১৯৩০। বয়স ৩১ বছর
বিয়ে হয় জীবনানন্দের। কনে— লাবণ্য গুপ্ত (১৯০৯-১৯৭৪)। কনের পিতা রোহিনীকুমার গুপ্ত, মাতা সরযূবালা দেবী। রোহিনীকুমার আসানসোলে এক ডাক্তারের অধীনে কাজ করতেন। ডাক্তারিতে তাঁর কোনো ডিগ্রি ছিল না। কিন্তু চর্চার গুণে সার্জারিতে বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন রোহিনীকুমার। হঠাৎ ‘ডবল নিউমোনিয়া’য় আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
স্বামীর মৃত্যুর পর সরযূবালা যশোরের ইটনায় বাপের বাড়িতে পুত্রকন্যা নিয়ে আশ্রয় নেন। রোহিনীকুমার শ্রাবণে মারা যান। তার চার-পাঁচ মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণে সরযূবালাও মারা যান।
রোহিনীকুমারের বড় ভাই অকৃতদার অমৃতলাল বড়মেয়ে প্রমীলা এবং ছোটমেয়ে ননীকে নিজের কাছে গিরিডিতে নিয়ে যান। রোহিনীকুমারের অন্য এক ভাই বিহারীলাল মেজমেয়ে লাবণ্য ও একমাত্র পুত্র শান্তিবিন্দুকে নিজের বাড়ি গয়ার করিমগঞ্জে নিয়ে যান। পরে গিরিডির উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে লাবণ্যকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়
রোহিনীকুমার খুলনার সেনহাটির কুলীন বৈদ্য-পরিবারের সন্তান আর সরযূবালা যশোর জেলার ইতিনা গ্রামের তারাপ্রসন্ন সেনের একমাত্র মেয়ে। মা-বাবা সম্পর্কে ‘মানুষ জীবনানন্দ’ গ্রন্থে লাবণ্য দাশ লিখেছেন—
‘আমার মা ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু পরিবারের মেয়ে। গল্প শুনেছি তিনি মুরগীর মাংস খাওয়া তো দূরের কথা, বাড়িতে আনতেও দিতেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী এবং তাঁর স্বভাবটি ছিল কঠোর ও কোমলের অপূর্ব সমন্বয়।’
‘আমার বাবা যেমনি ছিলেন স্ফূর্তিবাজ, তেমনি ছিল তাঁর দরাজ মন। হিন্দু সন্তান, কোনরকম কুসংস্কারের ধার দিয়েও তিনি যেতেন না।’
লাবণ্য মা-বাবার দ্বিতীয় কন্যা। তাঁরা তিন বোন, এক ভাই। নাম- প্রমীলা, লাবণ্য, ননী এবং শান্তিবিন্দু। লাবণ্য ১৯৩০-এ ম্যাট্রিক পাস করেন। ইডেন হোস্টেলে থেকে ঢাকার ইডেন কলেজে পড়াশোনা করছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে আকৃষ্ট হলে লাবণ্যকে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে এবং জীবনানন্দের পছন্দানুযায়ী জীবনানন্দের অভিভাবকের ইচ্ছানুসারে লাবণ্যের সঙ্গে জীবনানন্দের বিয়ে হয়। বিয়ের আগে ঢাকায় লাবণ্যকে দেখে কুসুমকুমারী পছন্দ করেন। এবং মা-বাবার ইচ্ছানুযায়ী জীবনানন্দ একা ঢাকায় যান লাবণ্যকে দেখতে। লাবণ্য গুপ্ত জীবনানন্দের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
‘ইনি নামক ব্যক্তিটি আমাকে যা-ই ভাবুন না কেন, ঠিক হয়ে বসব কি আমি তখন আমার হাসি সামলাতে ব্যপ্ত। যাই হোক, কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আমি তাঁর দিকে ফিরে বসলাম। কিন্তু অসীম ধৈর্য ভদ্রলোকটির। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না ফিরলাম, তিনি চুপ করেই বসে রইলেন। তাঁর দিকে ফেরার পর তিনি আমাকে তিনটি প্রশ্ন করলেন—আপনার নাম কি? আই.এ-তে কি কি সাবজেক্ট নিয়েছেন এবং কোনটি আপনার বেশী পছন্দ।’ [‘মানুষ জীবনানন্দ’, লাবণ্য দাশ, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ১৩৭৮]
জীবনানন্দ-লাবণ্যের বিয়ের তারিখ : ৯ মে ১৯৩০; ২৬ বৈশাখ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ। শুক্রবার। শুক্লা চতুর্দশী তিথি।
বিয়ের স্থান : ঢাকা, ব্রাহ্মসমাজের রামমোহন লাইব্রেরি। বিয়ে হয়েছিল ব্রাহ্ম মতে। বিয়ের আচার্য ছিলেন মনোমোহন চক্রবর্তী। বিয়ের আসরে উপস্থিত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮- ১৯৭৪), অজিতকুমার দত্ত (১৯০৮–১৯৭৯) প্রমুখ কবি-বন্ধুরা।
৩১ বৈশাখ বুধবার সন্ধ্যায় বরিশালের সর্বানন্দভবনে নববধূর সংবর্ধনা উপলক্ষে বউভাত অনুষ্ঠান এবং বিশেষ উপাসনা হয়।
বিয়েতে কন্যাপক্ষ থেকে জীবনানন্দকে একটি আংটি উপহার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই আংটির জন্যেও তিনি বিশেষ লজ্জাবোধ ও কুণ্ঠাবোধ করতেন।
বিয়ের আগে লাবণ্যের সঙ্গে জীবনানন্দের পত্র বিনিময় হয়। জীবনানন্দের ডায়েরিতে লাবণ্যকে সংক্ষেপে ‘লাব’ বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
তখন তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে। তিনি তিনজন প্রেমিকার কথা ক্রমাগত ভেবেছেন। প্রথমজন মনিয়া নাম্নী এক কিশোরী।
দ্বিতীয়জন খুন্তি। এঁর প্রকৃত নাম লীলাময়ী। মামা প্রিয়নাথ দাসের অবিবাহিত মেয়ে এই লীলাময়ী।
তৃতীয়জন কাকা অতুলানন্দের দ্বিতীয়কন্যা শোভনা। ডাকনাম বেবী। উল্লেখ্য, তিনটা প্রেমই একতরফা। জীবনানন্দের পক্ষ থেকে।
লাবণ্য দাশের মানুষ জীবনানন্দ’ বইতে একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। তা হল একবার জীবনানন্দ এক ধনীলোকের বিবাহযোগ্য কন্যাকে দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁর মেশোমশাই রসরঞ্জন সেন এর উদ্যোক্তা ছিলেন। বিত্তশালী পরিবারটি জীবনানন্দকে বিলেত পাঠাতেও আগ্রহী ছিলেন। জীবনানন্দ রাজি হননি। রাজি হয়েছিলেন পিতৃমাতৃহীন লাবণ্যকে বিয়ে করতে।
পরবর্তী জীবনে লাবণ্য দাশ বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। সাধারণ শিক্ষিকা থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হয়েছিলেন। জীবনানন্দ-বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মানুষ জীবনানন্দ’। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ : জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮। প্রকাশক : ময়ুখ বসু, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৪, বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রিট, কলকাতা-১২, প্রচ্ছদ-শিল্পী : মনোজ বিশ্বাস, মুদ্রাকর : অজিতকুমার সামই, ঘাটাল প্রিন্টিং ওয়ার্কস ১/১এ, গোয়াবাগান স্ট্রিট, কলিকাতা-৬। দাম : তিন টাকা]। ১৯৭৪ সালে বিয়ের ৪৪ বছর পর হাঁপানি রোগে লাবণ্য দাশ মারা যান।
জীবনানন্দ দাশের মাতামহী প্রসন্নকুমারী পরলোক গমন করেন; মৃত্যুর তারিখ : ৫ আষাঢ় ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ। তখন তাঁর বয়স ৮৬ বছর।
বেকার জীবন জীবনানন্দের। মাঝে কিছুদিন ইন্সিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করে এক বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসাও করেছেন। কোনোটিই স্থায়ী হয়নি এবং সফলতার মুখও দেখেননি জীবনানন্দ।
এ বছর (৩ পৌষ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) ৬৬ হ্যারিসন রোড, কলকাতা থেকে জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছেন—
‘শ্রীচরণেষু,
আপনার স্নেহাশীষ লাভ করে অন্তর আমার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আজকালকার বাংলাদেশের নবীন লেখকের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এই যে, তাদের মাথার ওপরে স্পষ্ট সূর্যালোকের মত আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীকে তারা পেয়েছে। … আর আমার জীবনের আকিঞ্চন সেই আরাধ্যশক্তি ও সেই কল্যাণময় শান্তির উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। আশা করি এর থেকে আমি বঞ্চিত হব না।’
এ সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ৬৯ বছর। বরোদায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে উত্তর ভারত যাত্রা করলেন রবীন্দ্রনাথ। নিমন্ত্রক : মহারাজ সহাজি রাও। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেলেন অমিয় চক্রবর্তী
মার্চে সপরিবারে অক্সফোর্ড যাত্রা করলেন রবীন্দ্রনাথ। উদ্দেশ্য : হিবার্ট-লেকচার প্রদান। তাঁর বক্তৃতার বিষয়—দি রিলিজিয়ন অব ম্যান।’ মে মাসে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আপ্রাণ চেষ্টায় ও অজস্র অর্থ ব্যয়ে রবীন্দ্রনাথের ১২৫টি ছবির প্রদর্শনী হল প্যারিসে। এটাই রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্র প্রদর্শনী। রবীন্দ্রনাথ ঘুরলেন লন্ডন, বার্লিন, মিউনিখ, ফ্রাঙ্কফুট, মারবুর্গ, ডেনমার্ক, রাশিয়া, হামবুর্গ, নিউইয়র্ক।
মে মাসে বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু নজরুলকে বিপর্যস্ত করে। এই সময় অসুস্থ পুত্রের শিয়রে বসে হাফিজ অনুবাদ করেন কবি। ‘প্রলয় শিখা’ বাজেয়াপ্ত হয়, ‘চন্দ্রবিন্দু’র ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। নজরুলের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ছয় মাসের কারাদণ্ড হয় নজরুলের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন বুদ্ধদেব বসু।
এ বছর বিষ্ণু দে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগের উত্তীর্ণ হন। ১৯২৯ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে প্রথমবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে পারেননি তিনি। একটি ঘটনায় মানসিকভাবে উত্তেজিত হয়ে লজিক পরীক্ষা দিতে পারেননি বলে পরীক্ষার ফল অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলন শুরু। গান্ধীর ডান্ডি অভিযান। সাইমন কমিশনের রিপোর্ট। লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকের শুরু। কংগ্রেস এই বৈঠক বর্জন করে। চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত হয়। রাইটার্স বিল্ডিং-এ বিনয়-বাদল-দীনেশের আক্রমণ। বাংলার বিপ্লবীদের গুলিতে ঢাকায় বাংলার আই.জি.পি. লোম্যান নিহত এবং পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট হডসন আহত হন। রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার অপরাধে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক বছরের জেল হয়। কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কর্পোরেশন ভবনে ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন করলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত
বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন সি.ভি. রমন। ‘সীতা’ নাটক প্রদর্শনের জন্যে শিশির ভাদুড়ী আমেরিকা গেলেন। প্রথম বাংলা নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মিত হল। ছবির নাম—’দালিয়া’। কাহিনীকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরিচালক : মধু বসু; জুলাইর ২৬-এ তা প্রথম প্রদর্শিত হল ক্রাউন সিনেমায়
বাঙালি ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কালাজ্বরের ইনজেকশান ‘ইউরিয়া স্টিবামাইন’ আবিষ্কার করেন।
জার্মানিতে নাৎসিদের উত্থান ঘটে। নেতার নাম অ্যাডলফ হিটলার। অন্যান্যদের সহায়তায় ভ্যানেভার বুশ প্রথম কম্পিউটার নির্মাণ করলেন।
এ বছর জন্ম নেওয়া বিখ্যাত ব্যক্তিরা হলেন শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, সুনীলকুমার নন্দী, সুনীল বসু, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, আবদুল্লাহ আল-মুতী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, এম.আর. আখতার মুকুল, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
পরলোক গমন করেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ডি.এইচ. লরেন্স।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান সিনক্লেয়ার লিউইস (১৮৮৫– ১৯৫১)। কথাশিল্পী। আমেরিকান।
পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি লেখেন—
‘For his vigorous and graphic art of description and his ability to create with wit and humour, new types of characters.’
লিউইসের বিখ্যাত রচনাগুলো হল— ‘Our Mr. Wrenn ‘, ‘Hike and the Aeroplane.
প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’, ‘শেষের কবিতা’। ইংরেজিতে বের হল ‘দি রিলিজিয়ন অব ম্যান’। প্রকাশ পায় যথীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ ‘মরুমায়া’, বুদ্ধদেব বসুর কাব্য ‘বন্দীর বন্দনা’, জসীম উদ্দীনের ‘বালুচর’, অজিত দত্তের ‘কুসুমের মাস’, অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘অসমাপিকা’, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের ‘কালের ভেরী’, নজরুলের ‘প্রলয় শিখা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘ঝিলিমিলি’, প্রবোধ সান্যালের ‘প্রিয় বান্ধবী’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘অমাবস্যা’। বের হল রোমা রোলাঁর ‘বিবেকানন্দ জীবনী’, এলিয়টের ‘অ্যাশ ওয়েডে’।
ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিতের ছোট্টগল্প গ্রন্থ ‘চলার পথে’ নিষিদ্ধ হয়। বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের কাব্য ডমরু’ বাজেয়াপ্ত হল।