1 of 2

১৯৪৮। বয়স ৪৯ বছর

১৯৪৮। বয়স ৪৯ বছর 

১৯৪৮-এ জীবনানন্দ দাশ পাকাপাকিভাবে বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। ১৯৪৮-এর ৮ এপ্রিল থেকে ৯ মে, মাসখানেক সময়ের মধ্যে লিখলেন ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসটি (১০টি খাতায় লেখা)। ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসটি প্রথমে ‘শিলাদিত্য’ পত্রিকায় ১৯৮১ সালের জুলাই সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে পরপর সতেরো কিস্তিতে প্রকাশিত হয়। [দ্রষ্টব্য : ‘জলপাইহাটি’, সম্পাদক : দেবেশ রায়, প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন প্রা. লি. ১৯৮৫]। আরো একটি উপন্যাস ‘সুতীর্থ’ মে মাসে শুরু করে জুন মাসে শেষ করলেন। [সূত্র : ‘সুতীর্থ’, জীবনানন্দ দাশ, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৌষ ১৩৮৪]। এই জুন মাসেই লিখলেন ‘মাল্যবান’ নামে আরেকটি উপন্যাস। জুন মাসের ষোলো তারিখে শুরু করে বাইশ তারিখের মধ্যে তিনটি বাহাদুর এক্সারসাইজ খাতায় উপন্যাসটি লিখেছিলেন জীবনানন্দ। [সূত্র ‘মাল্যবান’, জীবনানন্দ দাশ, নিউ স্ক্রিপ্ট, কলকাতা, ১৯৭৩]। মে-জুন মাসের প্রচণ্ড দাবদাহের দুপুরগুলোতে লেখা এই সব উপন্যাসের বর্ণনায় শীতঋতুর প্রাধান্য। এই বছরেই জীবনানন্দ আরো একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, নাম—’বাসমতীর উপাখ্যান’ (১০টি এক্সারসাইজ খাতায় লেখা)। এই উপন্যাসটিই জীবনানন্দের বৃহত্তম গদ্য রচনা। [সূত্র : জীবনানন্দ সমগ্র (৫ম খণ্ড), সম্পাদক : দেবেশ রায়, প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন প্রা. লি. কলকাতা, ১৩৯৫] 

উপন্যাস বিষয়ে জীবনানন্দ তিনটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ইংরেজিতে; নাম – ‘ Bengali Novel Today’, ‘The Novel in Bengali’ ও ‘The Future of the Novels. 

‘Bengali Novel Today’ প্রবন্ধে তারাশঙ্কর-বিভূতি-মানিক এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনা করেছিলেন; বঙ্কিমচন্দ্র থেকে সমকালীন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসের একটি রেখাচিত্র তৈরি করেছেন ‘The Novel in Bengali’ প্রবন্ধে আর ‘The Future of the Novel’ প্রবন্ধটি বিশ্ব-উপন্যাসের পটভূমিকায় রচিত। 

২৫ ডিসেম্বর জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী (১৮৭৫–১৯৪৮) পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। মারা যান কলকাতায়, অশোকানন্দের ১৭২/৩, রাসবিহারী এভিনিউ-এর বাসস্থানে। মায়ের মৃত্যুর পর জীবনানন্দ লেখেন— 

‘মা বেশি লেখবার সুযোগ পেলেন না। খুব বড় সংসারের ভেতর এসে পড়েছিলেন, যেখানে শিক্ষা ও শিক্ষিতদের আবহ ছিল বটে, কিন্তু দিনরাতের অবিশ্রান্ত কাজের ফাঁকে সময় করে লেখা—তখনকার দিনের সেই অসচ্ছল সংসারের একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠল না আর। কবিতাগুলোর চেয়ে কাজ ও সেবার সর্বাত্মকতার ভেতরে ডুবে গিয়ে তিনি ভালোই করেছেন হয়তো। তাঁর কাজকর্মের আশ্চর্য নিষ্ঠা দেখে সেই কথা মনে হলেও ভেতরের খবর বুঝতে পারিনি, কিন্তু তিনি আরো লিখলে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কিছু দিয়ে যেতে পারতেন মনে হয়।’ [‘আমার মা-বাবা’, জীবনানন্দ দাশ, পৃ-১১]। 

সাংসারিক অসচ্ছলতার মধ্যে মায়ের মৃত্যুতে অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন জীবনানন্দ। এই বছরে লাবণ্য দাশ, দেশপ্রিয় পার্ক রোডে কমলা গার্লস স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেছিলেন। চাকরির মেয়াদ ছিল ১৯৪৮-১৯৪৯। কবি বিষ্ণু দে’র স্ত্রী প্রণতি দে (জন্ম. ১৯১১) তখন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। 

ডিসেম্বরের শেষের দিকে জীবনানন্দের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’ প্রকাশিত হল (অগ্রহায়ণ ১৩৫৫)। প্রকাশক : আতাওর রহমান (১৯১৯–১৯৭৭), গুপ্ত রহমান অ্যান্ড গুপ্ত, পি- ১৩, গণেশচন্দ্র এভিনিউ, কলকাতা। মুদ্রাকর : প্রভাতচন্দ্র রায়, শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস, ৫ চিন্তামণি দাস লেন, কলকাতা। বোর্ড বাঁধাই। প্রচ্ছদশিল্পী : সত্যজিৎ রায় (১৯২১ – ১৯৯২)। উৎসর্গ : হুমায়ুন কবির/বন্ধুবরেষু। মূল্য : আড়াই টাকা। ডিমাই ৬ + ৮০। কবিতার সংখ্যা : ৪০। 

কবিতাগুরোর শিরোনাম 

১. আকাশলীনা, ২. ঘোড়া, ৩. সমারূঢ়, ৪. নিরঙ্কুশ, ৫. রিস্টওয়াচ, ৬. গোধূলি সন্ধির নৃত্য, ৭. যেই সব শেয়ালেরা, ৮. সপ্তক, ৯. একটি কবিতা, ১০. অভিভাবিকা, ১১. কবিতা, ১২. মনোসরণি, ১৩. নাবিক, ১৪. রাত্রি, ১৫. লঘুমুহূর্ত, ১৬. হাঁস, ১৭. উন্মেষ, ১৮. চক্ষুস্থির, ১৯. খেতে প্রান্তরে, ২০. বিভিন্ন কোরাস, ২১. স্বভাব, ২২. প্রতীতি, ২৩. ভাষিত, ২৪. সৃষ্টির তীরে, ২৫. জুহু, ২৬. সোনালি সিংহের গল্প, ২৭. অনুসূর্যের গান, ২৮. তিমির হননের গান, ২৯. বিস্ময়, ৩০. সৌরকরোজ্জ্বল, ৩১. সূর্যতামসী, ৩২. রাত্রির কোরাস, ৩৩. নাবিকী, ৩৪. সময়ের কাছে, ৩৫. লোকসামান্য, ৩৬. জনান্তিকে, ৩৭. মকরসংক্রান্তির রাতে, ৩৮. উত্তর প্রবেশ, ৩৯. দীপ্তি, ৪০. সূর্যপ্রতিম। 

কবিতাগুলো রচনাকাল : ১৯২৮ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত। 

কাব্যটি প্রকাশিত হয়েছিল ভূমিকা ছাড়াই। এই গ্রন্থের জন্যে প্রকাশকের কাছ থেকে জীবনানন্দ একশত টাকা সম্মানী হিসেবে পেয়েছিলেন। বই লিখে সম্ভবত এ-ই তাঁর প্রথম অর্থপ্রাপ্তি। 

‘সাতটি তারার তিমির’ প্রকাশিত হবার পর অশোক মিত্র (জন্ম. ১৯২৮) ‘কবিতা’ পত্রিকায় (পৌষ ১৩৫৬) একটি প্রবন্ধ লিখেন। তিনি ‘বনলতা সেন’-পরবর্তী কাব্যধারার বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুরই অভিমতকে গ্রহণ করেন এবং ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের চরিত্রলক্ষণাদি সম্বন্ধে নিজের কয়েকটি উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসাকে ব্যক্ত করেন। অশোক মিত্র এই প্রবন্ধে ‘সাতটি তারার তিমির’ সম্বন্ধে লেখেন— 

‘আরও একজন কবি যিনি স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন তিনি জীবনানন্দবাবু। স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের সাহিত্যিক হাতেখড়ির দিনে তাঁর কবিতার বিস্ময়কর চিত্রময়তা কিংবদন্তীর মতো হয়ে উঠেছিল। গ্রাম্যবাংলা, বিশেষ করে বরিশাল- নোয়াখালীর নদীমাতৃক জীবন, তার পশুপাখি, আকাশপ্রান্তর এবং শস্যশষ্পময় প্রকৃতির স্বাক্ষরে বারবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়। আবার এরই সঙ্গে জড়িত ছিল তাঁর অতি ভৌগোলিক অতি ঐতিহাসিক কল্পনা—যা প্ৰথম প্ৰথম সার্থক কবিতায় রূপায়িত হলেও অচিরেই প্রতীকী অরাজকতায় বিশৃঙ্খল করে দিল তাঁর কাব্য-সাধনাকে। ইদানীং আবার মনে হচ্ছে ফিরে আসছেন তিনি চিত্রকল্পের স্বাস্থ্যে এবং উপস্থিত জীবনকে গ্রহণ করেই তাঁর এই পুনরুত্থান ঘটেছে।’ [সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা’, মনীন্দ্র রায়, সাহিত্যপত্র, কার্তিক ১৩৫৫, পৃ. ১৪৭-১৪৮]। 

বুদ্ধদেব বসু লেখেন— 

‘He (Jibanananda Das) is important because he has brought a new note to our poetry, a new tone of feeling and has turned our ears to a subtle melody drawn from apparently conventional patterns of verse, for despite the metrical seductions of Modern Bengali, he has confined himself throughout to a single metrical norm, and that the oldest . ‘ [Modern Bengali Poetry : An Acre of Green Grass]. 

দেশ বিভাগের পর হাবিবুল্লাহ বাহারের প্রচেষ্টায় পূর্ব পাকিস্তান সরকার এ বছর থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে মাসিক দেড়শ’ টাকা বিশেষভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। 

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষার দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলেন জিন্নাহ। পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঘোষণা করলেন—’আমরা বাঙালি।’ 

হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেন কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল হন। 

গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে নাথুরাম বিনায়ক গডসে নামক জনৈক মারাঠী যুবক, সূর্যাস্তের ঠিক আগে, দিল্লির বিড়লা হাউসে। বিনায়ক সাভারকরের অনুপ্রেরণায় গঠিত পুনার এক ব্রাহ্মণগোষ্ঠী এই হত্যার পরিকল্পনা করে। মুসলমানদের প্রতি হিন্দু-অত্যাচারের অভিযোগ তুলে গান্ধীর আমরণ অনশন ইত্যাদি অনেকে ভালো চোখে দেখেনি। 

২৬ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়। 

নিজাম ভারতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে ভারতীয় সৈন্য হায়দরাবাদ আক্রমণ করে। নিজাম আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। 

বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। তেলআবিবে রাজধানী স্থাপন করে ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে। মিশর, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও সৌদি আরব একযোগে ইসরায়েল আক্রমণ করে। 

এ বছর মৃত্যুবরণ করেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী, মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, সঙ্গীতজ্ঞ গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী।

আর জন্মালেন দীপক রায়, শম্ভু রক্ষিত, সেলিম আল দীন, হুমায়ূন আহমেদ। 

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন টি. এস. এলিয়ট (১৮৮৮– ১৯৬৫)। কবি, নাট্যকার ও সমালোচক। ইংল্যান্ডের অধিবাসী। 

পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে কমিটি লেখেন- 

‘For his outstanding pioneer contribution to present-day poetry.’ 

তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখনীয় হল—’The Waste Land’, ‘Poems 1920’, ‘The Hollow Men’, ‘Ash Wednesday’, ‘Four Quarters’, The Elder Statesmen’, ‘Murder in the Cathedral’. 

প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : বের হয় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘প্রাচীন প্রাচী’, সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ঘুম নেই’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ফেরারী ফৌজ’, মনীন্দ্র রায়ের ‘সেতুবন্ধের গান’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘অগ্নিকোণ’, জসীম উদ্দীনের ‘এক পয়সার বাঁশি’, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র জীবনী- ২য় খণ্ড’, যতীন্দ্রনাথের ‘ত্রিযামা’। জানুয়ারি মাসে জে.জি. প্রোডাকশনের সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ছায়াচিত্রের জন্যে চুক্তি সই হয়। মে মাসের বোম্বাইয়ের কুতুব পাবলিশার্স প্রকাশ করে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কৃত প্রথম ইংরেজি অনুবাদ ‘Boatman of the Padma’. এছাড়া প্রকাশিত হয় দুটো গল্পগ্রন্থ ‘ছোটোবড়ো’ এবং ‘মাটির মাশুল’। 

দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের সম্পাদনায় ১৯৪৮-এর গোড়ায় কলকাতায় একটি মাসিক পত্রিকা বেরোল। এই পত্রিকার বিজ্ঞাপন ছিল এরকম— 

‘বড়োদের পড়বার, ছোটদের দুধ গরম করবার একমাত্র মাসিক। ‘ 

‘সাহিত্য পত্র’ নামের ত্রৈমাসিক পত্রিকার প্রকাশ। সম্পাদক : চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *