১১.
ডাইনিং রুমে টুকিটাকি কাজ সেরে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল মলি। পানভোজন গানবাজনা হৈ হট্টগোলের আর একটা সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে। হোটেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা চিন্তা তার মাথায়। টিম আর মলি দুজনে মিলে অনেক স্বপ্ন দেখে চলেছে।
এই সময় মিঃ ডাইসন যেন আচমকা সেখানে উপস্থিত হলেন।
-খুব দুঃখিত, চমকে দিলাম বোধহয়?
–ওঃ মিঃ ডাইসন। সত্যিই, আপনি এসেছেন একদম টের পাইনি।
আশপাশে তখনো কেউ এসে পৌঁছায়নি। মলিকে নিভৃতে পেয়ে খুব আন্তরিক স্বরে মিঃ ডাইসন কথা বলতে লাগলেন। পরে বললেন, ভাবছি তুমি আর আমি একদিন পিকনিক করব।
-মন্দ কি করা যাবে।
বলে মিষ্টি হেসে মলি মিঃ গ্রেগরীকে এড়িয়ে বারে গিয়ে ঢুকল। টিম কাছেই ছিল। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ওখানে মনে হল কার সঙ্গে কথা বলছিলে?
–গ্রেগরী ডাইসন। একটু রঙ্গরস করতে চাইছিল।
–লোকটা মেয়েদের দেখলেই নানারকম প্রস্তাব করে। একটু কড়কে দেওয়া দরকার।
ভেবো না, সময় বুঝে আমিই ব্যবস্থা করতে পারব।
এই সময় টিম কি কাজে সেখান থেকে আবার সরে গেল। মলি রান্নাঘরে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে তীরের দিকে চলতে লাগল।
.
গ্রেগরী ডাইসন আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে নিজের বাংলোর কাছাকাছি আসতেই অন্ধকারে ঝোপের ভেতর থেকে ভূতের ছায়ার মত ভিক্টোরিয়া তার সামনে এসে দাঁড়াল।
মিঃ ডাইসন, একটা কথা বলব আপনাকে।
–অ তুমি। কি হয়েছে?
–দেখুন তো, এটা আপনারই তো?
ট্যাবলেট ভর্তি একটা শিশি সে এগিয়ে ধরল।
-ওঃ, আমার সেরেনাইটের বোতল। এটা আমারই। কোথায় পেলে তুমি?
–সেই মেজর ভদ্রলোকের ঘরে–যিনি এখন কবরে শুয়ে আছে।
–মেজর প্যালগ্রেভের বাংলোতে?
-হ্যাঁ। ওরা আমাকে ঘরের সব জিনিস ফেলে দিতে বলেছিল-টুথপেস্ট, মালিশ, এই ওষুধটাও। এটা আপনি পাচ্ছিলেন না বলে খুঁজে দেখতে বলেছিলেন, তাই নিয়ে এলাম।
–হ্যাঁ, মনে পড়েছে বলেছিলাম। কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছিলাম না।
-আপনি কোথাও রাখেননি। আপনার বাংলো থেকে নিয়ে মেজরের বাংলোতে রাখা হয়েছিল।
-তুমি জানলে কি করে?
–আমি দেখেছি, ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে হাসল ভিক্টোরিয়া, একজন শিশিটা মেজরের ঘরে রেখেছিল। এবার আপনাকে বোতলটা ফিরিয়ে দিলাম।
–কি বলছ তুমি? কাকে দেখেছিলে?
একথার কোন জবাব দিল না ভিক্টোরিয়া। অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।
দাঁড়াও যেও না।
গ্রেগ দুপা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
-কার সঙ্গে কথা বলছ গ্রেগ?
মিসেস ডাইসন বাংলোর রাস্তায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
–ওই কালো মেয়েটা–ভিক্টোরিয়া না যেন কি নাম—
কি বলছিল ও?
–আমার সেরেনাইটের বোতলটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলেছিলাম না, মেয়েটা শিশিটা আমাকে দিয়ে গেল।
-ও সরিয়েছিল নাকি?
–না, কোথায় যেন পেয়েছে বলছিল।
–চল, রাতের খাওয়ার সময় হতে চলল।
.
তীরে গিয়ে মিসেস ইভিলিন হিলিংডনের সঙ্গে দেখা হল মলির। দুজনে দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসল। মলির বুকটা হুহু করছিল। চোখ ঠেলে জল আসতে চাইছিল। কিন্তু কারণ বুঝতে পারছিল না মলি।
–কি হল, মুখ অমন থমথমে কেন তোমার? জানতে চাইলেন ইভিলিন।
–না, কিছু না।
–নিশ্চয়ই টিমের সঙ্গে কিছু হয়েছে?
–না, না–সেসব নয়-
-শুনে সুখী হলাম। তোমাদের দেখলেই সুখী মনে হয়।
–তোমাদের চেয়ে নয়; যাই বলল। এডওয়ার্ড আর তোমাকে দেখে মনেই হয় না তোমাদের মধ্যে কখনো খিটিমিটি হয়।
–আমাদের কথা ভেবে লাভ নেই মলি। গত তিনবছর আমাদের মধ্যে আড়ালে কোন কথাবার্তা নেই।
–কি বলছ, আমিতো বিশ্বাসই করতে পারছি না।
–কি করে করবে। বাইরে যে আমরা মুখোশ পরে থাকি।
–গণ্ডগোলটা কি নিয়ে?
আবার কি, আর একজন–তুমিও তাকে জান—
তুমি কি মিসেস ডাইসন মানে লাকির কথা বলছ? ইভিলিন নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিল।
-ওদের দুজনকে প্রায় সময়ই খোলাখুলি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
–ওতেই কি আর শেষ? লাকির ব্যাপারে এডওয়ার্ড একেবারে পাগল।
–তোমাকে ছেড়ে যেতে চায় নাকি?
–দুটো বাচ্চা আছে বলে আমরা কেউই পরিবার ভেঙে দিতে চাই না। গ্রেগের প্রথম স্ত্রী প্রচুর টাকা রেখে গেছে। সে সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে। আর আমি আর এডওয়ার্ড বন্ধুর জীবন কাটাচ্ছি।
-বুঝতে পারছি না কি করে তুমি সহ্য করছ!
–অভ্যেস হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে অবশ্য ওই নচ্ছার মেয়েমানুষটাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা হয়। যাক ওসব বাদ দাও। তোমার কথা বল।
মলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। পরে বলল, জান আমার কেন যেন মনে হয়, কোথাও কোন গোলমাল রয়েছে। কেবলই মনে হয়, কারা যেন ঝোপের আড়াল থেকে আমাকে লক্ষ্য করছে, পায়ের শব্দ, ফিসফাস এসব যেন শুনতে পাই। কেবলই এরকম মনে হয়। আর ভয় পাই।
-কিসের ভয়? ইভিলিন জানতে চায়।
–তা বলতে পারব না।
–কতদিন এরকম হচ্ছে?
–তা জানি না। তাছাড়াও অন্য একটা ব্যাপার ঘটছে।
–কি ব্যাপার?
–অনেক সময়েই যেন জ্ঞান থাকে না আমার। সেই সময় কিছুই মনে করতে পারি না। মাঝে মাঝে যেন অচেনা কারোর সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু পরে তা আর কিছুতেই মনে করতে পারি না।
–প্রিয় মলি, অবস্থা যা বলছ, তোমার তো ডাক্তার দেখানো দরকার।
-না, না, ডাক্তার দেখাবো না। সব ডাক্তারই এক কথা বলবে-কদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে, অসহ্য।
-আচ্ছা, তোমার বাড়ির লোকজন, মানে মা, বোন বা আর কেউ এমন আছেন, এখানে তোমার কাছে আসতে পারেন?
-মায়ের সঙ্গে আমার বনে না। বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। বললে তারা হয়তো আসবে, কিন্তু আমি ওদের চাই না। কেবল টিম আমার কাছে থাকলেই হয়।
–টিমকে সব বলেছ?
–ঠিক বলিনি। কিন্তু ও বুঝতে পারে। আমাকে লক্ষ্য করে।
–ইভিলিন একমুহূর্ত চিন্তা করে। পরে বলে, আমার মনে হয়, তোমার সবই কল্পনা।
–কল্পনা-হ্যাঁ, তোমার কথাই হয়তো ঠিক। উরেব্বাস, বড্ড দেরি হয়ে গেল। ডাইনিং রুমে এখনই আমার যাওয়া দরকার।
ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে পলকের জন্য ইভিলিনকে বিদ্ধ করে মলি দ্রুত হোটেলের দিকে চলে গেল।
.
১২.
ভিক্টোরিয়ার সেই ছোট্ট ডেরা। ভেতরে ওরা দুজন।
–একটা কিছু করব আমি, বুঝলে? বলল ভিক্টোরিয়া।
ব্যাপারটা বলো আমাকে।
–অনেক, অনেক টাকার ব্যাপার’
–দেখ মেয়ে টাকার লোভে কোন ঝামেলায় যেন জড়িয়ে পড়ো না।
কলস্বরে হেসে উঠল ভিক্টোরিয়া।
-তোমার কিছু ভাবনা নেই। তুমি শুধু দেখে যাও । প্রচুর টাকা বুঝেছ। এমন কিছু দেখেছি আমি, বাকিটা আন্দাজ করতে পারছি। মনে হচ্ছে ঠিকই ধরেছি।
-ইভিলিন, আর নয়, চল আমরা ইংলণ্ডে ফিরে যাই।
চমকে স্বামীর দিকে তাকাল ইভিলিন। বলল, আমরা এসেছি এখনো তিন সপ্তাহ পুরো হয়নি।
ইভিলিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্বামীকে বুঝবার চেষ্টা করতে লাগল।
-সত্যিই তুমি বাড়ি ফিরে যেতে চাও?
–হ্যাঁ।
–তোমার লাকিকে ছেড়ে?
–তুমি নিশ্চয়ই সব জানেনা। কিন্তু আমাকে কিছু বলনি কেন?
–কার জন্য বলব। বছর কয়েক আগেই তো আমাদের সব মিটে গেছে। সব কিছু ভেঙ্গে দিতে চাইনি বলে আমরা দুজন এখনো অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না, হঠাৎ ইংলণ্ড ফিরবার জন্য উতলা হয়ে উঠলে কেন?
–ব্যাপার কিছু নয়। আমি এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে চাই।
–অর্থাৎ আমাকে বোঝাতে চাইছ তুমি প্রেমের টান কাটিয়ে উঠতে পেরেছ? তার দিক থেকে ব্যাপারটা মিটেছে তো? গ্রেগ জানে তোমাদের এসব?
-তা জানি না। সে বরাবরই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে থাকে।
–গ্রেগ, তোমার অস্থিরতার ব্যাপার আমাকে খুলে বলো। এক মুহূর্ত এডওয়ার্ড কি ভাবল। তারপর বলল, লাকির কাছ থেকে এখনই যদি সরে না যাই তাহলে ওকে হয়তো খুন করে ফেলতে পারি।
–লাকিকে খুন করবে? কেন?
–ও একটা জঘন্য কাজ করতে আমাকে বাধ্য করেছিল–একটা খুন করতে ওকে আমি সাহায্য করেছিলাম।
–গ্রেগ, তুমি এসব কি বলছ?
–বিশ্বাস কর ইভিলিন, আমি কি করছি তখন জানতাম না। ওর কথায় কেমিস্টের দোকান থেকে একটা কিছু কিনে দিয়েছিলাম আমি। সেটা ও কি কাজে লাগাবে আমি জানতাম না। পরে ডাক্তারের একটা ব্যবস্থাপত্র আমাকে দিয়ে কপি করিয়ে নেয়।
কবে হয়েছিল এসব?
–চার বছর আগে। আমরা মার্টিনিতে ছিলাম। গ্লেগের প্রথমা স্ত্রী
–মানে? তুমি বলছ লাকি তাকে বিষ খাইয়েছিল?
–হ্যাঁ। আর আমি ওকে সাহায্য করেছিলাম। পরে বুঝতে পেরে
ইভিলিন বাধা দিয়ে বলল, কাজ শেষ হলে নিশ্চয় লাকি তোমাকে বলে তুমিই ব্যবস্থাপত্র কপি করেছ, ওষুধ এনে দিয়েছ। তুমিও তার সঙ্গে ছিলে তাই তো?
-হ্যাঁ। ও আমাকে বলেছিল, সে নাকি লাকিকে অনুরোধ করেছিল তাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে। সেই অনুকম্পার বশেই কাজটা করেছে।
–অনুকম্পার বশে খুন! আর তুমিও তাই বিশ্বাস করেছিলে?
–অত তলিয়ে ভাবিনি। আমি তখন ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।
–লাকি যখন গ্রেগকে বিয়ে করল, তখনো তোমার ভুল ভাঙ্গেনি? গ্রেগ জানতো না কিছু?
–কিছুই জানত না।
–অবিশ্বাস্য। মোটেই বিশ্বাস করতে পারছি না।
–ইভিলিন, এডওয়ার্ড হিলিংডন সহসা আর্তনাদ করে উঠল, আমি এর থেকে মুক্তি চাই। ওই নচ্ছার মেয়েটা আমি যা করেছি তার জন্য এখনো আমাকে ব্যঙ্গ করে। ও জানে ওকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। কিন্তু এমন ভাব করছে যেন আমি তার কাছে বাঁধা পড়ে আছি।
ইভিলিন চিন্তিতভাবে ঘরে পায়চারি শুরু করল। পরে এডওয়ার্ডের সামনে এসে বলল, তোমার আসল গোলমালটা আমি ধরতে পারছি এডওয়ার্ড। তুমি অতি আবেগপ্রবণ আর সরল মানুষ। সেই সুযোগ নিয়েই শয়তানী মেয়েটা তোমাকে তার ইচ্ছামত কাজে লাগিয়েছে। ব্যাভিচারের পাপবোধ তোমার মধ্যে ছিল।
তুমি লাকির সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত ছিলে। সেকারণেই খুনের মতলবে সে তোমাকে এমনভাবে কাজে লাগিয়েছে যাতে এ ব্যাপারে জড়িত বলে তুমি আরও অপরাধবোধে আচ্ছন্ন থাক। কিন্তু এডওয়ার্ড, যা বললে, সবই সত্যি না তোমার বানানো?
–সত্য না হলে এভাবে তোমাকে বলতে পারি ইভিলিন। আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। চলো ইভিলিন আমরা ইংলণ্ডে ফিরে যাই।
-হ্যাঁ, তাই যাবো। তবে এখনই নয়।
–কেন?
বাকিটা দেখতে হবে। আমরা যেমন চলছি তেমনই চলব। আমাদের উদ্দেশ্য কোনভাবেই যেন লাকি জানতে না পারে। বুঝতে পেরেছ এডওয়ার্ড?
.
১৩.
সন্ধ্যা উতরে গেছে। রাত নেমে আসছে শিকারী বিড়ালের মত। সমাপ্তির সুর বাজছে হোটেলের স্টিল ব্যাণ্ডে। একে একে অতিথিরা ডাইনিং হল ছেড়ে শুতে চলে যাচ্ছে।
ডাইনিং হলের পাশে খোলা চত্বরের প্রান্তে দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে কথা বলছিল টিম আর ইভিলিন।
মলির শরীর সম্পর্কে সবকথা জানিয়ে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইভিলিন। শেষে বলল, আমার মনে হয় এখনই মলিকে ডাক্তার দেখানো দরকার।
–সেটা, জানি, বলল টিম, কিন্তু ও কিছুতেই সেটা করতে দেবে না। মনে হয় ডাক্তারের নামে অকারণ একটা ভয় আছে ওর।
-তোমাদের পারিবারিক কাউকে এসময় কাছে এনে রাখার সুবিধা নেই?
সেরকম সুযোগ নেই। কারোর সঙ্গেই, বিশেষ করে ওর মার সঙ্গে মলির বনিবনা নেই। তবে এই অবস্থাটাই ভাল বলে মনে হয় আমার।
–আমার মনে হয় এক ধরনের বাতিকে ভুগছে মলি।
–তা ঠিক নয়। স্নায়বিক কোন ব্যাপার বলেই আমার মনে হয়।
–সেক্ষেত্রে তো একজন মনস্তাত্ত্বিকের পরামর্শ নিতে পার।
–লাভ নেই। আমি ওসব আলোচনা করতে চাই না, ওর মাও মনস্তাত্ত্বিকের পেছনে কম ঘোরেনি।
–বলতে চাইছ, ওদের পরিবারে এধরনের ব্যাপার ছিল? মানে মানসিক রোগ।
-হ্যাঁ, এসব রোগ কিছুটা বংশানুক্রমিক। তবে তুলনায় মলি সুস্থই আমি বলব। ওই মেজর প্যালগ্রেভের মৃত্যুর পর থেকেই যত গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। একটা মানবিক ধাক্কা পেয়েছে।
টিম, তুমি কি আমায় অনুমতি দেবে–যদি আমি মলিকে নিউইয়র্ক বা মিয়ামিতে নিয়ে গিয়ে ভাল ডাক্তার দেখাতে চাই?
–তোমার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ ইভিলিন। মলি ক্রমেই ভাল হয়ে উঠছে–ও ঠিক আছে।
ইতিমধ্যে বেশির ভাগ অতিথিই নিজেদের বাংলোয় ফিরে গেছে। ইভিলিনও বিদায় নিয়ে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
দেখা গেল উপকূলের দিকে থেকে সিঁড়ির কাছে হেঁটে আসছে মলি। শরীর কাঁপছিল থরথর করে। এলোমেলো হাঁটার ভঙ্গি।
মলিকে দেখে চিৎকার করে উঠে টিম ও ইভিলিন ছুটে গেল তার দিকে।
মলি ততক্ষণে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাতদুটো পেছনে রেখে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠল-আমি ওকে দেখেছি…ওই সামনের ঝোপটাতে…আমার হাত দেখ–
ইভিলিন মলির হাত টেনে ধরেই বোবা হয়ে গেল। দুহাত ভর্তি রক্তের দাগ বুঝতে কষ্ট হল না তার।
–কি হয়েছে মলি? আর্তনাদের স্বরে বলে উঠল টিম।
কেমন টলে উঠল মলি। বলল, ওই ওখানে…ঝোপের মধ্যে।
টিম ইভিলিনের দিকে তাকালো। মলিকে তার দিকে সামান্য ঠেলে দিয়ে দ্রুত সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল। ইভিলিন দুহাতে মলিকে জড়িয়ে ধরে বলল, শান্ত হও মলি, এখানে একটু বোসো।
মলি অবসন্নের মত চেয়ারে গা এলিয়ে বসে পড়ল। হাত দুটো চোখের সামনে তুলে চিৎকার করে উঠল–ওঃ, আমার কি হয়েছে?
–সব ঠিক হয়ে যাবে মলি। ভেবো না।
টিম ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। তার মুখ থমথমে।
ইভিলিন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। টিম বলল, আমাদের একজন কাজের মেয়ে–ভিক্টোরিয়া, কেউ ওকে ছুরি মেরে খুন করেছে।
.
১৪.
মলি শুয়ে আছে বিছানায়। ওয়েস্ট ইণ্ডিজ পুলিশের দুই ডাক্তার ডাঃ রবার্টসন ও ডাঃ গ্রাহাম বিছানার একপাশে। অন্যপাশে টিম দাঁড়িয়ে আছে। ডাঃ রবার্টসন মলির নাড়ী দেখছিলেন।
কাছেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ ইনসপেক্টর ওয়েস্টন।
ডাঃ রবার্টসন পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশি সময় নেবেন না। মোটামুটি বক্তব্য শুনতে পারেন।
ইনসপেক্টর দুপা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস কেণ্ডাল, মেয়েটিকে আপনি কিভাবে দেখতে পেয়েছিলেন?
-ঝোপের মধ্যে…একটা সাদা কিছু চোখে পড়ল…আমি তুলতে চেষ্টা করলাম..দুহাত রক্তে ভরে গেল।
–উপকূলের রাস্তায় আপনি কি করছিলেন?
–সমুদ্রের বাতাসে ভাল লাগছিল
–মেয়েটিকে আপনি জানেন?
–হ্যাঁ। ভিক্টোরিয়া বড় ভাল মেয়ে। খুব হাসতো-ওঃ, আর ও হাসবে না–
ডাঃ রবার্টসন বললেন, একটা ইনজেকশন দিতে হবে। চব্বিশঘণ্টার মধ্যে ওকে দিয়ে আর কিছু বলানো ঠিক হবে না।
-ধন্যবাদ, আমি পরে খবর নেব। বলে ইনপেক্টর বিদায় নিলেন।
.
টেবিলের সামনে বসে থাকা দুজনের দিকে তাকিয়ে বিশালদেহী সুদর্শন নিগ্রোটি বলে উঠল, শপথ করে বলছি, আমি আর কিছু জানি না। সবই বলেছি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডেভেনট্রি মুখোমুখি চেয়ারে বসা গোয়েন্দা দপ্তরের ইনপেক্টর ওয়েস্টনের দিকে তাকালেন। ওয়েস্টনের ইঙ্গিতে নিগ্রোটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ওয়েস্টন বললেন, লোকটি যা জানে সবই বলেছে। মনে হয় ওরা দুজনই নির্দোষ।
–হ্যাঁ, ওদের দুজনের সম্পর্ক ভালই ছিল, বললেন ডেভেনট্টি, ওদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি। দ্বীপে এরকমই হয়ে থাকে। ওদের দুটো বাচ্চা রয়েছে।
ভিক্টোরিয়া এর মধ্যে ছিল বলে মনে হয় তোমার? ওয়েস্টন জানতে চাইলেন।
খুব সম্ভব না। তবে আমার সন্দেহ, খুনের ঘটনার কিছু মেয়েটা দেখে থাকবে। পিলের শিশি সম্পর্কে। যতদূর জেনেছি শিশিটা মিঃ ডাইসনের। তার কথাটা একবার শোনা দরকার মনে হয়।
একটু পরেই গ্রেগরি হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন।
–আপনাদের সাহায্যের জন্য কি করতে পারি বলুন।
–ভিক্টোরিয়াকে আপনি চিনতেন? ওয়েস্টন জিজ্ঞেস করলেন।
–বিলক্ষণ। তার মৃত্যুটা খুবই দুঃখজনক। আমরা দুজনেই ওকে পছন্দ করতাম। মনে হয় পুরুষ সম্পর্কিত কোন ঝগড়াঝাটি ছিল। গতরাতেই ওর সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করেছি।
–মিঃ ডাইসন, আপনি একটা ওষুধ, সেরেনাইট নাম–
-হ্যাঁ, ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী আমি ওধুষটা খেতাম। বেশি রকমের ব্লাডপ্রেসার আছে আমার।
-যতদূর মনে হয় এখানে কম লোকই তা জানে।
–হ্যাঁ। নিজের অসুস্থতা নিয়ে অনেকের মত বলে বেড়ানো আমার অভ্যাস নয়।
–কতগুলো পিল আপনি খান?
–সারাদিনে দু থেকে তিনবার। সবসময়ই কয়েক শিশি সঙ্গে রাখতে হয়।
–সেগুলো কোথায় রাখেন?
–সুটকেসে তালা দেওয়া থাকে। কেবল একটা বাইরে থাকে।
–শুনেছি, সেই বোতলটা কিছুদিন থেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না?
–ঠিকই শুনেছেন। ভিক্টোরিয়াকে খুঁজে দেখতে বলেছিলাম।
–শিশিটা সর্বশেষ কোথায় ছিল?
–আমার বাথরুমের তাকে।
–তারপর কি হল?
–ভিক্টোরিয়া শিশিটা এনে দেয়। বলে মেজর প্যালগ্রেভের ঘরে খুঁজে পেয়েছিল। জানতে চেয়েছিলাম, ওটা ওখানে গেল কি করে?
-উত্তরে ও কি বলেছিল?
-বলেছিল ও জানে না। তবে ওর হাবভাব দেখে সন্দেহ হয়েছিল, সবকথা আমাকে জানায়নি। সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। ভেবেছিলাম, ভুলবশত হয়তো কোথাও ফেলে এসেছিলাম। মেজর দেখতে পেয়ে তুলে এনেছিলেন, আমাকে পরে দেবেন বলে।
–এ ব্যাপারে আর কি জানেন আপনি?
–এটুকুই জানি। মেয়েটি ছুরির ঘায়ে মারা গেছে শুনেছি। অবশ্য রাত কটায় মারা গেছে জানি না। আর শুনেছি মিসেস কোল ওকে দেখতে পায়। বেচারি মলি, খুবই ধাক্কা খেয়েছিল অবশ্যই।
-আচ্ছা মিসেস কেণ্ডালকে শেষ কখন দেখেন?
–পোশাক বদলাতে যাবার আগে। টেবিলে ছুরি-চামচ ইত্যাদি সব গুছিয়ে রাখছিল। ঠাট্টা করার মেজাজেই ছিল ও। খুবই হাসিখুশি ভাল মেয়ে ও।
–ঠিক আছে, ধন্যবাদ মিঃ ডাইসন। ভিক্টোরিয়া জনসন পিলের শিশিটা দেবার সময় আপনাকে আর কিছু বলেনি বলছেন?
-না। কেবল জানতে চেয়েছিল, শিশিটা আমার কিনা।
এরপর মিঃ ডাইসন বিদায় নিলেন।
–খুবই বিবেচক মানুষ। নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে খুবই সচেতন। বললেন ওয়েস্টন, ওর সুযোগ কেমন মনে করেন?
ডেভেনটি কি বলতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ঘরের বাইরে হৈহট্টগোল শোনা গেল। পরক্ষণেই উর্দিপরা একজন পুলিস কর্মচারী ঘরে ঢুকে জানাল, এখানকার একজন রাঁধুনী আপনাদের সঙ্গে দেখা করবে বলে জেদ ধরেছে। জরুরী কিছু নাকি জানাতে চায়।
ওয়েস্টনের ইঙ্গিতে লোকটিকে ঘরে নিয়ে আসা হল। মাথায় রাঁধুনীর টুপি, গাঢ় রঙের লোকটিকে দেখে একজন কিউবান বলেই মনে হয়। লোকটি হড়বড় করে বলতে লাগল, স্যার, উনি রান্নাঘর দিয়ে গিয়ে বাগানে বেরিয়ে গেলেন। আমি স্পষ্ট দেখেছি স্যার, একটা ছুরি ছিল…ওর হাতে একটা ছুরি ধরা ছিল।
-শান্ত হও, ডেভেনট্রি বললেন, তুমি কার কথা বলছ?
–আমাদের মালিকের স্ত্রী স্যার…মিসেস কেণ্ডাল, হাতে একটা ছুরি ছিল। রান্নাঘর দিয়ে অন্ধকার বাগানের দিকে চলে গেলেন। ঠিক রাতের খাওয়ার আগে–আর ফিরে আসেননি–
.
১৫.
–এই হোটেলের পেছনে আমাদের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছিলাম। আমার আর মলির অনেক স্বপ্ন ছিল। দেখছি সবই ডুবতে বসেছে। সবাই চলে যেতে চাইছে। জানি না এর পরে কি হবে। সব তাড়াতাড়ি মিটে গেলে বাঁচা যেত। বলল টিম।
বুঝতে পারছি মিঃ কেণ্ডাল, বললেন, ইনপেক্টর ওয়েস্টন, আপনাদের ওপর খুবই চাপ পড়ছে।
–বেচারি ভিক্টোরিয়া। খুবই ভাল মেয়ে ছিল। মনে হয় প্রেমঘটিত কিছু ছিল, হয়তো ওর স্বামী–আপনাদের যেমন দরকার আমাকে প্রশ্ন করুন।
–হ্যাঁ, তাই করছি। গতরাতে দশটা তিরিশ মিনিটের পর থেকে যে কোন সময় ভিক্টোরিয়া জনসন নিহত হয়। সেই সময়ে গান বাজনা নাচ নিয়ে সকলেই মেতে উঠেছে। ইচ্ছেমত ঘোরাফেরা করছে।
-হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা। অতিথিদের মধ্যেই কেউ ওকে খুন করেছে বলে মনে হয়? টিম বলল।
–সবই তদন্ত সাপেক্ষ মিঃ কেণ্ডাল। আপাতত একজন রাঁধুনী যে মন্তব্য করেছে সেসম্পর্কে আপনার কি মত?
-ওঃ এনরিকো? সে কিউবার লোক। সে কি বলেছে?
–আপনার স্ত্রী লোকজন ডাইনিং রুমে পৌঁছনোর আগে, রান্নাঘরের মধ্য দিয়ে বাগানের দিকে চলে গিয়েছিলেন। তার হাতে একটা ছুরি ছিল।
মলির হাতে ছুরি? হতবাক টিম। লোকজনরা জিনিসপত্র অগোছালো করে রাখে, তাই মলি সবসময়ই গোছগাছ করে রাখতো। কঁটাচামচ ইত্যাদি সব। বাড়তি একটা চামচ বা কাটা হয়তো ওর হাতে ছিল।
–ডাইনিং রুমে আপনার সঙ্গে তার কথা হয়েছিল?
–হ্যাঁ, হয়েছিল। কার সঙ্গে কথা বলছিল জানতে চেয়েছিলাম।
–কার সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি?
–গ্রেগরী ডাইসনের সঙ্গে।
–হ্যাঁ, উনিও সেকথা বলেছেন।
–গ্রেগরীর একটু গায়েপড়া স্বভাব আছে, বিশেষ করে মেয়েদের। মলি তাই বলেছিল। আমি বলেছিলাম লোকটাকে একটু কড়কে দেওয়া দরকার।
–ওদের মধ্যে কোন কথা কাটাকাটি হয়েছিল?
–ঠিক মনে পড়ছে না। সেরকম কিছু হয়েছিল বলে মনে হয় না।
–কিন্তু আপনার রাঁধুনী বলেছে আপনার স্ত্রী রান্নাঘর দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল–তার হাতে একটা ছুরি ছিল।
-ওসব কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। টিম অস্বস্তির সঙ্গে তাকালো, ডাইনিং রুমে খাবার সময় মলির হাতে ছুরি থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।
–আপনার স্ত্রী ডাইনিং রুমে খাওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন?
–আমি…ওঃ হ্যাঁ, আমরা দুজনেই অতিথিদের আপ্যায়ন করি।
উনি উপকূলের পথ হয়ে আসছিলেন কেন বলতে পারেন?
–ডিনারের পরিশ্রমের পর একটু ঘুরে আসতে পছন্দ করত।
–তিনি যখন ফিরে আসেন, তখন বোধহয় আপনি মিসেস হিলিংডনের সঙ্গে কথা বলছিলেন?
-হ্যাঁ। মলিকে নিয়ে হোটেল চালানো, ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলছিলাম আমরা।
–এরপর কি ঘটেছে বলুন।
মলি ফিরে এসেছিল। তার হাতে রক্ত ছিল। মেয়েটাকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে দেখে ও তাকে তুলবার চেষ্টা করেছিল। তাতেই ওর হাতে রক্ত লেগে গিয়েছিল। আপনারা কি কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছেন?
ডেভেনট্রি বললেন, দয়া করে শান্ত হোন। শুনলাম আপনার স্ত্রীর শরীর ইদানীং ভাল যাচ্ছে না।
-বাজে কথা। ও ভালই আছে। মেজর প্যালগ্রেভের মৃত্যুতে স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা । বিপর্যস্ত বোধ করছিল।
মিসেস কেণ্ডাল সুস্থ হয়ে উঠলে আমরা তাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। অবশ্যই তাকে বিরক্ত করব না।
জবাবে টিম চুপ করে থাকল।
.
ইভিলিন হিলিংডন শান্ত ধীর কণ্ঠে বললেন, টিম কেণ্ডালের সঙ্গে যখন আমি কথা বলছিলাম। তখনই সিঁড়ি দিয়ে উঠে তার স্ত্রী খুনের কথা জানায়।
–টিম কেণ্ডালের সঙ্গে আপনার কি বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছিল?
–অদ্ভুত প্রশ্ন। ঠিক মনে পড়ছে না। সম্ভবত ওদের ব্যবসা সংক্রান্ত।
এর পর আর দু-একটির বেশি প্রশ্ন করার দরকার হল না। ইনপেক্টর ওয়েস্টন বললেন, ধন্যবাদ মিসেস হিলিংডন।
.
–আপনার কাছ থেকে কেবল বিষয়টা পরিষ্কার করে নিতে চাইছি মিসেস কেণ্ডাল। ডাঃ গ্রাহাম বলেছেন, আপনি কথা বলার মত সুস্থ হয়েছেন। আচ্ছা, মৃত মেয়েটিকে আপনি কিভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন? শুনেছি ডিনারের পর আপনি একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, প্রায়ই যাই।
–আপনি কোনদিকে হাঁটতে গিয়েছিলেন?
–তীরের দিকের রাস্তায়।
–তারপরে?
–হিবিসকাস ঝোপের মধ্যে কি যেন চোখে পড়ল হঠাৎ, আমি আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে টানতে গেলাম।…দেখতে পেলাম ভিক্টোরিয়া…রক্তে আমার হাত ভরে গেল।
–খুবই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। বেড়াতে যাওয়ার সময় হাতে কেন ছুরি নিয়ে গিয়েছিলেন?
–ছুরি? ছুরি নিতে যাব কেন?
–আপনাদের রান্নাঘরের এক অধস্তন কর্মচারী বলেছে, আপনি যখন রান্নাঘর দিয়ে বাগানে গিয়েছিলেন, আপনার হাতে একটা ছুরি ছিল।
-কিন্তু আমি তো রান্নাঘর হয়ে যাইনি। আপনি ডিনারের আগের কথা বলতে চাইছেন—
আপনি টেবিলে ছুরিকাঁটাচামচ গুছিয়ে রাখছিলেন?
মাঝে মাঝে করতে হয়। পরিচারকরা অনেক সময়েই কাঁটা অথবা ছুরি ঠিকঠিক রাখতে ভুল করে।
-ওই অবস্থাতেই সম্ভবত আপনি একটা ছুরি হাতে রান্নাঘর পার হয়ে গেছেন।
-মনে হয় তা করিনি।
–ভিক্টোরিয়া মেয়েটিকে কে মারতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
–আমার কোন ধারনাই নেই।
–ধন্যবাদ, আপাততঃ এটুকুই।
মলি বিদায় নিলে ডেভেনট্টি বলে উঠলেন, টেবিল ছুরিকে খুনের অস্ত্র হিসেবে ভেবে নেয়াটা কষ্টকল্পনা ছাড়া কিছু নয়।
–কিন্তু মিঃ ডেভেনট্টি, ছুরিটা মাংসকাটার ছুরি ছিল। রাতে মেনুতে মাংস ছিল। তাই সব ছুরিই শানানো ছিল।
-না, না, এই মাত্র যে মেয়েটির সঙ্গে কথা বললাম, তাকে একজন হত্যাকারিণী ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ওয়েস্টন?
–একথা বিশ্বাস করবার মত অবস্থা এখনো হয়নি। এমনতো হতে পারে, ডিনারের আগে বাগানে যাওয়ার সময় একখানা ছুরি তুলে নিয়েছিলেন। অন্যমনস্ক ভাবেই হয়তো ব্যাপারটা করেছিলেন। মিসেস কোল কোথাও ছুরিটা ফেলে রেখে দিতে পারেন। অন্য কেউ সেটা খুঁজে পেয়ে…তবে এটা ঠিক, আমি নিজেও ওকে খুনী বলে ভাবতে পারছি না।
ডেভেনট্রি চিন্তিত ভাবে বললেন, তবে আমার ধারণা উনি যা জানেন তার সব বলেননি।
–আমি ভাবছি অন্য কথা। ডিনারের সময় স্বামী সেখানে থাকলেও স্ত্রীকে কেউ সেখানে দেখেনি।
–কারও সঙ্গে তিনি দেখা করতে যান তুমি বলতে চাইছ?
–সম্ভবত ভিক্টোরিয়া জনসনের সঙ্গে। অথবা ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল এমন কাউকে দেখে থাকবেন।
নিশ্চয় গ্রেগরী ডাইসনের কথা ভাবছ?
.
১৬.
কিছু একটা করতেই হবে এবং নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই–এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। মিস মারপল।
ইতিমধ্যে অনেক কথাই তিনি জানতে পেরেছেন। তবে সেটুকুই যথেষ্ট নয়।
মিঃ র্যাফায়েল তার নিজের বাংলোর সামনে বসেছিলেন। মিস মারপলকে তিনি খবর পাঠালেন।
তার নিজের বাংলো আর মিঃ র্যাফায়েলের বাংলোর দুরত্ব কয়েক কদম মাত্র। মিস মারপল ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।
–আপনি আমাকে ডাকছিলেন?
নিশ্চয়ই ডাকছিলাম; বললেন মিঃ র্যাফায়েল, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। দ্বীপে যা সব অদ্ভুত ব্যাপার চলছে। নানান ফিসফাস কানে আসছে। এসবের একেবারে বাইরে রয়েছেন কেবল আপনি আর ওই পাদ্রী-মিঃ প্রেসকট আর তার বোন।
–অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এরকম ফিসফাস অস্বাভাবিক নয়। বললেন মিস মারপল।
দ্বীপের মেয়েটাকে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় ঝোপের কাছে পাওয়া গেল, বললেন মিঃ র্যাফায়েল, সম্ভবত ঈর্ষাঘটিত কোন ব্যাপার-ওর সঙ্গী লোকটার হয়তো কোন নতুন মেয়ে জুটে ছিল। এই এলাকার যৌন জীবন এই ধরনেরই।
–আমার অবশ্য তা মনে হয় না।
কর্তৃপক্ষও তা মানেননি। মেজর প্যালগ্রেভকে মনে হয় খুন করা হয়, আপনি কি মনে করেন?
-আমার আশঙ্কা সেটাই ঠিক কথা।
-হ্যাঁ, সম্পূর্ণ ঠিক। ক্যাভেনট্রির কাছে সবই শুনলাম। আপনি ডাঃ গ্রাহামকে কিছু বলেছিলেন। সে ডেভেনট্রিকে তা জানায়। তখন যোগাযোগ করা হয় গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে। তারা বুঝতে পারে ব্যাপারটা গোলমেলে, তাই মেজরের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে পরীক্ষা করে।
–ওরা কি জানতে পেরেছে?
–ওরা জেনেছে, প্যালগ্রেভকে বেশিমাত্রায় এমন কিছু খাওয়ানো হয়েছে যার সঠিক পরিচয় ডাক্তাররাই জানে। যতদূর সম্ভব জিনিসটা ডাই-ফ্লোর, হেক্সাগোনাল বা ইথাইল কারবেনজোল জাতীয় কিছু। এসব বেশিমাত্রায় খাওয়াতে পারলে মৃত্যু নিশ্চিত। উপসর্গ দেখে বেশিরকমের ব্লাড প্রেসার বলেই মনে হবে। এক্ষেত্রে তাই সবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল, তাই কেউ প্রশ্ন তোলেনি। আচ্ছা মেজরের ব্লাড প্রেসার ছিল আপনাকে কখনো বলেছিল?
-না।
–আমাকেও বলেনি। অথচ সকলেই এটা মেনে নিয়েছিল।
-আমার ধারণা মেজর লোককে বলে বেড়াতেন। মিঃ ডাইসনের ব্লাডপ্রেসার আছে, ওর স্ত্রী বলেছে।
কাজেই ডাইসনের ঘরের ওষুধের শিশি মেজরের ঘরে রেখে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল অতিরিক্ত ব্লাডপ্রেসারের জন্যই তার মৃত্যু হয়েছে।
-আমারও তাই ধারণা, মিস মারপল বললেন, সেই সঙ্গে রটনা করে দেওয়া হয় যে মেজর প্রায়ই লোককে তার ব্লাড প্রেসারের কথা বলে বেড়াতেন। এ ধরনের গল্প বানানো যায় খুবই সহজে। এখানে-ওখানে কিছু কথা ছড়িয়ে দিলেই কাজ হাসিল হয়।
–অত্যন্ত ধূর্ত কেউ একজন কাজটা সাফল্যের সঙ্গে করেছে, মিঃ র্যাফায়েল চিন্তিত ভাবে বললেন, আমার ধারণা ওই মেয়েটা কিছু দেখেছিল কিংবা জানত আর সে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেছিল।
–তা, না-ও হতে পারে। কেউ হয়তো ওর মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল।
–এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। এরপর আপনার অভিমত কি শোনা যাক। আপনি আমার চেয়েও বেশি কিছু জানেন বলে আমার ধারণা। ব্যাপারটা আমার আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছে। আমি লক্ষ্য করেছি, মেজর প্রায়ই আপনার সঙ্গে গল্প করে কাটাতেন। অন্যরা বিশেষ আমল দিত না তাকে। মেজর আপনাকে কি বলেছিলেন?
বেশ কিছু গল্প অনেককেই শোনাতেন মেজর। আমাকেও শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন তিনি একজন খুনীকে চেনেন। তার কাছে ছবি আছে। সেটা আমাকে দেখাতে চেয়েছিলেন–কিন্তু পারেন নি।
-কেন?
-কারণ আকস্মিকভাবে কাউকে চোখে পড়েছিল তার। ছবিখানা পকেট থেকে বার করে এনেও আবার ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। পরে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছিলেন।
-প্যালগ্রেভ কাকে দেখেছিলেন?
–সঠিক বলতে পারব না। আমরা বাংলোর সামনে বসেছিলাম। আমার সামনেই মেজর বসেছিলেন। তিনি যাই দেখে থাকুন, দেখেছেন আমার বাম কাঁধের ওপর দিয়ে।
-আপনার ডানদিকের পেছনের পথ ধরে কেউ আসছিল?
–হ্যাঁ। মিঃ আর মিসেস ডাইসন আর হিলিংডন দম্পতি। ওই রেখা বরাবর আপনার বাংলোটাও চোখে পড়ে।
-ওহো, তাহলে আমার এসথার ওয়াল্টার্স আর জ্যাকসনকেও এর মধ্যে ধরা যায়। এদের দুজনের যে কোন একজনের পক্ষেই বাংলো থেকে বেরিয়ে আসা বা ঢুকে পড়া সম্ভব আপনার অজান্তেই।
-হ্যাঁ, সেটা সম্ভব ছিল। আমি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে দেখিনি।
–তাহলে দেখা যাচ্ছে–ডাইসন আর হিলিংডনরা এবং এসথার আর জ্যাকসন–এদের কেউ একজন খুনী। আবার আমিও হতে পারি।
মিস মারপল হাসলেন। বললেন, মেজর খুনীকে একজন পুরুষ বলেই উল্লেখ করেছিলেন। ফলে ইভিলিন লাকি আর এসথার ওয়াল্টার্সকে আমরা বাদ রাখতে পারি।
ব্যাপারটা এরকম ঘটেছিল বলে মনে হয়, মেজর পকেট থেকে ছবিটা বের করে লোকটির মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে মুখ তুলেই অবিকল একই মুখ দেখতে পেয়ে যান। অতটা না হলেও হয়তো সেই মুখের আদলই তিনি দেখতে পান।
-হ্যাঁ, এটা হওয়া সম্ভব। মিঃ র্যাফায়েল বললেন।
নিশ্চিত চমকে গিয়েছিলেন মেজর। এবং সঙ্গে সঙ্গেই ছবিটা পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গল্প জুড়েছিলেন। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে পরে এক সময় তিনি ছবিটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতেন আর লোকটাকেও দেখে মিলিয়ে সিদ্ধান্ত করার চেষ্টা করতেন দুজনে একই ব্যক্তি কিনা।
-হ্যাঁ, এটাই সম্ভব বলে আমি মনে করি। কথা শেষ করে মিঃ র্যাফায়েল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মিস মারপলের দিকে। পরে আবার বললেন, যাই হোক, এবারে আপনি কি ভাবছেন তা জানতে ইচ্ছা করে।
–ঘটনাগুলোর পেছনে জোরালো কোন্ উদ্দেশ্য আছে বোঝা যাবে যদি খুব শিগগিরই আর একটা খুনের ঘটনা ঘটে যায়।
চমকে উঠলেন মিঃ র্যাফায়েল কথাটা শুনে। বললেন, ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে বলুন।
-বুঝিয়ে বলার ব্যাপারে আমার খুব একটা দক্ষতা নেই মিঃ র্যাফায়েল। তবে মেজরের গল্পটা নিশ্চয় আপনার মনে আছে, একজন স্ত্রীলোক খুন হয়েছিল। কিছু সময় পরে একই রকম পরিস্থিতিতে আরও একটা খুনের ঘটনা ঘটে। অন্য নামের একজন ভদ্রলোকের স্ত্রী একই রকম অবস্থায় মারা যান। এর থেকে আমি যা বুঝতে পারছি তা হল, খুন করা খুনীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন, কোন লোক একবার কোন খারাপ কাজ করে রেহাই পেয়ে গেলে স্বভাবতই তার উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। ব্যাপারটাকে সহজ বলেই সে ভাবতে থাকে। ফলে সে আবার অপরাধ করতে উৎসাহী হয়।
তবে প্রতিবারেই সে নিজের নাম আর ঘটনাস্থল বদলে নেবে। আমি ঠিক ভাবছি কিনা বুঝতে পারছি না।
মিঃ র্যাফায়েল কোন মতামত ব্যক্ত করলেন না। তিনি স্থির দৃষ্টিতে অপেক্ষা করতে থাকেন।
–ঘটনার স্রোত যদি এরকমই হয় তাহলে খুনী এখানেও স্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। আর যদি অল্পদিনের মধ্যেই এমন কোন খুনের ঘটনার মতলব এঁটে থাকে তাহলে সে কখনোই চাইবে না মেজর প্যালগ্রেভ, লোককে খুনের কাহিনী শোনায় কিংবা ছবি দেখিয়ে বেড়ায়।
কথা শেষ করে মিঃ র্যাফায়েলের দিকে কাতর ভাবে থাকালেন মিস মারপল।
-তাহলে তো দেখছি, ধীরে ধীরে বললেন মিঃ র্যাফায়েল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু একটা করা দরকার।
-হ্যাঁ। তবে সে ঘটনা শেষ হয়ে গেছে। এখন ভবিষ্যতের কথাই ভাবতে হবে আমাদের। কেন না মেজর প্যালগ্রেভকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, ছবিটা নষ্ট করা হয়েছে, এবারে লোকটা তার ছক মত এগিয়ে যাবে। এখন আমাদের ঠেকাতেই হবে, মিঃ র্যাফায়েল, আর ঠেকাতে হবে আপনাকে।
-আমাকে কেন?
-কারণ আপনি অর্থবান এবং গুরুত্বসম্পন্ন ব্যক্তি। আমাকে এখানে কেউ জানে না। আপনার কথা লোকে গুরুত্ব দেবে।
–বেশ, আপনি এখানেই থেকে সব ব্যাপার ফয়সালা করুন। হিলিংডন, ডাইসন আর আমার লোক জ্যাকসন–এই তিন জনের মধ্যে যে কোন একজনকে খুনী হতেই হবে।
.
১৭.
–এ ব্যাপারে এখনো আমি নিশ্চিত নই। বললেন মিস মারপল।
-কেন নয়–তিনজন সন্দেহভাজন আমাদের সামনে রয়েছে। তাদের একে একে যাচাই করে দেখা চলতে পারে। তাহলে হয়তো একজন কাউকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে পারবেন। বললেন মিঃ র্যাফায়েল।
কিন্তু এডওয়ার্ড হিলিংডন এবং জ্যাকসনকে নিয়ে বিচার করে কোন সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌঁছনো সম্ভব হল না।
ওদের আলোচনার মধ্যেই এসথার ওয়াল্টার্স সেখানে এল। মিঃ র্যাফায়েল তার দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম স্বরে বললেন, এতক্ষণে এলে? কোথায় আটকা পড়েছিলে?
-সকলেই চলে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো করছে–এসব নিয়েই। বলল এসথার।
চলে যেতে চাইছে কি ওই খুনের জন্য?
–তাই মনে হচ্ছে। টিম কেণ্ডাল বেচারা খুবই চিন্তায় পড়ে গেছে। ব্যবসাটা সবে জমে উঠতে শুরু করেছিল–
–খুবই স্বাভাবিক। আমরাও এতক্ষণ খুনের বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিলাম।
মনে হল এসথার ওয়াল্টার্স চমকে উঠল। সে মিস মারপলের দিকে তাকাল।
মিঃ র্যাফায়েল বললেন, মিস মারপলকে বুঝতে আমি ভুল করেছিলাম। ইনি অন্য বয়স্ক মহিলাদের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ইনি চোখ কান যথাযথ ব্যবহার করতে জানেন।
বাংলোর বারান্দা থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে বসলো এসথার।
মিঃ র্যাফায়েল বললেন, আমরা মৃত মেজরের গল্পের ঝুলির বিষয়ে আলোচনা করছিলাম।
-ওহ, ওর গল্পের ভয়ে আমি এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতাম।
–তিনি কি তোমাকে কোন খুনীর বিষয়ে কিছু বলেছিলেন? প্রশ্ন করলেন মিঃ র্যাফায়েল।
–হ্যাঁ, অনেকবার বলেছিলেন।
–গল্পটা ঠিক কি রকম আমাদের শোনাও তো।
–আমার মনে হয় খবরের কাগজের কোন খুনের ঘটনার খবর থেকেই প্রথম প্রসঙ্গটা উঠেছিল। বলেছিলেন, একজন খুনীকে মুখোমুখি দেখেছিলেন। আর বলেছিলেন আমাকে একজন খুনীর ছবি দেখাবেন।
–কোন ছবি তিনি দেখিয়েছিলেন তোমাকে?
–না, ফটো দেখাননি। তবে আমি ধরে নিয়েছিলাম তিনি যে কাহিনী আমাকে বলেছিলেন ফটোটা সেই কাহিনীতে বলা খুনীরই।
এই সময় আর্থার জ্যাকসন নিঃশব্দে সেখানে এসে দাঁড়াল।
–আপনার মালিশের সময় হয়েছে স্যার।
মিঃ রাফায়েল বললেন, চল তাহলে।
দক্ষ হাতে জ্যাকসন হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে নিল। মিস মারপলও উঠে দাঁড়িয়ে তীরের পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন।
.
১৮.
সমুদ্রতীর আজ প্রায় ফাঁকাই ছিল। গ্রেস জলের মধ্যে আলোড়ন তুলছিলেন। লাকি বালির ওপর শুয়ে রোদ-স্নান নিচ্ছেন। হিলিংডনরা কেউ নেই।
ক্যানন প্রেসকট আর মিস প্রেসকট দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসেছিলেন। মিস মারপল এগিয়ে এসে মিস প্রেসকটের চেয়ারের পাশে বসলেন।
লোকজন নাকি সব চলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওঃ খুবই দুঃখজনক অবস্থা। বললেন তিনি।
মিস প্রেসকট বললেন, কেণ্ডালরা এদের সর্বস্ব হোটেলের জন্য ঢেলেছে। যাই ঘটুক এটা তাদের চালিয়ে যেতেই হবে।
–মেয়েটি খুবই মিষ্টি। বললেন মিস মারপল।
-কিন্তু ওর মায়ের মতই স্নায়বিক হয়ে পড়েছে। ওর পরিবারের সবাই আমাদের দিকেই থাকে। বললেন প্রেসকট।
মিস প্রেসকট বললেন, জানেন, একবার একটা নিতান্ত অযোগ্য লোককে বিয়ে করবে বলে মলি উতলা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাড়ির লোকের বাধায় তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে নি। এর পরেই ভাগ্যক্রমে মলির দেখা হয় টিমের সঙ্গে।
–এরকম তো কতই হয়। বললেন মিস মারপল, আপনারা তো বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে আসছেন, তাই না? নিশ্চয় হিলিংডন আর ডাইসনদের ভালই জানেন।
–তা বলতে পারেন। মিস প্রেসকট জবাব দিলেন।
–মেজর প্যালগ্রেভ একটা অস্বাভাবিক কাহিনী আমাকে শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কানে কম শুনি বলে, সেই কাহিনী ভালভাবে বুঝতে পারিনি।
-আপনি কি বলতে চাইছেন জানি। এসম্পর্কে অনেক রটনা শোনা গিয়েছিল।
–মানে যখন
-হ্যাঁ, প্রথম মিসেস ডাইসন মারা যান। আচমকা রোগের আক্রমণে মারা যাওয়াতে লোকের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল।
-তারপর? বললেন মিস মারপল।
–সেই তরুণীর নাম ছিল মিস গ্রেটোরেক্স। মিস ডাইসনের সম্পর্কীত বোন ছিল সে। তাদের মধ্যে বনিবনা ছিল না বলেই শোনা গিয়েছিল। আরও রটনা হয়েছিল, এডওয়ার্ড হিলিংডন নাকি স্ত্রীর জন্য কেমিস্টের কাছ থেকে কিছু কিনে এনেছিলেন।
-ওঃ তিনিও এর মধ্যে ছিলেন?
-দারুণ ভাবে জড়িত ছিলেন। মিস গ্রেটোরেক্স আর নাকি–দুজনকে দুজনের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়েছিলেন। পুরুষও দুজন ছিল। গ্রেগরী ডাইসন আর এডওয়ার্ড হিলিংডন।
সেই কেমিস্টের ব্যাপার জানাজানি হল কি করে?
–ওরা সে সময়ে মার্টিনিতে ছিল। ফরাসীরা ওষুধপত্রের ব্যাপারে অনেক শিথিল। কেমিস্টই হয়তো কাউকে কিছু বলে থাকবে।
–কিন্তু এর মধ্যে কর্নেল হিলিংডন কেন জড়ালেন? বলতে চাইলেন মিস মারপল।
–আমার ধারণা তাকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল? অদ্ভুত ব্যাপার হল, স্ত্রীর মৃত্যুর একমাসের মাথায়ই গ্রেগরী ডাইসন বিয়ে করেন।
–মেজর প্যালগ্রেভ আপনাকে এরকম কিছু বলেছিলেন?
-হ্যাঁ, একদিন ওকে দেখিয়ে বলেছিলেন, দেখুন ওই মেয়ে মানুষটি একজনকে খুন করেও কেমন বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সময় ডাইসন আর হিলিংডনরা কাছাকাছি টেবিলেই বসেছিলেন। আমার খুব ভয় হচ্ছিল তারা না কথাগুলো শুনে ফেলে।
–মেজর কি কোন ছবির কথা বলেছিলেন?
–ঠিক মনে পড়ছে না।
এই সময় ইভিলিন হিলিংডন ওদের চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সুপ্রভাত জানিয়ে আবার তীরের পথ ধরে এগিয়ে গেলেন।
.
১৯.
একসময় ক্যানন প্রেসকট বোনের সঙ্গে হোটেলে ফিরে গেলেন। ততক্ষণে গ্রেগরী ডাইসন জল থেকে উঠে এসেছেন। লাকি বালির ওপরেই শায়িত। ইভিলিন তার দিকে তাকিয়েছিল। তা লক্ষ্য করে মিস মারপল অকারণেই কেমন শঙ্কিত হয়ে উঠলেন।
একটু পরে তিনিও ধীর পায়ে নিজের বাংলোর দিকে হেঁটে চললেন।
পথে মিঃ র্যাফায়েল আর এসথার ওয়াল্টার্সের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মিঃ র্যাফায়েল তাকে দেখে নিঃশব্দে হাত নাড়লেন।
বাংলোয় ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। নিজেকে খুবই ক্লান্ত মনে হচ্ছিল তার।
কয়েক মুহূর্তের জন্য বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চোখের পাতা খুলতেই মনে হল কেউ যেন বাইরে থেকে জানালায় উঁকি মারবার চেষ্টা করছে। ছায়ার আভাস দেখে তার মনে হল লোকটি জ্যাকসন।
লোকটির এমন ব্যবহারের কারণ বুঝতে পারলেন না। তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন কিনা তাই জানতে কি?
মিস মারপল বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। বাথরুমে ঢুকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন।
পাশের বাংলোটি মিঃ র্যাফায়েলের। দেখা গেল জ্যাকসন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সচকিতভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, কারুর চোখে না পড়ে। নিশ্চয় কোন মতলব হাসিল করার সুযোগ খুঁজছে জ্যাকসন, অনুমান করলেন মিস মারপল।
সেই মুহূর্তে সকলেই সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত। কারোর নজরের বাইরে বাংলোয় কিছু করতে চাইলে এই তার সুযোগ। জ্যাকসন নিশ্চিত হওয়ার জন্যই তার জানালায় উঁকি দিয়েছিল।
রবারের চপ্পল পায়েই শিকারী বেড়ালের মত সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মিস মারপল। মিঃ র্যাফায়েলের বাংলোটা ঘুরে কোণের দিকে চলে গেলেন। খুব সন্তর্পণে জানালার নিচে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন।
বাংলোর জানালাগুলো খুব নিচু। কিছু লতা গাছের আড়াল থেকে তিনি ঘরের ভেতরে তাকালেন।
দেখা গেল ঘরের মাঝখানে একটা সুটকেসের সামনে বসে আছে জ্যাকসন। সুটকেসের ঢাকনা খোলা। মিস মারপল লক্ষ্য করলেন, বেশ কিছু কাগজপত্র সুটকেস থেকে বার করে আনল জ্যাকসন। দ্রুত চোখ বুলিয়ে কাগজগুলো দেখে চলেছে।
বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে চাইলেন না মিস মারপল। জ্যাকসন চুরি করে কাগজপত্র দেখছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই তিনি সন্তর্পণে সরে এলেন জানলা থেকে। ফিরে এলেন নিজের বাংলোয়।
একটু পরে তিনি তীরের দিকে গিয়ে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়লেন। অদূরেই বসেছিলেন মিঃ র্যাফায়েল। তাঁর দিকে না ফিরেই মিস মারপল বললেন, আপনি জানেন, জ্যাকসন আপনার কাগজপত্র হাতড়ে বেড়ায়?
-একবার ধরা পড়েছিল। আপনি দেখেছেন?
–হ্যাঁ, জানালা দিয়ে দেখলাম, আপনার সুটকেস খুলে কাগজপত্র দেখছে।
-হ্যাঁ, উদ্যোগী লোক, কোনভাবে সুটকেসের চাবি হাতড়েছে। তবে ওর কাজে লাগবার মত কোন কিছু ও খুঁজে পাবে না।
আশপাশে কেউ ছিল না। এসথার ওয়াল্টার্স জলে নেমে আছে। মিঃ র্যাফায়েল বললেন, আপনাকে বলছি, বয়সের কথাটা ভাববেন। খুব বেশি ঝুঁকি নেবেন না। ভুলে যাবেন না, এখানে এমন একজন আছে যে বিবেকহীন নির্মম জীব।
.
২০.
স্টীলব্যাণ্ডের বাজনা অনেকক্ষণ থেমে গেছে। চারদিক নিস্তব্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছে গোল্ডেন পাম..
সেই রাতে টিম কেণ্ডাল ছুটে গিয়ে ইভিলিনকে তার বাংলো থেকে ডেকে নিয়ে চললো। মলি কেণ্ডাল অসুস্থ হয়ে পড়েছে–
–টিম বলল, মনে হচ্ছে কিছু খেয়েছে।
ইভিলিন গিয়ে দেখল, বিছানায় শায়িত মলির পাশে টেবিলে রয়েছে অর্ধেক ভর্তি একটা জলের গ্লাস। গ্লাসের পাশেই খালি ট্যাবলেটের শিশি।
টিম বলল, ওটা ঘুমের ওষুধের শিশি। মনে হয় সবগুলোই খেয়ে নিয়েছে।
ইভিলিন বলল, আমি রয়েছি এখানে, তুমি শিগগির ডাঃ গ্রাহামকে ডেকে নিয়ে এসো। যাবার আগে কাউকে বলে যাও কড়া এক কাপ কফি বানিয়ে পাঠিয়ে দিতে।
.
ডাঃ গ্রাহাম যাবার মধ্যে টিমকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, আর ভয় নেই। সময় মতই আমরা উপস্থিত হতে পেরেছিলাম। তবে বিপদ ঘটাবার মত বেশি খাননি মিসেস কেণ্ডাল।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মলি চোখ মেলে তাকালো।
ইভিলিন পাশেই ছিল। জিজ্ঞেস করল, কেন একাজ করেছিলে মলি?
–ভয়ে। ক্ষীণকণ্ঠে বলল মলি।
–কিসের ভয়?
জবাবে চোখ বুজল মলি।
.
টিমের অফিসে বসে ডাঃ গ্রাহাম বললেন, আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে কয়েকটা জরুরী কথা বলতে এলাম। শুনলাম উনি কিছুদিন ধরে নাকি দুঃস্বপ্ন দেখছেন?
–হ্যাঁ। প্রায় মাসখানেক ধরে এরকম চলেছে।
–আমার ধারণা মিসেস কেণ্ডাল কোন বিশেষ লোক সম্পর্কে মনে মনে খুবই ভীত। এব্যাপারে আপনাকে কিছু বলেছেন?
-হ্যাঁ জানিয়েছিল। কেউ নাকি ওকে অনুসরণ করে।
–মিসেস কেণ্ডালের কোন শত্রু আছে বলে জানেন আপনি?
–না, কোন শত্রুর কথা আমি জানি না।
–আপনার বিয়ের আগে মলি কারো বাগদত্তা ছিল কিনা, বলতে পারবেন? ওরকম কারোর পক্ষেই ঈর্ষা বশত তাকে ভয় দেখানো স্বাভাবিক।
–আমার জানা নেই। তবে আমার আসার আগে মলি একজনকে বিয়ের পাকা কথা। দিয়েছিল। কিন্তু বাড়ির সকলে এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিল।
বুঝেছি। টিম, আপনার স্ত্রীর বিষয়ে আমার পরামর্শ হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানো। এই রকম একজন ভাল বিশেষজ্ঞ আছেন কিংসটনে। তাছাড়া নিউইয়র্কে তো রয়েইছে। কোন বিশেষ কারণে আপনার স্ত্রীর মনে ভয় জন্মেছে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলেই তা কেটে যাবে।
ডাঃ গ্রাহাম টিমকে আশ্বস্ত করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।