স্পর্শসুখের উল্লাসে
মেন গেট দিয়ে ঢুকে হাজারো খুচরো বিক্রেতাদের ভিড় সামলে একটা মোটামুটি ফাঁকা জায়গায় এসে বড় করে নিশ্বাস নিলেন দোলগোবিন্দবাবু। উফ, কলকাতা বইমেলায় এখন বইপ্রেমীদের ভিড় যত হয়, তার চেয়ে ঢের বেশি ভিড় হয় কলেজ কেটে প্রেম করতে আসা ছেলেছোকরাদের আর মন্টেসরি স্কুলফেরত বাচ্চাকে নিয়ে খাবারের স্টলগুলোয় ঢুঁ মারতে আসা মায়েদের জন্য। সত্যিকারের পড়ুয়া আর কোথায়!
কথাটা মনে হতেই দোলগোবিন্দবাবুর বেজায় হাসি পেয়ে গেল। তিনি নিজেও কি বইপ্রেমীদের মধ্যে পড়েন যে অন্যের সমালোচনা করছেন? শুধু বইমেলা কেন সারা কলকাতা জুড়ে যখন যেখানে যে মেলা হয় সে খাদ্যমেলা, নাট্যমেলা, হস্তশিল্পমেলা থেকে শুরু করে মায় ইদানীংকালের জব অ্যান্ড এডুকেশন ফেয়ারেও একদিন না একদিন দোলগোবিন্দবাবুকে দেখা যাবেই। এমনকি, শিবরাত্রি, অন্নপূর্ণা পুজো বা গণেশ চতুর্থীর কোনো মেলাতেও বেজায় ভিড় হলে দোলগোবিন্দবাবুর গোলগাল মুখের দর্শন যে কেউ একটু খেয়াল করলেই পাবে। তবে দুর্গাপুজোটা দোলগোবিন্দবাবু সচেতনভাবেই অ্যাভয়েড করেন, কারণ বড় বড় পুজোর প্যান্ডেলগুলোয় এমনি পুলিশ তো থাকেই, এখন আবার ওই সিভিক পুলিশ ছেয়ে থাকে ভিড়গুলোয়। কি দরকার বেশি লোভ করে! দোলগোবিন্দবাবু অল্পেতে বরাবরই খুশি।
একটু জিরিয়ে নিয়ে দোলগোবিন্দবাবু সামনের দিকে তাকালেন। নাহ, এত বাস মেট্রো ঠেঙিয়ে আসাটা বৃথা হয়নি মনে হচ্ছে! ওই তো একটা টিভি চ্যানেলের স্টলের সামনে বেশ ভিড়, দোলগোবিন্দবাবু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিলেন।
একটা চলতি টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করা বাচ্চা মেয়ে বসে আছে, তার ছবি তুলছে সবাই পটাপট। মেয়েটা আবার মাঝে মাঝেই কচি গলায় তার জনপ্রিয় সংলাপ বলছে, জনতা হেসে গড়িয়ে পড়ছে, সেলফি আর ভিডিও উঠছে অগুনতি।
দোলগোবিন্দবাবু তাঁর অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে ভিড়ের ঠিক পেছনটায় দাঁড়িয়ে একটু উঁচু হয়ে চোখ বুলিয়ে নিলেন চারপাশে, না ষণ্ডা গোছের কেউ নেই, সবকটাই ম্যাদামারা রোমিও টাইপ ছেলে। মাইক ধরে অ্যাঙ্কারিং করা মেয়েটা এবার ক্যুইজ জাতীয় কিছু শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাই ভিড়ও বাড়ছে দ্রুত। দোলগোবিন্দবাবু সুকৌশলে ভিড়ের মধ্যে সুট করে ঢুকে গিয়েই টাইট ফিটিং জিনস পরা আঁটোসাঁটো টি-শার্টের মেয়েটার গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। ও-পাশটা আগেই দেখে নিয়েছেন, ক্যালানে কার্তিকের মতো একটা বয়ফ্রেন্ড, চাপের কিছু নেই। মেয়েটার গা থেকে ডিওডোরেন্টের মিষ্টি জুঁই ফুলের সুবাস দোলগোবিন্দবাবুর নাকে এসে লাগল। আহ! আর দেরি নয়।
অ্যাঙ্কর মেয়েটা প্রথম প্রশ্নটা বলতেই লোকজন ঝাঁপিয়ে লাফিয়ে হাত তুলতে লাগল। দোলগোবিন্দবাবু মেয়েটার একদম পাশাপাশি চলে এলেন, যেই মেয়েটা হাত তুলে বলছে, ”এদিকে মাইকটা দিন প্লিজ, আমি বলব” অমনি দোলগোবিন্দবাবু হাতটা আড়াআড়ি একদম পেছনদিক দিয়ে নিয়ে গিয়ে মেয়েটার নিতম্বটা ভালো করে কচলে দিলেন।
মেয়েটা চমকে গিয়ে পেছনে তাকাল। মুখে ভয়, লজ্জা আর অপমানের মিশ্র অনুভূতি। দোলগোবিন্দবাবু চাপ নিলেন না একদম। ভাবলেশহীন মুখ করে সামনের ক্যুইজের পরবর্তী প্রশ্ন শুনতে লাগলেন মন দিয়ে। দোলগোবিন্দবাবুর হাতের কাজ এমনই, পাশে দাঁড়িয়ে থেকে করলেও মেয়েটা ভাববে পেছনের কেউই করেছে। কিন্তু পেছনে একটা মোটা মহিলা। মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত স্থবির হয়ে গেল তারপর ওর বয়ফ্রেন্ডটাকে কিছু একটা বলল।
দোলগোবিন্দবাবু এতেও চাপ নিলেন না। বাঙালি প্রেমিকদের তাঁর জানা আছে। তারা তাদের বীরত্ব ঠিকঠাক জায়গায় দেখাবার বদলে প্রেমিকা বা স্ত্রীর ওপর দেখায় বেশি। একটু বাদেই বোঝা গেল দোলগোবিন্দবাবুর থিয়োরি একদম নির্ভুল। কিছুক্ষণ বাদে মেয়েটা মুখচোখ লাল করে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন ছেলেটাও।
দোলগোবিন্দবাবু কিছুই হয়নি এমন ভান করে ভিড় থেকে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে এলেন। নাহ, শুরুটা মন্দ হল না। পাশের বেনফিসের স্টল থেকে একটা গরম ফিশফ্রাই কিনে কামড় বসালেন। প্রথম কামড়টা বসিয়ে ওনার নিয়মমাফিক অপরাধবোধটা চলে এল মনে। ইস, এইটুকু মেয়েটার সঙ্গে এরকম অসভ্যতা করলেন!
পরমুহূর্তেই প্রতিবারের মতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন দোলগোবিন্দবাবু। এইটুকু আনন্দেই তো বেঁচে আছেন জীবনে। খারাপ পাড়ায় যান না, বাজে সঙ্গ করেন না, কোনো মেয়ের ওপর অত্যাচারও করেননি কোনোদিন, এইটুকু মজায় আর দোষ কি! এই রিটায়ার্ড লাইফে হঠাৎ নোলাটা একটু বেশিই বেড়েছে বছর দুয়েক হল, কি আর করা যাবে! ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডে কাজ করতেন, বউ তো কবেই চোখ বুজেছিল, তখন মেয়েটা এইটুকু। তাকে খাইয়ে স্নান করিয়ে বড় করা সবই তো একা করেছেন দোলগোবিন্দবাবু। সেই মেয়ে এখন বিয়ে-থা করে সুখে ঘরকন্না করছে। দুটো ফুলের মতো নাতনি, তারা দাদুর কাছে মাঝেমধ্যে এলে দোলগোবিন্দবাবুর একাকিত্বটা একটু কাটে। কিন্তু তাদেরও পড়ার চাপ। ভালো পেনশন পান, কোনোকিছুর অভাব নেই, রান্নার লোক, ঠিকে ঝি সবই আছে, মেয়ে মাসে একবার করে এসে সব তদারকি করে যায়। দোলগোবিন্দবাবু কি করবেন সারাদিন? তাই এই দৃষ্টিসুখ আর স্পর্শসুখ নিয়েই আছেন।
প্রথম শুরুটা হয়েছিল দু-বছর আগে, মনে পড়ল দোলগোবিন্দবাবুর। রিটায়ার করার পর একা বোকা জীবন কাটতেই চাইত না। কাঁহাতক আর ফ্যাশন চ্যানেল দেখা যায় আর ইন্টারনেটে ছোঁড়া সেজে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের সাথে সাহসী চ্যাট করা যায়, একটু বাদেই তারা ওয়েবক্যাম অন করতে বলে, প্রথম দু-একবার সাহস করে অন করেওছিলেন, কিন্তু দোলগোবিন্দবাবুর মাথা জোড়া চকচকে টাক আর নধর ভুঁড়ি দেখে পরপর কয়েকটা মেয়ে অফলাইন হয়ে যাওয়ায় আর ইচ্ছে করেনি। নিরলস দুপুর, অনন্ত সন্ধে কাটতেই চাইত না। দোলগোবিন্দবাবুর সেরকম বন্ধুবান্ধব কোনোকালেই নেই, নেই বই পড়ার নেশাও। জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
তখন একটা দরকারে হাওড়া গিয়েছিলেন, বাসে করে আসছিলেন, সাংঘাতিক ভিড় বাস, তিলমাত্র জায়গা নেই। ওঁর সামনেই একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল, বাসের হঠাৎ হঠাৎ ঝাঁকুনিতে দোলগোবিন্দবাবুর সাথে মেয়েটার ভালোই ঘষা লাগছিল। তখনই সাহস করে মেয়েটার বুকে হাত বুলিয়েছিলেন দোলগোবিন্দবাবু। আলতো করে চাপও দিয়েছিলেন একবার বুক দুরুদুরু অবস্থায়। কি করবেন, এই বয়সে এসে কামনা বড় বালাই! মেয়েটা বুঝতে পেরেছিল কিন্তু ভিতু ছিল, সদ্য গ্রাম থেকে আসা ভিরু চোখ তুলে ঘৃণার দৃষ্টি দোলগোবিন্দবাবুর দিকে ছুড়ে দিয়ে নেমে গিয়েছিল বাস থেকে, কোনো চেঁচামেচি না করে।
তখনই দোলগোবিন্দবাবু প্রথম বুঝেছিলেন যে অত ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। ভারতবর্ষের মেয়ে হয়ে জন্মেছে এরা, এটুকু অসভ্যতা তো সহ্য করতেই হবে। ৯৯ জন মেয়েই প্রতিবাদ করবে না, মুখ বুজে চেপে যাবে আর বাকি ১ জন করলেও আশপাশের লোকজনের নিরাসক্ত ব্যবহারে বেশিদূর এগোতে পারবে না, অতএব লাইন একদম ক্লিয়ার।
সেই শুরু। তারপর থেকে দোলগোবিন্দবাবুর জীবনে সময় কাটাবার আর অভাব হয়না। সারাটা সকাল তিন-চাররকম খবরের কাগজ দেখে দেখে প্ল্যান করেন কোথায় কোন মেলা বা পুজো হচ্ছে, কোনটায় যাবেন ছকে ফ্যালেন। যেরকম ভেন্যু তার সেরকম প্রিপারেশন। জব এডুকেশন না নাট্য মেলায় খুব সাবধানে থাকতে হয়, ইন্টেলেকচুয়ালদের ভিড়, অনেকসময় শুধু দেখা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। আবার চড়ক বা শিবরাত্রির মেলায় অবাধ স্বাধীনতা, শুধু নীচুজাতের মেয়েগুলো মহা বজ্জাত, তক্কে তক্কে থাকে, কেউ বদমায়েশি করলেই টাকা ঝাড়ার ধান্দা!
তারপর সারাটা দুপুর কেটে যায় দৃষ্টিসুখের উল্লাসে, অর্থাৎ ইন্টারনেটে অবাধ যৌনতার জগতে আনাগোনা করে। বড় নাতনি টুপুর যত্ন করে ধরে ধরে দাদুকে শিখিয়েছে মোবাইল, কম্পিউটার আর ইন্টারনেট। স্কটিশচার্চের ফিজিক্স অনার্স দোলগোবিন্দবাবুর এই বড় নাতনিটি সবেতেই এক্সপার্ট। টুপুরের থেকেই শেখা ফেসবুক আর ইউটিউব। তারপর ঘাঁটতে ঘাঁটতে পোক্ত হয়ে উঠেছেন এই ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। এতে অবিশ্যি নিজের কোনো কৃতিত্ব দেখেন না দোলগোবিন্দবাবু। একটা মানুষ যে সেলাইয়ের স-ও জানে না, তাঁকে যদি একটা উল আর কাঁটা দিয়ে একটা ঘরে ছ-মাস বন্দি করে দেওয়া হয়, সেও সোয়েটার বুনতে শিখে যাবে।
সারাটা দুপুর দৃষ্টিসুখ মিটতেই বিকেল হতে সপ্তাহে দু-দিন বেরিয়ে পড়েন স্পর্শসুখের খোঁজে। ঈশ্বরের কল্যাণে একটা দাদু মার্কা চেহারা পেয়েছেন, ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা সরল জটায়ু মার্কা মুখ দেখে কেউ সন্দেহও করে না। এই চেহারার জন্যেই একবার বিশাল কেলেঙ্কারির হাত থেকে কোনোরকমে বেঁচে গিয়েছিলেন দোলগোবিন্দবাবু। মেয়েটাকে দেখে বোঝা যায়নি এতটা ডাকাবুকো, সোজা এসে সাদা পাঞ্জাবির আস্তিন চেপে ধরেছিল।
দোলগোবিন্দবাবুও সঙ্গে সঙ্গে ”মা তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে, তোমার বয়সি আমার নাতনি আছে……” এইসব সেন্টিমেন্টাল ডায়ালগ দিতে শুরু করেছিলেন। তখন পাবলিকও এসে মেয়েটাকে আওয়াজ দিতে শুরু করল এরকম একজন অমায়িক দাদুর বয়সি ভদ্রলোকের গায়ে হাত, ছি ছি। বেগতিক দেখে একা মেয়েটা ছেড়ে দিয়েছিল।
এরকমভাবে আস্তে আস্তে দোলগোবিন্দবাবু এখন একজন পাকা খেলুড়ে হয়ে উঠেছেন। এই সাতষট্টি বছর বয়সে শরীরে যৌবন নেই, নেই সঙ্গমের ক্ষমতাও। তবু এই হালকা ছোঁয়ার লোভ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না কিছুতেই। নিজেকে হাজারবার প্রশ্ন করেছেন দোলগোবিন্দবাবু, আচ্ছা উনি কি বিকৃতকাম? সাথে সাথেই মনে হয়েছে ধুর, দোলগোবিন্দবাবু তো আর কোনো শিশুর সাথে এমন করেন না, যুবতী মেয়েদের দেখে এই ছোকছোকানি তো স্বাভাবিক! আর এরাই বা এমন পোশাক পরে কেন যাতে বাজে ইচ্ছা হয়? খবরের কাগজে পড়া নানা নেতা, সাধুদের মন্তব্য মনে পড়ে যেতে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন তিনি।
এভাবেই চলছিল। একদিন সকালে দোলগোবিন্দবাবু বসে ভাবছেন আজ কোথায় যাওয়া যায়! তেমন কোনো মেলাও চলছে না কোথাও, পুজোও তেমন নেই। কি করা যায়?
হঠাৎ চোখে পড়ল কাগজের এক দিকে, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে আজ মিছিল বেরোবে কাল রাতে ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে। বিশাল ছাত্র মিছিল যাদবপুর থেকে বেরিয়ে সোজা কলেজ ষ্ট্রিট অবধি আসবে। দোলগোবিন্দবাবুর মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটা ফন্দি খেলে গেল। মেলা, পুজো তো অনেক হল, এটায় চুপচাপ হাঁটলে কেমন হয়? এমনিতেই এই সব মিছিলে ঠ্যালাঠেলি ভিড় হয় খুবই, তারপর পুলিশের লাঠিচার্জে একবার ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেই তো সোনায় সোহাগা! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। একঝলক দেখে নিলেন, মিছিল শুরু হবে সন্ধে ছ-টায়। মানে শেষ হতে হতে রাত। অন্ধকারের অ্যাডভান্টেজটাও পাওয়া যাবে। দোলগোবিন্দবাবু ধোপদুরস্ত জামা পরে অধ্যাপকের মতো একটা লুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
মিছিল বেরোতে বেরোতে প্রায় সন্ধে সাতটা হয়ে গেল। অসংখ্য মানুষজন, তার মধ্যে ছাত্রছাত্রী যেমন আছে, তেমনি সাধারণ মানুষও আছে প্রচুর। দোলগোবিন্দবাবুকে কেউ তেমন খেয়াল করল না। কেউ খেয়াল করলেও কোনো শিক্ষক ভেবে জায়গা করে দিল। দোলগোবিন্দবাবু হাঁটতে লাগলেন। বেজায় গরম, তার ওপর কাল রাতের দু-পশলা বৃষ্টিতে কাদাকাদা হয়ে আছে চারদিক। মিছিলের একদম প্রথমে অনেক বড় বড় ব্যানার, ফেস্টুন, ঝাণ্ডা, সেখান থেকে মাঝে মাঝে কেউ একজন স্লোগানের আওয়াজ তুলছে, তাতে সুর মেলাচ্ছে মিছিলের মধ্য ও শেষভাগের লোকেরা। দোলগোবিন্দবাবু তাড়াহুড়ো করলেন না। ধীরেসুস্থে হাঁটছিলেন। অন্ধকারটা আরেকটু হোক।
প্রায় আটটা যখন বাজে, তখন মিছিলটা গিরিশ পার্ক পেরিয়ে এগিয়ে এসে ঢুকেছে একটা ছোট গলিতে। এদিকটা মনে হয় লোডশেডিং চলছে। ভিড় পাতলা তো হয়ইনি, উল্টে বেড়েছে। নতুন নতুন অনেক ছেলেমেয়ে মাঝখানে এসে ঢুকছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা রে-রে ধ্বনি শুনে দোলগোবিন্দবাবু চারপাশ থেকে শুনে যা বুঝলেন তা হল পুলিশের গায়ে কেউ কিছু ছোড়ায় পুলিশ তাড়া করেছে। বিশাল মিছিলটা ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করল সঙ্গে সঙ্গে। এমনিই অন্ধকার, তার ওপর পেছন থেকে চাপ আসতে এ ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে লাগল। দোলগোবিন্দবাবু এই সুযোগটাই খুঁজছিলেন। দেরি না করে প্রায়ান্ধকারে একটা মেয়ে ঘাড়ে এসে পড়েছে বুঝতে পেরে তাকে জাপটে ধরে বুক, তলপেট আর নিতম্ব মনের সুখে চটকে নিলেন।
দশ সেকেন্ডের হাতের সুখ করে নিয়ে ভালো মানুষের মতো সরে পড়তে যাবেন, এমন সময় মেয়েটার মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধিয়ে দিল তার। ভালো করে তাকাবার আগেই গালে একটা জোর রদ্দায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তিনি। ততক্ষণে মেয়েটার চিৎকারে ওর বন্ধুরাও ছুটে এসেছে। দোলগোবিন্দবাবু পড়ে গিয়েও মনে মনে সাজাচ্ছিলেন কিরকম অভিনয় করে পাশ কাটানো যায়, এমন সময় আবছা অন্ধকারে ওঁর চোখে পড়ল মেয়েটার পায়ের দিকে।
লাল রঙের ওপর ডোরাকাটা হলুদ ডিজাইনের খুব আনকমন এই ক্যাম্বিসের জুতোটা তাঁর বেশ পরিচিত, তিনি নিজেই এবারের পুজোয় কিনে দিয়েছিলেন টুপুরকে। কিছুটা আতঙ্কে আর কিছুটা বিস্ময়ে উনি মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেন!
এই মুখ তাঁর বড় চেনা, সেই জন্মানোর পর হসপিটালে দেখতে যাবার সময় থেকে!
পরেরদিন কাগজে পাঁচের পাতায় কোণের দিকে একটা ছোট্ট খবর বেরল, ”গতকাল গভীর রাতে দমদমে নিজের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এক বৃদ্ধ। তাঁর নাম দোলগোবিন্দ বসাক (৬৭)। কি কারণে তাঁর এই আকস্মিক আত্মহত্যা তা এখনো স্পষ্ট নয়। প্রতিবেশীদের মতে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বিপত্নীক দোলগোবিন্দবাবু একাই থাকতেন, বিশেষ কারুর সাথে মেলামেশা করতেন না। তিনি রেখে গেছেন তাঁর একমাত্র কন্যা অনিতা পালকে (৪২)। অনিতাদেবীর মতে প্রবল একাকিত্ব থেকেই তাঁর বাবা এই কাজ করে থাকতে পারেন। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।”