দেবীপক্ষ

দেবীপক্ষ

ভেবেছিল এই কাকভোরে ট্রেনে উঠছে, রীতিমতো হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে যেতে পারবে, কিন্তু নিজের এমন ভুল ধারণায় নিজেই অবাক হয়ে গেল সুমিতা। এই ভোর সাড়ে পাঁচটার ট্রেনেও বনগাঁ লোকালের লেডিজে আজ বেশ ভিড়, প্রতিটা সিটেই চারজন ঠেসাঠেসি করে বসে। তার ওপর আজ মহালয়া,কয়েকজনের মোবাইলে বেশ উচ্চৈঃস্বরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত গলায় মহালয়া বাজছে, কিছু বয়স্ক মহিলা মাথা দুলিয়ে পুরনোর জয়গান করছেন। সুমিতা মাথা ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল, কাশ ফুলের ঝোপ মাথা নাড়ছে, নীল সাদা শরতের প্রকৃতি ভেদ করে ট্রেন ছুটে চলেছে। নিজের করমচা-র মতো ফুলে থাকা চোখ দুটো কচলে নিয়ে নিজের মনেই ও আফসোস করল, এহ, আজ যে মহালয়া, নানাকাজের ডামাডোলে ওর একেবারে মনে ছিল না। কেউ মনেও করিয়ে দেয়নি। বিদ্যুৎচমকের মতো বাইশ বছর আগের মহালয়ার দিনটা ওর মনে পড়ে গেল।

ঠিক বাইশ বছর আগে মহালয়ার দিন ফোঁটা জন্মেছিল। এত ছোট্ট হয়েছিল, মাত্র পৌনে দু-কেজি ওজন, তাই ফোঁটা। নামটা শঙ্করের দেওয়া। বড় বড় বাদামি চোখ, মাথায় থোকা থোকা কোঁকড়া চুল। সুমিতা নিজের ইতিহাস প্রেম বজায় রাখতে, কলহনের সেই বিখ্যাত পুঁথির নামে নাম মিলিয়ে প্রথমে একরত্তি মেয়ের নাম রেখেছিল রাজতরঙ্গিনী। কিন্তু শঙ্কর নাকচ করে দিয়েছিল, বলেছিল মহালয়ার দিন জন্মেছে, ও তো মা দুর্গারই অংশ, ওর নাম হবে বিশ্বরূপা। ফোঁটা জন্মানোর পর সুমিতার সামান্য কিছু কমপ্লিকেশন হয়েছিল, ডাক্তার আরো কয়েকদিন অবজারভেশনে রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শঙ্করের কিছুতেই আর তর সইছিল না, বাড়িতে একা একা হাঁপিয়ে উঠেছিল, রীতিমতো তর্কাতর্কি করে বউ মেয়েকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল।

তারপর থেকে তারিখ ধরে ফোঁটার জন্মদিন সুমিতা পালন করত না, বলত এমন শুভ দিনে জন্মেছে মেয়েটা, মহালয়ার দিনই ওর জন্মতিথি। তাই তারপর থেকে প্রতি বছর মহালয়ার দিন ফোঁটার জন্মদিন পালন হত। চার বছর আগে অবধিও হয়েছে, ফোঁটার বন্ধুরা আসত, আর আসত কিছু বন্ধুবান্ধব। শঙ্কর আর সুমিতা অতদিন আগে বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল, কোনো পক্ষই ওদের মেনে নেয়নি, তাই মেয়েটা ছোট থেকে দাদু-ঠাকুমার আদর পায়নি বলে একটু বেশিই যত্নে রাখত ওরা। কোনোদিনও মেয়েকে কিছুর অভাব বোধ করতে দেয়নি। তবে ফোঁটাও ছোট থেকেই পড়াশুনোয় দারুণ শার্প ছিল, সঙ্গে তুখোড় বুদ্ধি, শঙ্করের তো মেয়েকে নিয়ে গর্বের শেষ ছিল না। জয়েন্টে যখন সারা রাজ্যে চল্লিশ র‌্যাঙ্ক করল, সারা পাড়ায় মিষ্টি খাইয়েছিল দেদার। শাড়ির নেতিয়ে পড়া আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে সুমিতা নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করলো, ফোঁটা ওদের বাপ-মা হিসেবে তো কম গর্বিত করেনি, ছোট্ট থেকে স্কুলের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন অনুষ্ঠানে বুক ফুলিয়ে যেত ওরা দুজন। কিন্তু আজ আর সেই আনন্দগুলো কিছু মনে পড়ে না কেন, মনে হয় যেন গতজন্মের কথা? আর বিনিময়ে ওরা কি দিতে পেরেছে মেয়েকে?

পাশের বউটা কখন ঢুলতে ঢুলতে একদম ওর ঘাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সুমিতা খেয়াল করেনি। ভারটা অসহ্য বোধ হতে সাবধানে বউটার মাথাটা আবার তুলে দিয়ে নড়েচড়ে বসল। এর মধ্যে শঙ্কর বারদুয়েক ফোন করেছে, ওরা সকাল সাড়ে ন-টায় নামবে। শিয়ালদা স্টেশনে নেমে চটজলদি একটা ট্যাক্সি করতে হবে সুমিতাকে, নাহলে ঠিক সময় পৌঁছতে পারবে না আর শঙ্কর ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলা এখন শঙ্করের একটা বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনেকে আড়ালে টিপ্পনীও কাটে। কিন্তু শঙ্কর পাত্তা দেয় না। আগে ওর লেটলতিফ বলে দুর্নাম ছিল। অফিস থেকে শুরু করে কোন নিমন্ত্রণবাড়ি, সব জায়গাতেই অন্তত আধ ঘণ্টা লেট হওয়াটাই ছিল ওর ট্রেডমার্ক। সুমিতা একটা চাপা নিশ্বাস ফেলল। সেদিনটা যদি শঙ্কর দশ মিনিটও আগে পৌঁছত ফোঁটাকে আনতে, ওদের তিনজনের জীবনটাই হয়তো এভাবে আমূল বদলে যেত না।

সুমিতা সঙ্গের ঝোলা থেকে একটা শুকনো পাউরুটি বের করে চিবোতে লাগল। আগে ও কত শৌখিন ছিল, এরকম অবিন্যস্ত শাড়ি, আলুথালু চুল, ট্রেনে বসে শুকনো রুটি চিবোনোর কথা ভাবতেই পারত না। ফিটফাট হয়ে স্কুল যেত সবসময়। পরিস্থিতি মানুষকে কতটা বদলে দেয়! যে ফোঁটা যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়ে একটু একটু সাজগোজ শিখছিল, কলেজ যাওয়ার আগে বড় বড় চোখদুটোয় আলগা কাজল দিত, সে-ই এখন চোখের গর্তের ওপর সেলাই করা চামড়ার ওপর সারাদিন হাত বুলোয়, জড়িয়ে যাওয়া বিকৃত গলা দিয়ে কান্না বেরিয়ে আসে, মনে করতে চায় নিজের এজীবনের মতো হারিয়ে যাওয়া সুন্দর দৃষ্টিটাকে!

পাশের বউটা আবার ঢুলে পড়েছে। সুমিতা আর সরাল না, হয়তো ওর থেকেও বউটার খারাপ অবস্থা। নিজের ঘাড়টাকে ভালো করে পেতে দিয়ে বউটার ঘুমের সুবিধা করে দিল ও। আগে কোথাও যখন ট্রেনে করে যেত, ফোঁটা ঠিক এইভাবে ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমত, আর ওর কোঁকড়া চুলে বিলি কেটে দিত সুমিতা। নিজের অজান্তেই বহুদিন বাদে চোখের কোণে দু-ফোঁটা জল চিকচিক করে উঠল ওর, এমনিতে চোখে জলটল আর আসে না, অনেক হয়ে গেল। হাসপাতালে কাটানো অনেক বিনিদ্র রাত, অনেক নিষ্ঠুর পুলিশি জেরা, অনেক কান্না, অনেক সান্ত্বনা হয়েছে, সময় এখন সবকিছুকেই অভ্যেস বানিয়ে দিয়েছে। মা হওয়ার যত আনন্দ ও পেয়েছে, এই সাড়ে তিন বছরে ভগবান যেন সব কিছু কড়ায়গন্ডায় পুষিয়ে দিয়েছেন।

ব্যাগে ফোন বেজে উঠতে নিজেকে সামলে নিয়ে বউটার ঘুম যাতে না ভেঙে যায় সেইরকম সাবধান ভাবে ফোনটা ধরল সুমিতা। শঙ্করের বাবা, সুমিতার শ্বশুরমশাই। সুমিতার ট্রেন কখন ঢুকবে জিজ্ঞেস করলেন। ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে সুমিতার মনে হল, ওদের অমতে বিয়ে, ফোঁটার জন্ম যে রাগকে গলাতে পারেনি, সাড়ে তিন বছর আগের সেই ঘটনায় সকলের সব রাগ অভিমান মুছে গিয়ে মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে যখন ও একা থাকে, পুরো ঘটনাটার ঘুঁটি নতুন করে সাজায়, এদিক-ওদিক পালটে দ্যাখে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, ফোঁটার এই পরিণতির পেছনে কি ওরও হাত নেই? ফোঁটা ছোট থেকে ওদের কত গর্বিত করেছে, আর বিনিময়ে ওর এই পরিণতিতে কি করেছে সুমিতা মা হিসেবে? সুমিতা বরাবরই ডাকাবুকো, বরং শঙ্কর অনেক শান্ত, গোবেচারা। ছোট থেকে সুমিতা নিজেই শিখিয়েছিল মেয়েকে প্রতিবাদী হতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। তা না হলে কোথাকার কোন মেয়ের সাথে রাস্তায় কারা অসভ্যতা করছে, সে তো কত লোকই দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, ওর মেয়েটা পারল না কেন? একা রুখে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়েছিল ফোঁটা। সেদিন বাড়ি ফিরে ফোঁটার বলা কথাগুলো আজও কানে বাজে সুমিতার। ওর আহত গলা থেকে কষ্ট যেন চুইয়ে পড়ছিল, ”কেউ এগিয়ে এল না মা, জানো! সবাই আড়চোখে দেখে চলে যাচ্ছিল। আমি যখন দলের পাণ্ডাটাকে চড় মারলাম, তখনও কেউ এলো না! এরকম কেন হয়ে যাচ্ছে মানুষ, মা?”

সেদিনের মতো ছেলেগুলো চলে গিয়েছিল। কিন্তু এলাকার বড়োলোকের ছেলে, ভরদুপুরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য একটা বাচ্চা মেয়ের কাছ থেকে থাপ্পড় তারা হজম করতে পারেনি। ঠিক এক সপ্তাহ বাদে সেই থাপ্পড়ের প্রতিশোধ ওরা নিয়েছিল, এক বোতল অ্যাসিডের বিনিময়ে!

এই তিন বছরে অন্তত একশবার সুমিতা নিজের গায়ে অ্যাসিড ফেলে দেখতে চেয়েছে মুহূর্তে চামড়া গুটিয়ে যাওয়ার কতটা দুঃসহ যন্ত্রণা তার ফুলের মতো মেয়েটাকে পেতে হয়েছে, মুহূর্তের মধ্যে চোখের নালি দিয়ে অসংখ্য শিরায় উপশিরায় পৌঁছে যাওয়া তীব্র দহনের স্বাদ পেতে চেয়েছে, পারেনি। আর অন্যরা? সেদিনের ফোঁটার সেই পাশবিক চিৎকার, কান্নায় রাস্তার যে লোকগুলো একবারের জন্যও এগিয়ে আসেনি, পরে পুলিশি সাক্ষীর জন্যও তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একদিকে শঙ্কর মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে পড়ে থেকেছে আর অন্যদিকে বাবাকে নিয়ে সুমিতা হত্যে দিয়েছে এক উকিল থেকে আরেক উকিলের চেম্বারে, যদি সেই ছেলেগুলোর, বিশেষত যে অ্যাসিড ছুড়েছিল, তার যাতে চরম শাস্তি হয়। চরম শাস্তি তো দূর, এই সাড়ে তিন বছরে জলের মতো টাকা খরচ ছাড়া কিছুই হয়নি। সে এলাকার এক বড় প্রোমোটারের ছেলে, উঠতি মস্তান, দিনে দুবেলা অবলীলায় বনগাঁ স্টেশনের পাশে বসে আড্ডা মারে, এদিকে পুলিশ নাকি ওকে খুঁজে পাচ্ছে না। আর ওর মেয়েটা দুমড়েমমুচড়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকে। কষ্টে রাগে গলার কাছটা আবার দলা পাকিয়ে যায় সুমিতার।

সুমিতা চুপচাপ জ্বরের রুগির মতো নিজের অজান্তেই কাঁপছিল। যখনই ও মানসচক্ষে পুরো ঘটনাটা দেখতে চেষ্টা করে, এটাই হয়। আশপাশ থেকে লোকজনের হৈ-হট্টগোলে ওর হুঁশ ফিরল। ট্রেন শিয়ালদা ঢুকে গেছে। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে ও ট্রেন থেকে নামাল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে আবার নিজের শরীরটাকে ট্যাক্সির ছেঁড়া সিটে এলিয়ে দিল ও। এই জীবনযুদ্ধ থামবার নয়!

বাবা-মা হওয়ার যে কতটা কষ্ট, সেটা একমাত্র বাবা-মা হয়েই টের পাওয়া যায়, ও ভাবল। আর সাফল্য, আনন্দের থেকেও যন্ত্রণাই রেশ ফ্যালে বেশি। মাসের পর মাস যখন ফোঁটা হসপিট্যালে ভর্তি, ডাক্তাররা যখন ওর আঠেরো বছরের শরীরটাকে নিত্যদিনের কাটাছেঁড়ার গিনিপিগ বানিয়ে ফেলেছেন, শুধু চোখেরই অপারেশন হয়েছে উনিশটা, অন্যদিকে পুলিশের জেরায় শঙ্কর আর সুমিতা জেরবার, রোজ থানায় যেতে হচ্ছে, তখন ফোঁটার জয়েন্টের চল্লিশ র‌্যাঙ্কটা একদম ফিকে হয়ে গিয়েছিল। যেদিন ফোঁটার চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হল, দুটো সুন্দর চোখের জায়গায় দুটো চামড়ার কোটর দেখে আতঙ্কে কষ্টে শঙ্কর আর সুমিতা চিৎকার করে উঠেছিল, তবু প্রাণপণে সংযত করেছিল নিজেদের, যাতে ফোঁটা কিছু বুঝতে না পারে।

এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে একটা পুজোর মণ্ডপের সামনে বিশাল জ্যাম, মাইকে গান বাজছে উদ্দাম। পুজোর জন্য আর আলাদা করে কোনো অনুভূতি হয় না ওদের আর! বরং এই জ্যাম, ট্রেনে বাসে ভিড়ের জন্য মনে হয় এই দিনগুলো গেলেই বাঁচা যায়!

ট্যাক্সি থেকে নেমে প্রথমে ও ভাবল শঙ্করকে একটা ফোন করবে, তারপর সামনে একটা জটলা দেখে এগিয়ে গেল। হুম, ও যা ভেবেছে তাই। শঙ্কর আর পাশে হুইল চেয়ারে ফোঁটা। এখনো কোনোরকমে হাঁটতে পারলেও বাইরে কোথাও গেলে হুইল চেয়ারেই যায় ওর সেদিনের সেই খলবলে মেয়েটা। আশপাশে দশ-বারো জন মানুষের ভিড়। দূর থেকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে সুমিতার চোখ জলে ভরে উঠল। ফোঁটা আবারও ওদের গর্বিত করল। ওর এইটুকু জীবনে এমন ঘটনা ঘটার পরেও মেয়েটা আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, প্রাণপণে আশপাশের খড়কুটোগুলো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে আপ্রাণ। ওর বন্ধুরাও সাহায্য করেছে নিরলস। জুগিয়েছে মনোবল। সেই মনের জোরেই বছরখানেক আগে হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে বন্ধুদের নিয়ে ফোঁটা একটা মোবাইল অ্যাপ বানিয়েছিল, যেটা শুধু বিপদে পড়লে জিপিএস লোকেশনই অটোমেটিক্যালি ফরোয়ার্ড করে দেবে না, সেই লোকেশনের সবচেয়ে কাছের পুলিশ স্টেশনে নিজের লোকেশন জানিয়ে মেসেজও যাবে আর ভিডিও রেকর্ডারটাও অন হয়ে যাবে ফোনের। সেইজন্যই দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পুরস্কার নিতে গিয়েছিল বাবা মেয়ে মিলে। ইনফরমেশন অ্যান্ড ব্রডকাস্টিং মিনিস্ট্রির তরফ থেকে মন্ত্রী নাকি কাল ঘোষণা করেছেন, ২০১৮ সালের মধ্যে সমস্ত ফোনে এই অ্যাপটাকে বিল্ট ইন করে দেওয়া হবে যাতে আর কোন ফোঁটার সাথে এরকম না হয়। কাগজে কাগজে হইচই হচ্ছে ফোঁটাকে নিয়ে, সবাই সাধুবাদ জানাচ্ছে, কুর্নিশ করছে সুমিতার সেদিনের সেই ছোট্ট দুর্গার এমন মনের জোরকে।

ওই তো, দূর থেকে ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কালো চশমার আড়ালে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া চামড়ার আড়ালে ঢেকে যাওয়া ফোঁটার সেই উজ্জ্বল চোখদুটো, যা দিয়ে ও একদিন অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখত। ওর সেলাই করে ঠোঁটের আকৃতি দেওয়া কৃত্রিম মুখগহ্বরটাও চোখে পড়ে সুমিতার, যা দিয়ে অসংখ্য ডিবেট, ক্যুইজে প্রতিপক্ষকে অবলীলায় যুক্তিতে হারিয়ে দিত ফোঁটা।

সুমিতা অল্প এগোয়। সাংবাদিকরা একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে ওদের। বেশিরভাগই শঙ্কর উত্তর দিচ্ছে, কয়েকটা জড়ানো ভোকাল কর্ড নিয়ে ফোঁটা বলছে। সুমিতা হঠাৎ খুব আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। নাহ, ফোঁটা সন্তান হয়ে ওদের যত গর্বিত করেছে, আজ অন্তত কিছুটা হলেও তার ঋণ শোধ করতে পেরেছে সুমিতা। আর এই যে মেয়েটার অসীম মনের জোর, তার পেছনেও কি ওর আর শঙ্করের একটুও হাত নেই?

সাংবাদিকরা এখনো কেউ মনে হয় খবর পায়নি। কাল রাতে যে ছুরিটা দিয়ে ওই ছেলেটার গলার নলিটা কেটে এসেছিল সুমিতা, সেই রক্তমাখা ছুরিটা ব্যাগের মধ্যেই ও খামচে ধরে। অনেক … অনেক দিন সহ্য করেছে ও, অনেক আইনের পথে হেঁটেছে, অনেক মন্ত্রী উজির, পুলিশ উকিল ধরেছে, কিছু হওয়ার নয় ও বুঝে গিয়েছিল। তাই শঙ্কর মেয়েকে নিয়ে দিল্লি যাওয়ার পরেই ও তক্কে তক্কে ছিল। ছেলেটা প্রায়ই মদ খেয়ে মাঝরাতে পাড়ার মোড়ে পড়ে থাকে সেটা ও জানতো।

সুমিতা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। হয়তো এরপর সারাজীবন ও জেলের ঘানি টানবে, তাতে ওর বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই, ওর মেয়েটার ওপর অত্যাচারের তো শাস্তি দিতে পেরেছে ও। সুমিতা মনে মনে ভাবে, এটাই ওর তরফ থেকে বিশ্বরূপার জন্মদিনের উপহার।

দূরের পুজোমণ্ডপ থেকে ও আবছা শুনতে পায় মহালয়ার আগমনী। ও স্বপ্ন দ্যাখে, একদিন ফোঁটা অনেক অ-নে-ক বড় হবে, সেটাই ওর পাওনা। বাহ্যিক রূপ, এই দৈহিক কাঠামোটাকে নষ্ট করে দিলেও ওর কিচ্ছু যায় আসে না, তা ও দেখিয়ে দেবে সবাইকে। চোখের জল মুছে দূরের অদেখা দুর্গামূর্তির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে ও উচ্চারণ করে, ”এবার দেবীপক্ষ শুরু!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *