থার্ড পার্সন
বাসের লেডিস সিটে বসে থাকলেও দরজা দিয়ে উঠে বাঁদিকে এক হাত ওপরে তুলে বাসের হাতল ধরে আরেক হাতে মোবাইল খুটখাট করা সোহমকে ঠিক দেখতে পেয়েছে ঈশানী। আর দেখেই সাতসকালে মেজাজটা ওর খিঁচড়ে গেল। কোলের ওপর পড়ে থাকা ঢাউস সানগ্লাসটাকে চোখে লাগিয়ে জানলা দিয়ে দূরে তাকিয়ে রইল ও। কানে হেডফোন গোঁজা। কিছুক্ষণ বাদে নারকেলবাগান স্টপেজ আসতে ভিড়টা একটু হালকা হতেই না চাইতেও চোখটা আবার চলে গেল, হুম, সে ব্যাটাও ঈশানীকে দেখেছে, আড়ে আড়ে চাইছে এদিকে। ঈশানী মুখটা আবার গম্ভীর করে বাইরের দিকে তাকাল। ডিভোর্স হতে যাওয়া স্বামীর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে কি করা উচিত সেটা ওর উকিল বলে দেয়নি।
ওদের ফাইনালি ডিভোর্সের আর মাস দুয়েক বাকি। নিয়ম অনুযায়ী ডিভোর্সের ফাইল পিটিশন করলে ছ-মাস সেপারেশনে থাকতে হয়, তারপরও কোর্টে জজের সামনে দুজনে একসাথে থাকতে নারাজ জানালে তবেই মিউচুয়ালি ডিভোর্স কমপ্লিট হয়। সেই জানুয়ারিতে কোর্টে দেখা হবার চারমাস বাদে আবার আজ দেখা হল। না চাইতেও ওর মনে হাজারো প্রশ্ন এসে উঁকি দিতে লাগল, আচ্ছা সোহম এই রাস্তায় কেন? এটা তো ঈশানীর অফিস যাবার রাস্তা, গত ছ-বছর ধরে বালি থেকে বাসে উঠে কলেজ মোড়ে নামে ও, মাঝে বিয়ের পর শুধু দু-বছর সোহমের সাথে এয়ারপোর্টের ফ্ল্যাটে থাকার সময় এয়ারপোর্ট থেকে উঠত, কিন্তু রুট একটাই। কিন্তু সোহমের তো অফিস ডালহৌসি, এদিকে কি করছে?
পরমুহূর্তেই ওর মনে পড়ল, নিশ্চয়ই সেই মেয়েটা, কি নাম বলেছিল সৌম্য, আত্রেয়ী, তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে, সেই মক্কেলের তো অফিস তো এদিকেই শুনেছিলো। গা’টা রাগে চিড়বিড় করে উঠল ওর, হু! আবার বেগুনি শার্টটা পড়েছে, ঈশানীই কিনে এনেছিল ওটা। চুলের অবস্থা দ্যাখো, চিরুনিও জোটেনি মনে হচ্ছে! গালটা কি একটু ভেঙে গেছে? চোখের কোলটাও বেশ বসা লাগছে। বয়েই গেছে ঈশানীর! ঈশানী হেডফোনটাকে আরও জোরে কানের মধ্যে গুঁজে অরিজিৎ সিং-এর দুনিয়ায় চলে গেল।
অফিসে পৌঁছে ব্যাগটা ডেস্কে রেখেই অনির্বাণকে ফোন লাগাল ঈশানী। অনির্বাণ ওদের দুজনেরই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় থেকে বন্ধু। অনির্বাণ প্রথমদিকে অনেক চেষ্টা করেছিল ওদের ঝামেলাটাকে মিটমাট করার, কিন্তু শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ঈশানীকে বুঝিয়ে কোনো লাভ হয়নি, সোহম নাকি অনুতপ্ত, বারবার অনির্বাণের কাছে ফোন করে বলে একবার যেন ঈশানী ওর ফোনটা রিসিভ করে। ওর চালাকি ঈশানী ভালোই বোঝে, একদিকে ওই আত্রেয়ীর সাথে ফষ্টিনষ্টিও করবে আবার অন্যদিকে ঈশানী, এইসব মেনে নেওয়ার বান্দা ঈশানী নয়!
অনির্বাণ বলল, ”আরে তুই জানিস না? সোহম তো সিটিএস-এ জয়েন করেছে আগের উইকে, কলেজ মোড়েই তো ওর পোস্টিং।” শুনে টুনে ঈশানী কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল, রাগে ওর ব্রহ্মতালু জ্বলছে, এত শয়তান সোহম, ইচ্ছে করে ঠিক এই সময়ে কোম্পানি চেঞ্জ করল, এইবার সকাল বিকেল দেখা হবে। অবশ্য করবে নাই বা কেন, ওই আত্রেয়ীও তো সিটিএস-এই আছে। ভালো! রাগে দুঃখে ঈশানীর চোখে জল এসে গেল। এই ওর এতদিনের ভালোবাসার পরিণাম! অসহ্য। যেদিন ওরা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আলাদা হয়ে যাবার, সেদিনের কথা মনে পড়ছিল ওর। চার বছরের প্রেম, তারপর বিয়ে করেছিল ওরা। প্রথম প্রথম দিনগুলো স্বপ্নের মতো কাটত, সারা সপ্তাহ অফিস, উইকএন্ডে টুকটাক বেরিয়ে পড়া, তিন-চার মাস অন্তর বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, এভাবেই কাটছিল জীবন। তারপর আস্তে আস্তে কি যে হল, ঈশানীর সবকিছুই সোহমের অসহ্য লাগতে শুরু করল। ছোটখাটো খুঁটিনাটি জিনিস নিয়ে ঝগড়া, তারপরেই তা তুলকালাম আকার ধারণ করত। কান্নাকাটি, চিৎকার চেঁচামেচি, ইগোর লড়াইয়ের মধ্যে ওদের ভালোবাসা যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। রোজ অফিসে এসে ঈশানী মন খারাপ করে বসে থাকত।
তখন ওদের প্রোজেক্টে সবে জয়েন করেছিল সৌম্য। সোহমের সাথে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে কখন যে ঈশানী সৌম্যর মধ্যে একটা সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে পেয়েছিল সেটা ও বুঝতেই পারেনি। রোজ সোহমের আঘাত করে বলা কথা, ঝগড়া, তিক্ততা এইসব কিছুর দুঃখ মনের মধ্যে চেপে অফিসে সৌম্যর সাথে কথা বলে টাটকা বাতাস পেতে চাইত ও। সৌম্য ধৈর্য নিয়ে ওকে বোঝাতে মন খারাপ না করতে, মানিয়ে নিতে। সৌম্যই বলেছিল ওকে আত্রেয়ীর কথা। সৌম্যর পুরনো অফিসে আত্রেয়ী কাজ করে, সেখান থেকেই জানতে পেরেছে সোহমের সাথে আত্রেয়ীর ঘনিষ্ঠতার কথা। তবু ঈশানী মুখ ফুটে কিছু বলেনি সোহমকে। কিন্তু শেষে একদিন যখন সোহম রাত করে বাড়ি ফিরে ঝগড়ার সময় তেতো মুখে বলল ঈশানীর কিছুই নাকি ওর ভালো লাগে না, ঘেন্না লাগে ওর মুখটা দেখে, সেদিন ঈশানী আর সহ্য করতে পারেনি। পরেরদিন ভোর হতে না হতেই ব্যাগ গুছিয়ে চলে বেরিয়ে এসেছিল ওদের দু-কামরার ছোট্ট সংসারটা থেকে। না, বাবার কাছেও যায়নি, ও কারুর সহানুভূতির পাত্রী হতে চায় না, সোজা এসে উঠেছিল ডানলপের একটা লেডিজ হস্টেলে। বাবামা অনেক বুঝিয়েছিল, বন্ধুরাও। কিন্তু ও কারুর কথা শোনেনি। দুজন মানুষ জন্তুর মতো একসাথে থাকার চেয়ে ভালোভাবে ভদ্রভাবে আলাদা থাকা অনেক ভালো। তার দিন পনেরো বাদে উকিলের নোটিশ পাঠিয়েছিল সোহমকে।
এমন তন্ময় হয়ে ও ভাবছিল, কখন সৌম্য এসে ডাকছিল বুঝতেই পারেনি ঈশানী। সৌম্য যে ওকে পছন্দ করে সেটা ঈশানী ভালোমতোই জানে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আর কিছু ভাবতে চায় না ও। সোজা হয়ে বসে মনটাকে শক্ত করল ঈশানী, রাস্তা সবার, যেকেউ সেখান দিয়ে যেতে পারে, তাতে ঈশানীর কিছুই যায় আসে না। বাসে সোহমের সাথে দেখা হলে কিছুই যায় আসবে না ওর, কত অপরিচিত লোকই তো প্রতিদিন ঈশানীর সাথে বাসে আসে, যায়, সোহমও তেমনই কেউ। পাত্তাই দেবে না ও।
*
কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা হয় না। এরপর থেকে প্রায়ই দুজনের দেখা হতে লাগলো। কখনো বাসে, কখনো লাঞ্চ টাইমে রাস্তায়। প্রথম প্রথম ঈশানী দেখতে পেলেই উল্টো দিকে তাকাত বা অন্য দিক দিয়ে চলে যেত। কিন্তু একদিন ফেরার সময় বাসে খুব ভিড় ছিল, আইপিএল-এর ম্যাচ চলছে, বাসে তিলধারণের জায়গা নেই। ঈশানী কোনোমতে উঠে একটা লেডিজ সিট পেয়েছিল। একটু বাদে ওর সামনে এসে সোহম দাঁড়াল। প্রথমে কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনেই, বাসটা খুব জোরে চলতে চলতে বারবার ব্রেক কষছিল, সোহমই প্রথম কথা বলল, ”ব্যাগটা একটু ধরবে?”
ঈশানী কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে ব্যাগটা নিয়ে কোলের ওপর রেখে আবার বাইরের দিকে তাকাল। মিনিট পনেরো দুজনেই চুপ, বাইরে জোর বৃষ্টি নেমেছে, তার ছাঁটে ঈশানী ভিজে যাচ্ছিল, সেটা দেখে সোহম ঝুঁকে এসে জানলার কাচটা নামিয়ে দিলো, মৃদু স্বরে বলল, ”কেমন আছ?”
—-”ভালো।”
সেদিন আর কোনো কথা হল না, এয়ারপোর্ট আসতে চাপা গলায় থ্যাঙ্কস বলে সোহম নেমে গেল।
এর পরেরদিন বাসে উঠে চোখাচোখি হতে সোহম হাসল, ঈশানীও হাসিটা ফিরিয়ে দিল। সোহম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার কেক বের করে খাচ্ছিল। ঈশানীর দিকে বাড়িয়ে বলল, ”খাবে?”
ঈশানী দু-দিকে মাথা নাড়ল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অন্যদিকে তাকিয়েই বলল, ”লক্ষ্মীমাসি কি আসেনি আজ?”
—”ছাড়িয়ে দিয়েছি। একা মানুষ, অসুবিধা হয় না। আমার ফেরার কোনো ঠিক নেই, বুড়ো মানুষ আর কত দেরি করে আসবে।”
—”ও। তাহলে…খাওয়াদাওয়া?”
—”লাঞ্চটা অফিসেই সারি। আর রাতের খাওয়াটা হোটেলে। আর মাঝে মাঝে এই কেক, পিৎজা দিয়েই চালিয়ে দিই।”
ঈশানী ঠোঁটটা কামড়াল। লক্ষ্মীমাসি রান্না করতে আসবে বলে ও রোজ ছুটতে ছুটতে অফিস থেকে সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরত। সোহমের বাড়াবাড়ি লেভেলের জন্ডিস হবার পর থেকে ঈশানী ওকে কিচ্ছু খেতে দিত না বাইরে। এদিকে কোর্টে দাঁড়িয়ে সোহম বলেছিল ঈশানীর নাকি সংসারের দিকে কোনো মন-ই নেই। তাহলে ঈশানী জীবন থেকে চলে যেতে এইরকম দশা কেন! সেপারেশনটা হয়ে গেলে ওই আত্রেয়ীকে বিয়ে করে নিয়ে এলেই ল্যাঠা চোকে! ঈশানীও খবর রাখবে, রোজ কত বিরিয়ানি, মণ্ডা-মিঠাই বানিয়ে খাওয়ায় মেয়েটা সোহমকে!
অফিসে গিয়ে সৌম্যকে ব্যাপারটা বলল ঈশানী। সৌম্য তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”ওসব তোমাকে গিল্টি ফিল করাবার জন্য।”
ঈশানীও মাথা নাড়ল সম্মতির ভঙ্গিতে। ঠিকই বলেছে সৌম্য, যে ঈশানীকে ঘেন্না করে, এত ভালোবাসার পর যে কোর্টে অমন মিথ্যে কথা বলতে পারে, সে সব কিছুই পারে!
*
সেদিন বাসে মারাত্মক ভিড় ছিল। ঈশানী জায়গা পায়নি, এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল কোনোমতে। ভিড় বাসে মেয়েদের দাঁড়িয়ে থাকা যে কি দুঃসহ ব্যাপার সেটা যারা রোজ ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে তাদের থেকে ভালো কেউ জানে না। একদিকে ব্যাগটাকে দিয়ে শরীরকে অবাঞ্ছিত স্পর্শ থেকে আড়াল করার প্রাণপণ চেষ্টা, অন্যদিকে বাসের হঠাৎ ব্রেক কষা, বা ঝাঁকুনিতে টাল সামলানো। এয়ারপোর্ট আসতে সোহম এখন উঠে প্রথমে লেডিজ সিটের দিকে ওকে খোঁজে, দেখতে পেলে সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু আজ তো ওকে সিটে দেখতে পাবে না। তাতে অবশ্য ঈশানীর কিছুই যায়-আসে না। রাস্তায় দেখা, ওই সৌজন্যমূলক যেটুকু কথা না বললে নয় আর কি! মনের দিক থেকে ঈশানী যথেষ্ট দৃঢ়, বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর সোহমের হাজার মেসেজ, ইমেইল, হোয়াটসআপেও ও সাড়া দেয়নি। হঠাৎ ঈশানী দেখতে পেলো, ভিড় ঠেলে সোহম ওর দিকে এগিয়ে আসছে, হাতে একটা বড় গিফটের বাক্স। লোকজন সাইড দিচ্ছে না, উল্টে কড়া কথা শোনাচ্ছে ভিড় ঠেলে এগোবার জন্য। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোহম ঠেলেঠুলে কাছে এসে যুদ্ধজয়ের হাসি হাসল। বেশ দামি একটা শার্ট পড়েছে, এটা প্রথম জামাইষষ্ঠীতে ঈশানীর বাবামা দিয়েছিলেন।
বাসের একটা রডে হেলান দিয়ে খুব ব্যালান্স করে ঈশানী দাঁড়িয়েছিল, মুখোমুখি সোহম। কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে ঈশানী বলল, ”আজ কোনো পার্টি আছে বুঝি?”
সোহম মাথা নাড়ল, ”হ্যাঁ, আজ আমাদের একটা কলিগ, তুমি নাম শুনেছ মনে হয়, আত্রেয়ী বসু বলে, ওর বিয়ে। অফিস থেকে ডাইরেক্ট চলে যাব। সবাই আমাকেই গিফট কেনার দায়িত্ব দিয়েছিল।”
ঈশানী হাঁ হয়ে গেল, ”আত্রেয়ী?”
—”হ্যাঁ, তুমি চেনো নাকি?”
ঈশানী কিছু বলল না। মনের মধ্যে নাগরদোলা পাক খাচ্ছে। বিরক্তি, কৌতূহল, খটকা সব মিলেমিশে ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি করছে ভেতরে। কিন্তু সৌম্য যে বলেছিল……হঠাৎ একটা সাংঘাতিক ঝাঁকুনিতে সোহম টাল সামলাতে না পেরে ঈশানীর গায়ের ওপর সটান হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাসটা খুব জোরে ব্রেক কষেছে। ঈশানীর প্রত্যেকটা অঙ্গ ছুঁয়ে গেল সোহমের সাথে, অনেক দিন বাদে। ঈশানী প্রথমে কি বলবে ভেবে পেল না, তারপর ওর মুখ দিয়ে একটু জোরেই বেরিয়ে গেল, ”কি অসভ্যতা হচ্ছে এগুলো!”
পাশের একটা ছেলে হাঁক দিল, ”কি ব্যাপার বলুন তো দাদা, চেহারা দেখে তো ভদ্রলোক বলেই মনে হয়, মেয়েদের ঘাড়ের ওপর পড়ছেন কেন? তখন থেকে দেখে যাচ্ছি।”
আরেকজন টিপ্পনী কাটল, ”যেই দেখেছে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অমনি ভিড় ঠেলে ওইখানে ছুটল, কি স্বভাব সত্যি এদের!”
”কানের গোড়ায় দু ঘা দিলেই এদের চুলকুনি বেরিয়ে যাবে।”
সব জায়গাতেই ইন্ধন জোগানো জনতার অভাব হয় না। বিনি পয়সার এন্টারটেনমেন্ট পেতে দু-একজন এগিয়ে এসে সোহমের কলার ধরল, ”এই এটাকে ধরে বাস থেকে নামিয়ে দে তো!”
ঈশানী থতমত খেয়ে গেছে, এরকম যে হবে ও ধারণাও করতে পারেনি। সোহমের মুখ অপমানে লালচে হয়ে গেছে। আরেকজন এসে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই সোহমের হাত থেকে গিফটটা মাটিতে পড়ে গেল। সোহম বলতে গেল, ”কি করছেন কি আপনারা! আমি কি ইচ্ছে করে গায়ে পড়েছি নাকি! আর তাছাড়া উনি আমার………” কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই একটা ফচকে ছেলের রদ্দায় ওর মুখটা একদিকে বেঁকে গেল।
ঈশানীর পাশে বসে থাকা এক ভদ্রমহিলা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”তুমি ভয় পেয়ো না মা, আমার সিটে এসে কিছুক্ষণ বসো, এইসব জানোয়ারদের জন্য মেয়েদের রাস্তায় বেরনোই দুষ্কর হয়ে উঠেছে।
ঈশানী হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। সোহম ততক্ষণে বাসের মেঝেতে শুয়ে পড়েছে, কিল চড় চলছে অবিরাম। ঈশানী প্রাথমিক ঘোর কাটিয়ে চিৎকার করল, ”কি করছেন কি আপনারা? ছেড়ে দিন এক্ষুনি ওনাকে!”
কেউ কান দিল না। আরো দু-একবার ঈশানীর চিৎকারে একটা ছেলে মুখ ফেরাল, ”আজব মাইরি! আপনার সাথে অসভ্যতা করল বলে আমরা মারছি, আর আপনিই?”
ঈশানী পাগলের মতো সবাইকে ঠেলে সরাতে সরাতে চিৎকার করল, ”উনি, উ-উনি আমার স্বামী।”
সোহমের ততক্ষণে মুখ-চোখ ফুলে গেছে, কপালে গভীর কালশিটে, সেই অবস্থাতেও ঈশানীর দিকে ও তাকাল। চোখে সেই লুপ্ত হয়ে যাওয়া দৃষ্টি, যেটা বহুকাল আগে বিয়ের আগে বা বিয়ের পরে পরে ঈশানী দেখতে পেত, যদিও সেই চোখে ভালোবাসার সাথে মিশে রয়েছে এক পরম নির্ভরতার আশ্বাস।
* * * * *
ঈশানী ধীর পায়ে কোর্টের এজলাসে ঢুকল। লোকজন তেমন নেই। কিছু অত্যুৎসাহী লোকজন কোর্টের আশেপাশে ঘুরঘুর করে, মামলা শোনা তাদের নেশা, কিন্তু ডিভোর্সের মামলা আজকাল জলভাত। ও একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল, সোহম বসে আছে চুপচাপ। মুখে বেশ কয়েকদিনের না কাটা দাড়ির জঙ্গল, চুল উসকো খুসকো।
প্রাথমিক ফরম্যালিটিজের পর হিয়ারিং শুরু হল। ঈশানীর সাথে ওর বাবা- মাও গেছেন। মা একবার ঈশানীর দিকে চেয়ে বললেন, ”এখনো সময় আছে, ভেবে দ্যাখ। স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকলে ঠোকাঠুকি লাগবেই, তোর বাবা আর আমার মধ্যে লাগেনি? শুধু স্বামী-স্ত্রীই বা কেন, মা মেয়ে, বাবা ছেলের সবার মধ্যেই লাগে। তার মানে কি ছাড়াছাড়ি করতে হবে? তাই বলে ভালোবাসাটা মিথ্যে হয়ে যায়না।”
জজসায়েব বললেন, ”আপনাদেরকে মহামান্য আদালত ছয়মাস সময় দিয়েছিল শেষ চেষ্টা করতে। সেই সময়কাল উত্তীর্ণ। আপনারা কি এখনো ডিভোর্সই চাইছেন?”
সোহম চুপ করে মাথা নামিয়ে বসে আছে। ঈশানীর উকিল এগিয়ে গেলেন, ”ইয়োর অনার, আমার মক্কেল মিসেস ঈশানী সেন………” হঠাৎ উনি চুপ করে গেলেন। ঈশানী উঠে দাঁড়িয়েছে, ”স্যার, আমাদের সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমরা, আ-আমরা আবার একসাথে থাকতে চাই।”
সোহম মাথা তুলল, অবাক দৃষ্টি।
ঈশানীর চোখে জল এসে গিয়েছিল বলতে বলতে, অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল ও। আজ ওর খুব হালকা লাগছে নিজেকে। সেদিন আত্রেয়ীর বিয়ের কথা জানতে পারার পর সব কিছু দিনের আলোর মতো ওর সামনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। অনির্বাণ ওকে আগেই বলেছিল ও বিশ্বাস করেনি। সৌম্য মিথ্যে কথা বলে দিনের পর দিন ঈশানীর মনটা বিষিয়ে দিয়েছিল। নিজে ঈশানীকে পাওয়ার জন্য পুরো প্ল্যানমাফিক এগিয়েছে, মাঝখান থেকে ঈশানী-সোহমের সাময়িক মনোমালিন্য অনুঘটকের কাজ করেছে।
*
রাতে শুয়ে সোহম ঈশানীর পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে দিচ্ছিল ঠিক আগের মতো। ঈশানী মনে মনে ভাবছিল মায়ের বলা কথাগুলো, সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই ঝগড়া হয়, তাই বলে ভালোবাসা নেই এটা ভাবা ভুল, আরও বড় ভুল সেই ঝগড়ার সুযোগ কাউকে নিতে দেওয়া। ঈশানী গুটিসুটি মেরে শুয়ে শুয়ে বলল, ”আর কোনোদিনও আমরা কেউ কোনো থার্ড পার্সনকে আমাদের মধ্যে আসতে দেব না, কেমন?”
সোহম চুপিচুপি ঈশানীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ”না। দেব। জুনিয়র সোহম আর জুনিয়র ঈশানীকে।”