১৯০৯। বয়স ১০ বছর
বাল্যবয়সের বরিশালের জীবনে খুব বেশি নিজ জেলার বাইরে যাবার সুযোগ পাননি জীবনানন্দ। বাবার অসুস্থতা বরিশালের বাইরে যাবার সুযোগ করে দিল জীবনানন্দকে।
বাবা সত্যানন্দ দাশের অসুস্থতার কারণে মামাবাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে গিরিডিতে বেড়াতে গিয়ে সেখানে কিছুদিন থাকবার সুযোগ পান জীবনানন্দ। নতুন পরিবেশ বালক জীবনানন্দকে খুবই মুগ্ধ করেছিল। উশ্রী নদীর ওপারের ঝুলন্ত সেতু, বালুতটের শিশির-ঝলমল হরিতকী বন তাঁর মর্মতলে জায়গা করে নিয়েছিল। মামাতো ভাইবোনদের নিয়ে হরিতকী বন ছাড়িয়ে ক্রিশ্চান হিল পর্যন্ত চলে যেতেন জীবনানন্দে।
একবার ওই বয়সে নেপালের কাছে মুপোলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল জীবনানন্দের। রোজ সকালে কখনো কখনো সন্ধ্যার সময় জীবনানন্দ ও অশোকানন্দ সেখানকার জনবিরল উদার প্রান্তরে হেঁটে বেড়াতেন। খোলা মাঠে হাঁটতে হাঁটতে আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখে জীবনানন্দ বলতেন, ‘জানিস, বড় হয়ে আমি, এমন নৌকা তৈরি করব, যাতে করে তুই ওই মেঘের মতো আকাশে বেড়াতে পারবি।’ (বাল্যস্মৃতি, অশোকানন্দ দাশ, পৃ. ১৩৭)
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৪৮। রবীন্দ্র-জামাতা শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী ‘Hillary Term’ ব্যারিস্টারি শেষ করে বিলাত থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। কলকাতা হাইকোর্টে কাজও শুরু করেন তিনি। বেলার সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন শরচ্চন্দ্র। সাড়ে তিন বছর পর রথীন্দ্রনাথ আমেরিকা থেকে ফিরে এলেন। পুত্রকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নৌকাযোগে জমিদারি পরিদর্শনে গেলেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় ঘটে নেপালচন্দ্র রায়ের। তাঁর পরিচয় হল নন্দলাল বসুর সঙ্গেও। ‘গীতাঞ্জলি’র গান রচনা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিরোধ চরমে ওঠে। দ্বিজেন্দ্রলাল লিখলেন—
‘‘তুমি যেও না এখনি’ বা ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ ইত্যাদি ‘লম্পটের গান।’
‘চিত্রাঙ্গদা’র বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এনে লিখলেন-
‘এ পুস্তকখানি দগ্ধ করা উচিত।’
দশ বছর বয়সে নজরুল গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষা পাস করেন। এবং সেই মক্তবেই শিক্ষকতা করার সুযোগ লাভ করেন।
বেগম রোকেয়া বিহারের ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
বেগম রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন এ বছর মৃত্যুবরণ করেন (১৮৫৮- ১৯০৯)। তাঁর জন্ম বিহারের ভাগলপুরের এক খানদানি ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম পরিবারে। হাজী মহম্মদ মহসীনের হুগলি কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি। পরে পাটনা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পাস করেন। প্রথম স্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পর ১৮৯৮ সালে রোকেয়াকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় রোকেয়ার বয়স ছিল ১৮ আর সাখাওয়াতের ৩৮। সাখাওয়াত অত্যন্ত ভালো লোক ছিলেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের (১৮২৭–১৮৯৪) পুত্র মুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাখাওয়াতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মুকুন্দদেব সাখাওয়াতকে ‘মহাত্মা পুরুষ’, ‘মাতৃভক্ত’, ‘ত্যাগী’, ‘উদ্যমশীল’, ‘আত্মমর্যাদা সম্পন্ন’ বলেছেন। সাখাওয়াতের কর্মজীবন নানা বৈচিত্র্যে পূর্ণ। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং কৃষি বিভাগের অধিকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষজীবনে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। এবং এই রোগেই ১৯০৯-এর ৩ মে কলকাতাতে তাঁর মৃত্যু হয়। সাখাওয়াত-রোকেয়ার দাম্পত্যজীবন পুরোপুরি সুখের ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর অনেক পরে দাম্পত্যজীবনের পীড়াদায়ক নিরানন্দময় অভিজ্ঞতার কথা এক চিঠিতে রোকেয়া লিখেছিলেন—
‘বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। প্রত্যহ Urine পরীক্ষা করেছি। পথ্য রেঁধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি।’ [‘পত্রে রোকেয়া পরিচিতি’, মোশফেকা মাহমুদ, ঢাকা, ১৩৭১, পৃ. ১৫]।
সতীন-কন্যার বিরূপ আচরণ রোকেয়ার মনে এক গভীর ক্ষোভ ও বেদনার জন্ম দিয়েছিল।
বসন্তরঞ্জন রায়বিদ্বদ্বল্লভ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্লা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গোয়ালঘর থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ আবিষ্কার করেন।
এশিয়াটিক সোসাইটির পক্ষ থেকে রাজপুতানা ও গুজরাটে ভাট-চারণদের পুঁথি সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে। এ বছরেই তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর বিশিষ্ট সদস্য নির্বাচিত হন।
সতীশচন্দ্র আচার্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম ডক্টরেট হন। ‘হ্যামলেট’ নাটকে শিশিরকুমার ভাদুড়ী মঞ্চে প্রথম অভিনয় করলেন। বরিশালে বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অপরাধে দুর্গামোহন সেনকে একঘরে করা হল।
পারস্য-শাহ মুহম্মদ আলী সিংহাসনচ্যুত হয়ে রাশিয়ার ওডেসা বন্দরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১১ বছর বয়স্ক পুত্র আহমদ মির্জা রাজপদে অভিষিক্ত হলেন।
বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড মৃত্যুবরণ করেন। ফরাসি বৈমানিক লুই ব্লেরিয়ট বিমানে করে প্রথমবারের মতো ইংলিশ চ্যানেল পার হন। ফোর্ড কোম্পানি সাধারণের ব্যবহার্য মোটর গাড়ি প্রথম রাস্তায় নামাল।
এ বছর মৃত্যুবরণ করেন নবীনচন্দ্র সেন, রমেশচন্দ্র দত্ত, সুইনবার্ন, মেরেডিথ।
আর যাঁরা জন্মেছেন, তাঁরা হলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, আশুতোষ ভট্টাচার্য, সুবোধ ঘোষ। এ বছর জন্মালেন বিষ্ণু দে, [১৮ জুলাই, কলকাতার টেমার লেনের মাতুলালয়ে। পিতা: অবিনাশচন্দ্র দে, মাতা: মনোহারিণী। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার পঞ্চম সন্তান।।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান সেলমা লাগেরলফ্ (১৮৫৮–১৯৪০)। ইনি প্রথম মহিলা নোবেল প্রাপক। সুইডেনের কথাকার তিনি।
তাঁর সম্পর্কে নোবেল কমিটির মন্তব্য এ রকম—
‘Appreciation of the lofty idealism, vivid imagination and perfection that characterize her writings’.
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ— Gosta Berlings Saga (2 vols), ‘ Invisible Links’, ‘The Wonderful Adventures of Nils’, ‘Anna Svard.’
প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’ (১-৮), ‘শব্দতত্ত্ব’, ‘ধর্ম’, ‘প্ৰায়শ্চিত্ত’, ‘চয়নিকা’, ‘গান’, ‘বিদ্যাসাগর চরিত’, ‘শিশু’। এ বছর প্রকাশিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল-মীর মশাররফ্ হোসেনের ‘আমার জীবন’, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ইংরেজ বর্জিত ভারতবর্ষ’, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সাজাহান’, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতশিল্প। প্রকাশিত হয় গলস্ওয়ার্দির ‘স্ট্রাইফ’, রাইনার মারিয়া রিলকের ‘রিকুয়েমস্’।