সুগারবেবি

সুগারবেবি

অ্যাক্রোপলিস মলটা পেরিয়েই যে চৌমাথা মোড়টা পড়ে, হাজার সিগন্যালের প্যাঁ-পোঁ শব্দে সেখানে কান পাতা দায়, তবু তারই মধ্যে একটা ছোট্ট অথচ দামি রেস্টুরান্টের সামনে কানে হেডফোন গুঁজে অসীম ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করছিল তিতলি। সেই কখন বুক করেছে উবের এর একটা ক্যাব, তা প্রায় মিনিট কুড়ি তো হলই। ফোনের ম্যাপে দ্যাখাচ্ছে ড্রাইভার রয়েছেন মাত্র ছ-মিনিট দূরে, জিপিএস-এ দ্যাখানো সত্ত্বেও তিতলি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে এগজ্যাক্ট লোকেশন, কিন্তু ঘনঘন সিগন্যাল পড়ার চোটে তাঁরও আসতে প্রাণান্ত! তিতলির বিরক্ত লাগলেও একদিক থেকে খারাপ লাগছিল না। অন্তত গিয়ে যে অকওয়ার্ড পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, তার থেকে তো একটু সময় পাওয়া যাচ্ছে!

পেছনের রেস্টুরেন্টটায় বোধ হয় কোনো ছোটখাটো পার্টি চলছে, জন্মদিনের হবে কি? তিতলি যতটা সম্ভব চোখ সরু করে দেখতে চেষ্টা করল। একটু ঝুঁকে পড়ে দেখতে গিয়ে খেয়াল করেনি, হাই হিল জুতোয় এখনো অতটা সড়গড় হয়নি, ধাক্কা লেগে গেল রেস্টুরান্টে ঢুকতে যাওয়া একটা ছেলের সঙ্গে। তিতলি সবে ‘স্যরি’ বলতে যাবে, তার আগেই ছেলেটার গার্লফ্রেন্ডই হবে সম্ভবত, এগিয়ে এল ব্যস্তসমস্ত হয়ে পাশ থেকে, ছেলেটার হাত জড়িয়ে ধরল পাশ থেকে, ”ওহ বেবি, তোমার লাগেনি তো?”

তিতলি নিজের মনেই হেসে সরে এসে দাঁড়াল। প্রথম প্রথম শিলিগুড়ির গণ্ডগ্রাম থেকে এসে এতবড় ছেলেমেয়ে নিজেদের মধ্যে বেবি সম্বোধন করছে দেখে ও খুব অবাক হত, পরে বুঝেছে ওটা আর কিছুই নয়, আদরের ডাক। আর কি আশ্চর্য, কাকতালীয়ভাবে তিতলির নামের সঙ্গেও এখন বেবি কথাটা জুড়ে গেছে, তবে সেটা আদর করে নয়, প্রফেশনালি।

তিতলি একজন সুগারবেবি।

নিজের গত তিনমাসের ট্রেনিংটা করার আগে তিতলি নিজেও জানত না এই সুগারবেবি ব্যাপারটা কি। পিঞ্জর ওখানে নিয়ে যাওয়ার আগে হাবেভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলেও পুরো বেসিক থেকে কনসেপ্টটা ক্লিয়ার করেছিলেন ‘রিফ্রেশার’-এর মেঘমালাদি। বাকিটা ক্লিয়ার হয়েছিল গুগলে সার্চ করে।

এখনো স্পষ্ট মনে আছে তিতলির তিন মাস আগের দিনটা। রোববার ছিল। কিন্তু অন্যান্য কর্পোরেট অফিসের মতো ‘রিফ্রেশার’ কিন্তু বন্ধ ছিল না। বরং ছুটির দিনগুলোতেই যে ব্যস্ততা থাকে বেশি! সল্টলেকের একটা আইল্যান্ডের পাশে অটো দাঁড় করিয়ে রেখে পিঞ্জর ওকে নিয়ে গিয়েছিল অফিসে। তিতলির ততদিনে বছরদেড়েক হয়েছে কলকাতায়, মফসসলের আড়ষ্টতাটা কাটিয়ে ফেললেও স্টাইল বা হালফ্যাশনের সাজগোজ কিছুই আয়ত্ত করতে পারেনি। ওর বেশ মনে আছে, আগেরবার পুজোয় কেনা একমাত্র কমলা-মেরুণ রঙের সালোয়ার কামিজটা পড়ে গিয়েছিল ও। অফিস থেকে ডাইরেক্ট আসতে হয়েছে বলে ঘামছিল কুলকুল করে, অবিন্যস্ত চুলের গোছা খুলে ছড়িয়ে পড়েছিল কপালের দু-পাশে ইতিউতি।

রিফ্রেশারের অফিসে ঢুকে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি নিপুণভাবে পারফেক্টলি মেনটেইনড মেঘমালাদিকে দেখে ওর আড়ষ্টভাবটা আরো বেড়ে গিয়েছিল।

কিন্তু পিঞ্জর প্রাথমিক আলাপটা করিয়ে দেওয়ার পর মেঘমালাদি বেশ হাসি হাসি মুখ করে ওর দিকে তাকিয়েছিলেন, ”তিতলি। বাহ! বেশ সুন্দর নাম। তোমাকে পিঞ্জর রেফার করছে যখন, আমি তোমার ওপর কনফিডেন্স রাখতেই পারি। ইন ফ্যাক্ট, আমি পিঞ্জরের সামনেই বলছি, হি ইজ ওয়ান অফ দ্য বেস্ট সুগারবেবিজ রিফ্রেশার হ্যাজ রাইট নাও।”

তিতলি মেকি একটা হাসির বিজ্ঞাপন দুলিয়ে তাকিয়েছিল মেঘমালাদির দিকে। পিঞ্জরের যে রিফ্রেশারের টোটাল বাইশ জন সুগারবেবির মধ্যে স্থান একদম প্রথমের দিকে, সেটা পিঞ্জর ওকে অলরেডি বলেছে ওদের কলসেন্টারে। হাজারো কল নেওয়ার ফাঁকে পাঁচ মিনিটের জন্য খেতে গিয়ে কফির কাপে চুমুক দিয়ে পিঞ্জর বেশ গর্বের সাথে বলেছিল, ”এই বিপিও-র খিস্তি খাওয়া চাকরির থেকে হাজার গুণ ভালো। শালা গালি খাও খালি ফোনে, তারপর কোনদিন ছাঁটাই করে দেবে তাঁর নেই ঠিক! আমি তো এই বছরের ইনসেনটিভটা নিয়েই রিজাইন মারব। তোর এখন রেগুলার বেসিসে টাকা সত্যিই দরকার বলে তোকে আমি এটা সাজেস্ট করছি। নাহলে, এসব তো আর লোককে বলে বেড়াবার মতো নয়। আমেরিকা লন্ডনে এসব আকছার, কিন্তু কলকাতায় তো লোকে সোজাভাবে নেবে না, না! আর হ্যাঁ, ভাবিস না, যে আমার ফিগারের জন্য রিফ্রেশার আমাকে এত টাকা দেয়, ভালো সুগারবেবি হতে গেলে শুধু চেহারা দিয়ে চলবে না বস, কালচারড হতে হবে রীতিমতো, স্মার্ট ওয়েতে কথা বলা আয়ত্ত করতে হবে, রবীন্দ্রনাথ থেকে রেঙ্গুন, ট্রাম্প থেকে টেনিস, সব ব্যাপারে নলেজ থাকতে হবে ইন ডেপথ! ডেইলি কোথায় কি ঘটছে, কেন ঘটছে সবকিছুর খবরও রাখতে হবে হাতের মুঠোয়। পারবি তো?”

মেঘমালাদি অবশ্য এরকম মাঝখান থেকে কথা বলে তিতলিকে ভয় দেখানো, নিখুঁত আইলাইনার পড়া চোখ নাচিয়ে হেসে বলেছিলেন, ”আগে সুগারবেবি জিনিসটা কি তোমাকে বোঝাই। সুগারবেবি তাদেরকে বলা হয় যারা অর্থের বিনিময়ে কারুর সাথে সময় কাটানো।”

তিতলির চোখ শুনতে শুনতে মেঘমালাদিকে পেরিয়ে চলে গিয়েছিল পেছন দিকে, সেখানে বন্ধ ক্লাসরুমের ওপারে চলছে কোনো ক্লাস, ধরন শুনে মনে হয় স্পোকেন ইংলিশ কি? মেঘমালাদির শেষ বাক্যে ফিরে তাকায় ও।

তিতলির এই বিস্মিত অভিব্যক্তির জন্য মেঘমালাদি বোধ হয় প্রস্তুতই ছিলেন, বলেছিলেন, ”তুমি ভাবছ, এ আবার নতুন কথা কি হল, আদপে প্রস্টিটিউশান, তাই তো? টাকা দেওয়া আর শরীর নেওয়ার সেই চিরাচরিত আদি ব্যবসা। কিন্তু না, সুগারবেবিরা ঠিক তা নয়।” নিজের সুন্দর ম্যানিকিওর করা আঙুল শূন্যে নাড়িয়ে বোঝাচ্ছিলেন মেঘমালাদি, ”দ্যাখো, সুগারবেবির প্রধান কাজ হল তার ক্লায়েন্ট যিনি হবেন, পুরুষ হলে সুগারড্যাডি, আর মহিলা হলে সুগারমাম্মি, সেই সুগারড্যাডি বা সুগারমাম্মির সঙ্গে সময় কাটানো, তাঁকে ভালো লাগানো। সেটা মুভি দেখতে গিয়েই হোক, কোনো শপিং মলে বাজার করতে গিয়েই হোক, কিংবা দিনের পর দিন ক্লায়েন্টের পছন্দমাফিক আড্ডা বা গল্প করেই হোক। বাইরে সুগারবেবি প্রোফেশন খুবই কমন, ইন্ডিয়াতে একদমই নতুন বলতে পারো। আমাদের কোম্পানি রিফ্রেশার একদম কর্পোরেট মডেলে কাজ করে। এখানে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে সুগারবেবিদের চুক্তি হয় লং টার্মে। নরম্যাল প্রস্টিটিউটদের মতো কয়েকঘণ্টার বেসিসে নয়, মিনিমাম একবছরের চুক্তি করি আমরা। আর শরীর থাকাও এখানে কম্পালসরি নয়। ক্লায়েন্ট ফর্ম ফিলাপের সময়ই চুজ করতে পারবেন তিনি উইথ ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ সুগারবেবি চাইছেন না উইদাউট! যেটা পরে কোনোভাবেই চেঞ্জ করা যাবে না। এক বছর বাদে যখন কন্ট্রাক্ট রিনিউ করতে হবে, তখনই একমাত্র তিনি সেই অপশনটা পাল্টাতে পারেন, চাইলে সুগারবেবিকেও পালটে নতুন কাউকে নিতে পারেন। সুতরাং সুগারবেবির কাজ মানেই সেক্স, এমন ভেবো না মোটেই। বরং, তুমি পিঞ্জরকে জিগ্যেস করে দেখতে পারো, ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ ছাড়া সুগারবেবি চাওয়া ক্লায়েন্টদের সংখ্যাই আমাদের এখন বেশি। কারণ মানুষ এখনকার লাইফস্টাইলে কোনোরকম বাঁধন বা দায়িত্ব ছাড়াই আনন্দ করতে চায়, এনজয় করতে চায়!”

তারও পরে প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে বিভিন্ন খুঁটিনাটি বুঝিয়ে মেঘমালাদি বক্তব্য শেষ করেছিলেন। তিতলিকে একটা ফর্ম ফিলাপ করতে হয়েছিল, বিভিন্ন মেডিকেল টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর তিনমাসের ট্রেনিং শুরু হয়েছিল ওর রিফ্রেশারে।

পিঞ্জর অবশ্য ওকে পরে বলেছিল শুনে যতটা ভালো লাগছে ততটা কিন্তু মোটেই নয়। ক্লায়েন্ট যে অপশনটাই নিক না কেন, রিফ্রেশার যে সুগারবেবিকে সেই কাজে অ্যালট করবে, তাকে সেটা করতেই হবে। আর অনেকসময়েই প্রথমে ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ চাইনা বলে এগ্রিমেন্ট করলেও পরে সেটা করতে বাধ্য করেন ক্লায়েন্ট। তারপর পিঞ্জর শুনিয়েছিল নিজেরই একটা অভিজ্ঞতা, কিভাবে একজন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী মহিলা ওকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে তাজপুরে গিয়ে শারীরিক অত্যাচার চালিয়েছিল, বলেছিল, ”মনে রাখবি, এরকম খারাপ কিছু হলে কিন্তু তুই প্রোটেস্টও করতে পারবি না, তাতে তোরই প্রোফেশনের ক্ষতি হবে। আর আমাদের ক্লায়েন্টরা যে প্রত্যেকেই সুপাররিচ হয়, সেটা তো বিলের অ্যামাউন্ট দেখেই বুঝতে পারিস। আবার দেখবি ভালো এক্সপিরিয়েন্সও হবে, একজন ক্লায়েন্ট তো প্রায় দিন ভালো ভালো রান্না করে খাওয়াত আমায়। সবরকমের জন্যই প্রিপেয়ারর্ড থাকতে হবে। ট্যাক্টফুলি চলতে হবে তাই, বুঝলি?”

না, বোঝেনি তিতলি। তিনমাসের ট্রেনিং এ ওদের সবরকমভাবে গ্রুম করানো হয়েছে যাতে সব ধরনের বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে পারে, মানুষকে সঙ্গ দিতে পারে ওরা। তবে সঙ্গে এও বলে দেওয়া হয়েছে তিন বছরে অন্তত একটা উইথ ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ কন্ট্রাক্ট নিতেই হবে। তিতলিদের ক্লাসের এগারোজনের মধ্যে মেয়ে ছিল সাতটা, সবার মুখের তখন পরিবর্তন ঘটলেও তিতলি কিছু ভাবেনি। ভেবে আর হবেটাই বা কি! ওর জীবনে যা ঘটার সবই বড্ড তাড়াতাড়ি ঘটে গেছে। কোন ছোটবেলায় বাপ মরে যাওয়া মেয়েকে মা যে কোনোমতে কলেজের গণ্ডিটা পার করাতে পেরেছে, এই ঢের। শরীরটাও ভালো নেই, তার ওপর মা-র বিয়েও হয়েছিল অনেক বয়সে। তিতলি যখন কলেজে পড়ত, তখনো মা চারটে বাড়ি রান্নার কাজ করে ধুঁকতে ধুঁকতে। কিন্তু কলেজ শেষ হবার পর তিতলিকে হন্যে হয়ে কাজ খুঁজতেই হল। তখনই কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে এই বিপিও-টার খোঁজে কলকাতা আসা। কিন্তু, ওই চাকরিটা দিনদিন সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছিল তিতলির কাছে। একে হাড়ভাঙা বারো ঘণ্টা ডিউটি শেষে মাস গেলে সর্বসাকুল্যে বারোহাজার টাকা, তাতে কলকাতা শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটিয়ে, নিজের টুকু রেখে মা-কে টাকা পাঠাতে যেন নাভিশ্বাস উঠত তিতলির। তবু দাঁতে দাঁত চিপে চালিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু এরপরেও যখন প্রতিমাসেই চাকরি হারানোর ভয় নিয়ে থাকতে হত, ওর চোখের সামনেই বিনাকারণে ওর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কস্তুরীর সামান্য কারণে চাকরিটা গেল, আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিল পিঞ্জরকে, অন্য কোনো কাজের সুযোগ ওর কাছে আছে কি?

তন্ময় হয়ে এমন ভাবছিল ও, কখন উবের-এর ড্রাইভার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, ও খেয়ালই করেনি। চমকে উঠে তাড়াতাড়ি ব্যাগটা বুকের কাছে সামলে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল ও। লোকেশন দেওয়াই আছে, বালিগঞ্জের একটা অভিজাত আবাসন। প্রথমদিন, রিফ্রেশারের ট্রেনারের কথামতো বেশ বোল্ড সেজেছে ও। হাঁটু অবধি কালো ড্রেস পড়েছে একটা, সঙ্গে কালো জুতো। গলায় আর কানে শুধু একটু করে স্টোনের জুয়েলারি, ব্যস! বেশি জবরজং রিফ্রেশারের ক্লায়েন্টরা নাকি পছন্দ করে না।

সারাদিনের কাজের শেষে ক্লান্ত কলকাতা, ট্র্যাফিক লাইটের ঝলমলে আলোয় যতই এগোয় গাড়ি, ততই যেন ওর বুকের ভেতরের শব্দটা জোরালো থেকে জোরালোতর হতে থাকে। কি আছে ওর কপালে আজ? কেমন হবে ওর প্রথম ক্লায়েন্ট? যাকে আগামী এক বছর যখন দরকার তখনই ফোনে বা সাক্ষাতে সঙ্গ দিতে হবে ওকে?

ভাবতে ভাবতে গলাটা শুকিয়ে যায় তিতলির, হঠাৎ মনে পড়ে ওর চেয়ে কিছুদিনের সিনিয়র শুভশ্রীর বলা অভিজ্ঞতার কথা। শুভশ্রীর সুগারড্যাডি প্রথমদিন ওর সঙ্গে বেশ ডিসেন্ট ছিলেন, ডিনারের সঙ্গে গল্প করেছেন টুকটাক, খেলায় আগ্রহ জেনে শুভশ্রী সেই সম্পর্কে আরো হোমওয়ার্ক করতেও ভোলেনি। কিন্তু দিনপনেরোর মধ্যেই ওর ক্লায়েন্টের মুখোশ খসে পড়েছে, জানা গেছে বিকৃত যৌনাচারেই তিনি অভ্যস্ত। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। মোটা অ্যাডভান্স পেয়ে গেছে শুভশ্রী, তখন আর বেরিয়ে আসা যায় না, রিফ্রেশারের নিয়ম অতি কড়া।

ঢকঢক করে বোতল থেকে অনেকটা জল খায় ও, বহুদিন আগে ফেলে আসা শিলিগুড়ির সেই হাকিমপাড়া মনে পড়ে ওর, সেই ছোটবেলার হালা ভালোলাগা, নাইন টেনে ক্লাসমেট অনীশের লাজুক চাউনি। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কত কি পালটে যায়! তিতলির ভবিষ্যৎ এবার থেকে কোন খাতে বইবে ও নিজেই জানেনা। নিজের দশায় নিজেরই হাসি পায় ওর, যতই এরকম নতুন প্রফেশনের নাম দিক, সফিস্টিকেটেড প্রস্টিটিউট ছাড়া আর কি হতে চলেছে ও?

হাল্কা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখটা আলগোছে মুছে ও শেষবারের মতো রিফ্রেশার থেকে পাঠানো ক্লায়েন্টের ডেটায় চোখ বোলাতে লাগলো। নাম ধাম নিয়মমতোই লেখা নেই, শুধু লেখা বয়স একাশি, ইন্টারেস্ট সিনেমা।

নিজের মনেই কেঁপে উঠল ও, একাশি! এই বয়সে সুগারবেবি চাইছে? এত বুড়ো, এদের বিকৃতি লেভেল আরো বেশি হয় ও শুনেছে। ঢোঁক গিলে ও ফোন করল পিঞ্জরকে, ”একাশি বছরের ক্লায়েন্ট আমার। কিভাবে ডিল করব রে? টেনশনে হাত পা কাঁপছে।”

পিঞ্জর ওপাশ থেকে অভয় দেয়, ”অত চাপের কিছু নেই। বেশি বাড়াবাড়ি দেখলে প্রথম দিন ফিরেই কমপ্লেন করবি গ্রিভান্স সেলে, ক্লায়েন্টের সাথে মিটের তিনদিনের মধ্যে বললে রিফ্রেশার রিভিউ করবে তোর প্রবলেম, তবে অ্যাপ্রেইজালে রেটিং কিন্তু বাজে হয়ে যাবে তোর।”

তিতলি অস্ফুটে বলল, ”তাহলে?”

পিঞ্জর বলল, ”আরে দ্যাখ না, উইথ না উইদাউট ফিজিক্যাল?”

তিতলি হাজারবার বোলানো ফরমের দিকে আবার তাকায়, ”উইথ!”

পিঞ্জর একটা গালাগাল দিলো কাঁচা, তারপর বলল, ”শালা একাশি বছরে এদের রসও আছে মাইরি!”

ইতিমধ্যে এসে পড়েছে তিতলির গন্তব্য, আলগোছে আকাশছোঁয়া কমপ্লেক্সটার দিকে তাকিয়ে তিতলি বলে, ”পৌঁছে গেছি। পরে করছি তোকে।”

ফর্মে দেওয়া ঠিকানামাফিক বিশাল বহুতলের লিফটে চড়ে সতেরো তলায় পৌঁছে তিতলি ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী ডানদিকে ফেরে। একটাই ফ্ল্যাট রয়েছে সেদিকে। এইটাই হবে। নিয়মমতো, ক্লায়েন্টের নাম বা অন্যান্য ডিটেইলস কিছুই নেই ওর কাছে। সুগারবেবি হিসেবে ক্লায়েন্টের কোনো ডিটেইল ও কোনোভাবে জানতে পারলেও সেটা প্রকাশ করা সাংঘাতিক সিকিউরিটি ব্রিচ রিফ্রেশারের কাছে। এমনকি ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে থাকাতেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

মনে মনে ট্রেনিং এর সব রুলগুলো আউড়ে নিল ও, তারপর মায়ের মুখটা মনে পড়ল হঠাৎ। এই কন্ট্রাক্টের অ্যাডভান্স পঞ্চাশ হাজার টাকার সিংহভাগই পাঠিয়ে দিয়েছে ও মা-কে। আরো পাঠাবে পরে। বুকের রোগটা ভালো করে সারাক ততদিনে মা, এমনিতে বয়সও হয়েছে প্রায় সত্তর, তার ওপর আঘাতে আঘাতে ভেঙে পড়েছে যেন আরো বেশি।

মনটা শক্ত করে ও কলিং বেল বাজায়। একবার, দু-বার। কোনো শব্দ নেই, তারপর একটু জোরে তিনবার।

ঠিক উনত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় দরজাটা খুলে গেলে তিতলি হতভম্ব হয়ে গেল।

এতটাও ও আশা করেনি!

ক্লায়েন্ট যে মহিলা হবে এটা ওর মাথাতেও আসেনি।

আলোআঁধারি দামি আলোর ফ্ল্যাট, দেওয়ালে বহুমূল্য সব পেন্টিং, বিদেশি মার্বেলে মোড়া ডাইনিং-এর মাঝে দাঁড়িয়ে অশীতিপর একজন খুনখুনে বুড়ি, বয়সের ভারে ন্যুব্জ প্রায়। মুখের স্বাভাবিক আকৃতিটা অজস্র ভাঁজের মাঝে যেন হারিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। হাতদুটো কাঁপছে দ্রুতগতিতে। দন্তহীন ফোকলা গালদুটো যেন নিজের মনেই বকে চলেছে অবিরত।

বিমূঢ় তিতলি বলল, ”ন-নমস্কার ম্যাডাম! রিফ্রেশার থেকে আসছি আমি, অ্যাঞ্জেল রুহি আমার নাম!”

কথা শেষ হল না ওর। বুড়ির মুখটা উজ্জ্বল হয় উঠল, হাতটা টেনে ওকে ঘরের মধ্যে টানলে নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে, কাঁপাকাঁপা গলায় কলকল করে উঠল, ”নাম জেনে কি করব রে মা! আমার সাথে থাকবি তো? গল্প করতে আসবি তো একটু আমার সাথে? বুড়ো হয়ে গেছি তো, একটু বকবক করতে চাই শুধু। পুরনো দিনের ছবি দেখতে আমি বড্ড ভালোবাসি রে! উত্তমবাবু, সুপ্রিয়া, সাবিত্রী আর সুচিত্রা! দেখবি তো আমার সঙ্গে বসে?”

তিতলি কি বলবে, সত্যিই বুঝতে পারছে না। ট্রেনিং-এ চটকদার কথা বলে কিভাবে ক্লায়েন্টকে ইম্প্রেস করানো যায়, সেটাই শেখানো হয়েছে বারবার, কেউ মনের গভীর থেকে কাতর হয়ে এভাবে ভালোবাসার ডাক দিলে কিরকম প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিৎ বলে দেয়নি তো রিফ্রেশারে!

কি করবে এখন ও? হাত ছাড়িয়ে চলে যাবে? গিয়ে জানাবে যে ক্লায়েন্ট পছন্দ নয়?

ও হতভম্ব হয়ে বলল, ”আপনি এতবড় ফ্ল্যাটে একা থাকেন? আপনার কেউ নেই?”

বুড়ি ফোকলা দাঁতে হাসল, ”সব আছে রে লো, ছেলে মেয়ে, সব থাকে বাইরে। ছেলেকে বলি নাতনিটাকে নিয়ে আয়, আসে না। মেয়েটাও আসে না নাতিটাকে নিয়ে। সক্কলে বড্ড ব্যস্ত যে! আমারই কোনো কাজ নেই। সারাদিন রতনের মা থাকে, রাত আটটা বাজলেই সেও চলে যায়। ছেলেকে রোজ ফোনে কাঁদতুম আমার কাছে আয়, আমার কাছে এসে বস, দুদণ্ড কথা বলি, তোকে দেখি, তোর হাতপা গুলোয় একটু হাত বুলিয়ে দিই!” বলতে বলতে বুড়ির চোখে জল চলে এসে, গলা ভিজে যায়, তোবড়ানো গাল বেয়ে নামে জলের ফোঁটা, ”ছেলে রেগে যেত রে মা! কাল বলল তোমার সঙ্গে সারাদিন গল্প করার জন্য একজনকে পাঠাচ্ছি, আর বিরক্ত করবে না আমায় বারবার। তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিও, তাকে নিয়ে সিনেমা দেখো’খন।”

বলতে বলতেই নিজের শিরা ফুলে ওঠা শীর্ণ হাত দিয়ে তিতলির হাতে বুড়ি হাত বোলাতে থাকে, ”আসবি তো রে মা রোজ আমার কাছে? এট্টু গল্প করব আর একসঙ্গে সিনেমা দেখবো, আর কিছু না! আসবি তো?”

তিতলি যেন ততক্ষণে মনে মনে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ধরে পৌঁছে গেছে বহু দূরে শিলিগুড়ির এক গ্রামে, কোন এক খুনখুনে বুড়ির কাছে। সে-ও কি এভাবেই মেয়ের জন্য চোখের জল ফ্যালে, মেয়ের গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য তারও কি প্রাণ করে আঁকুপাঁকু?

 সত্যিই তো, মায়ের সাথে সন্তানের টানই সবচেয়ে বেশি ফিজিক্যাল, নাড়ির টান। সুগারবেবি কন্ট্রাক্ট ফর্মে ভুল নেই বিন্দুমাত্র!

ছলছলে চোখে ওর ক্লায়েন্টের হাতদুটো জড়িয়ে ধরল তিতলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *