বালির বাড়ি
বাচ্চাগুলো জীবনে প্রথমবার সমুদ্র দেখে প্রথমে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা কৌতূহলে, আর অনেকটা অবিশ্বাসে!
এত বড় পুকুর এতদিন ওরা শুধু টিভিতেই দেখেছে।
এও হয় নাকি! ওদিকটা দেখাই যাচ্ছে না যে!
বর্ষার মেঘলা আকাশ, নুলিয়ারা বিশাল বড় বড় জাল ফেলেছে, কালো মেঘের মাঝে দূরে একটা মাছ ধরার নৌকো ঘুরছে ইতিউতি। পাশের দোকানগুলো থেকে টাটকা মাছ ভাজার গন্ধ এসে লাগছে নাকে। ডাবওলা ডাব নিয়ে বসে রয়েছে দূরে।
সকাল থেকে প্রায় ঘণ্টাচারেক বাসজার্নি করে আসা হয়েছে, লজে ব্যাগগুলো কোনোরকমে রেখেই ক্লান্তি দূরে সরিয়ে ওরা ছুটে এসেছে সমুদ্র নামক এই অদ্ভুত জিনিসটাকে দেখবার জন্য।
সবসুদ্ধ বারোটা বাচ্চা। মনোজের পাহারাদার চোখ আরো একবার গুনে নিয়ে নিশ্চিন্ত হল।
প্রথমে বাচ্চাগুলো একটু ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল জলের দিকে, ভীতু চোখে পরখ করে নিল কিছুক্ষণ পুরো ব্যাপারটা।
তারপরই দীনেশ বলে বাচ্চাটা আত্মহারা হয়ে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাফালাফি করতে শুরু করল। চিরকালই একটু বেশিই বিচ্ছু ওটা, আসার পর থেকেই। ওদিকে ইরফান একটা ডিগবাজি খেয়ে উল্টে পড়ল সমুদ্রের ছোটবড় ঢেউয়ের মাঝে।
পিয়ালি বলে মেয়েটা আবার বরাবরই শান্ত, অন্য দু-একজন ট্যুরিস্টদের দেখাদেখি সে নিবিষ্ট মনে বসে গেল বালির দুর্গ তৈরি করতে।
মুহূর্তে তাজপুরের এই অপেক্ষাকৃত নির্জন সমুদ্রসৈকতটা একরাশ কচি গলার কলকাকলিতে ভরে উঠল।
মনোজ সতর্ক চোখে সবক-টার দিকে কড়া নজর রাখছিল, এই দু-দিনের ট্যুরটা ঠিকমতো হ্যান্ডল করার উপর ওর প্রমোশানটা ভীষণভাবে ডিপেন্ড করছে।
ওদের এই এনজিও-টা অনাথ শিশুদের নিয়ে কাজ করে। এর মালিক অবশ্য কলকাতার প্রথম সারির শিল্পপতিদের একজন, সেফটি পিন থেকে শপিং মল সবকিছুরই ব্যবসা তাঁর আণ্ডারে। তার উপর কিছু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ওঠাবসায় এখন রাজ্যের একজন সেরা উদ্যোগপতিও বটে। তা সেই গ্ল্যামার বজায় রাখতে গেলে সবাইকেই চ্যারিটি করতে হয়, ওদের স্যারও তাই এটা খুলেছেন। সম্ভ্রান্তমহলে নাম কুড়োনো তো হলই, ট্যাক্সও বাঁচল।
একে বলে এক ঢিলে দুই পাখি।
ও আসার আগে স্যার পইপই করে বলে দিয়েছেন, ”মনোজ, আমিই প্রথম এরকম এক্সকারশন করাচ্ছি। অন্যরা তো ভাবতেই পারে না, খাওয়া পরা ছাড়া এদের ঘুরতেও নিয়ে যাওয়া যায়। হা হা !” পরক্ষণেই ঝুঁকে পড়ে সাবধান করে দিয়েছিলেন ওকে, ”শোনো, বিদেশের ওই গ্রান্টটাও কিন্তু এই নিউজটা প্রোমোট করেই আনতে হবে। ছবি তুলবে ঠিকঠাক করে! আর খুব কেয়ারফুল থাকবে, এতগুলোকে নিয়ে যাচ্ছ তো! বর্ষাকাল, একদম ভরা থাকবে সমুদ্র, নজরে রাখবে সবক-টাকে। বেশি লাই দেবে না, এরা আবার খেতে পেলে শুতে চায় তো! কোনো মিসহ্যাপ ঘটে গেলে কিন্তু মিডিয়া আমার পেছনে পড়ে যাবে।”
মনোজ মাথা নেড়ে একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল, ”স্যার, বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে গেলে হত না? এই ধরুন পুজোর আগে আগে?”
স্যার ওকে এবার যেতে বলার ইশারা করে গম্ভীর মুখে কম্পিউটারের দিকে মুখ ঘুরিয়েছিলেন, ”পুজোর আগে হোটেল রেট কোথায় যায় জানো? বর্ষাকাল বলেই এত সস্তায় লজটা পেয়েছি। কমন সেন্সটা অ্যাপ্লাই করো একটু!”
কথাগুলো মনে পড়তেই মনোজ মোবাইলে ক্যামেরাটা অন করল, ”অ্যাই সব, এদিকে আয় একবার, শিগগিরই, ছবি তুলব তোদের!”
অফিস থেকে এই ক-টা বাচ্চার থাকা খাওয়াবাবদ যা টাকা ওকে দেওয়া হয়েছে, বুদ্ধি করে চললে সবকিছু মিটে গেলে হাজার তিনেক টাকা ওর বাঁচবে। ও ঠিক করেই রেখেছে জলখাবারের পাট রাখবে না একদম, সকাল হতেই নিয়ে চলে আসবে সমুদ্রে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সবক-টার ভালো করে খিদে পেলে একবারে লাঞ্চ করিয়ে দেবে, তাতেই ওরা খুশি হয়ে যাবে। আর এদের কাউকে ফুটপাথের ধারে ফেলে যাওয়া হয়েছিল, কেউ আবার আস্তাকুঁড়ে পড়ে ছিল, ওদের পক্ষে এই ঘোরাটাই কল্পনার অতীত!
মনোজ ফোনটাকে একহাতে কায়দা করে ধরে অন্য হাতে একটা সিগারেট ধরাল। ওর ন-মাসের মেয়েটার গরমে ভারি কষ্ট হয়, সুমনা বলেই দিয়েছে এই গরমে এসি-টা লাগাতেই হবে। প্রমোশানটা হলেই মনোজ লাগিয়ে নেবে। সুমনা মাঝেমাঝেই গজগজ করে, কেন মনোজ সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসছে না, বা অন্য কোনো চাকরির চেষ্টা করছে না। বোকা মেয়েটাকে কি করে বোঝায় এখন এই এনজিও-র চাকরিতে ভালো মাইনে, তার সাথে বসকে খুশি রাখতে পারলে মোটা ইনসেনটিভ তো আছেই! এছাড়া ফরেন গ্রান্টে ট্যুরও জোটে ভালই। এখন একটু আটঘাট বুঝে নিচ্ছে, তারপর বছর দশেক বাদে নিজেই একটা এনজিও খুলে ফেলবে, এমনিই যা সব রেফারেন্স ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে ওর, ভালো স্পনসর পেয়ে যাবে।
আর একটু পার্টি ধরতে পারলে তো কথাই নেই।
সোশ্যাল ওয়ার্ক এখন লাভজনক ব্যবসাগুলোর মধ্যে একটা।
হৃষ্টচিত্তে মনোজ মাথাগুলো গুনতে শুরু করল, এক দুই তিন … দশ, এগারো, একি! বারোজন ছিল তো! আরেকটা গেল কোথায়?
ছুটে পাড়ের দিকে এগিয়ে এল ও, ঢেউয়ের জলোচ্ছ্বাস ছাপিয়ে গলা চড়াল, ”অ্যাই, তোরা এদিকে আয় সবাই শিগগিরই!”
কাউকে তো টেনে তোলাই যাচ্ছে না জল থেকে, বাবামায়ের স্নেহবর্জিত শিশুগুলো নোনা জলের উষ্ণ আদরে যেন ডুবে যেতে চাইছে! হোমে তো সেই একঘেয়ে জীবন ছোট ছোট মানুষগুলোর, সকালে উঠে গুড়ে ভিজিয়ে রুটি, তারপর কিছুক্ষণ পড়াশুনো, তারপর কাজ। অবশ্য ওগুলো তো কাজ নয়, জল তোলা, বাগানে জল দেওয়া, নিজেদের তো বটেই, হোমের কর্মীদেরও জামাকাপড় কাচা, ওদের শেখানো হয়েছে এগুলোও ওদের বেড়ে ওঠার একেকটা অঙ্গ। শুধু যে কাজ আর পড়াশুনোই শেখানো হয় তাও নয়, ম্যানারিজমেও বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখে না হোমের কেউ।
স্যার আবার একটু রক্ষণশীল মানুষ, তাই কেউ এলেই তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা, জল দেওয়া এসবও শেখানো হয় নিয়মিত বেসিসে। স্যারের রেফারেন্স অনেক লম্বা, কখন বাইরের কে চলে আসবে তার ঠিক আছে?
সবাইকে অনেক ধমকধামক দিয়ে টেনে এনে দেখা গেল কুসুম বলে নতুন আসা মেয়েটা নেই।
মনোজের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল, এই তো সমুদ্রে এল, এর মধ্যেই এ কি অঘটন রে বাবা! কোথায় গেল মেয়েটা!
মাত্র মাসদুয়েক আগেই কুসুমকে আনা হয়েছিল, ওদের একটা এজেন্টই নিয়ে এসেছিল কোথা থেকে যেন, জড়সড় ভাবটা এখনো কাটেনি আট-ন’বছরের মেয়েটার, কথা বলেই না প্রায়, কলকাতার হোমেও সারাদিন চুপ করে বসে কিভাবে, পড়াতেও মন নেই। বেশি কিছু বললেই কেঁদে ফেলে, সে কি বিড়ম্বনা! মনে পড়ে গেল মনোজের। মেয়েটা আসার পরে পরেই একজন মিনিস্টার এসেছিলেন হোমটা ঘুরে দেখতে, স্যারেরই বন্ধুস্থানীয়। জিজ্ঞেস করবি তো কর, আর কাউকে নয়, কুসুমকেই প্রথমে নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি।
কুসুম ঠিক একইরকম আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর একটু খোঁচাতেই সটান গিয়ে মন্ত্রীমশাইয়ের পা চেপে ধরেছিল, ”মুকে ক্ষমা করে দ্যান গো মাস্টারমশাই! মুই আর করবুনি!”
মন্ত্রীমশাই অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন, ”এদের কি খুব শাসনে রাখা হয় নাকি!”
কি অস্বস্তি তখন! মনোজের দিকে স্যার কটমট করে তাকিয়েছিলেন। কোনোরকমে ব্যাপারটা সামাল দিয়ে সব চুকিয়েই মনোজ ফোন লাগিয়েছিল সেই এজেন্টটাকে, ”কোত্থেকে এই সব ভুলভাল বাচ্চা আনো জগদীশ? প্রেস্টিজে পুরো পাংচার করে দিল!”
জগদীশ বলেছিল, ”একদম অজপাড়াগাঁয়ের মেয়ে তো স্যার, কাণ্ডজ্ঞান নেই তেমন, তার ওপর বাপমা-টা মরে গেল এই সেদিন, তারপর কতরকম কষ্ট পেতে হয়েছে তো, নিজের কাকাই মারধর …!”
”ওসব আমি কিছু শুনতে চাইনা। এইরকম করলে কিন্তু তোমার কমিশন বন্ধ করে দেব জগদীশ, এই শেষবারের মতো বলে দিলাম তোমায়! আমাদের একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে, বড় বড় লোকেরা আসে এখানে, সেটা ভুলে যেয়ো না।” রাগে গসগস করতে করতে দু-চারকথা শুনিয়ে তারপর ফোন ছেড়েছিল মনোজ।
তারপর দেখা গিয়েছিল কুসুম সেই একইরকমভাবে বসে থাকে, কেউ একটু জোরাজুরি করতে গেলেই সটান তার পায়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে, ”ক্ষমা করে দ্যান। আর করবুনি!”
ওর মনে বোধ হয় কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে যে পা ধরলেই একমাত্র ক্ষমা করা যায় কাউকে!
ঝামেলা এড়াতে মনোজরা কেউ ওকে আর তারপর থেকে বেশি ঘাঁটায় না।
মনোজ এখন উদ্ভ্রান্তভাবে বলল, ”কুসুমকে কেউ দেখেছিস তোরা? ভ্যানে করে আসার সময়েও তো ছিল, কোথায় গেল?”
কেউ কিছু বলতে পারল না। সবাই সমুদ্র দেখে এতই উৎফুল্ল, কুসুমকে কেউ খেয়াল করেনি।
মনোজ ছুটে গেল জলের দিকে, নুলিয়াগুলোকে চেঁচিয়ে বলল, ”ও ভাই, একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখেছ? দুদিকে বিনুনি, লাল জামা? এদিকেই ছিল এক্ষুনি!”
নুলিয়াগুলো এদিক-ওদিক চেয়ে মাথা নাড়ল দু-পাশে।
মনোজ পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো, একবার বালির চর পেরিয়ে ঝোপের দিকে যায়, একবার দোকানের ভেতরগুলো খুঁজে দ্যাখে, মেয়েটা কি কর্পূরের মতো উবে গেল নাকি!
আচ্ছা একটু দূরের ওই ঝাউবনটায় চলে যায়নি তো আবার! ছুটে গিয়ে ওদিকটাও দেখে মনোজ, কেউ কোত্থাও নেই।
এর মধ্যেই সুমনার ফোন এল একবার, আজকাল ওর ফোন মানেই যেন অভিযোগ, ”নিজে তো ভালোই ঘুরে বেড়াচ্ছ, আমরা গরমে মরে যাচ্ছি। পাশের ফ্ল্যাটের রঞ্জনারাও দেখলাম এসি কিনে ফেলল! ভাল্লাগে না আর! কবে কিনবে বলো তো?” মনোজ সংক্ষেপে ঘটনাটা বলে রেখে দিল। সুমনা আরো কিছু জানতে চাইছিল, কি করে মেয়েটা হারাল, এবার মনোজ কি করবে, কিন্তু ও আর কথা বাড়াল না।
অফিসের কাজে এতগুলো ল্যাঙবোটকে নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে আসাকে যে ঘুরতে আসা বলে, তাকে আর মনোজ কি বলতে পারে?
মিনিটকুড়ি বাদে যখন মাথার চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থা, ক্লান্ত শরীরে পিয়ালির পাশে বসে পড়ল মনোজ, ”পা-দুটো টিপে দে তো একটু!”
পিয়ালির দুর্গ এখন বেশ বড় হয়ে গেছে, তাতে চারটে জানলা আর একটা ছোট দরজাও দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার, সমুদ্রের বালুকণার নিয়ম মেনে সেখান দিয়ে ফিনকি দিয়ে বেরোতে শুরু করেছে জল।
উল্লসিত পিয়ালি মুখে কিছু বলছিল না, কিন্তু খুশি যেন ওর দু-চোখ দিয়ে ঝরছিল।
ওর বালির বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে।
মনোজ হুকুম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসে ও অভ্যেসমতো মনোজের পা টিপতে লাগলো, ”চিন্তা করবেন না স্যার! কুসুমের তো সব চেনা এদিকটা, ও হারাবে না!”
মনোজ পা-দুটো সামনে ছড়িয়ে বসে জিরোচ্ছিল, কুসুমের কথা চমকে উঠল, ”মানে? কুসুমের কি এইখানে বাড়ি নাকি?”
”হ্যাঁ স্যার!” পিয়ালি পা-দুটো টিপছিল, সঙ্গে সতর্ক নজর রাখছিল ওর বালির বাড়িটার দিকে, দুটো জানলা করা এখনো বাকি, জানলা বেশি না থাকলে ওর আবার দম আটকে আসে! ”এখানে আসার কথা শুনেই তো কুসুম আমায় বলেছিল, একটু দূরেই ওর গ্রাম তো!”
”মানে!” মনোজের চোখ বিস্ময়ে গোলগোল, এজেন্টদের বলাই আছে, সবদিক দেখে যেন বাচ্চা আনে, কোন ডিসপিউট কেসে নেই ওরা, সেখানে এই মেয়েটা বয়সে বেশ বড়, তার ওপর নিজের বাড়ি চেনে, জগদীশ পাচার- টাচার করে নিয়ে চলে আসেনি তো? সেইরকম কিছু হলে, প্রোমোশানটা তো গেলই, চাকরিটাও থাকবে কিনা সন্দেহ।
পিয়ালি একইরকম ভাবলেশহীনভাবে জানলা তৈরি করছিল, আলগোছে হাতটা তুলে বাঁ দিকে দ্যাখালো ও, ”ওই যে, ওই দিকে ওর বাড়ি ছিল, এসে বলছিল। এখন আর নেই।” ছোট ছোট আঙুল নাড়াল ও।
”আর নেই কেন?” মনোজ সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করল।
পিয়ালি বলল, ”ঝড়ে ভেঙে গেছে, বালির বাড়ি তো! সমুদ্র এসে বন্যায় সব নিয়ে গেছে। তাই তো ও সবসময় কাঁদে!”
কি সব আবোলতাবোল বকছে মেয়েটা! বালির বাড়ি আবার কি! মনোজ আর সময় নষ্ট করল না, এসি-টা ওকে এবারেই লাগাতে হবে, মেয়েটা রাতে ঘুমোতে পারে না, মাঝে মাঝেই গরমে ধড়ফড় করে ওঠে। ও বলল, ”কোনদিকে ওর ওই বালির বাড়ি ছিল কিছু বলেছে তোকে?”
পিয়ালি এখন সামনের পাঁচিলে মনোযোগ দিয়েছে, কুসুম ওকে আসার আগে পইপই করে বলেছে ঠিকমতো বাঁধ না দিলেই সমুদ্র ওর বাড়িটাকে নিয়ে চলে যাবে, সঙ্গে মানুষগুলোকেও।
পরে শুধু বালিগুলো ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। সমুদ্র কিচ্ছু নেয় না যে! তাই পিয়ালি ভাল করে পাঁচিল তুলছিল ওর বাড়ির চারপাশে।
মনোজ দিশেহারা হয়ে ছুটছিল পিয়ালির দেখিয়ে দেওয়া দিকে, বাচ্চাগুলোকে একটা ফ্যামিলির কাছে একটু খেয়াল রাখতে বলে কোনোরকমে এসেছে, এরকম গেরোয় ও কোনোদিনও পড়েনি।
মেয়েটাকে যদি সত্যিই না পাওয়া যায়!
বেশ কিছুক্ষণ চর বেয়ে ছোটার পর যেন সত্যিই একটা গ্রাম চোখে পড়ল, ঠিক গ্রাম কিনা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু কিছু বসতি চোখে পড়ছে, আর মাঝে মাঝে কিছু গাছ।
মনোজ হাঁপাচ্ছিল, তবু ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল। কায়িক পরিশ্রম না করে করে শরীরটা দিনদিন ভ্যাদভ্যাদে টাইপ হয়ে যাচ্ছে, আগে যখন স্যারের অন্য বিজনেসে ছিল তখন বরং অনেক পরিশ্রম হত।
আরো কিছুক্ষণ ছুটে জায়গাটা চোখে পড়ল ওর, জায়গা না বলে অবশ্য একটা পরিত্যক্ত গ্রাম বলাই ভালো। কেউ কোথাও নেই, অথচ বালির উপর যেন অনন্তকাল থেকে ভাঙা বাঁশ, টিন, ঘরের চালা পড়ে আছে, সেগুলোর বেশিরভাগই বালির মধ্যে ডুবেও গেছে। কোথাও জাহাজের মাস্তুলের মতো উঁচিয়ে রয়েছে সমুদ্রের নোনা জলে বছরের পর বছর ভিজে কালো হয়ে যাওয়া কারুর খাটের ছত্রী, কোথাও আবার কারুর ভেসে যাওয়া রান্নাঘরের ভাঙা শিশি পড়ে আছে, ঠিক যেন বালিঘড়ি!
বোঝাই যাচ্ছে উপসাগরের কোনো ভয়াবহ ঝড়ে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এই গ্রামটা। মনোজের হঠাৎ মনে হল কাগজে পড়েছিল পাঁচ-ছমাস আগে কি একটা ঝড় এসেছিল যেন, সেইটাতেই কি এই অবস্থা?
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পায়ের চপ্পলের ফাঁক দিয়ে কিছু একটা ফুটলো, মনোজ দাঁড়িয়ে বের করতে গেল আর তখনই দূরের সমুদ্রের একদম জলে দাঁড়িয়ে থাকা কুসুমের লাল রঙের অল্প ছেঁড়া ফ্রকটা চোখে পড়ে গেল ওর।
এমনিতেই বর্ষাকালের মেঘলা আকাশ, দূরের কালো মেঘ সমুদ্রের উপর ছায়া ফেলে কেমন সবুজ নীল একটা অন্ধকার রঙের সৃষ্টি করেছে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় মনোজ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ওর দিকে।
যাক বাবা! এই মাসেই এসি কেনাটা কনফার্মড!
একদম কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও, কুসুম সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চলভাবে। এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যে ঠিক ওর পায়ের পাতাদুটো নরম ঢেউ এসে বারবার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
এত ফাঁকা গোটা জায়গাটা, মনে হচ্ছে অন্য কোনো জগতে চলে এসেছে ওরা।
এই পোড়ো গণ্ডগ্রামে কি করছে কুসুম?
এটাই কি ওর গ্রাম নাকি? কিন্তু লোকজন সব কোথায়?
কুসুম খেয়ালই করল না কেউ পেছনে এসেছে। মেয়েটা চুপচাপ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর কি একটা বিড়বিড় করছিল। এত জোরে হাওয়া দিচ্ছে মনোজ বুঝতেই পারল না, ও কি বলছে।
কুসুমের কাছে ঝুঁকে এল মনোজ।
মেয়েটার চোখদুটো ফুলে গেছে, ঠোঁটটাও কাঁপছে তিরতির করে, ”যতই মুর পা ধরে ক্ষমা চা, মুই তোকে ক্ষমা করবুনি” কান্নার দমকে রোগা শরীরটা এমনভাবে কাঁপছিল যেন উড়ে যাবে এখুনি, ”মুর বাপমা-কে কেড়ে নিলা, মুর ঘরটাকে কেড়ে নিলা, এখন পা ধরে ক্ষমা চাইতে আসিস কুন মুখে?” মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠল, ”ছোটভাইটাকে অবধি ভাসিয়ে নিলা তুই! আর এখন ক্ষমা চাইছিস? মুর পা ধরে ধরে মরে যা তুই, তবু তোকে কোনোদিনও ক্ষমা করবুনি!”
মনোজ বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গেল।
ওর চোখের সামনে হঠাৎ যেন সিনেমার মতো পুরো দৃশ্যপট পালটে গেল, পরিত্যক্ত গ্রামটা সাগরপাড়ের সবুজ গাছগাছালিতে মোড়া ব্যস্ত হয়ে জেগে উঠল হঠাৎ! ও যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল, কুসুমের বাবা সমুদ্রে মাছ ধরতে গেছে, আর কুসুমের মা তার একরত্তি উঠোনে উনুন জ্বেলে রান্না করছে। ওর ছোট ভাইটা নিজের মনেই উঠোনে খেলছে চু কিতকিত। কুসুমের বাবা ফিরতেই তাঁর মাছের আঁশটে গন্ধওলা ঘেমো গায়ে হাসতে হাসতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কুসুম আর ওর ভাই!
তারপর একদিন এল বিষম ঝড়, তাতে তোলপাড় হয়ে গেল অনেকগুলো সংসার, অভাবী মানুষগুলোর অর্ধেকই মরে গেল বন্যার তোড়ে, আর যারা কোনোরকমে বেঁচে গেল, তাদের এঁটো পাতের জঞ্জালের মতো চালান করা হল বিভিন্ন জায়গায়, কেউ শহরে গিয়ে ভিক্ষা করতে লাগল, কেউ দুবেলা দু-মুঠো খাওয়ার জন্য প্রাণপাত করতে শুরু করল, আর কুসুমের মতো বাচ্চাগুলোর কারুর ঠাই হল অনাথ আশ্রমে, কারুর অবস্থা আরো খারাপ, হারিয়ে গেল অন্ধকারের কোনো অপরাধের গলিতে।
মনোজের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।
হঠাৎ ঘোর কাটিয়ে দিয়ে ফোনটা বেজে উঠল। সুমনা, ”কিগো? সব ঠিকঠাক আছে তো? পেলে মেয়েটাকে?”
মনোজ উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল।
ওর চোখদুটো বাষ্পে ভরে উঠেছে হঠাৎ, এই নোনা হাওয়ার জন্য কি? শার্টের আস্তিনে নিঃসাড়ে চোখ মুছল ও।
সুমনা এসি চায়, মনোজ প্রোমোশান চায়, ওদের স্যার সব পেয়ে গিয়ে এখন নামযশ চায়, আরো কত মানুষ গাড়ি, বাড়ি, স্টেটাস, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কত কি চায়!
কিন্তু কিছু মানুষ এখনো আছে, যারা একটু খেতে চায়, তাদের ছোট্ট ঘরটাকে শুধু ফিরে পেতে চায়, তাদের চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষগুলোকে একবার কাছে পেতে চায়।
বালির বাড়ির মতোই অনিশ্চিত তাদের জীবন!
তাদের চাওয়ার কাছে ওদের এই চাওয়াগুলো কি ঠুনকো, না?
মনোজ গলা দিয়ে বেরিয়ে আসা উদগত কান্নার দলাটাকে প্রাণপণ চেষ্টা করে গিলে ফেলল।
তারপর নিঃশব্দে গিয়ে জড়িয়ে ধরল কুসুমকে।
**********