আঠাশ বছর পরে
এতদিন বাবিনের কথাটাকে হালকাভাবে নিচ্ছিলেন শ্রাবন্তী, কিন্তু আজ যেরকম সিরিয়াসলি কথাটা বলে বাবিন ঘর ছেড়ে দুদ্দাড়িয়ে বেরিয়ে গেল, ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে শ্রাবন্তী সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলেন।
অনেকদিন ধরে লক্ষ করছেন, এ নিজে থেকে বলবার ছেলে নয়। মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে, বাবিন সত্যিই শ্রাবন্তীরই ছেলে তো?
এত মুখচোরা?
নাঃ! তাই যা করার শ্রাবন্তীকেই করতে হবে।
অরিন্দম অনেকদিন বাদে আজ টিভিটা খুলেছিলেন। আজকাল টিভি, ল্যান্ডলাইন টেলিফোন, বোতাম টেপা ফোন ডোডো পাখির মতোই লুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে, অধিকাংশ বাড়িতেই নেই। থাকবেই বা কেন, মোবাইলের টিভি অ্যাপ, অত্যাধুনিক ক্লাউড টেকনোলজির ইন্টারনেট তো সব চাহিদাই পূরণ করে দিচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সদাব্যস্ত থাকতে গিয়ে সবাই আজকাল আনসোশ্যাল, যে বন্ধুটার সঙ্গে চ্যাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লান্তিহীন ভাবে গল্প করতে পারে, সেই বন্ধুই বাড়িতে আচমকা চলে এলে বিরক্তি উথলে পড়ে যেন। সবটাই তো আজকাল বড় ভার্চুয়াল!
টিভিতে একটা ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল ডকুমেন্টারি চলছিল, শ্রাবন্তী অরিন্দমের পাশে গিয়ে সোফায় ধপ করে বসে পড়ে বললেন, ”আমি বাবিনের দেখেশুনেই বিয়ে দেব, ঠিক করে ফেললাম, বুঝলে!”
অন্য কেউ হলে শ্রাবন্তীর এই কথা শুনে ভিরমি খেত, দু-হাজার পঁয়তাল্লিশ সালে যেখানে বিয়ে ব্যাপারটাই অপশনাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, লোকজন আকছার লিভ ইন করছে, শীতের মরশুমে এক-আধটা বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণ পেলে যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার দশা হয়, সেখানে ছেলের দেখেশুনে বিয়ে দেওয়াটা চোখ কপালে তোলার মতো বিষয়ই বটে!
অরিন্দম কিন্তু অতটা চমকালেন না, প্রেমপর্ব-বিয়ে মিলিয়ে আজ চল্লিশ বছর হল শ্রাবন্তীকে তিনি দেখে আসছেন, ওর স্বভাবচরিত্র হাতের তালুর মতোই জানা। যতই বয়স হোক, শ্রাবন্তী হল গিয়ে একটা ছোট্ট চড়াই পাখির মতো, এই এখানে গিয়ে একদণ্ড জিরোচ্ছে, চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সেখান থেকে ফুড়ুৎ হয়ে উড়ে যাচ্ছে অন্য জায়গায়! সেই কলেজ থেকে তো দেখছেন। মাঝের পঁয়ত্রিশটা বছর তো দুজনে আইটি সেক্টরের জোয়াল টানতে টানতেই জেরবার হয়ে গিয়েছিলেন, এখন একসাথে রিটায়ার করে কলেজ লাইফের সেই ছটফটে বান্ধবীটাকে আবার খুঁজে পাচ্ছেন যেন অরিন্দম!
তারিয়ে তারিয়ে তাই এই অবসর জীবন উপভোগ করছেন দুজনে।
রিস্ট ওয়াচে একটা ভিডিও কল আসছিল, বাবিনেরই, ছবিটা দেখতে পেলেন শ্রাবন্তী। এই তো বেরলো বাড়ি থেকে, এখনই মা-কে আবার কি দরকার পড়ল?
শ্রাবন্তী রিসিভ করলেন না। একটা দরকারি কথা বলার সময় ফোন দুচক্ষে দেখতে পারেননা তিনি। আজকালকার ছেলেমেয়েদের কথা কথায় ফোন, এতে করে কথোপকথনের গুরুত্বটাই হারিয়ে যায়।
অরিন্দম শান্তভাবে বললেন, ”তুমি দেখেশুনে বিয়ে দেবে, সে তো ভালো কথা, কিন্তু বিয়েটা যার, সে মানবে কি?”
শ্রাবন্তী এবার বললেন, ”আরে সে মানবে বলেই তো বলছি, নাহলে আমি নিজে থেকে বলব কেন! চার পাঁচ মাস ধরে ফোন করলেই জিজ্ঞাসা করি, কিরে এবার বাড়ি এলে গার্লফ্রেন্ডের সাথে আলাপ-পরিচয় করা। বিয়ে করবি কবে? তো সে মক্কেল কোনো উচ্চবাচ্যই করে না! তারপর আজ জোরে চেপে ধরতে বলল, আমার সেরকম কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই, আমি বিয়ে করব না মা!”
অরিন্দম এবারেও টিভির পর্দা থেকে চোখ সরালেন না। মসৃণ দেওয়ালের উপর সুবিশাল ত্রিমাত্রিক টিভি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের স্ক্রিন থেকে জিরাফগুলো জীবন্ত হয়ে গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে বাইরে। ভার্চুয়াল জিরাফের লম্বা গলা নিজের গালে উপভোগ করতে করতে অরিন্দম বললেন, ”বাহ! তবে আবার কি, ছেলে তো বলেই দিয়েছে বিয়ে করবে না।”
শ্রাবন্তীর এবার রাগ হয়ে গেল, সোফার সাথেই অ্যাটাচড রিমোটের টাচ স্ক্রিনে আঙুল ঘষে টিভিটা মিউট করে দিয়ে ধমকে উঠলেন, ”সব ব্যাপারে তোমার ইয়ার্কি, না! দেখছ একটা সিরিয়াস ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছি, নিজে তো ছাব্বিশ বছর বয়সে ড্যাং ড্যাং করে বিয়ে করে নিয়েছিলে, নিজের ছেলের যে বয়স তেত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেল, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, তাই না!”
অরিন্দম এবার মনে মনে মুচকি হাসলেন। সত্যি, এতবছর হয়ে গেল, শ্রাবন্তীর কারণে অকারণে রেগে যাওয়া স্বভাবটা গেল না। এই হাসছে, কথা বলছে, পরমুহূর্তেই চিৎকার করছে। আগের মাসেই এই নিয়ে ধুন্ধুমার হয়ে গেল। এখন মোটামুটি সব সচ্ছল বাড়িতেই অ্যান্টি-ভায়োলেন্স সেন্সর লাগানো, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোরে চিৎকার করলেই অটোমেটিকালি অ্যালার্ট চলে যায় মিউনিসিপালিটির সার্ভারে, দশ মিনিটের মধ্যে সিভিক পুলিশের একটা টিম চলে আসে। মানুষের চলাফেরা, কথাবার্তা, হাসিকান্না সব এখন মনিটরড। রাগলে শ্রাবন্তীর কোনোদিনই মাথার ঠিক থাকেনা, এমন জোরে চেঁচাচ্ছিলেন, ব্যাস, পুলিশ এসে হাজির। তারপর সে কি অস্বস্তিকর ব্যাপার! তারা তো মানতেই চায় না, কথাচ্ছলে কোনো মহিলা এমন চিৎকার করতে পারে! তারপর তাঁদের মিষ্টি-টিষ্টি খাইয়ে শান্ত করে ফেরানো হল।
অরিন্দম স্ত্রীকে আরো রাগিয়ে দিতে বললেন, ”আমাকে ধমকাচ্ছ ধমকাও, আমি তো লাইফটাইম সাবস্ক্রিপশন নিয়েই ফেলেছি, পালাবার কোনো রাস্তা নেই। কিন্তু দেখো, তোমার এই ধমক আবার ওই সিভিক টিমের কানে না পৌঁছে যায়, এখুনি সাইরেন বাজিয়ে এসে হাজির হবে। আগের বারের ঝামেলাটা মনে আছে তো?”
শ্রাবন্তী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতে গিয়েও মনে মনে থমকে গেলেন।
অরিন্দম ঠিকই বলছে। উফ কি যে এই ডিজিটাল দুনিয়ার অভিশাপ! একদিকে ভালো ঠিকই, ক্রাইম রেট হু হু করে কমছে, সবকিছুই এখন হ্যাসল-ফ্রি, কিন্তু অন্যদিকে মানুষের আবেগ, উচ্ছাসগুলোকেও যদি এইভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকা হয়, তবে মাপা হাসি, মাপা কান্না, মাপা উত্তেজনা, এইভাবে তো সবাই আস্তে আস্তে রোবটে পরিণত হবে, ওই অনলাইনের রোবটগুলোর মতো, প্রত্যেকটা রোবটের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটে বিভিন্ন অ্যালগরিদম প্রোগ্রামড করা, সেই অনুযায়ী চলে তাদের চোখের পাতা পড়া থেকে শুরু করে কাজকর্ম, অভিব্যক্তি।
রক্তমাংসের মানুষরা কেন সেরকম করবে?
কিন্তু কি আর করা, পড়েছ যখন মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে, অনেক ছোটবেলায় দাদুর মুখে শোনা সেই প্রবাদটা মনে পড়ল শ্রাবন্তীর, প্রাণপণে রাগটা গিলে নিয়ে চাপা গলায় গজগজ করলেন, ”ছেলে নিজেই তো বলছে কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”
”গার্লফ্রেন্ড নেই তো কি, বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে। তোমার ছেলে গে হতে পারে, ইমপোটেন্ট হতে পারে, বাইসেক্সুয়াল হতে পারে, আরো অনেক কিছু হতে পারে। ধুম করে না জেনেশুনে পাত্রী খুঁজতে যাবে কেন তুমি?” অরিন্দম ব্যাখ্যা করলেন।
শ্রাবন্তী ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। টিভির ঢাউস স্ক্রিনে এখন একটা বিশাল সিংহ জিরাফটাকে ধরেছে, জিরাফটা অতবড় গলা দিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছে মৃত্যুকে এড়ানোর। সাউন্ড অফ করা থাকলেও থ্রি ডি টিভি-র জাদুতে তার সেই গলাটার তীব্র আস্ফালনের ঝাপটা যেন এসে লাগছে ওঁদের গায়েও।
এক মাইক্রোসেকেন্ডের জন্য শ্রাবন্তীর মনে হল টিভির স্ক্রিনে ছটফট করতে থাকা জিরাফটার মতো অরিন্দমেরও মাথাটা গুঁড়িয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করে বললেন, ”তুমি কি একটু সিরিয়াস হবে? বাবিন যে স্ট্রেট সেটা তুমি জানো না? বৈশালী বলে ওর ওই কলেজের বন্ধুটা ওর লং টার্ম গার্লফ্রেন্ড ছিল। মেয়েটা ইউএসএ চলে যাওয়ার পর ব্রেক আপ হয়ে গেল।”
”তো নতুন আরেকটা গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে নিতে বলো। লিভ ইন করলে করুক, বিয়ের শখ হলে বলতে বলো, দাঁড়িয়ে থেকে দুজনে বিয়েটা দিয়ে দেব। আবার কি চাই? বাবা-মা পাত্রী খুঁজে আনবে, এটা বাড়াবাড়ি না আজকের দিনে? অত টাইম নেই বস।” অরিন্দম সটান সারেন্ডারের ভঙ্গিতে হাত তুলে দিলেন, ”সারাজীবন অনেক রেটিং, অ্যাপ্রেইজাল, এসক্যালেশনের পেছনে দৌড়েছি, এবার লাইফটা একটু এনজয় করতে চাই, এখনো আর অত চাপ নিতে পারছি না।”
”কিরকম বাবা তুমি, হ্যাঁ?” শ্রাবন্তীর রাগে মুখটা লাল হয়ে গেল, ”নিজের ছেলের জন্য মেয়ে দেখবে, সেটাও তোমার কাছে চাপ?”
”তা চাপ নয় তো কি?” অরিন্দম শ্রাবন্তীর রাগকে মোটেই পাত্তা দিলেন না, ”আমাদের সময়ে মেয়ে খোঁজার অনেক অপশন ছিল। খবরের কাগজগুলোয় পাত্রপাত্রী কলাম ছিল, সবচেয়ে বড় কথা, প্রচুর ম্যাট্রিমনিয়াল ওয়েবসাইট ছিল, অ্যাপ ছিল, তাতে একটা প্রোফাইল খুললে লক্ষ লক্ষ মেয়ে পাওয়া যেত, একটা ক্লিকে তাদের পছন্দ, অপছন্দ সব জানা হয়ে যেত। এখন কি আর সেই সব ম্যাট্রিমনি সাইটের অস্তিত্ব আছে? কবে উঠে গেছে। আমার তো বেশ মনে আছে, খুব সিকিওরড ছিল প্রসেসটা।” অরিন্দম টিভির থেকে এইবার এই কথোপকথনটায় বেশি ইন্টারেস্ট পেয়ে সোৎসাহে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন, ”ফ্রি প্রোফাইল হলে শুধু মেয়ে দেখা যেত, কিন্তু তাদের সাথে যোগাযোগ করা যেত না, মেসেজ বক্সেও ফোন নম্বর দেওয়া যেত না। সেকি বিড়ম্বনা, ফোন নম্বরগুলো শব্দে লিখে কায়দা করে পাঠাতে হত।”
”তা তুমি এত কি করে জানলে? কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে তো আমার সাথে সেটিং করে রেখে দিয়েছিলে, ম্যাট্রিমনি তো তার অনেক পরের ব্যাপার, আমাদের সার্ভিস লাইফে। তুমি কি করে জানলে যে ফ্রি প্রোফাইলে শুধু মেয়ে দেখা যেত?” শ্রাবন্তী তীক্ষ্ন চোখে প্রশ্নটা করে অরিন্দমকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন।
অরিন্দম বেশ উৎসাহের সাথে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এবার কেমন ভেবলে গেলেন হঠাৎ, এইজন্য বলে বউয়ের সাথে বেশি দিলখোলা হয়ে কথা বলতে নেই, কেঁচো খুঁড়তে কখন কি কেউটে বেরিয়ে পড়ে! কি বলবেন বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ মাথা চুলকে তারপর হেসে ফেললেন, ”ইয়ে না মানে, সেই একবার টেম্পোরারি ব্রেক আপ হয়েছিল না? ওই সময় তুমি আড়াই মাস কথা বলো নি, অফিসে গেলেও দেখা করতে না মনে নেই? কত সাধ্যসাধনা বাপরে বাপ!” অরিন্দম চোখ বড়বড় করলেন, ”ইয়ে তখনই আর কি একবার জিনিসটা এক্সপ্লোর করার জন্য মানে…জাস্ট টাইম পাস…হে হে…!”
শ্রাবন্তী দাঁতে দাঁত চিপলেন। ত্রিশ চল্লিশ বছরের পুরনো গুপ্ত কথা হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই রিভিলড হয়ে যেতে অরিন্দম আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে টিভিটা নিজে থেকেই অফ করে দিয়ে শ্রাবন্তীর দিকে কেমন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছেন।
কিন্তু না। এখন এই নিয়ে কোনো ঝামেলা করব না, শ্রাবন্তী একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে মনে মনে ঠিক করলেন। শ্রাবন্তী মজুমদারকে এত বোকা পাওনি। এটা পরের কোনো মোক্ষম সময়ের জন্য তোলা থাক। আপাতত ফোকাসড থাকাই ভালো। সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা না জানানো পর্যন্ত যে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না তিনি। একমুহূর্ত গুম হয়ে থেকে বললেন, ”তা এখনো তো সেরকম ওয়েবসাইট আছে নিশ্চয়ই।”
”কে বলল আছে?” অরিন্দম প্রসঙ্গটা পালটে যেতে পরম আশ্বস্ত হয়ে পড়লেন, ”এই তো, সুমনের মেয়ের বিয়ের সময় ও বলেছিল কোনো ম্যাট্রিমনি ওয়েবসাইট এখন আর চালু নেই, সব উঠে গেছে। কেউ পেইড একাউন্টই খোলে না, চলবে কি করে? তারপর তো ওর মেয়ে নিজেই সব ঠিক করে বিয়ে করে নিল।”
”বুঝলাম।” শ্রাবন্তী মাথা নাড়লেন, ”কিন্তু আমাদের বাবিনের মেয়ে দেখার জন্য কোনো ওয়েবসাইট বা ঘটকের দরকার নেই। আমি মেয়ে ঠিক করে ফেলেছি। সেটাই তোমায় বলতে এলাম। বাবিন এখন দশ-বারোদিন থাকবে, তার মধ্যেই সব ফিক্সড করে নিতে চাই। পরের ছুটিতে ডেট ফেলব, এসে বিয়ে করে চলে যাবে।”
”ওহ! তাহলে তো ভালোই।” অরিন্দম বেশ উৎসুক হয়ে তাকালেন, ”তা মেয়েটা কে?”
শ্রাবন্তী একমুহূর্ত থমকালেন, তারপর বললেন, ”তিতির।”
”তিতির মানে?” অরিন্দম কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন, ”ওই বি ব্লকের কৌশিকের মেয়ে?”
”হ্যাঁ। ওই তিতির।” শ্রাবন্তী ঠোঁট কামড়ালেন, ”বাবিনের ছোটবেলার বন্ধু ছিল, নার্সারি থেকে একসাথে পড়েছে। ইন্টারনেটেও দুজনের মধ্যে ভালো কন্ট্যাক্ট আছে আমি দেখেছি। কাছাকাছি বাড়ি, ভালো ফ্যামিলি, ভালোই হবে। সবচেয়ে বড় কথা, কাল ওর মা ছন্দার সাথে দেখা হয়েছিল। বলল তিতির একটা ভালো স্কলারশিপ পেয়েছে, শিগগিরই অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে ডক্টরেট করতে। বাবিনও যখন অস্ট্রেলিয়াতেই, ভালোই হবে, তাই না! আজকাল স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকাটাও তো ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
অরিন্দম এবার শ্রাবন্তীর দিকে তাকিয়ে কিন্তু কিন্তু করলেন, ”কিন্তু … বাবিন! সে কি রাজি হবে?”
শ্রাবন্তী খর চোখে তাকালেন, ”কেন হবে না? তখন তো দিনের পর দিন তিতির এই বাড়িতে এসে থাকত। মনে নেই? স্কুল থেকে বাবিনের সাথে চলে আসত। তোমার মা তখনো বেঁচে, গল্প শুনত, ঘুমোত, তারপর আমি অফিস থেকে ফিরে ওকে বাড়ি দিয়ে আসতাম। কেন তুমিও তো কতদিন দিয়ে এসেছ মনে নেই?”
”না সে ঠিক আছে, কিন্তু…!” অরিন্দম আড়ষ্টভাবে বললেন, ”অতবড় একটা ট্রমা … মেয়েটা তো ঠিকমতো কাটিয়ে উঠতে পারেনি শুনেছিলাম।”
”তা ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলে কি তাকে ট্রমার জগতেই রেখে দিতে হবে?” কথাটা বলে শ্রাবন্তী ভাবলেন, কি যেন নাম ছিল ওদের প্রতিবাদসভাটার? অপ্রকাশিত শৈশব? উঁহু, না না, বিপন্ন শৈশব বোধ হয়!
দিনের পর দিন তখন অফিস কামাই করে শ্রাবন্তীর মতো সব অভিভাবকেরা মিলে শামিল হয়েছিলেন সেই প্রতিবাদে, তখন প্রায় সপ্তাহ দুয়েক ধরে সমস্ত টেলি মিডিয়া-প্রিন্ট মিডিয়ার হেডলাইন ছিল ঘটনাটা।
অথচ আজ, ঠিক আঠাশ বছর পরে, সেদিনের সেই শিশুটা কেমন আছে, শৈশবের অতবড় আতঙ্ক সামলে সে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনে সফল হয়েছে কিনা, বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তার ক্ষেত্রে সমানভাবে ডালপালা মেলতে পেরেছে কিনা, তা নিয়ে মিডিয়া তো দূর, পাড়াপ্রতিবেশীরও কারুর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
সত্যি, দেখতে দেখতে আঠাশ বছর হয়ে গেল। অথচ আজও মনে হয়, এই সেদিনের কথা।
কত বয়স যেন তখন বাবিনের? পাঁচ? না সাড়ে পাঁচ? তিতিরের তখন সাড়ে তিন। খবরের দৌলতে ‘সাড়ে তিন বছরের শিশুর উপর স্কুলশিক্ষকের পাশবিক যৌন নির্যাতন’ হেডলাইনটা আজও চোখের সামনে ভাসে শ্রাবন্তীর।
তখন সবে পুজো শেষ হয়েছিল। হাল্কা শীতের আমেজ, অফিসে সেদিন একটা খুব ইম্পরট্যান্ট মিটিং ছিল শ্রাবন্তীর। তারই মাঝে বারবার একটা ফোন আসছিল। কোনোমতে বাইরে এসে ফোনটা রিসিভ করতেই ভেসে এসেছিল উদ্বিগ্ন একটা কণ্ঠস্বর। বাবিনের স্কুলের এক বন্ধুর মা। তিনিই সবার নম্বর জোগাড় করে জানিয়েছিলেন ঘটনাটা, আকুলভাবে বলেছিলেন সবার একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ানোর সংকল্পটা। আজও মনে আছে শ্রাবন্তীর, শুনতে শুনতে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল সেদিন। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল তিতিরের ছোট্ট মুখটা। সাড়ে তিন বছরের একটা বাচ্চা, তাকে কিনা টিচার নিজেই …!
আর বেশি সাতপাঁচ ভাবেননি সেদিন শ্রাবন্তী। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন স্কুলের সামনে। তার পরের দশ বারোদিন অফিস ছুটি নিয়ে টানা ধর্নায় শামিল হয়েছিলেন সকলের সাথে। মিডিয়ার সামনে নৃশংসতা, স্কুলের উদাসীনতা, অবহেলা তুলে ধরেছিলেন সবাই মিলে। শ্রাবন্তীদের প্রবল চাপের মুখে পরে একে একে অপসারিত হতে হয়েছিল স্কুলের হেডমিসট্রেস, কো-অরডিনেশন কমিটির প্রেসিডেন্টকে, স্কুলে পা পড়েছিল দুঁদে মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু তাবড় তাবড় সব পুলিশ কর্তাদের, গ্রেফতার করা হয়েছিল সেই শিক্ষক নামের কলঙ্ক অপরাধীকে। এখনকার মতো তখন ক্লোজ সার্কিট টিভি এত ছেয়ে যায়নি, শ্রাবন্তীদের দাবিতে স্কুলে বসানো হয়েছিল সিসিটিভি।
আর এখন তো মানুষের প্রতিটা মুভমেন্টেই সেন্সরের মনিটরিং। কিন্তু মনিটর করে কি বিকৃত কামবোধগুলোকে কমানো যায়? আজ এত কড়াকড়িতেও কি সব অপরাধ লুপ্ত হয়ে গেছে?
রিস্ট ওয়াচে আবার ফোন ঢুকছিল, বাবিনের উজ্জ্বল মুখটা ঘড়ির স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। শ্রাবন্তীর এবার বেশ হালকা লাগছে, মা হয়ে ছেলের মনের কথা যদি নাই বুঝতে পারলেন, তবে তিনি কিসের মা? যতই ডিজিটাল হোক দেশ, যতই রোবটে ছেয়ে যাক রাস্তাঘাট, শপিং মল, ছেলেকে মা হয়ে তিনি চোখে চোখে রাখবেন না তো কে রাখবে?
শ্রাবন্তী একটু ভাবলেন, তারপর আড়চোখে অরিন্দমকে বললেন ”তিতিরদের বাড়িতে কথা বলতে যাবো আজ বিকেলে, দয়া করে রেডি হোয়ো ঠিক সময়ে। যেমন বাবা তেমনি ছেলে! কেউ মুখ ফুটে কিছু বলবে না, মা তো অন্তর্যামী, না!” কোনোমতে কথাগুলো বলেই বাবিনের ফোনটা রিসিভ করলেন তিনি, ”আজ আমি আর তোর বাবা তিতিরদের বাড়ি যাচ্ছি কথা বলতে।”
”মানে?” বাবিনের মুখটা ঠিক টিভির জিরাফটার মতোই তোম্বা হয়ে গেল।
”তিতিরকে বিয়ে করতে চাস ঝেড়ে কাশতে কি হচ্ছিল তোমার?”
বাবিন মিনমিন করছিল, ”সেটা নয়। ওকে নিয়ে সবার এত ফিসফিসানি এখনো হয়, ও নিজেও এই নিয়ে একটা চাপা কমপ্লেক্সে ভোগে। তোমরাও ব্যাপারটা কিভাবে নেবে, তা নিয়ে কনফিউজড ছিলাম, তাই ভেবেছিলাম বিয়ে করব না…!”
শ্রাবন্তী ছেলের মুখ থেকে কথাটা লুফে নিলেন, ”কিন্তু অস্ট্রেলিয়া গিয়ে দুজনে ওং বোং চোং করবে তাই তো? ওসব বাঁদরামি চলবে না। চুপচাপ বিয়ে করে নেবে। আর কমপ্লেক্সের কি আছে? আমাকে কোনো কুকুর রাস্তায় কামড়ে দিলে কি আমি লজ্জায় বাড়ি থেকে বেরবো না?”
বাবিন চুপ। একটু তুতলে বলল, ”কি-কিন্তু মা তুমি করে জানলে, মানে আমি তো কাউকে…!”
শ্রাবন্তী এবার বললেন ”তুই বোধ হয় ভুলে গেছিস বাবিন, আমি সারাটা জীবন এথিকাল হ্যাকিং ডিপার্টমেন্টে ছিলাম। ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ আ বেঙ্গলি মম, ওকে? এবার থেকে তিতিরের সাথে চ্যাটগুলো বুঝেশুনে করিস, কেমন?”
বাবিনের হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে দেখতে শ্রাবন্তী মুখ টিপে হেসে কলটা ডিসকানেক্ট করে দিলেন।
অরিন্দম অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন ”ছি ছি, মা হয়ে ছেলের প্রোফাইল হ্যাক করে ঢুকে তুমি চ্যাট পড়ছ? একি অন্যায়! অ্যাদ্দিন ভাবতাম তুমি শুধু আমার ওপর স্পাইগিরি করো, এখন তো দেখছি … ছি ছি !”
”এই থামো তো!” এক দাবড়ানি দিয়ে বরকে চুপ করিয়ে দিলেন শ্রাবন্তী, ”চ্যাটগুলো পড়তাম বলেই না তিতিরের মতো মেয়েটাকে বউ করে আনতে পারছি। তোমার মুখচোরা ছেলে তো বাবা মা কি ভাববে সেই ভয়েই অস্থির ছিল। আফসোস হয় নিজের মা-কে এতদিনে এই চিনল? আমার কত্ত আনন্দ হচ্ছে তিতির আসবে জেনে!”
”তবু ছেলের চ্যাট পড়া খুব গর্হিত কাজ কিন্তু শ্রাবন্তী! আমাদের সময় মায়েরা এসব ভাবতে পারত?” কথাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে গেলেও স্ত্রীর ভ্রূ কুঁচকোনো দেখে মাঝপথেই কথাটা গিলে ফেললেন অরিন্দম।
শ্রাবন্তী উঠে ভেতরের ঘরে যাচ্ছিলেন, এইবার কোমরে হাত দিয়ে স্বামীর দিকে সরু চোখে তাকালেন, ”বাই দ্য ওয়ে, আগের সপ্তাহে আমি যখন জিমে গিয়েছিলাম, তুমি দেখলাম সমর্পিতা বলে একজনের সাথে হাই হ্যালো করছিলে। মালটা কে?”
অরিন্দম অমনি মিউট মোডে চলে গিয়ে ভয়ার্ত মুখে টিভিটা চালিয়ে দিলেন।
শ্রাবন্তী কড়া গলায় বললেন, ”আজ বিকেলে ঘুরে আসি, তারপর তোমার হচ্ছে।” তারপর একটু থেমে বললেন, ”আর মায়েরা চিরকালই সমান, তারা শুধু ছেলেমেয়েদের ভালো চায় বুঝলে! সে যেভাবেই হোক না কেন!”
**********