ফুলশয্যা

ফুলশয্যা

প্রতিমা চুপটি করে খাটের কোণ ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। এই খাট, এই আলমারি, ওই আলনার তাকে রাখা দৈনন্দিন রান্নার নুন-হলুদ লেগে থাকা শাড়ির গন্ধ প্রতিটা জিনিষই গত কয়েক দশক ধরে তাঁর কাছে বড় আপন, কাছের। অন্যদিন হলে এতক্ষণে খাটের ওপর পা ছড়িয়ে বসে আজকের আনন্দবাজারটা উল্টোতে শুরু করতেন, সারাটাদিনের কাজের শেষে এইটুকু সময় তাঁর একমাত্র নিজের, এতগুলো বছরে এর ভাগ প্রতিমা কাউকে দেননি। এমনকি প্রথম প্রথম যখন ছেলেমেয়েগুলো অ্যাত্তটুকুন, তখনো বরের জিম্মাতেই এইসময়টা রাখতেন ওদের। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। নিজের এত চেনা খাটের পাশে দাঁড়িয়েও কেমন একটা লজ্জা, সংকোচ এসে গ্রাস করছিল তাঁকে।

প্রতিমা চশমাটা উঁচু করে ধরে ঘড়ির দিকে তাকালেন, সাড়ে দশটা বাজে, কিন্তু এখনো মানুষটার পাত্তা নেই। একঝলক পরনের বেনারসিটার দিকে তাকালেন, হাসিও পেল, আবার মনটা কেমন যেন ভিজেও গেল। এই একটা জিনিসই যা বাড়ি থেকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন প্রতিমা, তাও অন্য কিছুর লোভে নয়, স্রেফ মায়ের স্মৃতিটা সঙ্গে রাখবেন বলে। এত বছর হয়ে গেল, কিছু জায়গায় জরি অল্প ছিঁড়ে পিঁজে গেলেও মোটের ওপর অটুট রয়েছে শাড়িটা। এত বছরে এই প্রথম শাড়িটা কাজে লাগল। মুকুটটা কপালের নীচে ঝুলে পড়েছিল, পাতলা হয়ে আসা চুলের মাঝে ঠেলে দিলেন। কুটকুট করছে কিন্তু খোলার উপায় নেই। কড়া হুকুম আছে না খোলার। আজ যে ওঁদের ফুলশয্যা। সবার জীবনে বিয়ের পরের দিন কালরাত্রি হয়, তার পরেরদিনই ফুলশয্যা হয়।

কিন্তু প্রতিমার ফুলশয্যাটা একটু বেশিই দেরি করে হচ্ছে, মাত্র পঞ্চাশ বছর বাদে!

নিঃশব্দ ঘর, বাইরে আর তেমন হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে না। সবার মনে হয় খাওয়াদাওয়া শেষ। প্রায় সাড়ে চারশো লোক বলা হয়েছিল, সব ঠিকঠাক মিটল কিনা কে জানে! চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রতিমা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিলেন।

আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে প্রতিমা, বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন বাবামায়ের অমতে বিয়ে করবেন বলে। তখন পাত্রপাত্রীর নিজের পছন্দে বিয়ে শোনাই যেত না, উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা মানে সেটা সম্পূর্ণ বড়দের জন্য। সেইসময় প্রতিমাদের মতো সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে পালানো মানে বাবা-মায়ের আত্মহত্যার সামিল। চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের পড়াশুনোয় ভালো মেয়েটার নামে কত মিথ্যে, অকথা, কুকথা, গুজবের সিঁড়ি বেয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিমা জানতেন বাবা-মা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, জ্যাঠামশাই এরা কত কষ্ট পাবেন! কিন্তু প্রতিমা নিরুপায় ছিলেন। বাড়িতে থেকে আরও বড় আঘাত ওদের দিতে চাননি।

প্রতিমাদের ছিল উত্তর কলকাতার রক্ষণশীল যৌথ পরিবার। প্রতিমা ভালো ছাত্রী ছিলেন তবু বাড়ির মেয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে ঠিক আছে, কলেজে পড়ুক, তার ওপর কো-এড কলেজ, তাতে কারুরই মত ছিল না বিশেষ। ভারত তখন সবে স্বাধীন হয়েছে, সদ্যোজাত দেশটায় তখন জন্ম নিচ্ছে দুর্ভিক্ষ, হাহাকার, মড়ক। প্রতিদিনই নিত্যনতুন রিফিউজি এসে ঘাঁটি গাড়ছে শহরে। এই অবস্থায় বাস ট্রাম ঠেঙিয়ে প্রতিমা কলেজে যাক, চাননি কেউই। একমাত্র চেয়েছিলেন জ্যাঠামশাই। জ্যাঠামশাই বিদ্যাসাগরের শিক্ষায় শিক্ষিত, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন নারীশিক্ষায়। বলতে গেলে একমাত্র জ্যাঠামশাইয়ের ভরসাতেই কলেজে ঢোকা প্রতিমার। আর সেখানেই দেখা সুবিনয়ের সাথে।

প্রথম দেখাতেই ঝোড়ো হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সুবিনয়। তখন কম্যুনিস্টদেরকে সরকার ধরে ধরে জেলে পুরছে, সেই অবস্থায় সুবিনয় প্রতিমাকে শুনিয়েছিল এমন এক শ্রেণীহীন সমাজের কথা, যেখানে থাকবেনা কোনো ধনী আর দরিদ্রের বৈষম্য। অনেক পরে যখন নিজের মেয়ের কাছে সুমনের গানগুলো শুনতেন প্রতিমা, মনে হত আরে! এ তো সুবিনয়েরই কথা!

প্রতিমা চটুল প্রগলভ মেয়ে ছিলেন না, আবার জড়সড় লজ্জাবতীও নয়। চুপচাপ গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন সুবিনয়দের আবেগে মোড়া কথাগুলো। একদিন এই পচে গলে যাওয়া মৃতদেহের মতো সমাজটাকে ওরা পুরো পালটে দেবে, এই স্বপ্ন সুবিনয়ের সাথে প্রতিমাও দেখতে শুরু করেছিলেন। কয়েকমাসের না- কাটা দাড়ি মুখে সুবিনয় বলে চলত ওদের মিশন সম্পর্কে। বলত ওদের লিডার মানিকদা কিরকমভাবে নিজের জীবন তুচ্ছ করে সংগ্রাম করে চলেছেন। মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেত দিনকয়েকের জন্য, আবার ধূমকেতুর মতো উদয় হত। প্রতিমা সেই দিনগুলো চাতক পাখির মতো বসে থাকতেন।

হঠাৎ একটা শব্দে ওঁর চিন্তার জ্বাল ছিঁড়ে গেল। বড় নাতনি মিষ্টু ঢুকেছে ঘরে, হাতে এক রাশ গোলাপের তোড়া, ব্যস্ত হাতে গোলাপের পাপড়িগুলো বিছিয়ে দিচ্ছে ধবধবে সাদা চাদরে মোড়া বিছানাটায়। প্রতিমা বলে উঠলেন, ”অ্যাই, কি করছিস বলত তোরা! তোদের দাদু কোথায়?”

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সদ্য চাকরিতে ঢোকা মিস্টু হাতের কাজ চালাতে চালাতে ভ্রূ বেঁকিয়ে চোখ টিপল ঠাম্মার দিকে তাকিয়ে, ”বাবা! আমরা এদিকে খেটে খেটে মরছি, আর উনি নিজের বরের খোঁজ করে যাচ্ছেন! দাঁড়াও ঠাম্মি, আগে তোমাদের খাটটা রোম্যান্টিকভাবে সাজাই! তবে না দাদু তোমায় আদর করবে!”

প্রতিমা লজ্জা পেয়ে বললেন, ”যাহ! কি যে আজেবাজে বকছিস! আমার আবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে শোয়া তো, বড্ড ঘুম পাচ্ছে। তোর দাদু তো এখনো হার্টের ওষুধগুলো খায়নি।”

মিষ্টুর কাজ শেষ, রুম ফ্রেশনার স্প্রে করছে পুরো ঘরে, ”খাবে খাবে, ওষুধ কেন আরও কত কি খাবে আজ রাতে! ফুলশয্যা বলে কথা!”

প্রতিমা কপট রাগের ভঙ্গিতে হাতটা মারবার জন্য তুলতেই ফিচেল হাসি হেসে চড়াই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে চলে গেল মেয়েটা! ছেলেমেয়ের মোট পাঁচ নাতি-নাতনির মধ্যে এইটিই প্রতিমার সবথেকে কাছের। নিজের কলেজ, বন্ধু, বয়ফ্রেন্ড সব কিছু শেয়ার করে ঠাম্মার সাথে মিষ্টু। মিষ্টুর মুখের দিকে তাকালেই সুবিনয়কে দেখতে পান প্রতিমা। একমাত্র ওর মুখের আদলেই যেন জ্বলজ্বল করে সুবিনয়ের মুখ।

কিছুটা ভালো রেজাল্টের দৌলতে আর কিছুটা জ্যাঠামশাইয়ের প্রশ্রয়ে নিয়ম কানুন বেশ শিথিল ছিল বাড়িতে। সেই সুযোগে ঘন ঘন দেখা হত তখন কলেজের নামকরা ছাত্র কমলেশের বাড়িতে সুবিনয় আর প্রতিমার। কমলেশ নিজে সাতে পাঁচে না থাকা নিপাট ভাল ছাত্র হলেও বন্ধু সুবিনয়ের জন্য ওর অগাধ ভালোবাসা, বাড়িতে ছিল অবারিত দ্বার। সেখানেই প্রতিমাও যেতেন, আসতো সুবিনয়। কমলেশদের বিশাল বাড়ির একতলার অগুনতি ঘরগুলোয় চলত ওদের গল্প। একমাত্র কমলেশ ছাড়া কেউই জানত না ওদের এই সম্পর্কের কথা। এরকমই এক নির্জন দুপুরে সুবিনয় ওর শরীরের সমস্ত ঘাম মাখিয়ে দিয়েছিল প্রতিমার গায়ে। তার পরেরদিনই সুবিনয়ের উত্তরবঙ্গে চলে যাওয়ার কথা, ওদের পার্টির কাজে। প্রতিমার হাতে হাত রেখে সুবিনয় বলেছিল ফিরে এসেই ও চাকরির চেষ্টা করবে।

কিন্তু সুবিনয় আর ফিরে আসেনি। বরং একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। তাও কমলেশের বাড়ির ঠিকানায়। কমলেশের সাথে কফি হাউসে দেখা করে চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে দুলে উঠেছিল প্রতিমার সামনের পৃথিবী, কাঁপছিল মাটি। এখনো সেই সম্বোধনহীন চিঠির প্রত্যেকটা শব্দ মুখস্থ প্রতিমার। ”অনেক ভেবে দেখলাম। মানিকদাও অনেক বোঝালো, আমাদের মতো ছেলেদের জন্য সংসার নয় প্রতিমা। নিজের ভালোবাসা, নিজের পরিবার নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! নিজের ক্ষণিকের আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছি, তোমাকেও দুর্বল করেছি, পারলে ক্ষমা করো। ভালো থেকো। ভুলে যেয়ো।”

সামনে বসে চুপচাপ কমলেশ ওঁর মুখ দেখে আন্দাজ করেছিল কিছু একটা হয়েছে। শুধু বলেছিল, ”সুবিনয়কে ভুল বুঝো না। ও আসলে ছোট থেকেই খুব অস্থির প্রকৃতির।”

প্রতিমা আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ”ও কি আর ফিরবে না?”

কমলেশ প্রথমে চুপ করে ছিল, কিন্তু ওর মুখে উত্তরটা পরিষ্কার পড়তে পারছিল প্রতিমা। তারপর পীড়াপীড়িতে জানিয়েছিল সুবিনয়ের ব্যারিস্টার বাবা ছেলেকে কম্যুনিস্টদের খপ্পর থেকে বাঁচাতে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সুবিনয়ও দেশের অধ্যায় ভুলতে চায়। আগে কানাঘুষো অনেক কথাই প্রতিমার কানে আসত, সুবিনয় নাকি এইরকমই, অনেক মেয়ের সাথেই ওর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, সেসব খবর প্রতিমার অজানা ছিল না। কিন্তু ওকেও যে সুবিনয় তাদেরই দলে ফেলে দেবে ও কল্পনাও করতে পারেনি!

প্রতিমার পায়ের তোলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। হু হু করে কান্না নেমে আসছিল চোখ দিয়ে। কমলেশ বাধা দেয়নি। অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

আজ যখন প্রতিমা কাজের ফাঁকে বা কোনো অবসর সময়ে কথাগুলো ভাবেন, রাগে এখনো শরীরের শিরাগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে। আসলে সুবিনয়দের মত ছেলেরা অত্যন্ত স্বার্থপর, সমাজের উন্নতি কেন, কোনো ভালো কাজই এরা করতে পারে না, শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া। শুধু বড় বড় কথা বলে এরা চালিয়াতি মারে।

হঠাত দরজার কাছে কোলাহলে প্রতিমা মুখ তুলে তাকালেন। হাসি হাসি মুখে সব কটা নাতি-নাতনি জড়িয়ে ধরে ঘরে ঢোকাচ্ছে তাদের দাদুকে। ফোকলা দাঁতে টোপর পড়ে দাদুও বেশ হাসি হাসি মুখে তাকাচ্ছে। ওমা, পেছনে আবার ছোটবউমা আর বড়জামাইও রয়েছে। ছি ছি। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করল প্রতিমার। নিজের পেটের মেয়েও এমন শয়তান হয়! কি কুক্ষণেই বড়মেয়ে মালাকে ফোনে কথায় কথায় বলে ফেলেছিলেন প্রতিমা, তাঁদের তো অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয়নি, কত আত্মীয়র বিয়েই দায়িত্ব নিয়ে দিলেন কিন্তু নিজের আর এজীবনে বেনারসি পড়া হল না। সেই বদ মেয়ে যে তার ভাই, বোনেদের সাথে চক্রান্ত করে সবাই মিলে ঠিক এই দিনে জামশেদপুর এসে বাবা-মায়ের এত বড় করে পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকীর আয়োজন করবে কে জানত! মালাবদল, সিঁদুরদান, সাত পাক কিচ্ছুটি বাকি রাখেনি! তাও করেছিস করেছিস, কিন্তু ফুলশয্যা করা আবার কি ধরনের আদিখ্যেতা! কিন্তু কে শোনে প্রতিমার কথা! মালা চিরকালই বাপের ন্যাওটা আর সেই আসল লোকই যে তোল্লাই দিয়েছে ওদের। হ্যাঁ হ্যাঁ তোরা ভালো করে আয়োজন কর, নাহলে পঁচাত্তর পার হতে চলল, কোনদিন টুপ করে মরে যাব, ফুলশয্যাটা আর করা হবে না!— এইসব বলে বলে বুড়োটা নাচিয়েছে ওদের। আর ছেলেমেয়ে তো সব বাপের ভক্ত।

বড় নাতিটার বউ অনিন্দিতা কানে কানে এসে বলল, ”ঠাম্মি, একদম লজ্জা পাবেনা কিন্তু! বল তো কিছু টিপস দিয়ে যাই!”

জিন্স পড়া কোমরে শার্ট গোঁজা নাতবৌয়ের মুখের কথা শুনে প্রতিমা চোখ পাকালেন, ”তোদের মতো বেহায়া নাকি আমরা? বাঁদরের দল সব!”

অনিন্দিতা মুচকি হেসে বলল, ”আমার কাছে ভালো বিকিনি আছে, বল তো দিয়ে যাই। হানিমুনে মালদিভস গিয়ে পড়েছিলাম। নিয়ে আসব? আচ্ছা শোন প্রথমেই একটা সুন্দর হামি দিয়ে শুরু করবে কিন্তু!”

প্রতিমা বেশ করে কানটা মুলে দিতেই হতচ্ছাড়ি ছুটে পালাল। সবাই চলে গেল একে একে। ক্লাস এইটে ওঠা মেজনাতি সুমন চেঁচিয়ে বলে গেল, ”দাদু, ঠাম্মিকে কোনো গিফট দেবে না? ফুলশয্যায় বর বউকে গিফট দেয় তো, আমি টিভিতে দেখেছি।”

 দরজায় ছিটকিনি দিয়ে কমলেশ ঘুরে দাঁড়ালেন। কপালে চন্দন, দন্তহীন মুখে সলজ্জ নিষ্পাপ হাসি। প্রতিমা খেয়াল করলেন ওঁর হাতের আঙুল নড়ছে অল্প অল্প, নার্ভের ওষুধটা কি খায়নি আজ?

কমলেশ বললেন, ”হ্যাঁ গো, তুমি সত্যিই গিফট চাও? কিন্তু আমি তো এখন কিছুই আনিনি!”

প্রতিমা প্রথমে কি বলবেন ভেবে পেলেন না। তখনকার দিনে বাড়ির অবিবাহিতা মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা, এই খবরে সবার কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভেবে সুবিনয়ের প্রতারণায় চুরমার হয়ে যাওয়া প্রতিমা যখন লজ্জায় ঘেন্নায় নিজের জীবনটা শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন, তখন কমলেশই এসে ওঁর হাত ধরেছিল। শুধুমাত্র প্রতিমাকে সম্মান দেওয়ার জন্য কমলেশ কলেজের পড়া মাঝপথে ছেড়ে, নিজের অত বড় বাড়ি ছেড়ে দিয়ে প্রতিমাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল বিহারের এক ছোট্ট পাহাড়ি শহরে, অজানা লোকের মাঝে শুরু করেছিল সংসার। ও কত ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিল, কত উঁচুতে যেতে পারত, তা না করে অসমাপ্ত ডিগ্রি নিয়ে ছোট্ট ওই মফসসলের পাহাড়ি স্কুলে পড়িয়ে কাটিয়ে দিল গোটা জীবন। আবার সবাইকে গর্ব করে বলে বেড়ায়, ওঁর থেকে সুখী নাকি হিমালয়ের সাধুরাও নয়!

 প্রতিমা নিজের বাড়ির সাথে আর যোগাযোগ করেননি। এসেছে কত ঘাত- প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, তবু এই পঞ্চাশটা বছরে প্রতিমার দুঃখে, সুখে, বিপদে সবথেকে বড় বন্ধু হিসেবে পাশে থেকেছে কমলেশই। আজও কেউ জানে না মালা কমলেশের সন্তান নয়! প্রথম প্রথম প্রতিমার খুব অপরাধবোধ হত, নিজের স্বার্থের জন্য এভাবে কেন কমলেশকে ঠকাল ও! কিন্তু দিনের পর দিন ভালোবাসায় সেই অপরাধবোধ ম্লান হয়ে গিয়েছিল। এখন টিভিতে সিরিয়ালে কত প্রেমের গল্প শোনেন দেখেন, সবই যৌবনের ভালোবাসা! আসল ভালোবাসা কি সেইটা? প্রতিমা মিষ্টুকে বোঝান, না, তা নয়। বুড়ো বয়সে যখন জরা, রোগ ছাড়া মানুষের কিছুই থাকে না তখন পাশাপাশি থাকতে পারাই হল আসল ভালোবাসা। কমলেশ হয়তো কোনোদিনও প্রতিমাকে ‘ভালোবাসি’ বলেননি, কিন্তু প্রতিনিয়ত তিয়াত্তর বছরের প্রতিমার খেয়াল রেখে চলেন, ওষুধ মনে করিয়ে দেন, ব্যাথার মলমটা লাগিয়ে দেন, এরই নাম ভালোবাসা!

নিজের আত্মীয়দের কথা আর মনেই পড়ে না ভালো করে প্রতিমার। বাবা, মা, জ্যাঠামশাইয়ের স্মৃতি কবেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে মুছেই গেছে প্রায়। তাঁদের ছাড়াই এই বিশাল পৃথিবীতে বাঁচতে শিখেছেন প্রতিমা। কিন্তু আজ পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকীর ফুলশয্যার রাতে নববধূর বেশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ওঁর মনে হল, প্রতিমার যে পরম বন্ধু, সেই আত্মার আত্মীয় কমলেশকে ছেড়ে প্রতিমা একদিনও বাঁচতে পারবেন না।

প্রতিমা একমুহূর্ত ইতস্তত করলেন, তারপর একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে গিয়ে কোনো জড়তা ছাড়াই কমলেশকে জড়িয়ে ধরলেন। সেদিনের সেই কোঁকড়া চুলের ছেলেটার আজকের টাকে হাত বুলিয়ে আদর করলেন কিছুক্ষণ। তারপর গোড়ালিতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তোবড়ানো গালে আলগোছে একটা চুমু খেয়ে ফিসফিস করলেন, ”হ্যাঁ চাই। আমি যেন তোমার আগে এই পৃথিবী থেকে চলে যাই। পরে তুমি যেয়ো।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *