টাইমলাইন

টাইমলাইন

পারমিতা তার সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো ভ্রূদুটোকে প্রায় ইঞ্চিখানেক উপরে তুলে কায়দা করে বলেছিল, ”হুম, ওকে! করতে পারি তোর সাথে প্রেম, বাট দুটো কন্ডিশন!”

আমি পারমিতার সেই চোখ ঘুরিয়ে কথা বলার ভঙ্গিটা মনে পড়তেই নিজের অজান্তে হেসে ফেললাম। পাশে বিমলজেঠু একটু অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। বোধ হয় ভাবল মাথা-টাথা খারাপ হল নাকি! পরক্ষণেই আমি মুখটাকে স্বাভাবিক করে অন্যদিকে ফিরিয়ে তপেশকে বললাম, ”এনরোল করেছিস?”

বিমলজেঠুর ছেলে তপেশ। ওরও মুখ চোখ উদ্ভ্রান্ত। বেচারার অনেক খাটনি গেল সকাল থেকে। তপেশ ঘাড় নাড়ল, ”হ্যাঁ। সার্টিফিকেটটা জমা দিলাম। লাইন আছে তো, একটু টাইম লাগবে। বলল তো ঘণ্টাখানেকের আগে হবে না।” তারপর আমার দিকে চকিতে তাকিয়ে বলল, ”তুই বাইরে গিয়ে বোস না। আমরা তো আছি! কিছু খাবি?”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরের লবিতে বসতে ভালো লাগল না, এখানে কেমন একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ। চুপচাপ একদম বাইরে চলে এলাম, গঙ্গার ধারে এসে ফাঁকা একটা জায়গা দেখে সিগারেট ধরালাম আলগোছে। রাত প্রায় সোয়া বারোটা। ফাঁকা রাস্তাঘাট। দূরে দেখা যাচ্ছে হাওড়া ব্রিজের আলো। কিছুটা দূরের আর্মেনিয়ান ঘাটের নৌকাগুলোর দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। গঙ্গার সুন্দর হাওয়া এসে মুখ-মন সব যেন জুড়িয়ে দিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার মনে পড়ে গেল সব কথা।

ফার্স ইয়ারের ভিতু আমি বলেছিলাম, ”কি কন্ডিশন?”

পারমিতা তার বাঁ হাতের তর্জনিটা আমার সামনে দুলিয়ে দুলিয়ে বলেছিল, ”দ্যাখ, আমাদের লাইফে যতই ঝগড়া হোক, যাই হোক, এমনকি ব্রেক আপও যদি হয়ে যায়, তুই কিন্তু ফেসবুকে ইন রিলেশনশিপ উইথ পারমিতা ব্যানার্জিই লিখে রেখে দিবি। আজীবনকাল, এমনকি তোর বিয়ে হয়ে গেলেও তুই চেঞ্জ করতে পারবি না! ডান?”

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পুরো ফিউজ হয়ে গিয়েছিলাম। যাব্বাবা! এ যে দেখি শুরুর আগেই শেষ করে দিতে চায়! আর তার ওপর প্রপোজটা তো ও-ই আমায় করেছে, আর এখন আমি রাজি হতে এ যে দেখি উলটপুরাণ! আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই নিজের দর বাড়াচ্ছে দেদার! আর কন্ডিশনটাও তো যাকে বলে মারাত্মক বিটকেল! বাই চান্স এই ছিটিয়াল মেয়েটা যদি ব্রেক আপ করেই দেয়, সারাটা জীবন তো আমায় ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে! নাহ, পারমিতার ফেসবুক প্রেমের কথা ওই ক-টাদিনের মধ্যেই সারা কলেজ জানে, কিন্তু সেটা যে এইরকম পাগলামির লেভেলে, আমার ধারণা ছিল না।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে পারমিতা খোঁচা দিয়েছিল, ”কি হল? প্রেমের বেলুন চুপসে গেল বুঝি অমনি!”

আমি মিইয়ে যাওয়া বাসি শিঙাড়ার মতো মিনমিন করে বলেছিলাম, ”না সেটা নয়। কিন্তু, ব্রেক আপের পর এরকম লিখে রেখে দিলে তো তুইও বিয়ে করতে পারবি না বল!”

পারমিতা ঠোঁট উল্টে বলেছিল, ”সেটা আমার ব্যাপার! আমি ইটারনাল ভালবাসায় বিশ্বাস করি। ডান কিনা বল!”

আমি কোনোরকমে ঘাড় নাড়তে মহারানি বলেছিলেন, ”গুড। এবার সেকেন্ড কন্ডিশন। আমার সঙ্গে যখনই ঘুরতে বেরবি, সে মুভি দেখাই হোক, বা কোথাও খাওয়াদাওয়া, বা পাঁচ মিনিটের হাঁটা, আমাকে যেন বলতে না হয়, পটাপট ছবি তুলে যাবি, আর ফেসবুকে ইনস্ট্যান্ট রোম্যান্টিক স্ট্যাটাস দিবি, যাতে সবাই বোঝে আমার বয়ফ্রেন্ড আমায় কত্ত ভালোবাসে। ডান?”

আমি তখনই বুঝে গেছিলাম, এর মাথায় বড়সড় গণ্ডগোল আছে। এতটাই বড় গণ্ডগোল যে একে ইমিডিয়েটলি কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু একইসাথে যতবার ওর দিকে তাকাচ্ছিলাম, ওর ঠোঁটের ঠিক ডানদিকের সর্ষের মতো ছোট্ট তিলটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম।

সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমি পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফেসবুক খুললাম। চার বছর প্রেম, তারপর বিয়ের পর এই সাত মাস উনিশ দিনে ওর পাল্লায় পড়ে আমাকে খুঁটিনাটি সব কিছু ফেসবুকে দিতে হয়েছে। আমি অনেকবার ওকে জিজ্ঞেস করেছি, ”আচ্ছা, কি পাস বল তো তুই দুনিয়াসুদ্ধু লোককে সবকিছু জানিয়ে? আমরা কি করছি, কোথায় যাচ্ছি সব কিছু আপডেট দিলে লোকে খেলো ভাবে, জানিস?”

আমার বিয়ের পরেও তুই তুই করা বউ মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, ”ভাবুক। কে কি ভাবল তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা। ফেসবুক একটা ভার্চুয়াল দুনিয়া, সে দুনিয়ায় আমি সব্বাইকে দ্যাখাতে চাই আমার থেকে সুখী কেউ ভূভারতে নেই। আমার ফেসবুক করার মন্ত্রই হল দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মতো ফুলবি। আমার স্কুলের সব বন্ধুরা আমাকে কত হিংসে করে জানিস? ওরা ভাবে আমার বর আমায় কি সাংঘাতিক ভালোবাসে!”

আমার পৌরুষে এবার একটু ঘা লাগতেই আমি গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলেছিলাম, ”ভাবে মানে! আমি কি সত্যি ভালোবাসিনা নাকি!”

পারমিতা বলেছিল, ”সে বাসিস। আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু তোর প্রোফাইল থেকে আমি যে ভালোবাসার পোস্টগুলো সবসময় করি, সেইরকম ভাল তো তুই আমায় বাসিসনা। কিন্তু ওরা তো আর জানেনা যে ওগুলো আমিই লিখি! হি হি।”

ফেসবুকে আমার প্রোফাইলের টাইমলাইনে গেলাম। আমার শেষ স্ট্যাটাস হল, আমার সাধের ডিএসএলআর ক্যামেরাটা বিক্রি করার অ্যাড। সত্যি, ফেসবুকে যে কত দরকারি কাজও করা যায়, তার প্রমাণ পেলাম। আমি ঠোঁট কামড়ালাম। যদিও শেষ পর্যন্ত ক্যামেরাটা বিক্রি করতে হয়নি।

নিজের ফোটো তোলার শখ তো ছিলই, তার ওপর পারমিতার মতো ফটোপাগল বউয়ের পাল্লায় পড়ে বিয়ের ঠিক আগে আগেই দুজনে টাকা জমিয়ে কিনেছিলাম ক্যামেরাটা। বিয়ের পর হানিমুনে গিয়ে ছবি তোলার ঠেলায় আরও একটা মেমোরি চিপ কিনতে হয়েছিল। সেখানেও আরেক কীর্তি। পারমিতার কথায় কি করছি, কোথায় খাচ্ছি, সব কিছুর স্ট্যাটাস মিনিটে মিনিটে দিতে হবে, তাও আবার উইথ ফোটো।

আমি তো রেগে গিয়ে পাট্টায়ার সেই বিচে ক্যামেরাটা ছুড়ে ফেলে দিতে গিয়েছিলাম ওর ফোটো তোলার জ্বালায়। আরে কোথায় হানিমুনে এসেছি, বৌকে নিয়ে একটু নিরালায় সময় কাটাব, তা না ফোটো আর ফেসবুক, ফেসবুক আর ফোটো! অসহ্যকর! রেগে মেগে একটু দূরে গিয়ে চুপচাপ বসে বালির মধ্যে দুর্গ তৈরি করছি, একটু বাদে দেখি মহারানি গুটিগুটি পায়ে পাশে এসে বসেছেন। ভাবলাম স্যরি ট্যরি বলবে, ও বাবা কোথায় কি! একটু দূরে একটা মেয়ে বিকিনি পরে রোদ পোহাচ্ছিল, আমি খেয়ালও করিনি ভালো করে, ওমা আমার কানটা ধরে টেনে হিঁচড়ে প্রায় বালিতে ঠেকিয়ে দিয়ে বলল, ”শোন, আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে বলেছি, এখানকার মেয়েদের ফেস আর বুক দেখতে বলিনি বুঝলি! এমন মার মারব না, নিজের ফেসকাটিং ভুলে যাবি! চল ওঠ, এইখানটায় আমার একটা ভালো ফোটো তুলে দে ঝটপট নাহলে এই রোদটা আর পাব না!”

টাইমলাইনের আরেকটু নীচে যেতে চোখে পড়ল মাত্র দিনপনেরো আগে পারমিতার রান্না করা সেই পোড়া বিরিয়ানির ছবি। পাগলির রান্না করার দিকে মন ছিল কম, আর অ্যাপ্রন পরে ছবি তোলার দিকেই আগ্রহ ছিল বেশি। রান্নাঘরে কিরকম পোজ মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্যাখো! আমি গঙ্গার ঘাটের এই আবছা আলোয় ফোটোটা ভালো করে দেখছিলাম। নিজের মনেই হাসি আসছিল। মাঝে মাঝে যে বিরক্তি লাগত না একেবারেই, তা নয়! সারাক্ষণ ছবি তুলতে কি কারুর ভালো লাগে! তার ওপর অফিসে বন্ধুরা রীতিমতো টিটকিরি মারে এত ছবি দেওয়ার ঘটা দেখে। কিন্তু আজ কেন জানিনা সেই বিরক্তিকর কাজটাই করে যেতে ইচ্ছে করছে ভীষণভাবে।

আলগোছে প্রোফাইলটা আরো স্ক্রল করে নীচের দিকে যেতে যেতে চোখে পড়ল, আমাদের ফুলশয্যার ছবি। পারমিতা আর আমি আমার ভাড়াবাড়ির খাটে লজ্জা লজ্জা মুখ করে বসে আছি। প্রায় দুশোটার মতো লাইক তাতে, আর কমেন্টও প্রচুর। ছোটবেলা থেকে তিনকুলে কেউ নেই আমার। একাই বড় হয়েছি হস্টেলে, তারপর এই ভাড়াবাড়ির সংসার। তাই আমার বিয়েতে বরকর্তা থেকে শুরু করে সব দায়িত্বই প্রায় বিমলজেঠুকেই পালন করতে হয়েছিল।

ফোনটাকে ঝট করে পকেটে চালান করে দিয়ে আবার একটা সিগারেট ধরালাম। ফুলশয্যার রাতে নতুন শাড়িতে জড়সড় পারমিতাকে নিজের দুটো হাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলাম। ওর চুলের মিষ্টি গন্ধ নিতে নিতে বলেছিলাম, ”তোর ফার্স কন্ডিশনটা তো আজ থেকে ইনভ্যালিড হয়ে গেল রে পুঁটি!”

আদরের সময় আমি ওকে পুঁটি বলে ডাকতাম। পুঁটি চোখ পিটপিট করে বলেছিল, ”কেন? ইনভ্যালিড কেন?”

আমি বলেছিলাম, ”ইন রিলেশনশিপ উইথ টা চেঞ্জ করে এবার ম্যারিড টু করতে হবে তো!”

ও হঠাৎ কি মনে পড়েছে, এরকম ভঙ্গিতে বলেছিল, ”এই তাই তো! একদম ভুলে গেছি! চল চল, দুজনেই স্ট্যাটাসটা আপডেট করি। আর, শোন, কন্ডিশনটার ভ্যালিডিটি মোটেও শেষ হয়নি, ফ্লেভারটা শুধু চেঞ্জ হয়েছে বুঝলি! হু!”

সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে আঙুলে ছ্যাঁক করে লাগতেই চমকে উঠে ফেলে দিলাম। পেছনে বিমলজেঠু কখন এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। আমাদের দুজনের ছোট্ট সংসারে বাড়িওয়ালা বিমলজেঠু প্রথমদিকে পারমিতার হাজার বায়নাক্কা নিয়ে কেমন তিতিবিরক্ত ছিল, তারও আজ চোখে জল! জেঠু অস্ফুটে বলল, ”অগ্নি, চলো, আমাদের টাইম হয়ে গেছে।”

সাতদিন আগে রাস্তায় একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে যখন কোমায় চলে গিয়েছিল পারমিতা, খবর পেয়ে অফিস থেকে যখন পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে আসছিলাম, তখনো ভাবছিলাম কিরকম বকুনি দেব ওকে। সারাদিন খালি ফোন আর ফোন! নিশ্চয়ই ফেসবুকে মত্ত ছিল, তাই খেয়াল করেনি গাড়িটাকে। তারপর এই ক-দিনের উৎকণ্ঠা, হাজার হাজার প্রার্থনা, এদিক-ওদিক থেকে টাকা জোগাড়ের আপ্রাণ চেষ্টা আর চোখের জল! সব আজ শেষ হল। আমার পুঁটি এখন শুধুই একটা বডি। যে ইলেকট্রিক চুল্লিতে ওঠার জন্য লাইনে অপেক্ষা করছে।

আমি মাথাটা সজোরে ঝাঁকালাম একবার। তারপর বিমলজেঠুর পিছন পিছন যাওয়ার আগে আবার ফোনটা বের করলাম। ফেসবুক খুলে তাতে আমার টাইমলাইনে শেষ স্ট্যাটাসটা দিলাম, ‘ট্রাভেলিং টু মাই লাভ পারমিতা’।

কাঁধের ঝোলা থেকে ডিএসএলআর-টা বের করলাম, কয়েক সেকেন্ড তাতে হাত বুলিয়ে তাচ্ছিল্যভরে ছুড়ে দিলাম গঙ্গায়। ঝপাং শব্দে ওটা জলে গিয়ে পড়ল, তারপর ছোট্ট একটু ঢেউ তুলেই তলিয়ে গেল। যাক! কি হবে আর এসব! সারা দুনিয়ায় কেউ নেই আর আমার! কার ছবি তুলব আর? কে-ই বা নিরলস পোজ দিয়ে যাবে একের পর এক!

বেশি কিছু আর ভাবতে ইচ্ছে করছিল না। পেছনদিকে একবারও আর না তাকিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললাম ইলেকট্রিক চুল্লির দিকে। নাহ, এখানকার ফরম্যালিটিজ যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি মিটিয়েই যেকোনোভাবে আমার পুঁটির কাছে আমাকে পৌঁছতে হবে, আজ রাতের মধ্যেই।

পেছনের পৃথিবীতে ফেসবুকে জমে থাকুক আমাদের চার বছর সাত মাস উনিশ দিনের ভালোবাসা। ভার্চুয়াল টাইমলাইনে স্ট্যাটাস দিয়ে সত্যিকারের কাজে দেরি করা আমার বউ আবার একদম পছন্দ করে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *