রক্ষা করেছেন। সিলিয়া এরকুল পোয়ারোর দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন। আমার অনুমান যে, আপনি একজন ক্যাথলিক। তাদের কবরস্তম্ভে কী যেন লেখা ছিল–মৃত্যুতেও ওঁরা বিচ্ছিন্ন হননি। আচ্ছা এর থেকে কি ধরে নেওয়া যায় না যে, ওঁরা একসঙ্গে মারা গিয়েছিলেন। তবে আমি মনে করি ওঁরা অভিন্ন। দুটি মানুষ যাঁরা পরস্পরকে খুব ভালোবাসতেন এবং আমার ভাগ্যহীনা মাসিমাকে খুব বেশি যন্ত্রণা পেতে হয়নি। মনে রাখবেন যা তিনি লাঘব করতে পারেননি। বললেন সিলিয়া। আশ্চর্য ওঁর গলার স্বর কেমন বদলে গেল। বললেন তিনি, কোনো ব্যক্তি যদি ভালো না হয় আপনি শত চেষ্টা করলেও তাকে পছন্দ করতে পারবেন না। তিনি যদি চেষ্টা করতেন বরং অন্য রকম হতে পারতেন। সম্ভবত তিনি তা করতে পারেননি। আর তা যদি হত যে কোনো লোক তার সম্পর্কে ভাবত একজন অসুস্থ মানুষ হিসাবে। আমার মা ও বাবার জন্য আর কোনো চিন্তা আমার নেই, ওঁরা পরস্পরকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতেন যার তুলনা করা যায় না, অসুখী ডলিকেও সমানভাবে ভালোবাসতেন।
ডেসমণ্ড বললেন, সিলিয়া, আমার মনে হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের বিয়ে করা উচিত। তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি যে, আমার মা এব্যাপারে কখনও একটা কথাও জানতে পারবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা উনি আমার নিজের মা নন। এবং উনি সেরকম মানুষই নন যে, যাকে বিশ্বাস করে কোনো গোপন কথা বলা যাবে।
পোয়ারো বললেন, ডেসমণ্ড, আপনার পালিত মা আপনার ও সিলিয়ার ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারে খুবই চিন্তিত ছিলেন। আপনার মনে একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন এই বলে যে, সিলিয়া উত্তরাধিকার সূত্রে তার মা কিংবা বাবার চরিত্রের দোষ গুণ লাভ করতে পারেন। ওঁর সম্পর্কে এরকম ধারণা করে নেওয়ার মতো যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য কারণ আমার কাছে অবশ্যই আছে। আপনি জানতেও পারেন আবার নাও জানতে পারেন যে, আপনি আপনার সত্যিকারের মার প্রচুর অর্থের অধিকারী হতে যাচ্ছেন। তিনি মারা গেছেন বেশি দিন হয়নি। আপনার যাবার আগে তিনি তার সমস্ত টাকা আপনার নামে উইল করে দিয়ে গেছেন। সেই টাকাটা এখন একটা ট্রাস্টের কাছে গচ্ছিত আছে। আপনার বয়স যখন পঁচিশ বছর হবে ঠিক তখনই সেই অর্থের প্রকৃত উত্তরাধিকার হবেন।
ডেসমন্ড বললেন, যদি সিলিয়াকে আমি বিয়ে করি তবে বাঁচার তাগিদে আমাদের অর্থের প্রয়োজন হবে। আমার বর্তমান পালিতা মার টাকার ওপর খুব লোভ এবং তাকে আমি প্রায়ই টাকা ধার দিয়ে থাকি, এবং তিনি এও বলেছেন যে, আমার বয়স এখন একুশ। এখন উইল না করলে খুবই অসুবিধা হবে সুতরাং আমি যেন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করি। আমার অনুমান যে তিনি হয়তো ভেবেছেন যে, টাকাটা তিনি পাবেন। আর আমি ভেবেছিলাম সিলিয়া এবং আমি যখন বিয়ে করতে যাচ্ছি তখন আমার প্রায় সব অর্থই তার জন্য রেখে যাব। কিন্তু সিলিয়ার বিরুদ্ধে আমাকে তার প্রভাবিত করা আমি মোটেই পছন্দ করি না।
পোয়ারো বললেন, আপনার সন্দেহটা সম্পূর্ণ ঠিক। আপনার ভালোর জন্য আপনাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন এটা তিনি নিজেই আপনাকে বলতে পারতেন, সিলিয়ার জন্মের কথা অথবা তার বাবা আর মায়ের চরিত্র সম্পর্কে আপনার জেনে রাখা উচিত কারণ ওঁকে বিয়ে করলে বিয়ের পর যদি কোনো ঝুঁকি থাকে। কিন্তু
ঠিক আছে, বললেন ডেসমন্ড। যেহেতু তিনি আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন এবং বড়ো করে তুলেছেন আমার কৃতজ্ঞতা হিসাবে আমি আমার বাড়তি টাকা তাকে কিছু দিয়ে যাব, কিন্তু ওঁর প্রতি দয়া বলতে কিছু নেই আমার। সিলিয়া আর আমি, একটা সুখের সংসার গড়তে চলেছি। এর আগে ওই একটা ব্যাপারে আমরা দুঃখবোধ করতাম কিন্তু এখন আর আমরা কিছুই চিন্তা করব না। কি বলো সিলিয়া।
সিলিয়া বললেন, না, আমরা আর কখনও চিন্তা করব না। আমি মনে করি আমার বাবা ও মা খুব চমৎকার ছিলেন। মা তার জীবনে বোনের ভালো-মন্দ দেখার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মনে হয় তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ মানুষের স্বভাব কোনোদিনই বদলানো যায় না।
জেলি বললেন, প্রিয় বাচ্চারা আমার। ওহো বাচ্চা বলার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এখন তোমরা বড়ো হয়ে যুবক যুবতীতে পরিণত হয়েছে। সেটা আমি জানি। তোমাদেরকে যে আবার দেখতে পাবো ভাবতে পারিনি। তাই তোমাদেরকে দেখে খুব খুশি হয়েছি। আমি যা করেছিলাম সেটা যে কোনো ক্ষতিকারক ছিল না। এবং তোমরা যে সেটা বুঝতে পেরেছ, তা আমার জেনে খুব ভালো লাগল।
সিলিয়া জেলিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, আপনি আদৌ কোনো ক্ষতি করেননি। আপনার দেখা পেয়ে আমরাও খুব খুশি, এবং আপনি সব সময়েই আমার খুব প্রিয় ছিলেন।
আর আপনিও আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছেন, ডেসমন্ড বললেন, আপনার কথা যখন জানতে পারলাম তখন থেকেই আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল এবং আজ আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হল। আশাকরি আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে সিলিয়াদের পাশের বাড়িতে আমরা থাকতাম এবং আপনি আমাদের সঙ্গে খেলতেন। তখন কী মজার জীবন ছিল।
সিলিয়া এবং ডেসমন্ড দুজনেই মিসেস অলিভারকে ধন্যবাদ জানালেন। এবং বললেন, আপনার খুবই দয়া আর আমাদের জন্য আপনার খুবই কষ্ট করতে হয়েছে। আর আপনাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি মঁসিয়ে পোয়ারো।
সিলিয়া বললেন, হ্যাঁ ধন্যবাদ। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।
জেলি বললেন, আমাকে এক্ষুনি চলে যেতে হবে। আপনার কী ব্যাপার? আর এ-ব্যাপারে কাউকে আপনার কিছু বলতে হবে?
একজন পুলিশ অফিসার আছেন তাকে আমি গোপনে বলতে চাই। এখন আর কাজকর্ম করেন না, কারণ তিনি অবসরপ্রাপ্ত। ঘটনাটি যখন অনেক বছর আগের তখন আর এই বিষয়ে তিনি মাথা ঘামাবেন না। যদি তিনি কর্মক্ষম থাকতেন তবে অবশ্য আলাদা কথা ছিল।
ভয়ঙ্কর বীভৎস একটা কাহিনি, মিসেস অলিভার বললেন। যেসব লোকেদের সঙ্গে দেখা করেছি এব্যাপারে এখন দেখতে পাচ্ছি তারা সবাই কিছু না কিছু ঠিকই মনে রেখেছে। কিছু একটা যা সত্য আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে। সেগুলোকে অবশ্য একসঙ্গে জড়ো করে কাজে লাগাতে পারেনি। কেবল মঁসিয়ে পোয়ারো যিনি সব সময়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারেন। ছোটো ছোটো ঘটনাগুলিকে এক সঙ্গে করে একটা সত্য ঘটনা সৃষ্টি করতে পারেন কেমন অনায়াসে। যেমন পরচুল এবং সেই যমজ বোনের কথাই ধরা যাক।
জেলির কাছে এগিয়ে গেলেন পোয়ারো এবং বললেন যে, আপনাকে এখানে আনার জন্য এবং সেই ঘটনার সময় আপনি কী কী করেছিলেন তা খুলে বলার জন্য আপনাকে চাপ দিয়েছিলাম। সত্যি তার জন্য আমি দুঃখিত। তার জন্য আপনি আমাকে দোষারোপ করবেন না।
না, না। আমি বরং খুশি হয়েছি। আপনি ঠিকই করেছিলেন। দুটি ছেলেমেয়ে খুব ভালো। এবং ওরা নিশ্চয়ই সুখী হবে। আমরা যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, এক সময়ে এখানে দু-জন প্রেমিক প্রেমিকা প্রেম করতেন, সেখানে দু-জন মারাও গেছেন। তার সেই কাজের জন্য আমি জেনারেলকে দোষ দিই না। আমার ধারণা সেটার ভুল হয়ে থাকবে। কিন্তু তা বলে আমি তাকে দোষ দিতে পারি না। সেটা ছিল একটা খুব সাহসিকতার কাজ। যদিও সেটা ভুল হয়ে থাকে তবুও।
হ্যাঁ তাকে আপনি তো ভালোবাসতেন তাই না? বললেন এরকুল পোয়ারো।
হ্যাঁ সব সময়। যেদিন প্রথম আমি এ-বাড়িতে আসি সেইদিন থেকেই তাকে আপনজনের মতো ভালোবাসতাম। আমার মনে হয় না তিনি সেটা জানতেন। এছাড়া অন্য আর কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি আমাকে বিশ্বাস করতেন এবং আমিও তাঁর খুব প্রিয় ছিলাম। আমি ওঁদের দুজনকেই ভালোবাসতামও।
আমি আপনাকে আবার জিজ্ঞেস করতে চাই যে, তিনি ডলি ও মলিকে দু-জনকেই ভালোবাসতেন তাই না?
একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওঁদের দুজনকেই তিনি ভালোবাসতেন, এবং সেই জন্যই তিনি ডলিকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। আর মলিও তার বোনকে সমান ভালোবাসতেন। আর তা না-হলে কেনই বা তিনি মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে তার স্বামীকে দিয়ে শপথ করেছিলেন ডলিকে রক্ষা করার জন্য। তবে দুই বোনের মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসতেন সেটা বলা বেশ শক্ত। এই প্রশ্নটা এমন জটিল যে, সম্ভবত আমি কখনওই এর সঠিক উত্তর দিতে পারব না। আমি কখনও এই বিষয়ে ভেবে দেখিনি এবং ভেবে দেখবও না। এক মুহূর্তের জন্য তার দিকে তাকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন পোয়ারো। তারপর মিসেস অলিভারের সঙ্গে যোগ দিলেন।
দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ফিরে যেতেই হবে। বেদনাদায়ক ঘটনা। প্রেমঘটিত ব্যাপারে এসব এখন ভুলে যান কেমন?
হাতিরা মনে রাখতে পারে। আমরা ক্ষমাশীল এবং আমরা কেমন সহজেই ভুলে যাই, বললেন মিসেস অলিভার।