২১.
মলিকে দেখাশোনা করা, আবার হোটেল চালানো–দুই দিকের চাপে নাজেহাল হতে হতো। টিম কেণ্ডালকে, যদি না ইভিলিন তার কাজের দায়িত্ব কিছুটা হাল্কা করে দিত।
পুরো একটা বেলা মলির কাছে ছিলেন ইভিলিন। কিন্তু পরদিন পেলিক্যান পয়েন্টে পাখি দেখতে যাবার কথা ছিল সঙ্গীদের সঙ্গে। তাই মলির দেখাশোনার দায়িত্ব স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মিস মারপলই হাতে নিলেন।
–আজ তোমাকে খুব ভাল লাগছে মলি। খুব আনন্দ হল। বললেন মিস মারপল।
–আমি ভালই আছি। কেবল ঘুম পায়।
বেশতো ঘুমোবার চেষ্টা করো। আমি কথা বলব না। চুপচাপ বসে সেলাই করব।
মলি মলিন মুখে সামান্য হেসে বামদিকে পাশ ফিরে শুলো।
–আমি একটু ঘুমোই মিস মারপল।
দীর্ঘকালের সেবাব্রতের অভিজ্ঞতা রয়েছে মিস মারপলের। তাই মলির শ্বাসপ্রশ্বাস খানিক নিয়মিত হলে তিনি উঠে মলির বিছানার চাদর চারপাশ থেকে টেনে গদির নিচে গুঁজে দিলেন।
হঠাৎ গদির নিচে একটা বই হাতে ঠেকল তাঁর। একটু আশ্চর্য হলেও বইটা টেনে বার করলেন।
চকিতে একবার মলির দিকে দৃষ্টি ফেরালেন মিস মারপল। মনে হল নিদ্রিত। তিনি বইটির মলাট উল্টে দেখলেন–একটা স্নায়ুরোগ সংক্রান্ত বই। যেখানে মার্ক রাখা ছিল, সেই পাতায় মানসিক ব্যাধির নানা উপসর্গের কথা লেখা রয়েছে।
কয়েক পাতায় চোখ বোলানোর পরেই মিস মারপলের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি বই বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত কি ভাবলেন। বইখানা আবার যেখান থেকে বের করেছিলেন সেখানেই রেখে দিলেন।
কি ভেবে পেছনে ফিরে তাকালেন। তার চোখে পড়ল, মলি চোখ মেলে তাকিয়ে, তাকে লক্ষ্য করছিল, আবার চোখের পাতা বুজে গেল।
চকিতের জন্য তার সন্দেহ হল, মলি সত্যিই ঘুমিয়েছে না তার সবটাই ভান। সঠিক কিছু বোধগম্য হল না তার। তবু তার মনে হল মলির চোখে যেন ধূর্ততার ছায়া দেখতে পেলেন। তিনি তাঁর নিজের চেয়ারে ফিরে এলেন।
নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। বেশিক্ষণ চেয়ারে স্থির হয়ে বসতে পারলেন না তিনি। উঠে দাঁড়িয়ে ঘরে খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন, দুদিকের জানালায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন।
তারপর কি ভেবে জানালার পাল্লা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর ভেতরে লক্ষ্য করে বললেন, বাংলো থেকে একটু ঘুরে আসি বুঝলে, সেলাইয়ের নক্সাটা ফেলে এসেছি। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত ঠিক থেকো।
কোন জবাব এলো না। তিনি বুঝতে পারলেন, মলি এবারে সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে।
সামনের ফাঁকা জায়গা বরাবর এগিয়ে সিঁড়ি ধরে ডান দিকের পথ ধরলেন। পাশেই চোখে পড়ল একটা হিবিসকাস ঝোপ। তীব্র দৃষ্টিতে ঝোপের ভেতরটা একবার দেখে নিলেন।
ফুলের ঝোপ পার হয়ে বাংলোর পেছনে গিয়ে দ্বিতীয় দরজা দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকলেন। সেখান থেকে একটা ছোট ঘর পার হয়ে মূল শোবার ঘরে পৌঁছানো যায়।
ঘরে পরদা ঝোলানো। মিস মারপল চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করলেন। মলির ঘরে কেউ ঢুকলে এখান থেকে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে।
মিস মারপল যা দেখতে চাইছিলেন, মিনিট পাঁচ-ছয় পরেই তা দেখতে পেলেন।
আধখোলা জানালা পথে জ্যাকসনের চেহারা ভেসে উঠল। জানালায় আঙুলের টোকা পড়ল। ভেতর থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
চারপাশে ধূর্ত দৃষ্টি বুলিয়ে নিল জ্যাকসন। পর মুহূর্তেই খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে মিস মারপল ঘরের লাগোয়া বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখতে পেলেন জ্যাকসন হাত ধোওয়ার বেসিনের ওপরের তাকে চোখ বোলাচ্ছে। মিস মারপলের ওপর চোখ পড়তেই হকচকিয়ে গেল।
–ওহ,…আমি…মানে…আপনি…
–মিঃ জ্যাকসন! বললেন মিস মারপল। কিছু চাইছিলেন বুঝি!
–আমি মিসেস কেণ্ডেলের মুখে মাখার ক্রিমটা দেখতে চাইছিলাম। ব্রাটা–
জ্যাকসনের হাতে ধরাও ছিল একটা মুখে মাখার ক্রিমের কৌটো। তৎপরতার সঙ্গে সে এটাই কাজে লাগিয়েছে।
কৌটোটা নাকের কাছে এনে জ্যাকসন বলল, চমৎকার গন্ধ। এই ব্রাটাই ভালো।
–এ বিষয়ে আপনার কোন জ্ঞান আছে মনে হচ্ছে। বললেন মিস মারপল।
–কিছুকাল এসব তৈরির কারখানায় কাজ করেছিলাম। প্রসাধনী বিষয়ে অনেক কিছুই জানা হয়ে গিয়েছিল।
–এটার জন্যেই আপনি
–ঠিক এজন্যে নয়…মিসেস ওয়াল্টার্স সেদিন তার লিপস্টিক মিসেস কেণ্ডালকে দিয়েছিলেন। সেটাই ওর জন্য নিয়ে যেতে এসেছিলাম।
-বুঝেছি। সেটা পেলেন
–মিসেস কেণ্ডালের হাতবাগেই রয়ে গেছে মনে হয়। যাক মিসেস ওয়াল্টার্স অবশ্য সেভাবে বলেন নি…
জ্যাকসন তাকের বাকি প্রসাধনীগুলো তাকিয়ে দেখতে লাগল।
–আজকাল বাজারে অনেক সস্তার জিনিস বেরিয়েছে। তার কোন কোনটা খুবই বিপজ্জনক। বলল জ্যাকসন।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, বললেন মিস মারপল, আমিও জানি সেটা।
–এসব কথা আপনাকে বোধহয় মেজর প্যালগ্রেভ বলেছিলেন, তাই না?
–হ্যাঁ, মানে তিনিই বলেন। তিনি এসব খবর রাখতেন।
–কিন্তু অনেক ব্যাপারই তো লোককে যা বলতেন তা সঠিক নয়। মেজর প্যালগ্রেভ এমনি অনেক অনাসৃষ্টি ঘটিয়েছেন।
এই সময় লাকি ডাইসনের অবয়ব ভেসে উঠল বেডরুমের জানালায়। মিস মারপল দৃষ্টি ফেরালেন তার দিকে।
–ওহ আপনি, বললেন লাকি, ভাবছিলাম মলির কাছে কিছুক্ষণ বসব কি না। মলি এখনো ঘুমিয়ে রয়েছে?
–মনে হয়। তবে ভাল আছে। আপনার তো ওদের সঙ্গে পাখি দেখতে যাবার কথা ছিল।
–তাই যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু বিশ্রী মাথা ধরল বলে শেষ মুহূর্তে আর যাইনি। তাই ভাবলাম, যদি এখানে কোন কাজে লাগতে পারি।
-খুব ভাল কথা। আমি এখানেই রয়েছি।
মিস মারপল তার চেয়ারে ফিরে গিয়ে বসলেন।
লাকি কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে চলে গেলেন। ততক্ষণে বাথরুমের পাশের অন্য দরজা দিয়ে জ্যাকসনও বেরিয়ে গেছে।
জ্যাকসন যে ক্রিমের কৌটো হাতে নিয়েছিল সেটা তাক থেকে তুলে নিয়ে মিস মারপল নিজের পকেটে পুরে ফেললেন।
.
২২.
টিম ইতিমধ্যে ফিরে এসে মলির দেখাশোনা করছিল। নৈশ ভোজের সময় মিস মারপল মলির কাছে থাকবেন এমন ব্যবস্থা হয়েছিল।
টিম মিস মারপলকে জানিয়েছিল, ওই সময়টায় মিসেস হিলিংডন ও মিসেস ডাইসনও মলির কাছে থাকতে পারে।
হোটেলের সামনের পথ ধরে নিজের বাংলোর দিকে ফিরে চলেছিলেন মিস পারপল। এই মুহূর্তে কি কর্তব্য সেকথাই মাথায় ঘুরছিল।
মেজর প্যালগ্রেভ তার বিরক্তিকর গল্প বলার সময়ে এমন হঠকারী মন্তব্য করেছিলেন যে তা অন্যের কানেও ঢুকেছিল। আর তারই পরিণতিতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হল।
এ পর্যন্ত সবই পরিষ্কার। কিন্তু এরপর থেকেই দেখা দিয়েছে জটিলতা। কেউ যে নিহত হতে চলেছে এই ভাবনা ক্রমশই তার মধ্যে প্রবল হয়ে উঠছিল। কিন্তু সম্ভাব্য সেই ব্যক্তির পরিচয় না জানা পর্যন্ত মনের অস্বস্তি কাটবে না তার।
কে সেই লোক? যোয়ান প্রেসকট? গ্রেগরী ডাইসন? নাকি লাকির স্বামী গ্রেগরী ডাইসন? লাকি কি নতুন স্বামী লাভের জন্য লালায়িত হয়ে পড়েছে? তাহলে অবশ্য তার দুদিক থেকেই লাভ। গ্রেগরী ডাইসনের বিধবা স্ত্রী হিসেবে বিপুল অর্থ আর মুক্তি।
মিঃ র্যাফায়েলকে নিয়ে জ্যাকসন চলে গিয়েছিল। মিসেস এসথার ওয়াল্টার্স বারান্দায় চেয়ারে বসেছিল। মিস মারপলকে দেখে জিজ্ঞেস করল, আজ সারা বিকেল আপনাকে দেখতে পাইনি।
-মলির কাছে ছিলাম আমি। ওকে আজ অনেক সুস্থ দেখলাম। বললেন মিস মারপল।
এসথার মৃদু হেসে বলল, আমার কথা কি কেউ মানবে, আমি জানি ওর কিছু হয়নি।
কপাল কুঞ্চিত হল মিস মারপলের। বললেন, ওর আত্মহত্যার চেষ্টা বলছেন–
-আমি বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস করি না ও বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ডাঃ গ্রাহামেরও তাই অভিমত।
–বুঝতে পারছি না একথা কেন বলছেন?
-ওর উদ্দেশ্য হল, অন্যের নজর আকর্ষণ করা। আমি ওর সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। ওর এসব ব্যাপারে একজন পুরুষ জড়িত আছে। একসময় সেই লোককে বিয়ে করার জন্যই উতলা হয়ে উঠেছিল মলি। বাড়ির লোকের আপত্তির জন্য অবশ্য তা সম্ভব হয়নি।
–এরকম কিছু আমিও মনে হয় শুনেছি। বললেন মিস মারপল।
-টিমকে বিয়ে করলেও সেই লোক তার পেছন ছাড়েনি। আমার কেমন মনে হয়, মলিকে অনুসরণ করে সেই লোক এখানেও হাজির হয়েছে।
-কিন্তু কে সেই লোক?
–আমি জানি কে সে। ওরা এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক।
–তাহলে মলি কি এখনো সেই লোকের অনুরক্ত?
তা না হলে, সেই লোক পেছন নেবে কেন? কিন্তু আমি জানি, লোকটা ভয়ানক বদ। এই সব মেয়েদের হাত করে কাজ করিয়ে নিতে তার জুড়ি নেই।
–লোকটা অতীতে এ ধরনের কিছু করেছে কিনা আপনি জানেন?
-রটনা কত রকমই হতে পারে–তাতে কি। লোকটি হয়তো বিবাহিত ছিল, সেকারণেই বাড়ির লোকে আপত্তি করেছিল। এমনও হতে পারে সত্যিকারের একজন বদলোক ছিল কিংবা পানাসক্ত। বেআইনী কোন কাজে লিপ্ত থাকাও অসম্ভব নয়।
তবে এটা ঠিক মলি আজও তাকে পছন্দ করে। আমি এব্যাপারে নিশ্চিত।
–আপনি কি নিজে কিছু দেখেছেন, বা শুনেছেন? এসথার বলল, আমি যতটা জানি, ততটাই বলেছি।
–ওইসব খুনের ব্যাপার?
–খুনের ব্যাপারগুলো ভুলে যাওয়াই উচিত। যা ঘটেছে, ঘটে গেছে, তা নিয়ে অত মাতামাতি করার কি আছে। আপনি মিঃ র্যাফায়েলকেও এর মধ্যে জড়িয়েছেন। আমি জানি যতই চেষ্টা করুন আর বিশেষ কিছু জানতে পারবেন না।
–আপনি দেখছি অনেক কিছুই জানেন। বললেন মিস মারপল, সবকিছু আপনার প্রকাশ করা উচিত।
-এতে কি লাভ হবে। আমি কিছুই প্রমাণ করতে পারব না।
–এমনও তো হতে পারে, আপনি কিছু প্রকাশ না করার জন্য আবার একটা খুন হল।
–এরকম কিছুই ঘটবে না, আমি নিশ্চিত। জোরের সঙ্গে বলল এসথার। আমার মনে হয়, মলি যদি লোকটার সঙ্গে কোথাও চলে যায় তাহলে সবদিক থেকেই ভাল হয়। আমাদের কাউকেই আর ভেবে অস্থির হতে হবে না।
কথা শেষ করে এসথার তার ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, রাতের খাওয়ার সময় হয়েছে, আমাকে এখুনি পোশাক বদলাতে হবে।
মিস মারপল এসথারের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।
পেছন থেকে ডাঃ গ্রাহামের কণ্ঠস্বর শুনে ভাবনায় ছেদ পড়ল। ডাঃ গ্রাহামকেই খোঁজ করছিলেন তিনি। ঘুরে তাকিয়ে বললেন, বিকেলটা মলি কোলের কাছেই ছিলাম। ও খুব দ্রুত সামলে উঠেছে দেখলাম।
–এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, বললেন ডাঃ গ্রাহাম, জিনিসটা খুব বেশি মাত্রায় যায় নি।
–আমার ধারণা ছিল, আধ শিশি পিলই বুঝি খেয়ে বসে আছে। বললেন মিস মারপল।
–অতগুলো খেয়েছিল বলে মনে হয় না। ট্যাবলেটের কিছুটা শিশি থেকে আগেই সরিয়ে রাখা হয়েছিল বলে আমার ধারণা।
–এমনও হতে পারে, এ কাজটা ইচ্ছাকৃত। কিছু বোঝানোর জন্যই হয়তো…ওদের দুজনের মধ্যে যদি কোন মনোমালিন্য ঘটে থাকে–
-না, ওদের মধ্যে তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। ওরা পরস্পরকে ভালবাসে। তবে এখনও কয়েকদিন ওকে নজরে রাখা দরকার।
এরপর অভিবাদন জানিয়ে ডাঃ গ্রাহাম হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন। মিস মারপল, নিজের চেয়ারে বসেই নানা কথা ভাবতে লাগলেন। প্রেসকট যেসব কথা বলেছেন…এসথার ওয়াল্টার্সও যা বলল…আবার মেজর প্যালগ্রেভের কথাও মনে পড়ল। একে একে।
.
২৩.
ইতিমধ্যে স্টীলব্যাণ্ড পূর্ণোদ্যমে বাজতে শুরু করেছে। সেই শব্দে চিন্তার ছেদ পড়ল না। কেন না তিনি যথেষ্ট অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
মলির ধূর্তামি মাখানো দৃষ্টির কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না মিস মারপল। অথচ প্রথমে সবকিছুই তার কাছে কত স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কারোর মধ্যেই কোন অস্বাভাবিকতা তিনি দেখতে পাননি।
মলি আর টিম কেণ্ডাল–স্বাভাবিক উৎসাহী দুই তরুণ দম্পতি। হিলিংডনদের কত উজ্জ্বল হাসি-খুশি, সুখী মনে হয়েছে।
বেপরোয়া গ্রেগ ডাইসন আর লাকি–যেন পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পুরে নেবার জন্য ছটফট করছে, কত উজ্জ্বল তারা। চারজনের এই দলটাকে চমৎকার মানিয়েছিল।
হাসিখুশি দয়ালু এখজন যাজক ক্যানন প্রেসকট, তার বোন যোয়ান প্রেসকট চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত এক মহিলা।
তারপর মিঃ র্যাফায়েল-দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। একবার তার সঙ্গে পরিচিত হলে সহজে ভুলতে পারা যায় না।
মিঃ র্যাফায়েল অশক্ত মানুষ, তিনি নিজে জানেন তাঁর দিন শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু কোন জরুরী ব্যবস্থা নিতে হলে এই প্রভাবশালী মানুষটির সাহায্যই তাকে নিতে হবে। তিনি কি এতে সম্মত হবেন?
এমনি নানান বিষয় ভাবতে ভাবতে মিস মারপল তার চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন।
নৈশবাতাস ভরপুর হয়ে উঠেছে আনন্দ কোলাহলে। সকলেই তখন খুশির জোয়ারে ভেসে চলেছে। টিম কেণ্ডালও এই হাসি-আনন্দের হাটে যোগ দিয়েছে।
মিস মারপল উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে তার বাংলোর দিকে ফিরে চললেন।
.
একটা কলগুঞ্জনের শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় উঠে বসলেন মিস মারপল। ঘড়িতে রাত দুটো। অথচ মনে হচ্ছে বাইরে অনেক লোক কথা বলছে!
ধীরে ধীরে ড্রেসিং গাউন গায়ে চাপালেন তিনি। চপ্পল পড়লেন। তারপর মাথায় একটা উলের স্কার্ফ জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
চোখে পড়ল, টর্চ হাতে অনেকে কি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েক পা এগিয়ে ক্যানন প্রেসকটকে দেখতে পেলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কিছু ঘটেছে?
-ওহ, মিস মারপল? মিসেস কেণ্ডেলকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার স্বামী ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে পান তিনি বিছানায় নেই–তাকেই খুঁজতে বেরিয়েছি আমরা।
বলতে বলতে দ্রুত চলে গেলেন ক্যানন প্রেসকট। মিস মারপল ধীর পায়ে তার পেছনেই চললেন।
মলি বিছানায় নেই…ও কি আগেই এরকম একটা মতলব ভেঁজে রেখেছিল? স্বামী ঘুমিয়ে পড়লেই পালাবে? কিন্তু এর উদ্দেশ্য কি?
এসথার ওয়াল্টার্স যা বলেছে তাহলে তাই কি সত্যি? এর মধ্যে অন্য একজন পুরুষ জড়িয়ে আছে?
চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে এগিয়ে চললেন মিস মারপল। কিছুটা এগুবার পর অস্পষ্ট ডাক শুনতে পেলেন তিনি।
-এই যে…এই দিকে…ওই তো…
জায়গাটা হোটেল থেকে খানিকটা দূরে। সমুদ্রমুখী খাড়ির কাছাকাছি। বেশির ভাগ লোকই হোটেলে ঘুমিয়ে রয়েছে। খাড়ির ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাত্র কয়েকজন।
একজন পেছন থেকে ছুটে এসে প্রায় তাকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে গেল সামনে। মিস মারপল চিনতে পারলেন, টিম কেণ্ডাল।
এক মিনিট পরেই তার আর্দনাদ শুনতে পেলেন।
–মলি…হায় ভগবান…মলি…
ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি সকলের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাকিয়ে দেখলেন, সেখানে রয়েছে কিউবার ওয়েটার দুজন, ইভিলিন হিলিংডন আর দুজন স্থানীয় মেয়ে।
টিম সামনে মাটিতে হাঁটু মুড়ে ঝুঁকে রয়েছে। খাড়ির মধ্যে শায়িত মেয়েটির দেহ দেখতে পেলেন মিস মারপল। মুখ জলের মধ্যে ডোবানো। সোনালী চুল কাঁধ ঢেকে রাখা হাল্কা সবুজ শালের ওপর এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে।
–ওহ মলি…।
টিম হাত বাড়াল মৃতের একটা হাত স্পর্শ করবার জন্য। মিস মারপল এবারে দায়িত্ব হাতে না নিয়ে পারলেন না। তিনি কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে বলে উঠলেন, ওকে সরাবেন না মিঃ কেণ্ডাল। সেটা উচিত হবে না।
-কিন্তু আমাকে দেখতে হবে…ওই…মলি…
ইভিলিন এগিয়ে গিয়ে টিমের কাধ স্পর্শ করলেন। বললেন, ও মারা গেছে টিম, আমি ওর নাড়ি দেখেছি।
মারা গেছে? অবিশ্বাসের সুরে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল টিম, ও জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে…কিন্তু বোন? কি এমন ওর যন্ত্রণা…আমাকে কেন ও জানালো না?
কণ্ঠ চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে এল টিম কেণ্ডালের।
–কেউ ডাঃ গ্রাহামকে একবার ডেকে আনলে ভাল হয়। সেই সঙ্গে পুলিসে টেলিফোন করা দরকার। বললেন মিস মারপল।
–পুলিস? তিক্তস্বরে বলে উঠল টিম, ওরা এসে কি করবে?
–আত্মহত্যার ব্যাপার ঘটলে পুলিসকে জানাতেই হবে। বললেন মিস মারপল।
–আমিই ডাঃ গ্রাহামকে ডেকে আনছি। হয়তো এখনো তিনি কিছু বলতে পারেন।
একরকম টলতে টলতে হোটেলের দিকে চলে গেল টিম।
মিস মারপল আর ইভিলিন হিলিংডন মৃত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
–এখন আর কিছুই করার নেই। অন্তত একঘণ্টা আগে মারা গেছে মলি। ওঃ কী মর্মান্তিক। ওদের দুজনকে কত সুখী ভেবেছি। মলি যেন বরাবরই কেমন একটু অপ্রকৃতিস্থ ছিল।
না। ও কথা আমি মানতে পারি না।
দৃঢ়স্বরে বললেন মিস মারপল।
একটু আগেই চাঁদ ঢাকা পড়েছিল মেঘের আড়ালে। এবার মেঘ সরে গেল। মুক্ত চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ল চরাচরে। উজ্জ্বল রুপোলি আলোয় মলির ছড়িয়ে থাকা সোনালী চুল ঝকমক করে উঠল।
মিস মারপল হঠাৎ একটা অস্ফুট শব্দ করে নিচু হয়ে বসলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে সোনালী চুলে হাত রাখলেন।
–আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার। বললেন তিনি।
–কিন্তু আপনি যে টিমকে কিছু স্পর্শ না করার কথা বললেন। ইভিলিন বললেন।
–তা জানি। তখন চাঁদের আলো ছিল না, তাই আমি দেখতে পাইনি…
মিস মারপল ধীরে আঙুল চালিয়ে চুলের গোছা ফাঁক করতেই চুলের গোড়া দেখা গেল। ইভিলিন সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ বিস্ময়সূচক শব্দ করে উঠল।
–একি…এ লাকি–মলি নয়–
-হ্যাঁ। দুজনের চুলের রঙ প্রায় এক। কিন্তু মলির চুলের গোড়ার দিকটা গাঢ় রঙেরও কলপ লাগাতো
–কিন্তু লাকি মলির শাল গায়ে দিয়েছিল কেন?
–শালটা ও পছন্দ করত। লাকি বলেছিল এরকম একটা শাল কিনবে। বোঝা যাচ্ছে সেটা কিনে নিয়েছিল।
-ওটা দেখেই তো আমরা ভুল করেছিলাম…
–কেউ একজন টিম কেণ্ডেলকে খবর দিলে ভালো হত। ইভিলিন বলে উঠলেন, ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।
বলতে বলতে তিনি দ্রুত পায়ে পাম গাছের সারির মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মিস মারপল। পরে মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, তারপর বলুন কর্ণেল হিলিংডন?
পাম গাছের আড়াল ছেড়ে বাইরে আত্মপ্রকাশ করলেন এডওয়ার্ড হিলিংডন।
–আপনি জানতেন আমি ওখানে ছিলাম?
–আপনার ছায়া পড়েছিল। বললেন মিস মারপল।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর এডওয়ার্ড হিলিংডন নিজের মনে বলে উঠলেন, নিজের খেলায় ও বড় বেশি দূর চলে গিয়েছিল।
–ও মারা যাওয়ায় আপনি বোধ হয় খুশি?
–অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? অস্বীকার করব না। ও মারা যাওয়ায় সত্যিই আমি খুশি।
–হ্যাঁ, মৃত্যু অনেক সময় সমস্যার সমাধান করে দেয়। শান্ত ধীর দৃষ্টিতে তাকালেন মিস মারপল।
এবারে ভীতি প্রদর্শনের ইঙ্গিত প্রকাশ পেল এডওয়ার্ড হিলিংডনের কণ্ঠস্বরে।আপনি যদি ভেবে থাকেন
বাধা দিয়ে শান্ত স্বরে বললেন মিস মারপল, যে কোন মুহূর্তে আপনার স্ত্রী মিঃ ডাইসনকে নিয়ে এসে পড়বেন। তাছাড়া ডাঃ গ্রাহামকে নিয়ে মিঃ কোলও আসতে পারেন।
মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলেন এডওয়ার্ড হিলিংডন। ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মিস মারপল আর একটি শব্দও উচ্চারণ না করে নিঃশব্দে সরে এসে বাংলোর দিকে হেঁটে চললেন।
.
২৪.
মিঃ র্যাফায়েল তার বিছানায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। এত আতঙ্ক হৈ চৈ কোন কিছুই তার। কানে পৌঁছায়নি। হঠাৎ দুই কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে উঠলেন তিনি।
–কি…কি হয়েছে।
–আমি। হাঁপতে হাঁপাতে বললেন মিস মারপল। বালিশে উঁচু হয়ে বসবার চেষ্টা করলেন। মিঃ র্যাফায়েল। স্থির চোখে তাকালেন মিস মারপুলের দিকে।
–এই মাঝরাতে আমাকে এভাবে…
–আমাদের যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমি একটা অকাট–ঘটনার গতিপ্রকৃতি বুঝতে ভুল করেছিলাম। অথচ অতি সহজ ব্যাপার।
-একটু পরিষ্কার করে বলুন। কি সহজ ব্যাপার?
–আপনি গভীর ঘুমে ছিলেন বলে কিছুই জানতে পারেন নি। এদিকে একটা দেহ পাওয়া গেছে খাড়ির ধারে। প্রথমে আমরা মলির বলেই ভেবেছিলাম। পরে দেখা গেল লাকি ডাইসনের মৃতদেহ। খাড়িতে জলে ডুবেমরেছে।
লাকি–ডুবে গেছে? নিজেই ডুবেছিল না কেউ…
–কেউ ডুবিয়ে দিয়েছে। বললেন মিস মারপল।
-বুঝতে পেরেছি। এজন্যেই বললেন এত সহজ ব্যাপার। গ্রেগ ডাইসন…তাই তো? সে গা ঢাকা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন?
মিস মারপল বললেন, মিঃ র্যাফায়েল, যা বুঝতে পারছি, আমাদের একটা খুন ঠেকাতে হবে।
-খুনটা হয়ে গেছে বললেন যে
–এটা ভুলবশতঃ হয়ে গেছে। যে কোন মুহূর্তেই আর একটা খুন হতে পারে। যে করেই হোক আমাদের ঠেকাতে হবে। এখনই আমাদের যেতে হবে। •
-বুঝতে পারছি না কি বলতে চাইছেন। কিন্তু আমি আর আপনি খুন ঠেকাবো কি করে? আপনি প্রায় একশোতে পৌঁছেছেন আর আমি আমার ভাঙাচোরা শরীর।
-আপনি বলেছিলেন, জ্যাকসনকে যা হুকুম করবেন তাই সে করবে, তাই না? –অবশ্যই করবে, তবে তার জন্য তাকে পুষিয়ে দেবার ব্যাপার আছে।
–তাকে এক্ষুনি ডেকে পাঠান। আর বলে দিন, আমি যা বলব, তাই যেন সে করে।
কয়েক সেকেণ্ড কি ভাবলেন মিঃ র্যাফায়েল। তারপর হাতের নাগালের কলিংবেল টিপলেন। সেই সঙ্গে জ্যাকসনের নাম ধরে গলা তুলে হাঁক ছাড়লেন।
মাঝখানের দরজা দিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল জ্যাকসন।
–আমাকে ডেকেছেন স্যার? কোন গোলমাল কিছু? মিঃ র্যাফায়েল বললেন, শোন জ্যাকসন, তুমি মিস মারপলের সঙ্গে যাবে। তিনি তোমাকে যেখানে নিয়ে যেতে চাইবেন কিংবা যা করবেন বিনা আপত্তিতে তাই পালন করবে। ওতে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। এজন্য বাড়তি পুরস্কারের ব্যবস্থা করব আমি। বুঝতে পেরেছ, এই আমার হুকুম।
-ধন্যবাদ স্যার-সব বুঝতে পেরেছি।
–তাহলে আসুন মিঃ জ্যাকসন, বললেন মিস মারপল, মিঃ র্যাফায়েল, মিসেস ওয়াল্টার্সকে বলে যাচ্ছি আপনাকে তুলে নিচে চলে আসতে।
-কোথায় যেতে হবে? জানতে চাইলেন মিঃ র্যাফায়েল।
–কেণ্ডালদের বাড়িতে। আমার ধারণা মলি সেখানেই ফিরে আসবে। বললেন মিস মারপল।
হোক আম্মাতে পারছি না জীছেছেন আক যা হুকুম কি ব্যাপার আছে যেন সে
সমুদ্র থেকে আসা পথ ধরে এগিয়ে এসে মলি হোটেলের চৌহদ্দির বাইরে নিজেদের বাংলোর কাছে এসে একমুহূর্ত দাঁড়াল। তারপর পাল্লা ঠেলে শোবার ঘরে ঢুকে পড়ল।
ঘরে আলো জ্বলছে। বিছানা খালি। মলি বিছানায় গিয়ে বসল। কয়েক মুহূর্ত পরেই কি মনে হতে বিছানার গদির তলা থেকে লুকিয়ে রাখা বইখানা টেনে বার করল।
ঠিক এই সময় বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। চমকে উঠে অপরাধীর ভঙ্গীতে বইখানা নিজের পেছনে লুকিয়ে ফেলল।
হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকল টিম।
-ওঃ তুমি এখানে। কোথায় ছিলে? আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছি।
–খাড়ির কাছে গিয়েছিলাম।
–তুমি সেখানে
কি বলতে গিয়ে চেপে গেল টিম।
-খাড়ির কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারলাম না। কে যেন জলের মধ্যে মরে পড়ে আছে।
-হ্যাঁ, তোমাকে ভেবে আমি ভয় পেয়েছিলাম। এইমাত্র জানতে পারলাম খাড়িতে লাকি মারা গেছে।
–আমি ওকে মারিনি, বিশ্বাস কর টিম, আমি ওকে মারিনি। মারলে ঠিক আমার মনে থাকত
টিম এগিয়ে মলির পাশে বিছানায় বসল। বলল, না, না, তুমি ওকে মারতে পার না মলি। এ ধরনের চিন্তা একদম মাথায় আনবে না। নিশ্চয় সে নিজেই ডুবে মরেছে। হিলিংডনের সঙ্গে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল। তাই ও জলে গিয়ে ডুবেছে
–কিন্তু…লাকি এমন করতে যাবে কেন…কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ওকে মারিনি…
–প্রিয় মলি, বলছিতো তুমি কিছু করোনি। বলতে বলতে টিম ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। মলি নিজেকে মুক্ত করে সরে গেল।
এ জায়গাটা আর আমার ভাল লাগছে না। এখানে কেবল ভয় আর আতঙ্ক…কেবল অন্ধকার…আমি তার মধ্যে জড়িয়ে আছি…কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছি না। তীক্ষ্ণ তীব্র স্বরে বলে উঠল মলি।
-চুপ মলি। দয়া করে চুপ করো।
বলে এক লাফে বাথরুমে গিয়ে টিম গ্লাসে কিছু নিয়ে এল। স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নাও, এটা খেয়ে নাও। এতে সুস্থ বোধ করবে।
মলি নিজেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল। বলল, আমি কিছু খেতে পারব না..আমার খুব কষ্ট হচ্ছে…
-হ্যাঁ পারবে, বিছানায়, বসে এটা খেয়ে নাও।
টিম দুহাত দিয়ে মলিকে জড়িয়ে ধরল। তারপর গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে এগিয়ে ধরল।
–এই নাও, খেয়ে ফেল।
ঠিক এমনি সময়ে জানালার কাছে মিস মারপলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
জ্যাকসন, ভেতরে গিয়ে ওর হাত থেকে গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখবে। ও কিন্তু মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। সতর্ক থাকবে।
জ্যাকসনের শরীর সুগঠিত। বিনা প্রশ্নে হুকুম পালন করার শিক্ষায় শিক্ষণপ্রাপ্ত সে। পলকের মধ্যে ঘরের ভেতরে একঝলক বিদ্যুতের মতই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।
এক ঝটকায় মলির ঠোঁটের কাছে ধরা টিমের হাতের গ্লাসটা এক হাতে অন্য হাতে সবলে জাপটে ধরল টিমকে।
গ্লাস ধরা হাতে একটা মোচড় দিতেই গ্লাসটা চলে এলো জ্যাকসনের হাতে।
টিম হিংস্র গর্জন তুলে উন্মত্তের মত নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জ্যাকসনের হাতের বেষ্টনী ছাড়াতে পারল না।
বুনো পশুর মত চিৎকার করতে লাগল টিম–এসব কি হচ্ছে-আমাকে ছাড়ো–শিগগির ছাড়ো
ওকে শক্ত করে ধরে রাখো জ্যাকসন। বললেন মিস মারপল।
-এখানে কি ঘটছে সব?
বলতে বলতে এসথার ওয়াল্টার্সের সাহায্যে ঘরে ঢুকলেন মিঃ র্যাফায়েল।
-আপনার লোক বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। ওকে বলুন আমাকে ছেড়ে দিতে। চিৎকার করে উঠল টিম।
-না। কিছুতেই না। দৃঢ় স্বরে বললেন মিস মারপল।
মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে মিঃ র্যাফায়েল বললেন, এই কাণ্ড…এবার তাহলে শোনা যাক বৃত্তান্ত
-এতদিন বোবা আর মূর্খ সেজে ছিলাম। এখন আমি আর তা নই। মিঃ র্যাফায়েল, ওই গ্লাসের পদার্থটুকু ও তার স্ত্রীকে জোর করে পান করাতে চাইছিল। এটা পরীক্ষা করলেই সব প্রমাণ হয়ে যাবে।
আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি এরমধ্যে রয়েছে মারাত্মক পরিমাণের মাদকদ্রব্য। মেজর প্যালগ্রেভের বলা কাহিনীর মধ্যে যে নকশা পাওয়া যেত এখানেও রয়েছে তাই। মানসিক অবসাদগ্রস্ত স্ত্রী, আত্মহত্যার হাত থেকে তার জীবন রক্ষা করেছে।
সেই স্ত্রী দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় সফল হয়। ঠিক এরকমই ছিল মেজরের গল্পের কাঠামো। তিনি এমনি গল্প শুনিয়ে আমাকে একটা ছবি দেখাতে গিয়ে মুখ তুলে তাকিয়েই…
-হ্যাঁ, আপনার ডান কাঁধের ওপর দিয়ে…বললেন মিঃ র্যাফায়েল।
-না, আমার ডান কাঁধের ওপর দিয়ে কিছুই দেখা সম্ভব ছিল না তার। কিছুই দেখেন নি তিনি।
তবে যে আপনি বলেছিলেন–
–আপনাকে ভুল বলেছিলাম। সেটাই ছিল আমার বোকামি। আমার ডান কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু তার বাঁ চোখটা ছিল কাচের–ওই চোখে কিছু দেখা সম্ভব ছিল না।
-হ্যাঁ, মনে পড়েছে আমার, বললেন মিঃ র্যাফায়েল, ব্যাপারটা আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। তার মানে তিনি কিছুই দেখেননি।
–দেখতে পেয়ে ছিলেন অবশ্যই–তবে এক চোখে। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন তার ডান চোখ দিয়ে। আর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। সেই চোখে আমার ডান কাঁধের ওপর দিয়ে নয়। আমার বাঁ দিক থেকে।
-কেউ ছিল সেই দিকে?
–হ্যাঁ, টিম কেণ্ডাল আর তার স্ত্রী কাছাকাছি বসে ছিল। পাশেই ছিল মস্ত একটা হিবিসকাস গাছ। সম্ভবত তারা হোটেলের হিসাবপত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
মেজর প্যালগ্রেভের কাচের বাঁ চোখ জ্বলজ্বল করছিল। অন্য চোখ দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলেন হিবিসকাস গাছের কাছে যে লোকটি উপবিষ্ট, তার মুখ অবিকল ছবির মুখ। সেই ছবিটাও ছিল হিবিসকাস ঝোপের পাশে।
মেজর সকলকে যে কাহিনী শোনাতে শুরু করেছিল, তা টিম কেণ্ডালও জানতে পেরেছিল। তাতেই সে বুঝে যায় মেজর তাকে চিনতে পেরেছেন। তাই তাকে খুন হতে হল। পরে ভিক্টোরিয়া মেয়েটিকেও মরতে হয়। সে টিমকে মেজরের ঘরে একটা ট্যাবলেট ভর্তি শিশি রাখতে দেখে ফেলেছিল।
বাংলোতে অতিথিদের ঘরে ঢোকার ব্যাপারটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। নানা কারণেই টিমকে যেতে হত। তাই প্রথমে এ নিয়ে ভিক্টোরিয়ার মনে কোন সন্দেহ উপস্থিত হয়নি।
কিন্তু যে কোন কারণেই হোক সে এনিয়ে টিমকে নানা রকম প্রশ্ন করতে শুরু করে। বাধ্য হয়েই তখন তাকে শেষ করে দিতে হয়।
টিম আগাগোড়া এই খুনটার জন্যই ছক করে সব কাজ করে চলেছিল। ও একজন স্ত্রী হত্যাকারী–দাগী–
–সমস্ত মিথ্যা কথা–জঘন্য অপবাদ–উন্মত্তের মত চিৎকার করে উঠল টিম। এসথার ওয়াল্টার্স মিঃ র্যাফায়েলের হুইল চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আচমকা অস্ফুট আর্তনাদ করে সে ছুটে গেল টিমের দিকে। জ্যাকসনের হাত থেকে তাকে টেনে ছিনিয়ে আনার বৃথা চেষ্টা করল।
–ওকে ছেড়ে দাও–ছেড়ে দাও–এসব কোন কথাই সত্যি নয়। আমি জানি প্রিয় টিম-এসব সত্যি নয়। তুমি কাউকে খুন করতে পার না। কখনোই না-ওই শয়তানী–ওই যাকে তুমি বিয়ে করেছ, সেই এসব করেছে। ও তোমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছিল। না-না তুমি কাউকে খুন করতে পার না–আমি বিশ্বাস করি না টিম তোমাকে ভালবাসি। আমি…
এরপর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা আর সম্ভব হল না টিম কেণ্ডালের পক্ষে। সে ক্রুদ্ধ আক্রোশে চিৎকার করে উঠল–চুপচুপ কর শয়তানী–একদম, চুপ। ওই নোংরা মুখ বন্ধ কর–আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চাস
–তাহলে এইসব ব্যাপার চলছিল? নরম সুরে বলে উঠলেন মিঃ র্যাফায়েল।
.
২৫.
মিঃ র্যাফায়েল আর মিস মারপল নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেছেন।
-তাহলে আমাদের এসথার টিম কেণ্ডালের প্রেমে মজে ছিল। বললেন মিঃ র্যাফ্যায়েল।
–ভবিষ্যতে বিয়ের সম্ভাবনা নিয়ে ওর মধ্যে বেশ রোমান্টিকতা ছিল।
–টিম কেণ্ডালের স্ত্রী মারা গেলে বলছেন?
–আমার ধারণার কথা বলছি শুনুন। মলি মারা যাবে এমন কোন ধারণা এসথার ওয়াল্টার্সের ছিল বলে মনে হয় না। মলির সঙ্গে অন্য একজনের প্রেমঘটিত ব্যাপার রয়েছে এমন একটা ধারণা টিম এসথারকে দিয়েছিল নিশ্চয়, আর সে তা বিশ্বাসও করেছিল। সেই লোক যে মলিকে অনুসরণ করে এখানে উপস্থিত হয়েছে সম্ভবতঃ এমন কথাও টিম বলেছিল। ফলে এসথারের বিশ্বাস হয়েছিল, ওদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ অনিবার্য। এটা ওর কাছে সম্মানজনক হবে বলেই তার মনে হয়েছিল।
বুঝতে পারছি সবই। কিন্তু দুর্বোধ্য ঠেকছে টিম এসথারের প্রতি আকৃষ্ট হল কেন?
–একথা তো আপনার অজানা থাকার কথা নয়।
–ধারণা একেবারেই করতে পারছি না তা নয়। তবু আপনার ব্যাখ্যা শুনতে চাই। আপনার বুদ্ধি অসাধারণ।
আমি ব্যাখা করলে তা করব কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিয়ে। যাই হোক, নিশ্চয়ই আপনার মনে পড়বে, একবার আমি আপনাকে বলেছিলাম, জ্যাকসন আপনার কাগজপত্র সুযোগ পেলেই ঘাঁটাঘাঁটি করে।
-হ্যাঁ। তবে আমি এ বিষয়ে সতর্ক ছিলাম। ওর কিছু পাবারই সম্ভাবনা ছিল না।
–আমার ধারণা আপনার উইলের ব্যাপারটা ও জানতে পেরেছিল।
–হ্যাঁ তা সম্ভব। সুটকেসে উইলের একটা নকল রাখা ছিল।
–আপনি একবার, ওদের কানে যায় এভাবেই আমাকে বলেছিলেন, এসথার ওয়াল্টার্সের জন্য আপনার উইলে কোন ব্যবস্থা রাখেননি। এ বিষয়টা এসথার আর জ্যাকসনকে ও জানিয়ে রেখেছিলেন। এটা ঠিকই যে জ্যাকসনকে আপনি কিছুই দিয়ে যাননি। তবে এসথারকে উইলে টাকা দিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র আভাস আপনি কাউকে দেননি। তাই কি?
–ঠিক তাই। কিন্তু আপনি এসব জানলেন কি ভাবে?
–খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয়নি, হাসলেন মিস মারপল; আপনি যেভাবে জোর দিয়ে বারবার কথাটা জানাতে চেয়েছিলেন, তাতেই আসল ব্যাপারটা আমার জানা হয়ে যায়। কেউ মিথ্যা বললে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই আমি তা বুঝতে পারি।
-সত্যিই আপনি অসাধারণ মহিলা। আমি আমার উইলে এসথারের জন্য পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ডের ব্যবস্থা রেখেছি। আমি মারা যাবার পরে জানতে পেরে নিশ্চয় ও অবাক হয়ে যেত।
এবারে বুঝতে পারছি। টিম কেণ্ডাল উইলের কথা জানতে পেরেই লোভে পড়ে যায়। স্ত্রীকে বেশি মাত্রায় মাদক খাইয়ে বা অন্য উপায়ে শেষ করে পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড সেই সঙ্গে এসথারকে বিয়ে করার পরিকল্পনা ছকে নিয়েছিল।
কোন একসময়ে, টাকাটা হাতে এসে গেলে সম্ভবত তাকেও একইভাবে সরিয়ে দিত। কিন্তু ঠিক কিভাবে জানতে পারল এসথার পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড পেতে চলেছে?
মিস মারপল বললেন, জ্যাকসনই টিমকে সেকথা জানায়। ওদের দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কোন দিন গল্পচ্ছলেই সম্ভবতঃ জ্যাকসন কোন কিছু খেয়াল না করেই প্রকাশ করে ফেলেছিল, এসথার বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পেতে চলেছে।
আমার অনুমান, নিজে সে এসথারকে বিয়ে করার চেষ্টা করে চলেছে। এমন ইঙ্গিতও করে থাকতে পারে। যদিও সে তখনো পর্যন্ত এসথারের কাছ থেকে তেমন সাড়া পায়নি।
–আপনার ব্যাখ্যায় কল্পনার প্রশ্রয় থাকলেও সবই সম্পূর্ণ যুক্তিপূর্ণ।
–সব ব্যাপারই সুন্দর ভাবে মিলে যাচ্ছে, এটা সত্যি। তবে আমি এতই মূর্খ ছিলাম যে ধূর্ত টিম কেণ্ডালের একটা মোক্ষম চাল একদম ধরতে পারিনি।
গুজব রটাবার শিল্পটা বেশ ভালরকমে রপ্ত ছিল টিমের। যা যা আমার কানে এসেছে তার অধিকাংশই মনে হয় তার রটনা করা।
এমন একটা রটনা হয়েছিল যে মলি এক অনুপযুক্ত লোককে বিয়ে করতে জেদ ধরেছিল। তার পরিবারের লোকদের আপত্তির জন্য সেই বিয়ে সম্ভব হয়নি।
আমার ধারণা সেই অনুপযুক্ত লোকটি টিম স্বয়ং। যদিও আমার ধারণা তখন সে অন্য কোন নাম ব্যবহার করেছিল।
মলির বাড়ির লোকেদের জোরালো আপত্তির কথা শুনে টিম কোল হয়তো তার কোন গোপন অপরাধ সম্পর্কে শঙ্কিত হয়েছিল। তাই সে মলির বাড়ির লোকদের সঙ্গে পরিচিত হতে চায়নি পর্যন্ত।
তবে মলির সঙ্গে ঠিক করে সে একটা গোপন মতলব নিপুণভাবে কাজে লাগায় এবং উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে। ওদের দুজনের কাছেই ব্যাপারটা খুব মজার হয়ে উঠেছিল।
মলি বাড়ির লোকেদের কাছে এমন ভাব দেখতে চেয়েছিল যে সে লোকটির জন্য পাগল। ঠিক সেই সময়েই জনৈক টিম কেণ্ডালের আবির্ভাব ঘটে। এই ক্ষেত্রে সে মলির আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের অনেকের নাম করে তাদের বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হয়। তারাও তাকে আদর অভ্যর্থনার ত্রুটি করে না। আগের অযোগ্য লোকটির বদলে একজন যোগ্য নোক পাওয়া গেছে। বলে তারা নিশ্চয় আনন্দিত হয়েছিল।
মলি আর টিম এই ব্যাপারটি নিয়ে আড়ালে যে খুবই মজা করেছিল, তা সহজেই অনুমান করা চলে।
বিয়েটা দুজনের সুসম্পূর্ণ হয়েছিল। আর মলির টাকা দিয়েই টিম এই হোটেলটা আগের মালিকের কাছ থেকে কিনে নেয়। তারপর দুজনেই এখানে চলে আসে।
টিম কেণ্ডাল যথেষ্ট যোগ্য ও করিকর্মা পুরুষ। মলির টাকা সে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলে।
আর এমনি এক সময়েই তার পরিচয় ঘটে এসথার ওয়াল্টার্সের সঙ্গে। সে নতুন করে আবার প্রচুর টাকার সম্ভাবনার ইসারা পেয়ে যায়।
টিম কেণ্ডাল বুঝতে পেরেছিল, খুব বেশিদিন তাকে অপেক্ষা করতে হবে না। সময়টাকে সে দ্রুত প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগালো। সে নানারকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিল।
মলি মানসিক রোগগ্রস্ত একথাটা বিশ্বাস করাবার জন্য সে তার জাল কিভাবে বিস্তার করেছিল দেখুন। মানসিক বিপর্যয় সম্পর্কিত একটা বই সে হাতের কাছেই রেখে গিয়েছিল। তারপর মলি কিছু বুঝতে না পারে সেভাবে তাকে মাদক আর ওষুধ প্রয়োগ করে চলেছিল যাতে সে অলীক কিছু স্বপ্ন দেখে এবং উদ্ভট চিন্তা তার মাথায় আসে।
এখানে এই ব্যাপারে আপনার জ্যাকসন বেশ বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ রেখেছে। মলির কোন কোন উপসর্গ দেখে নিশ্চয় তার মনে খটকা লেগেছিল। সেসব মাদকের প্রতিক্রিয়া বলেই তার সন্দেহ হতে থাকে। এই সন্দেহ ভঞ্জনের জন্যই সেদিন সে মলির বাংলোয় ঢুকেছিল বাথরুমে রাখা প্রসাধনী পরীক্ষা করবে বলে। মলির মুখে মাখার ক্রিম পরীক্ষা করে দেখেও ছিল।
প্রাচীনকালে ডাইনীরা মলমে বেলেডোনা মিশিয়ে দিলে একই ধরনের উপসর্গ দেখা যেত–এই বিষয়টা কোনভাবে জ্যাকসনের মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে কিছু ভুলে যাওয়া, নানা রকম আতঙ্ককর স্বপ্ন–এসব থেকে মলি নিজেও বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
এইভাবে ক্রমে তার মধ্যে মানসিক রোগের সবরকম লক্ষণই দেখা দিতে শুরু করলে জ্যাকসনের সন্দেহও ঘণীভূত হয়। আমার মনে হয় মেজর প্যালগ্রেভের গল্প থেকেও জ্যাকসন এমন একটা ধারণা পেয়ে থাকতে পারে।
–মেজর সত্যিই এক অদ্ভুত লোক ছিলেন বটে। বললেন মিঃ র্যাফায়েল।
নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে এনে ছিলেন। বললেন, মিস মারপল, সেই সঙ্গে প্রাণ হারাল বেচারি ভিক্টোরিয়া। মলিও তো প্রায় শেষ হবার মুখেই চলে গিয়েছিল।
এসব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলেও তিনি একজন খুনীকে সনাক্ত করতে আমাদের সাহায্য করে গেছেন।
–মেজর প্যালগ্রেভের কাচের চোখের কথা হঠাৎ আপার মনে পড়ে গেল কি করে?
–আমার অবাক লাগছে অমন ধূর্ত টিম কেণ্ডাল ভুল করে লাকিকে খুন করল কি ভাবে? আপনি
–নিছক ভাগ্য বলতে হবে ব্যাপারটাকে। আমার মনে হয় সে নিশ্চিত হয়েছিল যে সকলকে নিঃসন্দেহ করতে পেরেছে মলি মানসিক রোগগ্রস্ত।
একটা কাজ সমাধা হওয়ার পর পরবর্তী কাজের দিকে হাত বাড়ায় সে। মলিকে যে মাদকজাতীয় ওষুধ খাইয়ে চলেছিল, তাই খাওয়ানোর পর ওকে বলে ওরা দুজনে মিলে খুনের ব্যাপারে রহস্য ভেদ করবে।
টিম মলির সাহায্যে চায় এবং বলে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে খাড়ির কাছে একটা বিশেষ জায়গায় ওরা দুজনে মিলিত হবে।
টিম নিশ্চয় এমন আভাস দিয়েছিল যে সে জানে খুনী কে। চেষ্টা করলে তারা তাকে ফাঁদে ফেলতে পারবে।
ওষুধ খাওয়ানোর ফলে মলি তার স্বাভাবিক বিবেচনা শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। তাই স্বামীর কথায় বাধ্য মেয়ের মত সে খাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল।
কিন্তু ওষুধটা এক্ষেত্রে শাপে বর হল। মলির ঠিক যেই সময়ে খাড়ির কাছে পৌঁছনোর কথা, গতি শ্লথ হয়ে পড়ার দরুন, সেই সময় পৌঁছতে পারে না। অনেক পিছিয়ে পড়েছিল ও।
যথাসময়ে টিম নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হয়। সেখানে যাকে সে দেখতে পায় তাকে মলি বলেই ভেবে নেয়। তার মাথায় সোনালী চুল, গায়ে জড়ানো ছিল হালকা সবুজ শাল।
টিম আর বিলম্ব করে না। মেয়েটির পেছনে এসে আচমকা মুখে হাত চেপে ধরে আর সজোরে জলে টেনে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে চেপে ধরে রাখে।
–আমারও মনে হচ্ছে, ঠিক এরকমটাই করেছিল সে। কিন্তু স্ত্রীকে শেষ করে দেবার আরও সহজ পথ তো হাতেই ছিল। বেশিমাত্রায় মাদক খাইয়ে দিলেই তো কাজটা হাসিল হত।
মিস মারপল বললেন, হ্যাঁ, এই কাজটা অনেক সহজ ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এতে সন্দেহ জাগার সম্ভাবনা ছিল।
সকলেই জেনে গিয়েছিল, ডাক্তারের নির্দেশে মলির হাতের কাছ থেকে সমস্ত রকম ওষুধ ও মাদক জাতীয় জিনিস সরিয়ে রাখা হয়েছিল।
এসত্ত্বেও যদি সে অতিরিক্ত মাত্রার কিছু ওষুধ পেয়ে যেত তাহলে স্বভাবতই সন্দেহের দৃষ্টিটা পড়ত তার স্বামীর ওপরেই। কেন না, টিম ছাড়া এটা করা আর কারও পক্ষেই সম্ভব হতে পারত না।
কিন্তু হতাশাগ্রস্ত মনের চাপে মলি যদি স্বামী যখন ঘুমন্ত অবস্থায়, সেই সময়ে জলে ডুবে আত্মহত্যা করে তাহলে কারোর মনেই এসম্পর্কে কোনপ্রকার সন্দেহ জাগবে না। সকলেই একটা বিয়োগান্তক ঘটনা বলে মেনে নেবে। তাকে জোর করে জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছে, এমন কথা কেউ বলবে না।
একটু চুপ করে কি ভাবলেন মিস মারপল। পরে বললেন, খুনীদের স্বভাবই অবশ্য এরকম। অপরাধকে একটু অসাধারণ আর জটিল করে তুলবার পক্ষপাতি।
–তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, টিম আদৌ বুঝতেই পারেনি অন্য মেয়েকে ভুল করে মেরে ফেলেছে?
–সে সুযোগই সে পায়নি, বললেন মিস মারপল, এমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সে কাজটা করে যে মৃতের মুখটাও ভাল করে দেখার সুযোগ পায়নি।
তাছাড়া কাজ শেষ করেই সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এক ঘণ্টা পরে কয়েকজন সঙ্গী জুটিয়ে মলির অনুসন্ধানে বেরয়। এইভাবে অতি নিপুণ ভাবে সে নিজেকে একজন বিহ্বল স্বামী বলে প্রতিপন্ন করে।
একটা বিষয়ে কিন্তু খটকা লাগছে। বুঝতে পারছি না লাকি অতরাত্রে একা খাড়ির কাছে কি উদ্দেশ্যে ঘোরাঘুরি করছিল?
আমার বিশ্বাস, লজ্জিত ভঙ্গীতে হেসে বললেন মিস মারপল, কারও জন্য অপেক্ষা করছিল।
–কে, এডওয়ার্ড হিলিংডন?
-না, সেদিকের আকর্ষণ কেটে গিয়েছিল। বরং এটা হওয়া সম্ভব, লাকি জ্যাকসনের জন্য অপেক্ষা করেছিল।
–জ্যাকসনের জন্য, বলেন কি?
মিস মারপল দৃষ্টি অবনত রেখে বললেন, লাকির ওপরে দৃষ্টি ছিল আমার। জ্যাকসনের প্রতি তার অনুরাগসিক্ত দৃষ্টিক্ষেপ আমার চোখ এড়ায়নি।
মিঃ র্যাফায়েলের দুচোখ নেচে উঠল। তিনি শিস দিয়ে উঠলেন।
পরে বললেন, জ্যাকসন একটা আস্ত হুলো। ওর অসম্ভব কাজ কিছু নেই। তা ভুল মানুষকে খুন করেছে বলে টিম নিশ্চয়ই প্রচণ্ডভাবে মুষড়ে পড়েছিল?
–ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুষড়ে পড়েছিল। মলি যখন সকলকে জানাত, সেই খাড়ির কাছে ওদের মিলিত হবার কথা ছিল, তখন টিম ফাঁদে পড়ে যেত। তাছাড়া ইভিলিন যেভাবে চাপাচাপি শুরু করেছিল, যদি মলিকে কোন দক্ষ মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে হাজির করা হয়, তাহলে এতদিন তার মানসিক অবস্থা নিয়ে যে গুজব সে ছড়িয়েছে, সবই ফাঁস হয়ে যেত।
কাজেই মলিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করে ফেলাই তার বাঁচার একমাত্র উপায়।
এর ফলে পুরো ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নিয়ে নিত। প্রত্যেকেই বিশ্বাস করত, মলিই লাকিকে জলে ডুবিয়ে খুন করেছে আর পরে ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।
-যথার্থ! ঠিক সময়ে আপনি যদি নিয়তির মত সেখানে উপস্থিত না হতেন তাহলে আর একটা খুনের ঘটনা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হত। আর প্রকৃত অপরাধী নিশ্চিন্তে গা-ঢাকা দেবার সুযোগ পেয়ে যেত।
বলতে বলতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন মিঃ র্যাফায়েল।
পরে বললেন, নিয়তি। আপনি ওরকম মাঝরাতে মাথায় গোলাপী পশম জড়িয়ে যখন আমাকে ডেকে তুললেন, তখন যদি নিজেকে দেখতে পেতেন, তাহলে আপনিও নিশ্চিত আমারই মত নিজেকে নিয়তি বলেই সনাক্ত করতেন।
.
এয়ারপোর্টে মিস মারপলকে বিদায় জানাবার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন অনেকেই।
মলি এসেছিল। সে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে আঘাতটা সামলে নিয়েছিল। মিঃ র্যাফায়েল তার জন্য তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার একজন প্রতিনিধির সহায়তার মলি তার হোটেলের কাজ চালাচ্ছিল।
মিঃ র্যাফায়েল রাতারাতি ইংলণ্ডে তারবার্তা পাঠিয়ে তার প্রতিনিধিকে আনিয়ে নিয়েছিলেন।
মিঃ র্যাফায়েল, ক্যানন আর প্রেসকট এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে অবশ্য এসথার ওয়াল্টার্স ও জ্যাকসনও ছিল।
প্লেনে ওঠার আগে পর্যন্ত সকলেই বারবার হাত নেড়ে, রুমাল নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মিস মারপলকে। অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।