পটীয়সী

পটীয়সী

ঝিমলি কি করে যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার মধ্যেই ওর মনে হল আর এক সেকেন্ডও ওয়েট করা যাবে না, এক্ষুনি টয়লেট যেতে হবে। ঝিমলির ছোট্ট থেকে এই এক বিচ্ছিরি অভ্যেস, টেনশন হলেই পটি পেয়ে যায়। কোথাও কোনো পেট খারাপের চিহ্ন নেই, কোনো পেট কামড়ানো বা গুড়গুড় নেই, দিব্যি ঝকঝকে নীল আকাশের মতো পরিষ্কার পেট, কিন্তু টেনশন শুরু হলেই কোত্থেকে যেন কালবৈশাখীর মতো ধেয়ে আসে পটি, আর সে পটি এমন পটি, যে চেপে বসে থাকা তো দূর, যতই মনকে অন্যদিকে ঘোরাক না কেন, যতই সোজা হয়ে, জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে, কোমরের বেল্ট আলগা করে বসার চেষ্টা করুক, কিছুতেই কিছু হয় না। এদিকে সেইসময় তড়িঘড়ি বাথরুমে ঢুকলেই সে পটি পি সি সরকারের ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে যায়। সেই ছোট থেকে যতবার কোনো কম্পিটিশনে গেছে, সে আবৃত্তি বা বসে আঁকো হোক, বা ক্যুইজ, সবেতে একই ব্যাপার। এই তো এবারেই, জয়েন্টে ভালো র‌্যাঙ্ক করার জন্য পাড়ার ক্লাব সংবধনা দেবে, সেখানেও এক কেস। স্টেজে ওঠার আগেই ঝিমলির মারাত্মক বেগ, সে একেবারে প্যান্ট নোংরা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! বাবা তো রেগেমেগে অস্থির, চেঁচাতে লাগল জোরে জোরে, ‘প্রত্যেকবার, প্রতিটা বার এই এক জিনিস! তোর দ্বারা কিছু হবে না! এতবড় ধেড়ে মেয়ে, আর কোনো কন্ট্রোল নেই! বাচ্চাদের যে পটিগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো পেছনে আটকে ঘুরতে পারিস তো!’ বাবা রেগে গেলে কোনোদিনই লোকজন মানে না, আশপাশের দশটা লোককে শুনিয়ে তারপর অনন্তকাকুদের বলে ঝিমলিকে পাশের একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। ওমা, বাথরুমে ঢোকার আগে পর্যন্ত মনে হচ্ছিল আর ধরে রাখতে পারবে না, আর যেই গিয়ে কমোডে বসেছে, অমনি বাছাধন হাপিস! রাগে দুঃখে ঝিমলির চোখে জল এসে যায়। প্রত্যেকবার এইরকম শাস্তি! কারুর ভালো লাগে?

আজকেও ঠিক এক জিনিস। একেই কলেজ শুরু হবার পর আজ তিন নম্বর দিন, রোজই টুকটাক র‌্যাগিং হচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় পেটটা গুড়গুড় করছে। তার ওপর, এখনো পর্যন্ত ওর ক্লাসের একমাত্র বন্ধু তৃষিতা কালকেই জানিয়ে দিয়েছিল আজ আসবে না, ওর কোনো দাদার বিয়ে, অতএব সারাটা দিন ওকে প্রায় একাই থাকতে হবে কলেজে। আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, একা মানেই সিনিয়রদের মুখের সামনে পড়ো। যদিও এখন অ্যান্টি র‌্যাগিং সেল হয়েছে, বেশি বাড়াবাড়ি হয় না, তবু যেটুকু হবে, সেটুকু ভেবেই আজ সকাল থেকে ঝিমলির টেনশন শুরু হয়ে গেছে। মা বলল, ‘কি হল, কাল পরশু তো ঠিকই ছিলি, আজ আবার শুরু করলি কেন। উফ, এত ডাক্তার দেখিয়েও তোর এই রোগ কিছুতেই কাটল না!’

দশটা থেকে ক্লাস, কিন্তু আজ ঝিমলি ন-টা পনেরোর মধ্যে কলেজে এসে ক্লাসে বসে পড়েছে। পরপর টানা ক্লাস হয়ে গেলে বাঁচা যায়, মাঝে কোনো গ্যাপ থাকলেই সিনিয়রগুলো ঢুকে পড়ছে, আর তারপর তাদের সে কি উৎপাত! তাও তৃষিতা মেয়েটা বেশ চালাক-চতুর, কায়দা করে কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছিল, ওর সঙ্গে লেজুড় হয়ে থেকে ঝিমলিও বেশ নিশ্চিন্তে ছিল, কিন্তু আজ সেই সুযোগও নেই!

প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। প্রায় পাঁচ মানুষ উঁচু সিলিং, কড়ি বরগা, তার থেকে বিশাল লোহার রডে ঝুলছে কালো মিশমিশে প্রাগৈতিহাসিক কয়েকটা ফ্যান। প্রায় একশো জন বসার মতো ক্লাসরুম। এত কষ্ট করে, এত খেটেখুটে এখানে পড়ার চান্স পাওয়া, তারপর এইরকম টেনশ, কারুর ভালো লাগে? ঝিমলি হঠাৎ কেঁপে উঠল নিজের অজান্তেই, আজ যদি আবার সেই দিদিটা আসে? চোখে জল চলে এল ওর।

কাল তৃষিতা কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছিল, ঝিমলি চুপচাপ বসেছিল নিজের ডেস্কে, ফাঁকা ক্লাস, পাঁচ-ছয়টা সিনিয়র দাদা এসে সবাইকে নাম ধাম কি পড়তে ভালো লাগে এসব জিগ্যেস করছিল। ও নিজের মনে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটছিল, হঠাৎ একটা রোগা লম্বা চশমা পরা দিদি এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে, ‘কিরে, কি নাম তোর?’

ও মিনমিন করে নিজের নাম বলেছিল। আরো কিছু টুকটাক কথার পর দিদিটা বলেছিল, ‘ফেভারিট সাবজেক্ট কি?’

ঝিমলির সবচেয়ে ভালো লাগে অঙ্ক, কিন্তু কাল ক্লাসের একটা ছেলে অঙ্ক বলাতে এমন কঠিন কয়েকটা ক্যালকুলাসের ইন্টিগ্রেশন করতে দিয়েছিল যে ছেলেটা পারেনি। তারপর সে কি ইনসাল্ট! তাই ঝিমলি আর সেই পথে হাঁটল না, বলল, ‘কেমিস্ট্রি’।

দিদিটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘বটে? তবে ইলেকট্রনিক্স পড়তে এলি কেন?’

ঝিমলি কি উত্তর দেবে, মুখে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে চেয়েছিল, এমন সময় দিদিটা বলল, ‘কেমিস্ট্রিতে ফ্ল্যুইডের ব্রাউনিয়ান মোশান পড়েছিস? বলতে পারবি?’

ততক্ষণে ঝিমলির নার্ভাসনেস অনেকটা কেটে গেছে, কেমিস্ট্রিতে ছিয়ানব্বই পেয়েছে উচ্চমাধ্যমিকে, আর ব্রাউনিয়ান মোশান বলতে পারবে না ইয়ার্কি নাকি! বেশ সপ্রতিভভাবে ও বলা শুরু করেছিল ফ্ল্যুইড, অর্থাৎ গ্যাস বা কোন লিকুইডের পার্টিকলগুলো কিরকমভাবে র‌্যান্ডম ওয়েতে নিজেদের মধ্যে কলিশন করতে করতে এদিক থেকে প্রচণ্ড গতিতে ওদিকে ছুটে বেড়ায়, সেটাকেই বলে ব্রাউনিয়ান মোশন। বোঝাবার সময় হাত দিয়ে ও বোঝাচ্ছিল পুরো সিস্টেমটা। দিদিটাও বেশ মন দিয়ে শুনছিল। ওর বলা হয়ে গেলে বলল, ‘গুড। এবার প্র্যাকটিকাল করে দ্যাখা।’

ঝিমলি বলতে বলতে থতমত খেয়ে বলল, ‘প্র্যাকটিকাল! মানে?’

দিদিটা বলেছিল, ‘ধর, তুই নিজে একটা গ্যাসের পার্টিকল, আর তোকে একটা বড় এয়ারটাইট জারে রাখা হয়েছে, ধর জারটা হল এই ক্লাসরুমটা। তুই কিভাবে ব্রাউনিয়ান মোশানে এদিক থেকে ওদিকে ছুটে বেড়াবি, সেটা করে দ্যাখা, ক্যুইক! ও হ্যাঁ, সঙ্গে মুখ দিয়ে একটা সুপারসোনিক আওয়াজও করবি।’

ঝিমলির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল শুনতে শুনতে। এ কি সাংঘাতিক কথা! ক্লাসে প্রায় পঞ্চাশের ওপর ছেলেমেয়ে, তার মধ্যে চল্লিশজনই প্রায় ছেলে, সেখানে ওকে সারা ক্লাসরুম এরকম করে এদিক থেকে ওদিকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ছুটে বেড়াতে হবে?

ততক্ষণে বাকি সিনিয়রগুলো মজা টের পেয়ে এদিকে চলে এসেছে। ঝিমলির মুখচোখ দেখে একটা দাদার বোধহয় দয়া হল, চুপিচুপি দিদিটাকে বলল, ‘এই অদিতি, মেয়েটা মনে হচ্ছে এবার কেঁদে ফেলবে! ছেড়ে দে, কি দরকার!’

অদিতি বলে দিদিটা তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিল, ‘তুই চুপ কর তো! এগুলো আবার র‌্যাগিং নাকি! এটুকুও স্মার্টনেস না থাকলে ক্যাম্পাসিং-এ বসবে কি করে! আমাদের এর চেয়ে কত বেশি সব করতে হয়েছিল, হুহ!’

ঝিমলি পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল, দিদিটা আরো দু-একবার তাড়া দিতে ওর চোখ দিয়ে বড় বড় জলের ফোঁটা নেমে এসেছিল। ও এমনিই শান্তশিষ্ট লাজুক ধরনের, তার ওপর এমন প্রগলভতা ও মরে গেলেও করতে পারবে না! চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও ভাবছিল কি করবে, তার মধ্যে হঠাৎ ওর চিরশত্রু জানান দিতে শুরু করেছিল, এমন পটি পাচ্ছিল, যে ও ‘বাথরুম যাচ্ছি’ বলেই ছুট লাগিয়েছিল ওয়াশরুমের দিকে। ওয়াশরুমে গিয়ে যথারীতি সেই পটি ভ্যানিশ।

মিনিট দশেক বাদে যখন ক্লাসে ফিরেছিল, তখন পরের প্রোফেসরের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, তারই মধ্যে পাশের দার্জিলিং থেকে আসা সোনম বলে মেয়েটা চুপিচুপি জানিয়েছিল ওই দিদিটা নাকি খুব রেগে গেছে ও এরকম ধুম করে পারমিশন না নিয়ে বেরিয়ে গেছে বলে, সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে পরের দিন আসবে বলে গেছে।

ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গেছিল ঝিমলি, হঠাৎ গুনগুন আওয়াজ হতে সম্বিত ফিরে পেয়ে দ্যাখে, অনেকেই চলে এসেছে ক্লাসে এরমধ্যে। ঘড়িতে দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। ওর পাশে এসে বসেছে সোনম বলে কালকের সেই মেয়েটা। চোখাচোখি হতে মেয়েটা হেসে বলল, ‘টেনশন হচ্ছে?’

ঝিমলি ম্লান মুখে মাথা নাড়ল।

সোনম আবার ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, ‘তাও তো তুমি যাওয়া-আসা করো। আমাদের মতো হস্টেলে থাকলে তো আরও র‌্যাগিং সহ্য করতে হত তোমায়।’

ঝিমলি কোনো উত্তর না দিয়ে চেয়ে রইল।

সোনম বলল, ‘তুমি এক কাজ করবে, কালকের ওই দিদিটা হস্টেলেই থাকে তো, আমার কাছে খবর আছে, আমাদের সেকেন্ড ক্লাস তো প্রোফেসর গাঙ্গুলির, উনি আজ আসবেন না, ছুটিতে আছেন, আর ওরা ওই সময়েই আসবে ক্লাসে। তুমি ফার্স্ট ক্লাস শেষ হলেই স্যারের সাথে সাথে বেরিয়ে যাবে বুঝলে!’

ঝিমলি অস্ফুটে বলল, ‘বেরিয়ে যাবোটা কোথায়! ওয়াশরুমে কতক্ষণ থাকব! আর কেউ দেখে ফেললে?’

সোনম বলল, ‘না শোন, এই রুমটার পেছন দিকে আরেকটা রুম আছে, ৭ নম্বর রুম। ওটা ফাঁকা থাকে। ওখানে গিয়ে বসে থেকো।’

ঝিমলি বলল, ‘কিন্তু আজকে না পেলে তো আবার কাল আসবে।’

সোনম দুদিকে মাথা নাড়ল, ‘না না, ওরা থার্ড ইয়ার তো, আজ রাতের ট্রেনেই ওরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং-এ যাচ্ছে এক মাসের, ফিরবে একমাস পর। ততদিনে তো তোমাকে আর চিনতেই পারবে না!’

ঝিমলি এতক্ষণে একটু আশার আলো দেখতে পেয়ে নড়েচড়ে বসল। এইটা একটা ভালো রাস্তা, নো ডাউট! চল্লিশ মিনিটের তো ব্যাপার, চুপচাপ গিয়ে বসে থাকবে, ফোনে গেম টেম খেলবে, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ঠিক হল, ওরা বেরিয়ে গেলে সোনম মেসেজ করে দেবে ওকে।

প্ল্যানমাফিক ফার্স্ট পিরিয়ড শেষের সঙ্গে সঙ্গে ঝিমলি মোবাইলটা মুঠোয় গুঁজে হাঁটা লাগাল পেছনের সাত নম্বর রুমের দিকে। আড়চোখে একবার সোনমের দিকে তাকাল, মেয়েটা বুড়ো আঙুল উপরের দিকে তুলে অভয়ের ভঙ্গি করল ওকে। তাড়া খাওয়া চড়াই পাখির মতো ছুটতে ছুটতে ও সাত নম্বর রুমের সামনে এসে দেখল, রুমের দরজা ভেজানো। পুরনো দিনের ভারী পাল্লা, দু-হাতে টেনে খুলে ভেতরে ঢুকেই আবার দরজা ভেজিয়ে দিল ও।

কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে টাপিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলল ও, ফাঁকা আলো- আঁধারি ক্লাসরুম, দূরে মাকড়সার বিশাল জাল, ভালো করে দেখতে গিয়ে ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। ক্লাসের ঠিক ফার্স্ট বেঞ্চটায় বসে আছে একটা ছেলে।

ঝিমলির মনে হল ওর ভেতরের প্যান্টটা আর শুকনো নেই, আস্তে আস্তে ভিজতে শুরু করেছে। যে সিনিয়রদের ভয়ে পালিয়ে এল, এখানে ফাঁকা ক্লাসরুমে তাদেরই একজনের খপ্পরে পড়ল? প্রথম দিনই কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোন সিনিয়রকে কোন ইয়ার জিগ্যেস করা যাবে না।

ভয়ে উদবেগে ও ঘামতে শুরু করেছে, এমন সময় ছেলেটা চোখ বড় বড় করে অল্প তুতলে বলল, ‘তু-তুমি সিনিয়র?’

টেনশনে প্রায় গলে যেতে যেতেও শেষ মুহূর্তে ঝিমলি নিজেকে সামলে নিলো, নাহ! এতো মনে হচ্ছে সেমসাইড গোল। ছেলেটা যেরকম ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে আছে, এ নির্ঘাত ফার্স্ট ইয়ার না হয়ে যায় না। ঝিমলিরই মতো ভয়ে এখানে লুকিয়ে আছে শিওর। ও এবার স্মার্ট গলায় বলল, ‘ফার্স্ট ইয়ার আমি। তুইও তাই?’

ছেলেটা এবার একটা বড় নিশ্বাস ফেলে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। ইলেক্ট্রিক্যাল। তুই?’

ঝিমলি কোমরে হাত দিয়ে জেরার ভঙ্গিতে বলল, ‘ইলেকট্রনিক্স। তা এখানে কেন?’

ছেলেটা এবার বেশ সহজ হয়ে উঠেছে, বলল, ‘আরে, হস্টেল থেকে থ্রেট দিয়ে রেখেছে দুটো সেকেন্ড ইয়ার, আজ কলেজে এসে ওদের দেখিয়ে দেওয়া একটা মেয়েকে গিয়ে প্রপোজ করতে হবে। তাই এখানে লুকিয়ে রয়েছি।’

ঝিমলি বলল, ‘সত্যি! এরা কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে বল! ভিসি-কে গিয়ে বলবি?’

ছেলেটা দুদিকে মাথা নাড়ল, ‘কোনো লাভ নেই। গায়ে হাত টাত দিলে অন্য কথা, আদার ওয়াইজ ভারবাল র‌্যাগিং-এর কোনো প্রূফ নেই, মাঝখান থেকে মার্কড হয়ে যাব। কি দরকার! আর বড়জোর দু-তিনটে তিন চলবে, তারপর তো ওরাও ট্রেনিং এ বেরিয়ে যাবে।’

ঝিমলি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল, ‘হুম! সেটা ঠিক। তোর নাম কি?’

ছেলেটা বলল, ‘পুষ্পম। তোর নাম কি?’

ঝিমলি উত্তর না দিয়ে বলল, ‘তুই হস্টেলে থাকিস? বাড়ি কোথায় তোর?’ প্রশ্নটা করার সময় ও লক্ষ করল, এই পুষ্পম বলে ছেলেটার চোখের পাতাগুলো অসম্ভব ঘন আর টানা টানা। গালের সদ্য গজানো সবুজ দাড়িটার ওপর এক ফালি রোদ এসে পড়েছে। সেই দাড়ির ওপর টোল দেখতে দেখতে ওর হঠাৎ নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, মনে হল এত মিষ্টি ছেলে ও জীবনে কখনো দেখেনি। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট কি একেই বলে? ও কিরকম খাবি খেতে খেতে বেলল, ‘আ-আচ্ছা, লেডিজ টয়লেট এদিকে কোথাও আছে কিনা জানিস? আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে!’

আর সময় পেল না ঝিমলি। কে যেন ভীষণ জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে চোখ খুলে ও দেখল, ওর চোখের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেখছে পুষ্পম। ঝিমলি বলল, ‘কি হয়েছে?’

পুষ্পম কপট রাগের ভঙ্গি করল, ‘কি আবার হবে! এতদিন পটীয়সী বউ কপালে ছিল, এখন কপালে জুটেছে পটীয়সী মেয়ে। উফ! একটা নরফ্লক্স দাও শিগগিরই। সারারাত তো একফোঁটা ঘুমোতে পারলাম না, কোলে নিয়ে একবার করে যাচ্ছি, কমোডে বসছে, বসেই বলছে, বাবা, পটিটা লুকিয়ে পড়েছে, আবার নিয়ে এসে খাটে শোয়াচ্ছি। তারপর আবার পাঁচ মিনিট বাদেই বলছে বাথরুম যাব। পুরো তোমার রোগ পেয়েছে, কাল ওদের ক্লাস ট্যুর আনুয়াল প্রোগ্রাম না! মা মেয়ে পুরো জেরক্স কপি যেন, অলওয়েজ ছিপি খোলা!’

ঝিমলি ঘুমচোখে উঠে বসল। বারো বছর আগের সেই দিনগুলো কেন যে ও প্রায়ই স্বপ্নে দ্যাখে! পুষ্পম সারাটা রাত জেগে, ইশ! পাশে শুয়ে থাকা সাড়ে ছয়বছরের মেয়ের দিকে চেয়ে ও হেসে ফেলল, সেই কলেজের সেইদিন থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসিং, প্রথম চাকরির দিন, বিয়ের দিন, ফুলশয্যার রাতে, এমনকি হানিমুনে গিয়েও পুষ্পমকে এই পটি পটি করে উৎপাত করে মেরেছে ও। পুষ্পম বেচারা, মুখ বুজে এই দৌরাত্ম্য সহ্য করে, কোথায় কোথায়, মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে, লোক ডেকে খুঁজে খুঁজে বাথরুম বের করেছে ঝিমলির জালায়! মাঝে মাঝে বলে, ‘আচ্ছা, তোমার এই ব্যাপারটার কোনো সিগন্যাল নেই? যখন তখন যেখানে সেখানে হাজির হয়ে যায়?’ বাবা-মা তো আজও বলে, পুষ্পম ছাড়া কেউ সহ্য করত না ওর এই বিদঘুটে রোগ। আর ঝিমলি? মনে মনে অদিতিদিকে ধন্যবাদ দেয় ও।

পুষ্পম ওর দিকে তাকিয়ে ছিল, হাই তুলে বলল, ‘কি হল? হাঁ করে কি দেখছ?’

ঝিমলি দেখল, সেদিনের সেই সবুজ দাড়িগুলোর দু-একটা রূপোলি পাক ধরেছে, সেই টানা টানা ঘন চোখের পাতাগুলো সপ্রেম দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ওর হঠাৎ প্রচণ্ড নিজের স্বামীকে আদর করতে ইচ্ছে করল। আস্তে আস্তে বলল, ‘এই, আমারও পটি পেয়ে গেছে! তুমি ঘুমিও না, আমি এক্ষুনি আসছি!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *