বুমেরাং
এরকম যে কিছু হতে পারে আমি কেন আমার চোদ্দপুরুষও ভাবতে পারেনি! বড় ল্যাংচাটার অর্ধেকটা মুখে আগেই জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বাকিটা বাইরে খুবই বিসদৃশভাবে ঝুলছিল। নির্লজ্জের মতো হে হে করে হেসে কি আর করি, বাকিটা ঠেসে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু সেটাকে পেটের মধ্যে গিলে ঢোকানো আমার পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। গলায় হঠাৎ আটকে গেছে এমন একটা ভান করে তাড়াতাড়ি ভেতরের ঘরে এলাম। ঘুপচি বাথরুমের অন্ধকার শ্যাওলা পড়া বেসিনে সেটাকে উগড়ে দিয়ে গলায় ঘাড়ে মুখে জলের ঝাপটা দিলাম ভালো করে। পিঠে একটা কার হাতের ছোঁয়া পেতেই চমকে ঘুরে তাকিয়ে দেখি, পুটপুটি।
পুটপুটির গলায় অল্প উৎকন্ঠা, ব্যগ্রভাবে বলল, ”কি হয়েছে বাবা? তুমি হঠাৎ ওরকমভাবে চলে এলে কেন? বিষম লেগেছে? জল দেব?”
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলাম। আমার সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটাকে আজ শাড়ি পড়ে কি বড়সড়ই না লাগছে! পাশের বাড়ির দোয়েলের থেকে ধার করে আনা শাড়ি, গলায় একটা সরু চেন, কপালে ছোট্ট টিপ। লম্বা চুলটাকে খুলে সামনের দিকে বিছিয়ে রেখেছে। আমার স্ত্রী মালতির মতে তাতে নাকি চুলের গোছটা বেশি মোটা দেখায়। কবে এতবড়ো হয়ে গেল মেয়েটা? বললাম, ”কিছু হয়নি রে মা। তুই যা বাইরের ঘরে। ওঁরা কি না কি ভাবছেন। আমি আসছি।”
পুটপুটি চলে যাওয়ার পর বাথরুমের লাগোয়া একফালি বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। আমাদের এই বারান্দা থেকে আকাশ তো দূর, পচা নর্দমার হাইড্রেন আর নোংরা ফেলার ভ্যাট ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। অবশ্য এই জবরদখল বস্তির দেড় কামরার সস্তা ফ্ল্যাটে এর থেকে বড় ব্যালকনি আশা করা অন্যায়। পুরো মুখটা তেতো লাগছিল। বড় করে একটা ধোঁয়া ছেড়ে সামনের দিকে তাকালাম। গুটিসুটি মেরে ওখানেই বসে পড়লাম। অথচ আমার এখন গলায় গামছা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করার কথা। কিন্তু বাইরের ঘরে গিয়ে সেই কাজটা করার মুখ আমার আর নেই।
আজ আমার একমাত্র মেয়েকে বারো নম্বর পাত্রপক্ষ তৃতীয় তথা ফাইনায় দফায় দেখতে এসেছে। ছেলে তার বন্ধুদের নিয়ে আগেই দেখে গিয়েছিল, মাঝে দুদিন ওরা দুজন নিজেদের মতো বেরিয়েছিল, পরে একদিন ছেলের বাবা আর জেঠা এসেছিল। আজ এসেছে মা আর আরো কিছু আত্মীয়, একদম পাকা কথা বলতে। আমাদের কাছে এই সম্বন্ধটা হাতে চাঁদ পাওয়ার চেয়েও বিশাল কিছু। পুটপুটি দেখতে খারাপ না হলেও রঙ চাপা হওয়ায় ওর তথাকথিত বিয়ের দাঁড়িপাল্লার বিচারে রূপ নেই, আর ওর বাপেরও রুপো মানে টাকাপয়সা নেই। মেয়েটার পড়াশুনোতেও তেমন মাথা ছিল না। কোনোরকমে গ্র্যাজুয়েশনটা করেছে। আমিও জোর করিনি। সবার দ্বারা সব কিছু তো হয় না। বাড়িতেই ক-টা বাচ্চাকে পড়ায় আর মা-কে সাহায্য করে। এমনিতে যে যাই বলুক, আমার মেয়ে ভারি শান্ত ভদ্র। রান্নাবান্না, ঘরদোর গোছানোতে খুব মন। কিন্তু অন্য ‘কিন্তু’-গুলোর জন্য বিয়ে ঠিক হয়েও হয় না। আমার স্ত্রী মালতী তো প্রায় অস্থির হয়ে উঠেছিল। একটার পর একটা সম্বন্ধ আসে, মেয়েকে সেজেগুজে বসানো, কৃত্রিম গুণকীর্তন, ইন্টারভিউ, তাদের জন্য এলাহি জলখাবারের আয়োজন, তার কয়েকদিন বাদে ফোনে ‘না’ শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে উঠেছিল আমার মেয়েটা। আমি ওর কষ্টটা বুঝি, কিন্তু কি করব! সাতাশ পেরিয়ে আঠাশে পড়েছে, এরপরেও যদি বিয়ে দিতে না পারি তবে তো মুশকিল! আমার স্ত্রী ওকে প্রায়ই গঞ্জনা দেয়, মুখে একটাও রা কাটে না পুটপুটি, কিন্তু আমার বুকটা ফেটে যায়। অথচ ও জন্মেছিল কত আদরে, কত বিলাসিতায় কেটেছিল ওর শৈশব! সব কিছুর জন্যই আমি দায়ী, সিগারেটের ধোঁয়ায় কাশতে কাশতে ভাবলাম আমি।
অথচ বিশাল উচ্চবিত্ত না হলেও যথেষ্ট সচ্ছল ছিলাম বছরকয়েক আগেও। আমি হিন্দমোটর কারখানায় ভালো পোস্টে চাকরি করতাম। পড়াশুনোয় সাধারণ হলেও বরাতজোরেই ভালো চাকরিটা বাগিয়েছিলাম অল্পবয়সেই। ছোট থেকেই আমার দ্যাখানেপনা, অহঙ্কার একটু বেশি, যে মামার সুপারিশে চাকরিটা পেয়েছিলাম, পরে সেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার তো দূর, মামার অন্তিমকালে দেখা করতে গিয়েও সময় নষ্ট করিনি। দু-হাতে খরচা করতাম। উত্তরপাড়ার মতো জায়গায় দোতলা বাড়ি, একটা বড় গাড়ি, মেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করা, বছরে দু-তিনবার ঘুরতে যাওয়া কোনোকিছুই বাদ রাখতাম না। চিরকালই যতটা না আয় তার থেকে ব্যয় দেখিয়ে লোকের কাছে ঠাটবাট দেখানো আমার স্বভাব। সেটাই করতাম। তাতেও কিছু অসুবিধা হত না, যদি না আমাদের কারখানাটা দুম করে বন্ধ হয়ে যেত! কারখানা বন্ধ হওয়ার পরেও বছর দুয়েক আমি আগের লাইফস্টাইলই বজায় রেখেছিলাম, কিন্তু শেষ অবধি আর পারলাম না! এদিক সেদিক অনেক চেষ্টা করেও কোনো চাকরি জোটাতে পারলাম না, কিছুটা আমার হামবড়া ভাবের জন্যই, শেষে গলা অবধি দেনায় ডুবে বাড়ি-গাড়ি সব বিক্রি করে দিয়ে এই বস্তির ফ্ল্যাটে উঠে আসতে হল। মালতী এ নিয়ে আমায় মাঝে মাঝে কথা শোনালেও পুটপুটি কোনোদিন কোনো অনুযোগ করেনি।
হঠাৎ মালতির ডাকে আমি চমকে পেছনে তাকালাম। মালতি চাপা গলায় ধমকাল, ”কিরকম আক্কেল গো তোমার! এত ভালো একটা সম্বন্ধ, কপালগুণে প্রায় ঠিক হয়ে এসেছে, কোথায় তাদের যত্নআত্তি করবে, তা না, এইখানে বসে সিগারেট টেনে যাচ্ছ? বলি সব দায় কি আমার একার?”
আমি বললাম, ”তুমি যাও। আমি আসছি”।
মালতি আরো রেগে গেল, অথচ বাইরের ঘরে যেন শোনা না যায় এইভাবে বলল, ”আসছি বলতে বলতে তো আধঘণ্টা হতে চলল। কি ভালো ফ্যামিলি! পুটপুটির হাজার জন্মের তপস্যা ওই ডাক্তার ছেলে এত ভালো ভালো মেয়ে থাকতে শেষে ওকে পছন্দ করেছে। ওই তো তোমার মেয়ের গায়ের রঙ! আর আমাদের ঘরের চালচুলোও তেমনি। কিন্তু কি ভালো ব্যবহার! সত্যিকারের শিক্ষিত একেই বলে। বিশেষ করে ছেলেটার মা। যেমন মিষ্টি দেখতে, তেমন ব্যবহার। কে বলবে ডাক্তারের বউ, ডাক্তারের মা। এত বড়োলোকের বউ, কিন্তু কোনো অহঙ্কার নেই। আমাকে এসেই হাত ধরে বলল দিদি আমায় কিন্তু তৃপ্তি বলে ডাকবেন, ওইসব বেয়ান টেয়ান আমার পোষায় না। আর তুমি এইখানে বসে রোয়াব নিচ্ছ?”
এইবার বিরক্ত লাগল আমার। একটু জোরেই বললাম, ”বললাম তো আসছি। বাজে বকছ কেন! পছন্দ হবার হলে এমনিতেই করবে। আমার মেয়ে অন্তত আমার কাছে ফ্যালনা নয়। তুমি যাও তো!”
মালতি পারলে চোখ দিয়ে আমায় ভস্ম করে দেয়, তবু কিছু না বলে দাঁত চিপে গজগজ করতে করতে চলে গেল। আমি আবার বাইরের খোলা নর্দমাটার মধ্যে ভনভন করা মাছিগুলোর দিকে তাকালাম। বেকার অভিনয় করে আর লাভ কি? সম্বন্ধটা ভেস্তে যাবেই যখন! হুম। নামটা পড়েছে এতক্ষণে। তৃপ্তিই বটে! তখনো খুব মিষ্টি ব্যবহারই ছিল। কিন্তু সেদিকে আমি ভ্রূক্ষেপ করিনি। করলে কি আজ কিছু অন্যরকম হত? কি জানি! আমি আবার ভাবতে লাগলাম।
মামার সুপারিশে সাধারণ ঘরের সাধারণ পড়াশুনোয় হয়েও যখন তখনকার হিসেবে মোটা মাইনের চাকরিটা বাগিয়েছিলাম, তখন আমার ল্যাজ আরো মোটা হয়ে গিয়েছিল। ধরাকে সরা জ্ঞান করতাম। বন্ধুদের সাথে পাড়ার আড্ডায় বার খেয়ে বাজি ধরেছিলাম, বিয়ে করব ঠিকই, কিন্তু তার আগে তিনশোটা বাড়িতে ফ্রিতে রোববারের জলখাবার খাওয়াব ওদের। সেইমতো রবিবার হলেই আমি সোমনাথ আর পরেশ বেরিয়ে পড়তাম। আমাদের মতো গরিব দেশে আর যা কিছুরই অভাব থাকুক না কেন, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অভাব হয় না কখনো। কয়েকটা ঘটককে ফিট করেছিলাম। গম্ভীরভাবে যেতাম, যতটা পেটে ঢোকানো যায়, ততটাই খাবার সাফ করতাম, মেয়ের মা মেয়েকে ধরে ধরে নিয়ে এলে শরীরের ঠিকঠাক জায়গায় ঠিকঠাক মাংস আছে কিনা দেখে নিয়ে আর কিছু অপ্রস্তুতে ফেলা বেয়াড়া প্রশ্ন করে পরে খবর দেব বলে কেটে পড়তাম।
শেষের দিকে সোমনাথ আর পরেশ আর যেতে চাইত না। বলত, ”ধুর, তোর বাজি রাখত! মেয়েগুলোর মা যখন চলে আসার সময় হাত ধরে বারবার বলে একটু দেখ বাবা, খুব কষ্ট হয় তখন। তুই তো শালা অমানুষ। আমরা তো আর তা নই। গরিব ঘরের মেয়ে, বাবারা কত কষ্ট করে খাবার দাবারের বন্দোবস্ত করে, আর এইভাবে গিয়ে…”
আমি বিয়ের বাজারে নিজের চাহিদার কথা ভেবে হাসতাম। ছোট থেকেই দেখেছি, কাউকে কষ্ট দিতে পারলে আমার মধ্যে একটা জান্তব আনন্দ হয়। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার জন্যই হোক বা আর যে কারনেই হোক, স্নেহ ভালোবাসার কোনো গুরুত্ব আমার কাছে ছিল না। বলতাম, ”আরে পছন্দ না হলে কি করব বল!”
ওরা রেগে উঠত, ”ফালতু বকিস না। তোর জন্য এতদিনে দুশোর ওপর মেয়ে দেখলাম, একটাকেও পছন্দ হল না! গেল রবিবারের অত ভালো মেয়েটা, কি সুন্দর গেয়ে শোনালো, দেখতেও ভালো, পরে যখন ওর বাবা বারবার ঘটককে দিয়ে জিজ্ঞেস করে পাঠাচ্ছিল, কি বলে কাটালি? না, আপনার মেয়ের কানদুটো বড়! ছি ছি। তুই তো আসলে বিয়ে করার জন্য দেখতে যাস না, যাস শুধু গিলতে।”
আমি বলতাম, ”আরে বিয়ে করতে হবে মালদার বাপ দেখে, তবেই না লাভ?”
তৃপ্তিও এদের মধ্যে একজন ছিল। এত ভিড়ের মধ্যে আমার ওকে আলাদা করে মনে রাখার কথা নয়, যদি না ওকে দেখে এসে নাকচ করে পাঠাবার কয়েকদিন বাদে বাসে ওর সাথে দেখা হয়ে যেত। ও নিজেই এসে কথা বলেছিল, আমার সেটা আজও স্পষ্ট মনে আছে। চোখের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে বলেছিল, ”আপনি আসলে কাউকেই বিয়ে করার জন্য দেখতে যান না, তাই না! আমার এক বন্ধুকেও দেখতে গিয়েছিলেন, তাকেও এইভাবে অযৌক্তিক একটা কারণ দেখিয়ে…কি পান আপনি?”
আমি ওর কথার মাঝখানে বাস থেকে নেমে পড়েছিলাম। মালতীকে বিয়ে করেছিলাম সত্যিকথা বলতে কি ওর বাবার ব্যবসা দেখে। শিক্ষা, রুচি এসব কিছুই গুরুত্ব পায়নি আমার কাছে তখন। বিয়ের পর বুঝলাম ওর বাবার ব্যবসা ভেতরে ভেতরে ফোঁপরা, মালতী যতটা না সোনাদানা নিয়ে আমার ঘরে এসেছে, মেজাজ, স্থূল রুচি, ছোট মন এনেছে তার দশগুণ বেশি।
সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে ছোট হয়ে আঙুলে ছ্যাকা লাগতেই চমকে উঠে এলে দিলাম। মনটা খুব খারাপ লাগছিল। সেদিনের সেই বাবাগুলোর কষ্টটা আজ একটা মেয়ের বাপ হয়ে টের পাচ্ছি। কিন্তু আমার পাপের শাস্তি আমার নির্দোষ মেয়েটাকে পেতে হবে বলেই খারাপ লাগছিল। এই ক-দিনে বুঝেছিলাম জয়ব্রতর প্রতি পুটপুটির একটা ভাললাগা জন্মেছে। এত বড়লোকের ছেলে, এতো শিক্ষিত, অথচ কত বিনয়ী। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে ওর এক বন্ধুর বাড়ি এসেছিল, তখন পুটপুটির সাথে আলাপ হওয়াতে বাড়ি গিয়ে জানায়। বাবাটাও বড় ভালো। এত ভালো সম্বন্ধটা কেটে গেল শুধু আমার জন্য! আচ্ছা তৃপ্তি কি আমায় চিনতে পেরেছে? নিশ্চয়ই পেরেছে। বিকাশবাবু, মানে ছেলের বাবা যখন আমায় জোর করে ওদের শক্তিগড়ের থেকে আনা ল্যাংচা মুখে পুরে দিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন, তখন পাশ থেকে তৃপ্তি একদৃষ্টিতে চেয়েছিল আমার দিকে। এত টাকার আয়োজন, এত খাবারদাবার সব বৃথা হল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। এখন এইটুকুই মনে হচ্ছে কোনো কটু কথা যেন শুনতে না হয় আমার মেয়েটাকে। ‘না’ বলার ছুতো হিসেবে অপমানজনক কিছু যেন না বলে ওরা, ঠিক যেরকমটা আমি বলতাম।
হঠাৎ একটা আওয়াজ হতে আমার চিন্তার জ্বাল ছিঁড়ে গেল। চমকে উঠে দেখলাম, তৃপ্তি আসছে, পাশে পুটপুটি। আমার সাথে চোখাচোখি হতে পুটপুটি বলল, ”বাবা, কাকিমা বাথরুম যাবেন, তাই নিয়ে এলাম।”
পুটপুটি তৃপ্তিকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। মালতী মনে হয় ভালোই রেগেছে, আর আসছে না ডাকতে। আমি আরো গুটিয়ে গেলাম সঙ্কোচে। ছি ছি। আমার এই নোংরা শ্যাওলা পরা অন্ধকার বাথরুমে ঢুকে কি ভাবছে তৃপ্তি! ভাগ্যের নিঠুর পরিহাস কি একেই বলে? ওদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসে যখন ওর বাবা বারবার ঘটককে গিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে পাঠাচ্ছিলেন, তখন জমিদারি চালে বন্ধুদের সামনেই আর কোনো খুঁত খুঁজে না পেয়ে ঘটকমশাইকে বলেছিলাম, ”বলে দেবেন এরপর যখন পাত্রপক্ষ দেখতে যাবে, খাওয়াদাওয়ার পর হাত ধোয়ার মগটা যেন একটু ঠিকঠাক মেজে দেয়! যেটায় হাত ধুয়েছিলাম সেটা জলের মগ না পায়খানার গাড়ু!” বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়েছিলাম।
আচ্ছা পুটপুটিকেও কি ওরা এরকমই কিছু একটা বলবে যাতে আমার মেয়েটার কষ্টে মনটা ফেটে যায়? মালতী একদিন ঘুরে এসেছে ওদের বাড়ি, বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি, তার এলাহি সব আসবাব আর ডেকোরেশন। কি বলবে তৃপ্তি আমার মেয়েটাকে?
এর মধ্যেই কখন তৃপ্তি ফিরে গেছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ মালতীর ডাকে ফিরে তাকালাম, ”ওগো, শীগগিরই চল। ওরা বিয়ের ডেট ঠিক করতে চাইছে। ছেলের মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে আমাদের পুটপুটিকে।”
আমি কিছুটা অবিশ্বাস কিছুটা সন্দেহ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তার মানে তৃপ্তি আমায় চিনতে পারেনি। আমি সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় নিজের মনখারাপ ভাবটাকে কাটিয়ে নিয়ে দায়িত্তবান অতিথিপরায়ণ মেয়ের বাবা হয়ে বাইরের ঘরে এসে ঢুকলাম। আর দেরি করা যায় না। চিনতে যখন পারেনি, যে করেই হোক এত ভালো সম্বন্ধটাকে পাকা করতেই হবে।
আরো ঘণ্টাখানেক বাদে ড. বিকাশ মজুমদার, তার ছেলে বউ আরও অন্যান্য আত্মীয়দের নিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে পড়লেন। আমার বউয়ের মুখটা আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে, আমি আলগোছে দেনাপাওনার কথা পাড়তেই ডাক্তারবাবু এমন ভাবে তাকিয়েছিলাম যে আমিই লজ্জায় পড়ে গেছিলাম। বললেন, ”আপনি তো সবচেয়ে দামি জিনিসটাই আমাকে দিয়ে দিচ্ছেন! আবার কি দেবেন! উল্টে আমারই আপনাকে মোটা ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।” হাসিহুল্লোড়ে সব কাজ শেষ হল। আমার মেয়েটাও ভারী খুশি, মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম। আনন্দে মনটা আমার ভরে উঠেছিল।
ওদের বিশাল দুধসাদা দামি গাড়িটা আমাদের ছোট গলিটাকে প্রায় ভরাট করে দাঁড়িয়েছিল। সবাই একে একে উঠছিল গাড়িতে। মালতী হবু বেয়াইয়ের সাথে হালকা রসিকতায় যোগ দিয়েছে। সবাই হাসছে। কত খুশি সবাই। তৃপ্তি উঠতে গিয়েও হঠাৎ নেমে এসে আমার দিকে এগিয়ে এল। চাপা অথচ স্পষ্ট গলায় কেউ শুনতে যেন না পায় এমনভাবে বলল, ”আপনার সব অপরাধ ক্ষমা করলাম আজ। শুধু পুটপুটির মতো একটা মেয়েকে তৈরি করেছেন বলে! ভালো থাকবেন বেয়াইমশাই।”