পমপমের ইন্টারভিউ
ছোট্ট পমপমের জীবনে আজ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। এতদিন সে প্লে স্কুলে পড়ে এসেছে, টিফিন বাক্স আর জলের বোতল নিয়ে রঙচঙে পোশাক পড়ে দাদুর কোলে চেপে স্কুলে যেত, সারাদিন খালি খেলত, কত্তরকম খেলা আর মিস খুব সুন্দর সুন্দর গল্প বলে শোনাতেন। বরং শনি রবিবার এলেই ওর মন খারাপ হয়ে যেত বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে না বলে।
একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও, এবার থেকে আর কোনোদিনই ওদের সাথে মনে হয় দেখা হবে না। ও যে বড় হয়ে গেছে, ফোর প্লাস হয়ে গেল, তাই বড়দের স্কুলে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে।
পৌঁছে ও হাঁ হয়ে গেল, এতবড় স্কুল! বিশাল মাঠ দেখে ওর মনটা খুশিতে ভরে গেল, তার পাশে ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট, এমনকি সুইমিং পুলও রয়েছে! ও অবাক হয়ে মা-কে জিগ্যেস করলো, ”মা, এখানে তো আরো বেশি করে খেলা যাবে, তাই না?”
মা আদর করে ওর গাল টিপে দিলেন, ”হ্যাঁ পমপম। কিন্তু, তার আগে তো তোমায় আগে সিলেক্টেড হতে হবে এখানে, বল! যা যা শিখিয়েছি, সব মনে আছে তো তোমার? আগের মতো হবে না তো? এরা কিন্তু আজ দুপুরের মধ্যেই রেজাল্ট ডিক্লেয়ার করে দেবে, আর সিলেক্টেড হলেই প্লে-স্টেশন।”
বাবা-মা দুজনেই আজ ওর জন্য অফিস ছুটি নিয়েছেন, আজ ওর সঙ্গে ওর বাবামায়েরও ইন্টারভিউ হবে। মা তো গত এক সপ্তাহ ধরে পড়িয়ে যাচ্ছেন ওকে, আমাদের দেশের নাম কি, ন্যাশনাল অ্যানিম্যাল কি, ওর ফেভারিট রঙ কি, সেই রঙ দিয়ে পাঁচটা ফুল, পাঁচটা ফল, এরকম প্রচুর প্রশ্ন।
আগের নামকরা স্কুলটায় অল্পের জন্য পমপম পেল না, ইংরেজির সবই ঠিকঠাক উত্তর দিয়েছিল, শেষে বাংলার টেস্টে যখন ওই রাগী মিস ওকে নিরামিষাশী দিয়ে একটা বাক্যরচনা করতে বলেছিলেন, ও বলে ফেলেছিল, ”আমার দিদুন নিরামিষাশী প্রাণী।”
তাতে ওই মিস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন ওর দিকে, আর ও আরো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সত্যিই তো ওর দিদুন ননভেজ খায় না, ও ভুল কি বলল?
তারপর যখন ওই মিস জিগ্যেস করেছিলেন, ওর ঠাম্মি ওর দাদুর কে হয়, ও আরো নার্ভাস হয়ে ভুল করে ‘হ্যাঁগো’ হয় বলে দিয়েছিল।
চশমার ফাঁক দিয়ে গম্ভীরমুখে ওই মিস বলেছিলেন, ”একি, নর্মাল ব্লাড রিলেশনগুলো এখনো ক্লিয়ার নয় কেন?”
মা বাড়ি ফিরে খুব রেগে গেছিলেন, কিন্তু পমপম কি করবে? বাবা যেমন মা-কে নাম ধরে ডাকে, দাদু তো ঠাম্মিকে নাম ধরে ডাকে না, ‘হ্যাঁগো’ বলে ডাকে, তাই ওর চট করে মাথায় ‘ওয়াইফ’ শব্দটাই আসেনি, নাহলে কি আর ও জানে না যে হাজব্যান্ড-ওয়াইফ ওরা?
মা সব দোষ চাপিয়েছিলেন ঠাম্মি আর দাদুর ঘাড়ে। ঘরে এসে বাবাকে রেগে রেগে বলছিলেন পমপমের বেশ মনে আছে, ”সারাদিন তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে মডার্ন ম্যানারিজমগুলোই গ্রো করছে না পমপমের মধ্যে! ইশ! এত ভালো স্কুলটা… আমার কান্না পাচ্ছে!”
তাই, এবার আর মা কোনো রিস্ক নেননি। ছুটি নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে পড়িয়েছেন পমপমকে।
প্রথম রাউন্ডগুলো ভালোই কেটে গেল। জিকে টেস্ট, পাজল টেস্ট, হ্যান্ডরাইটিং পেরিয়ে সবশেষে এল ইন্টারভিউ। এবার পমপম ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পেয়ে গেলেও বাইরে শান্ত হয়ে ছিল। এবারেও কিছু গণ্ডগোল করলে মা ওকে মেরেই ফেলবেন। তার চেয়ে দাদু ওকে কত দেশবিদেশের গল্প শোনান, সেগুলো মনে করছিল ও।
এই স্যারটা ওই মিসের মতো নয়, বেশ হাসিখুশি আর মোটা গোঁফওলা, ঠিক ওর দাদুর গোঁফের মতো। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে নাম, কি করতে ভালোবাসে এসব জিগ্যেস করতে লাগলেন। মা-র পড়ানো প্রশ্নের দিকে গেলেনই না। পমপমও বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিল, গল্প করছিল টুকটাক। বাবামা-ও হাসিমুখে ওর দু-পাশে বসেছিলেন।
কিন্তু গোল বাঁধল একদম শেষে এসে। স্যার ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ”লাস্ট কোয়েশ্চেন, তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও পমপম?”
মা সঙ্গে সঙ্গে পমপমের দিকে তাকালেন, মুখে উজ্জ্বল হাসি, এই প্রশ্নটা তোতাপাখির মতো করে মুখস্থ করিয়েছেন মা পমপমকে। শুধু, ‘অ্যাস্ট্রোনট’ শব্দটা না বলে তার সঙ্গে ওর যে স্পেসের ব্যাপারে খুব ইন্টারেস্ট সেটাও জুড়ে দিতে হবে সঙ্গে, পইপই করে বলে দিয়েছেন মা।
পমপম ঢোঁক গিলল এবার।
ওদিকে দাদু সবসময় মিথ্যে বলতে বারণ করেন। কিন্তু, এটা তো পুরো মিথ্যে। পমপমের মোটেও স্পেসের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই, আর ও পাইলট হতেও চায়না যে! তার চেয়ে দাদু ওকে বড় হয়ে যেটা হতে বলেন সেটাই ও হতে চায়।
কিন্তু সত্যি বললে মা যদি রেগে যান? তবে কিনা… ও মাথা চুলকোল, দাদু তো মায়ের থেকেও বড়!
পমপম চুপ করে আছে দেখে মা খুব অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন, হাসিমুখে ধরে রেখেই ইংরেজিতে বললেন, ”বল পমপম, তুমি কি হতে চাও, বলে দাও স্যারকে ইয়োর এইম ইন লাইফ?”
পমপম একটু ইতস্তত করল, তারপর বাংলায় স্পষ্টভাবে বলল, ”আমি মানুষ হতে চাই স্যার। একজন ভালো মানুষ। সৎ, সাহসী আর ভালো মনের মানুষ।”
স্কুল থেকে বেরিয়ে ইস্তক মায়ের বকুনি শুনছিল ও, সঙ্গে বাবার কাঁচুমাচু অপরাধী মুখ। পমপমের তো কান্নাই পাচ্ছিল, প্লে-স্টেশন তো হলই না, উল্টে বাড়ির খেলনাগুলো না মা ফেলে দেন!
মা চিৎকার করে যাচ্ছিলেন, ”গিয়েই আমি পমপমকে সারাদিনের জন্য কোনো ভালো ক্রেশে দেব! এভাবে ও পুরো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইশ, অত ভালো উত্তরটা শেখালাম, ওর হাই অ্যাম্বিশানটা বোঝানো যেত, তা না করে, একটা বাজে উত্তর দিয়ে পুরো জিনিসটা… উফ, আমি আর ভাবতে পারছি না, চোখের সামনে ছেলের কেরিয়ারটা স্পয়েলড হয়ে যাচ্ছে!”
মায়ের কথা শেষ হল না, তার আগেই টুং টুং শব্দে মায়ের ফোনে ওই স্কুল থেকে ইমেল ঢুকল, অ্যাডমিশন টেস্টের রেজাল্ট ডিক্লেয়ারড।
লিস্টে পমপমের নাম সবার ওপরে। ঠিক একজন সৎ, সাহসী আর ভালো মনের মানুষের মতোই।
**********