ওদের দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয় গোপনে, সকলের চোখের আড়ালে। নিজেদের মধ্যে মতামত বিনিময় করে তারা।
মিসেস পেরিনা, মিস মিল্টন, মিসেস ও রুরকি, মেজর ক্লে দম্পতি, কার্ল ভন দিনিম, শীলা, ও সকন্যা মিসেস স্প্রট–এদের সকলের সম্পর্কে নিজেদের ধারণার কথা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলে তাদের।
মেলামেশা, কথাবার্তা এসবের মধ্যে কী করে আসল মানুষ দুটিকে চিহ্নিত করা যায় এ নিয়ে দু-জনেরই নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে। সেই মতোই এগিয়ে চলতে থাকে টমি ও টুপেনস।
সান্স সৌচিতে ফেরার পথে টুপেনস ডাকঘরে ঢুকে কিছু ডাকটিকিট কিনল। তারপর একটা বুথ থেকে টেলিফোন সারল। ওখান থেকে বেরিয়ে কয়েকটা উলের গোলা কিনে পথে নামল।
টুপেনসের ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসির রেখা। বেলা শেষের মৃদুমন্দ হাওয়ার ছোঁয়া গাছের পাতায় পাতায়।
সান্স সৌচিতে নিজের ভূমিকার কথা ভেবে নিজেকেই বাহবা দেয় টুপেনস।
সকলেই জানে মিসেস ব্লেনকিনসপ তার প্রবাসী সন্তানদের জন্য উদ্বেগে আকুল হয়ে আছে। মনের ভার লাঘব করবার জন্য দুদিন অন্তর ছেলেদের নামে চিঠি পাঠায়। আর একাকিত্বের একঘেয়েমি কাটাবার সঙ্গী উল কাটা।
পাহাড়ি নির্জন পথ। পথের পাশের বাড়িগুলির দিকে তাকাতে তাকাতে সান্স সৌচির দিকে এগিয়ে চলতে থাকে টুপেনস। নামফলকগুলির ওপরও চোখ বোলায়।
স্মাগলার্স রেস্ট–বিচিত্র নামের বাড়িটি এখানেই আছে। কামাণ্ডার হেডকের আবাস। তার পাশাপাশি রয়েছে বেল ভিক্টা, শ্ৰেলি টাওয়ার, সী ভিউ, ক্যাসেল কার। এই সারির সব শেষের বাড়িটিই হল সান্স সৌচি।
কাছাকাছি এসে চলার গতি মন্থর করে টুপেনস। তার চোখে পড়ে পথের ধারে দাঁড়িয়ে এক মহিলা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সান্স সৌচির দিকে।
কৌতূহলী টুপেনস কাছাকাছি এসে পড়লে মহিলা চমকে মুখ ঘুরিয়ে তাকান।
দীর্ঘাঙ্গী, প্রশস্ত কাঁধ, মুখে মলিনতা থাকলেও বনেদিয়ানার ছাপ। কিন্তু বসনে দারিদ্র্যর চিহ্ন। বয়স চল্লিশের কোঠায়।
অপরিচিতা মহিলাকে চোখে পড়ামাত্র টুপেনসের মনে হল, এই মুখ তার চেনা, আগে কোথায় দেখেছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে স্মরণে আনতে পারল না।
টুপেনসই প্রথম কথা বলল, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
মহিলা ইতস্তত করে বললেন, মাফ করবেন, এই বাড়িটা কি সান্স সৌচি?
কথায় বিদেশী টান কান এড়াল না টুপেনসের। মৃদু কণ্ঠে সে বলল, হ্যাঁ। কাকে খুঁজছেন আপনি?
-আপনি এই বাড়িতেই থাকেন?
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা, বলতে পারেন, মিঃ রোসেনস্টাইন নামে কেউ থাকেন?
–মিঃ রোসেনস্টাইন, চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল টুপেনস, না, এই নামে তো কেউ এখানে নেই। আগে ছিলেন কিনা বলতে পারব না। খোঁজ নিয়ে বলতে পারি।
–তার আর দরকার হবে না, মাফ করবেন, আমারই ভুল হয়েছে।
বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না ভদ্রমহিলা। দ্রুত বিপরীত দিকে ফিরে চললেন।
অপরিচিতা মহিলার ব্যবহার টুপেনসের মনে সন্দেহ উসকে দেয়। সে রহস্যের আভাস পায়। কাকে খুঁজতে এসেছিলেন মহিলা? নাকি সবটাই ধোঁকা?
মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে নেয় টুপেনস। স্বভাবসুলভ ক্ষিপ্রতায় ঘুরে দাঁড়িয়ে অপসৃয়মান মহিলাকে অনুসরণ করতে থাকে।
কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ায়। কাজটা কি সঙ্গত হচ্ছে? তার মনোভাব প্রকাশ হয়ে পড়ছে।
কারোর নজরে পড়ে গেলে সন্দেহ করতে পারে। তাহলে মিসেস ব্লেনকিনসপের ভূমিকাটা বিঘ্নিত হবে। উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।
আর এগলো না টুপেনস। দ্রুতপায়ে ফিরে এল সান্স সৌচিতে।
অবাক হলো টুপেনস, গোটা হলঘর ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। ওপর থেকে কেবল বেটির আধো আধো কথার স্বর ভেসে আসছে।
টুপেনস ভাবল, ওপরে যে যার ঘরে চলে গেছে না বাইরে বেড়াতে বেরিয়েছে? একজনও কেন নিচে নেই?
নিস্তব্ধ হলঘরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল টুপেনস। নিঃঝুম বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বাইরে থেকে কী দেখবার চেষ্টা করছিলেন মহিলা? কাউকে খুঁজছিলেন নিশ্চয়? টুপেনস ভাবে, কী হতে পারে? কিছু কি ঘটতে চলেছে এই বাড়িতে?
ঠিক এই সময় চারপাশের নিথরতা যেন খানখান হয়ে যায়। টেলিফোন বাজছে।
এ বাড়ির টেলিফোনটা হলঘরে। একমাত্র এক্সটেনশন লাইন রয়েছে মিসেস পেরিনার কক্ষে।
এই মুহূর্তে আশপাশে কেউ নেই। টুপেনস কোনোরকম দ্বিধা না করে এগিয়ে গেল। সাবধানে রিসিভার তুলে আড়ি পাতল।
বোঝা গেল, এ বাড়ির এক্সটেনশনটি কেউ ব্যবহার করছে। পুরুষ কণ্ঠ শোনা যায়–সব কিছুই ঠিক ঠিক চলছে…সুযোগ বুঝে, মনে আছে তো, চার নম্বরে
এপাশ থেকে নারীকণ্ঠ কানে আসে–ঠিক আছে, চালিয়ে যাও…
এটা যান্ত্রিক শব্দ…রিসিভার নামিয়ে রাখার। ধীর পায়ে সরে আসে টুপেনস…তার মনে প্রচণ্ড আলোড়ন…সান্স সৌচির মহিলাদের মধ্যে কোনো একজন ধরেছিল টেলিফোন। কিন্তু কার কণ্ঠস্বর হতে পারে? কয়েকটি মাত্র শব্দ শোনা গেছে…এ থেকে তা বোঝার উপায় নেই।
টুপেনস পরক্ষণে ভাবে, মিথ্যাই উতলা হচ্ছে সে। কথাগুলোর মধ্যে আদৌ কোনো রহস্যই নেই। নিতান্তই সাধারণ ব্যক্তিগত আলোচনার খণ্ডাংশ…মূল্যহীন।
যা শুনবে মনে করে সে আড়ি পেতেছিল আসলে এসব কথা তা নয়।
তবে এটা বোঝা গেল, ফোনটা মিসেস পেরিনা ধরেননি। টুপেনস রিসিভার নামিয়ে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল মিসেস পেরিনা ঘরে ঢুকছে।
-মিসেস ব্লেনকিনসপ, আপনি কি ঘুরে এলেন না বেরচ্ছেন?
টুপেনস তার বৈকালিক ভ্রমণের কথা জানিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মিসেস পেরিনাও চললেন তার পেছনে।
সহসা অজানা এক আশঙ্কা ভর করল টুপেনসকে। তার মনে হল, মিসেস পেরিনার মুখে হিংস্র হাসি, তিনি যেন লোলুপ থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন তার দিকে।
সিঁড়ির বাঁকের মুখেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল মিসেস ওরুরকির সঙ্গে। তার চোখেও যেন শিকারি বেড়ালের চাউনি।
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল টুপেনস। সে তার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয়ের সহায়তায় পরিবেশটাকে বুঝে নেবার চেষ্টা করল। সত্যিই কি সে কোনো ফঁদে পড়েছে?
মিসেস ওরুরকি পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল টুপেনস। সে তার ভয় পাওয়ার কারণটা বুঝতে পারল। ফোনে আড়িপাতা সামাজিক অপরাধের মধ্যে গণ্য।
সেই কাজটা করেই মানসিক ভীতির শিকার হয়েছে সে।
তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বোর্ডিংহাউসের নির্জন পরিবেশ।
নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ওপরে উঠতে লাগল সে।
টেলিফোনে শোনা সংক্ষিপ্ত কথাগুলো কানের উপর ভাসছে এখনও-সবকিছুই ঠিক ঠিক আছে। ব্যবস্থা অনুযায়ী চার নম্বরে…
শব্দগুলো যদি কোনো অর্থবহন করে থাকে তবে তা টুপেনসের কাছে একেবারেই অপরিচিত।
চার নম্বর…এর অর্থ কী? তারিখ না মাস…কি বোঝাতে পারে? ল্যাম্পপোস্ট বা চার নম্বর ব্রিজ-এরকম তাৎপর্য হওয়াও অসম্ভব নয়। টুপেনসের মনে পড়ল, ওই ব্রিজটা জার্মানরা একবার উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে এসে ঢুকল টুপেনস।
স্মাগলার্স রেস্ট-অদ্ভুত নাম। নামের মধ্যেই যেন অপরাধের গন্ধ লুকনো। এই বাড়িতেই কমাণ্ডার হেডকের বাস।
এটা অবশ্য ঠিক, ভৌগোলিক দিক থেকে বাড়িটির অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হেডকের বাড়িতে মদের আসরে এসেছে টমি। ঘুরে ঘুরে বাড়িটা তাকে দেখালেন হেডক।
এই বাড়ির ইতিহাসটাও চমকপ্রদ। হান নামে এক জার্মান স্পাই বাড়িটার মালিক ছিল। বছর চারেক আগের কথা–হেডক সেই সময় লিহাম্পটনের একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।
হানের বাড়িতে তার বিদেশী বন্ধুদের ভিড় লেগে থাকত সারাক্ষণ। হেডকের সন্দেহ হয়। এরা সকলেই গুপ্তচর। যথারীতি তিনি পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তার কথার গুরুত্ব দেয়নি।
পরে যখন তাদের টনক নড়ল, তখন আর করার কিছু ছিল না। পাখি পালিয়েছে। অনুসন্ধান করে ওই বাড়িতে পাওয়া গেল ট্রান্সমিটার আর সংযোগরক্ষাকারী যন্ত্রপাতি।
হেডকের মুখে বাড়ির ইতিহাস শুনতে শুনতে টমি লক্ষ্য করল, এ বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের সমুদ্রে অনায়াসে সার্চ লাইটের সংকেত পাঠানো যায়। বাড়ির মুখ সমুদ্রের দিকে পেছন থেকে কেউই কিছু টের পাবে না।
জার্মানরা বেছে বেছে বেশ নিরাপদ একটি জায়গা বেছে নিয়েছিল।
লিহাম্পটনের নির্ভুল পরিচয় জানতে পেরেছিলেন প্রয়াত মিঃ ফারকুয়ার–ভাবল টমি। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি নির্দিষ্টভাবে এই বাড়ির নাম উল্লেখ না করে সান্স সৌচির কথা বললেন কেন?
…জার্মান গুপ্তচরদের এই ঘাঁটিটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন কমাণ্ডার হেডক। কিন্তু শত্রুপক্ষের অন্য কোনো আস্তানা কি আশপাশে নেই? হয়তো সান্স সৌচিই সেই ডেরা।
জার্মান স্পাইদের কার্যকলাপ ধরাপড়ার পরে চার বছর আগে ঠিক কাছাকাছি সময়েই লন্ডন থেকে এসে মিসেস পেরিনা বাড়িটি কিনে নেন। এই ঘটনা কি একেবারেই তাৎপর্যহীন?
লিহাম্পটন যথার্থই একটি অরক্ষিত এলাকা। এর পেছনে রয়েছে বিস্তৃত ঘাসের মাঠ। শত্রুসেনা অনায়াসে সেখানে ঘাঁটি গাড়তে পারে।
টমি সজাগ হয়ে ওঠে–মিসেস পেরিনা সম্পর্কে সে নতুন করে আগ্রহ বোধ করে।
.
বিদেশী পাতলা কাগজের চিঠিটা সকলকে শুনিয়েই পড়তে শুরু করেছে টুপেনস তথা মিসেস ব্লেনকিনসপ।
আসলে বিশেষ ব্যবস্থায় আসা এটা একটা নকল চিঠি। তার পেছনে রয়েছে বিচক্ষণ সরকারি গোয়েন্দা মিঃ গ্রান্টের পরিকল্পনা।
টুপেনসের সঙ্গে তার মাঝে মাঝে টেলিফোনে যোগাযোগ হয়–সে মিঃ গ্রান্টকে মিঃ ফেরাডে নামে সম্বোধন করে থাকে।
সামরিক বিভাগ থেকে সেন্সরড হয়ে আসা চিঠিটা পড়তে থাকে টুপেনস—
প্রিয় মা,
মিশরে আমরা তাকে নিয়ে বেশ জমে গেছি। চারদিকের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সবকিছুই গোপনীয়–তিনি কিছুই বলতে চাইছেন না। দারুণ একটা পরিকল্পনা রয়েছে সামনে–চমকে দেবার মতো কিছু কাজ আমার জন্যও রাখা হয়েছে…জেনে ভালোই লাগছে… কোথায় চলেছি…
টুপেনসকে বাধা দিলেন মেজর ব্লেচলি। অসহিষ্ণু কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, আপনার ছেলের চিঠি হতে পারে, কিন্তু এসব কথা লিখে জানাবার তার কোনো অধিকার নেই।
ব্রেকফাস্টের টেবিলে সকলেই সমবেত হয়েছেন। এই সুযোগটাই কাজে লাগাবার উদ্দেশ্য নিয়ে চিঠি পড়া আরম্ভ করেছিল টুপেনস।
বাধা পেয়ে বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণায় দেখা দিল তার। পলকে চারপাশটা দেখে নিয়ে বুঝতে পারল, সকলেরই মনোযোগ তার দিকে।
–আমাদের মা-ছেলের চিঠির মধ্যে একটা বিশেষ কৌশল থাকে, গম্ভীর স্বরে বলল টুপেনস, কিছু সংকেতের রহস্য কেবল আমরা দুজনই জানি।
আমি এখন নির্ভুল বলে দিতে পারি তারা কোথায় আছে..কী করতে চলেছে…কিন্তু এই চিঠি পড়ে সেসব বোঝার সাধ্য আর কারো নেই।
ব্লেচলি অপ্রস্তুত হেসে বললেন, আপনি যাই বলুন না কেন মিসেস ব্লেনকিনসপ–এভাবে চিঠি আদানপ্রদান সমর্থন করা যায় না। মিত্রপক্ষের গতিবিধি জানার জন্য জার্মানরা চারপাশে যেভাবে ওঁত পেতে রয়েছে–
-তা থাক না, চড়া গলায় বলল টুপেনস, আমি তো কাউকে কিছু বলি না। ভাববেন না আমি অসাবধানী।
-তাহলেও এটা ঠিক নয়। এসবের জন্য কোনোদিন দেখবেন আপনার ছেলেই বিপদে পড়ে গেছে।
-না, তা হবে না। আমি তার মা, আমার সন্তান কখন কোথায় আছে তা জানার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে।
–হ্যাঁ, আপনার দাবি আমি সমর্থন করছি, বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন মিসেস ওরুরকি, আপনার কাছ থেকে খবর বার করে নেওয়া কারো সাধ্য হবে না তা আমরা জানি।
–কিন্তু ওই চিঠি তো বেহাত হতে পারে। ব্লেচলি বলার চেষ্টা করলেন।
–অসাবধানে চিঠি ফেলে রাখলে তো বেহাত হবে, বলল টুপেনস, এগুলো সব সময়েই তালাবন্ধ অবস্থায় রাখি।
মেজর ব্লেচলি তবুও গজগজ করতে থাকেন।
.
টুপেনসের কাজ চলছে চক্রবৎ। চিঠি পড়ছে, নিজে চিঠি লিখছে, তারপর সেগুলো গোয়েন্দা দপ্তরের সংগৃহীত বিদেশী খামে ভরে সান্স সৌচির ঠিকানায় পোস্ট করা–আবার চিঠি পড়া…
সেই চক্রবৎ নিয়মেই একটা চিঠি ডাকঘরে ফেলে দিয়ে হালকা মনে সান্স সৌচিতে ফিরছে টুপেনস।
গেটের কাছাকাছি এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অদূরে দাঁড়িয়ে মূর্তি-কার্ল ভন দিনিম আর সেই মধ্যবয়স্কা মহিলা
এক মিনিট দাঁড়িয়ে তাদের নিরীক্ষণ করল টুপেনস। দিনিম ঘাড় ঘোরালে…টুপেনসের ওপর দৃষ্টি পড়তেই দুই মূর্তি সরে দাঁড়াল।
অপরিচিত মহিলাটি ক্ষিপ্রগতিতে রাস্তায় নেমে অন্য পাড় ধরে টুপেনসকে অতিক্রম করে চলে গেল।
টুপেনস তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করা ছাড়া আর কিছু করতে পারল না।
দিনিম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মোলায়েম স্বরে বলল, সুপ্রভাত।
-ওই মাঝবয়সি মহিলাটিকে, আপনি যে কথা বলছিলেন? টুপেনস সরাসরি জানতে চাইল।
-উনি একজন পোলিশ মহিলা।
–আপনার বান্ধবী?
কঠিন স্বরে জবাব দিল দিনিম, না, না, বান্ধবী কেন, এর আগে তাকে কখনও দেখিনি।
–তাই বুঝি।
–ভদ্রমহিলা এ জায়গা সম্বন্ধে জানতে চাইছিলেন।
পথ ভুল করেছিলেন বোধ হয়? সতর্ক কণ্ঠে প্রশ্ন করল টুপেনস।
-না, উনি জানতে চাইছিলেন মিসেস গেটানির নামে কাউকে চিনি কিনা।
–ও। টুপেনস গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। কিন্তু চোখের কোণে দিনিমের মুখভাব দেখে নিল।
দু-জনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। টুপেনসের মাথায় ঘুরছে দুটি নাম–মিঃ রোসেনস্টাইন …মিসেস গেটানির…নামের রহস্যময়তা।
কিন্তু মহিলা কি দিনিমের কাছেই আসে? না অন্য কোনো উদ্দেশ্য?
টুপেনস ভাবতে থাকে, শীলাকে বলতে শুনেছিল–খুব সাবধানে থেকো। এরা দুজন নাৎসী এজেন্ট নয় তো? কিন্তু টমি বলেছিল শীলা জার্মান স্পাই নয়। সে তত ভুলও করতে পারে।
টুপেনস তার সামনে সন্দেহভাজন তিনজনকে দেখতে পাছে–কার্ল, শীলা আর মিসেস পেরিনা। এদের সম্পর্কে আরও বেশি সজাগ থাকবে সে।
.
সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হয়েছে অনেকক্ষণ। ইতিমধ্যেই অনেকে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছে। টুপেনসও তার ঘরের দরজা বন্ধ করে একটি বিশেষ পরীক্ষার কাজে রত হল।
ড্রয়ার টেনে ছোট্ট একটা জাপানি বাক্স বের করে আনল। বাক্সের গায়ে পলকা তালা ঝুলছে। তালা সরিয়ে বাক্স খুলতেই ভেতরে দেখা গেল একগুচ্ছ চিঠি বাণ্ডিল করা।
ওপরের চিঠিটা আজই সকালে এসেছে। টুপেনস সতর্কভাবে চিঠির ভাজ খুলল।
তার চোখের দৃষ্টি ঝলসে উঠল…ঠোঁটের কোণে দেখা দিল বাঁকা হাসি। সকালে এই চিঠির ওপরেই চোখের ভুরু থেকে একটা চুল ছিঁড়ে আটকে রেখেছিল, সেই চুলটা এখন অদৃশ্য।
বাক্সটা হাতে করে হাত ধোবার বেসিনের কাছে এগিয়ে যায় টুপেনস। Grey powder রাখা আছে একটা বোতলে। সামান্য পরিমাণ পাউডার চিঠির ওপর ঢেলে দিল। কিছুটা ছড়িয়ে দিল জাপানি বাক্সটার ওপর।
বস্তুটার রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে টুপেনস আশ্বস্ত হল-চিঠি বা বাক্স কোথাও কোনো আঙুলের ছাপের চিহ্ন নেই। এই বাক্স থেকে যে চিঠিটা নাড়াচাড়া করেছে সে অতিশয় সাবধানী–হাতে গ্লাভস ব্যবহার করেছে।
টুপেনস ভাবনায় পড়ল লোকটি কে হতে পারে? মিসেস পেরিনা নয় তো? না কি শীলা? অন্য কেউও হতে পারে, যার সন্ধান এখনও সে জানে না। পুরুষ বা মহিলা যে কেউ একজন যে চিঠিগুলো নাড়াচাড়া করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
উদ্দেশ্য?
ব্রিটিশবাহিনীর গতিবিধির হদিস জানা।
.
দুপুরে নিজের বিছানায় শুয়ে নিজের ভাবনায় ডুবে আছে টুপেনস। এমন সময় টলমল পায়ে ঘরে ঢুকল ছোট্ট বেটি। টুপেনসকে খুব পছন্দ মেয়েটির। তাকে দেখলেই তার উচ্ছ্বাস বেড়ে ওঠে।
ঘরময় ঘুরে বেড়াতে থাকে বেটি–এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে থাকে।
টুপেনস মাথা ঝুঁকিয়ে ছড়া কাটতে থাকে–
ওরে বোকা চললে কোথা
সর ওপাশে সর–
উঁচু নিচু ধাপ পেরিয়ে।
ঢুকলে রানির ঘর।
ছড়া শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল বেটি। টুপেনস তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আবোলতাবোল বকল। তারপর আবার নিজের চিন্তায় ডুবে গেল।
বোর্ডিং হাউসে অনেক মুখ। কিন্তু কোনো মুখ সনাক্ত করতে পারছে না সে। কে হতে পারে? যেই হোক, তাকে আবার ঘরের ভেতরে টেনে আনার ফঁদ পাততে হবে। কিছু বুঝতে দেওয়া চলবে না।
টুপেনসের চিন্তায় ছেদ পড়ল-মিসেস ম্প্রট হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন।
–বেটি এখানে–ওমা…দেখ কি শুরু করেছে–কখন বেরিয়ে এসেছে একদম টের পাইনি। মিসেস ব্লেনকিনসপ, দেখুন কি সর্বনাশ করেছে–ছিঃ ছিঃ…আমি ভীষণ দুঃখিত।
টুপেনস উঠে বসল। বেটির কীর্তি চোখে পড়ল তার। উল লেস সব এক জায়গায় করে একটা জলের পাত্রে ফেলে ঘোরাচ্ছে আর নিজের মনে হাসছে।
হেসে উঠল টুপেনস।
-দেখুন কেমন মজা করছে। আপনি ভাববেন না মিসেস ট–ওতে কিছু হবে না। চুপচাপ ছিল বলে আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম।
ওর চুপ করে থাকাটাই তো ভয়ের। কখন কি করে বসবে–আমি আজই আপনার জন্য কিছু উল কিনে আনব।
–আপনি ব্যস্ত হবেন না, মিসেস স্প্রট, ওগুলো শুকিয়ে নিলেই হবে।
বেটিকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মিসেস স্প্রট।
.
-এর মধ্যেই আছে?
টুপেনসের বাড়িয়ে দেওয়া প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সতর্কস্বরে বলে উঠল টমি।
–হ্যাঁ, সাবধানে ধর। নিজের গায়ে ঢেলে দিয়ো না আবার।
প্যাকেটটা নাকের কাছে এগিয়ে নিয়ে চোখ কুঁচকে বলল টমি–ভয়ঙ্কর পচা গন্ধ-বস্তুটা কী?
–পচা হিং।
টুপেনসের কাছ থেকে টমি প্যাকেটটা নেবার পর সান্স সৌচিতে পর পর কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল।
প্রথম ঘটনা মিঃ মিয়াদোর ঘর বদল।
বেচারা নিতান্তই শান্তশিষ্ট মানুষ। অকারণে অভিযোগ তোলার মতো স্বভাব নয় তার। কিন্তু তীব্র গন্ধে টিকতে না পেরে মিসেস পেরিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
মিঃ মিয়াদোর ঘরে উগ্র কটু গন্ধটা অস্বীকার করতে পারলেন না মিসেস পেরিনা। গ্যাসের লাইন লিক হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা হল। কিন্তু কোনো গোলমাল ধরা পড়ল না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত করা হল, ঘরে কোথাও নেংটি ইঁদুর মরে পচে আছে।
টমি বলল, এই ঘরে রাত্রে শোওয়া অসম্ভব। বিকল্প একটা ঘরের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।
মিসেস পেরিনা বললেন, একটা ঘর আছে বটে তবে সেটা এমন ভোলামেলা নয়। মিঃ মিয়াদো সম্মত হলে সেটা খুলে দিতে পারেন।
মিঃ মিয়াদো আপত্তি করলেন না। গন্ধের হাত থেকে মুক্তি পেতে উদগ্রীব তিনি। তার জন্য যে ঘরটি বন্দোবস্ত করা হল তার মুখোমুখিই রয়েছে মিসেস ব্লেনকিনসপের ঘর।
প্রথম ঘটনার সূত্রেই দ্বিতীয় ঘটনার উদ্ভব।
মিঃ মিয়াদো তার নতুন ঘরে আশ্রয় নেবার পরেই চোখ নাক ও গলার রোগে আক্রান্ত হলেন। চোখ নাক থেকে অনর্গল জল গড়াচ্ছে।
আকস্মিক আক্রমণটা অতি দ্রুত তীব্র হয়ে উঠল এবং মিঃ মিয়াদো রীতিমত শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। প্রাতঃরাশ সারবার জন্য নিচে যাবার ক্ষমতা রইল না তার।
সেদিন সকালেই মিসেস ব্লেনকিনসপ তার ছেলে ডগলাসের কাছ থেকে চিঠি পেলেন। রীতিমত হৈচৈ জুড়ে দিল টুপেনস–সবাই জেনে গেল সৈনিক ছেলের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি পেয়েছেন মিসেস ব্লেনকিনসপ।
এবারে চিঠিটা সামরিক বিভাগের নজরে পড়েনি–সেন্সরড হয়নি–সেকারণেই চিঠিটা গুরুত্বপূর্ণ।
ডগলাসের এক বন্ধু ছুটিতে এসেছে, সেই চিঠিখানা হাতে করে নিয়ে এসেছে। এইবারেই প্রথম সরাসরি মাকে নিজের কথা বলার সুযোগ পেয়েছে ডগলাস।
টুপেনস গলার স্বর চড়িয়ে ঘোষণা করল, এই চিঠিটা পড়েই বুঝতে পারছি, যা ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে আমরা কত কম জানি।
প্রাতরাশের টেবিলে এইভাবে হৈচৈ বাঁধানোর পরে নিজের ঘরে এসে জাপানি বাক্সটার ভেতরে চিঠিটা রেখে দিল টুপেনস। তারপর চিঠির ভাঁজের ওপরে ছড়িয়ে দিল অদৃশ্য রাসায়নিক গুড়ো।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার মুখে টুপেনস শুনতে পেল মিঃ মিয়াদোর ঘর থেকে তার কাশি ও গোঙানি শোনা যাচ্ছে।
চকিতে তার মুখে হাসির রেখা খেলে যায়। কোনো দিকে নজর না দিয়ে সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।
সকলকে আগেই সে শুনিয়ে রেখেছে তার উকিলের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সে এ বেলা লন্ডন যাচ্ছে। সেই সুবাদে সান্স সৌচির বাসিন্দাদের অনেকেই কিছু কেনাকাটার দায়িত্ব দিয়েছে তাকে। অবশ্য টুপেনস গেয়ে রেখেছে, তার দরকারি কাজ সেরে সময় পেলেই ওসব করবে সে।
মিসেস স্প্রট বিদায় জানাল টুপেনসকে। ছোট্ট বেটির গাল টিপে আদর করল সে। বলল, ছোট্ট সোনা, তোমার জন্য লন্ডন থেকে রঙিন চকখড়ি নিয়ে আসব।
বাগান পার হয়ে রাস্তার দিকে যেতে গিয়ে আচমকা মোড় ঘুরে টুপেনস বাগানের কোণে চলে এলো। ওখানে কার্ল ভন দিনিম পাঁচিলে হেলান দিয়ে আপন মনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে মৃদু উত্তেজনার ছায়া।
টুপেনস কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, এখানে একা, কি ব্যাপার? কিছু ঘটেছে?
ক্ষোভে ফেটে পড়ল দিনিম, কী আবার, যা ঘটবার তাই ঘটছে।
টুপেনস তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তুলে ধরে।
-ওসব নিন্দা কটুক্তি আর সহ্য করতে পারছি না, বলল দিনিম, সব কিছুরই এবার একটা হেস্তনেস্ত করব।
হয়েছে কী বলবেন তো।
-এতগুলো মানুষের মধ্যে কেবল যা আপনিই আমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করেন। আপনি হয়তো আমার মর্মর্যাতনা কিছুটা বুঝতে পারেন…দেশে আমার ঠাই হয়নি-নাৎসীদের অন্যায় নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করেছিলাম বলে দেশত্যাগী হতে হয়েছে। নাৎসী জার্মানিকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি।
ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে পারব বলে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে জার্মান পরিচয়টাকেই সকলে বড়ো করে দেখছে।
–হ্যাঁ, আপনার অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পারি। সহানুভূতির স্বরে বলল টুপেনস।
–সামান্য অসুবিধা আমি মানিয়ে নিতে জানি। কিন্তু ওখানেই তো শেষ হচ্ছে না। আমি একজন জার্মান–আপনার কাছে আমি স্বীকার করেছি। খবরের কাগজে যখন চোখে পড়ে জার্মান সৈন্যরা অকাতরে দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছে, একটার পর একটা জার্মান প্লেন গুলিবিদ্ধ হচ্ছে, শহরের পর শহর বোমা বিধ্বস্ত হচ্ছে–মনের অবস্থা কেমন হয় বলুন। তার ওপর যখন ওই বুড়ো মেজর খবরের কাগজ হাতে নিয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জার্মান উদ্বাস্তুদের উদ্দেশ্যে গালাগালি ছুঁড়তে থাকেন আমি পাগল হয়ে যাই। বিশ্বাস করুন, আমি সইতে পারছি না–এসবের সমূহ অবসান আমি চাই।
দিনিমের উত্তেজিত মমর্যাতনাক্লিষ্ট রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। সে তার হাত চেপে ধরে বলে, আপনি শান্ত হোন। ধৈর্য ধরুন। এরকম মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নেবেন না। দোহাই।
-ইংরেজের জেলখানায় থাকলে তবুও অনেকটা স্বস্তি পাব আমি। পুলিশ আমাকে কয়েদ করলে খুশি হব।
–আপনি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছেন, তার কথা ভাবুন–বাকি সব কিছু তার কাছে তুচ্ছ। আমি শুনেছি, বিষাক্ত গ্যাসের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার উপায় খোঁজার জন্য আপনি গবেষণা করছেন। এ তো কেবল ইংলন্ডের নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণকর এই কাজ।
টুপেনসের কথায় দিনিমের উত্তেজনা যেন অনেকটাই প্রশমিত হয়। তার চোখের তারা বাঁকা হয়ে ঘুরে যায়।
-হ্যাঁ, ইতিমধ্যেই অনেকটা সাফল্য অর্জন করেছি গবেষণায়। জিনিসটা প্রস্তুত করা এমন কিছু কঠিন হবে না, ব্যবহারও করা চলবে সহজে।
-তাহলে, ভাবুন তো একবার, কতবড় মহৎ কাজে হাত দিয়েছেন আপনি। তাই বলি, শান্ত হোন। আমি নিজে জার্মান বিরোধী। তবু বলছি, এমন অনেক দয়ালু জার্মানকে আমি জানি, যাদের শ্রদ্ধা না করে আমি পারি না।
এখানে যেমন আমি রয়েছি, তেমনি মেজর ব্রেচলির মতো মানুষরাও রয়েছে। জার্মানিতেও তাই। এদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
কার্ল ভন দিনিম মাথা ঝুঁকিয়ে টুপেনসের হস্ত চুম্বন করে। বলে, আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাব…আপনার কথা বড়ো সুন্দর…আমি মনে অনেক জোর পেলাম।
টুপেনস বিদায় নিয়ে পথে এসে নামে। চলতে চলতে ভাবতে থাকে দিনিম এমন কর্তব্যপরায়ণ ও সৎ হওয়া সত্ত্বেও কেবল জার্মান পরিচয়ের জন্য কী নিদারুণ মর্ম নিপীড়ন সহ্য করছে। আরও দুর্ভাগ্য যে এখানে এই মানুষটাকেই সে সবচেয়ে পছন্দ করে।
.
কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবুও লন্ডনের একটা টিকিট না কেটে পারল না টুপেনস। লিহাম্পটনে থাকলে কখনও কারও চোখে পড়ে যেতে পারে।
সান্স সৌচির বাসিন্দাদের কে কখন কোথায় থাকে বলা যায় না। তাহলে তার গোটা পরিকল্পনাটাই ভণ্ডুল হবে।
টুপেনসের আশঙ্কাটা অচিরেই সত্য প্রমাণিত হল। শীলার সঙ্গে প্লাটফর্মে দেখা হয়ে গেল। একটা পার্শেলের খোঁজে নাকি বুকিং-এ এসেছিল, জানাল সে।
ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল টুপেনস। দেখতে পেল শীলা প্লাটফর্ম থেকে নেমে যাচ্ছে।
মেয়েটা এ সময় হঠাৎ করে স্টেশনে আসতে গেল কেন? সে কি তার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে? না কি তাকে কেউ পাঠিয়েছিল, টুপেনস সত্যি সত্যি লন্ডনে যাচ্ছে কিনা দেখবার জন্য? এ-কাজ মিসেস পেরিনারই হওয়া সম্ভব।
.
সান্স সৌচির আওতার বাইরে নিরিবিলিতে দু-জনে পরদিন দেখা করল। টুপেনস বলল, আমার ঘরে কাকে ঢুকতে দেখেছিলে তুমি?
টমি হেসে উঠল। বলল, প্রথমে দেখলাম সেই ছোট্ট মেয়ে বেটিকে-হাতে একটা উলের গোলা।
তার পরে?
–কার্ল ভন দিনিম।
–সত্যি? চমকে উঠল টুপেনস, কখন ঢুকেছিল?
লাঞ্চের সময়। ডাইনিং রুম থেকে সবার আগে ওপরে উঠে আসে। দেখলাম চুপচাপ তোমার ঘরে ঢুকে গেল। প্রায় মিনিট পনেরো ভেতরে ছিল।
টুপেনস চিন্তিতভাবে ঠোঁট কামড়ে ধরল। যুবক দিনিম যে একজন দক্ষ অভিনেতা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার ঘরে ঢোকার কোনো কারণ তো কার্লের নেই।
স্বদেশভূমি জার্মানির জন্যই দিনিমের এই গুপ্তচরবৃত্তি। নিঃসন্দেহে সে স্বদেশপ্রেমিক। সম্মানের যোগ্য। কিন্তু সে বিপজ্জনকও বটে। আর সেকারণেই তাকে ধ্বংস করা দরকার।
–খুবই দুঃখের ব্যাপার। চাপাস্বরে বলল টুপেনস। কিন্তু জার্মানিতে থাকলে আমরাও এ কাজই করতাম।
–যথার্থ বলেছ। স্বীকার করল টমি।
-যাইহোক, একটা দিকে পরিষ্কার হওয়া গেল, বলল টুপেনস, মিসেস পেরিনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে দিনিম আর শীলা কাজ করে চলেছে।
নেতৃত্বে রয়েছে মিসেস পেরিনা। আরও একজন আছে–এক অপরিচিতা বিদেশিনী মহিলা মাঝে মাঝে নিঃশব্দে এখানে আসে। তার সঙ্গে দিনিমকে কথা বলতে দেখেছি আমি।
-তাহলে এখন কি ভাবে এগুতে হবে বল।
-এখন আমাদের লক্ষ মিসেস পেরিনা। সুযোগ বুঝে তার ঘরে ঢুকতে হবে। নথিপত্র যদি কিছু পাওয়া যায়। তাছাড়া তার গতিবিধির ওপরেও কড়া নজর রাখা দরকার। আর যে মহিলার কথা বললাম, তিনি পোলিশ, তাকেও খুঁজে বার করতে হবে।
এই মিশনের সঙ্গে যোগাযোগটা সেই রাখছে মনে হচ্ছে। গোটা দলটাকেই তাহলে বাগে পাওয়া যাবে।
–ঠিক বলেছ। আবার কখন আসে নজর রাখতে হবে। গোপনে পেছন নিয়ে আস্তানাটা দেখে আসতে হবে।
জার্মান যুবক দিনিমের ঘরেও একবার হানা দেওয়া দরকার মনে হয়। বলল টুপেনস।
–তার ঘরে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ভালোভাবেই জানে যে কোনো মুহূর্তে পুলিশের নজর তার ওপরে পড়তে পারে। কাজেই হাতের কাছে কোনো প্রমাণ ফেলে রাখবে না। মিসেস পেরিনার ঘরে ঢোকাও কষ্টকর হবে।
-কেন?
–তারা মা মেয়ে খুবই সতর্ক। মিসেস পেরিনা যখন থাকেন না, তখন শীলা থাকে। তারপর বেটি তো সারাক্ষণই গোটা বারান্দায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তার পেছনে থাকে মিসেস স্প্রট।
লাঞ্চের সময়েই সুযোগটা নিতে হবে। বলে টুপেনস।
–দিনিমের ঘরেও?
-হ্যাঁ। চুপি চুপি ওপরে উঠে আসব। পরে নেমে গিয়ে বলব, তীব্র মাথা যন্ত্রণায় অসহ্য হয়ে উঠে গিয়েছিলাম।
–তাহলে আর রোগ ধরে রাখি কেন? সারিয়ে তোলাই ভালো–কাজ তো মিটে গেল।
-হ্যাঁ, এবারে ভালো হয়ে যাও। আমি তো ওপরে গিয়ে এঘর ওঘরে অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট খুঁজে বেড়াব, ধরা পড়ে গেলে ওই কথাই বলব,-সেই সময় ওপরে কোনো ভদ্রলোকের উপস্থিতি সন্দেহজনক মনে হতে পারে।
-তোমার বুদ্ধির তুলনা হয় না। উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠল টমি।
.
যথাসময়ে টমি মিঃ গ্রান্টকে দিনিম সম্পর্কে তার নিশ্চিত ধারণার কথা জানিয়ে দিল। মিঃ অ্যালবার্টের নামেও একটা চিঠি ডাকে ছেড়ে দিল।
ফেরার পথে কমাণ্ডার হেডকের সঙ্গে দেখা হল। নিজের টুসিটার নিয়ে বেরিয়েছিলেন হেডক। টমিকে সাগ্রহে গাড়িতে তুলে নিলেন। তারপর দুজনে একসঙ্গে ফিরে এলেন স্মাগলার্স রেস্ট-এ।
দুপুর দুটো নাগাদ সান্স সৌচিতে পৌঁছল টুপেনস। বাগান পার হয়ে হলঘরে ঢুকল। শব্দ শুনে বুঝতে পারল, ডাইনিং রুমে সকলে ভোজনে ব্যস্ত।
জুতো খুলে হাতে নিল টুপেনস। তারপর নিঃশব্দে অথচ দ্রুত ওপরে উঠে এল। সরাসরি এসে ঢুকল নিজের ঘরে। জুতো রেখে নরম স্লিপার পায়ে গলালো।
ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা ধরে হাঁটতে লাগল…ওর মধ্যেই একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল মিসেস পেরিনার ঘরে।
.
বুকে হাত চেপে ধরল টুপেনস। ঘরে ঢুকে ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে। মিসেস পেরিনা তো সাধারণ একজন মহিলা মাত্র নন…সেকারণেই এই শঙ্কা আর ভয়।
নিঃশব্দে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল টুপেনস।
ড্রয়ার টেনে পলকে সবকিছু দেখে নিল।
লেখার টেবিলে একটা ড্রয়ার টেনে খোলা গেল না। চাবি লাগানো।
আশান্বিত হয়ে উঠল টুপেনস। তাহলে এর মধ্যেই নিশ্চয় রয়েছে সব কিছু।
তালা বা বন্ধ ড্রয়ার খুলবার প্রয়োজনীয় কয়েকটা যন্ত্র সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল টুপেনস। সেগুলো এবারে কাজে লাগল।
সামান্য চেষ্টাতেই ড্রয়ারটা খুলে গেল।
ভেতরে পাওয়া গেল একটা ক্যাস বাক্স, কুড়ি ডলারের মতো খুচরো টাকা রয়েছে তাতে। সাগ্রহে একটা কাগজের বাণ্ডিল তুলে নিল হাতে। দ্রুত কাগজগুলোর ওপর চোখ বোলাতে লাগল। কিন্তু হতাশই হল।
কয়েকটা চিঠি, সান্স সৌচির মর্টগেজ ফর্ম, ইত্যাদি।
এর মধ্যে রহস্য কিছু পাওয়া গেল না। চিঠিগুলোও নির্দোষ।
সহসা ষষ্ট ইন্দ্রিয় সজাগ করে তুলল টুপেনসকে, এক ঝটকায় ড্রয়ারটা ঠেলে বন্ধ করে দিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার সামনে মিসেস পেরিনা আবির্ভূত হলেন।
পলকের মধ্যে বেসিনের কাছে সরে গেল টুপেনস। তাকের শিশি-বোতল নাড়াচাড়া করতে লাগল।
ঘাড় ঘুরিয়ে মিসেস পেরিনাকে দেখে ক্লিষ্ট হেসে বলল, মিসেস পেরিনা, মাফ করবেন, একটা অ্যাসপিরিনের খোঁজে আপনার ঘরেই ঢুকে পড়েছি। অসহ্য যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। আশাকরি কিছু মনে করবেন না। অ্যাসপিরিন তো সবসময়ই আপনার ঘরে থাকে জানি…
মিসেস পেরিনা ব্যস্তভাবে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলেন, মিসেস ব্লেনকিনসপ, আপনি কষ্ট পাচ্ছেন আগে আমায় বলেননি কেন?
-বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখলাম আপনারা সকলে খাবার টেবিলে বসে আছেন, তাই আর…
ক্ষিপ্র হাতে শিশি থেকে কতগুলি অ্যাসপিরিন বড়ি বার করে টুপেনসকে দিলেন মিসেস পেরিনা।
–যে কটা দরকার নিন।
টুপেনস তিনটা বড়ি তুলে নিল। তার আঙুল কাঁপছিল। মাথাযন্ত্রণার তীব্র কষ্টে এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।
টুপেনসকে তার ঘরে পৌঁছে দিলেন মিসেস পেরিনা। চকিতে ঘরের চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আপনার ঘরেই তো অ্যাসপিরিনের শিশি ছিল। আমি জানি।
-হ্যাঁ, আমার কাছে আছে, এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগল টুপেনস, কিন্তু কোথায় যে রেখেছি, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।
–ঠিক আছে, এখন বিশ্রাম নিন। দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন মিসেস পেরিনা। এতক্ষণে যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ পেল টুপেনস। টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
ভদ্রমহিলার ব্যবহারে তার মনোভাব কিছুই বোঝা গেল না। কিছু কি সন্দেহ করতে পেরেছেন? কিন্তু যখন দেখবেন লেখার টেবিলের ড্রয়ার খোলা, তখন তো তার মনে সন্দেহ উঁকি দেবে?
নাকি ভাববেন, নিজেই ড্রয়ার বন্ধ করতে ভুলে গেছেন। এমন ভুল তো সকলের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।
টুপেনস মনে করার চেষ্টা করল, বাণ্ডিলের কাগজগুলো আগের মতো ঠিক ঠিক সাজিয়ে রাখতে পেরেছে কিনা।
টুপেনস তার শোবার ঘরে চুপি চুপি উপস্থিত হয়েছে দেখে আর কি সন্দেহ করতে পারেন মিসেস পেরিনা? হয়তো ভাববেন মিসে ব্লেনকিনসপ বড় বেশি কৌতূহলী?
কিন্তু মিসেস পেরিনা যদি সত্যি সত্যি জার্মান গুপ্তচর হন? তাহলে এই ব্যাপারটাকে কখনওই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবেন না। সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবেন।
কিন্তু তেমন হলে তো তার কথায় বা ব্যবহারে প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ত। তাকে দেখে যথেষ্টই স্বাভাবিক মনে হয়েছে।…
হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা কথা মাথায় খেলে গেল টুপেনসের। উত্তেজনায় বিছানায় উঠে বসল সে। তার নিজের অ্যাসপিরিনের শিশি এই ঘরে টেবিলের পেছনে রাখা হয়েছে। আইডিন, সোডার বোতল এসবও রয়েছে সেখানে।
মিসেস পেরিনা ওসবের হদিশ জানলেন কী করে? অ্যাসপিরিন সম্পর্কে তার শেষ তীক্ষ্ণ মন্তব্যটা তো নিরর্থক নয়। তাহলে…তাহলে…যে কাজটা এখন টুপেনস করতে চেয়েছে, অনেক আগেই তা সেরে নিয়েছেন ভদ্রমহিলা।
চুপি চুপি টুপেনসের ঘরে ঢুকে সবই হাতিয়ে দেখে নিয়েছেন।
.
বেটিকে দেখাশোনার দায়িত্ব টুপেনসের কাঁধে চাপিয়ে পরদিন সকালেই লন্ডন গেলেন মিসেস স্প্রট। তাই সারা সকালটা তাকে নিয়েই কাটল।
ইতিমধ্যেই বেটির আধোআধো কথা অনেকটাই সড়গড় হয়েছে। শুনতে বেশ ভালোই লাগে।
বেটিকে নিয়ে মিসেস স্প্রটের ঘরে ঢোকে টুপেনস। একটা একটা করে ছবির বই দেখায়। কিন্তু পুরোনো বই একদম পছন্দ করে না বেটি। নোংরা বই বলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
মিসেস ওরুরকি নিজের ঘর ছেড়ে একদম বেরোন না। লাঞ্চের পর বেটিকে ঘুম পাড়িয়ে উঠতেই মিসেস ওরুরকির ডাক পেল টুপেনস।
ভদ্রমহিলা তার ঘরে নাতি-নাতনি আত্মীয়-স্বজনের একরাশ ছবি টেবিলে ছড়িয়ে নিয়ে বসেছিলেন।
ঘরে ঢুকে কুশল বিনিময়ের স্বরে টুপেনস একথা-সেকথায় কিছু সময় কাটাল। তারপরেই আচমকা একটা প্রশ্ন শুনে প্রবলভাবে চমকে উঠল।
–এবারে বলুন, মিসেস ব্লেনকিনসপ, সান্স সৌচি সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
চোখ তুলে তাকাল টুপেনস। কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটার জবাব দেবে ভেবে পেল না।
মিসেস ওরুরকি নিজেই তাকে সঙ্কটমুক্ত করলেন। বলে উঠলেন, আমি জানতে চাইছি, এখানে খারাপ কিছু আপনার নজরে পড়েছে?
এবারে একটা সূত্র পেয়ে গেল জবাব দেবার। তাই টুপেনস বলল, খারাপ কিছু? তেমন কিছুর আভাস তো পাইনি।
–মিসেস পেরিনা সম্পর্কে নয়? ওর সম্পর্কে আপনার কৌতূহল আমি লক্ষ্য করেছি। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি তাকে সর্বদা অনুসরণ করেন।
সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল টুপেনসের। এমনভাবে ধরা পড়ে যাবে আগে ভাবতে পারেনি। কোনোরকমে সামলে নিয়ে ইতস্তত করে বলল, উনি এক বিচিত্র মহিলা।
-বিচিত্র মোটেই নন, বললেন মিসেস ওরুরকি, আপাতদৃষ্টিতে নেহাত সাধারণ মহিলা বলেই মনে হবে। কিন্তু আমার ধারণা তিনি তা নন। আপনার ধারণা কী?
-আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন আমি ধরতে পারছি না। বলল টুপেনস।
-এ বাড়ির প্রতিটি মানুষকে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নজর করেছি–সবই রহস্যময় চরিত্র। মিয়াদোকে খেয়াল করেছেন কখনও।
সাদামাটা এক ইংরেজ ভদ্রলোক বলেই মনে হবে। কিন্তু মাঝে মাঝে তার কথায় অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ধরা পড়ে। ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হয় না আপনার?
-ঠিকই বলেছেন, বলে উঠল টুপেনস, ভদ্রলোক এক অদ্ভুত মানুষ।
–অদ্ভুত একা তিনিই নন, সকলেই। টুপেনসের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসতে লাগলেন মিসেস ওরুকি।
একটা দুর্বোধ্য অসহায়তা ক্রমশ গ্রাস করছিল টুপেনসকে। মিসেস ওরুরকির মুখের দিকে তাকাতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল।
ধীর পায়ে সে জানালার দিকে সরে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার।
জানালাপথে নিচের বাগানে তাকাল টুপেনস। খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছের পাতার জল ঝরছে টুপটাপ শব্দে।
হঠাৎ দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় টুপেনসের। একটা মুখ–সেই বিদেশিনী মহিলার, যে গতকাল রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দিনিমের সঙ্গে কথা বলছিল।
…সহসা একদিকের ঝোপ সরিয়ে এই বাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি মারছে।
টুপেনসের সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, সান্স সৌচির একটা জানালার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে কিছু দেখার প্রত্যাশা করছে। নিষ্পলক দুটি চোখে যেন আকুতি মাখানো, মনে হল টুপেনসের।
চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে মিসেস ওরুরকির দিকে তাকাল। অস্ফুট স্বরে কিছু বলবার চেষ্টা করল।
পরক্ষণেই ক্ষিপ্রবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে বারান্দা পার হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ির ধাপ ডিঙিয়ে নিচে নেমে এলো।
ঝড়ের বেগে হলঘর পার হয়ে বৃষ্টিভেজা বাগানে নেমে থামল।
একমুহূর্তের বিরতি নিল। আবার ছুটল বাগানের সেই কোণের দিকে, যেখানে সেই বিদেশিনীকে কিছুক্ষণ আগে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।
কিন্তু কাউকে পেল না টুপেনস। কোথাও নেই সেই মহিলা। এপাশ-ওপাশ ঘুরে খুঁজল সে-কিন্তু আশ্চর্য, ভোজবাজির মতো যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে সেই মূর্তি।
টুপেনস দৌড়ে বাগান পার হয়ে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত ছুটে গেল। কিন্তু জনহীন উঁচুনিচু পাহাড়ি পথে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো মানুষের ছায়া পড়ল না।
কোথাও নেই সেই বিদেশিনী মূর্তি। কিন্তু টুপেনসের তো দেখায় কোনো ভুল ছিল না। কোনো মতেই না। স্পষ্ট দেখেছে সেই মুখ। কিন্তু পলকের মধ্যে এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে?
হতাশ বিভ্রান্ত টুপেনস সান্স সৌচির দিকে ফিরে চলল।
টুপেন্সের বুকে সন্দেহ আর ভয় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে ঘুণাক্ষরেও যদি সে জানতে পেত, কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাড়িতে কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটতে চলেছে।
কিন্তু জানার উপায় ছিল না তার, কারুরই তা ছিল না।
সমস্যা পাকিয়ে উঠেছে বেটি, স্প্রটকে নিয়ে।
ক্লে দম্পতি অভিযোগ তুলেছেন তার বিরুদ্ধে।
আর তা নিয়ে আলোচনার জন্য সান্স সৌচির বাসিন্দারা মিলিত হয়েছেন মিসেস পেরিনার ঘরে।
মিঃ ক্লে অসুস্থ মানুষ।কিছুতেই ঘুম আসে না চোখে। কখনও সখনো যদি বা একটু ঝিমুনি আসে তা ভেঙ্গে যায় বেটির দাপাদাপিতে।
ছোট্ট বেটির বিরুদ্ধে মিঃ ক্লের এই অভিযোগের জবাবে মিসেস ব্লেনকিনসপ বললেন, ছোট্ট বেটির এখন তিন বছর বয়স পার হয়নি। ওরকম একটা শিশুর বিরুদ্ধে হইচই করে ঘুম নষ্ট করার অভিযোগ হাস্যকর বললেও কমই বলা হয়।
মিষ্টি মেয়েটা আছে বলে সান্স সৌচি আমাদের সকলের কাছেই আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
টুপেনসের ওই জবাবেই আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। সকলেই মূল বিষয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যুদ্ধের বিষয় নিয়েই কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন।
সুযোগ পেয়ে মিঃ ক্লে নিজেও জার্মানদের বিরুদ্ধে অনর্গল বিষোগার করতে লাগলেন।
মিসেস পেরিনার ঘরে আলোচনা যখন জমে উঠেছে, ঠিক সেই সময় মিসেস ক্লে এসে ঘরে ঢুকলেন।
বেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। তারপর পরপর কয়েক কাপ কফি খেলেন আর তার লন্ডন ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা সকলকে শোনাতে লাগলেন।
এরপর সকলে উঠে হলঘরে গিয়ে বসলেন। বেটি নিজের মনে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। একসময় সে সকলের অলক্ষে বাগানে নেমে গেল।…
রাত সাতটার আগে বেটির কথা মনে পড়ে না মিসেস স্প্রটের। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
-সর্বনাশ, বেটির ঘুমোবার সময় হয়ে এল যে, বেটি–বেটি–
সকলেই দেখেছিলেন কিছুক্ষণ আগেও বেটি আশপাশে খেলা করছে। এখন কোথায় গেল? মিসেস স্প্রট গোটা হলঘর চক্কর দিতে দিতে বেটির নাম ধরে ডাকতে থাকেন। কিন্তু বেটির কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
এবার সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বেটির অনুসন্ধানে নেমে পড়েন।
সান্স সৌচির বিভিন্ন ঘর, রান্নাঘর, বাগান–কোথাও খোঁজা বাকি থাকে না।
–বেটি-ই-ই
অস্থির হয়ে চিৎকার করে ওঠেন মিসেস স্প্রট।
কে একজন বললেন, রাস্তার দিকে যায়নি তো?
অমনি টুপেনস আর মিসেস স্প্রট ছুটে পথে নেমে এলেন।
কিন্তু এখানেও নেই বেটি। উঁচু নিচু পাহাড়ি পথের যতদূর দৃষ্টি যায়, কেউ নেই। কেবল দেখা গেল স্থানীয় একটি পরিচারিকা এগিয়ে আসছে।
মিসেস স্প্রট ও টুপেনসের জিজ্ঞাসার জবাবে মেয়েটি বলল, একটা বাচ্চা মেয়ে তো, আমি প্রায় আধঘণ্টা আগে তাকে দেখেছি। সবুজ ফ্রক পরা।
মিসেস স্প্রট সাগ্রহে জানতে চান, সে কোথায়–কোনদিকে গেছে?
মেয়েটি বলে, দেখলাম ঢালু পথ ধরে একজন মহিলার হাত ধরে হাঁটছে।
–মহিলা! মিসেস স্প্রট অস্থিরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, কেমন দেখতে তাকে?
মেয়েটি জানায়, পোশাক দেখে মনে হল বিদেশী। চেহারাও যেন কেমন।
টুপেনসের মনে পড়ল, সান্স সৌচির বাগানে সে এক মহিলাকে উঁকি মারতে দেখেছিল, তারপর তাকে আর কোথাও খুঁজে পায়নি।
কিন্তু বেটি তার সঙ্গে যাবে কেন?
মিসেস স্প্রট আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না।
-আমার বেটি। কি হবে–তাকে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। সেই মেয়েমানুষটাকে কি জিপসিদের মতো দেখতে?
মেয়েটি জবাব দেবার আগেই টুপেনস বলে উঠল, তাকে জিপসিদের মতো দেখতে নয় মোটেই–সুন্দর দেখতে নীল চোখ, এক মাথা চুল।
মিসেস স্প্রট কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে টুপেনসের দিকে তাকিয়ে থাকেন। টুপেনস বলতে থাকে, আজই দুপুরে তাকে আমি বাগানের ঝোপে দেখেছি। আড়াল থেকে বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল। আগে একদিন দেখেছিলাম, কার্ল ভন দিনিমের সঙ্গে কথা বলতে। একই লোক সন্দেহ নেই।
পরিচারিকাটি বলে উঠল, আপনি যেরকম বললেন, তেমনি দেখতে তাকে। মাথাভর্তি চুল, নীল চোখ। অদ্ভুত রকম ভাষায় কথা বলছিল।
নিশ্চয় কোনো জার্মান মহিলা। ওহ–আমার বেটিকে নির্ঘাত সে খুন করবে।
–অতটুকু মেয়েকে কে খুন করবে? ধমকে ওঠে টুপেনস, আপনি শান্ত হোন। চলুন ঘরে যাওয়া যাক, পুলিশে খবর দিতে হবে এখুনি–আমরা বেটিকে ঠিক ফিরে পাব।