ফরচুন কুকি
লম্বা সিঁড়ির করিডর বেয়ে সমস্ত বইখাতাগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়তেই ধ্রুব সেগুলো উবু হয়ে কুড়োচ্ছিল। বাইরের সদ্য ঝড় ওঠা কালবৈশাখী হাওয়ায় কয়েকটা পাতা এদিক-ওদিক উড়ে যেতে ব্যগ্রভাবে সেগুলোকে টেনে এনে জড়ো করছিল ও এক মনে। আর সিঁড়ির একদম ওপর প্রান্তে তাকাবে না ভেবেও আড়চোখে শ্রেয়সী চাইছিল ধ্রুবর দিকে, কিছুটা অবিশ্বাস ভরা কৌতূহলে, আর কিছুটা ভয়ে। ধ্রুব হেল্প করছে! এটা আবার নতুন কোনো কায়দা নাকি?
প্রায় বছর পঞ্চাশের পুরনো কোনোরকম সারাই না হওয়া রেল কোয়ার্টার। বেশিরভাগ জায়গাতেই বিশাল বিশাল বট অশ্বত্থের ঝুরি থাবা বসিয়েছে ইতিউতি। মাস দুয়েক আগেই দোতলার পেছনদিকে একটা মস্ত চাঙর ভেঙে পড়েছিল, কেউ সেই সময় থাকলে একটা দুর্ঘটনা ঘটত। নামেই রেলের কোয়ার্টার, এবাড়িতে যে বারো-তেরোটা পরিবার বাস করে তাদের প্রায় তিন প্রজন্ম আগে কেউ হয়ত রেলে কাজ করত, তারপর জবর দখল করে নেওয়া বাড়ি, উঠবে তো কেউ না-ই, এমনকি সারাবেও না কেউ নিজের গরজে। সে ক্ষমতাও নেই যদিও।
ধ্রুব সামনে এসে বইখাতাগুলো বাড়িয়ে ধরল শ্রেয়সীর দিকে। অন্য সময় দিনে রাতে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নামতে, বা রাস্তাঘাটে যখনই ধ্রুবর সামনাসামনি শ্রেয়সী পড়েছে, একটা অদ্ভুত আড়ষ্টতা এসে গ্রাস করেছে ওকে। মনে মনে অসংখ্যবার ভেবেছে, আচ্ছা, ধ্রুব কি আজকাল কখনোই প্রকৃতিস্থ থাকে না? মুখে সারাক্ষণের অশ্রাব্য গালিগালাজ ছাড়াও ভকভক করে বেরনো মদের গন্ধই যেন ধ্রুবর ট্রেডমার্ক। এই ছোট্ট কয়লাখনির শহরতলিতে ধ্রুবর মতো সবদিক দিয়ে গুণধর ছেলে খুঁজে পাওয়া ভার। বারতিনেক ড্রাগ সাপ্লাইয়ে ধরা পড়া থেকে, বড় মাফিয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে রাতের অন্ধকারে কয়লা পাচার, মারামারিতে জড়িয়ে পড়া, মাত্র তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সেই সব দিকেই হাত পাকিয়ে ফেলেছে ও। ওদের এই জবর দখল বাড়ির দু-একটা কাকা শাসন করতে গিয়ে উল্টে অপমানিত হয়ে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। আর তাছাড়া, এই পোড়োবাড়িতে সবাই রাজা, কেউ কাউকে মানে না!
শ্রেয়সী আড়ষ্টভাবে বইগুলো হাতে নিতেই ধ্রুব সামান্য হেসে নীচে নেমে গেল। অথচ মাত্র দু-দিন আগে এই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দুজনের মুখোমুখি দেখা হওয়ায় কি অপমানজনকই না একটা মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছিলি ধ্রুব! নিজেদের ঘরে ফিরে অপমানে, দুঃখে চোখে হু হু করে জল এসে গিয়েছিল শ্রেয়সীর।
অথচ পাঁচ-ছ’বছর আগেও কিন্তু ছেলেটা এরকম ছিল না! শ্রেয়সী আর ও একই স্কুলে পড়ত, তারপর কলেজও লোকাল। তখন ভদ্র লাজুক একটা ছেলে ছিল। আর এখন এত নোংরা হয়ে গেছে? কিন্তু এই প্রতিদিনের নোংরামির কথা কাকেই বা বলবে আর কোথায়ই বা যাবে শ্রেয়সী! তাও বিনা পয়সায় মাথার ছাদটা জুটেছে, নাহলে বাবা সেই কোন ছোটবেলায় মারা যাওয়ার পর থেকে তো ওদের দুজনকেই পথে পথে ঘুরতে হত। ভরসা এখন মায়ের সেলাই আর ওর টুকটাক টিউশন। এসবের মাঝে আর নিজের আত্মসন্মানের কথা ভাবার অবকাশ কোথায়!
বইগুলো তুলে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ধ্রুবও একই কথা ভাবছিল। এটাই ভাবছিল যে, শ্রেয়সী বলে সাত নম্বর ঘরের মেয়েটা নিশ্চয়ই আজ অবাক হয়ে গেছে। এক মাইক্রোসেকেন্ডের জন্য ওর মনে হল, মেয়েটার মুখে একটা আলগা লাবণ্য আছে, কেমন মায়াময় ঢলঢলে মুখ, ঠিক ওর মায়ের মতো। পরক্ষণেই নিজের এমন ভাবনায় অবাক হয়ে গেল ধ্রুব। অবশ্য কাল রাত থেকেই একেক পর এক অবাক হওয়ার মতো ঘটনাই ঘটে চলেছে ওর জীবনে। একটু আগে ল্যাংড়া শন্টুর ফোন এল, কলোনির ঠেকে ভালো দিশি মাল এসেছে, তবু ধ্রুব গেল না। এমনকি, পঞ্চা এসে আট-দশবার সাধাসাধি করলেও রোজকার মতো ও আর আজ সাদা গুঁড়োগুলো প্যাকেটে ভরে দু-পয়সা কামাবার ধান্দায় পড়ি কি মরি করে ছুটল না। রাস্তায় পড়ে থাকা পেপসির একটা ক্যানকে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিতে দিতে কোয়ার্টারের সামনের ধুলো মাখা বেঞ্চে বসে ধ্রুব ভাবল, ধুর শালা, কি কুক্ষণেই না ও কাল রাতে ট্যাংরায় গিয়েছিলো!
প্রপোজালটা দিয়েছিল অমিত, ওর গুটিকয়েক ভালো বন্ধু যে ক-জন আছে, তার মধ্যে একজন, যারা ওর এমন অধঃপতনেও ছোটবেলার বন্ধুত্বটাকে শেষ করে দেয়নি। অমিত মুম্বাইতে ভালো চাকরি করে, ছুটিতে এসেই ফোন লাগিয়েছিল ওকে, ”অনেকদিন দেখা করিনি তোর সাথে। জলদি মিট কর।”
দুজনের সুবিধামতো ঠিক হয়েছিল ট্যাংরার এক চিনে রেস্তোরাঁয় দেখা করা হবে। ধ্রুব ঠিক সময়মতো পৌঁছেও গিয়েছিলো সেখানে। ছোটবেলার বন্ধুত্বের টান এমনই, সেখানে স্ট্যাটাস, শিক্ষা বা অন্যকিছু খুব একটা ম্যাটার করে না, সেসব কিছু মনেও হয় না, শুধু ছোটবেলার সাদা কাগজের ওপর আঁচড় কাটা ঢলোঢলো পবিত্র ভালোবাসা মাখানো বন্ধুত্বটাই সেখানে বড় হয়ে দেখা দেয়। তবে ধ্রুব আগে থেকেই শর্ত দিয়ে গিয়েছিল, জ্ঞান-ট্যানের কারবার হলে ও নেই। এখন অনেক বন্ধুরাই তো দেখা হলেই ধ্রুবকে উপদেশ দেওয়ার ফ্রি ক্লাস খুলে বসে। সেই ধান্দায় যদি অমিত থাকে, তবে ধ্রুব যাবে না।
কিন্তু অমিত হেসে আশ্বস্ত করেছিল ফোনে, ”ধুর শালা, অ্যাদ্দিন বাদে দেখা করতে চাইছি, জ্ঞান কে দেবে? প্রেম করছি, তাই নিয়ে একটু চাপেও আছি, আয় না একটু হাল্কা হব।”
ঠিক ছিল অমিতই খাওয়াবে। চাকরিটা দুম করে পেয়ে মুম্বাই চলে যাওয়ায় সেই খাওয়াটা ডিউ ছিল। বেশ মনের সুখে পাঁচ-ছ’রকম আইটেম অর্ডার করে জমিয়ে বসেছিল দু-বন্ধু মিলে। চায়না টাউনের এই রেস্ট্যুরেন্টগুলো বেশ, কেমন নীলচে ধরনের আলো, আর হাল্কা মিউজিক, মনে হয় যেন কলকাতার মধ্যে আরেকটা কলকাতা।
ড্রাই চিলি চিকেনের একটা পিস ফর্কে করে মুখে চালান করে অমিত বলেছিল, ”তারপর, তুই এখন কি করছিস বল তো?”
ধ্রুব মন দিয়ে খেতে খেতে বলেছিল, ”কি আর করব! সাপ্লাইয়ের একটা বিজনেস করি আর কি!”
অমিত বলেছিল, ”তুই অঙ্কে অত ভালো ছিলি, বি এসসি টা পাশ করে দুম করে লেখাপড়ার লাইনটা ছেড়ে দিলি কেন বল তো? চাকরির পরীক্ষাগুলো দিতে পারতিস, নিদেনপক্ষে টিউশনি-টনি……!”
ধ্রুব ঠোঁট কামড়াল। অন্য সবার মতো অমিতও ধীরে ধীরে শর্তের খেলাপ করার দিকে এগোচ্ছে। নিজেকে প্রাণপণে সংবরণ করছিল ও। শালা অঙ্কে ভালো! অমিতরা কি বুঝবে! সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিল, বাপ পয়সা খরচা করে প্রাইভেটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াল, এখন বড় বড় বুলি কপচাচ্ছে। আর শালা ও নিজে, কোন ছোটবেলা থেকে টিউশনি করে পড়াশুনো করেছে। অনেক কিছু মাথার ভেতরের রেকর্ড প্লেয়ারটায় কিলবিল করতে শুরু করেছিল। থার্ড ইয়ারের পর ঈশানীর বিচ্ছিরিভাবে ল্যাং মারা, ঈশানীর বড়লোক কয়লাখনির মালিক বাপের বদমায়েশি করে ধ্রুবর রমরম করে চলতে থাকা সাধের কোচিং সেন্টারটাকে তুলে দেওয়া, ধ্রুবর বাবার ছোট দোকানটার পেছনে লাগা, বাবাকে রাস্তায় অপমান, বাবার হার্ট অ্যাটাক আরো অনেক কিছু! আর শালা সেদিনের ঠিকমতো ইন্টিগ্রেশন ক্যালকুলাসও করতে না-পারা অমিত এখন ওকে জ্ঞান দিচ্ছে! কেন যে ও এল!
দারুণ সংযম করে মাথার দু-পাশের দপদপ করতে থাকা রগদুটোকে দমিয়ে রেখে ধ্রুব চার অক্ষরের একটা গালাগাল দিয়ে উত্তর দিয়েছিল, ”তুই এসব বললে আমি কিন্তু কাটব!”
অমিত সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ঝুঁকে পড়ে হেসে বলেছিল, ”আচ্ছা ছাড় এসব। এই ট্যাংরার রেস্ট্যুরেন্টগুলোয় আগে কখনো এসেছিস তুই?”
ধ্রুব দু-পাশে মাথা নেড়েছিল। কোকওভেন কলোনির হাতকাটা ডেভিডদা একবার অনেক টাকার লাভ হতে কি একটা রেস্ট্যুরেন্টে খাইয়েছিল, সে তো বাইপাসের ধারে। এদিকটায় ও আসেনি।
অমিত সোৎসাহে ওয়েটারকে ডেকেছিল, ”একটা জিনিস অর্ডার করি দাঁড়া, এখানকার এক্সক্ল্যুসিভ!”
মিনিট পাঁচেক বাদে একটা সুন্দর পটে করে ওয়েটার যে জিনিসটা নিয়ে এসেছিল, সেটা আর কিছুই না, দুটো মোটা সোটা একধরনের বাদামি রঙের শক্ত বিস্কুট।
ধ্রুব জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে তাকাতে অমিত বলেছিল, ”এটা হল ফরচুন কুকিজ। এখানকার চিনা রেস্ট্যুরেন্টগুলোয় পাওয়া যায়।” তারপর একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে দিয়েছিল, ”এটাকে দু-হাতে করে ভেঙে দু-ভাগ কর।”
ধ্রুব হাতে নিয়ে দু-হাতে বিস্কুটটার মাঝামাঝি চাপ দিতে ভেতর থেকে একটা শক্ত খয়েরি রঙের কাগজ উঁকি মারছিল। ততক্ষণে অমিত নিজেরটা খুলে ফেলেছে, ”চাইনিজ থিয়োরি অনুযায়ী এই কাগজটার মধ্যে তোর ভাগ্য সম্পর্কে কিছু একটা লেখা থাকে যেটা ফলবেই, বুঝলি! কি লেখা আছে ওটায় দ্যাখ।” বলতে বলতেই অমিত নিজেরটা ভেঙে ভাঁজ করা কাগজটা খুলল। খুলেই ওর চোখমুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। ধ্রুব উঁকি মেরে দেখল, শক্ত তুলোট কাগজটার মাঝ বরাবর ছোট ছোট ইংরেজি অক্ষরে লেখা আছে, ”যাকে ভালোবেসেছ, তাকে খুব শিগগিরই সারাজীবনের জন্য কাছে পাবে।”
অমিতের চোখমুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করছিল, ”খুব চাপে আছি রে ভাই। থুরিয়া, মানে আমার গার্লফ্রেন্ড তামিল, ওর বাবা-মা মেনে নিচ্ছিল না প্রথমে। এখন ও অনেক করে বোঝাতে নিমরাজি হয়েছে। আমার এখান থেকে ফিরেই চেন্নাই যাওয়ার কথা। এখানে যখন লেখা আছে তখন সব ঠিকঠাকই হবে বল?”
ধ্রুব উপর-নীচে মাথা নেড়েছিল। যদিও ও এইসব কুসংস্কার এককালে উড়িয়ে দিত, আর ঈশানীর ব্যাপারটার পর থেকে কোন মেয়েকেই ও সহ্য করতে পারে না, তবু অমিতের হাবভাব দেখে ওর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হল এই ফরচুন কুকিকে।
অমিত বলল ”তোরটা খোল, দেখি কি লেখা আছে?”
বেঞ্চে বসে ভাবতে ভাবতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল ধ্রুব, হুঁশ হল কেউ একটা কাঁধে হাত রাখতে। পেছন ফিরে দ্যাখে, মা। একটু ইতস্তত করে বলল, ”অনেক রাত হয়েছে। খাবি আয়।”
ধ্রুব চকিতের জন্য মায়ের মুখের দিকে তাকাল, একরাশ সংকোচ মেশানো কিন্তু কিন্তু অভিব্যক্তি। নিজের মনেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধ্রুব। কতদিন বাদে মা এইভাবে ওর গায়ে হাত রেখে খেতে ডাকল? বছরদুয়েক তো হবেই। ধ্রুব যখন ওর পারিপার্শ্বিক মানুষজনের কাছে ধীরে ধীরে একজন অপরিচিত খারাপ লোক হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তখনই একের পর এক ঘটনায়, ধ্রুবর ব্যবহারে মা অনেক দূরে সরে গেছে। কথাই বলত না প্রায়। দিনের পর দিন মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে কম জুলুম করেছে ও।
তাই কাল রাতে ধ্রুব এসে যখন মায়ের জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে দেখে মাথা টিপে দিতে গিয়েছিল, তখন ধ্রুবর মতোই মা নিজেও খুব চমকে গিয়েছিল।
মায়ের পিছন পিছন ঘরে ঢুকে চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল ধ্রুব। ও এতদিনের দুর্ব্যবহারের পর মাত্র একবার মা-র সাথে ভালো করে কথা বলেছে, তাতেই মা গলে গেল? আর মা যদি জানত যে ওর এই ভালো হয়ে যাওয়াটা খুব সাময়িক, তাহলে? ওর আবার কালকের কথা মনে পড়ে গেল। নিজের বিস্কুটের ভেতরের কাগজটা পড়ে ও কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসেছিল। অমিতও উঠে এসে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। কাগজটার ভেতর খুদে খুদে ইংরেজি হরফে স্পষ্ট লেখা ছিল, ”তোমার হাতে আর ঠিক এক মাস আছে। সামনের মাসে এই দিনে এই সময়ে মর্গের ঠান্ডা ঘরে তুমি ঘুমিয়ে থাকবে। সব কাজ গুটিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হও।”
পুড়তে পুড়তে ছোট হয়ে আসা সিগারেটের ছ্যাঁকা আঙুলে লাগতেই ধ্রুব চমকে উঠে ফেলে দিল। ও আর সত্যি এক মাস বাঁচবে? তারপর ওর এই শরীর, মন সব বিলীন হয়ে যাবে পরম ভূতে? কেন ও জানেনা, আর কিছুতেই গাঁজাখুরি ভাবতে ইচ্ছে করছিল না ব্যাপারটা। কাল সারারাত অনেক ভেবেছে ধ্রুব। অনেক দিন তো নিজের ভেতরের কষ্টটাকে কৃত্রিম নিষ্ঠুরতা দিয়ে ঢেকে রাখল, আর যখন এক সপ্তাহই বাঁচবে, আর কোনো রাগ চেপে, নির্মম হয়ে থাকার কোন মানেই হয় না। রেল কোয়ার্টারের লোফার, মাতাল, দু-নম্বরি ধ্রুবকে শেষ ক-টা দিন লোকে নাহয় একটু ভালোবাসুক!
পরের দিন শন্টুর ফোন আসতে ধ্রুব গেল না, তার পরের দিনও না, তার পরের দিনও না। এই শহরের উত্তরদিকে মিশনারিদের ছোট্ট একটা অনাথ আশ্রম আছে, তার সাথে স্কুল। আগে ধ্রুব সপ্তাহে একদিন করে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে পড়িয়ে আসত নিজের ব্যস্ত পড়ানোর ফাঁকে। এই কয়েকদিনও তাই করবে বলে ঠিক করল। মা ওর এই আকস্মিক পরিবর্তনে খুব অবাক, ধ্রুব কতকাল বাদে এসে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকে আজকাল! কষ্টে, দুঃখে মায়ের মন মুচড়ে ওঠে, চোখ দিয়ে জল পড়ে অবিরাম। ছেলেটা তো আগে এমনই ছিল, কিছু মানুষের হিংসায়, অত্যাচারে আজ ওর এই দশা। পরম মমতায় মা হাত বুলিয়ে দেন ধ্রুবর মাথায়। ওদিকে ধ্রুব শুয়ে শুয়ে ভাবে, যে যতই ক্ষতি করুক ওর, এই ক-টা দিন আর কোনো ক্ষোভ রাখতে চায় না ও। রাতের আকাশের তারা দেখতে দেখতে ভাবছিল ধ্রুব, ঈশানীর প্রতি, ওর বাবার প্রতিও আর কোনো রাগ পুষে রাখবে না ও। ওর মতো একটা গরিব ছেলে, যে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ওদের ছোট্ট সংসারটাকে বাঁচাবার, তার এমন ক্ষতি করে কেন তারা সব শেষ করে দিল, সেই উত্তরও ও আর খুঁজবে না। দুঃখ নিয়ে মরার চেয়ে শান্তিতে মরা অনেক শান্তির।
দিনচারেক বাদে ও মিশনারি অনাথ আশ্রমটা থেকে পড়িয়ে বেরোচ্ছে, পেছন থেকে ওখানকার ফাদার ডাকলেন, ”ধ্রুব! একটু কথা আছে তোমার সাথে।”
বাড়ি এসে খেতে বসে ধ্রুব মনে মনে হেসে ফেলল। ফাদার ওর এই আকস্মিক পরিবর্তনে মায়ের মতোই খুশি। কত ছোট থেকে ওকে দেখেছেন। ভালো করে মাথায় কাঁধে হাত বুলিয়ে আজ বললেন ওদের স্কুলে একটা সাময়িক ভ্যাকেন্সি হয়েছে, ধ্রুব জয়েন করুক সেখানে। আপাতত কন্ট্রাকচুয়াল, পরে পারফরম্যান্স দেখে মেয়াদ বাড়ানো হবে। শুনে ধ্রুবর খুব মজা লাগছিল। মরে যাওয়ার আগে ভগবান ওর সব আক্ষেপ দূর করে দিতে চান নিশ্চয়ই, নাহলে যে চাকরিটার জন্য আগে ধ্রুব কত তদবির করেছিল, অথচ তখন একটাও ভ্যাকেন্সি না থাকায় ফাদার ইচ্ছে থাকলেও কিছু করতে পারেননি, সেটা আজ নিজে থেকেই চলে এল কি করে! ও-ও তাই মরে যাওয়ার আগে ভাল হয়েই মরতে চায়, আর একান্তই এই ভবিষ্যদবাণী না মিললে আবার ব্যাক টু আগের লাইফ।
ল্যাংড়া শন্টু আর ফোন করে না। পঞ্চাও অনেকবার ডাকাডাকি করে বিরক্ত হয়ে চলে গেছে। সবাইকে ও বলে দিয়েছে, ”সামনের মাসের সতেরো তারিখের পর।” ধ্রুব সকাল থেকে বিকেল অবধি ওই হোমের বাচ্চাদের সাথেই কাটায়। বাড়ি এসে মায়ের সাথে একটু গল্পগুজব, তারপর পাশের ঝুপড়ির দুটো বাচ্চা পড়তে আসে। বাচ্চাদের সাথে সময়টা বেশ ভালোই কেটে যায় ওর।
এর মাঝে বার চারেক সিঁড়ির মুখে শ্রেয়সীর সাথে ওর মুখোমুখি দেখা হয়েছে। ধ্রুব হেসে জায়গা করে দিয়েছে যাওয়ার। আজ শ্রেয়সীও চোখাচোখি হতে অল্প হাসল, বলল, ”ভালো আছেন?”
ধ্রুব স্কুলে যাচ্ছিল। এই ক-দিনের জন্য আর জয়েন করবে না ভেবেও শেষ পর্যন্ত করেই নিল। এই ক-টাদিন তো আনন্দে কাটবে। তারপর সব অভিনয়েরই ইতি। বলল, ”হ্যাঁ। ওই …… সেন্ট অ্যালয়সিয়াস হোমে পড়াই, সেখানেই যাচ্ছি।”
স্কুলে পৌঁছে ধ্রুবর মনে হল, শ্রেয়সী অনেক আগে ওকে ‘তুমি’ বলত, এখন ‘আপনি’ করে কথা বলল। দূরত্ব, আর কিছুই না। ও ভাবল, এই মেয়েটাও তো ওর মতো গরিব, কত স্ট্রাগল করে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছে, কই, ওর মতো খারাপ হয়ে যায়নি তো! সমাজে দুর্বলের ওপর সবলের শোষণ চলবেই, তাই বলে নিজেকে নষ্ট করে দেওয়ার কোনো যুক্তি আছে কি?
অমিত মাঝে একবার ফোন করেছিল মুম্বাই থেকে, ”ভাই, ঠিক আছিস তো?”
ধ্রুব উত্তর দিয়েছিল, ”হ্যাঁ ওই আর কি! আর তো মাত্র এক সপ্তাহ!”
অমিত বলেছিল, ”ধুস, তুই এখনো ওসব ফালতু জিনিস মনে রেখেছিস? তুই না সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিলি?”
গাঁজাখুরির ব্যাপারটা ধ্রুবরও আগে বহুবার মনে হয়েছে, কিন্তু কেন জানিনা ওর অবচেতন মন বলছে এটা সত্যি হবেই। আর বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার বাইরেও এখনো অনেক কিছু আছে পৃথিবীতে যেগুলোর এখনো কোনো ব্যাখ্যা নেই।
এক মাস পূর্ণ হবার দিন ও তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে ফিরে এল। মা-কে জড়িয়ে ধরল কিছুক্ষণ, তারপর বাচাদুটোকে নিয়ে বাইরে গিয়ে খেয়ে এল। ফেরার সময় শ্রেয়সীর সাথে দেখা। সংসারের জোয়াল টানতে টানতে মেয়েটার চোখমুখ কোটরগত প্রায়। হাতে ঢাউস একটা ব্যাগ।
ধ্রুবর হঠাৎ মনে হল, সব মেয়েরাই ঈশানীর মতো, এটা ভাবাটা খুব বোকামো। কেউ কেউ শ্রেয়সীর মতোও হয় মনে হয়! ও কি বলবে বুঝতে না পেরে বাচ্চাদুটোকে দেখিয়ে বলল, ”এই এদের নিয়ে একটু খেতে গেছিলাম বাইরে।”
ধ্রুবর বলার ধরনে শ্রেয়সী হেসে ফেলল। তারপর ওর শার্টের দিকে আঙুল তুলে মৃদুস্বরে বলল, ”বুঝতে পেরেছি। আপ…তোমার জামায় চাউমিন লেগে আছে ধ্রুবদা। মুছে নাও।”
বাড়িতে এসে ধ্রুবর হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। আজ রাতটাই ওর জীবনে শেষ, অথচ শেষের ক-টা দিন ও এই বড়োলোকের পা-চাটা নিষ্ঠুর পৃথিবীটাকে বড় ভালোবেসে ফেলেছে। যখন পায়ের তলা থেকে একে একে মাটি সরে যাচ্ছিল আগে, কতবার তখন সুইসাইড করতে গেছিল, অথচ এখন খুব কান্না পাচ্ছে।
চুপচাপ খেয়ে উঠে ও শুয়ে পড়ল। ফরচুন কুকি অনুযায়ী কাল সকাল দশটায় ও মর্গে থাকবে। এটা ভাবতেই চোখের দু-পাশ থেকে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ওর।
পরদিন ওর বেশ দেরি করে ঘুম ভাঙল। উঠে ও বেশ অবাক হয়ে গেল। এখনও ও মারা যায়নি, দিব্যি বেঁচে আছে। তার মানে আর এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যেই যা হওয়ার হয়ে যাবে। সাদা চোখে ধ্রুব বাইরের বারান্দায় গিয়ে বসে রইল।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মা বারকয়েক ডেকে গেছে, ও খায়নি, ওঠেওনি। দূরে সন্ধ্যের শঙ্খধ্বনি বাজতে ও বুঝল ফরচুন কুকির ভবিষ্যদবাণী মিলবে না আর। কথাটা মনে হতেই ওর মাথা থেকে যেন একটা মস্ত ভার নেমে গেল। নাহ! আর ওকে এই ভালো সেজে থাকতে হবে না। আবার ও যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কাল সকাল হলেই ও পঞ্চার সাথে শন্টুর বাড়ির দিকে রওনা দেবে, কতদিন হয়ে গেল ওদিকের কোনো খবর পায়নি।
পরদিন সকালে ওর ঘুম ভাঙল দরজার খটখট শব্দে। ঘুমজড়ানো চোখে মা ঘুমোচ্ছে দেখে ও দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল। শ্রেয়সী। এতদিনের এক বাড়ির বাসিন্দা হয়েও এই প্রথম শ্রেয়সী ওদের বাড়িতে এল। ধ্রুব অবাক হয়ে বলল, ”তুমি?”
শ্রেয়সী চাপা গলায় বলল, ”কাল আমার জন্মদিন ছিল। তাই পায়েস দিতে এলাম।” তারপর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ নামিয়ে বলল, ”বলছিলাম, আ-আমি অঙ্কে খুব কাঁচা। তাই চাকরির পরীক্ষাগুলোয় ঠিক সুবিধে করতে পারছি না। তু-তুমি আমায় একটু দেখিয়ে দেবে? আমি তোমায় তাহলে ইংলিশ আর জিকে-টা দেখাতে পারি। তাহলে দুজনেরই সুবিধা হবে।”
ধ্রুব ওর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল। আজ সকাল থেকে তো ওর আর অভিনয় করার কথা নয়, ব্যাক টু আগের লাইফ হওয়ার কথা। তবে? আজেবাজে বলে মেয়েটাকে দূর করে দেবে?
কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের জন্য ধ্রুবর মনে হল, নাহ! এই অভিনয়টাই তো ভালো লাগছে। এই ভালো থাকার, ভালো হওয়ার অভিনয়টা করতে করতে ও যেন কেমন সত্যিই ভালো থাকতে শুরু করেছে। আর কে বলে ভগবান সুযোগ দেন না? এই তো ওর সামনে সুযোগ এসেছে, ভালো হওয়ার, মানুষ হওয়ার। আরো একবার সুযোগ এসেছে, সম্ভবত এই শেষ সুযোগ।
জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করল ধ্রুব, তারপর এগিয়ে গিয়ে শ্রেয়সীর হাতটা ধরে ও আলগা চাপ দিল, বলল, ”কাল আমারও জন্মদিন ছিল, অন্যরকম একটা জন্মদিন শ্রেয়সী। চল আমরা দুজনেই একসাথে নতুন করে বাঁচি।”
দশ মিনিট বাদে শ্রেয়সী নিজেদের ঘরে পৌঁছে আলতো করে চোখের জল মুছল, তারপর একটা ছোট্ট মেসেজ করল, ”থ্যাঙ্ক ইউ অমিতদা!”
**********