দোলগোবিন্দবাবুর চশমা

দোলগোবিন্দবাবুর চশমা

পটলা ডাইনিং-এ এসে চায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই দোলগোবিন্দবাবু গরম তেলে পড়া পাঁচফোড়নের মত চিড়বিড়িয়ে উঠলেন, ”রোজ রোজ এক কথা জিজ্ঞেস করিস কেন রে হতভাগা? দিবি তো দে, না দিবি তো বিদেয় হ’ এখান থেকে!”

পটলা একটু হকচকিয়ে মানে মানে রান্নাঘরের দিকে কেটে পড়ল। বাবু এমনিতে তো বেশ শান্ত, এরকম চেঁচামেচি তো কোনোদিন করে না, আজ হলটা কি!

হয়েছেটা যে কি সেটা দোলগোবিন্দবাবু নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে মেজাজটা মারাত্মক খিঁচড়ে আছে সন্দেহ নেই। খিঁচড়ে থাকার যথেষ্ট গুরুতর কারণও আছে। তাও আবার একটা কারণ নয়, দু-দুটো কারণ। প্রথম কারণটার জন্যই দ্বিতীয় কারণটা ঘটেছে, আর দ্বিতীয়টাই বেশি চিন্তার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরশু সন্ধেবেলা ছিল রবিবার, অফিসের কলিগ অজয় তার অতীব বেয়াদপ বছরদশেকের ছেলেকে নিয়ে এসেছিল দোলগোবিন্দবাবুর বাড়ি। এদিকে কি কাজ ছিল, তাই ঘণ্টাখানেকের জন্য দেখা করে গেল। তার মধ্যেই সেই বিচ্ছু ছেলেটা একগাদা ক্ষতি করে দিয়ে গেল। প্রথমে পটলার আনা কাঁচের গ্লাস ভর্তি শরবৎ উল্টে একাকার করলো, তারপর চাউমিনের নুডলসগুলো রিং করে করে খেতে গিয়ে দোলগোবিন্দবাবুর সাধের সোফায় একগাদা ফেলল। দোলগোবিন্দবাবু তো রাগে দাঁত কিড়মিড় করছেন মনে মনে, এইসব বাচ্চাদের নিয়ে কেউ লোকের বাড়ি আসে! এরা হচ্ছে যাকে বলে গিয়ে খুদে একেকটা অ্যান্টিসোশ্যাল বম্ব! অবশেষে সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা করে ক্ষান্ত হল, দোলগোবিন্দবাবুর কাল সকালেই কিনে আনা নতুন সানগ্লাসটা ‘একটু দেখছি’ বলে নিয়ে সেটার ডাঁটি বেঁকিয়ে, তার কাচে দাগ বসিয়ে দিল।

এমনিতে দোলগোবিন্দবাবু একা বোকা মানুষ, নিজেকে নিয়ে থাকতেই ভালোবাসেন। বিয়ে করলে হাজার ঝঞ্ঝাটে জড়াতে হবে ভেবে আর ও-পথ মাড়াননি। এখন তো এইসমস্ত খুদে দুষ্কৃতীদের দেখে মনে মনে নিজেকে অশেষ ধন্যবাদ দেন তিনি। অফিস আর বাড়ি ফিরে অ্যাকোরিয়াম ভর্তি মাছ, সঙ্গে চাকর পটলা এই নিয়েই কাটে তাঁর জীবন। কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলেন, সকাল সাড়ে ন-টার সময় যখন অফিস বেরোন, এত রোদ, চোখ তুলে তাকানো যায় না, যেন ধাঁধা লেগে যায়। পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু দিনদিন পালটে যাচ্ছে। তাই কাল সকালে অনেক সাধ করে রে-ব্যানের দামি সানগ্লাসটা কিনেছিলেন। এমনিতে দোলগোবিন্দবাবু ভীষণ হিসেবি মানুষ, বাজে খরচা একদমই করেন না, নিন্দুকেরা তাকে কিপটে বলেই চেনে। তবু কখনো কখনো তো সবারই কিছু না কিছুর শখ হয়!

ভালো সানগ্লাসের দোকান অফিসের এক ছোকরার থেকে জেনে নিয়ে গুটিগুটি তাই হানা দিয়েছিলেন সেখানে। দোকানের ছেলেটিও বড়ো ভালো, প্রায় পঞ্চাশটার ওপর সানগ্লাস দেখে তারপর পছন্দ করেছিলেন দোলগোবিন্দবাবু, তবু তার এতটুকু বিরক্তি নেই! শেষে যখন এইটা পরে আয়নায় নিজেকে বেশ ভালো লাগছিল, তখন ছেলেটা একগাল হেসে বলল, ”এইটা নিয়ে যান স্যার, আপনার ওই লালমোহন গাঙ্গুলির মতো চকচকে টাকের সাথে হেব্বি মানিয়েছে! আপনার টাকটাও গোল, মুখটাও গোল, আর সানগ্লাসের ফ্রেমটাও একদম গোল, হে হে!”

দোলগোবিন্দবাবু বেশ লজ্জাটজ্জা পেয়ে খুশি হয়ে কড়কড়ে সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে সানগ্লাসটা কিনে বাড়ি চলে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন সোমবার অফিসে গিয়ে সবাইকে চমকে দেবেন। ওমা, দশঘণ্টাও টিকলো না সানগ্লাসটা! রাগে দোলগোবিন্দবাবুর গা রি-রি করছিল, মনে হচ্ছিল টেনে এক চড় কসিয়ে দেন বিচ্ছুটার গালে।

রাগে দুঃখে অজয়ের দিকে তাকাননি পর্যন্ত অফিসে গিয়ে। কাল অফিস- ফেরতা কাঁচুমাচু মুখে নিয়ে গিয়েছিলেন চশমাটা সেই দোকানে। আর সেইখানেই দু-নম্বর কারণটার সূত্রপাত। দোকানের সেই হাসিখুশি ছেলেটা সানগ্লাসটা উল্টে পালটে দেখে বলল, ”জেঠু, এটা তো একদমই ড্যামেজড হয়ে গেছে, আর এটা তো ইচ্ছে করে ভাঙা, তাই ওয়ারান্টির মধ্যে আসবে না!”

দোলগোবিন্দবাবু কাঁদোকাঁদো হয়ে বলেছিলেন, ”প্লিজ কিছু একটা ব্যবস্থা করো বাবা! এত টাকা দিয়ে কিনলাম বুঝতেই পারছ! নইলে যে আমি ধনেপ্রাণে মারা পড়ব!”

ছেলেটা আরো কিছুক্ষণ পরীক্ষানিরীক্ষা করে বলেছিল, ”না জ্যেঠু, এটা সারাতে আপনার প্রায় দু-হাজার টাকা মতো পড়ে যাবে।”

শুনে তো দোলগোবিন্দবাবুর প্রায় ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা। স্থানকালপাত্র ভুলে ছেলেটার হাত ধরে কাকুতিমিনতি করতে থাকেন কিছু একটা করার জন্য। অবশেষে ছেলেটা গলা একটু নামিয়ে বলেছিল, ”আপনি এত করে যখন বলছেন, একটা কাজ করতে পারি।”

দোলগোবিন্দবাবু সোৎসাহে বললেন, ”কি ভাই বল না!”

ছেলেটা গলা আরো খাদে নামিয়ে বলেছিল, ”আমাদের তো কিছু ডিফেক্টিভ মাল স্টকে থাকে, মানে আপনারা খালি চোখে সেই ডিফেক্ট বুঝতেই পারবেন না, সেরকম একটা সানগ্লাস দিয়ে দিতে পারি আপনাকে! তবে তার জন্য পাঁচশো টাকা লাগবে।”

দোলগোবিন্দবাবু একটু চুপসে গিয়ে বলেছিলেন, ”কিন্তু আ-আমি তো নতুনের দামেই কিনেছি, এতগুলো টাকা দিয়ে! ডিফেক্টিভ মাল নেব, তাও আবার টাকা লাগবে?”

ছেলেটা তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলেছিল, ”তাহলে আমার আর কিছু করার নেই দাদা!”

স্যার থেকে জ্যেঠু, জ্যেঠু থেকে দাদা! আর বেশি কথা বাড়ালে বোধ হয় নাম ধরেই ডাকবে! কিছু করার নেই, দোলগোবিন্দবাবু বেজার মুখে নতুন সানগ্লাস নিয়ে বাড়ি এলেন। নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো। তবে বাড়ি এসে ভালো করে দেখেটেখে তাঁর মন খুশ হয়ে গেল। কি ডিফেক্ট কে জানে, দোলগোবিন্দবাবুর তো কিছুই চোখে পড়ল না, একদম আগেরটারই মতো অবিকল! বরং আজ সকালে চোখে দিয়ে বেরোতে চোখটা বেশ ঠাণ্ডাই লাগছিল।

দ্বিতীয় কারণটা এর পরেই ঘটতে শুরু করল। প্রথম গোল বাঁধল অফিস যাওয়ার সময়েই। প্রচণ্ড চড়া রোদ উঠেছিল বলে দোলগোবিন্দবাবু সানগ্লাসটা পরে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলেন, খুলে হাতে নিয়ে বাসে উঠতে যাবেন এমন সময় পাশের পাড়ার অলোক বলে উঠল, ”হ্যাঁ চশমাটা খুলেই রাখুন দাদা, আকাশ এমন অন্ধকার করে এসেছে, সানগ্লাসের দরকার কি! হোঁচট খাবেন তো এবার!” এইরকম চাঁদিফাটানো রোদ্দুর, আর বলছে অন্ধকার করে এসেছে? বাজে রসিকতা ভেবে দোলগোবিন্দবাবু কটমট করে তাকিয়েছিলেন, এরকম ফচকেমির জন্য কিছু বলতেও যাচ্ছিলেন, এমন সময় বাস আসতে কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লেন।

পরের গণ্ডগোলটা হল অফিস গিয়েই। দোলগোবিন্দবাবু রাজ্যসরকারের আপার ডিভিশন ক্লার্ক, এই দপ্তরে এগারোটা সাড়ে এগারোটার আগে কেউ অফিস ঢোকে না। দোলগোবিন্দবাবুও ওরকম সময়েই ঢুকে চেয়ারে বসে সানগ্লাসটা সবে খুলতে যাবেন এমন সময় চোখ পড়ল সামনের দিকে। মাথার ওপর ঘড়ঘড় ঘুরছে পাখা, টেবিলের ওপর ছোট্ট ক্ল্যালেন্ডার শো-পিস, প্রতিদিন সকালে পিওন ঝন্টু এসে ওর তারিখটা বদলে দেয়। দেখে ভ্রূ কুঁচকে গেল দোলগোবিন্দবাবুর। ব্যাটার কাজে মন নেই, খালি বখশিশ পাওয়ার ধান্দা! আজ হল গিয়ে একুশ তারিখ, ব্যাটাচ্ছেলে বাইশ করে রেখেছে। সানগ্লাসটা খুলে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে হাঁক পাড়লেন ঝন্টুকে, ”হ্যাঁরে, আর কটাদিন বাকি আছে চোখে তুলসীপাতা পড়তে? কাজেকম্মে মন আছে তোর?”

ঝন্টু এসে তাকিয়ে রইল হাঁ করে কিছুক্ষণ, তারপর মুখ বেঁকিয়ে খিঁচিয়ে বলল, ”তুলসীপাতা পড়বে কেন বাবু! এত তাড়াতাড়ি আমি মরছি না, মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে, ছেলেটাকে……।”

দোলগোবিন্দবাবু আরো রেগে গিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ”আরে বাবা, তোকে কে মরতে বলছে! বলছি তোর চাকরিলাইফে তুলসীপাতা পড়তে তো আর একবছর বাকি আছে, না? এর মধ্যেই কাজে ঢিলে দিতে শুরু করেছিস? আজকে একুশ তারিখ ভুলে মেরে দিয়েছিস বুঝি?”

হাত দিয়ে ঝন্টুকে ভুলটা দেখাতে গিয়ে দোলগোবিন্দবাবু নিজেই থ হয়ে গিয়েছিলেন, না, একুশই তো রয়েছে! একটু আগে কি ভুল দেখলেন নাকি! দোলগোবিন্দবাবু আর কিছু বলতে পারলেন না। উল্টে ঝন্টু অ্যাটিটিউড নিয়ে বলে গেল, ”হু!, ঝন্টু হেলা কখনো কাজে ভুল করে না, আপনি বরং আপনার চোখটা দেখান!”

দোলগোবিন্দবাবু আর কি বলবেন! সরকারি অফিস, কেউ কাউকে তেমন মানে না। খুঁতখুঁতে মনে বিকেলে বাড়ি ফিরে এলেন। এরকম কেন হচ্ছে? ডিফেক্টিভ সানগ্লাস পড়ে চোখ টোখ খারাপ হচ্ছে না তো! চুপচাপ সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন, হঠাৎ চোখ পড়ল সামনে রাখা সানগ্লাসটার দিকে। আনমনে সানগ্লাসটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে ঘুরিয়েফিরিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন, তারপর চোখে দিলেন সেটা। এরই মধ্যে টিভিতে চলতে থাকা খবর পালটে গেছে, পোস্তা অঞ্চলে একটা উড়ালপুল ভেঙে পড়েছে, প্রচুর মানুষ মারা গেছে, চাপা পড়ে আছে অনেকে, সেটাই দেখাচ্ছে বারবার। দোলগোবিন্দবাবু চমকে গেলেন, আরে ওখানেই তো তাঁর এক খুড়তুতো ভাইয়ের বাড়ি, ওই ফ্লাইওভারের পাশেই তো তার দোকান। সাবধানে সানগ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করলেন ভাইকে, ”হ্যাঁ রে, তোরা সবাই ঠিক আছিস তো?”

সুজয় তো অবাক, দাদা এতকাল বাদে হঠাৎ ফোন করেছে, সাতজন্মে তো কারুর সাথে যোগাযোগ রাখে না! সে বলে, ”হ্যাঁ বুবুদা, আমরা তো ঠিকই আছি, তুমি কেমন আছ?”

দোলগোবিন্দবাবু আবার বললেন, ”না না, ওই যে তোদের বাড়ির পাশের ফ্লাইওভারটা ভেঙে পড়েছে, কিছু হয়নি তো তোদের?”

সুজয় তো আকাশ থেকে পড়ল, ”কি সব বলছ দাদা! ফ্লাইওভার ভেঙে পড়েছে! কোথায়! এই তো দিব্যি দোকানে বসে দেখতে পাচ্ছি!”

দোলগোবিন্দবাবু বললেন, ”অ্যাঁ? অ্যাঁতবে কি অন্য কোথাও নাকি! কিন্তু না, ওই জায়গার কথাই তো বলল!”

সুজয় আবার বলল, ”তোমার শরীর-টরির ঠিক আছে তো বুবুদা? একদিন যাব’খন দেখতে!”

দোলগোবিন্দবাবু হু-হা করে ফোন ছেড়ে দিয়ে আবার সোফায় এসে বসলেন। কি হল ব্যাপারটা? এতবড় একটা খবর, আর সুজয় জানেনা! টিভিতেও এখন আর কিছু দেখাচ্ছে না ওই ব্যাপারে! অন্যমনস্কভাবে দোলগোবিন্দবাবু আবার সানগ্লাসটা চোখে পড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে টিভির খবর পালটে গিয়ে ভেসে উঠল ফ্লাইওভার দুর্ঘটনায় হতাহতের মর্মান্তিক সংবাদ। স্ক্রিনের ডানদিকে চোখ পড়ল দোলগোবিন্দবাবুর, বাইশ তারিখ দেখাচ্ছে! ঝটিতি সানগ্লাসটা খুললেন, এখন টিভির পর্দায় একুশ তারিখ, খবরও শান্ত, চুপচাপ ডিবেট চলছে একটা। নিজের অজান্তেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বেয়ে গেল দোলগোবিন্দবাবুর। এ কি অপার্থিব ব্যাপার! সানগ্লাসটা পরলে একরকম, খুললে আরেকরকম কেন! কাঁপাকাঁপা হাতে সানগ্লাসটা আরেকবার পরলেন দোলগোবিন্দবাবু, কোনো সন্দেহ নেই, এটা ভূতুড়ে সানগ্লাস। সানগ্লাসটা যখন পরছেন, তখন ঠিক একদিন পরের ঘটনা দেখতে পাচ্ছেন দোলগোবিন্দবাবু, খুলে ফেললে আবার যে কে সেই! অন্য কেউ হলে এতক্ষণে ভয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিত, কিন্তু দোলগোবিন্দবাবু মাথা ঠাণ্ডা রাখলেন। প্রথমেই রিমোট টিপে টিভিটা বন্ধ করলেন, তারপর তাকালেন চারপাশে। অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে চোখ পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করলেন তাঁর প্রিয় অস্কার ফিশটা জলের নীচে এককোণে শুয়ে আছে, কমলা রঙের শরীরটা কেমন ফুলে উঠেছে। সানগ্লাসটা খুলতেই দেখলেন মাছটা আনন্দে সাঁতার কেটে চলেছে। দোলগোবিন্দবাবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তার মানে ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা বাদে মাছটার শরীর খারাপ হবে আর সেটা এই সানগ্লাসটা পরে দোলগোবিন্দবাবু এখনই জেনে গেলেন! উত্তেজনায় দোলগোবিন্দবাবুর শিহরণ হতে লাগল। অলৌকিক ব্যাপার, কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু দোলগোবিন্দবাবু যদি এটাকে ঠিকমতো ব্যবহার করেন, সে যে একদম মারকাটারি ব্যাপার হবে!

**********

সেদিনের পর প্রায় ছ-মাস কেটে গেছে। দোলগোবিন্দবাবু চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, গড়িয়াহাটের মোড়ে তাঁর এখন পেল্লায় চেম্বার। ফিল্মস্টার, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে মিনিস্টার পর্যন্ত তাবড় তাবড় লোকের লাইন পড়ে তাঁর কাছে। সবথেকে বেশি ভিড় হয় রেস খেলার লোকেদের, দোলগোবিন্দবাবু শুধু মোটা টাকার বিনিময়ে রেসের মাঠে একবার যান, ব্যস, বলে দেন পরের দিনের রেসে কোন ঘোড়াটা জিতবে। দোলগোবিন্দবাবুর হয়ে প্রচার চালায় তাঁর খুড়তুতো ভাই সুজয়। ফ্লাইওভার সত্যিই ভেঙে পড়ার পর সে তাঁর দাদার অলৌকিক প্রতিভা টের পেয়ে আর একদিনও দেরি করেনি, ছুটে এসে সে-ই বুদ্ধি দিয়েছিল চেম্বার খোলার।

দোলগোবিন্দবাবু কাউকেই বলেননি আসল ব্যাপার। অলৌকিক প্রতিভা যে তাঁর কিছুই নেই, সবই এই সানগ্লাসের খেল, তা সুজয়ও জানে না। দোলগোবিন্দবাবুর ব্যাঙ্কব্যালান্স প্রতিদিন গুণোত্তর প্রগতিতে বেড়ে চলেছে, ত্রিকালজয়ী মহাপুরুষ বলা হচ্ছে তাঁকে, তিনি এসবে বড়ই খুশি। খুব শীগগিরই নিজের পুরনো বাড়ি ছেড়ে উঠে আসছেন নিউ আলিপুরের এক বাংলোয়। ভক্তদের বলা হয়েছে তাঁর ত্রিনয়ন জাগ্রত হয় শুধুমাত্র অন্ধকারে, তাই চশমা পড়ার প্রয়োজন হয়। আর ভক্তদেরই বা অত কথায় কাজ কি, তারা হাতেনাতে ফল পাচ্ছে এতেই গদগদ।

এভাবেই চলছিলো, কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল একদিন বিকেলে। দোলগোবিন্দবাবু সবেমাত্র তখন তাঁর দৈনন্দিন রেসের মাঠভ্রমণ সেরে চেম্বারে তাঁর দামি ল্যাম্বরগিনি গাড়িতে চড়ে ফিরছেন, তাঁর এক ভক্ত উমেশ ঝুনঝুনওয়ালা রেসের মাঠে প্রচুর টাকা জেতার পর খুশি হয়ে তাঁকে এই গাড়িটা উপহার দিয়েছে। বেশ তাড়াহুড়ো আছে আজ, কাল বিধানসভা ভোটের রেজাল্ট, আজকেই তা জানতে উঁচুতলার দু-তিনজন নেতা আসবেন গোপনে দোলগোবিন্দবাবুর কাছে, কি ফলাফল হবে তা জেনে তারপর তাঁরা প্রস্তুতি শুরু করবেন। দোলগোবিন্দবাবুকে বিশেষ কিছুই করতে হবে না, শুধু একবার টিভিটা খুলে বসতে হবে, ব্যস!

দোলগোবিন্দবাবুর আদেশমত ড্রাইভার বেশ জোরে গাড়ি চালাচ্ছে, বালিগঞ্জের দিক থেকে এসে গড়িয়াহাট ক্রসিংটার কাছে এসে সিগন্যালে অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ চোখে পড়ল ওপারে তাঁর চেম্বারটার সামনে বিশাল জটলা। কি হল, ফিল্মস্টার কেউ এলো নাকি! চট করে পকেট থেকে ডায়রিটা বের করলেন দোলগোবিন্দবাবু, না, সেরকম তো কারুর আসার এখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই! তবে এত ভিড় কেন?

সিগন্যাল সবুজ হতে আরও মিনিটতিনেক লাগল। ওপারে পৌঁছে চেম্বারটার কাছে পৌঁছে দোলগোবিন্দবাবুর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। লোকে লোকারণ্য, তারই মধ্যে একটা শববাহী স্বর্গরথ দাঁড় করানো রয়েছে মাঝখানে, তার চারপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে অগণিত লোকজন। ড্রাইভার তাঁকে নামিয়ে দিয়ে দুটো গলি পরে গ্যারাজে চলে গেল, দোলগোবিন্দবাবু বিস্মিত চোখে গাড়িটার কাছে এসে প্রথমেই দেখতে পেলেন, তাঁর ভাই সুজয় শববাহী গাড়িটার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে, ওদিকে উমেশ ঝুনঝুনওয়ালাও চোখ মুছছে ঘনঘন। আরো কিছু চেনা ভক্তকে চোখে পড়ল তাঁর। বিহবল চোখে আরেকটু এগোতেই পাশ থেকে শুনতে পেলেন একটি মেয়ের সঞ্চালনা, ”বাংলা নিউজ এক্সক্লুসিভ, আপনাদের আবারও দেখাচ্ছি ওঁর নশ্বর দেহ, প্রায় তিন ঘন্টা আগে এই প্রবাদপ্রতিম সিদ্ধপুরুষের জীবনাবসান হয়েছে, খবু অল্পদিনের জন্যই উনি পৃথিবীতে এসে…।”

আতঙ্কে ভয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য দোলগোবিন্দবাবুর খেয়াল হল যে তিনি সানগ্লাসটা পরে রয়েছেন, বিদুদবেগে সেটা খুলে ফেলতেই সব ভেঁ-ভাঁ, তাঁর চেম্বারের গেটের সামনে অলস ভঙ্গিতে দারোয়ান দাঁড়িয়ে, তাঁকে দেখে পেল্লায় সেলাম ঠুকছে ঘনঘন। ঘামে সারা শরীরটা ততক্ষণে জবজবে হয়ে উঠেছে দোলগোবিন্দবাবুর, অবসন্ন শরীরে টলে পড়ে গেলেন সামনের চাতালটায়।

পরেরদিন সকালে ঘুম ভেঙে নিজেকে একটা পুরনো হোটেলের ঘরে আবিষ্কার করলেন দোলগোবিন্দবাবু। সুজয় পাশে টেবিলে বসে কি করছিল, দোলগোবিন্দবাবুকে চোখ মেলতে দেখেই উঠে কাছে এসে বলল, ”বুবুদা, এখন কেমন লাগছে তোমার?”

দোলগোবিন্দবাবু ঘড়ির দিকে তাকালেন, সাড়ে দশটা। উঠে বসে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ”এখানে কেন?”

সুজয় বলল, ”কাল তোমার প্রেশারটা হঠাৎ ফল করেছিল, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে, তাই ডাক্তার বলার পর আর বাড়ি নিয়ে যাইনি, চেম্বারের পাশেরই এই হোটেলে নিয়ে এসে রেখেছি তোমায়। হোটেলটা ভালো নয় খুব একটা, কিন্তু তখন আর বেশি দূরে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাইনি। এখন ঠিক লাগছে?”

দোলগোবিন্দবাবু উত্তর না দিয়ে ঠোঁট কামড়ালেন। নাকের পাটা লাল হয়ে আছে, ফুলছে ঘনঘন। আজ তার মানে তাঁর জীবনের শেষ দিন? আজ বিকেলের আগেই তাঁর মৃত্যু হবে? না না, সে কি করে হয়, দোলগোবিন্দবাবু কেঁপে উঠলেন। সবেমাত্র অর্থ, নাম, যশের স্বাদ পেতে শুরু করেছেন, এর মধ্যেই মরে যাবেন তিনি, হয় নাকি! আচ্ছা, কাল শরীরখারাপের জন্য ভুলভাল দেখেননি তো? পরক্ষণেই গলায় ঝোলা সানগ্লাসটার দিকে চোখ পড়ল, হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ওটাকে গলায় ঝুলিয়েই রাখেন তিনি। না, ভুল দেখেননি। আর সানগ্লাস ভুল দেখাবেও না। আজই দোলগোবিন্দবাবু মরে যাবেন।

সুজয় তাকিয়ে ছিল, দোলগোবিন্দবাবু ওকে আজকের সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করতে বলে হোটেলের ঘর বন্ধ করে বসলেন। কনকনে এসির মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছেন। আচ্ছা, কিভাবে মৃত্যু হবে ওনার? হার্ট অ্যাটাক? না, ক-দিন আগেও ডাক্তার দেখিয়েছেন, হৃৎপিণ্ড যথেষ্ট সবল। তবে কি গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট? এই পরেশ ছোকরা যা রাফ চালায়! নাকি চেনা কেউ খাবারে কিছু মিশিয়ে দেবে! সুজয় নয়তো! এত টাকা, দোলগোবিন্দবাবু মরে গেলে তো সব ও-ই পাবে।

জানলা থেকে নীচের মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে দোলগোবিন্দবাবুর মনে হল, আচ্ছা কেউ গুলি করবে নাতো? রেসের নম্বর বলে দেওয়াতে শত্রুর অভাব নেই এখন। মনস্থির করে নিলেন দোলগোবিন্দবাবু। সানগ্লাস যা দেখায় দেখাক গে যাক, দোলগোবিন্দবাবু আজ কিছুতেই মরবেন না! কোথাও বেরোবেন না, কিচ্ছু খাবেন না, এমনকি কারুর সাথে দেখাও করবেন না। তাহলে আর মৃত্যু হানা দেবে কোথা দিয়ে!

যেমন ভাবা তেমন কাজ। সুজয়কে ফোন করে কঠোর নির্দেশ দিলেন দোলগোবিন্দবাবু, কেউ যেন না বিরক্ত করে, সে যে-ই হোক না কেন। ডাক্তারও নয়। কাউকে বিশ্বাস নেই। এখন মরলে কিছুতেই চলবে না দোলগোবিন্দবাবুর। হোটেলের দরজায় ডু নট ডিস্টার্ব বোর্ড লাগিয়ে ফোন সুইচড অফ করে এসে বসলেন দোলগোবিন্দবাবু। এইবার মনটা বেশ ভালো লাগছে। বেশ বিজয়ী বিজয়ীও মনে হচ্ছে! হু, ওঁরই সানগ্লাস ওঁকেই নাকি মৃত্যুর নোটিশ দেবে! নিজেকে সত্যিই ত্রিকালজ্ঞ মনে হচ্ছিল দোলগোবিন্দবাবুর।

ঘড়িতে দেখলেন আড়াইটে বেজে গেছে। কোনো কাজ নেই, তাই ক্লান্তিতে এতদিনের ব্যস্ত শরীরটা বুজে আসছে। বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে দোলগোবিন্দবাবু ভাবতে লাগলেন, আর কি! তিনটে তো বাজতেই চলল, সানগ্লাস ব্যাটাকে তিনি জব্দ করেছেন। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। গা-টাও চ্যাটচ্যাট করছে। সকাল থেকে কিচ্ছু খাননি, স্নান করেননি, বাথরুমে যদি পড়ে যানসেই ভয়ে! পেটে ব্যথা হয় হোক, আর ঘণ্টাখানেক উতরে গেলেই……

দোলগোবিন্দবাবুর ভাবা শেষ হল না। বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, মাথার ওপর ঘুরতে থাকা প্রাগৈতিহাসিক বিশালমাপের কালো মিশমিশে সিলিং ফ্যানটা হঠাৎ তার ছিঁড়ে বিকটভাবে বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসছে তাঁর দিকে…!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *