নিউটাউনের টোটোওয়ালা

নিউটাউনের টোটোওয়ালা

প্রদীপ্ত দিব্যি টেকনোপলিস থেকে হোম টাউন পেরিয়ে আরেকটু নারকেলবাগানের দিকে এগিয়ে ডান দিকে টার্ন নিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আলো-আঁধারিতে আজকেও মেয়েটাকে চোখে পড়ে গেল। সেই সেদিনের মতোই। কি একটা ঝ্যালঝেলে ধরণের কালো জামা পড়ে অল্প ঝুঁকে ওড়নাটাকে গলায় পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে সস্তা ব্যাগ, গলায় ঝুটো পাথরের মালাটা চকচক করছে। চোখের নীচের কাজল ধেবড়ে গিয়ে কালো বলে ভ্রম হয় এই ষ্ট্রিটলাইটের ঝকমকে আলোতেও।

প্রদীপ্ত দূর থেকেই চোখ সরু করে সেদিনের মত কোনো গাড়ি আছে কিনা দেখতে চেষ্টা করলেন। নাহ, কেউ কোথাও নেই। এমনিতেই এই নিউটাউনের গলিগুলো সন্ধে নামতে না নামতেই শুনশান হয়ে যায়, তারপর এখন তো শীতের রাতের সাড়ে ন-টা। মাইলখানেক দূরের আইটি কোম্পানির ছেলেমেয়েগুলো শুধু বড় রাস্তার মোড়গুলোতে শাটল বা বাস ধরার অপেক্ষায় এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে থাকে ক্লান্ত শরীরে ঢাউস ব্যাগ পিঠে। কতদিন একজন দুজনকে একটু এগিয়ে দিয়ে শাটল ধরতে হেল্প করেছেন প্রদীপ্ত। দু-একটা ছেলেমেয়ের কাছে এখন বেশ মুখচেনাও হয়ে গেছেন।

অবশ্য কলকাতার উপকণ্ঠের র‌্যাপিড গতিতে বেড়ে ওঠা এই নিউটাউনে প্রদীপ্ত এখন খুব ছোটখাটো লেভেলের সেলিব্রিটিই বলা চলে! বিশেষ করে এই পনেরোই আগস্ট নিউটাউন থানা সংবর্ধনা দেওয়ার পর। আরতিও বেশ গর্ব করেন তাঁর স্বামী রত্নটিকে নিয়ে ইদানীং, খেয়াল করেছেন প্রদীপ্ত। অথচ এই আরতিই না সেদিন কি বাধা দিয়েছিলেন, মনে পড়লেই নিজের মনেই হাসেন প্রদীপ্ত।

অবশ্য তার জন্য আরতিকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। স্টেট ব্যাঙ্কের পুরো ইস্টার্ন রিজিওনের জেনারেল ম্যানেজার হয়ে বছর দুয়েক হল রিটায়ার করেছেন প্রদীপ্ত। ছাত্রজীবনে ঝকঝকে স্টুডেন্ট ছিলেন, বাইশ বছরের সদ্য কলেজ পাশ করা তরুণ হয়ে যোগ দিয়েছিলেন স্টেট ব্যাংকে, তাও আবার ডাইরেক্ট অফিসার হয়ে। তখনকার দিনে বাঙালি ছেলে ডিরেক্ট অফিসার হয়ে ব্যাংকে ঢুকছে শোনাই যেত না, অধিকাংশই ঢুকতো কেরানি হয়ে। নিজের মেধা আর কর্মদক্ষতার জোরে প্রায় উল্কার গতিতে উঠেছেন অফিসের সিঁড়ি বেয়ে, ঘুরেছেন কত দেশ-বিদেশ, সরকারের বহু হাই লেভেল কমিটিতে মেম্বার হয়ে নিয়েছেন বহু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, সেই দুঁদে কর্মকর্তা হয়ে প্রদীপ্ত এখন যদি রিটায়ারের পর এক লাখ সাড়ে উনিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা টোটো গাড়ি কিনে নিউটাউনের পথে পথে চালিয়ে বেড়ান, তাতে আরতি কেন, অনেক স্ত্রীই তুমুল আপত্তি করবে।

কিন্তু প্রদীপ্তর নিজের ওই সমস্ত তথাকথিত উঁচু কাজ নীচু কাজের সোশ্যাল ট্যাবু একেবারেই নেই। ব্যাংকের মার্কিন অপারেশানস সামলাতে বেশ কয়েক বছর ছিলেন আমেরিকায়, ওখানকার কালচার বেশ পছন্দ প্রদীপ্তর, খেয়াল করে দেখেছেন ওখানে কোনো কাজই ছোট মনে করা হয় না। হার্ভার্ড-এর মতো বিশ্বসেরা ইউনিভার্সিটির টপার ফ্রি টাইমে কোনো হেসিটেশান ছাড়াই পিজ্জা ডেলিভারি বয়ের কাজ করে কিংবা পিএইচডি করা মেয়েটা কোনো আইসক্রিম পার্লারে। মেয়ের কাছে কানাডা গিয়েও একই জিনিস দেখেছেন, বা জার্মান জামাইয়ের জার্মানির বাড়িতে গিয়েও এর কোনো ব্যতিক্রম দেখেননি তিনি। এসব দেখেটেখে তাঁর মনে হয়েছে, প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে এসব নিয়ে মানুষের কোনো ছুঁৎমার্গ নেই, যত সংস্কার এই উন্নয়নশীল দেশে।

আর তাছাড়া প্রদীপ্ত তো আর রোজগার করার জন্য টোটোটা কেনেননি! চেতলায় পৈত্রিক বাড়ি ছিল, সে বাড়ি মেরামতির অভাবে আর হাজার শরিকের খেয়োখেয়িতে এখন ভগ্নপ্রায়, আর কাজের সুবাদে সারাটা জীবন ঘুরে বেড়ানোয় কোথাও আর থিতু হওয়া হয়নি। তাই রিটায়ারমেন্টের বছরখানেক আগে যখন একটা স্থায়ী বাসস্থান খোঁজার দরকার পড়ল, নিউটাউনে নামি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কমপ্লেক্স তৈরির বিজ্ঞাপন দেখে সাত-পাঁচ না ভেবে তখন বুক করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, কলকাতার পলিউশান আর ব্যস্ততা থেকে একটু দূরেও থাকা যাবে, আবার নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলোও পাওয়া যাবে বেশ। প্রথম প্রথম আসার পর ভালোই লেগেছিল, একটু গাড়ি নিয়ে এগোলেই শপিং মলও আছে, আবার ইকো ট্যুরিজম পার্কের মতো ঘোরার জায়গাও আছে, তার সাথে রবীন্দ্র তীর্থ, নজরুল তীর্থের মতো সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ। এছাড়া বেশ ফাঁকাফাঁকা অঞ্চল, দূরের বড় রাস্তা দিয়ে বাস ছুটে চলে।

কিন্তু মাস কয়েক কাটার পর আরতি একদিন বলেই ফেললেন, ”কি ভূতুড়ে জায়গায় যে বেছে বেছে ফ্ল্যাট কিনলে তুমি! বাজারটা নাহয় তুমি গাড়ি করে এনে দাও, বাকি সারাটা দিন কোনো লোক নেই! একটা মাছ ওলা নয়, একটা সেলসম্যান নয়, ধুর! ভালো লাগে নাকি! হাঁটাপথে কিছুই নেই। টুকটাক কিছু দরকার হলেও তোমাকে যদি গাড়ি বের করতে হয়, তাহলে তো মুশকিল! এত বড় এরিয়া, আর দুটো মোটে রিকশা চলে। না অটো, না কিছু। বুড়োবুড়িতে থাকি, কেউ এসে গলা কেটে রেখে গেলেও আশপাশের কেউ টের পাবে না!”

প্রদীপ্তও মনে মনে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলেন, তবু নিজের ভেতরের উষ্মা প্রকাশ না করে আরতিকে বুঝিয়েছিলেন, ”আরে, নতুন এরিয়া! একটু ডেভেলপ হতে সময় লাগবে না? বাষট্টি সালে তোমার বাবা যখন তোমাদের ওই সল্টলেকের বাড়ির জমিটা কিনেছিলেন, তখন তো ওইসব জায়গা পুরো জলা ছিল! রাতবিরেতে শিয়াল ডাকতো রীতিমতো! আর এখন? তোমার ভাইকে জিগ্যেস করো ও-বাড়ির দাম দশ কোটির ওপরে! আর কি নেই ওখানে! একটু টাইম তো লাগবেই!”

আরতি একটুও কনভিন্সড না হয়ে প্রদীপ্তকে দাবড়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন, ”তুমি থামো তো! আমার বাবা না হয় জানত যে ভাই সুবিধাটা একসময় ভোগ করবে। আমাদের কে করবে শুনি? তোমার মেয়ে কি কানাডার সিটিজেনশিপ এমনি এমনি নিল? না তোমার জার্মান জামাই এই নিউটাউনে এসে থাকবে! তোমার ওই চেতলার বাড়ির মতো আমাদের এই ফ্ল্যাটও একদিন খসে খসে পড়বে। তার চেয়ে নিজেরা ভালো জায়গায় থাকলেই হত! কতবার তখন বলেছিলাম দমদমের দিকে দ্যাখো, দেখলে না। অবশ্য আমার মতামতের মূল্য আর কোনোদিন দিয়েছ তুমি!”

মেয়েটার কাছাকাছি আসতেই প্রদীপ্তর সঙ্গে মেয়েটার চোখাচোখি হল, মেয়েটা ফ্যাকাসে হেসে একটু ইতস্তত করে বলল, ”অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, রিকশাগুলো যে কোথায় গেল!”

অন্য কেউ হলে প্রদীপ্ত এত কথা বলতে দিতেন না। দশ-পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে আলাপ সেরে নিয়েই উঠিয়ে নিতেন টোটোয়, তারপর গল্প করতে করতে ছেড়ে দিয়ে আসতেন বাড়িতে। এই তো সর্বসাকুল্যে ছ-সাতটা গলি। ঝোঁকের মাথায় বছরখানেক আগে টোটোটা কিনে এনেছিলেন চিনার পার্কের একটা দোকান থেকে, ভেবেছিলেন টুকটাক বাজার দোকান তো করবেনই, রাস্তায় যে যখন লিফট চাইবে, পৌঁছে দেবেন আনন্দের সাথে। এই চত্বরে নয় নয় করেও একশো-র কাছাকাছি অ্যাপার্টমেন্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তাদের কতরকমের মানুষ। সকালের বাজার সেরে আসার পর বেশ কিছুটা দূরের একটা ক্লাবে তাস, দাবা এইসব খেলতে যান প্রদীপ্ত। ফেরার পথে যাকে পান তাকেই পৌঁছে দেন গন্তব্যে। পাঁচ-দশ মিনিটের যাত্রাপথে স্বল্প আলাপ, তাতেই বড় আনন্দ পান প্রদীপ্ত। সারাজীবন রোজগার তো দু-হাতে করলেন, এই বয়সে এসে টোটো চালিয়ে বড় তৃপ্তি হয়। প্রথমে কেউ কেউ ভুল করে, টোটো থেকে নেমেই বাড়িয়ে দেয় দশ টাকার নোট, প্রদীপ্ত সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেন এটা তাঁর শখ মাত্র। প্রথম প্রথম আরতি খুব রাগ করতেন, আশপাশের সবাই হাসাহাসি করে, তাছাড়া কি রাত অবধি এই পলকা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, বুড়ো বয়সে কি ভীমরতি ধরল নাকি!

তবে মাস তিনেক আগে হঠাৎ একটা অ্যাকসিডেন্টে রাস্তার পাশে কাতরানো একটা ছেলেকে যখন নিয়ে গিয়েছিলেন হসপিট্যালে, তখন থেকে এই ছোট্ট জায়গায় বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছেন প্রদীপ্ত। ধবধবে সাদা ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি পরে দামি রিমলেস চশমার অভিজাত চেহারার প্রদীপ্তকে টোটো নিয়ে আসতে দেখলেই সামনের ডিপিএস স্কুলের খুদেগুলো চেঁচিয়ে ওঠে, ”ওই তো টোটোদাদু! দাদু, আজ কিন্তু আমি তোমার পাশে বসব, কাল মা বসতে দেয়নি সামনে, মা-কে আজ একটু বকে দাও না দাদু!” বাচ্চাদের মায়েরা কপট রাগ করে বলে, ”না জেঠু ওর বায়না শুনবেন না তো, কালও বাড়ি গিয়ে কেশেছে।” প্রদীপ্ত গল্প করতে করতে পৌঁছে দেন তাদের বাসস্ট্যান্ডে।

শুধু যে নামি স্কুলের বাচ্চা নয়, যেকোনো মানুষ, সে রাস্তার হতদরিদ্র মানুষও হাঁটছে দেখে কোথায় যাবেন জিগ্যেস করে বহুদিন টোটোয় তুলে নিয়েছেন প্রদীপ্ত। কাজেই, এই মেয়েটির এত ইঙ্গিত দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।

কিন্তু তবু প্রদীপ্ত ভ্রূক্ষেপ করলেন না। মেয়েটার করুণ দৃষ্টির পাশ দিয়ে একটুও গতি না কমিয়ে টোটোটা নিয়ে সজোরে এগিয়ে গেলেন সামনের রাস্তায়। কড়া কথা শোনাবার মনস্থির করেও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালেন, তবু নিজের অজান্তেই মনটা ঘৃণায় ভরে উঠল। যত নতুন শহরতলিই হোক, এরই মধ্যে এখানে পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে এরা। এক ঝলকের জন্য মেয়েটার মুখটা মনে পড়তেই মাথাটা আরো গরম হয়ে উঠল প্রদীপ্তর। শুধু বাজে মেয়ে তাই নয়, মিথ্যেবাদীও। বলেছিল করুণাময়ীর দিকে কোন সেলাই সেন্টারে কাজ করে। সরল বিশ্বাসে কোনো সন্দেহও করেননি প্রদীপ্ত। সেদিনের ঘটনাটা না ঘটলে জানতেও পারতেন না ওর আসল পরিচয়।

কমপ্লেক্সের ভেতরে ঢুকে টোটোটাকে গ্যারাজে ঢোকাতে ঢোকাতে প্রদীপ্ত ভাবলেন, অন্তত চল্লিশ বার তো মেয়েটাকে টোটোয় করে নিয়ে এসেছেনই। তখন অনেক গল্প হত আসতে আসতে। প্রদীপ্তরও একটা অলিখিত ডিউটি হয়ে গিয়েছিল পৌনে দশটা নাগাদ একবার ওই স্ট্যান্ডটা চক্কর মেরে আসা। মনে হতো আহা, বাচ্চা মেয়ে! এই রাতে এতটা রাস্তা একা একা ফিরবে? কতই বা বয়স, বড়জোর সাতাশ আঠাশ, প্রদীপ্তর নিজের মেয়ে চাঁদনীর থেকে ছোটই হবে। এই বয়সে কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে।

মেয়েটাও আসতে আসতে অনেক গল্প করত, ওর বাড়িতে ছোট ছেলে আছে, স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করত, কিন্তু রঙ করতে গিয়ে মাচা থেকে পড়ে গিয়ে চার মাস হল বিছানায়। এখন ঘরে থেকে থেকে মেজাজ খিটখিটে আর সন্দেহ দিনরাত। কোন ভোরে উঠে রান্না করে বাড়ির বাকি সব কাজ সেরে আসতে হয়, ছোট ছেলেটা মা না আসা অবধি জেগে বসে থাকে, এইসব টুকটাক দুঃখের কথা। অনুযোগের সুরে পেছন থেকে বলত মেয়েটা, ”এত দুরন্ত না আমার ছেলেটা কাকু, ওর বাবা তো শুয়ে থাকে, আমি আসতে দেরি করলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, আর এখানে ফাঁকা রোডে যা জোরে জোরে গাড়ি যায়, আমার যে কি ভয় আগে সারাদিন!” বকতে বকতে প্রদীপ্তদের মতো ঝাঁ চকচকে কমপ্লেক্সের আশপাশে উলু খাগড়ার মতো গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট বস্তিগুলো এলেই একটা ঘুপচি ঘরের সামনে নিঃসাড়ে নেমে যেত মেয়েটা।

গত পরশু প্রদীপ্ত শরীরটা ভাল না থাকতেও টোটো নিয়ে গিয়েছিলেন, নেহাত কর্তব্যবোধের তাগিদে। আরতি বারণ করেছিল, ”আহা, আজ যখন চলেই এসেছ, আবার এই ঠান্ডায় বেরচ্ছ কেন?” প্রদীপ্ত শোনেননি। অন্যদিন পৌঁছোবার আগে থেকেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু সেদিন গিয়ে দেখতে পাননি।

মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসবেন বলে সবে টোটোটা সবে ঘুরিয়েছেন, হঠাৎ একটা গাড়ির কর্কশ ব্রেক কষার আওয়াজে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন, সেই মেয়েটা গাড়ি থেকে নামছে। নামছে বলা ভুল, কয়েকজন মিলে তাকে জোর করে নামিয়ে রাস্তায় একরকম ঠেলে ফেলেই দিচ্ছে। মেয়েটা চিৎকার করে কি বলছে শোনার আগেই হিতাহিতজ্ঞান ভুলে প্রদীপ্ত ছুটে গিয়েছিলেন গাড়িটার দিকে, ঘটে যাওয়া কোনো সাংঘাতিক বিপদের কথা আঁচ করে।

গাড়ির সামনের কাচে গিয়ে দুমদুম করে ধাক্কা মেরে চিৎকার করেছিলেন, ”এত সাহস তোদের! শিগগির গাড়ি থামা!” আলোর চেয়েও বেশি স্পীডে পরবর্তী প্ল্যান মনে মনে ছকেও ফেলেছিলেন, গাড়ির নম্বরটা একঝলক দেখে নিয়ে মনের মধ্যে মুখস্থ করছিলেন আপ্রাণ। এমনিতেই ছোটবেলার বন্ধু সন্দীপন এখন লালবাজারের বড় কর্তা, তার ওপর নিউটাউন থানার ওসিও এখন প্রদীপ্তকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন।

কিন্তু প্রদীপ্তর সব প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে গাড়ির সামনের কাচ নেমে এসেছিল, আর ভেসে এসেছিল কদর্য হাসির সাথে কিছু অশ্রাব্য মাতাল গালিগালাজ, ”এ বুড়োটা আবার কে বে? দালাল নাকি? দেখে তো মনে হয় না, পার্ট টাইম দালালি করে নাকি? ওই তো হাজার টাকার মাল, তারও আবার দালাল আছে বাওয়া?”

প্রদীপ্ত রাগে উন্মত্ত হয়ে কি বলতে যাচ্ছিলেন, মেয়েটা পেছন থেকে ছুটে এসে চিৎকার করছিল, ”পনেরশো টাকায় কথা হয়েছিল, আর পাঁচশো টাকা দিন আমায়, প্লিজ আর পাঁচশো টাকা দিয়ে যান!” চিৎকার করতে করতে মেয়েটার গলা ভেঙে যাচ্ছিল, গালের দু-পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামছিল চোখের জল, তবু গাড়ির সামনের কাচ ছাড়ছিল না সে। কিছুটা ঘষটে ঘষটে সঙ্গে যাওয়ার পর গাড়ির ভেতর থেকে নোংরা গালাগালির সঙ্গে ছুড়ে এসেছিল এক দলা থুতু, তারপর স্পিড বাড়িয়ে গাড়িটা হাওয়া হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে।

গোটা ঘটনাটা মনে পড়লেই প্রদীপ্তর রাগে আর ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠে। এতদিনের আলাপে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি মেয়েটার আসল পেশা। আর কতটা নির্লজ্জ দ্যাখো, তার পরেও আজকে আবার কথা বলছে দাঁত বার করে। ছি!

হাতমুখ ধুয়ে লিভিং রুমে এসে বসতে আরতি টিভির সুইচটা বন্ধ করলেন, ”হল তোমার নাইট ডিউটি? খেতে দেব?”

মেয়েটার কথা আগে আরতিকে গল্প এত করতেন প্রদীপ্ত যে, সেদিনের কথাটা আর লজ্জায় বলতে পারেননি। গম্ভীর মুখে দায়সারাভাবে মাথা নেড়ে প্রদীপ্ত জিগ্যেস করলেন, ”আগে এক কাপ চা দাও তো! একটু পরে খাবো। চাঁদনী ফোন করেছিলো?”

আরতি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে নিয়ে এসে টেবিলে রাখলেন, ”হ্যাঁ, আজ এক কাণ্ড করেছে তোমার নাতি, জানো!”

প্রদীপ্ত বললেন, ”আবার কি করলো? রোজই তো কিছু না কিছু করছে সে!”

আরতি বললেন, ”হ্যাঁ। আজ চাঁদনীর অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়েছে, ম্যাক্স তো এমনিই ফেরে অনেক রাত করে, বাবুই যে গুজরাটি বৌটার কাছে থাকে, সে নাকি টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর বাবুই একা একা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়েছে।”

প্রদীপ্ত শুনতে শুনতে সোজা হয়ে বসলেন, ”সেকি, ওদের বাড়ির বাইরেই তো বড় রাস্তা! তারপর?”

আরতি চায়ের কাপটা এগিয়ে ধরলেন, ”তারপর সে কি কাণ্ড, ওদের পাশেই যে ইজরায়েলের ফ্যামিলিটা থাকে না, তারা দেখতে পেয়ে বাবুইকে ওদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে চাঁদনীকে ফোন করেছে। ওরা তো বলছিল পুলিশে খবর দেবে, বৌটা খেয়াল রাখবে না? কিন্তু চাঁদনী আর ওসব করেনি। গুজরাটি বৌটার দোষ নেই, চাঁদনী তো বলে, এত জেদি হয়েছে ছেলেটা, চাঁদনী না থাকলে কিছুতেই নাকি খাবে না, বৌটা তাও অনেক চেষ্টা করে, তার ওপর ভাষা তো একদমই বোঝে না বৌটা। … আমি তাই ভয়ে মরছি, কি অঘটনই না হতে পারত আজ! মেয়েটার গলাটা কি কাঁপছে ফোনে! বলছে মা, তুমি কলকাতার কাউকে পাঠাও আর নয়তো নিজে এসো। তুমি একবার চা-টা খেয়ে নিয়ে ফোন করো তো!”

প্রদীপ্ত চায়ের কাপে চুমুক দিয়েও আস্তে আস্তে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। ওঁর মাথার ভেতরটা কেমন ঘুরে উঠল। আরতির চায়ের হাত খুব ভালো, তা সত্ত্বেও চা-টা কেমন বিস্বাদ ঠেকল হঠাৎ। আচ্ছা, ওই মেয়েটার ছেলেটাও তো নিশ্চয়ই মা না এলে এরকমভাবেই না খেয়ে বসে থাকে, এরকমভাবেই ওই অন্ধকার ঘুপচি ঘর থেকে বেরিয়ে খুঁজতে যায় তার মা-কে, তাই না? বিদ্যুৎ চমকের মতো প্রদীপ্তর হঠাৎ মনে হল, নামি কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া কানাডায় বিশাল চাকরি করা চাঁদনীও যেমন মা, স্বামী আর ছেলেটার মুখে দুবেলা খাবার তুলে দেওয়ার জন্য নিজের শরীর বিক্রি করে পয়সা রোজগার করা এই মেয়েটাও তেমনই একজন মা। আজ চাঁদনী তাঁর ঘরে জন্মেছিল বলে ওখানে, ভাগ্যের ফেরে যদি আজ উল্টোটা হত? চাঁদনীকে যদি আজ এভাবে রোজগার করতে হত সংসার আর ছোট্ট ছেলেটার জন্য? আসল দোষ তো এই পচা গলা মৃতদেহ হয়ে যাওয়া সমাজের, যারা এদের পেটে ভাত জোগানোর দায়িত্ব হেলায় উপেক্ষা করে ঠেলে দেয় এই পাঁকের জগতে।

প্রদীপ্ত আর ভাবতে পারলেন না, মেয়েটা এখন নিশ্চয়ই ফাঁকা নিউটাউনের গলি ধরে অবসন্ন দেহে টলোমলো পায়ে ফিরছে বাড়ি? আর তার সেই ছোট্ট ছেলেটা? সে কি বাড়িতে আছে? না বেরিয়ে পড়েছে মা-কে খুঁজতে?

প্রদীপ্ত আর দেরি করলেন না। মাফলারটা গলায় বেঁধে বেরোতে বেরোতে বললেন, ”আসছি এক্ষুনি।”

আরতি অবাক হয়ে বললেন, ”এই তো এলে! আবার কোথায় যাচ্ছ?”

প্রদীপ্ত সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন, ”ওই যে মেয়েটার কথা বলেছিলাম না, চাঁদনীরই বয়সি, ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরছি এক্ষুনি। তুমি খাবার রেডি করো। আর হ্যাঁ, চাঁদনীকে জিগ্যেস করো তো, একটা মেয়ে আছে ভালো, তারও ছোট ছেলে, ওকে পাঠালে চাঁদনীর বাচ্চাটাকে দেখভাল করতে সুবিধে হবে কিনা?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *