বাবা আর ভায়াগ্রা
চান্দ্রেয়ী গোঁজ হয়ে বিছানায় বসেছিল।
শুভব্রত দু-তিনবার এসে কথা বলানোর চেষ্টা করে অবশেষে ধাতানি খেয়ে বাইরের ঘরে ফিরে গেছে।
মিঠাই এসেছে বারতিনেক, ওর স্বভাবমতো কিম্ভূতকিমাকার সমস্ত প্রশ্ন করেও মা-র কাছ থেকে কোনো উত্তর পায়নি, চান্দ্রেয়ী এমন দায়সারাভাবে কথা বলেছে, শেষে বাচ্চা মেয়েটা ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেলেছে।
অন্যসময় হলে চান্দ্রেয়ী মেয়ের এইসব কৌতূহল মেটানোর দিকে কড়ানজর রাখে, এই সাড়ে তিন-চার বছর বয়সটা হল নিজের ডেটাবেস তৈরি করার সময়। এই সময় বাচ্চারা দিনে চার-পাঁচশো প্রশ্ন করে, আর সেটা স্বাভাবিক। সাধারণ জ্ঞানগুলো তো এখনই মনের অবচেতনে তৈরি হয়। নিজে সায়কিয়াট্রিস্ট হয়ে চান্দ্রেয়ী যদি নিজের মেয়েকে এই সময়টা ভালোভাবে না গড়ে তোলে, আর কে করবে?
কিন্তু আজকের ব্যাপার আলাদা। চান্দ্রেয়ী বিছানায় বসেও যেন এখানে নেই, শূন্যদৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে দূরের কোনো অজানা দিকে।
শুভব্রত বাইরের ঘরে দিব্যি খোশগল্পে মেতেছিল, এবারে অনেকদিন পর শ্বশুরবাড়ি আসা হয়েছে। ব্যাঙ্গালোরে দুজনেরই টাইট শিডিউল, শুভব্রত আর চান্দ্রেয়ী একই হসপিটালে চাকরি করে, ও অর্থোপেডিক, আর চান্দ্রেয়ী সায়কিয়াট্রি। সেখানে পুজোর সময় এত টানা ছুটি কোনোবারই মেলে না, একদিন ছুটি নিয়ে হোয়াইটফিল্ড বা কোনো বেঙ্গলি ক্লাবে মেয়েকে নিয়ে গিয়ে দুর্গাপুজো দেখাতে হয়। তাই এবার প্রায় এপ্রিল-মে মাস থেকে দুজনেই প্ল্যান করেছিল পুজোয় দিনদশেকের ছুটি নিয়ে কলকাতা আসবেই।
কলকাতা মানে চান্দ্রেয়ীর বাড়ি। শুভব্রতর বাবা-মা কয়েক প্রজন্মের প্রবাসী বাঙালি, তাঁরা থাকেন রাজস্থানের জয়পুরে। সেখানেও ঘুরে আসা হয়েছে এই বছরের জানুয়ারিতে।
চান্দ্রেয়ী বিছানায় এতক্ষণ বসেছিল, এবার পা-দুটোকে সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে মাথাটা একটু হেলিয়ে দিল বালিশে। সদ্য পাটভাঙা নতুন শাড়ি পরেছিল প্যান্ডেলে একটু ঘুরে আসবে বলে।
কিন্তু এখন সেসব আর ইচ্ছেই করছে না। এটা কি করে সম্ভব? যতবার ব্যাপারটা ভাবছে, ভেতরে ভেতরে কেমন একটা ভয়মেশানো বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে। বাবা, যাকে ও ছোট্ট থেকে নিজের আদর্শ ভেবে এসেছে, সেই বাবার সম্পর্কে এইধরনের কথা যেন ও কল্পনাও করতে পারছে না!
মা কখন ঘরে ঢুকেছেন ও খেয়াল করেনি, এখন চটকাটা ভেঙে গেল মায়ের কথায়, ”কি ব্যাপারটা কি তোর? নিজেই সকাল থেকে উঠে আমাকে তাড়া মারলি প্যান্ডেলে যাব প্যান্ডেলে যাব করে, তাড়াহুড়ো করে রান্নাবান্না সারলাম, আর নিজেই এখন গোঁজ হয়ে বসে পড়লি?”
চান্দ্রেয়ী এবারেও কোনো উত্তর দিল না।
উদাসচোখে মাথাটা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিল।
”কি হয়েছে কি তোর?” মা এবার পায়ে পায়ে ওর কাছে এগিয়ে এলেন, ”শুভব্রতর সঙ্গে আবার ঝগড়া-টগড়া করলি নাকি? ভালো ছেলেটাকে পেয়েছিস তো, তাই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছিস। আমাদের মতো হলে …!”
মায়ের এই তিনশো তিরানব্বইবার বলা কথার মাঝখানে চান্দ্রেয়ী বাধা দিয়ে বলল, ”আচ্ছা মা, আমরা যখন থাকি না, তোমরা তখন কি করো?”
”মানে?” মা এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে যেন বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন, ”তোরা আবার থাকিস কোথায়! এই তো এলি কতদিন পর!”
”হ্যাঁ সেটাই বলছি। দুজনে মিলে সকাল থেকে কি করো এতবড় বাড়িতে সারাদিন?”
”কি আবার করব?” মা খাটের একপাশে কাল রাত থেকে পড়ে থাকা চান্দ্রেয়ীর সালোয়ার কামিজটা ভাঁজ করতে শুরু করলেন, ”তোর বাবা সকালে উঠে বাইরের বাগানে ফুলগাছগুলোর তদারকি করে, আমি ফুলুর মা এলে রান্নার জোগাড় করি।”
”তারপর?” চান্দ্রেয়ী তীক্ষ্ন গলায় প্রশ্ন করে।
”তারপর কাগজ পড়তে পড়তে চা খেয়ে তোর বাবা বাজারে যায়, আমি জলখাবার বানাই, বাজার থেকে ফিরে জলখাবার খেয়ে খেলতে বসে পড়ে।” মা এবার ভ্রু কুঁচকোলেন, ”কি ব্যাপার বল তো? আমরা সারাদিন কি করি, তাই নিয়ে তুই কি করবি? এসব তো কোনোদিন জিজ্ঞেস করিস না?”
”কতক্ষণ মোবাইলে খেলে বাবা?” চান্দ্রেয়ী মা-র শেষ প্রশ্নটায় পাত্তাই দিল না।
”ওই তো, একটা-দেড়টা নাগাদ। তারপর স্নান করে খেতে বসে। দুপুরে চারটে অবধি খেলে ক্লাবে বেরিয়ে যায়। আসে সন্ধে ছ-টা সাড়ে ছ-টা। এসে একটু টিভি-ফিভি দেখে, আমিও বইটই পড়ি, তারপর রাতের খাওয়া সেরে ঘুম।” মা চোখ সরু করলেন, ”বুড়োবুড়িকে নিয়ে গল্প লিখবি নাকি?”
চান্দ্রেয়ী এবারেও মা-র কথায় উত্তর দিল না, কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল, ”তার মানে, সকালে দশটা থেকে একটা, আবার দুপুরে দুটো থেকে চারটে অবধি বাবা মোবাইলে বসে থাকে?”
”তাছাড়া আবার কি!” মা এবার মুখ বেঁকালেন, ”আগে তবু গল্পগুজব করত, ক্লাবে কি হল, চায়ের দোকানে কি হল, এখন সারাক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে মোবাইল করছে। বিরক্ত লেগে যায় মাঝেমধ্যে! চোখেরও বারোটা বাজছে, ঘাড়েরও।”
”বাবা যখন মোবাইলে খেলে, তখন তুমি পাশেই বসে থাকো?” মা থামতে না থামতেই চান্দ্রেয়ী বুলেটের মতো প্রশ্ন করল।
মা এবার ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ”আমার কি কাজকম্ম নেই নাকি যে সারাক্ষণ পাশে বসে থাকব? তোর বাবা তো মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত, আমি একা একা বসে কি করব? আমি আমার কাজ করি, সংসারে কি কাজ একটা? তাছাড়া তোর বাবা তো দোতলায় গিয়ে খেলে।”
চান্দ্রেয়ী ঠোঁট কামড়াল।
পাঁচ বছর আগে যখন বাবা রিটায়ার করেছিলেন, তার বহু আগে থেকেই ওরা সবাই জানত বাবা অবসর জীবনটা খেলেই কাটাবেন।
খেলা মানে ব্রিজ। বাবার ব্রিজ খেলার নেশা বহুবছর থেকে ছিল, সেই ট্রেনে সবাই মিলে রুমাল পেতে খেলতে খেলতে যাওয়া থেকে নানারকমের টুর্নামেন্ট। তারপর তো গত দশবছর হল ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ক্লাবের হয়ে খেলে বেড়ান। আগে অফিস থাকার সময় তবু ছুটিছাটা পাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা ছিল, রিটায়ারের পর আর কোনো অসুবিধা নেই। এপাড়ার আরো দুজন আছেন, সাধনকাকু আর ব্যানার্জিজেঠু, তিনজন মিলে হিল্লিদিল্লি করে বেড়ান।
বছরখানেক ধরে চান্দ্রেয়ী যখনই ফোনে বাবাকে জিজ্ঞেস করত, ”কি বাবা, কেমন খেলা হচ্ছে?”
বাবা তখন বিমর্ষমুখে বলতেন, ”আর বলিস না। দিনদিন পিছিয়ে পড়ছি।”
”কেন? এই তো এত মোটা মোটা বই পড়ো!” চান্দ্রেয়ী অবাক হয়েছিল।
বাবা মাথা নেড়েছিলেন, ”শুধু বই পড়ে থিওরেটিকাল নলেজ নিয়ে তো কিছু হয় না, রেগুলার বাঘা বাঘা খেলোয়াড়ের সাথে খেলতে হয়, তবেই তো চালগুলো পাকা হবে। চৌধুরী, ব্যানার্জিদা আর সাধনও আমারই মতো, ঠিক সময়ে কল করতে পারে না। আমরা টুর্নামেন্টগুলোয় শুধু এইজন্য ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি!”
চান্দ্রেয়ী চিন্তিতভাবে বলেছিল, ”তাহলে? কি উপায়? সবাই কি করে প্র্যাকটিস করে? মানে বললেই তো আর কেউ বাঘা বাঘা প্লেয়ার পাচ্ছে না দিনরাত প্র্যাকটিসের জন্য।”
”একটা ওয়েবসাইট আছে।” বাবা বলেছিলেন, ”সেখানে সারা পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে সবরকমের প্লেয়ার অনলাইন থাকে। সেখানেই তো সবাই খেলে। তিনরকম ক্যাটেগরি হয়। বিগিনার, মডারেট আর এক্সপার্ট। রোজ ওই এক্সপার্টদের সাথে খেলতে পারলে …!” বাবা উৎসাহী গলায় বলেছিলেন।
বাবার ব্রিজ খেলা নিয়ে চিরকালই চান্দ্রেয়ীর ভীষণ উৎসাহ, বাবা থামতে না থামতেই বলে উঠেছিল, ”দারুণ তো! তুমিও খেল।”
বাবা বলেছিলেন, ”কি করে খেলব? আমার কি কম্পিউটার আছে? আর এই বুড়ো বয়সে ওইসব শেখার আর ইচ্ছেও নেই।”
চান্দ্রেয়ী আর কিছু বলেনি। দিনকয়েক পরে অনলাইন একটা ই-কমার্স সাইট থেকে ঝকঝকে একটা স্মার্টফোন পৌঁছে গিয়েছিল কলকাতায় বাবার ঠিকানায়।
বাবা অমনি ফোন করেছিলেন, ”এইবয়সে এইসব ঢাউস ফোন কি করে ইউজ করব! দুমদাম তুই এসব পাঠাস কেন? এটা ফেরত দেওয়া যাবে না?”
”না যাবে না।” হসপিট্যালে ডিউটি করতে করতে চান্দ্রেয়ী সাফ জানিয়েছিল, ”রুকুকে বলে দিয়েছি, বিকেলবেলা ও গিয়ে তোমার ফোনে ওই ওয়েবসাইটের অ্যাপটা ইন্সটল করে সব শিখিয়ে দিয়ে আসবে।”
রুকু ওদের পাশের বাড়িতে থাকে। ক্লাস এইটে পড়ে। সে এসে জেঠুকে শুধু ব্রিজ খেলাই নয়, আরো অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
ফলস্বরূপ সপ্তাহখানেকের মধ্যে বাবার যখন তখন ভিডিও কলের ঠ্যালায় চান্দ্রেয়ী পাগল হয়ে যেতে বসেছিল প্রায়।
এখন বাবা ফোনটাকে অনেকটাই রপ্ত করে ফেলেছে, নাতনির সাথে ভিডিও চ্যাট থেকে শুরু করে, কোন দরকারী ডকুমেন্টস ছবি তুলে পাঠানো, সবই করে ফেলে নিমেষে।
কিন্তু এতকিছুর ভালোর মধ্যে যে কাল রাতে চান্দ্রেয়ীকে যে ওইরকম একটা জিনিস দেখতে হবে, তা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
মা কখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন, ভাবতে ভাবতে ও খেয়ালই করেনি। সম্বিত ফিরল শুভব্রতর কথায়, ”কি ব্যাপারটা কি তোমার, অ্যাঁ?”
চান্দ্রেয়ী চমকে তাকাতে শুভব্রত বেশ গলা চড়িয়ে বলে চলল, ”কবে থেকে কলকাতার পুজো কলকাতার পুজো করে হাঁপিয়ে যাচ্ছিলে, আর এখন সকাল থেকে বিছানায় থম মেরে বসে আছ। মা পর্যন্ত তোমার জন্য রেডি হয়ে বেরোতে পারছেন না। মিঠি, বাবা সবাই হাঁকডাক করছে। কি হল কি তোমার?”
চান্দ্রেয়ী কেমন শূন্য দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকাল।
চান্দ্রেয়ীর এরকম মূর্তি দেখে শুভব্রত এবার একটু ভেবলে গেল, কাছে এসে বলল, ”কি হয়েছে বলো তো তোমার? এনি প্রবলেম?”
ছোট থেকেই চান্দ্রেয়ীর এই এক দোষ, মন খারাপের সময় কেউ ভালো করে কথা বললেই ও নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না, সব দুঃখ ঝরিয়ে দিয়ে পেতে চায় একটু আশ্রয়। এবারেও সেটাই হল। শুভব্রতর নরম জিজ্ঞাসাতেই ওর চোখ জলে ভরে গেল, সেখানে টলটল করতে লাগল বড় বড় জলের ফোঁটা।
”কি হয়েছে চান্দ্রেয়ী?” দেখেশুনে শুভব্রত আরো হতবুদ্ধি হয়ে গেল। এতদিন পরে বাপের বাড়ি এসে কান্নাকাটি তো খুব সামান্য ব্যাপার নয়।
চান্দ্রেয়ীর গলার কাছটা দলা পাকিয়ে উঠছিল। তবু ও মুখে কিছু বলতে পারল না। হাতের চেটো দিয়ে চোখদুটো মুছে ধরা গলায় বলল, ”কিছু না। তুমি যাও। মা-কে বলো আমি আসছি।”
কিন্তু শুভব্রত গেল না, উলটে খাটের কোণায় বসে পড়ে বলল, ”না বলো আমাকে কি হয়েছে।”
চান্দ্রেয়ী কাঁদোকাঁদো মুখে শুভব্রতর মুখের দিকে তাকাল। শুভব্রত শুধু যে ওর স্বামী তাই নয়, কতবছর হয়ে গেল, সেই মেডিক্যাল কলেজ থেকে ওরা বন্ধু। সামান্য কিছু ঘটলেও ওকে না বললে পেটের ভাত হজম হয় না চান্দ্রেয়ীর।
কিন্তু, এ যে বড় লজ্জার কথা! কি করে বলবে ও? বাবার সম্পর্কে এত খারাপ একটা ব্যাপার, এত চিন্তার একটা ব্যাপার কি ওকে বলা যায়?
শুভব্রতই বা কি ভাববে শ্বশুরমশাইয়ের সম্পর্কে?
তবুও চান্দ্রেয়ী বলাই ঠিক করল। এভাবে মনের মধ্যে একা একা গুমরে মরলে লাভ তো কিছু হবেই না, উলটে বিপদ বাড়তে পারে।
বিদ্যুৎচমকের মতো ওর মনে হল, আচ্ছা, বাবা কোনো ফাঁদে পড়েননি তো? কোনো বিপদে পড়লে ওরা তো ব্যাঙ্গালোর থেকে চট করে আসতেও পারবে না, তখন কি হবে!
ও কাঁদো কাঁদো গলায় শুভব্রতর হাতটা চেপে ধরে বলল, ”বাবা … বাবা খুব খারাপ হয়ে গেছে গো!”
”বাবা খারাপ হয়ে গেছে!” শুভব্রত আরো দিশেহারা হয়ে গেল, ”মানে?”
চান্দ্রেয়ী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ”বাবা সকালে ফোনটা দিয়ে গিয়েছিল, বলল সাইলেন্ট হয়ে যায় মাঝেমধ্যে ফোনটা, একটু ঠিক করে দে তো!”
”হ্যাঁ তো?”
”বাবার ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে যা দেখলাম …!” চান্দ্রেয়ী আর নিজেকে সামলাতে পারল না, বেশ সশব্দে কেঁদে উঠল।
শুভব্রত বলল, ”আরে কি দেখলে সেটা বলবে তো!”
চান্দ্রেয়ী প্রাণপণে নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল, ”দেখলাম কাল বাবা ইন্টারনেটে সার্চ করেছে ভায়াগ্রা সত্যিই উপকারী কিনা!” কথাটা বলেই ও লজ্জায় বালিশে মুখ গুঁজে ফেলল।
শুভব্রত সামান্য কয়েক মুহূর্ত নিল পুরো ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য, তারপর হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ল, ”তুমি এই সামান্য ব্যাপারের জন্য সকাল থেকে মৌনব্রত পালন করছ? আরে ওইসব লিঙ্ক তো ভাইরাস, অনেক সময় দেখবে একটা ওয়েবপেজ খুলতে গেলে ওইসব খুলে গেল। তুমি না সত্যিই!”
”না। এটা ভাইরাস নয়।” চান্দ্রেয়ী শক্তগলায় বলল, ”বাবা গুগলে বারবার সার্চ করেছে, সেটা আমি সার্চ হিস্ট্রিতে দেখেছি। শুধু তাই নয়, বাবা আমাজনেও উইশ লিস্টে অ্যাড করে রেখেছে।”
শুভব্রত এবার হাসি থামিয়ে বলল, ”তা রেখেছেন রেখেছেন। তাতে তোমার সমস্যাটা কোথায়? একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাঁর নিজের ইচ্ছেমতো কিছু কেনার কথা ভাবতেই পারেন। আর …।” শুভব্রত এবার রীতিমতো রেগে উঠল, ”তোমার এই গোয়েন্দাগিরির বদভ্যাসটা আমার ওপর দেখিয়ে দেখিয়ে তো আমার অবস্থা খারাপ করছই, এবার যার-তার ওপর অ্যাপ্লাই করতে শুরু করেছ। এগুলো কি ধরনের অভব্যতা? ছি ছি। বাবা শুনলে কি ভাববেন বলো তো? প্রত্যেকের একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকে। সেটাকে সম্মান করতে শেখো।”
চান্দ্রেয়ী যেন শুনতেই পেল না, বলল, ”তুমি বুঝতে পারছ না। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন বাবা-মা আমরা কি করছি, কার সাথে মিশছি সেসব দিকে খেয়াল রাখতেন না?”
”তোমার বাবা এখন কি ছোট হয়ে গেছেন বলতে চাও?” শুভব্রত এবার ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠছিল।
”আহা বয়সে ছোট না হোক, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় তো ছোটোই। ইন্টারনেটে কতরকম ট্র্যাপ থাকে, তা তুমি জানো না?” চান্দ্রেয়ী বলল, ”এইতো সেদিন, আমাকে ফোন করে বলে কি, একটা ইমেল এসেছে আমি ১০ লক্ষ পাউন্ড জিতেছি, একাউন্ট নম্বর পাঠাতে বলছে, রিপ্লাইতে গিয়ে লিখে সেন্ড করে দেব তো? ভাব! যদি আমাকে না জিজ্ঞেস করত, তাহলে কি হত?”
শুভব্রত বলল, ”কিন্তু এখানে তো তেমন কিছু …!”
”কে বলেছে তোমায়?” চান্দ্রেয়ী ফুঁসে উঠল, ”তুমি জানো এই বয়সে কতরকম সমস্যা হয়? মেয়েদের মেনোপজাল ডিপ্রেশনের মতো ছেলেদেরও ডিপ্রেশন আসে। মা তবু আমার সাথে শেয়ার করতে পারে, বাবা কার সাথে করবে? হসপিট্যালের জার্নালে গতবছর একটা আর্টিকেল লিখেছিলাম পড়োনি? হাইপারঅ্যাকটিভ সেক্সুয়াল ডিজায়ার ডিজঅর্ডার অ্যামাং এল্ডারলি?” চান্দ্রেয়ীর মুখটা আবার কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল, ”বা-বাবারও যদি তেমন কিছু হয়? হয়তো সঙ্কোচে কাউকে বলতেও পারছে না, মা-র সাথেও শেয়ার করতে পারছে না, এদিকে ইন্টারনেটে এইসব করে কোনো ডেটিং সাইট ফাইটে গিয়ে যদি বাজে কারুর পাল্লায় পড়ে …!”
”উফ! কোথা থেকে কোথায় নিয়ে চলে গেলে!” শুভব্রত রেগেমেগে বলল, ”আগে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে দাও। প্রথমেই ওভাররিয়্যাক্ট কোরোনা। বাবার সার্চ হিস্ট্রিতে ভায়াগ্রা ছাড়া আর কি দেখেছ?”
চান্দ্রেয়ী এবার অসহায় চোখে তাকাল, ”আর তো কিছু তেমন … মানে ওই টুকটাক … ফেসবুক, নেটব্যাংকিং, ব্রিজ, শেয়ারমার্কেট এইসব।”
”কোনো পর্নোগ্রাফি সাইট চোখে পড়েনি?” শুভব্রত চোখ সরু করে বলল।
চান্দ্রেয়ীর মুখটা নিমেষে লাল হয়ে উঠল, ”ছি! তুমি আমার বাবার সম্পর্কে এমন বাজে ভাবনা ভাবতে পারলে? আমার বাবার মতো আদর্শবাদী মানুষ তুমি দেখেছ কখনো? এইজন্য তোমায় কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।”
”আ হা!” শুভব্রত বলল, ”এর সাথে ভাল খারাপ আদর্শ-টাদর্শের কি আছে রে বাবা! উফ, এটা একটা হিউম্যান ইন্সটিংক্ট! প্রতিটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ জীবনে একবার হলেও পর্ণ দেখেছেন।”
”থামো তুমি।” চান্দ্রেয়ী কেটে কেটে বলল, ”আমার বাবা তোমার মতো নয়। আমাদের গোটা সুভাষনগর জানে বাবা কেমন মানুষ, বুঝলে? সমস্ত মেয়েকে উনি মাতৃজ্ঞানে দেখেন।”
”সমস্ত মেয়েকে মানে, তোমার মাকেও কি মায়ের চোখে …?” শুভব্রত রাগিয়ে দেওয়ার জন্য আরো কি বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চুপ করে গেল।
আকস্মিক চান্দ্রেয়ীর বাবা ঢুকেছেন ঘরে, ”কি ব্যাপার! তোরা বেরোবি না? বেলা তো হয়ে এল। এরপর আর কখন যাবি?”
চান্দ্রেয়ী মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল, ”হ্যাঁ, এই যাব। বাবা তোমার ফোনটা আর সাইলেন্ট হয়ে যাচ্ছে নাতো?”
বাবা হেসে বললেন, ”না, এইতো সাধন ফোন করল, তোকে বলেছিলাম না, একাদশীর দিন আমরা ক্লাবে একটা হেলথ ক্যাম্প করছি, সেই ব্যাপারেই। দিব্যি রিং হল।” কথাটা বলেই বাবা শুভব্রতর দিকে তাকালেন, ”তোমাকে কিন্তু ঘণ্টাতিনেক বসতে হবে সেদিন ওখানে শুভব্রত। আমি সবাইকে বলে রেখেছি। বেশি কিছু না, একটু জেনারেল চেক আপ করলেই …!”
”হ্যাঁ হ্যাঁ সে ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার নয় বাবা।” শুভব্রত আশ্বস্ত করল, ”সঙ্গে ব্লাড ডোনেশন-টোনেশনও আছে নাকি?”
”ব্লাড ডোনেশন আগেরবার রেখেছিলাম, এবার বাদ দিয়েছি। পরে সেই ব্লাড রিপোজিটরি নিয়ে খুব সমস্যা হয়, ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোও অনেক অজুহাত দেখায়।” বাবা বললেন, ”এবার ওই কয়েকজন ডাক্তার বসবেন, কিছু ওষুধ দেওয়া হবে, ওই আর কি!”
”শুভব্রতকে বসতে বলছ, আর আমাকে বলছ না?” চান্দ্রেয়ী খনখনে গলায় বলল।
বাবা বললেন, ”হাড়ের সমস্যায় তো সবাই এখন ভুগছে, বিশেষ করে পাড়ার বয়স্করা। তাই অর্থোপেডিকের খুব ডিমান্ড। সঙ্গে অস্থায়ী এক্স-রে মেশিনও লাগাচ্ছি আমরা, যাতে দরকারে চট করে এক্স-রে করে দেখিয়ে নেওয়া যায়।” তারপর বাবা চান্দ্রেয়ীকে রাগানোর জন্য শুভব্রতর দিকে তাকিয়ে একটু চোখ টিপে বললেন, ”মাথার গোলমালে তো এখনো তেমন কেউ পড়েনি, তাই তোকে আর ডাকা হচ্ছে না।”
চান্দ্রেয়ী আবার রেগে উঠল, ”তোমাকে কতবার বলেছি সায়কিয়াট্রিস্ট মানে মোটেও পাগলের ডাক্তার নয়? মানুষের এখন স্ট্রেসফুল জীবন, সবারই মাঝেমধ্যে সায়কিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।”
”সে যাইহোক, এখানকার লোকেদের ওইসব ডাক্তারের দরকার নেই।” বাবা গম্ভীরভাবে বললেন, ”তখন তো অনেকবার বলেছিলাম কার্ডিও বা অর্থোতে এমডিটা কর, তখন তো শুনিসনি।”
শুভব্রত এবার চান্দ্রেয়ীকে আরো চটিয়ে দিতে দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, ”আসলে নম্বরটা একটু বেশি পেলেই ওগুলো পেয়ে যেত, সেটা হল না, আর কি করা যাবে!”
চান্দ্রেয়ী দুজনের রসিকতা এখনো বুঝতে পারল না, বলল, ”মানে? আমি তোমার থেকে বেশি মার্কস পেয়েছিলাম শুভ! সায়কিয়াট্রি আমি স্বেচ্ছায় পছন্দ করেছিলাম! আর বাবা তুমিও চুপ করে বসে কি শুনছ? তুমি তো সত্যিটা জানো!”
বাবা হাত উলটে বললেন, ”আমি তোদের ডাক্তারির পরীক্ষার কি অত বুঝি বল তো? যা বুঝিয়েছিস তাই বুঝেছি।”
চান্দ্রেয়ী এবার আর সহ্য করতে পারল না, বিছানা থেকে নেমে দুম দুম করে পা ফেলে চলে গেল বাইরের ঘরে।
বাবা আর শুভব্রত হেসে উঠল হো হো করে। বউ রেগেমেগে চলে গেলেও শুভব্রত বেশি চাপ নিল না, চান্দ্রেয়ীর মান-অভিমান এই বর্ষা, এই শরতের মত। একটু বাদেই ঠিক হয়ে যাবে।
*
কিন্তু কিছুই ঠিক হল না।
চান্দ্রেয়ীর দুশ্চিন্তা তো কমলই না, বরং হু হু করে বেড়ে গেল।
মহাষ্টমীর সকালে ও মিঠাইকে শাড়ি পরিয়েছিল। অনেকদিন ধরে ইচ্ছে ছিল মেয়েকে টুকটুকে একটা শাড়ি পরিয়ে অঞ্জলি দেওয়াবে। বাইরে থেকে থেকে বাঙালি কালচারগুলো তো শিখছেই না। সেইমত সাজিয়ে গুজিয়ে চান্দ্রেয়ী মা আর মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছিল পাড়ার পুজোয় পুষ্পাঞ্জলি দিতে।
চান্দ্রেয়ীর মা নাতনির হাত ধরে হাঁটছিলেন। মিঠাই একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল দিদুনকে। মহিষাসুর কেন বন্দুক চালায় না, মা দুর্গা কেন হাজব্যান্ডকে নিয়ে বাপের বাড়ি আসে না, এমন হাজার হাজার সব অদ্ভুত প্রশ্ন। চান্দ্রেয়ীও হাসিমুখে হাঁটছিল পাশে পাশে।
হঠাৎই ছন্দপতন। বিভিন্ন সময়ে বাবার ইমেলগুলো চেক করার জন্য বাবার ইমেল অ্যাকাউন্টটাও ওর ফোনে লিঙ্ক করা আছে। সেই ইমেল অ্যাকাউন্টেই একটা মেল ঢুকল, ”নমস্কার মি. জয়ন্ত চক্রবর্তী, অমুক ওয়েবসাইটে অর্ডার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার অর্ডার তিন-চারদিনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।”
সঙ্গে অর্ডার ট্র্যাক করার একটা লিঙ্ক।
চান্দ্রেয়ী ভ্রু কুঁচকে প্যান্ডেলে ঢোকার আগে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মা বললেন, ”কি হল চল। মাইকে অ্যানাউন্স করছে, আর একবার মাত্র হবে।”
লিঙ্কটা খোলামাত্রই চান্দ্রেয়ীর মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল ও। বলল, ”তোমরা ঢোকো, আমি আসছি।”
”কখন যে কি মতিগতি হয় কিছুই বোঝা যায় না!” গজগজ করতে করতে মা কাঁধ ঝাঁকিয়ে মিঠাইকে নিয়ে এগোলেন।
চান্দ্রেয়ীর হাত কাঁপছিল, তারই মধ্যে ও অতিকষ্টে শুভব্রতকে ডায়াল করল, অস্ফুটে বলল, ”সব শেষ হয়ে গেল গো!”
মাইকে ইতিমধ্যে এক পর্ব পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রোচ্চারণ শেষ, এখন বিরতিতে গান বাজছে। চারদিকের কোলাহলে শুভব্রতর গলা শুনতে পেল, ”আবার কি হল?”
”বা-বাবা!”
”হ্যাঁ, বাবার কি হল আবার?”
চান্দ্রেয়ী অস্ফুটে বলল, ”বাবা একটা অনলাইন মেডিসিন শপ থেকে ভিগোরা ১০০ অর্ডার দিয়েছে। ৫০ প্যাকেট।”
”প-পঞ্চাশ প্যাকেট!” চান্দ্রেয়ী এদিক থেকে দেখতে না পেলেও পরিষ্কার বুঝতে পারল শুভব্রতর মুখটা হাঁ হয়ে গেছে।
ও বলল, ”হ্যাঁ।”
শুভব্রত বলল, ”ভিগোরা ১০০ তো ভায়াগ্রা। প্রেসক্রিপশন ছাড়া এইরকম ওষুধ তো অনলাইনে পাওয়া যায় না! তার ওপর এতগুলো!”
চান্দ্রেয়ী এবার এদিক-ওদিক দেখে ছলছলে চোখে বলল, ”নিজের ইচ্ছেমতো ট্যাবলেটগুলো খেলে বাবার যে হার্ট ফেলও হয়ে যেতে পারে, নিশ্চয়ই জানো তুমি!”
”সেতো খুবই ন্যাচারাল। সম্রাট শাজাহান কি করে মারা গিয়েছিল জানো না? বুড়ো বয়সে দুটো কচি মেয়ের সাথে ফুর্তি করার আগে নিজের পারফরম্যান্স বাড়াতে গিয়ে ভায়াগ্রা খেয়েছিল। সামলাতে পারেনি, একদম হার্ট ফেল।” শুভব্রত বলল।
”তুমি থামবে?” চান্দ্রেয়ী ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, ”তোমাকে কতবার বোঝাব যে আমার বাবা … আমার বাবা ওইরকম নয়! মানে, আমি যে কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না!”
শুভব্রত বলল, ”এখানে আরো একটা বোঝার মতো ব্যাপার আছে। তোমার বাবা কি তোমার মা-র জন্যই … মানে ইয়ে… অন্যভাবে নিও না, মানে আমি ভাবছি, তোমার বাবাও ওইরকম কোনো বাচ্চা মেয়ের জন্য এইসব …।”
চান্দ্রেয়ীর মুখটা কালো হয়ে গেল। ওদিক থেকে আসছিল পাড়ার দাদা বিল্টুদা, সে বলল, ”কিরে চাঁদু, ধেড়ে মেয়ে হয়ে রাস্তার মধ্যে কাঁদছিস কেন? হারিয়ে গেছিস নাকি?”
চান্দ্রেয়ী ফোনটা আগেই কেটে দিয়েছিল। এখন শক্তমুখ করে এগোল। বিল্টুদা এখনো ওকে ক্লাস ফাইভের চান্দ্রেয়ী ভাবে। সবার সামনে চাঁদু বলে ডাকবে আর পেছনে লাগবে। আলগোছে চোখের পাতায় লেগে থাকা অশ্রুবিন্দুটা মুছল ও।
কি করবে ও? কার সাথে শেয়ার করলে বাবাকে এই বিপদ থেকে মুক্ত করতে পারবে? এইবয়সে এতগুলো ভায়াগ্রা ট্যাবলেট খাওয়ার পরিণাম কি ভয়ানক হতে পারে, নিজে ডাক্তার হয়ে সেটা ও হাড়ে হাড়ে বুঝছে। কিন্তু বাবাকে কি করে বোঝাবে? কাকে দিয়ে বোঝাবে?
পরক্ষণে শুভব্রতর কথাটা না চাইতেও মনে ভেসে ওঠে। সত্যিই কি বাবা অন্য কোনো মেয়ের সাথে … সে-ই কি এইসব বুদ্ধি দিচ্ছে? কোনো পেশাদার প্রস্টিটিউট ছাড়া এমন বুদ্ধি কে দিতে পারে?
চান্দ্রেয়ী পুস্পাঞ্জলি তো দিলই না, সারাটা দিন বলতে গেলে কিছুই খেল না। উল্টে অষ্টমীর সারাটা দুপুর বাবার ফোন নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে রইল।
বাবা-মা, শুভব্রত তো বটেই, মিঠাইও মায়ের এই আচরণে বেজায় ক্ষুব্ধ। মিঠাই কবে থেকে শুনে আসছে কলকাতায় গিয়ে মা এখানে নিয়ে যাবে, ওখানে নিয়ে যাবে, আর সেখানে এরকম কারুর ভালো লাগে?
কিন্তু যে যাই ভাবুক, চান্দ্রেয়ী সারাটা দুপুর বাবার ফোন পুরো ঘেঁটে ফেলল। কিন্তু কোথাও কোন সন্দেহজনক মেসেজ বা মেল পেল না। বাবার ইনবক্সে কেজো জিনিস আর গ্যালারিতে নাতনির ছবি ছাড়া কিছুই নেই।
তবে? তবে কি মা-র জন্যই? চান্দ্রেয়ীর কানদুটো অজান্তেই লাল হয়ে উঠল। কিন্তু মা-র তো মেনোপজ হয়ে গেছে, এইসময় এত বাড়াবাড়ি করলে … ও আর ভাবতে পারছিল না। মেডিকেল সায়েন্স যাই বলুক, নিজের বাবামা-কে সবসময় যুক্তির আতশকাচের নীচে ফেলে দেখতে মন চায় না।
অষ্টমীর সন্ধেবেলা সারা কলকাতা যখন আলোর গয়নায় মেতে উঠেছে, তখন চান্দ্রেয়ীদের বাড়িতে রীতিমতো অশান্তি শুরু হয়েছে। বাবা-মা, শুভব্রত, মিঠাই প্রচণ্ড রেগে গেছে চান্দ্রেয়ীর ওপর। সবাই সেজেগুজে রেডি, চান্দ্রেয়ী সেই একভাবে শুয়ে আছে।
মিঠাই তো রীতিমতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে, ”চলো না মাম্মাম, প্লিজ! তুমি কতকিছু প্রমিস করে এলে, এখন তো একটাও রাখছ না। আমি একটাও ভালো ছবি গিয়ে বন্ধুদের দেখাতে পারব না।”
চান্দ্রেয়ীর মা রাগ চাপতে চাপতে বললেন, ”চল মিঠাই আমরাই ঘুরে আসি। তোর মা ওইরকমই, বিয়ের আগেও যেমন, বিয়ের পরেও তেমন! এত মেজাজ নিয়ে কি করে কি করবে কে জানে!”
চান্দ্রেয়ী করুণচোখে মা-র দিকে তাকাল, হায়! যার জন্য করি চুরি, সে-ই বলে চোর! মা বুঝতেও পারছে না আসন্ন কতবড় বিপদের হাত থেকে এই চক্রবর্তীবাড়িকে বাঁচানোর জন্য নিজের শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছে চান্দ্রেয়ী!
ইতিমধ্যে বাবার বন্ধু ব্যানার্জিজেঠুও চলে এসেছেন। এমনি সময় চান্দ্রেয়ী ব্যানার্জিজেঠু এলেই হাঁটু মুড়ে বসে খোশগল্পে মেতে ওঠে, ব্যানার্জিজেঠু লোকটা ভারি আমুদে, বিয়ে-থা করেননি, ক্লাব, খেলা আর পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে থাকেন। আড্ডা একেবারে জমিয়ে দেন বসলেই। এই বয়সেও বিশাল ফিট, দৈনিক ব্যায়াম জগিং করেন আর মাঝেমধ্যেই কাউকে কিছু না বলে কয়ে উধাও হয়ে যান কোথায়, আবার ফিরে আসেন হঠাৎ করে।
জেঠু বললেন, ”আরে ডাক্তারম্যাডাম কেমন আছেন? আমাদের দিকে একটু চেয়ে দেখুন!”
হালকা হাসলেও আজ চান্দ্রেয়ী জ্যেঠুকে খুব একটা সাড়াশব্দ দিল না। ভালোই লাগছে না কিছু! অজানা একটা আশঙ্কায় মন কু ডাকছে ঘনঘন।
এটা এমন একটা বিষয় যা মা-কে বলা যায় না, শুভব্রতকে বলে তো কোনো লাভই হল না, ছেলেটা বিয়ের আগে অনেক ভালো ছিল, দিনদিন দাম্পত্য পুরনো হচ্ছে, আর কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।
সবই আসলে চান্দ্রেয়ীর দুর্ভাগ্য!
সময় কারুর জন্যই থেমে থাকে না। অষ্টমী, নবমী, দশমী এভাবেই কেটে গেল। আনন্দের অনুষ্ঠানে বেজে উঠল মায়ের বিসর্জনের বিষাদসুর।
চান্দ্রেয়ীকে বাকি ক-টা দিন আর কেউ জোরাজুরি করেনি। ও একবারও বেরনো তো দূরের কথা, ভালো জামাকাপড়ও পরেনি। সারাক্ষণ নিজের ঘরের জানলায় বসে চেয়ে থেকেছে বাইরের দিকে, মাইকে বাজা গানের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলতে চেয়েছে নিজেকে।
থেকে থেকে ছোটবেলার কথা ওর মনে ভেসে এসেছে।
বাবা। সেই বাবা, যাকে ও ছোট থেকে নিজের আদর্শ ভেবে এসেছে। যে বাবাকে কখনো একবারের জন্যও ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে দেখেনি, যে বাবা সবসময় সৎপথে অবিচল থেকেছেন। আর সেই বাবাই কিনা …!
একাদশীর দিন বেলায় চান্দ্রেয়ী নিজের ঘরে অলসভাবে বসেছিল। মা মিঠাইকে নিয়ে গিয়েছেন বড়মাসির বাড়ি বিজয়া করতে। শুভব্রত আর বাবা বাইরের ঘরে বসে দাবা খেলছিল। শুভব্রত একবার এসে ডেকেছে, ও সাড়া দেয়নি।
শক্ত হয়ে বসে ও অপেক্ষা করছিল। ট্র্যাক করে দেখেছে অর্ডারটা আজই ডেলিভার হবে।
ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। বাবার যদি লজ্জা না থাকে এমন একটা জিনিস বাড়িতে নিতে, চান্দ্রেয়ীরই বা লজ্জা করবে কেন?
কলিং বেলটা বাজল ঠিক এগারোটা বেজে দশ মিনিটে। অন্যসময় চান্দ্রেয়ী ওঠেই না, আজ প্রায় উল্কার গতিতে ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।
প্রিপেইড অর্ডার, সই করে বাক্সটা নিয়ে পেছনে ঘুরতেই ও চমকে উঠল। বাবা আর শুভব্রত দুজনেই বেরিয়ে এসেছে ড্রয়িং রুম থেকে।
চান্দ্রেয়ীর বুকের ভেতর কেউ দুমদুম করে হাতুড়ি পিটছিল। নিজেকে প্রাণপণ সংবরণ করে ও বাবার দিকে তাকাল।
বাবা নিশ্চয়ই মেয়ের হাতে জিনিসটা এসে পড়েছে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে উঠবেন? কিভাবে ম্যানেজ করবেন নিজের কুকীর্তি?
চান্দ্রেয়ী ঠান্ডা চোখে বাবার দিকে তাকাল। কিন্তু না, বাবার চোখে কোনোরকম ভয় বা লজ্জা দেখতে পেল না ও।
বাবা এগিয়ে এসে বললেন, ”ও! জিনিসটা এসে গেছে? দাঁড়া! ওকে আগে ফোন করে ডাকি।”
প্রবল অবিশ্বাসে চান্দ্রেয়ী শুভব্রতর দিকে তাকাল। কি করতে যাচ্ছেন বাবা? কাকে ডাকবেন? মা এখন বাড়িতে নেই, সেই সুযোগে কি শুভব্রতর কথা অনুযায়ী কোনো বাচ্চা মেয়েকে …!
শুভব্রতর মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। সে নির্বিকার নিজের ফোনে গভীর মনোযোগে কি যেন দেখতে ব্যস্ত।
ওদিকে বাবা ফোনের বোতাম টিপছেন। চান্দ্রেয়ীর মুখে যেন সব রক্ত এসে জমা হয়েছে। কোনোরকমে তুতলে ও বলতে পারল, ”কা-কাকে ফোন করছ বাবা?”
”আরে ব্যানার্জিকে। ও তো কেমন অদ্ভুত লোক জানিসই, কিছুতেই কোনো ভালো ফোন ব্যবহার করবে না, এদিকে ইন্টারনেটের সবকিছু জানে। ব্যাটা এখন চারমাসের জন্য কোথায় ঘুরতে যাবে, তার জন্য হ্যান ওষুধ অর্ডার দাও, ত্যান ওষুধ অর্ডার দাও। নিজে আমার ফোনে নেট ঘাঁটবে আর ওষুধ অর্ডার দেবে। ভাগ্যিস এবারে শুভব্রত ওর প্যাডে লিখে দিল, নাহলে তো নাকি অর্ডারই করতে দিচ্ছিল না!”
চান্দ্রেয়ী শুভব্রতর দিকে তাকাল। সে তখন কিছুই না শুনতে পাওয়ার ভান করে ফোনে কার সঙ্গে যেন হ্যালো হ্যালো করতে লেগেছে।
*
রাতে শুভব্রত চান্দ্রেয়ীর কাছে শুতে আসার রিস্ক কিছুতেই নিচ্ছিল না, বারবার ইনিয়েবিনিয়ে বাবাকে বলছিল, ”চলুন বাবা, আজ আমি আর আপনি কোন পুরনো ভালো সিনেমা দেখি।”
কিন্তু চান্দ্রেয়ীর হিমশীতল চাউনিতে কিছু একটা প্রচ্ছন্ন ছিল, যাতে মা কি বুঝলেন, বাবাকে একাই শুতে পাঠালেন। নিজে মিঠাইকে নিয়ে শুতে গেলেন আর শুভব্রতকে পাঠালেন চান্দ্রেয়ীর কাছে।
শুভব্রত এসেই বলল, ”আমি কি করব বলো, আমি আসার পরেই ওই ব্যানার্জিকাকা আমাকে হাত করেছিলেন। তিনি নাকি একজন সঙ্গিনী পেয়েছেন, তার সঙ্গে এখন চারমাসের জন্য তীর্থে যাবেন। এবার ওইজন্যই নাকি …। বুঝতেই তো পারছ …রসিক লোক … সপ্তাহে তিনটে করে … হে হে!”
”সবই ঠিক আছে। কিন্তু আমার বাবাকে তুমি আমার কাছে খারাপ কেন করলে আর আমার পুজোটা এবারে নষ্ট কেন করলে এইটুকু শুধু বলো।” চান্দ্রেয়ী বরফ গলায় বলল।
”কি মুশকিল? আমি তোমাকে বাবার নামে কখন কি বলেছি? তুমিই তো যা ভাবার ভেবে নিলে! নিজের বাবাকে কি না কি …ছি ছি!” শুভব্রত ছদ্মপ্রতিবাদ করলো, ”আর তোমার পুজো নষ্টের জন্যও তুমি আমাকে দায়ী করতে পারো না। আমি ব্যানার্জিকাকার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। বেচারা সারাজীবন বিয়ে-থা করলেন না, এখন শেষ বয়সে একটু রোমাঞ্চ খুঁজতে যাচ্ছেন, আর আমি তাতে ইয়ে করব না একটু?”
চান্দ্রেয়ী মাথা নাড়ল, ”তুমি আমার এতবড় ক্ষতি করেছ, কলকাতায় এসেও তুমি আমাকে পুজো এনজয় করতে দাওনি, দুটো প্রায়শ্চিত্ত না করলে আমি তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করব না। একনম্বর হল, এরপর থেকে টানা পাঁচবছর পুজোয় কলকাতায় আসতেই হবে। ”
শুভব্রত এবার ভয়ার্তচোখে তাকিয়ে রইল স্ত্রীর দিকে।
চান্দ্রেয়ী এবার গম্ভীর গলায় বলল, ”আর দু-নম্বর, বাক্সটা খুলে একটা স্ট্রিপ বের করে রেখেছি। ব্যানার্জিজেঠু কিছু বুঝতে পারবেন না। সেইটা এখন তোমাকে গলাধঃকরণ করতে হবে।” ও কথাটা বলেই টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল, ”এই নাও। খেয়ে ফ্যালো। ক্যুইক।”