1 of 2

১৯২৭। বয়স ২৮ বছর

১৯২৭। বয়স ২৮ বছর 

৪৭ পুরানা পল্টন, ঢাকা থেকে জুলাই মাসে ‘প্রগতি’ পত্রিকা প্রথম মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয় [পত্রিকাটি প্রথমে হাতে লেখায় প্রকাশিত হয়েছিল]। সম্পাদক : বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্ত। প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘খুশ-রোজী’ নামক কবিতাটি ছাপা হয়। কবির নাম—’শ্রীজীবনানন্দ দাশগুপ্ত’। ‘খুশ-রোজী’ কবিতাটি পরে ‘ঝরা পালক’ কাব্যে অন্তর্গত হয়ে প্রকাশিত হয়। তখন কবিতাটির শিরোনাম হয় ‘যে কামনা নিয়ে।’ প্রথম বর্ষের পরবর্তী সংখ্যাগুলোতেও তাঁর পদবি ‘দাশগুপ্ত’ উল্লিখিত হয়েছে। এ সময় প্রচুর কবিতা লিখেছেন জীবনানন্দ। জীবনানন্দের এই সময়ের কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) ও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)-এর বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এই সময়েই কবি তাঁর পদবি ‘দাশগুপ্ত’ ছেঁটে ‘দাশ’ লিখতে শুরু করেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-এর বিখ্যাত কবিতা ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘বোধ’ ইত্যাদি ‘প্রগতি’তে প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার মাধ্যমেই বুদ্ধদেব বসু প্রথম জীবনানন্দের পক্ষে জোরালো সওয়াল-জবাব করেছিলেন। 

মাসিকরূপে ‘শনিবারের চিঠি’র নব পর্যায়ে (বছর খানেক বন্ধ থাকার পর) পুনঃপ্রকাশ ঘটে [১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ৯ ভাদ্র থেকে] সম্পাদক : যোগানন্দ দাস (১৮৯৩–১৯৭৯) হলেও প্রকাশ্য-পরিচালক ছিলেন সহ-সম্পাদক সজনীকান্ত দাস (১৯০০–১৯৬২)। 

‘শনিবারের চিঠি’র পরিচালনমণ্ডলীর অনেকেই ‘কল্লোল’-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। উভয় পত্রিকার সম্পর্ক মধুর হবার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিক্ত হল। অল্পসময়ের মধ্যে উভয় পত্রিকার কলহ প্রকাশ্যে রূপ পেল। ‘শনিবারের চিঠি’র প্রধান লক্ষ্য হল আধুনিক সাহিত্যিকদের বীভৎস বিরোধিতা করা। পরবর্তী কয়েক বছরে অতি-আধুনিক সাহিত্যিকদেরকে তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে ক্ষতবিক্ষত করাই শনিবারের চিঠি’র প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। 

ক্রমাগত শরবর্ষণ’ ও ‘আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য’ হয়ে উঠেছিলেন জীবনানন্দ। সাময়িকপত্রে প্রকাশিত তাঁর কবিতার পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে অভব্য ভাষায় বিদ্রূপ করা হতে থাকে ‘শনিবারের চিঠি’তে। প্রায়ই তাঁর নামের বিকৃত উচ্চারণে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে নঞর্থক ইঙ্গিতে ‘জীবানন্দ নহে’ বা ‘জিহ্বানন্দ নহে’ বলে উল্লেখ করা হতো। 

১৯২৭ সালে প্রকাশিত ‘ঝরা পালক’ কাব্যে জীবনানন্দের পদবি লেখা হয় ‘দাশ’। তবে ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ, পৌষ সংখ্যা) ‘ঝরা ফসলের গান’ কবিতায় কবির পদবি ‘দাশ’ সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়। সর্বানন্দ নিজের নামের শেষে ‘দাস’ লিখতেন। তাঁর পুত্ররা আমৃত্যু নিজেদের পদবি ‘দাস’ লিখেছেন। জীবনানন্দও বিশ্ববিদ্যালয় কাল পর্যন্ত ‘দাস’ পদবিই লিখে গেছেন। কিন্তু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখা শুরু করলে নিজের পদবি ‘দাশগুপ্ত’ ব্যবহার করতে থাকেন জীবনানন্দ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বৈদ্যজাতির লোকদেরকে একসময় এরকম পদবি লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। 

জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্য ‘ঝরা পালক’-এর প্রকাশ। গ্রন্থটিতে প্রকাশকালের উল্লেখ নেই। তবে ভূমিকায় জীবনানন্দ উল্লেখ করেছেন ‘ঝরা পালক’-এর প্রকাশকাল : ১০ আশ্বিন ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ। [প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল কার্তিকের শেষে কিংবা অগ্রহায়ণের প্রথম দিকে। সূত্র : ‘জীবনানন্দ দাশ’, প্রভাতকুমার দাস, পৃ.২২]। কাব্যটির প্রকাশক ছিলেন সুধীরচন্দ্র সরকার (যদিও গ্রন্থটি সম্পূর্ণ কবির টাকায় মুদ্রিত)। ৯০/২ এ হ্যারিসন রোড, কলিকাতা থেকে প্রকাশিত। মুদ্রাকর : এ. চৌধুরী, ফিনিক্স প্রিন্টিং ওয়ার্কস, ২৯ নং কালিদাস সিংহ লেন, কলিকাতা। প্রচ্ছদ : গায়ে জলপাই রঙের লিনেন ফিনিস্ মলাট কাগজের ওপর ডানদিকে/বামদিকে, আড়াই ইঞ্চি/চার ইঞ্চি মাপের পৃথকভাবে সাঁটা নীল রঙের জরির ওপর রিভার্স-এ নামাক্ষর এবং আটটি ছোটবড় পালকের ছবি। প্রথমে গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ। ইনি ‘কল্লোল’ ও ‘শনিবারের চিঠি’রও প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। তাঁর আঁকা ‘মস্ত এক পালকের ছবি’ ওয়ালা প্রচ্ছদটি জীবনানন্দের পছন্দ হয়নি। ফলে কবি প্রথম আঁকা এই প্রচ্ছদটি ‘ঝরা পালকে’ ব্যবহার করেননি। [সূত্র : ‘আমি চলে যাবো’, ইন্দ্ৰ মিত্র 

উৎসর্গ : কল্যাণীয়াসু [জীবনানন্দের কাকা অতুলানন্দের কন্যা শোভনা]। 

শোভনার ডাকনাম খুন্তি (১৯১৩-২০০৩)। ইঞ্জিনিয়ার সুহৃদ মজুমদারের সঙ্গে বিয়ে হয় শোভনার। শোভনার জন্ম আসামের ডিব্রুগড়ে। গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস। 

শোভনা যখন এইট কি নাইনের ছাত্রী, ওইসময় জীবনানন্দ কাকা অতুলানন্দের বাড়িতে (আসামের ডিব্রুগড়ে) গিয়েছিলেন। বেড়াতে নয়, কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায় কি না, এই উদ্দেশ্যে। চার-পাঁচ মাস একটানা ছিলেন। সেবার মিলুদাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল শোভনার। একাকী ঘরের দরজা বন্ধ করে কবিতা লিখতেন জীবনানন্দ। নতুন কোনো কবিতা শোভনাকে পড়ে শোনাতেন। এসব শোভনার মা সরযূবালা পছন্দ করতেন না। জীবনানন্দ কাকীর সঙ্গেও তেমন করে মিশতেন না। কাকীমা শোভনাকে ধমকের ওপর রাখতেন। 

‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হবার পর এক কপি ডাকযোগে শোভনার কাছে পাঠিয়েছিলেন জীবনানন্দ। কিন্তু সেই খবরটা অনেকদিন গোপন রেখেছিলেন শোভনা। ম্যাট্রিক পাসের পর শোভনা চলে এলেন ডায়েসেশন কলেজ হোস্টেলে। হোস্টেলের কড়া নিয়মকানুন মেনেই জীবনানন্দ-শোভনার মধ্যে সাক্ষাৎ হতো হোস্টেল গেটে। শোভনাকে নিরন্তর কাছে পাওয়ার জন্যে নিজে নিজে স্বপ্নজাল রচনা করে গেছেন জীবনানন্দ। শোভনার পক্ষ থেকে একধরনের নিরাসক্তিই ছিল। জীবনানন্দের দিনপঞ্জিতে শোভনার উল্লেখ ছিল ‘বি ওয়াই’, পরে শুধু ‘ওয়াই’ নামে। 

মূল্য : এক টাকা। 

ক্রাউন ৮ পেজি, পৃ. [১০] + ৯৩। কাগজে বাঁধাই। 

‘ঝরা পালকে’র ভূমিকা এ রকম— 

‘ঝরা পালকে’র কতকগুলি কবিতা ‘প্রবাসী’, ‘বঙ্গবাণী’, ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’, ‘প্রগতি’, ‘বিজলি’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশ হইয়াছিল। বাকীগুলি নূতন।

শ্রীজীবনানন্দ দাশ 
কলিকাতা 
১০ আশ্বিন, ১৩৩৪ 

‘ঝরা পালকে’ কবিতার সংখ্যা : ৩৫। 

কবিতাগুলোর শিরোনাম নিম্নরূপ— 

১. আমি কবি—সেই কবি, ২. নীলিমা, ৩. নব নবীনের লাগি, ৪. কিশোরের প্রতি, ৫. মরীচিকার পিছে, ৬. জীবন-মরণ দুয়ারে আমার, ৭. বেদিয়া, ৮. নাবিক, ৯. বনের চাতক—মনের চাতক, ১০. সাগর-বলাকা, ১১. চলছি উধাও, ১২. একদিন খুঁজেছিনু যারে— ১৩. আলেয়া, ১৪. অন্তচাঁদে, ১৫. ছায়া-প্রিয়া, ১৬. ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার কুমার, ১৭. কবি, ১৮. সিন্ধু, ১৯. দেশবন্ধু, ২০. বিবেকানন্দ, ২১. হিন্দু-মুসলমান, ২২. নিখিল আমার ভাই, ২৩. পতিতা, ২৪. ডাহুকী, ২৫. শ্মশান, ২৬. মিশর, ২৭. পিরামিড, ২৮. মরুবালা, ২৯. চাঁদনীতে, ৩০. দক্ষিণা, ৩১. যে কামনা নিয়ে, ৩২. স্মৃতি, ৩৩. সেদিন এ ধরণীর, ৩৪. ওগো দরদিয়া, ৩৫. সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়। কবিতাগুলোর রচনাকাল : ১৯২৫ থেকে ১৯২৭ সাল। 

অবনীন্দ্রনাথকে জীবনানন্দের ‘ঝরা পালকে’র উপহার লিপি– 

‘পরম পূজনীয় শিল্পাচার্য্য/শ্রীযুক্ত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর 
মহাশয়ের /শ্রীচরণ কমলেষু/শ্রীজীবনানন্দ দাশ। 

বন্ধু অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে জীবনানন্দের ‘ঝরা পালক’ উপহার লিপি 

‘অচিন্ত্যকে/জীবনানন্দ।’ 

‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হওয়ার পর নানাজনে নানা মন্তব্য করেন। 

১. ‘ঝরা পালক’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু সেই মন্তব্যসহ চিঠিটি আজও অনাবিষ্কৃত। 

২. ‘কল্লোল’ (অগ্রহায়ণ ১৩৩৪)-এ ‘প্র’-স্বাক্ষরিত জীবনানন্দের ‘ঝরা পালক’ গ্রন্থের একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়। তার কিয়দংশ- 

‘‘ঝরা পালক’ কবিতার বই, শ্রীজীবনানন্দ দাশগুপ্ত প্রণীত। দাম এক টাকা। কয়েক বছরের মধ্যেই শ্রীজীবনানন্দ দাশগুপ্ত কাব্যসাহিত্যে আপনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তরুণ কবির সমস্ত কবিতাতেই তারুণ্যের উল্লাস ধ্বনিত। তাঁর ছন্দ, ভাষা, ভাব সবেতেই বেশ বেগ আছে। ত্রুটি যা কিছু আছে তা কখন কখন সেই বেগের অযথা আতিশয্য। নজরুল, মোহিতলালের প্রভাব তিনি এড়াতে পারেননি বটে কিন্তু সে প্রভাবকে নিজের বৈশিষ্ট্যের পথে ফেরাতে পেরেছেন বলে মনে হয়।’

৩. ‘সম্মিলনী’ (১ মাঘ ১৩৩৪)-তে ‘ঝরা পালকে’র আলোচনা বের হয়। এই লেখাটিতে লেখকের কোনো নাম ছিল না। লেখাটির কিয়দংশ এরকম— 

‘জীবনবাবু সিটি কলেজের ইংরাজীর অধ্যাপক, সাহিত্য চর্চ্চা তাঁর ঘরে বাইরে। মব্রতের সঙ্গে তাঁর কর্মব্রতের কোনো বিরোধ হয়নি। জীবনবাবুর পরিচয় অনাবশ্যক-বাংলাদেশের মাসিক সাহিত্যে তিনি তরুণ পরিষদে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। বই-এর (ঝরা পালক) কবিতাগুলো রসজ্ঞ পাঠকগণ কোন না কোন মাসিকে আগেই পড়ে থাকবেন।’ 

উপসংহারে প্রবন্ধকার লিখেছেন— 

‘জীবনানন্দ যেন সাহিত্য সাধনার অবসর গান —তাঁর মধ্যে যতটুকু প্রতিভা প্রচ্ছন্ন আছে, তাঁর জীবনে যতটুকু আনন্দ অবরুদ্ধ আছে তার সবটুকু যেন পরিপুষ্ট হয়ে পরিস্ফুট হতে সুযোগ পায়—তাঁর মর্ম্মকোষের ডিম্বে নিহিত মূক সঙ্গীত যেন গগনময় মুখর হয় রঙীন লঘুচঞ্চল ‘ওড়া পালকের’ ভরে।’ 

এই প্রবন্ধে লেখকের নাম স্বাক্ষরিত না থাকলেও ‘শনিবারের চিঠি লেখকের নাম বের করে ফেলেছিলেন। লেখক ছিলেন কালিদাস রায়। ‘শনিবারের চিঠি’ ‘সংবাদ সাহিত্য’ বিভাগে (মাঘ ১৩৩৪, নব পর্যায়, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, পৃ. ৪৬৫-৬৬) লেখা হল- 

‘একে মর্ম্মকোষ, তাহার আবার ডিম্ব, তাহাতে নিহিত সঙ্গীত সেও মূক। সেই মূক সঙ্গীত মুখর হইবে রঙীন লঘুচঞ্চল ‘ওড়া পালকে’র ভরে। বাপরে বাপ্। কবিতার সমালোচক তো পাওয়া গেল। কিন্তু এই সমালোচনার টাকা করিবার উপযুক্ত মল্লিনাথ কোথায়? ছেলেবেলায় একটা গান শুনেছিলাম, তাহার অর্থ-বোধ আজিও হইল না। সম্ভবত কালিদাসবাবুর সমালোচনার অর্থের সহিত সেই গানের অর্থেরও সামঞ্জস্য আছে।’ 

এখানেই ‘শনিবারের চিঠি’ ক্ষান্ত হয়নি। এই লেখার সঙ্গে ওই গানটিও উদ্ধৃত করেছিল। গানটি নিম্নরূপ— 

হামানদিস্তা মন— 
কাম-পানেরে বিবাগী খল ছেঁছে অনুক্ষণ। 
হৃদয়-মৰ্ম্ম কোষো— 
রিপু-হংস ডিম পেরেছে তা দিচ্ছ তায় বসে— 
হায়রে অকিঞ্চন! 
ঝরবে পালক, মন-বলাকা চলবে বৃন্দাবন। 

এরকম সমালোচনা জীবনানন্দকে ভীষণ বিষণ্ণ করে তোলে। একজন প্রকৃত বন্ধুর সংঘ- সুখের জন্যে তিনি আকুলিত হয়ে ওঠেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে এই সময় একটি চিঠি লেখেন জীবনানন্দ। চিঠির কিয়দংশ এরূপ 

‘চারদিকেই বে-দরদীর ভিড়। আমরা যে কটি সমানধর্মা আছি, একটা নিরেট অচ্ছেদ্য মিলন-সূত্র দিয়ে আমাদের গ্রথিত করে রাখতে চাই। আমাদের তেমন পয়সাকড়ি নেই বলে জীবনের ‘Creature Comforts’ জিনিসটা হয়তো চিরদিনই এড়িয়ে যাবে; কিন্তু একসঙ্গে চলার আনন্দ থেকে আমরা যেন বঞ্চিত না হই–সে পথ যতই পর্ণমলিন, আতপক্লিষ্ট, বাত্যাহত হোক না কেন।’ (কল্লোলযুগ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ডি. এম. লাইব্রেরি, কলকাতা, পৃ. ১০৭) 

এই বেদনাদীর্ণ সময়ে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬১)-এর কাছ থেকে জীবনানন্দের নিকট একটি চিঠি এল। তখন ধূর্জটিপ্রসাদ লখনউ-এর বাদশাবাগে থাকতেন। প্রকাশিত হবার পর জীবনানন্দ ধূর্জটিপ্রসাদকে এক কপি ‘ঝরা পালক’ পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল একটি চিঠি। এর উত্তরে ধূর্জটিপ্রসাদ ৬.১২.১৯২৭ তারিখে জীবনানন্দকে লেখেন— 

‘আপনার প্রেরিত পুস্তকখানা যথাসময়ে এসে পৌঁছেছে। বাড়ী বদল করেছি বোলে বড় গোলমালে ছিলাম। ঝরা পালক উড়তে উড়তে আমার গায়ে কী করে এল ভেবে পাই না। তবুও সেটিকে শ্রদ্ধা সহকারে গ্রহণ করছি। যে পাখী ভোরে পূর্ব গগনে উঠে পশ্চিমে রং- এর ভিয়ানে আত্মগোপন করে, এ কি সেই পাখীর পালক? না যে পাখী সূর্য্যাস্তের গরিমায় জন্ম নিয়ে সারারাত কাতর হয়ে ডাকতে ডাকতে ভোর হবার পূর্বেই ক্লান্ত হয়ে বনান্তের গোপন নীড়ে আশ্রয় নেয়, সেই পাখী? উল্লেখ্য, এই চিঠিতে ধূর্জটিপ্রসাদ জীবনানন্দকে ‘জীবানন্দবাবু’ বলে সম্বোধন করেছেন। জীবনানন্দেরও রসবোধ কম ছিল না। ধূর্জটিপ্রসাদের চিঠির প্রত্যুত্তরে জীবনানন্দ লিখলেন— 

‘আমার মনে হচ্ছিল ঝরা পালকের পলকা ফুঁয়ে আপনার ঘুম জমবে ভালো। কিন্তু জানতে পারচি পালকের অত্যাচারে নিদ্রার ব্যাঘাত হয়েছে। কিন্তু তবুও চোখে ঘুমের ঘোর ছিল, তাই আমাকে ‘জীবানন্দবাবু’ বলে সম্ভাষণ করেছেন। আমি কিন্তু জীবনানন্দবাবু বুঝলেন?’ (‘চিঠিপত্র’, ‘জীবনানন্দ’ শতবার্ষিক আলোচনা ও প্রদর্শনী, বাংলা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভূমেন্দ্র গুহ, মার্চ, ১৯৯৯, পৃ. ২১ ) 

কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিককে (১৮৮৩-১৯৭০) জীবনানন্দ এক কপি ‘ঝরা পালক’ পাঠিয়েছিলেন। মাথরুন থেকে ১২.১২.১৯২৭ তারিখে একটি চিঠি লিখে নিজের অভিব্যক্তি জানান কুমুদরঞ্জন মল্লিক— 

‘‘ঝরা পালক’ উপহার পাইয়া এবং পাঠ করিয়া আহ্লাদিত হইলাম। এ কোন রহস্যময় পরীরাজ্যের অচেনা পাখার ঝরা পালক, না এ বাণী স্বর্ণসরালের ঝরা পালক। আলো ও রঙের ঝিলিমিলির অপূর্ব্ব সমাবেশ।” 

রবীন্দ্রনাথের বয়স ৬৬। জোড়াসাঁকোর ভবনে ‘নটীর পূজা’য় অভিনয় করে নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী দেবী অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়ালেন। এটা ছিল পাবলিকের সামনে শান্তিনিকেতনের ছাত্রীদের প্রথম নৃত্যাভিনয়। 

ভরতপুরের রাজা কিষণ সিংহের আমন্ত্রণে ‘হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে’ সভাপতিত্ব করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ রাজপুতনায় গেলেন। ভ্রমণ করলেন জয়পুর, আহমেদাবাদ। মে মাসে সপরিবারে আসামে গেলেন। ‘তিনপুরুষ’ উপন্যাস (যেটি ‘যোগাযোগ’ নামে প্রকাশিত) লেখা শুরু করলেন। 

কলকাতায় ফিরে দূরপ্রাচ্যে যাত্রা করলেন জুলাই-এ। ভ্রমণ করলেন সিঙ্গাপুর, মালাক্কা, কুয়ালালামপুর, তাইপিং, মালয়, জাভা, বালিদ্বীপ ইত্যাদি দেশ। সর্বত্র বিপুল সমাদর পেলেন। অক্টোবরে কলকাতায় ফিরলেন। হায়দরাবাদের নিজাম মীর উসমান আলী খাঁ বিশ্বভারতীতে ‘আরবি বিভাগ’ চালু করার জন্যে ১ লক্ষ টাকা পাঠালেন। 

বুদ্ধদেব বসু প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষা পাস করলেন। এজন্যে তিনি মাসিক কুড়ি টাকা হিসেবে বৃত্তি পেলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান অধ্যাপক ও বিজ্ঞান বিভাগের ডীন পদ লাভ করেন। 

বরিশালের কুলকাঠি গ্রামের মসজিদের সামনে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এড়াবার জন্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. রান্ডির আদেশে পুলিশরা মুসলমানদের ওপর গুলি চালায়। এতে ১৯ জন নিহত হয়। 

মিশরের জাতীয় দলের নেতা সা’দ জগলুল পাশা প্রাণত্যাগ করেন। 

ব্রিটেনে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে আইন পাস হল। বিমানে করে প্রথমবারের মতো সিন্ডবার্গ আটলান্টিক পার হলেন। ব্রাসেলসে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সভা’ স্থাপিত হল। এর অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। 

এ বছর জন্মেছেন লোকনাথ ভট্টাচার্য, রাজলক্ষ্মী দেবী, আতোয়ার রহমান, আশরাফ সিদ্দিকী, কাজী দীন মুহাম্মদ, গল্পকার নাজমুল আলম, মুস্তফা নূরউল ইসলাম, শহীদুল্লাহ কায়সার। 

পরলোক গমন করেছেন যোগীন্দ্রনাথ বসু, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। 

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন ফ্রান্সের দার্শনিক লেখক আঁবী বার্গাস (১৮৫৯–১৯৪১)। 

নোবেল কমিটি পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে লেখেন— 

‘In recognition of his rich and vitalising ideas, the brilliant skill with which they have been presented.’ 

বার্গাসের বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল—’ক্রিয়েটিভ ইভোলিউশন’, টাইম অ্যান্ড ফ্রি উইল’, ‘ম্যাটার অ্যান্ড মেমারি’ 

প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : রবীন্দ্রনাথের ‘লেখন’ ও ‘ঋতুরঙ্গ’ প্রকাশ পায়। ‘বিচিত্রা’য় ধারাবাহিকভাবে বেরোতে থাকে ‘যোগাযোগ’। জসীম উদ্দীনের প্রথম কাব্য ‘রাখালী’-এর প্রকাশ। মোহিতলাল মজুমদারের ‘বিস্মরণী’, গিরীন্দ্রশেখর বসুর ‘স্বপ্ন’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘বেদে’ প্রকাশিত হয়। বের হয় আবুল ফজলের ‘চৌচির’, নজরুলের ‘ফণি-মনসা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘বাঁধন-হারা’, পরশুরামের ‘কজ্জলী’, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমরা কি ও কে’। 

ঢাকা থেকে বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত ‘প্রগতি’ প্রকাশ করলেন। [‘প্রগতি’র জন্ম হল ১৩৩৪-র আষাঢ়ে। ভাদ্র ১৩৩৪-এর ‘কল্লোল’-এ ‘প্রগতি’র পরিচয় দেওয়া হল এভাবে- ‘প্রগতি’সচিত্র মাসিক পত্রিকা। ঢাকা ৪৭ নং পুরানা পল্টন হইতে প্রকাশিত। শ্রীঅজিতকুমার দত্ত ও শ্রীবুদ্ধদেব বসু কর্তৃক সম্পাদিত। প্রতি সংখ্যা চার আনা মাত্র। বার্ষিক মূল্য তিন টাকা ছয় আনা। এই পত্রিকাখানি কিছুকাল পূর্ব্বে হাতে লিখিয়া বাহির হইত। এই আষাঢ় মাস হইতে ছাপিয়া বাইর হইল। পত্রিকাখানি ছোট হইলেও ইহার লেখা প্রভৃতি পড়িয়া মনে হয়, এই পত্রিকা পরিচালনায় যাঁহারা প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাঁহাদের শক্তি ও আদর্শে বিশিষ্টতা আছে। আমরা এই পত্রিকাখানির সর্ব্বাঙ্গীন কল্যাণ কামনা করি]। শনিবারের চিঠি’ মাসিক আকারে বের হল। ‘গণবাণী’ পত্রিকায় ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র প্রথম বঙ্গানুবাদ ছাপা হয়, আবদুল কাদির প্রমুখের উদ্যোগে ‘শিখা’ পত্রিকা প্রকাশিত হল। 

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ হল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *