১৯৪৪। বয়স ৪৫ বছর
ইংরেজি তরজমায় বাংলা কবিতার একটা সংকলন প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছিল সিগনেট প্রেস; সময়: চল্লিশ দশকের প্রথম পর্ব। জীবনানন্দের নিজের কিছু কবিতা অনুবাদ করে পাঠাবার জন্যে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৯৩) জীবনানন্দকে বরিশালের ঠিকানায় চিঠি লেখেন। এই সংকলনটির প্রধান অনুবাদক মার্টিন কার্কম্যান আর সম্পাদক হলেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। উত্তরে জীবনানন্দ দাশ ১০.০৩.৪৪ তারিখে দেবীপ্রসাদকে লিখলেন—
‘সম্প্রতি University-র পরীক্ষার খাতা দেখতে বড় ব্যস্ত আছি। আপনাদেরও সময় অল্প। নতুন তর্জমার কিংবা পুরনো অনুবাদ (যদি পাওয়া যায়) শোধরাবার সময় তো আমার হাতে এখন নেই। তর্জমার ওস্তাদ অমিয়বাবু এবং বুদ্ধদেব বসু। তাঁরা যদি আমার কোনো কবিতা—’বনলতা সেন’, ‘নগ্ন নির্জন হাত’, ‘মাঠের গল্প’, ‘ক্যাম্পে’, ‘সহজ’, ‘পাখিরা’, ‘শকুন’ (এ ক’টির ভেতর থেকে তাঁদের রুচি অনুযায়ী কয়েকটি) এবং তাঁদের পছন্দমতো আমার আধুনিকতর ‘সমাজ সচেতন’ কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেন, তাহলে আনন্দিত হব।’ [‘জীবনানন্দ দাশের কাব্য সংগ্রহ’, পৃ. ৮৪০-৪১ ]।
জীবনানন্দের চতুর্থ কবিতাগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশিত হল (শ্রাবণ ১৩৫১ বঙ্গাব্দ)। এর আগের তিনটি কাব্যই নিজের খরচে প্রকাশ করেছিলেন জীবনানন্দ। এই প্রথম তিনি প্ৰকাশক পেলেন। প্রকাশক : পূর্ব্বাশা লিমিটেডের সত্যপ্রসন্ন দত্ত (১৯১১–১৯৯৮)।
মহাপৃথিবী : প্রথম প্রকাশ : ১৩৫১ বঙ্গাব্দ, ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ।
প্রকাশক ও মুদ্রক : সত্যপ্রসন্ন দত্ত, পূৰ্ব্বাশা লিমিটেড, পি-১৩, গণেশচন্দ্ৰ এভিন্যু।
উৎসর্গ : প্রেমেন্দ্র মিত্র, সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রিয়বরেষু। [মৃত্যু-পরবর্তী সংস্করণে এই উৎসর্গপত্র বর্জিত হয়]।
বোর্ড জ্যাকেট সম্বলিত!
মূল্য : দেড় টাকা।
রয়াল পৃ : ৮ + ৪০
কবিতার সংখ্যা : ৩৫। [উল্লেখ্য, ‘বনলতা সেন’ কাব্যের প্রায় সবগুলো কবিতাই ‘মহাপৃথিবী’তে স্থান পেয়েছে]।
কবিতাগুলোর শিরোনাম :
১. বনলতা সেন, ২. হাজার বছর শুধু খেলা করে, ৩. কুড়ি বছর পরে, ৪. নিরালোক, ৫. সিন্ধুসারস, ৬. ঘাস, ৭. ফিরে এসো, ৮. হাওয়ার রাত, ৯. শ্রাবণ রাত, ১০. আমি যদি হতাম, ১১. হায় চিল, ১২. মুহূর্ত, ১৩. শহর, ১৪. বুনো হাঁস, ১৫. শঙ্খমালা, ১৬. নগ্ন নির্জন হাত, ১৭. শিকার, ১৮. শব, ১৯. হরিণেরা, ২০. স্বপ্ন, ২১. বিড়াল, ২২. বলিল অশ্বত্থ সেই, ২৩. আট বছর আগের একদিন, ২৪. শীত রাত, ২৫. আদিম দেবতারা, ২৬. স্থবির যৌবন, ২৭. আজকের এক মুহূর্ত, ২৮. ফুটপাতে, ২৯. প্রার্থনা, ৩০. ইহাদেরই কানে, ৩১. সূর্যসাগর তীরে, ৩২. মনোবীজ, ৩৩. পরিচায়ক, ৩৪. বিভিন্ন কোরাস ৩৫. প্রেম অপ্রেমের কবিতা।
কবিতাগুলোর রচনাকাল : ১৩৩৬ থেকে ১৩৪৫-৪৮ বঙ্গাব্দ, ১৯২৯ থেকে ১৯৩৮-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ।
‘মহাপৃথিবী’ কাব্যের ভূমিকাটি ছিল এরকম-
‘ ‘মহাপৃথিবী’র কবিতাগুলো ১৩৩৬ থেকে ১৩৪৫-৪৮-এর ভিতর রচিত হয়েছিল। বিভিন্ন সাময়িক পত্রে বেরিয়েছে। ১৩৪২ থেকে ১৩৫০-এ। ‘বনলতা সেন’ ও অন্য কয়েকটি কবিতা বার হয়েছিল ‘বনলতা সেন’ বইটিতে। বাকি সব কবিতা আজ প্রথম বইয়ের ভিতর স্থান পেল।’
জীবনানন্দ দাশ
শ্রাবণ ১৩৫১
প্রথম প্রকাশের ২৫ বছর পর ১৩৭৬ বঙ্গাব্দে (১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ) ‘মহাপৃথিবী’র প্রথম সিগনেট সংস্করণ হয়। তথ্যাবলী নিম্নরূপ—
মহাপৃথিবী : প্রথম সিগনেট সংস্করণ : বৈশাখ ১৩৭৬।
প্রকাশক : দিলীপকুমার গুপ্ত, সিগনেট প্রেস, ২৫/৪ একবালপুর রোড, কলকাতা-২৩।
প্রচ্ছদ : পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়।
উৎসর্গ : শ্রীমতী মঞ্জুশ্রীকে/বাবার আশীর্বাদ Į
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা /সম্পাদনা : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
মূল্য : চার টাকা।
ডিমাই : পৃ. ১২ + ৮২।
কবিতার সংখ্যা : ৩৯।
কবিতাগুলোর শিরোনাম :
১. নিরালোক, ২. সিন্ধুসারস, ৩. ফিরে এসো, ৪. শ্রাবণ রাত, ৫. মুহূর্ত, ৬. শহর, ৭. শব, ৮. স্বপ্ন, ৯. বলিল অশ্বত্থ সেই, ১০. আট বছর আগের একদিন, ১১. শীত রাত, ১২. আদিম দেবতারা, ১৩. স্থবির যৌবন, ১৪. আজকের এক মুহূর্ত, ১৫. ফুটপাতে, ১৬. প্রার্থনা, ১৭. ইহাদেরই কানে, ১৮. সূর্যসাগর তীরে, ১৯. মনোবীজ, ২০. পরিচায়ক, ২১. বিভিন্ন কোরাস, ২২. প্রেম অপ্রেমের কবিতা, ২৩. মৃত মাংস, ২৪. হঠাৎ-মৃত, ২৫. অগ্নি, ২৬. উদয়াস্ত, ২৭. সুমেরীয়, ২৮. মৃত্যু, ২৯. আমিষাশী তরবার, ৩০. তিনটি কবিতা [‘সন্ধিহীন, স্বাক্ষর বিহীন’, ‘শান্তি’, ‘হে হৃদয়’], ৩১. ১৩৩৬-৩৮ স্মরণে, ৩২. ঘাস, ৩৩. সমিতিতে, ৩৪. কোরাস, ৩৫. দোয়েল, ৩৬. সমুদ্র পায়রা, ৩৭. আবহমান, ৩৮. জর্নাল : ১৩৪৬, ৩৯. পৃথিবীলোক।
কবিতাগুলোর রচনাকাল : ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৪।
১৯৪৪ সালে ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশিত হওয়ার পর এই গ্রন্থটি বিষয়ে বেশ কয়েকটি আলোচনা- সমালোচনা প্রকাশিত হয়। ‘মহাপৃথিবী’ সম্পর্কে মন্তব্যগুলো নিম্নরূপ—
‘পূৰ্ব্বাশা’য় (কার্তিক ১৩৫১ সংখ্যা) প্রকাশিত অস্বাক্ষরিত একটি আলোচনা—
‘রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দ দাশই একমাত্র বাঙালি কবি, যাঁর কবিতায় সমগ্রভাবে জীবনবোধের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিষয় আর ভাষা দু’দিক থেকেই ‘মহাপৃথিবী’র কবিতায় পাঠক নূতনত্বের আশ্বাস পাবেন; আর এই বইটিকে তাঁরা সার্থক আধুনিক কবিতার বই বলে অভিনন্দিত না করে পারবেন না।’
প্রকৃতিধর্মী, আবেগ-প্রধান মন নিয়ে জীবনানন্দ বিশ শতকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক অনিবার্য ক্লান্তির জালে কীভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, ‘মহাপৃথিবী’র আলোচনা প্রসঙ্গে তা উল্লেখ করতে গিয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেছেন-
‘স্বপ্নের জীর্ণ জগতকে ফেলে দিয়ে জৈব প্রয়োজনকেই জীবনের সাধনা করে নেবার . ইঙ্গিত হয়ত তাঁর (জীবনানন্দের) কবিতায় আছে—কিন্তু ‘বুড়ি চাঁদটারে’, ‘কালীদহে বেনোজলে পার’ করে দিয়ে ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’ শূন্য করে দিয়ে যাবার সুরে একটা বেপরোয়া মেজাজই আমরা আবিষ্কার করতে পারি, মনের দৃঢ়তা নয়।’ [‘আধুনিক কবিতায় জীবনবোধ’, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ‘নিরুক্ত’, পৌষ ১৩৫১ বঙ্গাব্দী।]
বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন —
‘‘মহাপৃথিবী’তে কোনো নতুন সুর লাগেনি, বস্তুত এই বই ভিন্ন নামে ‘বনলতা সেন’-রই পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ। … ‘মহাপৃথিবী’র শেষের দিকে যে সব কবিতা আছে, সেগুলি যেন কতগুলি বাঁধাধরা বাক্যের বিচিত্র ও অদ্ভুত সংস্থাপন মাত্র; বাক্যগুলি সুন্দর, কিন্তু সবটা মিলিয়ে কিছু পাওয়া যায় না। একে পুনরুক্তি না বলে নিজের অনুকৃতি বলতে হয় এবং কোনো কবি যখন নিজের অনুকরণ করেন, তখন দেবতারা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মনে হয় জীবনানন্দ স্বরচিত বৃত্তের মধ্যে বন্দী হয়েছেন, প্রার্থনা করি তিনি তা থেকে বেরিয়ে আসুন, তাঁর কাব্যক্ষেত্রে যৌবনের ফুল ফোটার পরে এবারে প্রৌঢ় দিনের পাকা ফসল ফলুক।’ [‘কবিতা’, আষাঢ় ১৩৫১]।
এ বছর নিম্নোক্ত পত্রিকায় ‘মহাপৃথিবী’র স্বতন্ত্র আলোচনা প্রকাশিত হয়—
১. ‘পূৰ্ব্বাশা’, কার্তিক ১৩৫১।
২. ‘কবিতা’, চৈত্র ১৩৫১।
‘কবিতা’ পত্রিকার বিশেষ নজরুল সংখ্যা’র প্রকাশ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নজরুল ইসলামকে ‘জগত্তারিণী’ স্বর্ণপদক প্রদান।
এ বছর জন্মেছেন মহাদেব সাহা, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, রমা ঘোষ, আবুল কাসেম ফজলুল হক।
মারা গেলেন আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
গান্ধী-জিন্নাহ আলোচনা ব্যর্থ হয়।
সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ মণিপুর আক্রমণ করে। এই বাহিনীতে নেতৃত্বস্থানীয় ছিলেন—শা’নওয়াজ খাঁ, এনায়েত উল্লাহ কিয়ানী, মোহন সিংহ এবং গুরুব সিং ধীলন। প্রবল বর্ষার কারণে রসদ সরবরাহে অসুবিধা এবং ম্যালেরিয়া ও আমাশয় রোগে আক্রান্ত হলে আজাদ হিন্দ বাহিনী আসাম সীমান্ত থেকে পশ্চাদপসরণ করে।
রুশবাহিনীর আঘাতে জার্মানবাহিনী পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। ব্রিটিশ ও মার্কিনসৈন্য রোম অধিকার করে। মিত্রবাহিনী বিভীষণ যুদ্ধের পর প্যারিস অধিকারে আনে। বেলজিয়াম থেকে জার্মানরা বিতাড়িত হয়। মার্কিনসৈন্য জার্মানিতে প্রবেশ করে। জার্মান-রকেটবোমার আঘাতে ইংল্যান্ডে ধ্বংসলীলার সৃষ্টি হয়। মার্কিনবিমান টোকিওতে বোমা ফেলে।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান জে.ভি. জেনসেন (১৮৭৩—১৯৫০)। কথাশিল্পী। ডেনমার্কের অধিবাসী।
তাঁর সম্পর্কে নোবেল কমিটির মন্তব্য—
‘For the rare strength and fertility of his poetic imagination, with which is combined an intellectual curiosity of wide scope and a bold freshly creative style.’
জেনসেনের বিখ্যাত গ্রন্থ হলো —’দ্য বুল ফাইট’।
প্রকাশিত গ্রন্থ : ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশিত হয়। প্রকাশ পায় অমিয় চক্রবর্তীর ‘দূরযানী’, বিষ্ণু দে’র ‘সাত ভাই চম্পা’ [কবিতার সংখ্যা : ৪৪, রচনাকাল : ১৯৪১- ১৯৪৪, উৎসর্গ : শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্যকে; প্রকাশক : অমল বসু, কলকাতা], দিনেশ দাসের ‘ভুখামিছিল’, মনীন্দ্র রায়ের ‘ছায়া সহচর’, সমর সেনের ‘তিন পুরুষ’, সুবোধ ঘোষের ‘তিলাঞ্জলি’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’, অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘বিনুর বই’, প্রমথনাথ বিশীর ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’, প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘মহাস্থবির জাতক’, বনফুলের ‘জঙ্গম’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উপনিবেশ’। প্রকাশিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভেজাল’ গল্পগ্রন্থ।