প্রতিবন্ধী

প্রতিবন্ধী

যারা হাওড়া থেকে ছ’নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আমতা রানিহাটি রোড বরাবর গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ঝিখিরা নামক মফসসলটির নাম শুনে থাকবেন। আর অন্যরা যারা ঝিখিরার নাম শোনেননি, তাঁরা জেনে রাখুন, খাতায় কলমে ঝিখিরাকে মফসসলের মর্যাদা দেওয়া হলেও আদপে এটি একটি গ্রাম, অজ পাড়াগাঁ না হলেও গঞ্জ জাতীয় এলাকা। এখানে দুটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাই স্কুল আর একটিমাত্র ব্যাঙ্ক ছাড়া কিছুই নেই তেমন।

সুকন্যা ঝিখিরার সেই ব্যাঙ্কে চাকরি করে। রোজ কর্ড লাইন লোকাল ধরে হাওড়া এসে সেখান থেকে ঘণ্টাদুয়েক হাওড়া-ঝিখিরা রুটের বাসে হ্যাজাতে হ্যাজাতে কর্মস্থলে পৌঁছোয় সে। গত তিনবছর ধরে এই রুটে যাতায়াতের ফলে এই রুটের ড্রাইভার থেকে শুরু করে কন্ডাক্টর মোটামুটি সবাই সুকন্যাকে ব্যাঙ্কের দিদিমণি বলেই চেনেন। আজও সেরকমই সকাল সকাল সুকন্যা বাসের লেডিজ সিটে বসে যাচ্ছিল। কানে হেডফোন নিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করা তার স্বভাবে নেই, তাই আশপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতেই যাচ্ছিল, বাসে যাতায়াতের এইটুকু সময়ই যা ওর একান্ত নিজের। হঠাৎ একটা বেমানান ব্যাপারে চোখটা আটকে গেল।

হাওড়ার স্ট্যান্ড পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই আড়াইজন মানুষ বাসে উঠল যারা এই রুটে একান্তই বেমানান। দুজন মহিলা, সাথে একটা বছর পাঁচেকের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। দুজন মহিলারই বয়স চল্লিশের নীচে, কিন্তু তাদের মুখের উগ্র প্রসাধন তাদের সৌন্দর্য বাড়াবার বদলে যেন বয়সটাকেই বাড়িয়ে দিয়েছে। একজনের পরনে হাঁটুর একটু ওপরে শেষ হয়ে যাওয়া সাদা একটা টাইট কেপ্রি, উপরে গোলাপি স্লিভলেস ট্যাঙ্ক টপ, কালার করা চুল ঘাড়ের একটু নীচেই শেষ হয়ে গেছে, পুরনোদিনের বলিউডি ঢাউস সানগ্লাস মাথার ওপর তোলা। আরেকজন কুমড়োর মতো মোটা হলেও তার হাঁটু অবধি গাউন দেখে সুকন্যার হাসি পেয়ে গেল, ভুঁড়ি উঁকি মারছে গাউনের ফ্রিল থেকে, দুজনেরই ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক। বাচ্চাটার গায়ে সুন্দর একটা ফ্রক।

এই গরমে কি করে লোকজন এমন উৎকট সাজে ভেবে সুকন্যার অবাক লাগে! ও তো ঠিকমতো চুল বাঁধারও এনার্জি পায় না, কোনোমতে চূড়ো করে পনিটেল করে বেরিয়ে আসে। আর এদের দেখে মনে হচ্ছে যেন ফ্যাশন কনটেস্টে চলেছে!

এই তিনজন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাসের প্রত্যেকের নজর ওইদিকে চলে গেল। গত দু-বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ও এইটুকু জানে এই বাসের যাত্রী মূলত নিম্নবিত্ত সব্জিবিক্রেতা আর খুচরো দোকানদার যারা হাওড়া থেকে পাইকারি দরে জিনিসপত্র কিনে এনে গাঁয়ে বিক্রি করেন, এছাড়া ওই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা আছেন তাঁরা যাতায়াত করেন, তাদের প্রত্যেকের সাথেই সুকন্যার আলাপ আছে। আলাপটা করিয়ে দিয়েছেন ব্যাঙ্কের লাগোয়া প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার রমেশদা। রমেশদা ভারি ভালো মানুষ, গ্রামেই থাকেন, আপদে বিপদে সবার পাশে দাঁড়ান। ঝিখিরা গ্রামের মানুষজন খাতায়-কলমে শিক্ষিত না হলেও ভারি সরল আর সোজাসাপটা। তাদের ডিগ্রি না থাকুক, সহবৎ আছে যথেষ্ট।

সাদা কেপ্রি উঠেই বেশ জোরে মুখ বেঁকিয়ে বলল, ”উফ! মাগো! এইবার এই জঘন্য বাসে করে যেতে হবে? আমি তো ভাবতেই পারছি না!”

কুমড়ো বলল, ”কি করবি বল! বাবার ওই ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভার যে এইভাবে ঝোলাবে কে ভেবেছিল! তিন মাস আগে থেকে বলে আসছি হাওড়ায় নেমে যেন গাড়ি পাই! তবু সকালে শুনি ড্রাইভার নাকি অসুস্থ, আসতে পারবে না! যতসব আনকালচারড ভূত! এখন এইসব ছোটলোকের সঙ্গে গা লাগিয়ে চল!”

সুকন্যা বেশ অবাক হয়ে গেল। কোনো শিক্ষিত লোক যে বাসে উঠে এইরকম মন্তব্য করতে পারে ওর ধারণাতেই ছিল না। ও কন্ডাক্টর রতনদার দিকে তাকাল। রতনদা বুঝতেই পেরেছিল, কাছে এসে চুপিচুপি বলল, ”দেখেছেন দিদিমণি, কিরকম কথাবার্তা? আমরা না হয় ছোটলোক, কিন্তু আপনি রয়েছেন বাসে, হাই স্কুলের সুমন মাস্টারবাবু রয়েছেন!”

সুকন্যা মুখে কিছু বলল না, কিন্তু ওর বিরক্তি পারদের মতো চড়ছিল। এই ক-বছরে ও ঝিখিরার মানুষদের সাথে বেশ একাত্ম হয়ে পড়েছে। আশপাশের সরল সাধাসিধে মানুষগুলো তাকে বড় ভালোবাসে। কার বাগানে আম হল, কার জমিতে ভালো চাষ হল, গরিব মানুষগুলো টুকটাক দিয়ে যায় জোর করে, কারুর বহুদিনের চালু না হওয়া পেনশন সুকন্যা ব্যাঙ্কে ঠিকমতো ব্যবস্থা করে দিলে, বা কেউ বিধবাভাতা পেলে এইভাবেই তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। সেখানে এই দুটো জোকার এতবড় সাহস পায় কি করে!

সুকন্যা খুব স্ট্রেট ফরওয়ার্ড, ভিতু নয় মোটেই। কোথাও অন্যায় দেখলেই তার প্রতিবাদ করে, তবু ও কিছু বলল না। ড্রাইভারের দিকে মুখ করে কন্ডাক্টরের ঠিক পেছনের সিটদুটো প্রতিবন্ধীদের জন্য, তার পরের লেডিজ সিটেই ও বসেছিল। মহিলাদুটো এসে ওর সামনের প্রতিবন্ধী সিটে বসে পড়ল ধপ করে। বাচ্চাটা দাঁড়িয়ে রইল জানলার রেলিং ধরে।

চড়া পারফিউমের গন্ধে সুকন্যার নাক বন্ধ হয়ে এল। নাক কুঁচকে ও বাইরের দিকে তাকাল। অন্যদিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করলেও সামনের সিটের কথোপকথন ওর মনটাকে বারবার বিক্ষিপ্ত করে দিতে লাগল।

কুমড়োই শুরু করল, ”বুজু ডিয়ার, তুমি আমার কোলে এসে বসো সোনা, বাসের ঝাঁকুনিতে পড়ে যাবে তো!”

সাদা কেপ্রি অমনি ঝাঁঝিয়ে উঠল, ”উফ দিদি, তোকে কতবার বলেছি না! বুজুর সাথে কখনো বাংলায় কথা বলবি না? ইন ফ্যাক্ট ওর সামনে আমাদের নিজেদের মধ্যেও ইংলিশে কথা বলা উচিত, তবেই না ফ্লুয়েন্সিটা তৈরি হবে!”

—”ওহো সরি। বুজু সোনা, তুমি আমার কোলে এসে সিট করো বাবু!”

এহেন ইংলিশ শুনে সুকন্যা প্রাণপণে হাসি চেপে ডানদিকে তাকাতেই দেখল হাই স্কুলের মাস্টার সুমনদা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, ভাবখানা এমন, বিনা পয়সায় রগড় দেখা যাচ্ছে বেশ! সুকন্যা আবার শুনল, সাদা কেপ্রি বলছে, ”শোন, তুই যেন আবার গিয়েই বাবাকে বলিস না আমরা কেন এসেছি!”

কুমড়ো অবাক, ”ওমা! না বললে কাজটা হবে কি করে! আমাকে তো তোর জিজু পাঁচদিনের আল্টিমেটাম দিয়ে পাঠিয়েছে, তার মধ্যে লিখিয়ে নিতেই হবে।”

সাদা কেপ্রি দাঁতে দাঁত চিপল, ”উফ, তোর বুদ্ধি কবে হবে! এই আট ন’বছরে একবারও যাইনি, নিজে থেকে ফোন করি না, হঠাৎ করে গিয়ে যদি বলি বাড়ি আমাদের দুজনের নামে লিখে দাও, বিয়েতে তো একটা গয়নাও ঠেকাওনি, এখন সেগুলো দাও, সন্দেহ করবে না?”

বাচ্চাটা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ”বাড়ি কি করে লেখে মাম্মি? বাড়ি তো একটা বিশাল জিনিস, বাড়ি লেখা যায় নাকি!”

কুমড়ো বেশ রেগেছে, ”বুজু তুমি আমার কোলে এসে ঘুমোও।” তারপর ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ”সন্দেহ করবে মানে! সত্যিই তো আমাদের দু-বোনকে নমো নমো করে বিদায় করেছিল মায়ের গয়নাগুলো তখনও বন্ধক ছিল বলে কিচ্ছুটি দেয়নি! সব কি দাদা একাই নেবে নাকি!”

—”আরে সেটা তো আগ বাড়িয়ে বলার কিছু নেই! এমনিই বাবা দাদা অন্ত প্রাণ, দাদা ভালো চাকরি পেয়েও না গিয়ে ওই গণ্ডগ্রামে থেকে মাস্টারি করছে, বাবার দেখাশুনো করছে, তার ওপর মায়ের গয়নাগুলো দাদাই ছাড়িয়ে এনেছে টাকা দিয়ে, বাবার তো ওর ওপর টান থাকবেই!”

—”সত্যি! দাদা এত গবেট জানা ছিল না। তোর জিজু তো প্রায়ই হাসে, বলে তোমার দাদা এত ভালো স্টুডেন্ট ছিল, ওই পাড়াগাঁয়ে পড়ে থেকে নিজের কেরিয়ারটা বরবাদ করল! আর বুড়ো বয়সে বিয়েই বা করতে যাচ্ছে কেন! মায়ের যে কটা গয়না পেতাম সে-কটাও যাবে!”

—”কিচ্ছু যাবে না। এমনি এমনি কি তুই হায়দ্রাবাদ আমি পুনে থেকে ছুটে এসেছি নাকি! দ্যাখ না, কেমন ইমোশনাল কথা বলে দাদার কাছ থেকে ওগুলো হাতিয়ে নিয়ে যাই!”

বাচ্চাটা আবার প্রশ্ন করল, ”হাতিয়ে নেওয়া কি মাম্মি?”

সাদা কেপ্রি শুনতেই পেল না বাচ্চার প্রশ্ন। কুমড়ো অমনি বিগলিত, ”সে জানি! তোর ওপর আমার ভরসা আছে! তবে আর যাই করিস, মায়ের ওই রতনচূড়টা কিন্তু আমি নেব বলে দিলাম! ওটায় কিন্তু তুই নজর দিবি না!”

”সে দেখা যাবে। এখন গিয়ে আগে দাদাকে পটাতে হবে। কাজ নেই কম্ম নেই, কত আশায় ছিলাম মা চলে গেলেই গয়নাগুলো নিয়ে আসব, তা না, কোত্থেকে একটা পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করবে, তাও এই বয়সে! সোসাইটিতে প্রেস্টিজ বলে আর কিছু রইলো না। আমার তো ক্লাবে রীতিমতো বলতে লজ্জা করে যে আমার দাদা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার!”

সুকন্যা আঁচ করেছিল, এতক্ষণে নিঃসন্দেহ হল আর স্তম্ভিত হয়ে গেল। এই দুজনই তাহলে রমেশদার আদরের দুই বোন! যারা আসবে বলে দিনকয়েক ধরে রমেশদা ব্যাঙ্কে এসে বারবার টাকা তুলছে। গতকালও জিজ্ঞেস করেছিল সুকন্যা, ”কি ব্যাপার রমেশদা, সব ভাঙিয়ে টাকা তুলে নিচ্ছেন কেন? বোনেরা আসবে বলে কেউ ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙায় নাকি!”

রমেশদা কান এঁটো করা হাসি হেসে বলেছিল, ”আপনি জানেন না ম্যাডাম, আমার বোনদুটো বহুদিন বাদে আসছে। সেই বিয়ের পর একবার এসেছিল। সঙ্গে আমার ছোট্ট ভাগ্নি, তাকে আমি দেখিইনি। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে! ভাগ্নিকে কোলে নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরব ঠিক করেছি।” পরক্ষণেই মুখ কালো করে বলে উঠেছিল, ”কিন্তু আমার বিয়েতে ওরা আসতে পারবে না জানেন! দুজনের বরই খুব বড় চাকরি করে তো! ওরা অনেক বড়োলোক জানেন! ওদের এসে কষ্ট হবে না ঠিকমতো বাথরুম ঘর না পেলে? বাবা তেমন ধুমধাম করে বিয়ে দিতে পারেনি ওদের! কিন্তু ওরা দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসে!”

সুকন্যা হঠাৎ শুনল কুমড়ো বলছে, ”শোন বুজুকে বেশি বাবা, মা, দাদার কাছে ঘেঁষতে দিবি না, এরা সব গাইয়া লোকজন, কিসব শিখিয়ে দেবে!”

”সে আর বলতে! সামনের বছর ডিপিএস-এ ট্রাই করব, এইরকম সময়ে ভুলভাল শিখলে তো সব বারোটা বেজে যাবে। অনির্বাণ তো আমাকে পইপই করে বলে পাঠিয়েছে আমি যেন ওকে একমুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল না করি।”

সুকন্যার ইচ্ছে করল উঠে দাঁড়িয়ে দুজনের মাথাদুটো ঠুকে দিতে জোরে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল ও। কিন্তু রাগে ওর শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রমেশদা বিয়ে করতে চায়নি, সুকন্যারাই জোর করে ঠিক করেছে। রমেশদাদেরই স্কুলের টিচার সুমনার সাথে। সুমনার একটা পা নেই, ছোটবেলায় একটা অ্যাকসিডেন্টে ওর বাবা মারা যান, তখনই ওর পা-টাও কেটে বাদ দিতে হয়। কিন্তু সুমনা ভারি ভালো মেয়ে।

 পাশাপাশি লাগোয়া ব্যাঙ্ক আর স্কুল থাকলে যা হয়, মানুষ মিলেমিশে যায়। অবসর সময়ে একসাথেই আড্ডায় মেতে ওঠে ওরা। সুমনা খুব কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছে, ঝিখিরার আগের গ্রামে বয়স্ক মা-কে নিয়ে একাই থাকে, ভালো গানও গায়। রমেশদা আর সুমনা দুজনেই মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে, গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে তাকে সেবা করা, কারুর ছেলেমেয়ে অভাবে পড়তে না পারলে তাকে সাহায্য করা, সবেতেই দুজন এগিয়ে যায়। আর তাদের সম্পর্কে এইরকম মন্তব্য! সুকন্যা ঠিক করল গিয়েই রমেশদাকে সব বলবে।

দেখতে দেখতে পলাশপাই স্টপেজ এসে গেছে, এখান থেকে বেশ কিছু মানুষ ওঠে। আর কিছুক্ষণ লাগবে ঝিখিরা পৌঁছতে। সুকন্যা হঠাৎ দেখল হালকা খয়েরি রঙের সুতির শাড়ি পড়ে সুমনা উঠছে বাসে, ওকেও সবাই চেনে। কন্ডাক্টর রতনদা গিয়ে ক্রাচদুটোকে টেনে তুলল, তারপর সাবধানে ওঠাল ওকে। সুমনা উঠে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে বলল, ”কি খবর রতনদা? মেয়ে ভালো আছে তো?”

রতনদা হেসে বলল, ”হ্যাঁ দিদিমণি, আপনি আর দাদাবাবু সেবার কলকাতায় নিয়ে গিয়ে যে ডাক্তার দেখিয়ে আনলেন, সেই ওষুধেই মেয়ে আমার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সামনের সপ্তাহ থেকেই ভাবছি স্কুলে পাঠাব।”

সুমনা বলল, ”হ্যাঁ অবশ্যই পাঠাবে, না হলে ও অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে।” পরক্ষণেই ওর চোখ পড়ল সুকন্যার দিকে, ”কিগো, তুমি?”

সুকন্যা মনে মনে গজরাচ্ছিল, হবু দুই ননদের সামনেই যে সুমনা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা সুমনা জানেনা! হঠাৎ ও বেশ জোরেই বলল, ”তুমি বোসো সামনের সিটটায়। ওদের উঠতে বল। ওটা তো প্রতিবন্ধী সিট!”

অদ্ভুত ব্যাপার মহিলাদুটো শুনতে পেয়েও ওঠার কোনো লক্ষন দেখাল না।

সুমনা ভালো করেই সুকন্যার মেজাজ চেনে, নিরস্ত করার জন্য বলল, ”ছাড়ো না! আর তো মাত্র মিনিট পনেরো! এখুনি পৌঁছে যাব!”

বাসে আর কোনো সিট নেই, সুকন্যা উঠে সুমনাকে বসাল জোর করে। মহিলাদুটো নির্লজ্জের মতো তখনো সিটে বেমালুম বসে গল্পে মশগুল, ”গিয়ে যদি চার-পাঁচদিনও থাকতে হয়, কি করে ওই পোড়ো বাড়িতে থাকব জানিনা!”

বাচ্চাটা বলল, ”পোড়ো বাড়ি কি মা?”

সাদা কেপ্রি বলল, ”হন্টেড বুজু!”

বুজু চোখ বড়বড় করে বলল, ”দাদুরা তার মানে হন্টেড হাউজে থাকে মা? কিন্তু আমাকে যে মামা ফোনে বলছিল বাড়িটা খুব সুন্দর?”

সাদা কেপ্রি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, ”তোমাকে কতবার বলেছি না, দাদু বলবে না? গ্র্যান্ড পা বলো! উফ দাদা যে কেন ফোন করে এইসব উল্টোপাল্টা শেখায়!”

বাস ততক্ষণে ঝিখিরায় ঢুকছে। সুমনা সুকন্যা দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছে, নামবে সামনেই। জোরে একটা ব্রেক কষতেই সুমনা টাল সামলাতে না পেরে পড়ল কুমড়োর গায়ে, অমনি কুমড়ো চেঁচিয়ে উঠল, ”এই এই, ঠিক করে দাঁড়াও, ইস, নতুন ড্রেসটা…কোত্থেকে যে এরা সব আসে অশিক্ষিত খোঁড়ার দল…!”

সুকন্যার এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। বেশ জোরেই বলল, ”ভদ্রভাবে কথা বলুন। খোঁড়া ও নয়, খোঁড়া আপনারা দুজন। শুধু খোঁড়া নন, অন্ধ, কালা সব। আপনাদের শিক্ষার দৌড় তো দেখলাম, প্রতিবন্ধী সিটে কেমন গ্যাঁট হয়ে বসে রইলেন ইনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেখেও! আসল প্রতিবন্ধী তো আপনারাই! প্রতিবন্ধকতা আপনাদের মনে। আর মাতৃভাষা বাংলা না শিখিয়ে শুধু ইংলিশ বলাতেই বুঝি শিক্ষার দৌড় বোঝা যায়? যে নিজের মা-কেই ভালো করে চিনল না সে অন্যের মা-কে চিনবে কি করে!” পরমুহূর্তেই বিদ্রূপের একটা হাসি হেসে বলল, ”অবশ্য নিজের মায়েদের থেকে যা শিক্ষা পাচ্ছে সেটা না শেখাই ভালো! ডিপিএস-এ ভরতির জন্য সবথেকে আগে দরকার বাচ্চটাকে আপনাদের দুজনের সঙ্গ ত্থেকে বাঁচানো বুঝলেন!”

 বাচ্চাটা প্রশ্ন করল, ”পোতিবন্দি কি মাম্মি? তোমরা পোতিবন্দি?”

সুকন্যা বলল, ”আপনারা শুধু প্রতিবন্ধী নন, অত্যন্ত গরিব। মনের দিক থেকেও, সম্পদের দিক থেকেও। আপনাদের দাদা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার ঠিকই, কিন্তু তিনি সত্যিকারের বড়োলোক বুঝলেন! আপনাদের থেকে অনেক বড় একটা মন আছে তাঁর! পারলে মেয়েকে তাঁর কাছে রেখে আসুন, প্রকৃত মানুষ হবে, আপনাদের মতো মানুষের মতো দেখতে জন্তু নয়!”

সাদা কেপ্রি আর কুমড়ো হাঁ করে তাকিয়ে রইল, সুকন্যা অবাক হয়ে চেয়ে থাকা সুমনাকে সাবধানে নামিয়ে নিয়ে গট গট করে হেঁটে চলে গেল। মনটা ওর এখন অনেক বেশি হালকা লাগছে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল ও, ব্যাঙ্ক খোলার আগেই স্কুলে গিয়ে রমেশদার সাথে কথা বলতে হবে।

**********

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *