1 of 2

১৯৩৫। বয়স ৩৬ বছর

১৯৩৫। বয়স ৩৬ বছর 

বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের (বি.এম কলেজ) ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন জীবনানন্দ। এই সময় ব্রজমোহন কলেজে জীবনানন্দের সহকর্মী ছিলেন রসায়নবিদ্যার অধ্যাপক রমেশ সেন। সজনীকান্ত দাসের বিশেষ বন্ধু ছিলেন তিনি, প্রবল রবীন্দ্রানুরাগীও। জীবনানন্দের কাব্যভাষাকে পরিহাস করে কিছু বিদ্রূপমূলক কবিতা লিখেছিলেন এই রমেশ সেন। জীবনানন্দের বিপক্ষে রমেশ সেন ‘শনিবারের চিঠি’র জন্যে তথ্য সরবরাহ করতেন। 

আশ্বিন ১৩৪২ বঙ্গাব্দে ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রকাশ। সম্পাদক : বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) ও প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪–১৯৮৮), সহকারী সম্পাদক : সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭)। এই পত্রিকার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ‘ক্যাম্পে’ প্রকাশিত হবার পর বিগত পাঁচ বছরে কোনো পত্রপত্রিকায় জীবনানন্দের কোনো লেখা প্রকাশিত হয় নি। ‘মৃত্যুর আগে’ দিয়ে তাঁর পুনরায় উপস্থিতি ঘোষিত হল। 

‘কবিতা’র প্রথম সংখ্যা পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৫ সালের ৩ অক্টোবর বুদ্ধদেব বসুকে একটি দীর্ঘ পত্র লেখেন। এই চিঠিতে ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তা এ রকম— 

‘জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে।’ 

জীবনানন্দের বহুবিশ্রুত ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় (পৌষ ১৩৪২) প্রকাশিত হয়। ‘বনলতা সেন’ কবিতার ওপর এডগার অ্যালান পো (১৮০৯-১৮৪৯)-র ‘To Helen’ কবিতার প্রভাব আছে বলে জীবনানন্দ-বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস। পো-র ‘To Helen’ কবিতাটি এবং তার একটি বাংলা অনুবাদ উপস্থাপিত হল। 

Helen, thy beauty is to me 
like those Nicean barks of yore 
That gently, o’er a perfumed sea, 
the weary, way-worn wanderer borne 
to his own native shore. 

On desperate seas, long wont to roam,
thy hyacinth hair, thy classic face,
thy naiad airs have brought me home
To the glory that was Greece 
And the grandeur that was Rome. 

Lo, in you brlliant window-niche 
How statue-like I see thee stand 
the agate lamp within my hand!
Ah, psyche, from the regions
Which are holy land. 

এই কবিতার বিষ্ণু দে-কৃত তর্জমা : 

হেলেন, তোমার রূপ মোর মনে হয়
সেকালের ভিনীসীয় তরণীর মতো,
সুগন্ধ সমুদ্র-বক্ষে শান্তধীরে বয়
ক্লান্ত প্রবাসীকে দীর্ঘপথশ্ৰমাহত 
আপন স্বদেশে সমাগত। 

কত না দুরন্ত সিন্ধুবিহারের পরে 
তোমার অতসী কেশ, ক্লাসিক বয়ান, 
নেয়াড় তোমার লাস্য, মোরে আনে ঘরে 
গ্রিসে, চিরগৌরবের আদিপীঠস্থান 
আর রোমে, আছিল যে বৈভবশিখরে। 

দেখি বাতায়নবেদীতে উদ্ভাস 
আভঙ্গে খোদাই স্তব্ধ স্থির মূর্তি তুমি 
মর্মরের দীপ জ্বলে করপুট চুমি। 
আহা সাইকি! সেই দেশে তোমার নিবাস 
সে যে পুণ্যভূমি। 

এ ছাড়া উক্ত সংখ্যায় জীবনানন্দের আর যে তিনটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলো হল—কুড়ি বছর পর’, মৃতমাংস’ ও ‘ঘাস’। 

‘বনলতা’ নামটি বিষয়ে কিছু তথ্য এখানে সন্নিবেশ করা যেতে পারে। ১৯৩৩-এ লেখা ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে ‘বনলতা’ একটি চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত। ১৯৪৮-এ লেখা উপন্যাসে ‘বনচ্ছবি’ নামে আরেকটি চরিত্র আছে। ১৯৪৬-৪৭-এর দিনলিপিতে একজন ‘বনলতা সেন’- এর উল্লেখ আছে এভাবে— 

‘Frustrations in Lit, Love, Herodias’ daughters, বনলতা সেন, Imaginary women, Bus women and life impel me to invoke God.’ 

তাহলে দেখা যাচ্ছে বনলতা সেন কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয় জীবনানন্দের জীবনে।

‘কবিতা’ পত্রিকায় জীবনানন্দ আমৃত্যু অনেক কবিতা লিখেছেন। তাঁর আত্মপ্রকাশ ও খ্যাতির প্রধান মাধ্যম ছিল এই ‘কবিতা’ পত্রিকাটি।

জীবনানন্দ-পত্নী লাবণ্য দাশ বিএ পাস করলেন। তাঁর বিএ পরীক্ষা নিয়ে ঘটনাটি এ রকম— 

‘আমি যে বারে বি.এ পরীক্ষা দিলাম সে বারে সেই কলেজেই (বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ) ইংরেজির অধ্যাপক পদে ছিলেন। ইতিহাস পরীক্ষার দিন শরীর খুব খারাপ বোধ হওয়াতে আমি পরীক্ষা দেব না স্থির করে বাড়ি চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু একজন অধ্যাপক আমাকে বাধা দেন। এমন কি আমাকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করবার জন্য কবিকে ডেকে নিয়ে এলেন। তাঁর সামনেই আমি বললাম, ‘আমি পরীক্ষা দেব না, বাড়ি যাব।’ তিনি আমার মুখের দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘ইচ্ছে না থাকলে পরীক্ষা দিও না। শরীর বেশি খারাপ লাগলে বাড়ি চলে যাওয়াই উচিত।’ কথাটা বলেই মুহূর্তমাত্র সেখানে অপেক্ষা না করে নিজের কাজে চলে গেলেন। কিন্তু শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক হেমচন্দ্র ঘোষ কবির উপর ভীষণ চটে গিয়ে বলেই ফেললেন, ‘বাড়ি যাবার অনুমতি তুমি দিতে পার, কিন্তু আমি কিছুতেই দেব না।’ তাঁরই ব্যবস্থায় আমি পরীক্ষা দিতে বাধ্য হলাম। তিনি যদি সেদিন আমার জন্য অতখানি কষ্ট স্বীকার করতে এগিয়ে না আসতেন তাহলে হয়ত নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ আর পেতামই না।’ [‘মানুষ জীবনানন্দ’, লাবণ্য দাশ]

রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৪। বাংলার লাট স্যার জন এন্ডারসন শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে এলেন ৬ ফেব্রুয়ারিতে। হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে সম্মানীয় ‘ডক্টর’ উপাধি প্রদান করল। লাহোরের দয়ানন্দ অ্যাংলো বেদিক কলেজ পরিদর্শন করলেন রবীন্দ্রনাথ। স্থানীয় বাঙালিসমাজ দ্বারা সংবর্ধিত হলেন। 

অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘Visabharati Quarterly’ মে মাস থেকে পুনরায় প্রকাশ পেতে থাকল; সম্পাদক : কৃষ্ণ কৃপালনী। রবীন্দ্রনাথের ‘সকল গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয়। কালিঘাট মন্দিরে জীববলি বন্ধ সম্পর্কিত আন্দোলনকে রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করলেন। গোঁড়া হিন্দুসমাজ এতে বিরক্ত হল। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব সম্পর্কে চার পঙ্ক্তির কবিতা লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। Mrs. Sanger-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে আলোচনা করলেন। রুশ মহিলা ভেরা নভিকোভা বাংলাভাষা শিখলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য কবির কবিতা রুশভাষায় অনুবাদ শুরু করলেন। 

বুদ্ধদেব বসুর প্রথম কন্যা মীনাক্ষীর জন্ম হয়। একই দিনে ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’ পত্রিকার প্ৰকাশ। 

এ বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর বিষ্ণু দে-র প্রথম কন্যা রুচির জন্ম হয়। 

‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় বিষ্ণু দে-র ‘পঞ্চমুখ’ কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয়। ‘কবিতা’র প্রাথমিক সংগঠন-পর্বে বিষ্ণু দে ছিলেন অন্যতম উৎসাহদাতা ও সাহায্যকারী। 

শারীরিক-মানসিক অতিরিক্ত শ্রম এবং নিজের প্রতি অযত্ন-অবহেলায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে অসুস্থতা দেখা দেয়। এ বছরেরই কোনো একদিন সংজ্ঞা হারান মানিক এবং দু’এক মাস অন্তর অন্তর এটা ঘটতে থাকলে চিকিৎসায় ধরা পরে তিনি Epilepsy বা মৃগীরোগে আক্রান্ত। চিকিৎসাতীত এই ব্যাধি ছিল তাঁর আমৃত্যু সঙ্গী। 

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড নতুন ভারত শাসন আইন পাস করেন। পঞ্চম জর্জের রাজত্বের ২৫ বছর পূর্তিতে সর্বত্র ‘রজত জুবিলী’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ইতালির সামরিক নেতা সিনর মুসোলিনী আবিসিনিয়া দখল করে নেন। জার্মান নায়ক হের হিটলার ব্রিটিশ-ফরাসি দখল থেকে স্যার প্রদেশ পুনরুদ্ধার করেন। 

এ বছর জন্মালেন সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, অমিতাভ দাশগুপ্ত, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান। 

আর মারা গেলেন জাতকের অনুবাদক ঈশানচন্দ্র ঘোষ। 

নোবেল কমিটির সদস্যরা স্থির সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে ১৯৩৫ সালে সাহিত্যে কোনো নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়নি। 

প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ সপ্তক’, ‘সুর ও সংগতি’, ‘বীথিকা’ এবং ইংরেজিতে ‘ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট’। বের হল সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’, দীনেশচন্দ্ৰ সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রাইকমল’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জননী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘অতসী মামী’, জগদীশ গুপ্তের ‘গতিহারা জাহ্নবী’, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘অন্তঃশীলা’, বনফুলের ‘তৃণখণ্ড’। প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’, প্রমথনাথ বিশীর ‘মৌচাকে ঢিল’, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আই হ্যাজ’, এলিয়টের ‘মার্ডার ইন দি ক্যাথিড্রাল’। 

বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশ পায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *