টিকলির গোলাপি স্কুটি আর পাঁচটা ষাঁড়
টিকলির বুকের ভেতর দুম দুম করে ড্রাম বাজছিল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন কোনো সিডাকটিভ দিয়ে ওর পায়ের নীচ থেকে উপরের অংশটা আস্তে আস্তে অসাড় করে দিচ্ছে। ভালো ছেলে জুটছে না সহ্য করা যায়, তাই বলে এদের নাছোড় প্রেমিক হিসেবে ভাবতে পারে কেউ? একটা পঁচিশ বছরের তরুণী মেয়ের পক্ষে এর চেয়ে বড়ো অপমান আর কি হতে পারে?
সমান্তরালভাবে পাশেই বোম্বে রোড হাইওয়ে। সেখান থেকে প্রায় উল্কার গতিতে সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে গাড়ি। আর সেই ছ-টা হাইওয়ে লাইনের পাশ দিয়েই সরু এই রাস্তাটায় অসহায়ভাবে নিজের এগারো দিন পাঁচ ঘণ্টা পুরনো গোলাপি রঙের স্কুটিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও।
টিকলি মনে মনে নিজেকে বলল, মাথা ঠাণ্ডা রাখো বৎস্য, মাথা গরম করে কোনো লাভ হবে না, উল্টে আরো বিপত্তি হবে। কিন্তু ঠিক নিজেকে কাউন্সেলিং করার সেই মহার্ঘ্য মুহূর্তেই ভগবান যেন ওর কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিলেন। ওর জন্মশত্রু হেঁচকি তার কাজ পুরোদমে শুরু করে দিল।
রাগে দুঃখে ভয়ে টিকলির চোখে জল চলে এল। সব দিক থেকে সবাই যদি এরকম করে ওর পেছনে আদা জল খেয়ে লাগে, ও একা কি করে সামলাবে? কোথায় এইরকম বিপদের মুহূর্তে বিরাট কোহলির মতোই আস্তে আস্তে ম্যাচটাকে মাঠের বাইরে বের করে নিয়ে যাবে, সেখানে ওর বিখ্যাত হেঁচকি শুরু হয়ে গেল।
অবশ্য বিপদের সময় হেঁচকি ওঠাটা ওর কাছে নতুন কিছু নয়। সেই ক্লাস টু-তে পড়তেও বেশ মনে আছে, ক্লাসের দেওয়ালে ও আঁকিবুঁকি কেটে নোংরা করেছিল বলে মিস ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ওর ভীষণ পটি পেয়ে গিয়েছিল, তবু ভয়ে মিসকে বলতে পারছিল না। ওইরকম ক্রিটিকাল সিচুয়েশনেই ওর সেই মারাত্মক হেঁচকি আরম্ভ হয়েছিল। সে কি অবস্থা! যেমন সেই হেঁচকির আওয়াজ, তেমনই তার ফ্রিকোয়েন্সি আর ইন্টেনসিটি। জল খেয়ে কমছে না, নিশ্বাস বন্ধ করে নাক টিপে থাকলে কমছে না, আরো হাজার মানুষের হাজার টোটকাতেও কমছে না। শেষে তো মিস নিজেই ভয় পেয়ে গেছিলেন।
সেই শুরু। তারপর থেকে প্রতিটা ঝামেলাকর পরিস্থিতিতে মীর জাফরের মতো হাজির হয়েছে ওর এই হেঁচকি। কত ডাক্তার বদ্যি, কত কবিরাজি, সব বিফলে গেছে। বাবা তো একবার ভেলোর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন, সেখানকার ডাক্তার হাজার গন্ডা টেস্টের পর গম্ভীর মুখে টিকলিকে বুঝিয়েছিলেন ওর হেঁচকির পেছনের রহস্য। তখন টিকলি ক্লাস সিক্সে পড়ে, তবু ওর স্পষ্ট মনে আছে, তিনি সহজ করে বলেছিলেন, আমরা নিশ্বাস নেওয়ার সময় যে পেশিগুলো কাজ করে, সেই ইন্টারকোস্টাল পেশিগুলো রেগে গেলে হেঁচকি ওঠে। অনেকক্ষণ না খেলে বা খুব তাড়াতাড়ি খেলে আবার আমাদের পাকস্থলী রেগে গিয়ে এই পেশিগুলোকে খোঁচা মারে, তখনো হেঁচকি ওঠে, আবার ব্রেন থেকে যে নার্ভগুলো এই পেশির সঙ্গে কানেক্টেড রয়েছে, তাদের রাগিয়ে দিলেও হেঁচকি শুরু হয়ে যায়। তোমার পেশিগুলো একটু বেশিই রাগী। কাজেই, তাদের রাগানো চলবে না, বুঝলে!
তাদের কেন, টিকলি কাউকেই রাগানো পছন্দ করে না, তবু এদের টিকলির প্রতি কেন এত রাগ কে জানে!
টিকলির চোখ মুখ লাল হয়ে আসছিল হেঁচকি তুলতে তুলতে, তবু ও সামনের দিকে তাকাল। দু-পাশে ফাঁকা ধানখেত, তার ওপর বসন্তের এই গোধূলিবেলার পড়ন্ত নরম রোদ পড়ে ঝলমল করছে। যতদূর চোখ যায়, কেউ কোথাও নেই। সুবিশাল হাইওয়ের পাশ দিয়ে উপনদীর মতো এগিয়ে চলা মাত্র সাড়ে ছ-ফুট এই রাস্তার আদি অন্ত জনশূন্য। অনেক দূরে খেতের পাশ দিয়ে কিছু বাড়ি। টিকলি একা ওর স্কুটিটার ওপর চেপে বসে আছে। আর ওর থেকে ঠিক ত্রিশ ফুট মত দূরে পুরো রাস্তাটা আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাঁচটা ষাঁড়।
রাস্তাঘাটে চড়ে বেড়ানো অপুষ্টিতে ভোগা ষাঁড় নয়, মিশমিশে কালো রঙের বিশাল দেহের দশাসই চেহারা, আর তার সঙ্গে ভয়ঙ্কর দেখতে গণ্ডারের শিঙের মতোই ধারালো শিং তাদের। একদম পাশাপাশি রিপাবলিক ডে-র কুচকাওয়াজের মতো ডিসিপ্লিনড ওয়েতে পরস্পরের মধ্যে এক ইঞ্চিও ফাঁক না রেখে নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা।
হেঁচকি তুলতে তুলতেই টিকলির এবার কান্না পেয়ে গেল। এত ম্যানেজ করে আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোল, বাড়ি গিয়ে কত কাজ, যতই এখন আর আগেকার মতো সেজেগুজে পটের বিবি হয়ে বসার চল নেই, আর তাছাড়া রাজ্য সরকারের ইলেক্ট্রিসিটি ডিপার্টমেন্টে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার পাত্রী দেখতে আসছে ছেলে আর ছেলের বন্ধুরা, তারা সে ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহালও, কিন্তু মিনিমাম তো নিজেকে একটা গ্রুম করার ব্যাপার থাকে! একেই এখন ইয়ার এন্ডিং এর ঝামেলা, সকাল থেকে সব কাজ প্ল্যানমাফিক করে বেরল, ভাবল বাড়ি যাওয়ার পথে সোমাদি-র পার্লারে একটু ঢুঁ মেরে যাবে, কোথায় কি!
সবচেয়ে বড়ো কথা, এরকমভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে টিকলি? এরপর সন্ধ্যে নামলে তো আরো মুশকিল। জায়গাটা তো তেমন নিরাপদও নয়! অমনি মায়ের কথা মনে পড়ে গেল টিকলির।
মায়ের তুমুল আপত্তি ছিল এই স্কুটি নিয়ে হাইওয়ের পাশ দিয়ে এভাবে অফিস যাওয়ায়, রেগেমেগে বলেছিলেন, ”কেন, বেশ তো বাসে করে যাস, স্কুটি নিয়ে যাওয়ার কি হয়েছে?”
টিকলি আমল না দিয়ে বলেছিল, ”ধুর! ওই তিনখানা বাস পালটে, তারপর আবার ভ্যানে চেপে ওই গণ্ডগ্রামে পৌঁছতে আর ভালো লাগছে না। আরে ওইজন্যই তো স্কুটিটা কিনলাম! কেমন ভেতর দিয়ে আধঘণ্টায় পৌঁছে যাব! হু হু করে!”
অফিসের গ্রামেই বাড়ি কলেজের বন্ধু সম্বরণের, সে মাঝেমধ্যেই আসে ওর অফিসে আড্ডা দিতে, সেও টিপ্পনি কেটেছিল, ”একেই তো দেড় ফুটিয়া, তার ওপর স্কুটিও একটা খেলনা টাইপ কিনেছিস, বড় বড় ট্রাক ড্রাইভারগুলো দেখতেই পাবে না, সাইডে হালকা চেপে দিয়ে বেরিয়ে যাবে, আর তুই হাড়গোড় ভেঙে পড়ে থাকবি। তার চেয়ে যেমন বাসে আসিস, তেমনই আয়।”
টিকলি পাত্তা দেয়নি। মায়ের কথাই শোনেনি, তায় আবার সংবরণ! মালটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় পড়াশুনোয় ভালো ছিল, কিন্তু একদম ক্যাবলা ছিল, তখন টিকলি এক ডিপার্টমেন্ট হয়েও পাত্তাই দিত না, নিজের গ্রুপ নিয়েই থাকত, কিন্তু কপালফেরে টিকলির পোস্টিং হল সম্বরণেরই গ্রামে। আর এখানে এসে জানতে পারল, সংবরণ ক্যাম্পাসিং এ পাওয়া চাকরিটায় জয়েনই করেনি, বাড়ির গোরুর দুধের বিজনেস করছে! কি অবস্থা! দেখা হওয়ার পর থেকেই তার আবার খুব খই ফুটেছে মুখে!
টিকলি মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, ”তুই ছয়ফুটিয়া হয়েও কি করছিস ভাই? সেই তো বাড়িতে গিয়ে গোরুর বাঁট থেকে দুধ দুয়ে সাপ্লাই করিস। কি করতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লি? ইশ মাগো! ভাবলেই কিরকম ঘেন্না লাগে। ওইজন্য তোর গায়ে সবসময় দুধ দুধ গন্ধ!”
টিকলি মনটা ঘুরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকাল আবার। সেই একইরকম অষ্টাবক্র মুনির মতো নট নড়ন-চড়ন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ষাঁড়গুলো। কি করবে ও? আশপাশে সামনে পেছনে কাউকে তো দেখতেও পাচ্ছে না। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজছে। একটু পরেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে যাবে। টিকলি নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল। মাথা থেকে গোলাপি হেলমেটটা খুলে ফোন করল মা-কে।
যথারীতি মায়ের ফোন বেজে বেজে কেটে গেল। একবার নয়, তিন তিনবার। চড়াং করে মাথাটা গরম হয়ে গেল টিকলির। যে সমস্ত মানুষজন মোবাইলটাকে ল্যান্ডলাইনের মতো করে ট্রিট করে, তাদের কোনো অধিকারই নেই মোবাইল ফোন ইউজ করার। পরে এই নিয়ে বললেই বলবে, ”ওমা, ফোন করেছিলি? আমি তো বাজারে গিয়েছিলাম!” বাজারে যাওয়ার সময় যে কেন এরা ফোন নিয়ে যায় না, সেটা হাজারবার জিগ্যেস করেও উত্তর মেলে না।
কি করবে মাথা পুরো গুলিয়ে যাচ্ছে টিকলির। ষাঁড়গুলো ওকে যেন নিবিষ্টমনে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এই ভয় আর দুঃখের মধ্যেও হেঁচকি তুলতে তুলতে ওর হাসি পেল নিজের অবস্থা দেখে। সম্প্রীতের সঙ্গে ব্রেক আপের পর থেকে আর কোনো রিলেশনেই জড়ায়নি ও, তাই বলে ওর যে ক্রেজ কমে গেছে, তা তো নয়! একইরকম ফ্যাশনেবল আর সুন্দরী আছে ও। এমনকি কলেজে পড়ার সময় সম্প্রীতের সঙ্গে স্টেডি রিলেশনে থাকা সত্ত্বেও অনুরাগীর অভাব হয়নি ওর কখনো। আর এই গণ্ডগ্রামে সরকারি চাকরি পেয়ে কিনা শালা ক-টা মুশকো ষাঁড় এখন ওর অনুরাগীর জায়গাটা নিয়েছে? এরকম দুর্দশা ওর?
একবার মনে হল যতটা স্পিড তোলা যায়, সেই স্পিড তুলে ষাঁড়গুলোর মধ্যে দিয়েই স্কুটিটাকে চালিয়ে দেবে ও, যা থাকে কপালে। সারগুলোর ভয় পেয়ে সরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি না সরে? তখন তো টিকলিই উল্টে পড়ে যাবে ওদের গায়ে, আর তারপর কি হবে ও কল্পনাও করতে পারছিল না।
হঠাৎ ওর মনে হল সম্বরণকে ফোন করে জানলে হয়, ওদের বাড়ির তো এই সব ব্যবসা, নিশ্চয়ই ব্যাটা ষাঁড়েদের সাইকোলজি ভালো বলতে পারবে। পরক্ষণেই আজ দুপুরের কথা মনে পড়তে ও একটু হেসিটেট করতে লাগল। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে সম্বরণ এসেছিল। টিকলি কয়েকটা কথা বলে ফেলেছে একটু উত্তেজনার বশেই, যেটাকে ইয়ার্কির মোড়কে অপমানই বলা চলে।
এরপর এখন ফোন করলে কিছু ভাববে না তো? তাও আবার টিকলির নিজের দরকারে?
মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে টিকলি আশঙ্কাটাকে রিজেক্ট করে দিল। ধুর, অত ভাবাভাবির কি আছে! টিকলি তো কিছু ভুল বলেনি! একটা ভালো রেজাল্ট করা ইঞ্জিনিয়ার ছেলে যদি এখন চাকরিবাকরি না করে গোয়ালা হয়ে যায়, সেটা হজম করা কারুর পক্ষে সম্ভব?
সম্বরণ অবশ্য গম্ভীরভাবে বলতে শুরু করেছিল, ”গোয়ালা মোটেও নয়, আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগ্রিকালচারাল সেক্টরে প্রোডাকশনে একটা বিপ্লব…!”
টিকলি হাত নাড়িয়ে থামিয়ে দিয়েছিল। এমনিতেই ওর আজকে বাড়িতে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে বলে টেনশনে ছিল, তার ওপর সম্বরণ এসেই ওর কি একটা পেপার ছাপা হয়েছে বাইরে কোথায়, তা নিয়ে বকবক করছিল। একে তো ওর বাড়ির নাকি দুধের ব্যবসা, শুনেই টিকলির গা গুলিয়ে ওঠে, তার ওপর সম্বরণ নিজেও একটু আধপাগলা গোছের আছে, কি একটা রিসার্চ চালায় তলে তলে কে জানে! সেই নিয়ে ও নাকি পেটেন্টও নিয়েছে। যতসব! ও যতই বলতে চাক, টিকলি পারতপক্ষে কোনো ইন্টারেস্ট দেখায় না।
ও আর আগুপিছু না ভেবে সম্বরণকে ফোন করল। যতটা সম্ভব সংক্ষেপে ঘটনাটা বর্ণনা করে টিকলি বলল, ”কি করব এখন বলত? কি করলে এগুলো সরবে? সোজা জোরে চালিয়ে দেব গাড়ি?”
সম্বরণ সব শুনে টুনে বলল, ”না, ওটা ভুলেও করিস না। ষাঁড়েরা দেখতে ওরকম হলেও এমনিতে শান্ত হয়, কিন্তু ক্ষেপে গেলে পাগলা হাতির মতোই হয়ে যায়।”
টিকলি অধৈর্য হয়ে বলল, ”তবে? কি করব তাহলে আমি এখন? এদিকে বাড়িতে ওরা এসে পড়বে তো! হে ভগবান!”
সম্বরণ খুব শান্তভাবে বলল, ”তুই একটা কাজ কর, তোর তো সঙ্গে ল্যাপটপ আছে? সেটাকে ব্যাগ থেকে বের কর, করে স্কাইপটা অন কর।”
টিকলি একটু অবাক হয়ে গেল, সম্বরণ কি এখন ভিডিও চ্যাটে ওকে ষাঁড় তাড়াবার টেকনিক শেখাবে নাকি! রাগে মাথাটা আরো গরম হয়ে উঠলেও টিকলি কিছু বলল না। যেভাবেই হোক, এই পরিস্থিতি থেকে তো মুক্তি তো পেতে হবে ওকে! চট করে স্কুটি থেকে নেমে ও নিজের ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা খুলে নেট কানেক্ট করল। সূর্য অলরেডি পশ্চিমদিকে হেলতে শুরু করেছে।
পাঁচমিনিটের মধ্যেই সম্বরণের সাইড করে চুল আঁচড়ানো গোল ক্যাবলাকান্ত মুখটার দর্শন পেয়ে গেল টিকলি। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও অধৈর্যভাবে বলল, ”বল, কি করব এখন।”
সম্বরণ কোথায় রয়েছে কে জানে, কেমন নিশ্চুপ জায়গাটা যেন। ও বলল, ”তোকে কিছু করতে হবে না। তুই ওদের দিকে ল্যাপটপটা নিয়ে এগিয়ে যা।”
টিকলি হাঁ হয়ে গেল। মানে? সম্বরণ কি ষাঁড়গুলোর সঙ্গে স্কাইপ করবে নাকি? হায় রে, কি পাগলের পাল্লায় পড়ল ও! এর চেয়ে স্কুটি নিয়ে পেছনে গিয়ে লোকজনকে ডাকাডাকি করলে হত বরং! ও বলল, ”মানে? ল্যাপটপ নিয়ে ওদের দিকে এগতে যাব কেন?”
সম্বরণ গম্ভীরভাবে বলল, ”যেটা বলছি সেটা কর, প্রশ্ন না করে।”
টিকলি দিশেহারা হয়ে গেল, তারপর আর কোনো উপায় না দেখে ল্যাপটপটা নিয়ে খুব সন্তর্পণে ওদের দিকে এগোতে লাগলো। মোটামুটি ওদের পাঁচ ফুটের মধ্যে গিয়ে বলল, ”এবার কি করব বল? একদম হাই ভল্যুমে কোনো র্যা প মিউজিক বাজাব? কিন্তু আমার ল্যাপটপের স্পীকারটা অতটা ভালো নয় তো!”
সম্বরণ বলল, ”না। কিচ্ছু বাজাবি না। তুই ল্যাপটপটা ওদের দিকে ঘোরা।”
টিকলি চোখ কপালে তুলে বলল, ”মানে? তু-তুই কি ওদের সাথে কথা বলবি নাকি?”
সম্বরণের পেছনে অস্তমিত সূর্য দেখা যাচ্ছে, সেই আলোয় ওর মুখটা কেমন গোলাপি লাগছে। সম্বরণ এবার একটা ধমক দিয়ে বলল, ”যেটা বলছি সেটা কর না! এত বকছিস কেন?”
টিকলি ল্যাপটপটা ষাঁড়গুলোর দিকে ঘুরিয়ে দিতেই ষাঁড়গুলোর মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। এতক্ষণ পাহাড়ের মতো নিশ্চল থাকা শরীরগুলোয় প্রাণ এসেছে যেন। টিকলি হতভম্ব হয়ে দেখল, সম্বরণ বেশ জোরে বলতে শুরু করেছে, ”যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেব, তোমরা একে একে সরে যাও। সরে বাঁদিকে চলে যাও, বাঁদিকের কালভার্টটা পেরিয়ে হাঁটো তোমরা, সোজা চলে যাও আস্তানায়……।”
বিমূঢ় টিকলি দেখল, এত আদরের সম্বোধনে পাহাড়গুলোর মধ্যে একটা মুভমেন্ট দেখা দিয়েছে, ওরা সবাই একটু গা ঝাড়া দিল, তারপর হেলেদুলে সরে যেতে লাগলো বাঁদিকে। সরে গিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল দূরে।
টিকলি কিছু বলার আগেই সম্বরণ বলে উঠল, ”তোকে ইচ্ছে করেই আজ একটু ভড়কে দিলাম। তুই সবসময় আমার কাজ না জেনেবুঝেই আমাকে ছোট করিস। কখনো কি ভালো করে শুনেছিস আমাদের কিসের ব্যবসা? গোরুর নয় মোটেই। ভালো ষাঁড় কিনে সেই ষাঁড়ের বীর্য গোয়ালাদের কাছে বিক্রি করাই আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। সেই সিমেন প্রচুর দামে গোরুদের ইনজেক্ট করা হয়, বুঝলি! তবে গোরুরা প্রেগন্যান্ট হয়। যে ষাঁড়ের বীর্য যত গুণবান, তার দাম তত বেশি। আমরা মোটেই গোয়ালা নই। আমাদের আন্ডারে অনেক লোক কাজ করে। আমাদের শুধু এই কাজের জন্যই তিনটে ম্যাটাডোর আছে।”
টিকলির দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সম্বরণ বলে যেতে লাগল, ”এখন একটা বয়সের পর ষাঁড়দের স্বাভাবিকভাবে যৌবন চলে যায়, বীর্য উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়ে তারা, তখন তাদের বেচে দেওয়া হয় কোনো কসাইয়ের কাছে। এই পাঁচটা ষাঁড় অনেকদিন রয়েছে আমাদের বাড়িতে। তাই ওরা যখন বুড়ো হয়ে গেল, আমি অনেক পড়াশোনা করতাম, রিসার্চ করতাম কি করে ওদের যৌবন দীর্ঘায়িত করা যায়। অনেক খেটেখুটে বিভিন্ন জার্নাল কনসাল্ট করে আমি একটা ওষুধ বানাই, যাতে ওদের বীর্য উৎপাদন ক্ষমতা অন্তত আরো পাঁচ বছর বাড়ে, এমনিই ওরা বাঁচে কুড়ি পঁচিশ বছর, এতে সেটা প্রায় তিরিশ হবে, আর সুস্থভাবে। আমার এই ওষুধটা ইন্টারন্যাশনাল বুল রিসার্চ ইন্সটিটিউটের জার্নালে দারুণ সাড়া ফেলল, আমি পেটেন্টও নিলাম। এখন চল্লিশজন লেবার আলাদাভাবে আমার নিজস্ব ল্যাবে কাজ করে, পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসাটাও চালিয়ে যাচ্ছি। খুব শিগগিরই আরো একটা ফ্যাক্টরি বানাচ্ছি আমি। আমার ওষুধটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শুধু বীর্য ক্ষমতাই নয়, এতে ষাঁড়দের জেনেটিক একটা পরিবর্তনও হয়, যেটা ইতিবাচক। দেখতেই পেলি কেমন পোষ মেনেছে আমার।”
টিকলি হাঁ করে শুনছিল। বলল, ”কিন্তু…কিন্তু আ-আমাকে এসব দ্যাখানোর কি মানে?”
সম্বরণ বলল, ”ইয়েস, আমি ভাবছিলাম কখন তুই প্রশ্নটা করবি। দ্যাখ, আজ খোলাখুলিই বলছি, তুই আমাকে পাত্তা দিতিস বা না দিতিস, তোকে আমি কলেজ থেকেই ভালোবাসতাম। যখন সম্প্রীত তোকে ল্যাং মারল, তার আগে থেকেই। চান্স পেয়ে বাধ্য হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হয়েছিল, নাহলে ওদিকে আমার কোনোদিনই ইন্টারেস্ট ছিল না তেমন। তাই ওদিকে আর এগোইনি। তুই আমাদের গ্রামে আসার পর থেকে তোকে আভাসে ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুই তো পাত্তাই দিলি না। তুই আমাকে ভাবতিস আমার কোনো যোগ্যতাই নেই বুঝি! খালি দুধ দুয়ে বেড়াই। তাই ভাবলাম তোকে আজ যখন কয়েকটা ষাঁড় দেখতেই আসবে, তার আগে আমার অনুগত ষাঁড়ের দলটা দিয়ে তোকে প্রোপোজটা করি।”
টিকলির মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। হেঁচকিটাও কখন যেন থেমে গেছে।
সম্বরণ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ”আগেকার দিনে তো রাজারা যে রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী হতেন, তাঁর কাছে আগে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতেন, তাই আমিও তাই করলাম আর কি! তো, বুঝতেই পারছিস তোর ওই সফটওয়ার এর প্যাংলাটার বেশি শক্তি না আমার! এবার বল, তুই কি আমায় বিয়ে করবি?”
টিকলির অনেকক্ষণ ধরেই সন্দেহটা হচ্ছিল, এবার ও বলেই ফেলল, ”তুই কোথায় রয়েছিস বল তো?”
সম্বরণ মনে হয় এতক্ষণের স্পীচের বেশ সুন্দর মহড়া দিয়ে এসেছিল, হঠাৎ এরকম আউট অফ সিলেবাস কোয়েশ্চেনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ”মা-মানে?”
টিকলি দূরে ষাঁড়গুলো যে বাড়িটায় গিয়ে ঢুকেছিল, সেদিকে তাকিয়ে বলল, ”তুই যে ক্যাটকেটে লাল গেঞ্জিটা পড়েছিস সেটা আমি এখান থেকেই তোর বাড়ির ছাদে দেখতে পাচ্ছি। এক থেকে পাঁচ গুনব, তার মধ্যে এখানে আয়।”
ঠিক তিন মিনিটের মাথায় সম্বরণ যখন হাঁপাতে হাঁপাতে টিকলির সামনে এলো, তখন টিকলি কোমরে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ আপাদমস্তক ওকে দেখে বলল, ”একটাই কন্ডিশন। গা থেকে এই গোবর গোবর গন্ধটা তাড়াতে হবে।”
সম্বরণ এক গাল হেসে দাঁত বের করে বলল, ”কোনো চাপ নেই। আজই ইন্টারন্যাশনাল কোনো ডিও অর্ডার দিচ্ছি। আমার জন্য প্লাস আমার পাঁচ ভাইয়ের জন্যেও!”
আরো দশ মিনিট বাদে সূর্য যখন পুরোপুরি পশ্চিমে ঢলে গেছে, আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে সরু রাস্তাটায়, টিকলির গোলাপি স্কুটিটা একা একা গায়ে সদ্য দেখা দেওয়া চাঁদের জ্যোৎস্না মেখে দাঁড়িয়েছিল।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে টিকলির আবার হেঁচকি শুরু হয়েছিল। বেশি উষ্ণতায় হয় এরকম ওর।
হেঁচকি তুলতে তুলতেই সম্বরণের কানে ফিসফিস করে ও বলল, ”আর তোর নিজের ওপর ওষুধটা আবার ভুল করে কখনো অ্যাপ্লাই করে ফেলিস না যেন!”