১৯৩৯। বয়স ৪০ বছর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯–১৯৪৫) অব্যবহিত পূর্বে কলকাতার সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে দুটো বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বুদ্ধদেব বসু তখন বিতর্কিত। কবিতাভবন বাংলাকাব্য সংকলন প্রকাশ করার উদ্যোগ নিল। এই গ্রন্থের সম্পাদনার দায়িত্ব পেলেন দু’জন অকবি—আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬– ১৯৮২) ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (১৯০৭–২০০৪)। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামের এই সংকলনটি ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে বের হল। এই সংকলনে গৃহীত হল জীবনানন্দের চারটি কবিতা—’পাখিরা’, ‘শকুন’, ‘বনলতা সেন’ ও ‘নগ্ন নির্জন হাত’। এই সংকলনে ‘সমাজ সচেতন’ কবিতার প্রাধান্যে বুদ্ধদেব বসু খুব অসন্তুষ্ট হন। পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন—
‘আমার পক্ষে সবচেয়ে বড় বেদনার কারণ জীবনানন্দ – যাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র পরেও আরো অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা বেরিয়ে গেছে ততদিনে, অথচ যিনি স্থান পেয়েছিলেন অতি সংকীর্ণ : আমি বহু তর্ক করেও অন্যদের বোঝাতে পারিনি যে জীবনানন্দ শুধু ‘বর্ণনাধর্মী’ লিপিকার নন, অতি গভীর ভাবনা-ঋদ্ধ এক কবি, আমাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।’ [আমাদের কবিতাভবন’, বুদ্ধদেব বসু, দেশ শারদীয় ১৩৮১, পৃ. ২২]
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৮ বছর। জানুয়ারিতে ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম মাণিক্য শান্তিনিকেতনে এলেন; ঘুরে গেলেন কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু। জওহরলাল হিন্দিভবনের উদ্বোধন করতে এলেন। শান্তিনিকেতন বেড়িয়ে গেলেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ, কলকাতার লর্ড বিশপ মেট্রোপলিটন, কবিবন্ধু দানবীর রাজা সূর্যপাল সিং, কেরলকবি ভারতনাট্যম বিশারদ বেল্লেখোল।
পুরীর রাজা রবীন্দ্রনাথকে ‘পরম গুরু’ উপাধি প্রদান করলেন। মংপুতে গ্রীষ্মযাপন করতে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। চীনের ওপর জাপানের অত্যাচারে কবির মন অবসন্ন। সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্র রচনাবলীর ১ম খণ্ড প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের পৌত্রী (পালিত) নন্দিনীর বিবাহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতে সভাসমিতি নিষিদ্ধ হল। সুভাষচন্দ্রের পূর্ণ-স্বরাজের দাবি দক্ষিণপন্থী কংগ্রেসীদের দ্বারা অগ্রাহ্য হলে তিনি পদত্যাগ করেন।
মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায়।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে প্রথম বেতার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু।
রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত। জাপান চীনের উপকূলস্থ হেইনান দ্বীপ অধিকার করে। মুসোলিনী আলবেনিয়া অধিকার করে।
শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। একদিক থেকে জার্মানি অন্যদিক থেকে রাশিয়া পোল্যান্ড আক্রমণ করে। উভয়ে মিলে পোল্যান্ড ভাগাভাগি করে নেয়। রাশিয়া দ্বারা ফিনল্যান্ড আক্রান্ত হয়।
এ বছর জন্মেছেন দিব্যেন্দু পালিত, আনন্দ ঘোষ হাজরা, ওমর আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, রিজিয়া রহমান, হায়াৎ মামুদ, হাসনাত আবদুল হাই, হাসান আজিজুল হক, খালেদা এদিব চৌধুরী।
আর মারা গেছেন জলধর সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, ইয়েটস্, রোমা রোলাঁ।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ইমিল সিল্লানপা (১৮৮৮–১৯৬৪)। কথাশিল্পী। ফিনল্যান্ডের অধিবাসী।
নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি লেখেন—
‘For his deep comprehension and exquisite art in painting the nature of his country and the life of its peasants in their mutual relations.’
ইমিল সিল্লানপার বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল- ‘The Maid Silja’, ‘ A Man’s Way’, ‘The Fifteenth’, ‘People in the Summer Night’.
প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের ‘প্রহাসিনী’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শ্যামা’, ‘পথের সঞ্চয়’, ‘রবীন্দ্র রচনাবলী-১ম ও ২য় খণ্ড’। বের হয় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পৃথিবী’, অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠো’, মনীন্দ্র রায়ের ‘ত্রিশঙ্কু’, অজয় ভট্টাচার্যের ‘ঈগল’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রীদেবতা’, গোপাল হালদারের ‘একদা’, প্রমথনাথ বিশীর রবীন্দ্র কাব্যপ্রবাহ, সুকুমার সেনের ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা, সুবোধ বসুর উপন্যাস ‘পদ্মা প্রমত্তা নদী’। প্রকাশিত হয় আশুতোষ ভট্টাচার্যের ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ‘শ্রীমধুসূদন’, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’। [এটি ODBL-এরই পরিপূরক গ্রন্থ। এ গ্রন্থ রচনায় সুনীতিকুমারের পথপ্রদর্শক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উনিশ শতক জুড়ে বাংলা ব্যাকরণ চর্চা ছিল সংস্কৃতের বিশ্বস্ত অনুসরণ। খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ রচনার দাবি তুলতে শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। সুনীতিকুমারের এই ব্যাকরণ বইটি এই দাবিরই সার্থক ফলশ্রুতি]।
প্রকাশ পায় জেমস জয়েসের ‘ফিনেগানস ওয়েক’।
প্রকাশিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ‘সরীসৃপ’ (আগস্ট)। সেপ্টেম্বর মাসে সম্পূর্ণ উপন্যাস ‘সহরতলী’ মুদ্রিত হয় শারদীয় ‘আনন্দবাজার-এ। পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় সম্পূর্ণ উপন্যাস মুদ্রণের ঘটনা এই প্রথম এবং এর মধ্যদিয়ে বিশেষ সংখ্যায় সম্পূর্ণ উপন্যাস প্রকাশের রীতি সূচিত হল।