১৯১৩। বয়স ১৪ বছর
স্কুলে ওপরের ক্লাসে পড়বার সময় থেকেই জীবনানন্দ নিজের মধ্যে গাছ-ফুল-পাতার আকর্ষণ বোধ করতেন। টাকা জমিয়ে কলকাতার নার্সারি থেকে নানা রকম ফুলের চারা আনিয়েছিলেন। জুঁই, চামেলি, গন্ধরাজ, কাঁঠালিচাঁপা, রঙ্গন, নীলজবা, হাস্নাহেনা, কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে কয়েকটি উৎকৃষ্ট গোলাপের চারাও ছিল সেখানে। গোলাপফুল ও কৃষ্ণচূড়ার জন্যে তাঁর বাগানটি বরিশালে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল সে সময়। জীবনানন্দ দাশের বরিশালের বাড়ির বিবরণ পাওয়া যায় এরকম-
‘বগুড়া রোড আর গোরস্তান রোডের কোণে পাঁচ-ছ বিঘা জমি জুড়ে তাঁদের বসতবাড়ি, ফুল ফোটা কৃষ্ণচূড়া, বাতাবিলেবু, বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তে পোড়োজমিতে সতেজ বেতবন আর কেয়াঝোপ, নারকেল সুপারির কুঞ্জ ঘেরা মাছের চোখের মতো ঝকঝকে একটি পুকুর, আম কাঁঠাল জামরুল লিচু সব বড় বড় গাছ, পরিচ্ছন্ন আঙিনার তিনদিকে আধা-শহুরে আধা গ্রামীণ ধরনের কয়েকটি ছোট- বড় কামরাযুক্ত তিনটি পৃথক ভিটে বাড়ি।’ [জীবনানন্দ দাশ’, প্রভাতকুমার দাস]।
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৫২। ছ’মাস আমেরিকায় ভ্রমণের পর লন্ডনে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। লন্ডনের হাসপাতালে অর্শ অস্ত্রোপাচার করলেন। ১ বছর ৪ মাস ১২ দিন পর ৪ অক্টোবর দেশে ফিরেন কবি। কলকাতায় এসে আত্মীয়দের মধ্যে বিরোধের কথা শুনে বিরক্ত হয়ে শান্তিনিকেতনে চলে গেলেন তিনি। জ্যেষ্ঠা কন্যা বেলা ও জামাতা শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী জোড়াসাঁকোর বাড়ি ত্যাগ করে চলে যান। ১৪ নভেম্বর শান্তিনিকেতনে নোবেল প্রাইজ পাবার খবর আসে। ইংরেজিতে অনূদিত ‘গীতাঞ্জলি’র জন্যে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সুইডিশ একাডেমির কাছে, অন্যতম সম্ভাব্যপ্রার্থী টমাস হার্ডির বদলে রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেন স্টার্জ মুর। এ ব্যাপারে রোদেনস্টাইন এবং ইয়েটস্ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১০ দিন পর কলকাতা থেকে ৫০০ শিক্ষিত ব্যক্তি এসে শান্তিনিকেতনে কবিকে সম্মান প্রদর্শন করে যান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (২৬ ডিসেম্বর) কবিকে D. Lit উপাধি দান করেন, নোবেল প্রাইজের ১,০৮,০০০ টাকা বিশ্বভারতীকে দিয়ে দিলেন কবি।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংল্যান্ড পার্লামেন্টের সদস্য লর্ড হেডলীর সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। নতুন রাষ্ট্র আলবেনিয়ার জন্ম। আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় ছাত্র ও শ্রমিকরা ‘গদর পার্টি’ স্থাপন করেন। ভারত সরকার শিক্ষানীতির পরিবর্তন করে।
এ বছর জন্মেছেন পি.সি. সরকার, আলবেয়ার কামু। পরলোক গমন করেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
এ বছর নোবেল পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। ভারতবর্ষের কবি- নাট্যকার-কথাশিল্পী 1
১৩ নভেম্বর সুইডিশ আকাডেমি রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রয়টারের টেলিগ্রামে জানা যায় —
‘Stockholm, Thursday, Nov. 13/The Nobel Prize for literature for 1913 has been awarded to the Indian Poet Rabindranath Tagore.’
১৪ নভেম্বর সংবাদটি কলকাতায় পৌঁছে। Empire নামে একটি সান্ধ্যদৈনিক ভারতবর্ষে প্রথম রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সংবাদটি প্রকাশ করে। সংবাদটি ছিল এই রকম—
Great honour for/Tagore/Nobel Prize conferred/
‘Largest contribution to/the common good’/
Reuter’s service ) / London, Thursday.’
এই পত্রিকা এই পুরস্কারকে ‘epoch’ বলে অভিহিত করেছে।
নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ছিল ৮০০০ পাউন্ড।
তাঁর সম্পর্কে মন্তব্যে নোবেল কমিটি লেখেন—
‘Because of his profoundly sensitive, fresh and beautiful verse by which, with consummate skill, he has made his poetic thought expressed in his own English words a part of the literature of the West.’
রবীন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় ‘গীতাঞ্জলি’ বা ‘Song offerings’ এর জন্যে। এর কবিতাগুলো কবির মূল বাংলা ৯টি কাব্যগ্রন্থ এবং ১টি নাটক থেকে তরজমা করা। ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে ৫৩টি, ‘গীতিমাল্য’ থেকে ১৬টি, ‘নৈবেদ্য’ থেকে ১৫টি, ‘খেয়া’ থেকে ১১টি, ‘শিশু’ থেকে ৩টি, ‘উৎসর্গ’, ‘স্মরণ’, ‘কল্পনা’ ও ‘চৈতালি’ থেকে ১টি করে এবং ‘অচলায়তন’ নাটক থেকে ১টি কবিতা বা গানের অনুবাদ নিয়ে ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’র ১০৩টি কবিতা সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে আবার ‘নৈবেদ্য’র দুটি কবিতা (৮৯ ও ৯০ সংখ্যক) ইংরেজি অনুবাদে একটি কবিতার রূপ পেয়েছে।
প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রা’ প্রকাশিত হয়। ম্যাকমিলানের সুলভ সংস্করণে বের হয় রবীন্দ্রনাথের ‘Gitanjali’, ‘গার্ডেনার’, ‘ক্রেসেন্ট মুন’, গ্লিমসেস্ অব বেঙ্গল লাইফ’। প্রকাশ পায় প্রমথ চৌধুরীর ‘সনেট পঞ্চাশৎ’, শরৎচন্দ্রের ‘বড় দিদি’, কামিনী রায়ের ‘মাল্য ও নির্মাল্য’, ক্ষীরোপ্রসাদের ‘ভীষ্ম’, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’, নিরুপমা দেবীর ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। প্রকাশ পেল ডি.এইচ. লরেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সানস্ অ্যান্ড লাভার্স’, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পালস্ অব বেঙ্গল’।
অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ও জলধর সেন সম্পাদিত মাসিক ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা প্রকাশ পেল। এবছরেই ‘ভারতবর্ষ’ প্রথম পুরোমাত্রার শারদীয় সংখ্যা হিসেবে বের হয়েছিল। পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ২০০। এতে লিখেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বিপিনবিহারী গুপ্ত, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। উল্লেখ্য, ১৩৬ বছর আগে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ বা ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১০ আশ্বিন কলকাতায় প্রথম পূজা সংখ্যা বের হয়েছিল। দাম ছিল মাত্র এক পয়সা। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘ছুটির সুলভ’। এটি ছিল কেশব সেন সম্পাদিত ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা।