লোফার
ডাউন ব্যান্ডেল হাওড়া লোকাল যখন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে হাওড়ায় ঢোকাল, তখন ঐশানীর ঘড়িতে ন-টা পাঁচ। ক্লান্ত ঘামে ভেজা শরীরটাকে কোনোমতে টেনেহিঁচড়ে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল ঐশানী। আজ ভীষণ দেরি হয়ে গেছে। অন্যদিন ও সাড়ে-আটটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যায়, আজ এখানেই এত রাত হয়ে গেল। একে সোমবার, তার ওপর উত্তরপাড়া স্টেশনে কিছুক্ষণ কি একটা ঘটনায় অবরোধ চলছিল। আগে হলে কিছুই মনে হত না ওর, কিন্তু গত পরশু থেকে শুরু হওয়া বিশ্রী ঘটনাটায় ওর মনটা তেতো হয়ে রয়েছে।
সাবওয়ে দিয়ে বেরিয়ে আস্তে আস্তে ও প্রায় নির্জন গুলমোহর কলোনির পাশ দিয়ে হাঁটছিল। ওকে এখন প্রায় আধঘণ্টা হাঁটতে হবে। হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে উঠে বেনেটোলায় গিরীশ পার্ক মেট্রো স্টেশন ধরে আরেকটু হাঁটলে ওর বাড়ি। বাসে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়, শ্রীরামপুর কলেজে বাংলা নিয়ে ভর্তি হয়ে প্রথমে দিনকয়েক তাই গিয়েছিল, তারপর একদিন ট্রেনে আসতে আসতে দু-পিঠের বাস ভাড়া ত্রিশ দিয়ে গুণ করতে ও চমকে উঠেছিল। ওই পয়সায় বাবার একটা ওষুধ হয়ে যাবে। তারপর থেকে ও হেঁটেই যাতায়াত করে। আর এমন কি-ই বা রাস্তা! সারাদিন কলেজে তো বসে বসেই দিন কাটে, তারপর কলেজ শেষে কোন্নগরে একটা কোচিং সেন্টারে টিউশনি পড়িয়ে একেবারে রাতে বাড়ি ফেরা, সে-ও তো বসে বসেই। দৈহিক কোনো পরিশ্রম নেই, বরং দিনে দু-বার এই হাঁটাহাঁটিতে শরীর ভালো থাকবে, নিজেই নিজেকে বিজ্ঞের মতো বুঝিয়েছিল ঐশানী।
পিঠের শতচ্ছিন্ন ব্যাগটাকে আর একবার টাইট করে নিয়ে হাঁটার ভল্যুম বাড়িয়ে দিল ও। হাতিবাগানের মোড় থেকে কেনা সস্তা সালোয়ার কামিজ ভিজে সপসপে হয়ে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। যতটা না ঘামে, তার চেয়ে বেশি হয়তো ভয়ে। যতই স্থির থাকার চেষ্টা করুক, ভেতরে ভেতরে একটা অজানা আশঙ্কায় মনটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। আজও যদি ছেলেটা থাকে!
কথাটা মনে হতেই ওর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। হাওড়া ব্রিজের ফুটপাথে ইতিউতি শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে সাবধানে ডিঙিয়ে চলতে চলতে চোখের কোণে দু-ফোটা জলও এসে গেল ওর। ও তো কখনো কারুর কোনো ক্ষতি করেনি! ছোট্ট থেকে, যবে থেকে বাবার কারখানায় লক-আউট হয়েছে, তবে থেকে দাঁতে দাঁত চিপে সংগ্রাম করে চলেছে ও। হাজার প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে পড়াশুনো শিখে, রোজগার করে ওদের ধুঁকতে থাকা সংসারটাকে দাঁড় করাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে সেই ক্লাস ইলেভেন থেকে। সেই বছরেই মা দু-দিনের জ্বরে ভুগে চলে গেল, বাবা বেকার হয়ে গিয়ে কিছুটা শারীরিক আর অনেকটা মানসিক আঘাতে বিছানা নিল। সেই তখন থেকে নিজে রান্না করে স্কুল গিয়ে, টিউশনি পড়িয়ে সংসার চালাচ্ছে ও। এত অভাব-অনটনেও কখনো কারুর কাছে হাত পাতেনি, শত কষ্টেও আত্মীয়স্বজনের গলগ্রহ হয়নি। তবু ওর সাথেই এসব ঘটনা ঘটে কেন! নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে রাগে দুঃখে ঝড়ের গতিতে হাঁটছিল ঐশানী।
ঘটনাটা শুরু হয়েছে গত পরশু। এই দু-দিনে ও ভয়ে কাউকে ব্যাপারটা বলতে পারেনি, কাকেই বা বলবে, বাবাকে বললে হয়তো ওকে আর রাত করে ফিরতেই দেবে না, তখন সংসার চলবে কি ভাবে! কলেজেও ওর তেমন একটা বন্ধুবান্ধব নেই, একে ফ্রি-শিপ পাওয়া ছাত্রী, তার ওপর ওর মলিন পোশাক- আশাকে কেউ তেমন আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্বও করেনি। ও-ও হয়তো একটা হীনমন্যতায় গুটিয়ে থাকে। কলেজ লাইফের আনন্দ নেওয়ার সময় বা ভাগ্য কোনোটাই ওর নেই। সপ্তাহে প্রতিদিনই কোন্নগরের ওই কোচিং সেন্টার থেকে পড়িয়ে ফেরে ও, পরশুও ফিরছিল। স্ট্র্যান্ড রোড অফিস কাছারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এমনিই বেশ নির্জন হয়ে যায়, দু-একটা খুচরো ব্যবসায়ী তাদের ঝাঁপ বন্ধ করতে ব্যস্ত থাকে, তার ওপর নিমতলা শ্মশানঘাটের কাছটা তো একেবারেই নির্জন। একটা পুরনো মন্দিরের পাশ দিয়ে ও বেশ দ্রুতগতিতে হাঁটছিল, সেদিন সকালে রান্না পুরোটা করে আসার সময় পায়নি, বাড়ি গিয়ে বাকিটা শেষ করতে হবে, হঠাৎ একটা শিসের শব্দে মুখ ঘুরিয়ে বাঁ-দিকে তাকাতেই মন্দিরের সামনের রকে বসে থাকা ছেলেটাকে দেখতে পেয়েছিল ও।
বয়স ঐশানীর থেকে বছর চার-পাঁচ বেশিই হবে, লম্বাটে দোহারা গড়ন, গায়ের রঙ শ্যামলা। আগেকার দিনের হিন্দি ফিল্মের হিরোর মতো কাঁধ অবধি নেমে আসা লম্বা লম্বা চুল, একটা ছেঁড়া-খোঁড়া জিন্সের ওপর বুকের অনেকটা খোলা একটা চকরাবকরা শার্ট। সেখানে ঝুলছে একটা লকেট।
ছেলেটা দুই হাতে কি একটা পাকাতে পাকাতে এসে প্রথমে অনেকদিনের চেনা, এমন একটা ভাব করে হেসেছিল, তারপর পরিষ্কার অথচ মিহি কণ্ঠে বলেছিল, ”কি ম্যাডাম, এত রাতে একা একা ফিরছেন, দিনকাল ভালো না, একটু এগিয়ে দেব নাকি!”
ঐশানীকে ভিতু মেয়ে বলা যায় না, ছোট থেকে অনেক প্রতিকূল পরিবেশে মানাতে হয়েছে নিজেকে, বিপদের মুহূর্তে মাথা ঠাণ্ডা রাখার গুণটা ও অনেকদিনই আয়ত্ত করেছে। তবু জনমানবহীন এই রাস্তায় রাত্রিবেলা এরকম পরিস্থিতিতে পড়ে ওর গলাটা বুঝি একটু কেঁপে গেছিল। হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে শক্ত গলায় বলেছিল, ”বিরক্ত করবেন না। আ-আমি কিন্তু লোক ডাকব!”
ছেলেটা সেদিন আর কিছু করেনি। পেছন থেকে শুধু চেঁচিয়ে বলেছিল, ”হেল্পই তো করতে চেয়েছিলাম ম্যাডাম, আমার একটা দারুণ বাহন আছে, দু-মিনিটে পৌঁছে দিতাম!”
পরেরদিন সকালেই নানা কাজের ব্যস্ততায় মাথা থেকে পুরো ঘটনাটা উড়ে গিয়েছিল ঐশানীর। রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করা ফচকে ছেলেদের অভাব নেই, সমাজে মেয়েদেরকে বিরক্ত করা, তাদের সাথে অসভ্যতা করে মজা পাওয়াটাকে এখনো বীরপুঙ্গবের চিহ্ন বলে কোথাও কোথাও ধরা হয়, অন্তত এই লোফারগুলো তাই মনে করে। তবে, নিজের আগেকার অভিজ্ঞতায় ঐশানী দেখেছে, মুখ নীচু করে চলে না গিয়ে গলা উঁচিয়ে প্রতিবাদ করলে বেশিরভাগ বীরপুরুষই তখন লেজ গুটিয়ে পালায়। তাই গতকালও ছেলেটাকে আবার একইভাবে বসে থাকতে দেখে ও মনে মনে প্রস্তুত হয়েছিল।
ছেলেটা কাল একেবারে ওর সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, কোনো ভূমিকা না করেই বলেছিল, ”ম্যাডাম, আপনার জন্যই বসে আছি। দেখুন না, আমার লাইটারটা শেষ হয়ে গেছে, আপনার কাছে লাইটার বা দেশলাই কিছু হবে?”
ঐশানী স্থির চোখে তাকিয়েছিল, ছেলেটার মুখ থেকে ভকভক করে বেরনো বিকট গন্ধে গা গুলিয়ে আসছিল ওর, মনে হয় গাঁজা-টাজা খাচ্ছে! একটা মেয়ের কাছে দেশলাই চাওয়ার মতো অসভ্যতা করে কি পাচ্ছে এই লোফারটা? প্রথমে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হল ঠাস করে একটা চড় কসায় ছেলেটার গালে, তারপর মনে হল, এই জনশুন্য রাস্তায় ছেলেটা বাড়াবাড়ি করতে শুরু করলে ও চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেললেও কেউ আসবে না! তার চেয়ে বরং অন্য রাস্তা নিতে হবে। মনের সমস্ত শক্তি এক করে ও বলেছিল, ”দেখুন, আমি সারাটাদিন অনেক খেটে ফিরি। আপনি কেন আমাকে এভাবে রোজ বিরক্ত করছেন বলুন তো, কি পাচ্ছেন এসব করে আপনি!”
নিজের অজান্তেই ওর গলাটা কাঁদোকাঁদো হয়ে গিয়েছিল শেষের দিকে, ছেলেটা সেটা লক্ষ করে হেসে বলেছিল, ”এ বাবা, আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন! আমি তো শুধু আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই!” বলে নিজের ডানহাতটা কায়দা করে বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলেছিল, ”হাই, আমি অনঘ। বলুন তো আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসি কিছুটা।”
ছেলেটার গোটা ডানহাতটায় আঁকিবুঁকি করা বিকট সাপের ট্যাটু দেখে ঐশানী ঘেন্নায়, ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিল, তারপর এর সাথে কথা বলা বেকার বুঝে হনহন করে হাঁটা দিয়েছিল। পেছন থেকে ছেলেটার হাসিতে ভয়ে ওর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
কাল সারাটা রাত একফোঁটা ঘুমোতে পারেনি ও, ছটফট করেছে, বারবার উঠে মুখে জলের ঝাপটা দিয়েছে, শেষে ভোররাতে উঠে ওদের বস্তির লাগোয়া একফালি উঠোনে গিয়ে বসেছিল চুপচাপ, নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে জল বেয়ে নামছিল অবিরাম। আচ্ছা ওকে দেখে কি সেরকম বাজে মেয়ে মনে হয়, যারা অচেনা ছেলেদের বাইকে উঠে পড়ে! কি করবে ও, এরকম চললে ও কলেজ করে পড়িয়ে ফিরবে কিভাবে! না খেয়ে শুকিয়ে মরতে হবে তো দুজনকে! ভেতরের ঘরে বাবার একনাগাড়ে কাশি শুনতে শুনতে ও দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। একবার ভাবছিল বাসে করেই ফিরবে এবার থেকে, তারপর মাসে প্রায় পাঁচশো টাকা বেড়ে যাবে বুঝে সেটা নাকচ করল। আচ্ছা, ভোরবেলায় একটা টিউশনি ধরলে কেমন হয়, তাতে বাবার ওষুধের টাকাটাও উঠে আসবে, আর ও বাসেও ফিরতে পারবে রাতটুকু!
মোটামুটি একটা সমাধান করে চোখ মুছে রান্নাঘরে ঢুকেছিল ও। আজ কলেজ কি একটা কারণে ছুটি, তাই একদম সেই বিকেলে কোন্নগর যেতে হবে পড়াতে। খুন্তি নাড়তে নাড়তে ও ভাবছিল, আজকের মধ্যেই যাহোক করে একটা টিউশনি জোগাড় করতেই হবে ভোরবেলাটায়।
গত ক-দিনের ঘটে যাওয়া এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে কখন স্ট্র্যান্ড রোড, নিমতলা শ্মশান পেরিয়ে বেনেটোলার মুখে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়েছে, ঐশানী খেয়ালই করেনি। দাঁতগুলো অজানা এক ভয়ে কাঁপছে, বুকের ভেতর ড্রাম পিটছে অবিরত। না চাইতেও চোখ চলে গেল মন্দিরের রকটার দিকে, আজ অমাবস্যা মনে হয়, আকাশে চাঁদ নেই, রাস্তায় দুয়েকটা লাইটও জ্বলছে না ঠিকঠাক। ভয়ে আশঙ্কায় ঐশানী মনে হচ্ছিল অবসন্ন দেহে টলেই পড়ে যাবে, এমন সময় চোখ পড়ল রকটার দিকে, না, কেউ নেই। প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন মন্দির, এখন পরিত্যক্ত। বট অশ্বত্থের ঝুড়ি দিয়ে ঘিরে থাকা প্রায় ভেঙে পড়া দরজার আশপাশ দিয়ে উঁকি মারছে মিশমিশে কালো জমাট বাঁধা অন্ধকার, ও একঝলক তাকিয়েই মনে মনে ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে ছুটতে শুরু করলো, মিনিট পাঁচেক চললেই বেনেটোলার মোড়, সেখানটা তবু লোকজন আছে এখনো।
কিন্তু দু-কদম ছুটেই ওকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল, ডানদিক থেকে যেন অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল ছেলেটা। আজ গায়ে একটা কালো গেঞ্জি, তাতে চকচক করছে সোনালি রঙের একটা বাঘের মুখ। স্মিত হেসে বলল, ”এই তো ম্যাডাম এসে গেছেন! ম্যাডাম একটা হেল্প করবেন আমায়, বড় বিপদে পড়েছি, আপনি ছাড়া আমার আর তেমন কোনো বন্ধু নেই যে!”
ঐশানীর চামড়ার নীচ দিয়ে যে রক্ত চলাচল করছিল, সেগুলো মনে হচ্ছিল শিরা ফেটে বাইরে ছলকে বেরিয়ে পড়বে, তবু ও ক্লান্ত স্বরে বলল, ”কি, বলুন?”
ছেলেটা ওর চোখে চোখে রেখে বলল, ”সকাল থেকে খুব দুধ খেতে ইচ্ছে করছে, জানেন! আমাকে একটু দুধ খাওয়াতে পারেন?”
ঐশানী ছেলেটার স্পর্ধায় স্তম্ভিত হয়ে গেল, মাথার সব শিরাগুলো দপদপ করছে, যা হয় হোক, আর রাগ সংবরণ করতে না পেরে সজোরে একটা থাপ্পড় কসাল ও ছেলেটার গালে। চিৎকার করে বলতে লাগল, ”অসভ্য শয়তান লোফার কোথাকার! কেউ এখানে আছেন, প্লিজ হেল্প! প্লিজ হেল্প মি!”
ওর তারস্বরে চিৎকারের মাঝে ছেলেটা কিন্তু চড় খেয়েও কিছু করল না, ঠিক সেরকমই মৃদুমন্দ হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল সেই পরিত্যক্ত মন্দিরটার দিকে। বট অশ্বত্থের ডালপালা সামলে অদৃশ্য হয়ে গেল ভেতরটায়।
ঐশানীর মাথা আর কাজ করছিলো না, রাগে অপমানে কাঁপতে কাঁপতে ও-ও দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে যেতে গেল মন্দিরটার দিকে। তার আগেই কিছু লোক চলে এসেছে। ওর চিৎকার শুনে পেছনের নিমতলা শ্মশান থেকে কয়েকজন হেঁটে এদিকে এসেছে, তাদের মধ্যে একজন বলল, ”কি হয়েছে?”
ঐশানী অস্থির হয়ে চিৎকার করতে করতে বলল, ”দাদা আমাকে বাঁচান প্লিজ! এ-একটা ছেলে! রোজ অসভ্যতা করে আমার সাথে! আজও করেছে! ওই যে, ঐ মন্দিরের ভেতর ঢুকেছে!”
লোকগুলোর মধ্যে একজন অবাক হয়ে বলল, ”ঐ মন্দিরের ভেতরে! সেখানে তো সাপখোপ ছাড়া কিছু নেই! ওখানে লুকিয়ে থাকবে কি করে! আর একটাই তো দরজা ওটার, পেছন দিয়েও তো পালাতে পারবে না!”
ঐশানী ছটফটিয়ে উঠে বলল, ”ওখানেই ঢুকেছে! আপনারা প্লিজ কিছু করুন!”
লোকগুলো একে অন্যের দিকে দু-একবার তাকাল, তারপর একজন হাতে লাঠি উঁচিয়ে মন্দিরের রকে উঠে ডালপালা সরিয়ে মোবাইলের আলো জ্বেলে সাবধানে ভেতরে উঁকি মারল, তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল, ”কই এখানে তো কেউ নেই!”
ততক্ষণে ঐশানী নিজেকে কিছুটা সামলেছে, বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে গেল দরজাটার দিকে, ভেতরে মুখ বাড়াতেই ও স্থবির হয়ে গেল, সত্যিই ভেতরে কেউ নেই! বোঝাই যাচ্ছে গত পঞ্চাশ বছরেও এর ভেতরে কারুর পা পড়েনি। ধুলোভরা পাথরের মেঝের মাঝখানে ঝুলে ভর্তি শিবলিঙ্গ। অবিশ্বাসে, আতঙ্কে ও লোকটার মোবাইলটা নিয়ে উঁচু করে ধরে ভালো করে দেখতে লাগল, চারপাশের দেওয়ালে শতাব্দী প্রাচীন কিছু ছবি আঁকা, এত বছরেও তা মোটামুটি স্পষ্ট। শিবের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি, কোনোটা নটরাজ ভঙ্গিতে নৃত্যরত, কোনোটা পার্বতীর সাথে, কোনোটা আবার ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। ছবিগুলো ভালো করে দেখতে দেখতে হৃৎপিণ্ডটা ওর গলার কাছে উঠে এল। এই কয়েকদিন ধরে রাতের অন্ধকারে দেখে চলা অনঘ বলে ছেলেটার মুখের সাথে ছবির ওই শিবের মুখের যে একচুলও পার্থক্য নেই!
জ্ঞান হারানোর আগে ওর শুধু দুটো কথাই মনে পড়ল, একটা হল বাংলা পুরাণে বহুদিন আগে পড়া একটা সমার্থক শব্দ—শিবের আরেক নাম অনঘ। আর দু-নম্বর হল আজ শিবরাত্রির জন্য ওদের কলেজ ছুটি ছিল!
ঘণ্টাখানেক পরে ওই দাদারা যখন ওকে গাড়ি করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলো, তখন ও অনেকটাই সামলে নিয়েছে নিজেকে! শুধু ভেতরটা মরমে পুড়ে যাচ্ছে! সব কিছুই দিনের আলোর মতো ওর সামনে স্পষ্ট এখন, সাপ আঁকা ট্যাটু, বাঘের ডোরাকাটা গেঞ্জি, কাঁধ পর্যন্ত ছাপানো চুল, মুখে গাঁজার গন্ধ! নিজের নামের মানেটাও মনে পড়ছিল ওর, ঐশানী দুর্গারই আরেক নাম! শিবরাত্রির দিন ওর এত কাছে এসেছিলেন, তবু ঐশানী তাঁকে চিনতে পারল না!
বাথরুমে ঢুকে ভিজে শরীরে বালতি থেকে জল তুলে ঢালতে গিয়ে খেয়াল হল গলায় কি একটা ফুটছে। হাতে নিয়ে দেখল, একটা ছোট্ট ত্রিশূল শেপের খাঁটি সোনার ভারী লকেটটা। যেটা গত কয়েকদিন ধরে অন্য একজনের গলায় ও দেখছিল।