১৯৩৭। বয়স ৩৮ বছর
জীবনানন্দ ১৯৩৭ সালের মে-জুন মাসের সন্ধি-সময়ে বরিশাল থেকে কলকাতায় গেলেন। বুদ্ধদেব বসুকে সঙ্গে নিয়ে ব্রাইট স্ট্রিটের বাসায় গিয়ে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন জীবনানন্দ। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র একটি কপি উপহার দিলেন তিনি তাঁকে। জীবনানন্দের ইচ্ছে ছিল—বিচিত্রা’য় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র একটি সমালোচনা লিখুন প্রমথ চৌধুরী। বরিশাল ফিরে ১৯৩৭ সালের ৭ জুন প্রমথ চৌধুরীকে একখানি চিঠি লিখেছিলেন জীবনানন্দ—
‘তৃপ্তি দিক–অতৃপ্তি দিক, আমার কাব্যে কোন গুণ থাকুক বা অনেক দোষ থাকুক, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পড়ে আমার সম্পর্কে আপনার যা মনে হয়েছে সে সম্বন্ধে ‘বিচিত্রা’য় একটা বড় প্রবন্ধ লিখলে আমি নিজেকে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করব। আমার ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেকে অনেক হৃদয়গ্রাহী মতামত প্রকাশ করেছেন। তবু সে সব সমালোচনা নয়। সেই ‘সবুজপত্রে’র দিন থেকে জানি বাংলা সাহিত্যের অদ্বিতীয় সমালোচক হচ্ছেন আপনি। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ সম্বন্ধে আপনার সমালোচনা সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হবে। যত শীঘ্র সম্ভব ‘বিচিত্রা’য় আপনার প্রবন্ধ দেখতে পাব ও তৎপূর্বে আপনার চিঠি পাব এই আশা নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি।’ [জীবনানন্দ দাশ ও প্রমথ চৌধুরীর পত্রাবলী, অনাথনাথ দাশ (সংকলিত), ‘মহানগর’, দ্বাদশ সংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৮২, পৃ. ৫০–৫১]
প্রত্যুত্তরে ১৪.৬.১৯৩৭ তারিখে প্রমথ চৌধুরী জীবনানন্দকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির কিয়দংশ এ রকম—
‘আমি আপনার কবিতার বই সম্বন্ধে আজও কিছু লিখে উঠতে পারিনি, তার কারণ প্রথমতঃ আমার শরীর এখনও ভাল নেই। উপরন্তু এখানে এখন ভয়ঙ্কর গরম। গ্রীষ্ম আমাকে চিরদিনই কাতর করে, এখন আরো বেশি করছে।’ [প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩]।
এর কিছুদিন পর ওই বছরেই জীবনানন্দ প্রমথ চৌধুরীকে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখেছিলেন। চিঠিতে নিজের প্রয়োজনের কথা জানিয়েছিলেন অসংকোচে
‘কোনো রকমে কলকাতার কোনো College-এর ইংরেজির Staff-এ আপনি যদি আমার জন্য একটা জায়গা করে দেন তাহলে আমার বড়ো উপকার হয়। Mr. J. Chowdhury ও Mr. Bhavasankar Banerjee-কে যদি আপনি একটু বিশেষভাবে বলেন তাহলেই সব হয়।’ [জীবনানন্দ দাশ : বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত, পৃ. ১১৪]
চিঠি লেখা সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশ প্রমথ চৌধুরীর আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। এ বছর নিম্নলিখিত পত্রিকায় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র স্বতন্ত্র আলোচনা প্রকাশিত হয়।
১. ‘কবিতা’ : চৈত্র ১৩৪৩। আলোচক : বুদ্ধদেব বসু।
‘প্রকৃতির কবি’ নামের দীর্ঘ আলোচনাটির প্রথমেই বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দকে ‘প্রকৃতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বললেন—’জীবনানন্দ একেবারেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত।’ বুদ্ধদেব বসু আরও লিখেছেন,
‘আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে তিনি বোধ হয় সবচেয়ে সক্রিয়। তাঁর কল্পনা সদাই নব নব রূপের সন্ধানী, তাঁর রচনাভঙ্গি গভীরতার পরিণতির দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু এতদিনেও আমাদের সাহিত্যের বাজারে তাঁর খ্যাতির রোল ওঠেনি। আমাদের সুধীশ্রেণীও তাঁর কাব্যের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত, এমন মনে হয় না।’
২. ‘পরিচয়’ : বৈশাখ ১৩৪৪। আলোচক : গিরিজাপতি ভট্টাচার্য। (১৮৯৩–১৯৮১)
৩. ‘Amrita Bazar Patrika’ আলোচক : Samar Sen.
৪. ‘একক’ : ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৪৪। আলোচক : নলিনীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়।
‘কবিতা’ পত্রিকায় (আশ্বিন ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ সংখ্যা) জীবনানন্দের ‘ও হৈমন্তিকা’ এবং ‘ফিরে এসো’ নামক দুটো কবিতা প্রকাশিত হয়। এ দুটো কবিতার এক বিরূপ সমালোচনা ‘শনিবারের চিঠি’তে (অগ্রহায়ণ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ সংখ্যা) বেরোয়। ‘ও হৈমন্তিকা’ কবিতাটি বিষয়ে বলতে গিয়ে সমালোচনার এক জায়গায় লেখা হয় —
‘প্রেয়সীকে এতকাল আমরা হৃদয়ে পাইতাম, ভালবাসিতাম। এইবার প্রেয়সীর হৃদয়ে চরিবার দিন আসিল। একসঙ্গে দেহের আহার ও মনের ওষুধ—এ সম্ভাবনার কথা কে কল্পনা করিতে পারিয়াছিল?’
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৬। ইতালি ইথিওপিয়া আক্রমণ করলে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভাপতি হিসেবে ভাষণ দিলেন কবি, ভাষণ দিলেন বাংলায়। সমাবর্তন ভাষণে বাংলার ব্যবহার এই প্রথম, বেসরকারি সভাপতি ও এই প্রথম।
মার্চে বিজ্ঞানী স্যার জন রাসেল শান্তিনিকেতন ভ্রমণ করে গেলেন। জুলাই-এ জীবনের শেষবারের মতো জমিদারির পতিসর ভ্রমণ করে এলেন রবীন্দ্রনাথ। সেপ্টেম্বর ১০-এ উত্তরায়ণে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন। চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথকে দেখতে আসার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ উল্টো গান্ধীকে দেখতে গেলেন।
‘বন্দে মাতরম্’-এর প্রথমাংশ জাতীয় সঙ্গীত করার জন্যে সুপারিশ করলেন রবীন্দ্রনাথ। কংগ্রেস তা সাদরে মেনে নিল।
গিরিডিতে জগদ্বিখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিক স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর মৃত্যু হল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটি সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গ করলেন।
মাসিক পঁয়ষট্টি, টাকা বেতনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। বুখানিনের ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ ও লিয়েনতিয়েভের ‘মার্কসীয় অর্থনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে মার্কসীয় মতবাদে উজ্জীবিত হন মানিক। মৃগীরোগের প্রকোপ বৃদ্ধি। চিকিৎসাবিদ্যার বইপত্র ঘেঁটে মানিক নিজেই এই রোগের একপ্রকার ওষুধের ব্যবস্থা করেন। এ ধরনের ওষুধে অ্যালকোহলের পরিমাণ বেশি। এই রকম ওষুধ সেবনের ধারাবাহিকতায় তিনি ক্রমশ অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন।
ভারতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হল। এই আইন অনুসারে ১১টি প্রদেশে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হয়।
প্রায় ৫০ বছর ভারত সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ব্রহ্মদেশ পৃথক রাষ্ট্রীয় পরিচয় লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতাও পায়। জাপান চীন আক্রমণ করে রাজধানী নানকিন অধিকার করে নেয়। লীগ অব নেশনস্ দ্বারা জাপান নিন্দিত হয়।
এ বছর জন্মালেন রত্নেশ্বর হাজরা, বিজয় মুখোপাধ্যায়, আনিসুজ্জামান, কবি দিলওয়ার।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন মার্টিন ডুগার্ড (১৮৮১–১৯৫৮)। ঔপন্যাসিক। ফ্রান্সের লোক তিনি।
পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে কমিটি লেখেন—
‘For the artistic vigour and truthfulness with which he has pictured human contrasts, as well as some fundamental aspects of contemporary life, in the peries of novel ‘ .
ডুগার্ডের বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল—’জীন বেরোস’, ‘বিকামিং’, ‘আফ্রিকান সিক্রেট’, ‘দ্য সাইলেন্ট ওয়ান’।
প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘খাপছাড়া’, ‘সে’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘বিশ্বপরিচয় আর ইংরেজিতে ‘ম্যান’। বের হয় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘ক্রন্দসী’, বুদ্ধদেব বসুর ‘কঙ্কাবতী’, বিষ্ণু দে’র ‘চোরাবালি’, সমর সেনের কয়েকটি কবিতা’, রাধারাণী দেবীর ‘সিঁথি মৌর’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আগুন’, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘সুর ও সঙ্গীত’। প্রকাশ পায় পরশুরামের ‘হনুমানের স্বপ্ন’, মোহিতলাল মজুমদারের ‘আধুনিক বাংলাসাহিত্য’, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘রাণুর প্রথমভাগ’, সরোজ রায়চৌধুরীর ‘ময়ূরাক্ষী’। বেগম রোকেয়া সম্পর্কে প্রথম গ্ৰন্থ শামসুন্নাহার মাহমুদের ‘রোকেয়া জীবনী’ প্রকাশিত হয়। প্রকাশ পায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘প্রাগৈতিহাসিক’।