মনি
উত্তরার প্লেন যখন দমদমের মাটি ছুঁল তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। আঠেরো ঘণ্টার সুদীর্ঘ প্লেন জার্নির শেষে উত্তরা তখন ক্লান্তির চূড়ান্ত সীমায়। এদিকে বেশ বৃষ্টি হয়েছে, তবু উত্তরার জন্য এয়ারপোর্টের বাইরে অন্তত কয়েকশো মানুষের ভিড়। উত্তরার বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে রাজ্য সরকারের তরফে উচ্চপদস্থ অফিসিয়াল, প্রোফেসররা তো আছেনইনি, অনেক অপরিচিত মানুষও আছেন যাঁরা এই বৃষ্টি মাথায় করে ছুটে এসেছেন কলকাতাকে রাতারাতি বিশ্বের কাছে গর্বিত করে তোলা বাংলার মেয়ে উত্তরাকে শুভেচ্ছা জানাতে। তাঁরা উত্তরাকে ব্যক্তিগতভাবে নাই বা চিনলেন, গত দিনদশেক ধরে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের প্রতিটা কাগজের ফ্রন্ট পেজে উত্তরার উত্তরণ পড়ে পড়ে তাঁরা এই ক-দিনে উত্তরাকে ঘরের মেয়ে বানিয়ে ফেলেছেন।
কাস্টমসের ঝামেলা মিটিয়ে বাইরে বেরোতেই অসংখ্য ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের দেখতে পেল ও। উৎসুক চোখে ও বিশেষ একজনকে খুঁজছিল কিন্তু ভালো করে খোঁজার আগেই একজন হোমরাচোমরা সরকারি অফিসার এগিয়ে এলেন, ”ম্যাডাম, আমি এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের জয়েন্ট সেক্রেটারি জয়ন্ত সান্যাল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে আপনাকে অসংখ্য অভিনন্দন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। আপনি দয়া করে আমাদের সঙ্গে এখন নবান্নে চলুন।”
উত্তরা বলল, ”অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমি তো এখন ভীষণ টায়ার্ড। কাল সকালে যদি……………।”
—”কাল ভোরের ফ্লাইটে চিফ মিনিস্টার দিল্লি চলে যাচ্ছেন ম্যাডাম, ফিরবেন চারদিন বাদে। তাই উনি আজই আপনার জন্য বিশেষ সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন। প্রেস কনফারেন্সও থাকবে। আপনাকে রাতে সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে।”
উত্তরা কিছুটা ইতস্তত করে সরকারি কনভয়ের দিকে এগোল। আলগোছে আরেকবার তাকাল জনতার ভিড়ের দিকে। মনি কিন্তু শেষ কথা হবার সময়ও আসবে বলেছিল এয়ারপোর্টে! কিন্তু ও দেখতে পাচ্ছে না! হতাশ চোখে ও মুখ ফেরাতেই পাঁচ-ছ’টা সংবাদ মাধ্যমের মাইক আর ক্যামেরার চোখ ওর দিকে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটা মেয়ে তো প্রায় ওর মুখের সামনে এসে ওকে ক্যামেরায় রেখে বলতে শুরু করল, ”নমস্কার, এতক্ষণ অপেক্ষার শেষে আপনারা অবশেষে যাকে দেখতে পাচ্ছেন তিনিই উত্তরা, যার জন্য গোটা বিশ্বের কাছে ভারতবর্ষের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আপনাদের সুবিধার্থে গোটা ঘটনাটা সংক্ষেপে আরেকবার জানিয়ে রাখি, উত্তরা প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি ফিল্ডস মেডেল পেলেন। আপনারা সকলেই জানেন বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার হল নোবেল প্রাইজ যা সাহিত্য, শান্তি, অর্থনীতি, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এরকম কিছু বিভাগে আউটস্ট্যান্ডিং কাজ করলে দেওয়া হয়। কিন্তু গণিত বিভাগ অর্থাৎ ম্যাথসে কিন্তু কোনো নোবেল প্রাইজ নেই। তাই অঙ্কের নোবেল প্রাইজ যে অ্যাওয়ার্ডকে বলা হয় তা হল ‘ফিল্ডস মেডেল’। এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অঙ্কের অ্যাওয়ার্ড, কিন্তু একদিক থেকে দেখতে গেলে নোবেলের থেকেও এটা কঠিন, কারণ চল্লিশ বছরের নীচে বয়স থাকতে হয় এই অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার জন্য আর চারবছর অন্তর দেওয়া হয়। এখনো পর্যন্ত মাত্র একজন ভারতীয় এই ফিল্ডস মেডেল পেয়েছেন। আর প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে এই বছরের ফিল্ডস মেডেল পেয়েছেন আমাদের ঘরের মেয়ে মাত্র তেত্রিশ বছরের উত্তরা। আর আমাদের পক্ষে সবথেকে গর্বের কথা উত্তরা অনেক সুযোগ পেলেও বিদেশে পড়াশুনো করতে যাননি, দেশেই গবেষণা করে ছিনিয়ে এনেছেন প্রায় আট লক্ষ টাকা মূল্যের প্রেস্টিজিয়াস এই প্রাইজ।” এতক্ষণ একনাগাড়ে বলার পর একটু দম নিয়ে মেয়েটা উত্তরার দিকে ঘুরল, সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাও, ”বাংলা নিউজ চ্যানেলের পক্ষ থেকে অনেক অনেক অভিনন্দন ম্যাডাম। কেমন লাগছে আপনার?”
উত্তরা দূরে তাকিয়ে দেখল, মি. সান্যাল লাল বাতি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ইশারা করছেন পাঁচ মিনিটের বেশি যেন না লাগে, ওদিকে নবান্নে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ও ক্লান্ত হেসে বলল, ”ধন্যবাদ। খুবই ভালো লাগছে।”
মেয়েটা মনে হয় বেশ পড়াশুনো করে এসেছে অংক নিয়ে, সেই একইরকম কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে ধরে রেখে বলল, ”আচ্ছা বেশিরভাগ মানুষই তো অঙ্ককে বেশ ভয়ই পান, সেখানে অঙ্কের নোবেল প্রাইজ! তাও এত অল্প বয়সে! এই অসম্ভব কিভাবে সাধন হল যদি একটু বলেন। আপনার পড়াশুনো তো ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে?”
উত্তরা জবাব দিল, ”হ্যাঁ।”
মেয়েটা ঝড়ের গতিতে বলে যেতে লাগল, ”আচ্ছা, আমাদের এখানকার বেশিরভাগ মেধাবী ছেলেমেয়েই যেখানে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে যান, সেখানে আপনি অনেক ভালো ভালো সুযোগ পেয়েও বাইরে না গিয়ে দেশে থেকে গবেষণা করলেন কেন?”
উত্তরা বলল, ”কারণ আমার মনে হয়েছিল দেশ আমাকে এতদিন ধরে অনেক কিছু দিয়েছে, এবার আমার দেশকে কিছু দেওয়া উচিত, সেই কারণে……।”
মেয়েটা কথার মাঝেই প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ”আপনার এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান কার? আপনার ফ্যামিলি সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।”
উত্তরা ঠোঁট কামড়াল, ”আমি ছোটবেলাতেই বাবামা-কে হারিয়েছি। ইনফ্যাক্ট আমার বাবামা-কে তাও আমি জানি না। আমার শুধু সাফল্য নয়, আমার এই পৃথিবীতে এতগুলো দিন কাটানো, ছোট থেকে পড়াশুনো এমনকি আমার বেঁচে থাকা সবকিছুর জন্যই আমি আমার মনির কাছে ঋণী। মনিই আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে।”
মেয়েটা বুলেটের গতিতে প্রশ্ন করল, ”আচ্ছা মনি কে হয় আপনার? উনি কি আজ এখানে এসেছেন?”
উত্তরার জবাব দেওয়ার আগেই মি. সান্যাল এগিয়ে এলেন, ”যথেষ্ট হয়েছে। এখন ওঁকে প্লিজ ছাড়ুন, অনারেবল সিএম ওঁর জন্য ওয়েট করছেন।”
মেয়েটা ব্যস্তসমস্ত হয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই উত্তরাকে গার্ড করে ঝড়ের গতিতে নিয়ে এসে মি. সান্যাল গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ি চলতে শুরু করার পর উত্তরার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ”সত্যি ম্যাডাম, সারা দেশ আপনার জন্য গর্বিত। জানেন খুব শীগগিরই প্রধানমন্ত্রী আপনার সাথে দেখা করবেন? আমিও অঙ্কের ছাত্র ছিলাম, স্কটিশচার্চ। তারপর এখন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সামলাতে সামলাতে তো মনে হয় যোগবিয়োগও ভুলে গেছি।”
উত্তরা অস্বস্তিতে একটু হাসল। জার্মানিতে ও প্রাইজটা আনতে গিয়ে এই ক-দিন ধরে মনি ফোনে অবশ্য বলেছে ওকে নিয়ে দেশে কি নাচানাচি চলছে, তবে সেটা এই লেভেলে ও বুঝতে পারেনি। ফলের আশা করে তো কখনো কিছু করেনি ও জীবনে। বস্তির ঘুপচি ঘরে, হাইড্রেনের পচা নর্দমার পাশে একচিলতে মাথা গোঁজার আস্তানায় ব্যাটারির আলোয় পড়েছে ও, সাময়িক স্কলারশিপ, ক-দিনের সরকারি অনুদান বাদ দিলে ওর পুরো জোয়ালটাই নীরবে টেনেছে মনি। ওকে কোনোদিনও কিছু বুঝতেই দেয়নি। তারপর আই এস আইতে চান্স পাওয়ার পর ওর মোটা স্টাইপেন্ডে অবস্থার কিছু উন্নতি হয়। আইএসআই থেকেই বি ম্যাথ, এম ম্যাথ করে পিএইচডি, তারপর ওখানেই রিসার্চ করছিল ও। বছরখানেক আগে নাম্বার থিয়োরির ওপর রিসার্চ পেপারটা একটা আন্তর্জাতিক জার্নালে পাঠাবার পর যে বিশ্বের অঙ্কমহলে এতো হইহই পড়ে যাবে সেটা ও বুঝতে পারেনি।
মি. সান্যালের কথায় ওর হুঁশ ফিরল, ”আচ্ছা, মনি বলে যার কথা বলছিলেন উনি কি এয়ারপোর্টে ছিলেন?”
উত্তরা বলল, ”না, মনি আসেনি।” দমদমে নামার পর থেকেই মনির ফোন বন্ধ পাচ্ছে ও, এতবার করে বলা সত্ত্বেও মনি ওকে আনতে এল না! পাছে উত্তরাকে লোকে কিছু বলে, হাসাহাসি করে তাই মনি আসেনি ও জানে। কিন্তু ফোনটা বন্ধ কেন!
মি. সান্যাল বললেন, ”আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমরা যাওয়ার পথে ওঁকে তুলে নিতে পারি। যিনি আপনার জন্য এত কিছু করেছেন, তাঁকে রাজ্যসরকারের তরফে আপনাকে দেওয়া এতবড় সংবর্ধনাতে নিয়ে যাবেন না? সমস্ত বড় বড় মিডিয়ার রিপোর্টাররা থাকবেন।”
উত্তরা মি. সান্যালের দিকে তাকাল। সরকারি আমলা বলতেই যেরকম ইমেজ ভেসে ওঠে, ইনি তেমন একদমই নন। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত আন্তরিক ভাব আছে। কিন্তু সত্যিটা যদি উত্তরা বলে, তখন কি প্রতিক্রিয়া হবে এঁর? ও আমতা আমতা করে বলল, ”না আসলে মনির পক্ষে আসাটা…।”
মি. সান্যাল সোৎসাহে বললেন, ”উনি কি খুব বয়স্ক? অসুস্থ বুঝি?”
উত্তরা মাথা নাড়ল, ”না, তা নয়।”
—”তবে? চলুন ওনাকে নিয়েই যাই, যার আপনার সাফল্যের পেছনে এতবড় অবদান, তাঁকে সারা দেশের চেনা উচিত।”
হঠাৎ উত্তরার ফোন বেজে উঠল, কানে লাগাতেই ও শুনতে পেল সহেলীমনির উচ্ছ্বসিত গলা, ”কিরে কোথায় তুই! এই তো টিভিতে দ্যাখাচ্ছিল এখন কোথায় গেলি? শীগগিরই আয়, তোর মনির আর তোর সইছে না। আমরা এখানে আজ খুব হুল্লোড় করব।”
উত্তরা ফোনের ও-পাশ থেকে মিঠুমনি, ববিমনি সবার কলরব শুনতে পেল, ও শান্ত স্বরে বলল, ”শোন, তোমরা সবাই রেডি হয়ে থাকো। তোমাদের সবাইকে নিয়ে আমি এক জায়গায় যাব।” ফোনটা কেটে দিয়ে ও বলল, ”আচ্ছা মি. সান্যাল, আপনাদের কনভয়ে সাত-আটজনের জায়গা হবে তো?
মি. সান্যাল একটু অবাক হয়ে বললেন, ”হ্যাঁ তা তো হবেই কিন্তু আপনি যে বললেন…!”
উত্তরা বলল, ”আপনি বেলঘরিয়া স্টেশনের পাশের ঝুপড়িগুলোর দিকে যেতে বলুন।”
মিনিট পনেরো পরে বেলঘরিয়া স্টেশন লাগোয়া ঝুপড়িগুলোর সামনে যখন উত্তরাদের কনভয়টা পৌঁছল, তখন প্রচুর মানুষজন ফুল, মিষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তরা গাড়ি থেকে নামতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মনি এসে উত্তরাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, পাশে তখন ববিমনি আর মিঠুমনি আবির মাখাচ্ছে এঁর ওর গালে, মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছে মিষ্টি। ফিল্ডস মেডেল কি, সেটা কতটা বড় প্রাইজ, সেটা বোঝার ক্ষমতা ওদের নেই, তবু যে যাকে পারছে জড়িয়ে ধরছে, মনে হচ্ছে ফিল্ডস মেডেল উত্তরা নয়, ওরাই পেয়েছে।
পাশে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মি. সান্যালের দিকে তাকিয়ে উত্তরা হাসল, ”কি? অবাক লাগছে তো? আপনাদের কাছে তো হিজড়েরা শুধু জোরজুলুম করে টাকা চাওয়ার মানুষ, তাই না? প্রায়ই খবরের কাগজে পড়েন এদের জোর করে টাকা আদায়ের কথা। কিন্তু আমার কাছে এরাই আমার বাবা-মা জানেন! এই যে দেখছেন একে, ইনিই আমার মনি। আমার তখন একসপ্তাও বয়স নয়, ডাস্টবিন থেকে মনি আমাকে না তুললে কুকুর বিড়াল খুবলেই খেয়ে নিত হয়তো! সেই থেকে আমাকে মানুষ করা, বড় করা, সব কিছু করেছে মনি। আমাকে নিজের মেয়ের মতোই আগলে রেখেছে এই ববিমনি, মিঠুমনিরা। আমাকে খাইয়েছে, আমাকে জড়িয়ে ধরে তাদের দুঃখে কেঁদেছে, আমার পরীক্ষার ফিস জোগাড় করতে সবাই উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করেছে। তাই আমার এই সাফল্যের সংবর্ধনা যদি নিতেই যেতে হয়, এরা সবাই আমার সাথে সেই সংবর্ধনার সমান অংশীদার মি. সান্যাল!”
প্রায় এক ঘণ্টা বাদে নবান্নের প্রেস কনফারেন্সে রিপোর্টাররা তো বটেই, অঙ্কের বিভিন্ন দিকপাল পণ্ডিত থেকে শুরু করে মন্ত্রীপারিষদরাও বেশ অবাক হয়ে উত্তরার সঙ্গের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মনি তো এই লজ্জাতেই আসতে চাইছিল না, সারাটা রাস্তা উত্তরার কানে মুখ রেখে বলছিল, ”এত আনন্দের দিনে এসব কেন করছিস তুই! সবাই তোকে দেখে হাসবে!”
উত্তরা শোনেনি। শক্ত হাতে ধরে রেখেছে মনির হাত। মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রথমে কিছু বললেন, তারপর উত্তরাকে বললেন কিছু বলার জন্য। উত্তরা উঠে দাঁড়িয়ে মনির হাতটাকে জড়িয়ে ধরে মাইকের সামনে এসে বলল, ”সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। আমি জানি আমার ফিল্ডস মেডেল পাওয়ার আনন্দের থেকেও এখন আপনাদের কৌতূহল বড় হয়ে উঠেছে যে এই মানুষগুলো আমাদের এই ভদ্রসমাজে কেন! যতই আইন পাশ হোক, আজও এরা সমাজে ব্রাত্য! অথচ এঁর পেছনে এদের কোনো হাতই নেই, জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য এরা একঘরে। এদের মধ্যে প্রতিভা, মেধা থাকলেও তাঁরা সেটা কাজে লাগাবার সুযোগ পান না, সমাজের সংস্কার এদের দূরে ঠেলে দেয়। কিন্তু আমি এই মনির জন্যই আমি আজ পৃথিবীর আলো দেখতে পাচ্ছি। মনি শুধু আমার বাবামা-ই নয়, মনি আমার সব। মনিই আমাকে পড়তে শিখিয়েছে, বড় হতে শিখিয়েছে।” বলতে বলতে ও কেঁদে ফেলল।
এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ”ম্যাডাম, এই বৃহন্নলারা আপনাকে মানুষ করেছে বলতে চাইছেন?”
উত্তরা চোখ মুছে একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, ”মহাভারত পড়েছেন? মহাভারতে অর্জুন একবছর বৃহন্নলা সেজেছিলেন আর বিরাট রাজার মেয়ে উত্তরা ছিল তাঁর কন্যাসমা ছাত্রী! আমার নামও উত্তরা। আমার মনি বই পড়তে খুব ভালোবাসে, সেই থেকে আমার নাম রেখেছিল উত্তরা। তাই আপনারা এদের বৃহন্নলা বলুন কি হিজড়ে বলুন তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমার কাছে এরা আমার জন্মদাতা। জানেন, এখানে আসতে মনি চায়নি, আমি অপদস্থ হতে পারি ভেবে, কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ”আমাদের কেন কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গ নেই বলত! কোথাও যেতে পারি না, সব জায়গায় বিদ্রূপের শিকার হতে হয়?” কথাটা বলে পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কান্নায় আবেগে ভেসে যাওয়া মনিকে জড়িয়ে ধরে উত্তরা বলল, ”আমি বললাম, ঈশ্বরও তো উভলিঙ্গ! তাতে কি আমাদের তাঁকে পুজো করতে কোনো অসুবিধা হয়?”
আরেকজন সাংবাদিক প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ”আচ্ছা, ফিল্ডস মেডেলের প্রাইজ মানি প্রায় আট লাখ টাকা, তা দিয়ে আপনি কি করবেন কিছু ভেবেছেন?”
উত্তরা বলল, ”আমি এই টাকাটা দিয়ে আমার মনির মতো মানুষদের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। যাতে আর কোনো মনির কাছে বেঁচে থাকাটা আপনাদের অনুগ্রহ না হয়ে ওঠে।”
মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবার হাততালিতে তখন ভেসে যাচ্ছে গোটা হলঘর। মনি, মিঠু, ববি ওরাও ভাসছে অবশ্য, আনন্দের চোখের জলে।