লুকোচুরি
সনাতনদা দরজার দিকে তাকিয়ে সোৎসাহে বলে উঠলেন, ”ওই যে, দিদিমণির রানার এসে গেছে! তাই তো বলি, আড়াইটে বাজতে চলল, এখনো দেখা নেই কেন?”
ছেলেটা সেলসম্যানসুলভ মিষ্টি হেসে বলল, ”কাকু আপনাকে সেদিন বললাম না, রানার নয়, আমার নাম সুশান্ত!”
পারমিতা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসতে গিয়েও গম্ভীর হয়ে গেল। ওদিকে গণেশদা ওপাশের কেবিন থেকে হাসতে হাসতে চাপা গলায় বলছে, ”আরে, ওর দ্যাখাদেখি তো গোমড়াথেরিয়াম সুমনও একই কাণ্ড শুরু করেছে, এই মাসে নয় নয় করে তিন বার জিনিস এল ওর! সত্যি বাপু, কি ভাইরাসই না ছড়াচ্ছ তুমি পারমিতা!”
পারমিতা কৃত্রিম হেসে সইসাবুদ করে চটজলদি ফ্লিপকার্টওলা কে বিদেয় করলো। সবার সামনে সুন্দর প্যাকেট করা জিনিসটা খুলতে ইচ্ছে করল না ওর। ইতিউতি চেয়ে সুট করে প্যাকেটটাকে ড্রয়ারে চালান করতে যাবে, এমন সময় সনাতনদার ঠিক চোখে পড়ে গেছে, ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ”কই, খোলো দেখি! জামা না জুতো, নাকি বাসন মাজার সাবান-টাবান? ওই রানার ছেলেটা তো আমাদের পাড়াতেই থাকে, সকালটায় ব্যাচ ব্যাচ পড়ায়, আর দুপুর হলেই ঝোলা নিয়ে বেরোয় এইসব পার্টটাইম করতে! দ্যাখো আজ কি এনেছে!”
পারমিতা অন্য প্রসঙ্গে কথা ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ বকে টকে সনাতনদাকে ওর ডেস্ক থেকে বিদায় করল। কথাটা অবশ্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। পারমিতার একটা বিদঘুটে স্বভাব হল, অনলাইন শপিং পোর্টাল থেকে সব কিছু কেনা, সে পোশাক আশাক জুতো মোজা থেকে শুরু করে রান্নাঘরের টুকিটাকি, বই-খাতা-পেন, কাজল-সানস্ক্রিন-লিপস্টিক মায় কাজের মাসির স্ক্রচ বাইট পর্যন্ত ও অনলাইনে কেনে। বছরদুয়েক আগে ফ্লিপকার্ট, আমাজন, স্ন্যাপডিল এইসব সাইট থেকে টুকটাক কেনা শুরু করেছিল, এখন সেটা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে আগের মাসে ভাইয়ের জন্মদিনে সাইকেল পর্যন্ত অনলাইনে কিনেছিল। সে কি কাণ্ড! ওদের এতবড় প্যাকেজিং দেখে মনে হচ্ছিল যেন সাইকেল নয়, আস্ত একটা চারচাকা গাড়ি এসেছে বাড়িতে!
অফিসেও সবাই পারমিতার এই বাতিক নিয়ে মজা-ঠাট্টা করে। ওদের এই ল্যান্ড রেভেনিউ অফিসের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সেকশনে পারমিতা আর সুমন বাদে বাকিদের বয়স ওদের বয়সের ডাবলেরও বেশি। বেশিরভাগেরই রিটায়ারমেন্টের আর দু-বছরও বাকি নেই।
সুমন বয়সে ছোট হলেও খুব গম্ভীর ধরনের, কথাবার্তা প্রায় বলে-ই না, কিন্তু পারমিতা সারাক্ষণ এই জ্যেঠুর বয়সি কলিগদের সাথে বন্ধুর মতো মেশে। তাই পারমিতাকে সবাই স্নেহের চোখেই দ্যাখে। ও ছাড়া বাকি সবাই এই আধা শহর আধা গ্রামেই থাকে, শুধু ওকেই তিনটে স্টেশন পেরিয়ে আসতে হয় রোজ। ওর এই অনলাইন শপিং-এর বাহার দেখে ওরা ভারী মজা পায়, আবার দরকারি কিছু কেনার হলে টুক করে পারমিতাকে দিয়ে অনলাইনে দামটা আর রিভিউটা একবার চেকও করিয়ে নেয়।
অন্যদিন হলে পারমিতা নিজেই সোৎসাহে প্যাকেট খুলে দেখাত আজ কি এল। কিন্তু আজ ও সেটা করল না। কারণ ও খুব ভাল করে জানে অন্তত ও নিজে কোন কিছু অর্ডার দেয়নি। ওর কপালের মধ্যিখানের ভাঁজটা আবার চওড়া হয়ে গেল।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে মাসখানেক হল। প্রায় প্রতি সপ্তাহে পারমিতাকে কেউ বা কারা একটা করে গিফট ফ্লিপকার্টের থ্রু দিয়ে পাঠাচ্ছে। আগে থেকে টাকা মেটান থাকায় পারমিতা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না কার কাজ এটা! দু-বার ফোন করেছে ফ্লিপকার্ট কাস্টমার কেয়ারে, তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছেন কাস্টমারের প্রাইভেসি রক্ষার স্বার্থে তাঁরা ডিটেইল জানাতে পারবেন না।
প্রথম দিনটা এখনো মনে আছে ওর। আগে প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিতে আসার আগে ফ্লিপকার্টের ছেলেটা ওকে একবার ফোন করে রুটিনমাফিক কনফার্ম হয়ে নিত, যে ও এই ঠিকানায় আছে কিনা। এটা মফসসল এলাকা, তাই এ চত্বরে ফ্লিপকার্টের প্রোডাক্ট একজনই সাপ্লাই দেয়। কিন্তু গত একবছর ধরে ওর এত হাজার হাজার প্রোডাক্ট আসে যে ছেলেটা ফোন-টোন আর করে না, সোজা এসে ওর কেবিনের বাইরে ঢাউস ব্যাগটা নামায়। সেদিনও কাজের ফাঁকে ছেলেটাকে দেখে ওর ভ্রূ কুঁচকে গেছিল, ও তো কোনো অর্ডার দেয়নি! পরক্ষণেই আর বেশি মাথা ঘামায়নি, দুমদাম, ট্রেনে-বাসে, এমনকি বাথরুমে বসেও ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে ও দুম করে ছোটখাটো এত জিনিস অর্ডার দিয়ে ফেলে, যে পরে নিজেই ভুলে যায়। কথা না বাড়িয়ে ও প্যাকেটটা নিয়ে টেবিলে রেখে দিয়েছিল। এমনিতে সারাবছর আহামরি যে কিছু কাজের চাপ থাকে তা নয়, কিন্তু মার্চ মাসটা একদম নিশ্বাস ফেলার অবধি টাইম হয় না। কাজ শেষে উঠে প্যাকেটটা হঠাৎ খেয়াল হতে যখন খুলেছিল, তখন হাঁ হয়ে গিয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসাধারণ ঐতিহাসিক ট্রিলজি ‘সেইসময়-প্রথম আলো-পূর্ব পশ্চিম’! আনন্দে পুলকিত হতে গিয়েও ও অবাক হয়ে গিয়েছিল, ও তো এটা কস্মিনকালেও অর্ডার দেয়নি! কে পাঠাল ওকে এটা?
আমতা আমতা মনে বই তিনটেকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল পারমিতা। হ্যাঁ এটা ঠিক, এই তিনটে বই নিজের সংগ্রহে রাখার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল পারমিতার। এই তো সেদিনই কথায় কথায় অফিসে বলছিল ও, এই তিনটে বইয়ের জন্য প্রতিটা বাঙালির সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ঋণী থাকা উচিত! এটাও দুঃখ করে বলেছিল যে, লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়লেও ওর অনেকদিনের ইচ্ছে এই বই তিনটেকে বাড়িতে নিজের কাছে রাখবে। কিন্তু কোনো না কোনো কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু তাই বলে অন্য কারুর কাছ থেকে কেন নেবে ও? তাও আবার অচেনা কেউ! এমনিতেই মনটা খারাপ হয়েছিল, তার ওপর এই ঘটনায় আরো তেতো হয়ে গেল ওর মনটা। এক মুহূর্তের জন্য পার্থর নামটা মনে আসতেই ঝটিতি সে সম্ভাবনা বাতিল করেছিলো পারমিতা। চার বছরের দীর্ঘ সম্পর্কে যে কোনোদিন পারমিতার ইচ্ছে অনিচ্ছের মূল্য দেয়নি, পারমিতার এই বই প্রীতিকে ‘ব্যাকডেটেড’ বলে উপহাস করেছে, যে এইসমস্ত ক্লাসিক পড়ার থেকে ক্লাবে গিয়ে স্থূল রসিকতা আর মাতলামি করে বেশি আনন্দ পায়, সে কিনা পারমিতাকে এটা পাঠাবে! তাও আবার বিয়ে ঠিক হয়েও তিক্তভাবে ভেঙে যাওয়ার পর! অসম্ভব!
অফিস থেকে যখন ট্রেনে একলা বাড়ি ফেরে, তখন জানলার ধারে বসে মাঝে মাঝে আনমনে ভাবে পারমিতা! সত্যি! কি করে যে ওদের দুজনের সম্পর্ক এতদিন টিকল, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। দুজনের মধ্যে কোনো দিকেই কোনো মিল নেই, না মানসিকতায়, না রুচিতে, না পছন্দ-অপছন্দে। পারমিতা চিরকালই বই-লেখালেখি-গান এইসব নিয়ে থাকতে ভালোবাসে, নিজের পছন্দগুলোকে বিসর্জন দেবে না বলেই ব্যাঙ্কের দারুণ চাকরিটা পেয়েও ছেড়ে দিয়ে রাজ্য সরকারের এই চাকরিতে ঢুকেছিল ও, অপেক্ষাকৃত কম মাইনে হলেও এখানে কাজের চাপ অনেক কম, ও সারাটা জীবন নিজের ভালোলাগাগুলো পারস্যু করতে পারবে। চাকরিসর্বস্ব জীবন ওর কোনোকালেই পছন্দ নয়। সরকারি চাকরির কোচিং নিতে গিয়ে পার্থর সাথে ওর আলাপ। যদিও পার্থ কোনোদিনই এইসব চাকরি করার বা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না, কোনো বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ভর্তি হয়ে মাস তিনেক বাদেই ছেড়ে দেয়। ওর দ্বারা ঐ দশটা পাঁচটার চাকরি হবে না, তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না, কারণ ওদের অগাধ টাকাপয়সা। পারমিতার বাড়ি স্বচ্ছল হলেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জেদটা ওর মধ্যে বরাবরই ছিল।
ট্রেনের দমকা হাওয়ায় চুল ঠিক করতে করতে ভাবে পারমিতা, বছরখানেক ধরেই হয়তো পার্থ হাবেভাবে বোঝাচ্ছিল ও আর টানতে চায় না এই রিলেশন, ও-ই বুঝতে পারেনি। শেষে পার্থর বাড়ির লোক যখন পারমিতাদের বাড়ি এসে পার্থর সামনেই দুই পরিবারের স্টেটাসের বৈষম্যের কথা তুললেন, তখন পার্থর নীরব সম্মতি মাখানো চোখটা দেখেই পারমিতা পিছিয়ে এসেছিল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে পারমিতা, খুব ভালো ডিসিশন নিয়েছে ও। নিজের মতো করে বাঁচছে যেন ও এবার! কিন্তু মাঝখান দিয়ে এই উটকো গিফটের বহরে ও দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে।
এরপর প্রতি সপ্তাহে একটার পর একটা প্রোডাক্ট আসতে শুরু করল। কোনো সপ্তাহে সমরেশ মজুমদারের ‘কালপুরুষ’ তো কোনো সপ্তাহে একটা দারুণ পার্কার পেনের সেট। কোনো সপ্তাহে আবার সুন্দর কলমকারি কাজ করা কুর্তি। ভেবে ভেবে পারমিতার মাথা খারাপ হয়ে যেতে লাগল।
আজকের গিফটটাও নিয়ে তেমনি আনমনে ও ট্রেনে বসেছিল। বারকয়েক ভেবেছে ক্যুরিয়ারের ছেলেটাকে বলে দেবে যে ও প্রোডাক্টটা নেবে না, কিন্তু আগে থেকে টাকা মেটানো প্রোডাক্ট নিতে রিফিউজ করলে কি ভাববে সবাই, এই লজ্জায় ও বলতে পারেনি। কিন্তু দিনে দিনে তো সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে! আজকের প্যাকেটটায় রয়েছে খুব সুন্দর শান্তিনিকেতনের কাজ করা একটা ঝোলা ব্যাগ, তাতে ফেব্রিক দিয়ে লেখা গীতাঞ্জলির একটা কবিতার প্রথম স্তবক- ”জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই, ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।”
সেটা দেখতে দেখতে পারমিতার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। যে-ই পাঠাক, সে আর কিছু না হোক, পারমিতার পছন্দ-অপছন্দ খুব ভালো করে জানে। ও কি বই পড়তে ভালোবাসে, কেমন জামা পড়ে, কিরকম ব্যাগ নেয়, সব তার জানা। ওর আবার মনটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। কে হতে পারে? কলেজের বন্ধুদের সাথে এখন আর তেমন যোগাযোগ নেই বললেই চলে, তাছাড়া তারা কেউ পারমিতার অফিসের ঠিকানাও জানে না। বাকি রইল অফিস। হঠাৎ পারমিতার মাথায় ধাঁ করে একটা সম্ভাবনা উদয় হল। আচ্ছা, সুমনের কাজ নয় তো! পরক্ষণেই ওর মনে হল, ধুর, ও ব্যাটা তো কথাই বলে না কারুর সাথে! চুপচাপ কাজ করে যায় মুখ বুজে।
পরের দিন পারমিতা অফিসে ঢুকেই দেখল তখনো কেউ আসেনি সুমন ছাড়া। এই সুযোগ। ও সুমনের একদম মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করল, ”এই শোন তুমি আমাকে ফ্লিপকার্টে প্রোডাক্ট পাঠাও?”
পারমিতা বইতে পড়েছে অপরাধীকে সরাসরি গিয়ে দুম করে প্রশ্ন করলে সে সত্যিটা স্বীকার করে ফেলে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হল না। সুমন বেজার মুখে চোখ কুঁচকে মুখ তুলল, ”মানে! আমি তোমাকে প্রোডাক্ট পাঠাব? কেন? আমি কি পাগল নাকি!”
ফাঁদটা কাজে তো লাগলোই না, উল্টে অপ্রস্তুত হয়ে পারমিতা নিজের ডেস্কে ফিরে এল। অসহ্য লাগছে! এগুলো কি ধরনের বেয়াদপি! একবার মনে হল, সনাতনদা গণেশদা এদের কাজ নয়তো! পরক্ষণেই মনে হল, ধুর, ঠিক করে গুগলই খুলতে পারে না, ওরা আবার অনলাইনে অর্ডার করবে! তাহলে? কে এটা করছে? কেনই বা করছে?
অন্যমনস্ক থাকার কারণে কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না পারমিতা। পার্থর সঙ্গে সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর এই কয়েকমাসে তো সবকিছু বেশ সামলে নিয়ে নিজের মতো করে চলছিল, হঠাৎ এ কি উপদ্রব? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ পড়ল নিজের জামায়, সেই কলমকারি প্রিন্টের কুর্তি, নিজের অজান্তেই মনটা নরম হয়ে এল ওর। কে ওর ভালোলাগাগুলোর এত মর্ম বোঝে, তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ। যতই বাইরে রাগ হোক, এই ক-দিনে সেই অদেখা অজানা উপহারদাতার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা জন্মেছে পারমিতার।
হঠাৎ সনাতনদার জোর গলায় কথায় চিন্তার জ্বাল ছিঁড়ে যায় ওর, চমকে তাকিয়ে দেখে, সনাতনদা কাকে যেন বলছেন, ”পাঞ্জাবিটা তো জব্বর পরেছ সুবলদা, কোত্থেকে কিনলে?”
‘সুবলদা’ নামক লোকটা বলল, ”আরে, ছোটছেলে করে দিয়েছে গো, ওর তো খুব ভালো আঁকার হাত! পাঞ্জাবিটার ওপর ও-ই এসব লিখেছে-টিখেছে।”
সনাতনদা দু-হাত কোমরে দিয়ে বলল, ”বটে! তোমার ছোটছেলের তো অনেক গুণ দেখছি! এত ভালো আঁকে, এত ছেলেপিলে পড়ায়, আবার ক্যুরিয়ার সার্ভিসেও কাজ করে!”
পারমিতা আনমনে ওই সুবলবাবুর সুতির পাঞ্জাবিটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল, ওর ব্যাগের ওপর গীতাঞ্জলির যে দুটো পঙক্তি লেখা, তার ঠিক পরের দুটো পঙক্তি লেখা ওই পাঞ্জাবিতে, ”মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই, চাহিতে গেলে মরি লাজে!”
পারমিতা বিস্ফারিত চোখে দেখল, হাতের লেখা থেকে শুরু করে হরফগুলোর টান, রঙ সব-ই এক! ও সেদিকে তাকাতেই সনাতনদা বললেন, ”এই দ্যাখো সুবল, এই হচ্ছে আমাদের দিদিমণি। অবশ্য তোমার ছেলে ওকে ভালো করেই চেনে।” তারপর পারমিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ”তোমার রানারের বাবা, বুঝলে দিদিমণি?”
পারমিতার যা বোঝার যা আগেই বোঝা হয়ে গিয়েছিল। রাগে ওর ব্রহ্মতালু জ্বলছিল। ঠিক, ক্যুরিয়ারের ওই ছেলেটার সামনেই তো ও সেদিন বলেছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইগুলোর কথা! জীবনে এই প্রথম, নিজের রুচি, ভালোলাগার সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে একজনকে পেয়েছিল, তার কাছ থেকেও এমন ফাঁকি! অনেক কষ্টে নিজের রাগ চেপে রেখে বলল, ”আপনার ছেলেকে আজ একবার স্টেশনে আসতে বলবেন প্লিজ, পাঁচটার সময়, ভীষণ দরকার!”
পাঁচটা সতেরোর ডাউন লোকাল যখন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল, তখন ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের একদম শেষের একটা বেঞ্চিতে বসেছিল পারমিতা আর সুশান্ত। পারমিতার রাগ তখনো পড়েনি। সুশান্ত মিনমিন করে যাই বলতে যাচ্ছিল, প্রবলদর্পে থামিয়ে দিচ্ছিল পারমিতা। তবু সুশান্ত বলল, ”তুমি চাকরি করো, আমি তো এখনো চাকরি পাইনি, তাই ভয়ও হচ্ছিল বলতে কি করব বল! তাই, নিজেই ওগুলো অর্ডার দিতাম। আর ওই ব্যাগটা প্যাকেট থেকে বের করে লাইনগুলো লিখে আবার প্যাক করে দিয়েছিলাম!”
পারমিতা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, ”এত কাণ্ড করতে পারলে, এক মাস ধরে এত পয়সা খসিয়ে আমাকে টেনশন দিলে, আর একবারও মুখ ফুটে বলতে পারলে না! এত লুকোচুরি?”
সুশান্ত মাথা নাড়ল, এতক্ষণে একটু সাহস পেয়ে ভয়ে ভয়ে পারমিতার একটা হাত ধরল, অস্ফুটে বলল, ”মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই, চাহিতে গেলে মরি লাজে!”