ফেকবুক

ফেকবুক

স্টেশনের ওভারব্রিজে উঠতে না উঠতেই রেশমী দেখল দূরে ডাউন লোকাল আবছা কুয়াশার বুক চিরে ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে। ছোটার গতি আরো বাড়িয়ে দিয়ে মনে মনে কম্পিউটারের চেয়েও দ্রুতগতিতে ক্যালকুলেশান করতে লাগল রেশমী, ওভারব্রিজ থেকে নেমে লেডিজ কামরা অবধি পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় সাড়ে তিন মিনিট, তার মধ্যে যদি ট্রেন থেকে লোক নেমে ওভারব্রিজ দিয়ে উঠতে শুরু করে দেয়, তবে আজকের মতো আর কোনো চান্স নেই, সেই সতেরো মিনিট পরের ট্রেন, আর তার মানেই হেডুর ত্যারচা চাউনি! তার ওপর এই আটটা পঞ্চান্নর মজাটা আর ওই ট্রেনে থাকে না। মুখটা নিজের অজান্তেই সিঁটকে গেল রেশমীর, তবু সে ছোটার গতি কমাল না। ব্যাগটাকে চেপে বুকের কাছে নিয়ে সামনে থপথপ করে উঠতে থাকা এক মোটা মহিলার প্রায় বগলের তলা দিয়ে পোল ভল্ট খেয়ে ছুটতে লাগল ও। তার ওপর ঠান্ডাটাও পড়েছে জব্বর! নাক দিয়ে যেন বরফকুচি ঢুকছে!

ওভারব্রিজ থেকে নেমে লেডিজের দিকে যখন ও রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে, তখন ট্রেন তার ভেঁপু বাজিয়ে দিয়েছে। একে তাকে ধাক্কা মেরে হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে ও কোনোমতে লেডিজের হাতলটা ধরে উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

একেই আজকাল ছোটার অভ্যেস চলে গেছে, তার ওপর মোটা হয়ে যাচ্ছে, রাস্তার নেড়িকুকুরগুলোর মতো জিভ বার করে কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নিল ও, বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে! নাহ, ব্যায়ামটা এবার শুরু করতেই হবে। কিছুক্ষণ ঠান্ডা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে বেশ জিরিয়ে নিল, তারপর চোখ খুলে ভেতর দিকে তাকাতেই ওর মুখটা হাসিতে ভরে গেল। বাহঃ, আজ একদম ভরা সংসার! সহেলীদি, রুমাকাকিমা, অনুদি, শর্মিষ্ঠা, সুপর্ণা সক্কলে আছে। আবার ফাঁকাও আছে বেশ। গুটিগুটি পায়ে ও এগিয়ে গেল ওদের আটটা পঞ্চান্নর লেডিজ গ্রুপের দিকে।

ওকে দেখেই সহেলীদি চেঁচিয়ে উঠল, ”ওই তো রেশমী! যাক পেয়েছিস তাহলে! আমরা ভাবছিলাম আজকেও বুঝি লেপের তলা থেকে আর বেরোতে পারিসনি!”

কথাটা মিথ্যে নয়। পরপর দশটা অ্যালার্ম সেট করে রাখে রেশমী, একদম তিন মিনিটের গ্যাপে গ্যাপে, তবু লেপের তলা থেকে বেরনোর সময় যেন চোখ ফেটে জল আসে প্রত্যেক দিন! কত ভাবে নিজেকে মোটিভেট করে ও, আজ থেকে কত হাজার বছর আগে রাম সীতা লক্ষ্মণ এই কনকনে ঠান্ডায় কিভাবে দিনের পর দিন বনে থাকতেন, তাঁদের নিশ্চয়ই এত আরামদায়ক লেপও ছিল না, গাছের ছালটাল পড়েই থাকতে হত! এভারেস্টে ওঠার সময় তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারি কত কষ্ট করেছিলেন, এই ঠান্ডায় পাশের ফ্ল্যাটের লোকটা রোজ ফার্স ট্রেন ধরে, সেইসব ভেবে নিজেকে সাহস জুগিয়ে চলে নিরন্তর। এরা যদি পারে, রেশমী পারবে না কেন, তাও আবার আটটার সময়! শুয়ে শুয়ে একটা করে অ্যালার্ম অফ করে, আর নিজেকে বলে, ”অনেক হয়েছে রেশমী, এবার ওঠ, নাহলে সেই ছোটাছুটি, স্কুলে ঢুকতে লেট, ফার্স পিরিয়ড মিস!”

ওর রোজকার এই সেলফ মোটিভেশানের কথা অনির্বাণকে রাতের টেবিলে বললে অনির্বাণ গম্ভীর মুখে খেতে খেতে বলে, ”হুহ! চোখের সামনে এতবড় মোটিভেটিং পার্সন থাকতে তোমার কিনা রাম সীতাকে দরকার পড়ছে! কেন আমাকে দেখতে পাও না? সকালে সাতটা পনেরোর ট্রেন ধরি আর রাতে সাড়ে ন-টায় ঢুকি? তোমার দেড় ঘণ্টা আগে বেরোই আর আড়াই ঘণ্টা পরে ঢুকি বুঝলে! তার ওপর প্রাইভেট চাকরি, তোমার মতো নাকি! আমাকে দেখে ইন্সপায়ার্ড হওয়া উচিত তোমার!”

রেশমী চুপসে যায়। অনির্বাণ প্রত্যেকদিন একদম রেডি হয়ে খেতে বসার আগে ওকে ডাকে, রেশমী অনেক কষ্টে লেপ থেকে বেরিয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে এসে জবুথবু হয়ে ওই পাঁচ মিনিট যা ডাইনিং-এ বসে, তারপর রান্নার মাসির তৈরি করে দেওয়া ব্রেকফাস্ট খেয়ে অনির্বাণ বেরিয়ে গেলেই ও অন্ধের মতো গিয়ে বিছানায় ডাইভ মারে। কাজেই অনির্বাণকে দেখে মোটিভেট হওয়াই যায়, কিন্তু সেটা রেশমী স্বীকার করবে কেন! ও অমনি উত্তর দেয়, ”তা হতে পারে, কিন্তু তোমার শনি রবি দু-দিন ছুটি, আর আমার? অনলি রবি! সেটা ভুলে যেওনা চাঁদু!”

সহেলীদি ওর দিকে চেয়ে আছে দেখে রেশমী হাসি হাসি মুখে বলল, ”উফফ, আর ভাল্লাগেনা গো! কবে যে ঠান্ডাটা কমবে!”

সহেলীদি বলল, ”চুল এত উসকো খুসকো কেন তোর? স্নান করার টাইম পেয়েছিস আজ?”

রেশমী বলল, ”না, সেইজন্যই তো ট্রেনটা পেলাম! স্নান করার জন্য উঠলাম, গিজা অন করে কাগজটা দড়ি থেকে খুলতে গিয়ে দেখি ওমা, ঠান্ডায় তিনজন মারা গেছে। তাই আবার এসে ঘুমিয়ে পড়লাম, মাঝখান থেকে পনেরো মিনিট এক্সট্রা আরাম করা গেল। হি হি।”

রেশমী ভেবেছিল ওর কথা শুনে একটা হাসির হুল্লোড় উঠবে কিন্তু সেরকম কিছুই উঠল না দেখে ও বাঁদিকে চাইতেই ওর গা-পিত্তি জ্বলে গেল। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। সবাই ঝুঁকে রয়েছে সুপর্ণার নতুন ফোনের দিকে, আর সুপর্ণা বেশ অহংকারী মুখ করে সবাইকে দ্যাখাচ্ছে ওর নতুন আই ফোন সেভেন। কাল রাতেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেখেছে রেশমী, ওর বর ওকে অ্যানিভার্সারিতে গিফট করেছে।

সুপর্ণা বেশ গদগদ মুখে সবাইকে বলছে, ”আরে আমি অমিতকে বললাম, এত দামি ফোন দেওয়ার কি আছে, এই তো জন্মদিনে প্ল্যাটিনামের সেটটা দিলে! কিন্তু আমার বরকে তো জানোই, কোনও কথাই শুনবে না! শুধু এটাই নয়, ওই দিনটা আবার ফ্লোটেলে টেবিল বুক করেছে জানো! কি যে পাগলামি করে না!”

সহেলীদি, শর্মিষ্ঠা, অনুদি-রা হাঁ করে গিলছে সুপর্ণার কথা, মুগ্ধ চোখে হাতে নিয়ে টুকটাক ঘাঁটছে মহার্ঘ্য আই ফোনটা, কিন্তু রেশমীর আনন্দের ভাবটা কেটে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই শুরু হল সুপর্ণার বরের পাঁচালী। সারাক্ষণ ওর বর ওকে এটা দিচ্ছে ওটা দিচ্ছে, উফফ! পরক্ষণেই অনির্বাণের মুখটা মনে পড়তেই ওর গা-টা রি রি করে উঠল। সুপর্ণারই বা দোষ কি! যে বর এত ভালোবাসে, কারণে কারণে এত গিফট দেয়, ছুটির দিন হলেই বাইরে ঘুরতে যায়, ট্যুরে গেলেই সুপর্ণার জন্য নিয়ে আসে দামি শাড়ি, তার প্রশংসা করবে না তো কি রেশমীর বরের করবে? ফেসবুকে তো দেখে, বাপ রে! প্রতি সপ্তাহে গিফট, আর ভালোবাসার স্ট্যাটাস তো আছেই! কত সব ইনোভেটিভ গিফট দেয়, ওদের দুজনের ছবি দেওয়া কফি মগ, সুপর্ণার নাম কোলাজ করা কুর্তি!

রেশমীর ধাঁ করে মনে পড়ে গেল, ঘটনাচক্রে সুপর্ণা আর ওর বিয়ের তারিখ এক। শুধু সুপর্ণার বিয়ে হয়েছে চার বছর আগে, আর রেশমীর এটা সেকেন্ড বিবাহবার্ষিকী। আগামী পরশু। সুপর্ণার বর টেবিল বুক করেছে আর অনির্বাণ? রেশমীর মুখটা বেঁকে গেল, হুহ! ও ড্যাম শিওর অনির্বাণের মনেই নেই দিনটার কথা! নির্লজ্জের মতো যেচে মনে করালে আগের বারের মতো একটা শাড়ি নিয়ে এসে হাজির হবে। না আছে কোনো রোম্যান্টিক প্ল্যান, না আছে কোনো নতুন ধরনের গিফট দেওয়ার চিন্তাভাবনা! ফেসবুকে স্ট্যাটাস তো দূর, খোলেই না! বললেই বলে, ”আমার ওসব ভালো লাগে না! তার চেয়ে চল দুজনে ল্যাপটপে একটা সিনেমা দেখি।” মরণ!

স্কুলে পৌঁছেও ওর মনখারাপ ভাবটা কাটল না। অনির্বাণ বার দু-তিনেক ফোন করায় হু-হাঁ করল শুধু। আজকাল ও চুপচাপ থাকলেও অনির্বাণ সেটা নোটিসই করে না, রুটিনমাফিক প্রশ্নোত্তর রাউন্ডের পর ঠিক রেখে দেয় ফোন।

অনির্বাণ এতটাও আনরোম্যান্টিক কিন্তু ছিল না আগে, বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিল রেশমী। বিয়ের আগে তো বটেই, বিয়ের পরেও প্রথম প্রথম হঠাৎ হঠাৎ দু-চার লাইনের কবিতা লিখে মেসেজ করত রেশমীকে, অফিস থেকে ফেরার সময় চকলেট নিয়ে ফিরত। যত ক্লান্তই থাক, রাতে রেশমীকে বুকের ওপর নিয়ে ঘুমত অঘোরে।

কিন্তু ইদানীং যেন কোনো দায়ই নেই রেশমীর ওপর। অফিস থেকে ফিরে শুধু কেজো কথা, ব্যস! তারপর ঘুমিয়ে যায় ভোঁস ভোঁস করে। বাসের বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা হিমেল হাওয়ায় রেশমীর কাঁপুনি লেগে যায়, ভালো করে টুপিটা জড়াতে জড়াতে চোখটা ভিজে আসে হঠাৎ। সুপর্ণার চার বছরেও এত ভালোবাসা, আর রেশমীর মাত্র দু-বছরেই কি এমন হল যে অনির্বাণ এরকম হয়ে গেল! তবে কি অন্য কেউ এখন দখল করেছে অনির্বাণের মন? আশঙ্কাটা মনে আসতেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় রেশমীর। সে-রকম কিছু হলে কি করবে ও? হ্যাঁ রেশমী মাথা গরম করে ফ্যালে দুমদাম, রেগে যায় হঠাৎ করে, সব ঠিক আছে, কিন্তু অনির্বাণকে তো ও প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে! যদি সত্যিই ওকে ঠকায় অনির্বাণ? নিজের মনেই চোয়াল শক্ত করে রেশমী, সেরকম কিছু সত্যি সত্যি হলে লম্বা একটা ধারালো ছুরি সটান অনির্বাণের বুকে ঢুকিয়ে দিতে ওর একফোঁটাও হাত কাঁপবে না, একদম খুন করে দেবে ও। তারপর ও নিজেও সেই ছুরি দিয়ে মরবে না জেলে যাবে, তাই নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যাথা নেই। যা হবার হবে।

আনমনে সহেলীদি-কে একটা হোয়াটসঅ্যাপ করল ও, ”কি করছ গো?”

মুহূর্তের মধ্যেই সহেলীদির উত্তর, ”এই তো, ট্রেনে রে, তুই বাড়ি পৌঁছে গেছিস?”

রেশমী উত্তর না দিয়ে লিখল, ”সুপর্ণার বরটা কি ভালো বল! কত কিছু দেয় ওকে! কি ভালোবাসে!”

সহেলীদি লিখল, ”হুম। পয়সাও আছে রে। আমার বর তো ভাবতেই পারেনা।” লেখার শেষে একটা দুঃখের ইমোটিকন।

রেশমী অমনি লিখল, ”নাগো, পয়সাটাই সব নয়। অনির্বাণ কি আইটি-তে কম মাইনে পায়? দেওয়ার মতো মন থাকা চাই বুঝলে? বৌকে ভালোবাসার মতো মন! কি সুন্দর সুন্দর সব ছবি দেয় সুপর্ণার বর!”

সহেলীদি লিখল, ”এটা ঠিকই বলেছিস রে। সবই ভাগ্য। আমি তো ফেসবুকে নেই, আমায় ক-টা পাঠাস তো, দেখব!”

আরো কিছুক্ষণ কথার পর বেশ কয়েকটা দুঃখের ইমোটিকন সহেলীদিকে ফরোয়ার্ড করে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ও নতুন কাজের মেয়েটাকে ফোন করল। আগের সন্ধেবেলায় আসা মেয়েটা দুম করে কাজ ছেড়ে দিয়ে খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিল, তারপর সুপর্ণাই এই মেয়েটার খোঁজ দিয়েছে। সুপর্ণার কাছে আগে কাজ করত, টাইমের অসুবিধার জন্য ছেড়ে দেয়। মেয়েটা ভালোই বেশ, বয়স কুড়ির মতো, বেশ হাসিখুশি আছে, তড়বড়িয়ে কথা বলে।

মাইনে টাইনে আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটাকে আপাতত একটা ডিমের অমলেট করতে বলে রেশমী ফেসবুক খুলল। অনির্বাণ আসার আগে অবধি এই দু-আড়াই ঘণ্টা ওর রোজকার অখণ্ড অবসর। অন্যদিন কোন সিনেমা দেখে, কিংবা মা-কে ফোন করে বকবক করে কিছুক্ষণ, আজ আর সেসব ইচ্ছে হল না। কি মনে হল, অনির্বাণের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা খুলল। হুম, যা ভেবেছে ঠিক তাই। অ্যাক্টিভিটি লগ দেখে বুঝল, সকালে মিনিট পাঁচেক অন হয়েছিল অনির্বাণ, টুকটাক ক-টা লাইক করে কেটে পড়েছে। না কারুর সঙ্গে চ্যাট, না কারুর ফটোয় কমেন্ট! ধুস! কি গোয়েন্দাগিরি করবে রেশমী!

বিরস মুখে ও লগ আউট করে নিজের অ্যাকাউন্টে ঢুকল। প্রথমেই সুপর্ণার ঝলমলে ছবি। পেছন থেকে জড়িয়ে আছে ওর বর। ছবির ক্যাপশন, প্রি-অ্যানিভার্সারি ক্লিক! রঙিন সুন্দর ছবিটা গোটা ল্যাপটপ জুড়ে যেন রেশমীকে উপহাস করতে লাগল।

রেশমীর হঠাৎ সহেলীদির কথা মনে পড়তে ফোন থেকে ফেসবুক খুলে ছবিটা ফরোয়ার্ড করতে গেল সহেলীদিকে, এমন সময় নতুন মেয়েটা রেশমীকে অমলেটের প্লেটটা দিতে এসে ল্যাপটপের দিকে চোখ পড়তে বলে উঠল, ”ওমা, সুপর্ণা দিদিমণি না! কত রোগা হয়ে গেছে গো!”

রেশমীর হঠাৎ মনে পড়ল মেয়েটা বেশ কয়েকমাস কাজ করেছিল সুপর্ণার বাড়ি, ও কাঁটাচামচে করে অমলেটের একটা ছোট পিস কেটে মুখে পুরে বলল, ”তুই ওর বাড়িতে কাজ করার টাইমে অন্য কাজ নিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলি? আমার এখানেও ওরকম করবি না তো? ওরকম করলে আগেভাগেই বলে রাখ বাপু, আমি অন্য লোক দেখব। দুম করে ছেড়ে দিলে খুব মুশকিল হয়।”

নতুন মেয়েটার নাম মহুয়া, মহুয়ায় মাতাল মানুষের মতোই মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল সে, ”ইইহ, মহুয়া সর্দার কক্ষনো ওরকম করে না দিদিমণি। একজনের টাইমে অন্য কাজ নেবই বা কেন। সে তো আমি সুপর্ণা দিদিমণিকে তাই বলে ছেড়েছিলাম। দিদিমণিকে তো আর বলা যায় না আসল কারণ, বলো না!”

রেশমীর মুখে একটা কাঁচালংকার টুকরো পড়েছিল, এই মহুয়াকে বলা হয়নি ও ঝাল একদমই খেতে পারে না। ঝালে অস্থির হয়ে টুকরোটা বের করতে গিয়ে ও চোখ কুঁচকে তাকাল, ”আসল কারণ মানে! কি আসল কারণ?”

মহুয়া তার হিলহিলে শরীর দু-বার মুচড়িয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, ”তোমার তো বন্ধু, তুমি আবার বোলো নি কো! ওই সুপর্ণাদিদিমণির বর যা শয়তান না, কি বলব তোমায়! আমি ঘর মুছতে ঢুকলেই নোংরা চোখে চেয়ে থাকত আমার দিকে, বজ্জাতটার নজর খালি বুকের দিকে। আমি চোখে চোখেই রাখতাম, একদিন সুপর্ণাদিদি ছাদে গেছে কাপড় মেলতে, আমার পিঠে হাত দিয়ে ডেকে বলে মহুয়া তোর চোখটা কি সুন্দর রে! ঝাঁটা মারি মুখে! মহুয়া সর্দার পয়সার জন্য খেটে খেতে পারে, কিন্তু অত সহজে চরিত্তির খোয়ায় না সে, বরকে গিয়ে বললাম ধোলাই দিতে, তো বর বলল আর যেতেই হবে না। পরদিন থেকেই আর যাইনি, ফোন করে বলে দিয়েছি সুপর্ণা দিদিমণিকে!”

শুনতে শুনতে মিনিটখানেক আগের ঝাল লাগাটা কোথায় উবে যায় রেশমীর, দিকবিদিক ভুলে ও চেঁচিয়ে ওঠে, ”কি যা তা বকছিস তুই? মিথ্যে কথা বলার আর জায়গা পাসনি? সুপর্ণার বর ওকে কত ভালোবাসে জানিস?”

মহুয়ার ফিসফিসে ভাব কেটে যায়, এবার তীক্ষ্ন গলায় আরো চেঁচিয়ে ওঠে, ”কি আমি মিছে কথা বলছি? ভালোবাসে? ওদের সারা পাড়া জানে গো দিদি, সুপর্ণাদিদির বর আদ্ধেক দিন রাতে এসে চেঁচামেচি করে, মারধোর করে, দিদির মাইনে নিয়ে নেয়, কত দিন আমি সকালে গিয়ে কালশিটে দেখেছি সুপর্ণাদিদির গায়ে। আমার কাছে একদিন কেঁদেও ফেলেছিল দিদি বলতে বলতে, আমি বলেছিলুম তুমি তো চাকরি করো, চলে যাও, এখানে পড়ে পড়ে মার খাও কেন? কিন্তু দিদি যাবে না। তারপর হাজারো মেয়ের সাথে লটরপটর গো, তাদের নিয়ে বাইরে যায় কাজে, সেই নিয়ে রোজকার অশান্তি। বরটা একদম ভালো না গো। মিছে কথা বলছি কিনা শুধোও গিয়ে তুমি ওদের পাড়ায়!”

রেশমী হতবাক হয়ে গেল। সুপর্ণার বাড়ি সে কোনোদিনও যায়নি, একেবারেই ট্রেনের আলাপ, সেই থেকে ফোনে, ফেসবুকে কন্ট্যাক্ট। সুপর্ণার বরের এই ভালোবাসা, রোম্যান্স সম্পর্কে রেশমীর পুরো ধারণাটাই ফেসবুকের ওপর দাঁড়িয়ে। হঠাৎ ও উপলব্ধি করল ভার্চুয়াল দুনিয়ায় যা দেখা যায় সেটাই যে সত্যি, তার কোনো মানে নেই। বরং ভার্চুয়াল দুনিয়ার পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে মেকি শো অফের উপর। মানুষ এখানে তার দুঃখ কষ্ট চেপে রেখে কৃত্রিম একটা ফানুসের মধ্যে বাস করে। আর তাই দেখে রেশমীর মতো বোকারা সেই ফানুসটাকেই সত্যি ভেবে নেয়। নিজেকে একটা আস্ত গর্দভ মনে হয় ওর।

ওকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মহুয়া বলল, ”কি গো জল দেব? খুব ঝাল লেগে গেছে বুঝি?”

রেশমী উত্তর দিল না।

হোয়াটসঅ্যাপের দিকে চেয়ে দেখল সুপর্ণার ছবিটা তখনো সহেলীদির কাছে যাচ্ছে, ক্রস চিহ্নটা টিপে সেটা যাওয়া বন্ধ করল ও, তারপর একমুহূর্ত থেমে লিখল, ”হ্যাঁ, সবই ভাগ্য সহেলীদি! আমাদের ভাগ্য সত্যিই ভাল।”

লেখাটা পাঠিয়েই আর একমুহূর্তও দেরি করল না রেশমী, অনির্বাণকে ফোন করে পরশুদিনের অকেশনটা মনে করিয়ে দিতে হবে, নাহলে এবারেও ঠিক গিফট আনতে ভুলে যাবে ভোঁদাইটা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *