১৮৯৯ – জন্ম
জীবনানন্দ দাশের জন্ম : ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯, ৬ ফাল্গুন ১৩০৫ বঙ্গাব্দ। শুক্রবার।
লাবণ্য দাশ বলেছেন—
‘কবির জন্মসাল ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ।’ [সূত্র : বিষ্ণু দে সম্পাদিত ‘একালের কবিতা র ভূমিকা
‘আমার জন্ম হয়েছিল বরিশালে ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে ফাগুন মাসে।’—জীবনানন্দ (২.৭.১৯৪৬ তারিখে জনৈক অনুরাগীকে লেখা চিঠি থেকে )।
বাংলাদেশে ৬৫টি জেলা। বরিশাল দক্ষিণাংশের অন্যতম জেলা। বরিশাল সদর ছাড়া ৯টি উপজেলা। উপজেলাগুলো হল—বানারীপাড়া, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, আগৈলঝাড়া, গৌরনদী, বাকেরগঞ্জ, মুলাদী, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ। বরিশাল শহরটি কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত। বরিশালের অন্য একটি উল্লেখযোগ্য নদী হল তেতুলিয়া নদী। খাল-বিল-নদীনালা আর জানা অজানা নানা বৃক্ষাদি সংবলিত বরিশাল শহরের প্রায় মাঝখানে জন্মেছিলেন জীবনানন্দ।
অশ্বিনীকুমার দত্তের বাড়ির উল্টো দিকের একটা ঘরে থাকতেন সর্বানন্দ। আটচালা ঘর। ওই বাড়িতেই জীবনানন্দ জন্মান। পরে সর্বানন্দের পুত্ররা সেই বাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। একটা সময়ে হরিচরণ নিজস্ব ভিটার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। একান্ত আগ্রহে বগুড়াপাড়ায় মায়ের নামে হরিচরণ জমি কেনেন। ভাইদের সহায়তায় ওই জমিতে ১৯০৭ সালে বাড়ি বানান তিনি। হরিচরণ জমিটি কিনেছিলেন রাজকুমার ঘোষের কাছ থেকে।
এই জায়গাটি আলেকান্দা মৌজার অন্তর্গত। একসময়ে স্থানটির নাম হয় নতুনবাজার এলাকা। জীবনানন্দের বসতবাড়ির পূর্বপাশ দিয়ে বগুড়া রোড চলে গেছে। বর্তমানে এই রোডের নাম জীবনানন্দ সড়ক। জীবনানন্দের বাড়িটি ‘সর্বানন্দ ভবন’ নামে পরিচিত ছিল। পাড়ার লোকেরা বলত ‘বড়বাড়ি’।
জীবনানন্দ মা-বাবার প্রথম সন্তান। ডাকনাম মিলু।
‘ছোট পিসিমা (স্নেহলতা দাশ) আমাদের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে পণ্ডিতিয়া প্লেসে কাকার (শ্রীব্রহ্মানন্দ দাশ) বাড়িতে যাওয়ার সময় যে মুহূর্তে বলেছেন, ‘মিলু এবারে যাই’, অমনি কবি তাঁর কবিতার খাতাপত্র ফেলে রেখে পিসিমার ডান হাতখানি জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘এখনি কি যাবে?’ [‘মানুষ জীবনানন্দ’, লাবণ্য দাশ, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ]
স্নেহলতা দাশ ছিলেন সর্বানন্দ-প্রসন্নকুমারীর অষ্টম সন্তান। চিরকুমারী। আইএ পাস করে সদর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী হন। ‘আজন্ম ব্রহ্মচারিণী, স্বল্পভাষী, সদাপ্রসন্ন, শান্ত, স্নেহময়ী।’
বরিশালের সকলের কাছে ‘বড় দিদিমণি’ বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁরই চেষ্টায় সদর বালিকা বিদ্যালয়টি হাইস্কুল স্তরে উন্নীত হয়। পরে মতান্তরের ফলে তিনি সেই স্কুল ত্যাগ করেন। নিজের উদ্যোগে তাঁদের বাসস্থানের চৌহদ্দির মধ্যেই ‘রবিবাসরীয় নীতি বিদ্যালয়’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। দেশভাগের পর গোটা দাশ-পরিবার বরিশাল ছেড়ে ভারতে চলে গেলেও স্নেহলতা দাশ অনেক দিন পৈতৃক ভিটে আঁকড়ে বরিশালে থেকে গিয়েছিলেন।
জীবনানন্দের জন্ম বরিশাল জেলা-শহরে। পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার পদ্মা-তীরবর্তী গাউপাড়া গ্রাম। বর্তমানে এই গাউপাড়া গ্রাম পদ্মাগর্ভে বিলীন। সেখানে তাঁর পূর্বপুরুষের পরিবার ‘মুশি-পরিবার’ নামে পরিচিত ছিল
জীবনানন্দের পিতার নাম সত্যানন্দ দাশ [১৮৬৩–১৯৪২]। বিএ। সত্যানন্দ ছিলেন সর্বানন্দ দাশের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথমে বরিশাল জেনারেল পোস্ট অফিসে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের দপ্তরে কাজ করতেন সত্যানন্দ। পরে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হন। প্রাবন্ধিক। ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ব্রজমোহন স্কুলটি জাতীয় বিদ্যালয়ে পরিণত হলে মডেল স্কুল নামে একটি উচ্চ ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্যানন্দ এই নব প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পান। সত্যানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১–১৯৪১) সমবয়সী ছিলেন। সত্যানন্দ ছিলেন কর্মশীল মানুষ ও আদর্শবাদী শিক্ষক।
‘একমাত্র জ্ঞানযোগই যে বাবার অন্বিষ্ট ছিল সেকথা সত্য নয়; কিন্তু মধ্যবয়স পেরিয়েও অনেকদিন পর্যন্ত সাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞান এমনকি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় তাঁকে প্রগাঢ় হয়ে থাকতে দেখেছি—মানুষের জীবন ও চরাচর সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব একটা বিশুদ্ধ ধারণায় পৌঁছুবার জন্যে। নিজের হিসেবে পৌঁছুতে পেরেছিলেন তিনি। উচ্ছ্বাস দেখিনি কখনো তাঁর, কিন্তু জীবনে অন্তঃশীল আনন্দ স্বভাবতই ছিল—সবসময়ই প্রায়।’ [‘আমার মা-বাবা’, জীবনানন্দ দাশ]
প্রচণ্ড রকমের ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন সত্যানন্দ। তিনি ছিলেন ধার্মিক ও জ্ঞানী। তাঁর কাছে সবচাইতে আকর্ষণের বস্তু ছিল ভারতীয় দর্শন আর উপনিষদ। ধর্ম-রাষ্ট্র-সাহিত্য-সমাজ-পরিবার- সব বিষয়ে তিনি ছিলেন মোহমুক্ত। রোজ শেষরাতে উপনিষদের শ্লোক আওড়াতেন সত্যানন্দ।
জীবনানন্দের মা হলেন কুসুমকুমারী দাশ (১৮৭৫–১৯৪৮)। সুরসিক, হাস্যকৌতুকধর্মী ছড়া রচনাকার চন্দ্রনাথ দাশ (১৮৫২-১৯৩৮) ও ধনমণির প্রথম কন্যা। বরিশাল শহরেই কুসুমকুমারীর জন্ম। কবি। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’—বিখ্যাত ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটির রচয়িত্রী। কুসুমকুমারীর কাব্যগ্রন্থের নাম— ‘কাব্যমুকুল’। তিনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের (১৮৮২–১৯২২) প্রায় সমবয়সী।
লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন কুসুমকুমারী। বরিশালের ক্ষণস্থায়ী একটি বালিকা বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। পরে কলকাতার বেথুন স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৯১ সালের প্রায় গোটা সময় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৬৫-১৯৪৩) ২৮ নম্বর ঝামাপুকুর লেনের বাড়িতে থেকে কুসুমকুমারী বেথুনে পড়েছেন। কিছুদিন রাখাল রায়চৌধুরীর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতেও ছিলেন তিনি। এরপর ১৩ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ব্রহ্মবালিকা বিদ্যালয়ের বোর্ডিং-এ লাবণ্যপ্রভা বসুর তত্ত্বাবধানে থেকেছেন। ১৮৯৪ সালের ২৩ মে (১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩০১ বঙ্গাব্দ) দশম শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থায় সত্যানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ওই সময়ের আগে থেকে কুসুমকুমারী প্রবন্ধ ও কবিতা লিখে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। বেথুন স্কুলে পড়বার সময়, তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ শুনেই সত্যানন্দ মুগ্ধ হন। এবং বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দেন। অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তীর ‘কুসুমকুমারী দাশ—’সেই ছেলে’র মা’ (দেশ, ৪৯:৩৪, ১১ আষাঢ় ১৯৮৯, পৃ. ২০) নামের প্রবন্ধে এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা আছে। কুসুমকুমারীর বাপের বাড়িতে বাসরঘরের বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়নি। জগৎচন্দ্র গুপ্তের স্ত্রী মুক্তকেশী দেবী এগিয়ে এসেছিলেন। নিজেদের পাকাঘরের উত্তরদিকের একটা ঘরে ফুলশয্যার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। বিয়ের কারণে তাঁর আর প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় নি। সত্যানন্দ ও কুসুমকুমারীর বিয়ে হয়েছিল ব্রাহ্মমতে, স্থানীয় ব্রাহ্মমন্দিরে। বিয়ের আচার্য ছিলেন গিরিশচন্দ্র মজুমদার, বিয়েতে শিবনাথ শাস্ত্রীর স্ত্রী ও কন্যা যোগ দিয়েছিলেন।
বালিকা বয়স থেকেই কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করে কুসুমকুমারী অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ‘ব্রহ্মবাদী’, ‘মুকুল’ ও ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। ‘নারীত্বের আদর্শ লিখে কুসুমকুমারী স্বর্ণপদক লাভ করেন। কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন সুগৃহিণী। তিনিও ব্রাহ্মসমাজের মহিলা শাখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
‘মার কাছে শুনেছি তিনি কলকাতার বেথুন স্কুলে পড়তেন। …মা খুব সম্ভব ফাৰ্ষ্ট-ক্লাস অব্দি পড়েছিলেন—এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে পারেন নি, তার আগে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। ছাত্রী হিসেবে কৃতী ছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে পরীক্ষায় পারদর্শিতার জন্যে তিনি যে সব বই পুরস্কার পেয়েছিলেন তার দু’একটা অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের কাছে ছিল। …তিনি অনায়াসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় খুব ভালোই করতে পারতেন। এ বিষয়ে সন্তানদের চেয়ে তাঁর বেশি শক্তি ছিল মনে হচ্ছে।’ [‘আমার মা-বাবা’, জীবনানন্দ দাশ]
জীবনানন্দের জন্মের সময় সত্যানন্দের বয়স ৩৬ এবং কুসুমকুমারীর বয়স ২৪। তাঁদের বিয়ের পাঁচ বছর পর জীবনানন্দের জন্ম হয়।
জীবনানন্দের পিতৃকুল :
জীবনানন্দের প্রপিতামহ বলরাম দাশগুপ্ত কিছুদিন নেমকের দারোগা ছিলেন। বলরাম দাশগুপ্তের তিন পুত্র—তারিণীচরণ, ভোলানাথ ও সর্বানন্দ (১৮৩৮–১৮৫৫)। সর্বানন্দ সর্বকনিষ্ঠ। বরিশাল জেলা স্কুল থেকে সর্বানন্দ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। চাকরি পান কালেক্টরি দপ্তরে। গাউপাড়া থেকে বরিশালে অস্থায়ী এক ভাড়াবাড়িতে উঠে আসেন। বিয়ে করেন নিজ গ্রামের তারিণীচরণ সেনের কন্যা প্রসন্নকুমারীকে।
হরিচরণ (১৮৬০-১৯১৮) ও দুর্গামোহন—এই দুই পুত্রের জন্মের পর সর্বানন্দ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। এরপর স্থায়ীভাবে তিনি বরিশালেই বসবাস করতে থাকেন। সর্বানন্দ নিজের নামের পদবি ‘দাশগুপ্ত’ বাদ দিয়ে ‘দাস’ লিখতে শুরু করেন। প্রথম পুত্র হরিচরণকে গ্রামের হিন্দু আত্মীয়দের সান্ত্বনার জন্যে তাঁদের সমাজের সঙ্গে যুক্ত রাখেন। ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পর দুর্গামোহনের নতুন নাম হয় সত্যানন্দ দাশ (১৮৬৩–১৯৪২)। পরবর্তীকালে জন্মগ্রহণকারী সকল পুত্রসন্তানের নামের সঙ্গে ‘আনন্দ’ যুক্ত করার প্রথা চালু হয়।
বরিশালে সর্বানন্দের বিপুল খ্যাতি ছিল। সামাজিক সেবামূলক কাজে তিনি নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখতেন। স্থানীয় আদালতের প্রধান করণিক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। বরিশালের মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে অশ্বিনীকুমার দত্তকে পরাজিত করে কমিশনার হন তিনি। ৪৭ বছর বয়সে সর্বানন্দ বিসূচিকা রোগে (?) মারা যান। সর্বানন্দের মৃত্যুতে বরিশাল শহর মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলে এক মহা শোকযাত্রার আয়োজন করেছিলেন। দাশ-পরিবারের বন্ধু পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭–১৯১৯) ও অশ্বিনীকুমার দত্ত (১৮৫৬-১৯২৩) পারিবারিক বিপর্যয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন।
সর্বানন্দের বড়ছেলে হরিচরণ জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। প্রথমবার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করেন। কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সিটি স্কুল থেকে পরে এন্ট্রান্স পাস করেন। হরিচরণ ও সত্যানন্দ—দুজনেই সিটি কলেজে পড়েন। হরিচরণ থাকতেন মেসে। সত্যানন্দ থাকতেন ভবানীপুরের দুর্গামোহন দাস ও ভুবনমোহন দাসের বাড়িতে। পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে উভয়ে বরিশালে আসেন। ফিরে গিয়ে পরীক্ষায় বসেন। এবং অকৃতকার্য হন।
সরকারি নিয়মে কোনো সরকারি কর্মচারীর মৃত্যু হলে তার প্রতিপাল্য চাকরি পাবে। কিন্তু সর্বানন্দের দুই পুত্রের কেউই সেরকম সরকারি সাহায্য পাননি।
সত্যানন্দ প্রথমে হবিগঞ্জে শিক্ষকতায় যোগ দেন, পরে কাজ করেন বরিশাল জেনারেল পোস্ট অফিসে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের দপ্তরে। এর পরে শিক্ষকতার আকর্ষণে বিএ পাস করে বরিশাল ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশনে যোগদান করেন। হরিচরণও পূর্বের কাজ ছেড়ে একই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন।
সর্বানন্দের সাত পুত্র ও চার কন্যার মধ্যে প্রথম দুই পুত্র হরিচরণ ও সত্যানন্দ আর কনিষ্ঠ কন্যা চিরকুমারী স্নেহলতা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
সর্বানন্দের তৃতীয় পুত্রের নাম যোগানন্দ। আবগারি বিভাগে কাজ করতেন। বাড়ির ছেলেমেয়েরা তাঁকে ‘সুন্দরকাকু’ বলে ডাকত।
চতুর্থ পুত্র প্রেমানন্দ। সিভিল সার্জন ছিলেন। পুরীতে কাজ করতেন। ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব পেয়েছিলেন।
পঞ্চম পুত্র অতুলানন্দ (১৮৭৯-১৯৫২)। বনবিভাগে কাজ করতেন। ভালো শিকারি।
ষষ্ঠ পুত্র ব্রহ্মানন্দ (১৮৮৩-১৯৬৭)। চায়ের বীজ ও কাঠের ব্যবসা করতেন। ডাকনাম ডগা। ভালো খোলবাজিয়ে ছিলেন। চারণ কবি মুকুন্দ দাস (১৮৭৮-১৯৩৪) তাঁর বাদনগুরু ছিলেন। কড়া প্রকৃতির লোক। ভাইপো-ভাইঝিদের খুব ভালোবাসতেন। কলকাতার বিখ্যাত খাবার দোকান ‘জলযোগ’-এর প্রতিষ্ঠাতা।
সর্বানন্দের সপ্তম পুত্রের নাম জ্ঞানানন্দ। বিয়ে করেননি। ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সর্বানন্দের প্রথম কন্যা প্রিয়ম্বদা। পাঞ্জাবপ্রবাসী ব্রজেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় প্রিয়ম্বদার।
দ্বিতীয় কন্যা প্রেমদা। স্বামীর নাম মনোমোহন চক্রবর্তী। ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক ছিলেন প্রেমদার স্বামী। বহু ব্রাহ্ম-সঙ্গীতের রচয়িতা। তিনি মাননীয় ব্যক্তি ছিলেন।
তৃতীয় কন্যার নাম বিনোদা। বাইশ বছর বয়সে মারা যান।
চতুর্থ কন্যা স্নেহলতা (১৮৭৮-১৯৬২)। বিয়ে করেননি। শিক্ষকতায় জীবন কাটিয়েছেন।
প্রেমদার স্বামী মনোমোহন চক্রবর্তী প্রথমে স্নেহলতাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। মনোমোহন ব্রাহ্মণ বলে ব্রাহ্মকন্যা হেলতা তাঁকে বিয়ে করতে প্রথমে রাজি হননি। মনোমোহন গলার পৈতে একটানে ছিঁড়ে ফেলে নিজেকে অব্রাহ্মণ বলে ঘোষণা দেন। এতে স্নেহলতা মর্মাহত হন। বলেন যে একজন নারীকে পাওয়ার জন্য নিজের ধর্ম ত্যাগ করে তাকে কখনো বিয়ে করবেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেননি। মনোমোহন অবশেষে স্নেহলতার দিদি প্রেমদাকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি একটি বাড়িতে বসবাস করা শুরু করেন।
জীবনানন্দের মাতৃকুল :
জীবনানন্দের মাতামহ চন্দ্ৰনাথ দাশ (১৮৫২–১৯৩৮)। বরিশালের গৈলা গ্রামের অধিবাসী। অত্যন্ত রসিক ব্যক্তি। ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন, কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে ছাত্রবৃত্তি পাওয়া চন্দ্রনাথ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আর বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারেননি। বরিশালের কালেক্টরিতে হেডক্লার্ক পদে কাজ করতেন। হাসির কবিতা লিখে ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ পেয়েছিলেন চন্দ্রনাথ। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম—’হাসির গান’, ‘ক্ষেপার গান’ ও ‘সাময়িক চিত্র’ (কাব্য)।
চন্দ্ৰনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় সামাজিক বিরোধিতার কারণে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন; পরে তিনি বরিশালের আলেকান্দায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ধনমণি। তাঁদের চার সন্তান—প্রিয়নাথ, কুসুমকুমারী, সুকুমারী ও হেমন্তকুমারী।
হেমন্তকুমারীর ডাকনাম ছিল—দই। আইএ পাস করেছিলেন হেমন্তকুমারী।
.
জীবনানন্দের মামা প্রিয়নাথ দাশ। বিসিএস। সাব ডেপুটি কালেক্টর। প্রতিভাবান ভাগ্নে জীবনানন্দকে বড় ভালোবাসতেন। ভাগ্নেকে প্রিয়নাথ মজার মজার গল্প শোনাতেন। দুর্গম গিরি, কান্তার মরু আর কূলহীন সমুদ্রের গল্প শুনতে শুনতে জীবনানন্দ বিভোর হয়ে পড়তেন। মফস্সলে পরিদর্শনের সময় মামার নৌকাপথের সঙ্গী হতেন জীবনানন্দ। খাল-বিল-নদীর ওপর দিয়ে নৌকা ভেসে যেত, চরাচর পরিব্যাপ্ত সৌন্দর্যে মগ্ন হতেন কিশোর জীবনানন্দ।
বালক-বালিকার বন্ধু ছিলেন প্রিয়নাথ। জলের বড় ভয় ছিল জীবনানন্দের। তাঁকে পিঠে নিয়ে পুকুরের জলে সাঁতার কেটে ভাগ্নের ভয় কাটাতেন প্রিয়নাথ দাশ। রাতে ভাগ্নেদের আকাশের তারা চেনাতেন মামা।
দুপুরে জামগাছের নিচে রবীন্দ্রনাথের গল্পপাঠের আসর বসাতেন প্রিয়নাথ। সেই গল্পের রেশ জীবনানন্দের মনে বহুদিন ধরে অনুরণিত হতো।
.
রবীন্দ্রনাথের গৃহশিক্ষক রাজনারায়ণ বসু এ বছর মারা যান। শিক্ষাবিদ ফজিলতুন্নেসা ও বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যমাগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও মৃত্যু হয় এ বছর।
ইন্দিরা দেবী ও প্রমথ চৌধুরীর বিয়ে হয়।
.
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৩৮, প্রমথ চৌধুরীর ৩১, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৮, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ২২, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ১৭, মোহিতলাল মজুমদারের ১১।
রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদকত্ব ত্যাগ করলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের উদাসীনতা ও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরকারি চাকরির কারণে রবীন্দ্রনাথ জমিদারির মালিকানা পেলেন। অতি বিশ্বাসী ম্যানেজার ফেরার হবার কারণে রবীন্দ্রনাথদের কুষ্টিয়ার ব্যবসায় বহু সহস্র টাকার লোকসান হয়।
.
জগদীশচন্দ্র বসুর (১৮৫৮-১৯৩৭) সঙ্গে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের বিরোধের সূত্রপাত হয়। বিবেকানন্দ বেলুর মঠ প্রতিষ্ঠা করলেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ স্থাপিত হয়। ভারতের দশম রাজ-প্রতিনিধি লর্ড এলগিন পদত্যাগ করলে কার্জন ভারতের বড়লাট হয়ে আসেন।
ভারতবর্ষে রেলওয়ে সিগনেলার্স শ্রমিকদের ঐতিহাসিক ধর্মঘট পালিত হয়। ভারতে ব্যক্তি-স্বাধীনতা হরণের জন্যে ‘ইন্ডিয়ান অফিসিয়ালস সিক্রেটস অ্যাক্ট’ পাস।
সরকারি হিসেব মতে ভারতীয়দের গড়ে মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৩০ টাকা।
শীতকালে কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয়। গুজরাট, রাজপুতানা, বিরার, মধ্যপ্রদেশ ও মহীশূরে দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়।
.
ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিকামী বীর টেঙ্কু উমর ওলন্দাজদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা যান। রুশ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসের প্রস্তাবানুযায়ী ২৬টি স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে হল্যান্ডের বিখ্যাত হেগ শহরে ‘International Court of Arbitration’ গঠিত। দক্ষিণ আফ্রিকার বুয়র জাতি ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। এ সময় সাংবাদিক হিসেবে উইনস্টন চার্চিল দ্বিতীয় বুয়র যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করছেন।
.
জীবনানন্দ ছাড়া এ বছর আর যাঁরা জন্মেছেন তাঁরা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম (জন্ম : ২৪ মে ১৮৯৯, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ; মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার পুরনো শেরগড় পরগনার চুরুলিয়া গ্রামে। ডাকনাম দুখু মিয়া। পিতা: কাজী ফকির আহমদ, মাতা: জাহেদা খাতুন), শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল), শিশুসাহিত্যিক আবুল হাশেম, সঙ্গীতজ্ঞ সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ফেদোরিকো গার্সিয়া লোরকা প্রমুখ।
প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : টলস্টয়ের রেজারেকশন’, রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’, জলধর সেনের ‘প্রবাসচিত্র’ প্রকাশ পায়।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-এর বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস আলোচনার পত্রিকা ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ প্রকাশিত হয়।