মায়ের জন্য গোটা একটা দিন

মায়ের জন্য গোটা একটা দিন

সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠেই মিমির অভ্যেস হল বিছানায় শুয়ে শুয়েই ফেসবুকটা একবার আলগোছে দেখে দেওয়া, হোয়াটসঅ্যাপটা একবার চেক করা। এমনিতেই রাতে শোয় ঘড়ির কাঁটা মোটামুটি বারোটা পার হলেই, তারপর গভীর রাতে কেউ ওকে মেসেজ পাঠিয়ে রাখবে এমন কোনো বিশেষ ব্যক্তি ওর জীবনে এখনও নেই।

তবু, এটা যেন একটা অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজকে ফেসবুক খুলতেই উপচে পড়ল সমস্ত বন্ধুর মাদার্স ডে উপলক্ষে মা-কে প্রচুর ভালোবাসার কথা। মা-কে তারা যে কত ভালোবাসে, মা ছাড়া তারা যে সম্পূর্ণ নিঃস্ব সেটা বিভিন্ন শেয়ারড ছবি, ভিডিও, কবিতার মাধ্যমে প্রত্যেকে বুঝিয়ে দিতে চায়। কেউ মা-র সঙ্গে ছবি পোস্ট করেছে, কেউ মা-কে নিয়ে বেরোনোর প্ল্যান করছে, কেউ আবার নিজেই কবিতা লিখে ফেলেছে কয়েক লাইনের।

মিমি লক্ষ করল বেশিরভাগ বন্ধুরাই তাদের মায়ের প্রোফাইলটাকে ট্যাগ করে দিয়েছে, কারুর কারুর মা তো ইতিমধ্যেই রিপ্লাইও দিয়ে দিয়েছেন। আস্তে আস্তে সবার মা-ই তাহলে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলছে।

দেখেশুনে মিমির মেজাজ খিঁচরে গেল। সবার মা যতই সবচেয়ে কাছের বন্ধু হোক না কেন, ওর মা নয়। আর এইরকম ফেসবুক করা আধুনিক মানসিকতার তো নয়ই। ছোট থেকেই কেমন যেন একটা ছাড়াছাড়া ভাব মায়ের। ছোট থেকেই স্কুল থেকে এসে যখন বাংলা সিরিয়ালের মতো ও মা-কে জড়িয়ে ধরতে যেত, সঙ্গে সঙ্গে মা ধীরে ধীরে ঠেলে সরিয়ে দিত ওকে। মানে, মা-র কাছে গেলেই কেমন একটা মায়ের চারপাশে অদৃশ্য বিকর্ষণ বল কাজ করতে শুরু করত। শুধু ওর সঙ্গে যে, তা নয়, দাদার সাথেও এই এক জিনিস। প্রথম প্রথম এই নিয়ে অনেক অনুযোগ করত ও, তারপর আস্তে আস্তে নিঃস্পৃহ হয়ে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে ও নিজের মনেই ভাবে কেউ কাছে গেলেই মা যদি এরকম সরিয়ে দেয় সবসময়, ও আর দাদা পৃথিবীতে এল কি করে!

যাই হোক, এসব আর ভেবে লাভ নেই। সবাই তো একরকম ছাঁচে ঢালা হয় না, একটা নিশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নামতে নামতে ভাবল মিমি। ওর সব বন্ধুরা তাদের মায়েদের নিয়ে হরদম সিনেমা দেখতে যায়, কি কোথাও খেতে যায়। ব্রেক আপ হলে পর্যন্ত সবচেয়ে আগে তারা বলে মা-কে।

আর ও? সেই বন্ধুত্বই কোনোদিন হল না মায়ের সাথে ওর। ও কি কম চেষ্টা করেছে? কতবার বলেছে মা-কে, ‘চল না মা! আজ বিকেলে কোথাও ঘুরে আসি! তোমাকে বাসে ট্রেনে উঠতে হবে না, ওলায় করে যাব আসবে।’

মা নিরাসক্ত উত্তর দিয়ে এড়িয়ে গেছে, ‘না, আজ শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। তার ওপর সব ঘর এলোমেলো হয়ে আছে, গোছাতে হবে। অন্য আরেকদিন যাবো। তুই যা না, ঘুরে আয় বন্ধুদের সাথে।’

আগে বাবা থাকতে তবু হইহুল্লোড় করত, বাবা দুম করে চলে যাওয়ার পর যে মিমি কি একা হয়ে গেছে!

মিমি আজ অবধি বুঝে উঠতে পারল না, মা কি চায়। নিজের কর্তব্যে কোনো খামতি রাখে না, কিন্তু মানুষের তো একটু আনন্দ করতেও ইচ্ছে করে!

আসলে মায়ের জীবনে ঘরদোর গোছানো ছাড়া আর কোনোকিছু নেই মনে হয়, সারাদিন খালি রান্নাঘর আর এটা সেটা গোছানো-সাজানো করেই চলেছে। স্কুল থেকে বা টিউশনি থেকে ফোন করলেই রেখে দেয়, বলে ‘ঝুল ঝাড়ছি, পরে কথা বলব।’

কারুর সারাটা দিন ঘরের মধ্যে কি করে ভালো লাগে? আগে তবু যখন ছিল ওকে নিয়ে টিউশনি ক্লাসে দিতে যেত, এখন ও ইঞ্জিনিয়ারিং হস্টেলে চলে যাওয়ার পর থেকে সেটাও বন্ধ। কোনো বন্ধু নেই, বাইরের কোনো জগৎ নেই, কি করে যে থাকে কে জানে!

ব্রাশ করে ও রান্নাঘরে একবার উঁকি মারল, যা ভেবেছে ঠিক তাই। মা চুপচাপ নিজের মনে কি একটা নাড়ু টাইপের জিনিস বানাচ্ছে। কিছু একটা পাকিয়ে পাকিয়ে মূর্তির শেপে কিছু করছে। এগুলো প্রায়ই বানায়, খেতেও দারুণ। কিন্তু ও যে আর তিনদিন বাদে এতদূরে চলে যাবে, সেই ব্যাপারে মা-র কোনো হেলদোল নেই। একবারও কাছে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল না যে তুই এতদূরে চলে যাচ্ছিস, আমার খুব মন খারাপ করছে, সাবধানে থাকবি।

একবার ভাবল আজকের দিনটা জানিয়ে উইশ করে মা-কে, তারপর ভাবল ধুর! যার কোনো ফিলিংসই নেই, কি হবে এসব বলে!

ও আর কিছু বলল না। এখন ওর শেষ মুহূর্তের অনেক কাজ বাকি। ভিসা-পাসপোর্ট, অ্যাডমিশন লেটার এগুলো সব সুন্দর করে ফাইলে সাজিয়ে নিয়েছে। জামাকাপড়ও গোছানো হয়ে গেছে প্রায়। অবশ্য ওর সবসময় গোছানোই থাকে, ওদের বাড়ি যখনই কেউ আসবে, মনে করবে বুঝি কোনো সাজানো হোটেলে এসে পড়েছে, এতটাই পরিষ্কার থাকে সবসময়। ওর নিজের আর্ট ওয়ার্কগুলোও ঢোকাতে হবে সাবধানে, লাগেজেই দিয়ে দেবে ঠিক করেছে। হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে প্লেনে অতক্ষণ বসে থাকা খুব কষ্টকর।

ভাবতে না ভাবতেই ফোন ঢুকল ওর, প্রিয়াঙ্কা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে প্রিয়াঙ্কার মায়ের উত্তেজিত গলা ভেসে এল, ‘কিরে মিমি, কি করছিস? আজ কি প্রোগ্রাম তোদের?’

ও একটা ছোট ঢোঁক গিলল, ‘সেরকম কিছুই না গো! ওই বাড়িতেই। কেমন আছ কাকিমা?’

প্রিয়াঙ্কার মা ভীষণ হুল্লোড়ে, হইহই করে আড্ডায় গল্পে মাতিয়ে রাখতে পারেন সবাইকে, বললেন, ‘বাড়িতে কেন রে? আজ তো রোববার পড়েছে, তুই চলে যাবি। মা-কে নিয়ে বাহুবলী দেখে আয়। তোর কত ছবি দেখি সারাদিন ফেসবুকে রে, কি ভালো লাগে। পিঙ্কি দারুণ উপকার করেছে আমায় ফেসবুকটা শিখিয়ে দিয়ে, সারাদিন কোনো একঘেয়েমি আসে না। তোর মা-কেও শিখিয়ে দে না। আমার সাথে আলাপটাও হয়ে যাবে। উনি তো কোথাও যান না। হ্যাঁ রে, ওখানে গিয়ে ভালো ভালো ছবি পাঠাবি যেন!’

মিমি এবার নিজের মনেই হাসল। হু! ফেসবুক! কম চেষ্টা করেছে ও? মায়ের জন্মদিনে একটা স্মার্টফোন সারপ্রাইজ গিফট করেছে, তাতে সবকিছু ইন্সটল করে মা-কে পাশে বসিয়ে শিখিয়েছে। এরকমভাবে পর্যন্ত বলেছে তুমি দাদাকে চোখে দেখতে পাবে মা, আমিও চলে গেলে আমার সঙ্গে দেখে দেখে কথা বলতে পারবে, এমন কিছু হাতিঘোড়া জিনিস না, আজকাল সবাই ফেসবুক করছে।

মা দু-তিন মিনিট বসে থেকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেখে টেখে কিছু একটা কাজের দোহাই দিয়ে সরে গেছে। বললেই বলে, ‘দূর! আমার ওসব ভালো লাগে না! একবার শিখে নিলে নেশা হয়ে যাবে তোদের মতো, তখন কাজকর্ম সব মাথায় উঠবে, কি দরকার! আর তোর দাদার সাথে কথার জন্য তো ল্যান্ডলাইনই ভালো, কেমন চেয়ারে বসে ধীরেসুস্থে কথা বলা যায়।’

‘আরে মোবাইলে তো তুমি শুধু বসে কেন, শুয়ে, দাঁড়িয়ে, কাত হয়ে যেভাবে খুশি কথা বলতে পারব!’ অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল মিমি।

মা রান্নাঘরের দিকে পা চালাতে চালাতে বলেছিল, ‘ও বাবা, সে আবার আরেক হাঙ্গামা। অত ফোন করলে সারাদিন কাজ করবো কখন? দরকার নেই বাবা, আমার ল্যান্ডফোনই ভালো।’

কাজ আর কাজ! নিজের মনে হতাশ মাথা নাড়ে মিমি। আজ পর্যন্ত মিমি বুঝে পেল না যে কি মা এই ঘরদোর গোছানো আর রান্না ছাড়া কি কাজ করে, কি করতে ভালো লাগে মায়ের আল্টিমেটলি! অবশ্য কিই বা করবে, কোনো যোগ্যতাই নেই মায়ের কিছু করার!

তারপরেও অনেকবার জোরাজুরি করেছে মা-কে শেখানোর জন্য। কত কাজও যে করা যায়, যেমন ক্যাব বুকিং, অনলাইন কেনাকাটা, গ্যাস বুক করা, এসবের অজুহাতও দিয়েছে।

মা কোনো আগ্রহই দেখায়নি। উল্টে একদিন ও বাথরুমে গেছে, পরিষ্কার শুনল মায়ের ফোনে ফেসবুকে কোনো নোটিফিকেশন ঢুকল, তার পরমুহূর্তেই ও শুনতে পেল, মা ফোনটা কানে ধরে, ‘হ্যালো হ্যালো, উত্তর দেবেন না তো ফোন করেছেন কেন!’ এসব বকে চলেছে।

রাগে দুঃখে মাঝে মাঝে কান্না পায় মিমির। এরকমভাবে পর্যন্ত বুঝিয়েছে লাল সিগন্যাল হলে গাড়ি থেমে যায়, আর সবুজ হলে চলতে শুরু করে, তুমি এটা মনে রাখবে মা, ফোন এলেই সবুজ, আর ফোন কাটার সময় লাল, এটুকু মনে রাখবে।

কিছুই লাভ হয়নি বিশেষ। মা সেই লাল দিয়ে ধরতে আর সবুজ দিয়ে কাটতে যেত। মোবাইল পড়ে থাকত, মা ল্যান্ডফোন থেকেই কথা বলত।

বাধ্য হয়ে মাসখানেক আগে ফোনটা ওএলএক্স-এ বেচে দিল ও।

ওপাশ থেকে এবার প্রিয়াঙ্কা চেঁচাল, ‘কিরে, গোছগাছ কমপ্লিট? আমার তো ভেবেই এক্সাইটেড লাগছে মিমি, আমাদের সব ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া পাবলিকগুলো টুয়েলভের পর বাইরে পড়তে যাবে বলে সেই সেভেন এইট থেকে স্যাট, টোয়েফলের প্রিপারেশন নিয়ে চুল পাকিয়ে ফেলল, তাদের নাকের ডগা দিয়ে তুই এতবড় একটা ইন্সটিটিউটে পড়তে যাচ্ছিস, তাও আবার ফুল স্কলারশিপে। আই অ্যাম ফিলিং সো প্রাউড অফ ইউ সুইটি! আজকে যেতাম তোর বাড়ি, কিন্তু আজ আমি আর মা বেরোচ্ছি, বাহুবলী আর পোস্ত দেখব, একদম ব্যাক টু ব্যাক!’

মিমি হাসল, অস্ফুটে বলল, ‘বাহ। দারুণ। তবে আমি ঠিক পড়তে যাচ্ছি না, ইন্টার্নশিপ করতে যাচ্ছি। আর স্কলারশিপ নয়, আমি স্টাইপেন্ড পাব।’

প্রিয়াঙ্কা হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘উফ, ওই হল বাবা! তোর হাতের কাজ এতটাই সুন্দর যে দেখে ওই ওয়ার্ল্ডফেমাস বডি পেইন্টিং অ্যাকাডেমি পড়ার বদলে ডাইরেক্ট ইন্টার্নশিপের জন্য তোকে অ্যাপ্রোচ করেছে, তাই তো? ভাবা যায়? তার ওপর প্যারিস! উফ, ভাবলেই বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে যে তুই প্যারিসে থাকবি। এ তো পুরো থ্রি ইডিয়টসের ফারহান ক্যুরেশির গল্প! কি ভাগ্য তোর! অ্যাই, এর পরের বার এসে আমার পিঠে বাহুবলীর প্রভাসকে এঁকে দিবি তো?’

পাশ থেকে প্রিয়াঙ্কার মায়ের গলা স্পষ্ট শুনতে পেল মিমি, ‘ভাগ্য কেন হবে? পরিশ্রম বা প্রতিভাকে যারা ভাগ্য বলে ছোট করে তারা আসলে ফাঁকিবাজ, ঠিক তোর মতো। তোকে তো ছোট থেকে কতবছর ধরে আঁকা শেখালাম, ঠিক করে এখনো একটা চোখ আঁকতে শিখলি না, ওই খালি ফিল্মস্টারদের নিয়েই পড়ে থাক। আর মিমি? কোনোদিন ও কোথাও না শিখে এত দারুণ আঁকার হাত ওর। এটা ট্যালেন্ট না?’

ফোনটা রেখে মিমিও ভাবল সত্যিই আঁকাটা ওর প্রতিভাই বটে। নাহলে কোনোদিনও না শিখে ওর হাত এত সড়গড় হয় কিভাবে। গানবাজনা, আঁকা এসব তো বংশগত হয় বলে, কার থেকে যে ও এই প্রতিভাটা পেল কে জানে! বাবামা তো আঁকার ধারেকাছে দিয়ে যায়নি কোনোদিন। তাও আবার অদ্ভুতভাবে এমনি আঁকতে ওর হাত খোলে না তেমন, কিন্তু হিউম্যান বডিতে আঁকার সময় ওর হাত যেন কথা বলতে শুরু করে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে ফরম্যাল আর্ট শেখার বদলে বডি পেইন্টিং শেখার কথাই ভেবেছিল ও। এদেশে তেমন চালু না হলেও বিদেশে এটার দারুণ কদর, বড় বড় একজিবিশন হয়, ঠিকমতো ইন্টার্নশিপটা করতে পারলে ওখানেই প্লেসমেন্ট পেয়ে যাবে ও, তারপর তো একদম এনআরআই। কে আর আসে এই দেশে!

মা কখন জলখাবার নিয়ে ঢুকেছে ও খেয়াল করেনি। ওর ফেবারিট লুচি আর মাখামাখা আলু চচ্চড়ি, আর সাথে গাঙ্গুরামের সেই ‘আবার খাবো’ মিষ্টি। আহ, মুখে দিলেই যেন মিলিয়ে যায়, মিষ্টির একটা কোণা ভেঙে মুখে পুরে ভাবল মিমি। আচ্ছা গাঙ্গুরামে কে গিয়ে নিয়ে এল মিষ্টি? দাদা তো নেই। তবে কি মা-ই নিয়ে এসেছে? কে জানে! ও আর অতশত ভাবতে পারল না। এখন ওর মাথায় অনেক চাপ। স্টাইপেন্ড পাবে ঠিকই, কিন্তু প্যাসেজ মানিটা তো নিজেদের দিতে হয়েছে!

মা-কে যখন পুরো ব্যাপারটা জানিয়েছিল, ভেবেছিল মা রাজিই হবে না, পড়তে টড়তে গেলে তবু ঠিক আছে, কিন্তু বডি পেন্টিং। মায়ের মতো আদ্যিকালের মানসিকতার মহিলা কিসব খারাপ ভাবত কে জানে! হয়তো নোংরা কিছুই ভেবে বসতো। তাই ও অতকিছু জানায়ও নি, শুধু বলেছিল আর্ট স্কুলেই চান্স পেয়েছে।

মা তেমন কিছু বলেনি, শুধু ওর মোট কত টাকা লাগবে, কোথায় থাকবে এইসব জিগ্যেস করেছিল। এমনিতে ওদের অবস্থা খুব একটা ভালোও না, আবার খারাপও না। বাবা মারা যাওয়ার পর পেনশনের টাকাতেই সংসার চলছে ওদের। কিন্তু দাদা পড়তে যাওয়া থেকে ইস্তক একটু টানাটানি চলছে। তবে তা নিয়ে মা কিছু বলে না। কি করে চালায়, দাদার কলেজের মোটা ফি, ওর পেছনে খরচ, কোথা থেকে টাকা আসে মা-ই জানে। বাবার পেনশন তো খুব বেশি কিছু নয়। তবে ও এব্যাপারে কিছু জানতে চায় না। আসলে সেই বন্ডিংটাই ওর আর ওর মায়ের মধ্যে নেই। সবকিছুই কেমন ছাড়াছাড়া! কোথা যায় না, মেশে না, কি যে করে ভগবানই জানেন!

জলখাবার খেয়ে নিয়ে ও একটু ইতস্তত করে মায়ের কাছে গেল। যাওয়ার আগে ওর পাঁচ-ছ’হাজার মতো টাকা চাই। ওই ওর করা যে কোনো বডি পেন্টিং এর লাইভ একটা মডেল ওরা ওখানে নিয়ে যেতে বলেছে। ও তো এমনি পেপারে ডিজাইন করে পাঠিয়েছিল অ্যাপ্লিকেশন, তাই এটা দরকার। আর এটা নিয়েই ও একটু চাপে আছে। চামড়ার ওপর আঁকতেই ওর ভালো লাগে সবচেয়ে বেশি, কিন্তু তেমন প্র্যাক্টিস তো করতে পারেনি। নিজের এত পয়সা খরচ করে যাচ্ছে, গিয়ে ওখানে ওর কাজ পছন্দ না হলে যদি ইন্টার্নশিপ বাতিল করে দেয়? অনেক ভেবেচিন্তে ও একটা ডিসিশন নিয়েছে, কলকাতায় বডি পেইন্টিং অ্যাকাডেমি তো নেই, কিন্তু নামকরা ট্যাটু সেন্টার তো আছে ওই রাসবিহারীর মোড়ে, ওর অনেক বন্ধু ওখানে ট্যাটু করিয়েছে। সেখানে গিয়ে যদি একটু টাকাপয়সা দিয়ে একবার প্র্যাক্টিস করা যায়, তাহলে নিজের গায়েই ও এঁকে নেবে। এব্যাপারে ও কথাও বলেছে কয়েকজনের সঙ্গে। সারা পৃথিবীতেই বডি পেন্টিং তো বটেই, ট্যাটুর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম, শিখতে বা শেখাতে গেলে নিজের শরীরে করে দেখাতে হয়।

মা বলল, ‘ছ-হাজার টাকা! এক্ষুনি? কি করবি?’

মিমি মনে মনে একটু বিরক্ত হল, তবু মুখে এটা প্রকাশ করল না, ‘একটা কাজ আছে।’

মা এবার চুপ করে গেল, ‘এখন তো অত টাকা হবে না আমার কাছে। মাসের শেষ, এমনিই এখন তোর যাওয়ার জন্য হাতে কিছু নেই। তাও কি দরকার বললে না হয়….!’

মিমি এবার রেগে গেল, মা-কে তো ও এটাই বলেনি যে বডি পেন্টিং শিখতে যাচ্ছে ও, সেখানে ট্যাটু করাবে শুনলে কি বলবে কে জানে! তবু ও আর চুপ করে থাকতে পারল না, ‘ট্যাটু করাব। আর সেটা শখে নয়, দরকারে। বুঝেছো? টাকাটা দিতে পারবে কি?’

মা এবার কেমন যেন থমকে গেল, ‘ট্যাটু? মানে উল্কি? কেন হঠাৎ?’

মিমি বেজারমুখে উত্তর দিল, ‘লাগবে আমার, ওখানে গিয়ে। তুমি টাকাটা দিতে পারবে কি? আমি তোমায় পরে সব শোধ করে দেব।’

মা চুপ করে রইল, কোনো উত্তর দিল না।

মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে থেকে ও দুমদুম করে নিজের ঘরে চলে এল।

মায়ের এই নিরাসক্তির জন্য ওর রাগও হচ্ছে আবার মা-কেও সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। এত টাকা মা হঠাৎ কোথা থেকে পাবে। কি করবে এখন ও নিজেই বুঝতে পারছে না। যাওয়ার আগে আগে করালে একদম টাটকা থাকবে বলে এতদিন কাজটা ফেলে রেখেছিল। সেটাই ভুল হয়েছে। আগে থেকে বলে রাখলে হয়তো মা…।

ওর ভাবনা শেষ হল না, মা এসে ঢুকেছে ঘরে। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলল, ‘ট্যাটু করতে কিন্তু খুব লাগে, স্কিনের কিছুটা ভেতর দিয়ে ছুঁচ চালায় তো, করার পরেও জ্বর চলে আসে, ফোলা ভাবটা থাকে প্রায় এক সপ্তাহ। তোর কষ্ট হবে না?’

বাবা! মা এত কি করে জানল! মিমি তবু শান্তভাবে উত্তর দিল, আর ঢেকেঢুকে লাভ নেই, ‘কিছু করার নেই মা! আমি বডি পেন্টিং এর ইন্টার্নশিপ করতে যাচ্ছি, নরম্যাল আর্টের নয়। সেখানে এটা করে নিয়ে যেতে হবে।’

মা এবার অবাক হয়ে গেল, ‘বডি পেন্টিং? মানে তুই ট্যাটু শিখতে যাচ্ছিস?’

মিমি এবার বিরক্ত হয়ে উঠল, এই শুরু হল বোকা বোকা প্রশ্ন আর জেরা, ‘ট্যাটু শুধু শরীরের একটা জায়গায় হয় আর সেটা ছুঁচ দিয়ে। কিন্তু বডি পেন্টিং সারা শরীরে করা হয়, আর সেটা ছুঁচ দিয়েও হতে পারে, এমনি রঙ দিয়েও। আমার ওটাতেই ইন্টারেস্ট। এটা খুব নতুন একটা আর্ট, আর ডিম্যান্ডও খুব।’

মা এবার চুপ করে গেল।

মিমি আবার বলল, ‘রাসবিহারীর মোড়ে একটা ভালো ট্যাটু সেন্টার আছে, সেখানেই করাব।’

মা বলল, ‘কিসের ছবি করাবি?’

মিমি বলল, ‘এখনো তেমন কিছু ভাবিনি, তবে হিউম্যান ফিগার ঠিক করেছি, ওই ড্রাগন টাগন নয়।’

ওদের সাবেক আমলের ঘরে ঘটাং ঘটাং ফ্যান চলছে, বাইরে কিছু একটা পাখি ডেকে চলেছে একটানা। তারই মধ্যে মা ওর একদম সামনে এলে দাঁড়াল, একমুহূর্ত ইতস্তত করে ন্যাতার মতো জড়িয়ে থাকা পড়নের শাড়িটা সরিয়ে দিল পেটের সামনে থেকে, ‘এরকম হলে চলবে? তাহলে আমিই করে দিতে পারি, পয়সা লাগবে না কিছু। এটা আমিই করেছি।’

মিমি একমুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল। মায়ের পেটে সুনিপুণ হাতে আঁকা একটা সুন্দরী মহিলার নিখুঁত পোর্ট্রেট। শুয়ে থাকা একজন ইউরোপিয়ান তরুণী, তাঁর গলা দিয়ে এলিয়ে পড়ে রয়েছে একটা সুন্দর নেকলেস। সারা শরীরে কোথাও বেদনার ছাপ না থাকলেও মুখে কেমন একটা অবিশ্বাস ও ব্যাথার ছাপ। একটু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে পিঠের দিক থেকে প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে একটা ছুরি বেঁধানো পিঠে।

ওথেলোর ডেসডিমোনা!

ও স্থবির হয়ে গিয়ে মায়ের দিকে তাকাল, বাকশক্তিও হারিয়ে ফেলেছে ও।

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে মা বলল, ‘এটা পছন্দ হল না? তবে এইটা?’ পায়ের গোছ থেকে শাড়িটা তুলে একটা অসাধারণ সুন্দর ময়ূরের ট্যাটু বের করে আনল মা, তবে এটা বেশ ঝাপসা।

ও বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে বলল, ‘তু-তুমি ট্যাটু করেছ! কিন্তু কেন মা?’

মা ওর মুখটা তুলে নিজের বুকে চেপে ধরল, ‘এই একটা জিনিসই যে পারি আমি মিমি! আর কিছুই যে করার ক্ষমতা নেই আমার। ছোট্ট থেকে, উল্কি আঁকাই ছিল আমার শখ। বন্ধুবান্ধবদের কত যে এঁকে দিয়েছি! বিয়ের পর তোর ঠাকুমা একদিন আমার হাতের একটা উল্কি দেখে ভীষণ বকাবকি করল, সব ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তোর বাবা চলে যাওয়ার পর আবার শুরু করতেই হল। তোর দাদার অত টাকা ফিজ, তোর খরচ, ওইটুকু পেনশনে কি হয়? তাই নতুন করে শুরু করলাম। তোরা স্কুলে বেরিয়ে যেতিস, আমিও বেরিয়ে পড়তাম শিখতে। আগে থেকে তো জানতামই, তাই হাত পাকাতে বেশি টাইম লাগল না। তোর স্কুলের অনেককেই করে দিয়েছি আমি। রাসবিহারী মোড়ের ট্যাটু সেন্টারে আমিও একজন আর্টিস্ট!’

মিমির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। ওর আঁকার জন্মগত প্রতিভা তাহলে মায়ের থেকে পাওয়া! বুজে আসা গলায় কোনোমতে ও বলল, ‘আমাদের বলনি কেন মা?’

মা বলল, ‘ট্যাটু জিনিসটাই তো আমাদের সমাজে এখনো কেমন বাজেভাবে দেখা হয় রে। এটা যে কতবড় আর্ট সেটা লোকে বোঝে না, তাদের ধারণাই নেই যে কাগজে আঁকা আর চামড়ায় আঁকার মধ্যে অনেক পার্থক্য। তোরা কেমনভাবে নিবি ব্যাপারটা, বুঝতে পারিনি তো! তাই বলিনি। তোদের কাছে আসতেও দিতাম না তাই। পাছে দেখে ফেলিস! ফেসবুক বা বাইরেও তোদের সাথে বেরোলে যদি কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, আলটপকা কিছু বলে বসে? তাই বেরোতামও না।’

মিমি আর চোখের জল মুছছিল না। এতদিনের জমে থাকা সব অভিমান যদি আজ জল হয়ে বেরোতে চায়, তা বেরোক। মা ওদের জন্য এত কষ্ট করেছে? আর সেই মা-কে ও কিনা কত ভুল ভেবেছে! ওর এরকম কনভেনশনের বাইরে গিয়ে পড়তে যাওয়ার জন্য মা-কে কত খাটতে হয়েছে। ওরা কি ভাববে সেইজন্য মা দিনের পর দিন কোথাও বেরোয়নি ওদের সাথে, আড়ালে এত কষ্ট করে চাহিদা মিটিয়েছে ওদের।

এতটা নিঃস্বার্থ কি কেবল মায়েরাই হতে পারে! কিভাবে এত ভালোবাসা শোধ করবে ও?

মিনিট দশেক বাদে ও মা-কে জড়িয়ে ধরল, ‘তুমি তোমার করা সব ট্যাটু গুলোর ছবি দিতে পারবে মা?’

মা ওকে একটুও বাধা দিল না, ‘সে তো প্রচুর। সেন্টারের অ্যালবামেই রাখা আছে। কি করবি?’

মিমি শক্ত করে মা-কে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার ওই ইন্সটিটিউটে পাঠাব। ওরা তোমাকেও সিলেক্ট করবে দেখো ইন্টার্নশিপের জন্য! আমরা দুজনেই যাব মা!’

তারপর ও মায়ের কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘আর আমি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে গুণের, সবচেয়ে মা-টার সঙ্গে এখন যাব প্রভাসকে দেখতে। হ্যাপি মাদার্স ডে মা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *