১৯৪৩। বয়স ৪৪ বছর
১৯৪৩ সালের গোড়ার দিকে অশোকানন্দ দাশ বিয়ে করেন নলিনী চক্রবর্তীকে। নলিনীর ডাকনাম নিনি। বিয়েটা প্রণয়ঘটিত। বিয়ের সময় অশোকানন্দের বয়স ৪২ আর নলিনীর ২৭।
দর্শনশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন নলিনী। ছাত্রীজীবন অত্যন্ত উজ্জ্বল ছিল তাঁর। নলিনী চক্রবর্তী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর দৌহিত্রী। নলিনীর বাবা অরুণনাথ চক্রবর্তী (১৮৮৩— ১৯৭২) আর মা পুণ্যলতা চক্রবর্তী (১৮৮৯–১৯৭৪)। মা-বাবার কনিষ্ঠা কন্যা নলিনী। এই নলিনী চক্রবর্তীই পরবর্তী সময়ে অধ্যক্ষ নলিনী দাশ হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে ১৯৭৫ সালে রাজ্যসরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হন। শিশুসাহিত্যিক ও ‘সন্দেশ’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক ছিলেন তিনি। নলিনী দাশের জ্যেষ্ঠা ভগিনী কল্যাণী কার্লেকরের সঙ্গে প্রথম জীবনে ‘মেয়েদের কথা’ ও উত্তরকালে ‘শ্রাবণী’ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘রা-কা-যে-টে-না-পা’, ‘মধ্যরাতের ঘোড়সওয়ার’, ‘গোয়েন্দা গণ্ডালু’ ইত্যাদি।
১৯৪৩ সালের গোড়ার দিকে গরমের ছুটিতে কলকাতা বেড়িয়ে এলেন জীবনানন্দ। ছোট ভাই অশোকানন্দ নলিনীকে বিয়ে করে টালিগঞ্জের রসা রোডের মোহিনী ম্যানসনে নতুন সংসার পেতেছেন। সেবার অশোকানন্দের বাসাতেই উঠেছিলেন কবি। কয়েকদিন এই নতুন দম্পতির আতিথ্যে কাটিয়ে কবি বরিশালে ফিলে এলেন। সেখান থেকে ভ্রাতৃবধূ নলিনীকে ডাকনামে সম্বোধন করে একটি চিঠি লিখলেন জীবনানন্দ। চিঠির অংশবিশেষ এরকম
‘এবার সুদীর্ঘ গ্রীষ্মের ছুটি কলকাতায় তোমাদের সঙ্গে কাটিয়ে খুবই আনন্দ লাভ করেছি। কলকাতায় গিয়ে এবার নানা রকম অভিজ্ঞতা লাভ হল; সাহিত্যিক, ব্যবসায়িক ইত্যাদি নানারূপ নতুন সম্ভাবনার ইসারা পাওয়া গেল। এর আগে মাঝে মাঝে আমি ২/৪ দিনের জন্য কলকাতায় যেতাম; কিন্তু নানা দিক দিয়ে কলকাতায় সামাজিক, সাহিত্যিক ও অন্যান্য ব্যাপারে যে এরকম সজীব পরিবর্তন এসেছে তা লক্ষ্য করার সুযোগ পাইনি।’ [জীবনানন্দ স্মৃতি ‘ময়ূখ’, পৃ. ২৩৪]
জীবনানন্দ দাশের এ পর্যন্ত প্রকাশিত তিনটি কাব্যকে অবলম্বন করে সঞ্জয় ভট্টাচার্য নিরুক্ত’ পত্রিকার ১৩৫০ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যায় ‘জীবনানন্দ দাশ’ নামে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন। তার কিয়দংশ এরকম–
‘যৌবনের শেষে স্থবিরতার পথে সত্যকে খুঁজতে এগিয়ে গেছেন জীবনানন্দ। এ তাঁর এক সম্পূর্ণ নূতন জগতে অভিযান। এখন আর চোখ তাঁর স্বপ্ন মেদুর নয়, জিজ্ঞাসায় তা প্রখর। মন ছেড়ে মননের পথে এসে কবি দেখলেন, আজকের দিনের জীবন আমাদের জটিল সমস্যায় ঘেরা। বিংশ শতাব্দীর প্রশ্নসমাকীর্ণ জীবনকে যখন তিনি বুঝতে চাইলেন, তখন তাঁর ভাষা থেকেও স্বপ্নের সেই প্রাক্তন কোমল ঋজুতা ঝরে পড়ছে, ক্রমেই এসেছে তাতে গদ্যভঙ্গী, মিশেছে জটিলতা।’ [জীবনানন্দ দাশ’, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ‘নিরুক্ত’, ৩:৪, আষাঢ় ১৩৫০, পৃ. ১৬৫]
নির্জনতার কবি হিসেবে জীবনানন্দকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু।
১৯৪৩ সালে বুদ্ধদেব বসুর ‘দময়ন্তী’ কাব্যটি প্রকাশিত হয়। এই কাব্যের ‘বিচিত্রিত মুহূর্ত শিরোনামাঙ্কিত উত্তর-অংশে ‘জীবনানন্দ দাশ/কবি করকমলে’ উল্লেখ করে নিম্নলিখিত কবিতাটি লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু
‘সে-পথ নির্জন
যে-পথে তোমার যাত্রা।
সে-পথে আসে না অশ্বারোহী,
পদাতিক বীর সৈন্যদল।
অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা নেই, যান-যন্ত্র-মুখরিত নাগরিত জনতার স্রোত নেই,
নেই যোদ্ধা নেই জয়ী, নেই পরাজিত।
সে-পথ সন্ধ্যার।
শুধু সমুদ্রের স্বর, অন্য কোনো শব্দ নেই।
শুধু সমুদ্রের স্রোত, অন্য কোনো গতি নেই।
একটি জ্বলন্ত তারা
আমাদের জ্বলন্ত হৃৎপিণ্ড যেন,
এঁকে যায় সেই পথ স্বচ্ছ নীল ঝলকে ঝলকে
সমুদ্রের মানচিত্র-নীলে।’
এ বছর যাঁরা জন্মেছেন তাঁরা হলেন—আহমদ ছফা, যোগব্রত চক্রবর্তী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, করুণাময় গোস্বামী।
মারা গেলেন নীলরতন সরকার, মানকুমারী বসু, ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ১৯১৭ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী হেনরিক পন্টাপপিদান।
১৯৪৩-এর ৩০ অক্টোবর সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩)-এর জন্মতিথি উদযাপনের মধ্য দিয়ে সিগনেট প্রকাশনার যাত্রা শুরু হয়।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’ গঠিত হয়। সমিতির পক্ষ থেকে কবিকে দু’শত টাকা করে পাঁচ মাস সাহায্য দেওয়া হয়। অবিভক্ত বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক দু’শত টাকা সাহিত্যিক ভাতাও দেওয়া হয় নজরুলকে।
ভারত ও বাংলা গভর্নমেন্টের ঔদাসীন্যে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষ ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। এতে প্রায় ৩০ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটে।
লর্ড লিনলিথগো পদত্যাগ করলে ভারতে ভাইসরয় হয়ে আসেন উত্তর আফ্রিকান যুদ্ধবিজয়ী ব্রিটিশ সেনাপতি লর্ড ওয়াভেল।
সুভাষ বসু বার্লিন থেকে সিঙ্গাপুরে এসে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজে’র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সিঙ্গাপুরে অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হয়। এই সরকারকে সামরিক সাহায্য দিতে জাপান স্বীকৃত হয়।
খাজা নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন।
উত্তর আফ্রিকার কাসাব্লাঙ্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মিলিত হয়ে যুদ্ধনীতি বিষয়ে পরামর্শ করলেন। রুশদের প্রতিরোধে জার্মান বাহিনী পশ্চাদপসরণ করল। জার্মান ও ইতালি বাহিনী আক্রান্ত হয়ে আফ্রিকা ত্যাগ করে। ইতালির নেতা মুসোলিনী পদত্যাগ করলে মার্শাল বাগদালিও ইতালির প্রধানমন্ত্রী হলেন। ইতালি সরকার মিত্রপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করল।
প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রকাশিত হয় শওকত ওসমানের ‘বনি আদম’ উপন্যাস, অমিয় চক্রবর্তীর কাব্য ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’, বুদ্ধদেব বসুর কাব্য ‘বিদেশিনী’, অরুণ মিত্রের কাব্য ‘প্রান্তরেখা’, এস. ওয়াজেদ আলির ‘ভবিষ্যৎ বাঙালি’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পঞ্চগ্রাম’, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘মোহনা’, নীহাররঞ্জন রায়ের ‘রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা’, বনফুলের ‘সে ও আমি’, ‘জঙ্গম’, সমর সেনের ‘খোলা চিঠি’, সুকুমার সেনের ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস-২য় খণ্ড’, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ভারতবর্ষ ও মার্কসবাদ’। প্রকাশ পায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ষষ্ঠ গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বাদ’, উপন্যাস ‘চিন্তামণি’, ‘প্রতিবিম্ব’। ‘নতুন জীবন’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা থেকে বারো কিস্তিতে মানিক ‘খুনী’ নামের একটি উপন্যাস লেখেন। অগ্রন্থিত এই উপন্যাসটি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র’-এর ১১শ খণ্ডে (ডিসেম্বর ২০০৭) সংকলিত হয়েছে।