ঝরাপাতার রূপকথা

ঝরাপাতার রূপকথা

।। এক।।

ভেতরের করিডরের বড় ঘড়িটায় ঢং ঢং করে ছ-টা বাজল, তবু বিশ্বরূপ বেঞ্চ থেকে উঠলেন না। অ্যাটেন্ডেন্ট সুদীপ বলে ছেলেটা দু-বার তাগাদা দিয়ে গেছে, ”দাদু, সন্ধে নেমে গেল, এরপর কিন্তু মশা কামড়াবে, আপনার এমনিই কিছু একটু হলেই স্কিনে রাশ বেরিয়ে যায়, ভেতরে চলুন।” বিশ্বরূপ পাত্তা দেননি। এই অ্যাটেন্ডেন্টগুলো বিরক্ত হলেও বেশি কিছু বলতে পারে না, মোটা টাকা প্রতিমাসে জমা পড়ে এই সংস্থার অ্যাকাউন্টে, খারাপ ব্যবহার করলে এদেরই চাকরি যাবার সম্ভাবনা।

গঙ্গার পাড়ে এই সুন্দর সাদা বিলাসবহুল ওল্ড এজ হোম, মাত্র বছর পাঁচেকের পুরনো হলেও ভিক্টোরিয়ান গথিক স্টাইলে বানানো, অনেকটা রাজভবনের স্টাইলে, নাম ‘ঝরা পাতা’। মূলত উচ্চবিত্ত পরিবারের বৃদ্ধ বৃদ্ধা, যাদের সুশিক্ষিত ছেলে বা মেয়ে বাইরে ওয়েল সেটলড, তারাই এখানকার বাসিন্দা। বিশ্বরূপও তাঁদের মধ্যেই একজন। সারাটা জীবন নেভিতে ভালো চাকরি করেছেন, একমাত্র ছেলে রূপক ছোট থেকেই মেধাবী, বহুবছর ধরেই সে আমেরিকায়, আগে তবু বছরে একবার আসত, বছর পাঁচেক আগে ওর মা চলে যাওয়ার পর আর আসে না, মাসে এক-দুবার ফোন করেই বুড়ো বাবার প্রতি কর্তব্য সারে। বিশ্বরূপের তার জন্য কোনো অসন্তোষ নেই, সারাটা জীবন তিনি কারুর গলগ্রহ হয়ে কাটাননি, এখনো তা চান না। মোটা টাকা পেনশন পান, বইয়ের পোকা তিনি, অবসর কাটাবার অভাব হয় না। শুধু সল্টলেকের বিশাল বাড়িটার শূন্যতা তাঁকে যেন গিলে খেটে আসছিল স্ত্রী চলে যাওয়ার পর থেকে। তাই একরকম নিজের ইচ্ছাতেই এই বৃদ্ধাবাস খোলার বিজ্ঞাপন দেখে চলে এসেছিলেন এখানে। তবু কিছু লোকের সাহচর্য তো পাওয়া যাবে। তাই ‘ঝরা পাতা’র তিনি একদম প্রথম থেকেই বাসিন্দা, আর তিনিই বোধ হয় একমাত্র যার এইখানে থাকা নিয়ে কারুর প্রতি কোনো ক্ষোভ বা অভিমান নেই।

বিশ্বরূপ গঙ্গার থেকে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। দূরে অস্ত যাওয়া সূর্যটাকে আর দেখা যাচ্ছে না, শুধু তার ফেলে যাওয়া লাল রেশটা সারা পশ্চিম আকাশটায় কেমন বিষণ্ণতার সৃষ্টি করেছে, ঠিক বিশ্বরূপের বর্তমান মানসিক অবস্থার মতো, ভাবলেন বিশ্বরূপ। গতকাল অবধিও প্রতিটা বিকেলবেলা কত সুন্দর কাটত, সন্ধে হতে না হতেই মালবিকা এসে বসত তার ঠিক পাশটাতে, কত গল্প, কত কথা বলতেন দুজনে। এই পঁয়তাল্লিশ বছরের জমে থাকা কত অভিমান, হাসি, কান্না মুক্তোর মতো ঝরে পড়ত। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের প্রথম প্রেমের বিন্দু বিন্দু কথা দিয়ে কেটে যেত এই অনন্ত অবসর। কিন্তু আজকের পর থেকে তা আর হবে না। মালবিকা আর কোনোদিনও এসে বসবে না পাশে। ভাবলেই কেমন অস্থির লাগছে।

হঠাৎ একটা মৃদু গলাখাঁকারিতে বিশ্বরূপ চমকে পাশে তাকাতেই দেখলেন মালবিকা এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বেঞ্চে বসেনি, আলগোছে বলল, ”কাল অনেক ভোরে গাড়ি আসবে, তুমি তখন হয়তো ঘুম থেকে উঠবে না, তাই দেখা করতে এলাম।”

বিশ্বরূপ মৃদু হাসলেন, বললেন, ”বেশ তো, বোসো না একটু।” তারপর কি মনে পড়তে বললেন, ”অর্পণ কাল বুঝি খুব ভোরে আসবে?”

মালবিকা পাশে বসে পড়ে বলল, ”হ্যাঁ। অফিস যাওয়ার আগে নিয়ে যাবে আমায়।”

প্রায় দশমিনিট কেউ কোনো কথা বলল না। সুদীপ বলে ছেলেটা আরো একবার ডেকে গিয়েছে, এরা বেশ মজা পায় বিশ্বরূপ আর মালবিকার ব্যাপারে, নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে ইয়ার্কিও মারে, বিশ্বরূপ জানেন। ভাবে বুড়ো বুড়ির রস কত, এখানে এসে এই বয়সেও প্রেম! বিশ্বরূপ পাত্তা দেন না, ওরা তো আর জানে না, পুরনো হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে ওরা এখানে এসে খুঁজে পেয়েছেন!

বিশ্বরূপ হঠাৎ নরমসুরে বললেন, ”সেই পঁয়তাল্লিশ বছর আগে জাহাজের চাকরি নিয়ে আমি তোমায় ছেড়ে চলে গেছিলাম, সেই শোধ তুমি এখন তুলছ মালি? ক্লিন্তু আমি তো ফিরে এসেছিলাম তোমার কাছে, তখন তুমি অন্যের বউ। কিন্তু তুমি তো আর ফিরে আসবে না!”

মালবিকা ঠেঁট কামড়ালেন। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে তিনি ছিলেন স্কুল ছেড়ে সদ্য কলেজে পা রাখা এক যুবতী, বিশ্বরূপ চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার তিন বছর অবধিও যে নানা অজুহাতে নানা বাহানায় অজস্র বিয়ের সম্বন্ধ ক্যানসেল করেছিল, শুধু কবে বিশ্বরূপ ফিরে আসবেন সেই আশায়। শেষটা যখন বাবাও চলে গেলেন, মায়ের মুখ চেয়ে আর অরুণের সাথে বিয়েটা ভাঙতে পারেননি। সময়ের সাথে সাথে, সংসারের জাঁতাকলে, সন্তান, কর্তব্যের মাঝে বিশ্বরূপের মুখটা কখন যেন ফিকে হয়ে গিয়েছিল, পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া অ্যালবামের মতোই হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর বিশ্ব, শেষে এতবছর বাদে এই ‘ঝরা পাতা’য় এসে যে দেখা হবে ভাবতেও পারেননি মালবিকা। মাত্র ছ-মাস হল এখানে এসেছিলেন মালবিকা, কিন্তু এই ক-টা দিন যেন রূপকথার মতো কেটেছে তাঁর। না, বিশ্বরূপের মধ্যে তিনি হারানো প্রেমকে আর খুঁজতে চাননি, বরং পেয়েছিলেন এক বন্ধু, পরম নির্ভরতার। যে তাঁকে সঙ্গ দেবে, কথা বলবে। এখানে মালবিকা এসেছিলেন বাড়ি ছেড়ে, সংসার ছেড়ে আসার মন খারাপ নিয়ে, আর যাচ্ছেন ‘ঝরা পাতা’কে ছেড়ে যাওয়ার মনখারাপ নিয়ে। মালবিকা হঠাৎ বললেন, ”আচ্ছা, আমরা বাবা-মায়েরা সবসময় চাই ছেলেমেয়ে দারুণ পড়াশুনোয় হোক, বিশাল চাকরি করুক, কেন বল তো! বুড়ো বয়সে বাবা-মাকে ছেড়ে তারা নিজেদের কেরিয়ারের জন্য দূরে গিয়ে থাকবে বলে? তার থেকে তো সাধারণ হওয়াই ভাল, আমার বান্ধবী মনিকার ছেলেটার সাধারণ দোকান, কিতু মনিকা কি সুন্দর ছেলে, বউ, নাতনির সাথে রয়েছে, মনির শরীর খারাপ হলে ছেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, পাশে বসে দু-দণ্ড কথা বলছে! আমরা কি পাচ্ছি বল তো?”

অন্য কেউ এই কথাগুলো বললে এতক্ষণে বিশ্বরূপ প্রতিবাদ করতেন, বলতেন, ”আপনি মশাই ভারি সেলফিস, ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, তাদের নিজেদের মতো লাইফটা কাটাতে দিন না! সারাক্ষণ আপনার সাথে লেপ্টে থাকলে জগৎটাকে জানবে কি করে সে? এই জন্যই বাঙালি জাতটার কিছু হল না!” কিন্তু এখন বিশ্বরূপ কিছু বললেন না। মালির মনটা আজ বড় খারাপ। ওর ছেলে এতদিন চেয়েছিল তাদের প্রাইভেসি রক্ষার্থে মা বৃদ্ধাশ্রমেই থাকুক, কিন্তু সম্প্রতি বিদেশ চলে যাওয়ার অফার আসায় আর ইদানীং কিছু চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনায় সে ব্যাটার মনে হয়েছে বালিগঞ্জ লেকের একদম পাশে অমন দোতলা বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকলে বড়ই চিন্তার, যেকোনো সময় বেহাত হয়ে যেতে পারে। তাই মোটা মাইনের লোক রাখার থেকে বিনাপয়সার মা-কেই বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে বেশি উপযুক্ত মনে হয়েছে তার। তাই মালবিকাকে নিয়ে যাচ্ছে সে কাল সকালে। এই সপ্তার মধ্যেই সে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে পাড়ি দেবে বিদেশে।

বিশ্বরূপ ভাবলেন, তিনি নিজে সন্তান হলেও কি নিজের স্বার্থটাই এমন নির্মমভাবে দেখতেন? মায়ের ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো মুল্যই দিতেন না? কিন্তু ছেলে যদি মা-কে নিয়ে যেতে চায়, তিনি কিভাবে আটকাবেন? অসহায় হয়ে মালির শীর্ণ হাতটা ধরতে ইচ্ছে করল তাঁর।

মালবিকা আবার বললেন, ”অবশ্য আমাদের ভালো লাগা মন্দলাগার কি-ই বা দাম আছে! সত্যিই তো আমরা ঝরে যাওয়া পাতা!”

বিশ্বরূপ সোজা হয়ে বসলেন। এখন এই দুঃখবিলাস তাঁর ভালো লাগছে না, ঝরে যাওয়া পাতা হতে যাবেন কেন তিনি! মানুষের বয়স হলেই তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয় কেন? তিনি নিজে এখনো যথেষ্ট কর্মঠ, নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন, বাঁচার ইচ্ছে তাঁর এখনো পুরো মাত্রায় রয়েছে। মনটা তেতো হয়ে গেল। সারাজীবন নিজের চারপাশে একটা কঠিন বর্ম তৈরি করে রেখেছিলেন, কষ্ট হলে মন খুলে কাঁদতে পারেননি, আনন্দ হলে প্রাণ খুলে হাসতে! ডিফেন্সে চাকরি করতে করতে কখন যেন একটা কঠিন পাথরে পরিণত হয়েছেন! কিন্তু কাল সারারাত সত্যিই ঘুম আসেনি একফোঁটাও। আচ্ছা মালি এল কেন? এর থেকে আর দেখা না হলেই ভালো ছিল, বেশ ছিলেন বিশ্বরূপ সারাদিন বই নিয়ে। সাময়িক মনখারাপটা ঝেড়ে ফেলে আজ সারাদিন ধরে ভেবে চলা কথাগুলো মনে পড়তেই বললেন, ”চল মালি আমরা কিছু একটা করি।”

মালবিকা অবাক হয়ে তাকালেন, ”কি করব!”

বিশ্বরূপ সোজা হয়ে বসলেন, ”এত বছর তো খালি নিজেদের জন্যই বাঁচলাম, নিজের পড়াশুনো, নিজের কেরিয়ার, নিজের ছেলেমেয়ে, খালি আমার আমার আর আমার! ওপরে গিয়ে কি জবাবদিহি করবে মালি, যদি জিজ্ঞেস করে এত বছর ধরে পৃথিবীর সম্পদ ধ্বংস করলে, কি দাগ কেটে এলে? কি বলবে মালি?”

মালবিকা বললেন, ”দাগ আমি কি কাটব রূপ! আমি সাধারণ মানুষ। ছেলেকে বড় করেছি এতেই আম্মার………।”

বিশ্বরূপ অস্থির হয়ে বললেন, ”ওসব ছেঁদো কথা ছাড়ো। ওগুলো আমাদের ভেতরের স্বার্থপর ‘আমি’-টার অজুহাত বুঝলে! অন্যের জন্য বাঁচতে গেলে অসাধারণ হতে হয় না মালি, শুধু মনটাকে বড় করতে হয়।”

মালবিকা বললেন, ”এই বয়সে কি করার কথা ভাবছ তুমি?”

বিশ্বরূপ একমুহূর্ত থমকালেন, বললেন, ”মালি, তোমার ছেলে আমার ছেলে মেধা নিয়েই জন্মেছে, এদের কৃতিত্বে আমাদের বিশেষ কোনো ক্রেডিট আছে কি? এই যে নরেন্দ্রপুর, রহড়া থেকে শুরু করে সব ভালো ভালো জেলা স্কুল বা নামজাদা স্কুলগুলোয় এত টাফ অ্যাডমিশন নিয়ে ছেলেমেয়েদের ভর্তি কড়া হয়, তারা তো এমনিই ভালো মালি, তারা যেখানেই পড়ুক, ভালো করবে, তাহলে স্কুলের কি ক্রেডিট হল? ক্রেডিট তো সেটা যদি পচতে শুরু করা গাছগুলোতে আবার সবুজ পাতা আনানো যায় তাই না মালি? চল না আমরা দুটি ঝরা পাতা মিলে কয়েকটা সবুজ পাতা তৈরি করি!”

সেদিনের সন্ধ্যেয় বিশ্বরূপ আর মালবিকার কথোপকথনের পর প্রায় একবছর কেটে গেছে। কিন্তু এই একবছরে দুজনের জীবনই আমূল বদলে গেছে। আজ সকাল থেকে মালবিকা ভীষণ ব্যস্ত। তাঁর ছেলে অর্পণ বিদেশে চলে গেছে প্রায় বছরখানেক হল, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তার ফেরার সম্ভাবনা নেই। তা নিয়ে আর তেমন মনখারাপও হয় না মালবিকার! ওরা সুখে থাকলেই স্বস্তি। মালবিকা ‘ঝরা পাতা’ ছেড়ে তাঁর বালিগঞ্জের বিশাল বাড়ির দোতলায় থাকেন আর সঙ্গে দুটো কাজের মেয়ে। কিন্তু তাঁর একা লাগেনা মোটেই। কারণ নীচতলাটা সবসময়েই গমগম করে আর তিনি নিজেও ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। বিশ্বরূপও এখন ভীষণ ব্যস্ত, সকাল হলেই চলে আসেন এই বাড়িতে, দুপুর অবধি সব দেখাশোনা করে চলে যান তাঁর নিজের সল্টলেকের বাড়িতে, সেখানেও একই চিত্র। এত ব্যস্ততায় বিশ্বরূপের বয়স যেন আরো কমে গেছে, সুঠাম ঋজু গড়নের ফর্সা রিমলেস চশমার অভিজাত যুবকটিকে দেখলে কে বলবে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন তিনি! সপ্তায় দুদিন তাঁকে ছুটতে হয় লালবাজারে, এছাড়া কোর্টের ঝামেলা তো লেগেই আছে।

 মালবিকা রান্নাঘরে গিয়ে তদারক করছিলেন। রান্নাঘরের বাইরের কলতলাতেও শামিয়ানা খাটানো হয়েছে, সেখানে রাখা রয়েছে বিশাল বিশাল সব গ্যাসওভেন। মালবিকা এটা ওটা নির্দেশ দিচ্ছিলেন। অদ্ভুতভাবে তাঁর কোমরের ব্যথাটাও বহুদিন হল নেই, বিশ্বরূপ ঠিকই বলেন, কাজই মুক্তি! আজ প্রায় সত্তর আশি জন খাবে এবাড়িতে। বাইরে থেকে রাঁধুনি আনানোর প্রস্তাব হয়েছিল, কিন্তু রতন জোর করে বারণ করেছে, বারবার বলেছে, ”না মেসোমশাই, তোমরা লোক রাখবে না কিন্তু! আরে আমি একাই দুশো জনের রান্না করতাম, আর সেখানে তো এই ক-টা লোক!”

মালবিকা রতনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সে ভীষণ ব্যস্ত। দুই হাতে একই সাথে অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় দুটো কড়াইয়ে রান্না করছে, ওদিকে কুটনো কুটছে আরো তিনজন। তিনি নরমসুরে ডাকলেন, ”রতন, সকাল থেকে মুখে কিছু দিয়েছিস?”

রতন মুখ না ঘুরিয়েই বলল, ”ওসব পরে মাসিমা! রান্না একটা পুজো জানো! সেটা মন দিয়ে না করলে ঠাকুর রেগে গিয়ে খাবারের বারোটা বাজিয়ে দেয়!”

মালবিকা মৃদু হাসলেন, রতন ছেলেটা একটু বেশি বকে, কিন্তু মনটা বড় ভালো। কে বলবে এই ছেলে তিনবছর জেল খেটে বেরিয়েছে? প্রথম যখন বিশ্বরূপ বলেছিলেন যে অল্পবয়সে জেলে ঢোকা ছেলেদের নিয়ে কিছু করতে চান, মালবিকা শুনে আঁতকে উঠেছিলেন, ”কি বলছ তুমি! জেলফেরত ক্রিমিন্যালদের বাড়িতে থাকতে দেব! তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?”

কিন্তু বিশ্বরূপ ছটফটিয়ে উঠে বলেছিলেন, ”উফ মালি, তুমি না টিচার ছিলে? আমাদের দেশে নাবালক অপরাধীর সংখ্যা সাংঘাতিক হারে বেড়ে চলেছে, পনেরো ষোল বছরের ছেলেরা এমন সব জঘন্য অপরাধ করছে যা কল্পনাও করা যাচ্ছে না! কিন্তু ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী এদের জুভেনাইল কোর্টে বিচার হচ্ছে, আর আঠারো বছর বয়স হতেই এরা জেলে কুসঙ্গে মিশে আরো বড় আসামী হয়ে বেরোচ্ছে! আমরা তো কন্সটিটিউশনের নিন্দা করেই খালাস, কিন্তু একবার ভেবে দ্যাখো তো, আমরা নিজেরাই কি এইজন্য দায়ী নই?”

মালবিকা রাগে কাঁপছিলেন, ”আমরা? আমরা কেন দায়ী হতে যাব রূপ? নির্ভয়ার কথা ভুলে গেছ? সবথেকে নৃশংস অত্যাচার করেছিল নাবালক ছেলেটা, মেয়েটার শরীর থেকে অন্ত্র পর্যন্ত টেনে বের করে এনেছিল, এরা শুধু জন্মায় লোকের সর্বনাশ করতে!”

বিশ্বরূপ অস্থির হয়ে বলেছিলেন, ”মালি, একটা বাচ্চা যখন জন্মায় তখন তাঁর মন, মানসিকতা, সব কিছু থাকে একটা সাদা কাগজের মতো, আশপাশের বড়রা যা করে, বাচ্চারা সেটাই তার মনের কাগজে লেখে, আশপাশের সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতিই তাকে চালিত করে। জেলের আরেকনাম সংশোধনাগার হলেও দাগী আসামীদের সাথে মিশে এরা পাল্টাবার বদলে আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে! আমরা এতদিন তো খালি নিজের আর নিজেদের লোকেদের কথাই ভেবে সব কিছু করলাম মালি, চল না এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ভালো কিছু করে যাই? একটাই তো জীবন! ভালোরা তো ভালো হবেই, খারাপদের ভালো করতে পারাটাই তো চ্যালেঞ্জ মালি!”

মালবিকা তবু রাজি হতে পারেননি। গোঁজ হয়ে বসেছিলেন।

বিশ্বরূপ হাল ছাড়েননি, বলেছিলেন, ”তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার দিনটার কথা মনে পড়ে তোমার? স্বামী বিবেকানন্দের জন্মতিথিতে কলেজে তোমার সেই তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, তোমার সেই বলা লাইন আমার আজও মনে আছে, স্বামীজী বলেছেন এসেছিস যখন একটা আঁচড় কেটে যা। সারাজীবন তো খালি নিজেদের খুশি করলাম আর কর্তব্য করলাম আমরা, আঁচড় কাটার তো এটাই সবচেয়ে ভালো সময় মালি!”

এই একবছরে সত্যিই দেখিয়ে দিয়েছেন বিশ্বরূপ। জুভেনাইল কোর্টে সাজা পেয়ে নাবালক কোনো অপরাধী আঠেরো বছর হবার পর জেল থেকে বেরোলেই তাকে নিয়ে আসেন মালবিকার বাড়ি। প্রথমদিকে লিগ্যাল কিছু ঝামেলায় পড়তে হলেও লালবাজারে বিশ্বরূপ এখন শুধু পরিচিতই নন, খুব সন্মানিয় ব্যক্তি। এমন মানুষ ক-জন হয় যে দেশি বিদেশি কোনো গ্র্যান্টের তোয়াক্কা না করে, নিজের কোনো স্বার্থের কথা না ভেবে পাঁকে পদ্মফুল ফোটাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন?

মালবিকার বাড়ির একতলায় প্রায় কুড়িটা এরকম ছেলে থাকে। তাদের অতীত ভুলে যে যা ভালোবাসে সেইদিকে তাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করেন বিশ্বরূপ আর মালবিকা। কেউ ভালোবাসে ছবি আঁকতে, কেউ চায় নতুন করে পড়াশুনো শুরু করতে, কেউ আবার বুঁদ হয়ে থাকে বাগানের কাজে। ছ-মাস আগে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় বিশ্বরূপের নিজের সল্টলেকের বাড়িতেও এখন ত্রিশটা মতো ছেলে থাকে।

পেছন থেকে তোতন ডাকল, ”দিম্মা, দাদু কখন আসবে?”

মালবিকা সস্নেহে তোতনের দিকে তাকালেন। অথচ এই তোতনই যখন প্রথম আসে, ঘেন্নায় রাগে কিছুদিন ওর মুখের দিকে তাকাতে পারেননি মালবিকা। মাত্র তেরো বছর বয়সে পাঁচ বছরের একটা মেয়েকে রেপ করে খুন করেছিল তোতন। কিন্তু বিশ্বরূপ বুঝিয়েছিলেন, মালি, রোগকে ঘৃণা করো, রুগিকে নয়। ঘেন্না করে দায় এড়িয়ে যাওয়া সোজা, সবাই পারে, পারলে পাল্টিয়ে দেখাও।

তারপর ধীরে ধীরে মালবিকা জানতে পেরেছেন, তোতন ছোট থেকেই মায়ের ওপর বাবার ওপর অত্যাচার, ওর সামনেই গায়ে হাত তোলা, অশ্রাব্য গালিগালাজ দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। ওকে তো ভালো মানুষ হবার জন্য পরিবেশই দেওয়া হয়নি! এখান এসে তোতন ক-দিন গুম হয়েছিল, অন্য ছেলেদের সাথে মারামারি করত, তারপর ভালোদের মাঝে থেকে, আর মালবিকার স্নেহে আস্তে আস্তে ও-ও ভালো হয়ে উঠেছে। এখন সারাদিন ছবি আঁকে, বিশ্বরূপ মাটি এনে দেন, তাই দিয়ে আপন মনে ও মূর্তি গড়ে। বাকি ছেলেরাও যে যা ভালোবাসে, তাই করতে দেওয়া হয়। এই সবক-টা ছেলের সব খরচ দেন বিশ্বরূপ, মালবিকা নিজে কিছু দিতে চাইলেই বলেন, ”সারাজীবন অনেক কামিয়েছি মালি, এখন না হয় তার কিছুটা ভালো কাজে লাগালাম, তাতে তুমি ভাগ বসিয়ো না!”

মালবিকা মাঝেমাঝে ভাবেন। বিশ্বরূপ যদি সত্যিই তাঁর স্বামী হতেন, জীবনটাকে ওর চোখ দিয়ে অন্যরকমভাবে দেখতে পারতেন! এরকম থোড় বড়ি খাড়ার মতো কাটত না পুরো জীবনটা! তিনি হেসে বললেন, ”আসবে, তোর সব সাজানো হয়ে গেছে?”

তোতন লম্বা করে ঘাড় নাড়ল। বিশ্বরূপের এই উদ্যোগে উদবুদ্ধ হয়ে কলকাতা পুলিশের ডিজি নিজে আসবেন আজ। এরকম অভাবনীয় উদ্যোগে উনিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চান। কয়েকদিন আগে কাগজে একটা লেখা বেরিয়েছিল এই নিয়ে, তারপর থেকেই টুকটাক সাংবাদিক আসছে বাড়িতে দুই বুড়োবুড়ির এই কীর্তিকলাপ সম্পর্কে জানতে। যদিও বিশ্বরূপ আর মালবিকা কেউই বেশি প্রচার চান না, তাতে আসল উদ্দেশ্যটাই একদিন হারিয়ে যেতে পারে, তবু ডিজি সায়েবের উৎসাহে আজ দু বাড়ি মিলে একটা খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটু বাদেই বিশ্বরূপ তাঁর বাড়ির ছেলেগুলোকে নিয়ে চলে আসবেন। মালবিকা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওপরে উঠতে গেলেন, কাজের মেয়েদুটোকে শেষ মুহূর্তের কিছু জিনিস মনে করিয়ে দিতে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার আগেই বাড়ির মেন দরজায় কলিং বেল।

মালবিকা ব্যস্তসমস্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ”ওই, ওঁরা বোধ হয় এসে পড়লেন! চাঁপা, শীগগিরই আয়!” চাঁপার অপেক্ষা না করে হুড়মুড়িয়ে তিনিই গেলেন দরজা খুলতে।

দরজা খুলতেই ছ-সাতটা ছেলে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল, এরা সব বিশ্বরূপের সল্টলেকের বাড়িতে থাকে। মালবিকা উঁকি মেরে দেখলেন গেটের সামনে একটা ছোট ম্যাটাডোর এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা থেকে একগাদা চেয়ার, টেবিল, ফুলের তোড়া নামিয়ে ছেলেগুলো ভেতরে ঢোকাতে লাগল। মালবিকা অবাক হয়ে বললেন, ”এত চেয়ার কি হবে রে! বাইরের লোক তো বেশি আসবেন না!”

দ্রুত গতিতে চেয়ারগুলোকে পেছনের বাগানে নিয়ে যেতে যেতে মিন্টু বলে ছেলেটা জবাব দিল, ”দাদু আনতে বলেছে দিম্মা। তুমি একটু সাইড হয়ে দাঁড়াও, না হলে লেগে যেতে পারে!”

মালবিকা ভ্রূ কুঁচকে সরে দাঁড়ালেন। বিশ্বর ছেলেমানুষিপনা এখনো গেল না। সবেতেই বাড়াবাড়ি! একসাথে একটা গেট টুগেদার, তাতে পুলিশের এক বড়কর্তা আসবেন আর আসবেন ‘ঝরা পাতা’র কয়েকজন বন্ধু, তার জন্য এমন এলাহি ব্যবস্থা করার কোনো দরকার আছে? আর এই ছেলেগুলোও তেমনি, ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। হয়তো বিশ্বরূপ বলেছেন একটা ফুলের বোকে আনতে, এরা একরাশ ফুলের তোড়া, মায় মালা নিয়ে এসে হাজির!

মালবিকা নিজের মনেই হেসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আবার ডাকলেন, ”চাঁপা-আ-আ!” কোনো সাড়াশব্দ নেই! কোথায় যে থাকে মেয়েদুটো কে জানে! বিরক্ত হয়ে ওপরে উঠতে গেলেন, কিন্তু হঠাৎ খোলা দরজায় হাঁক ডাক শুনে নেমে এসে দেখলেন, বিশ্বরূপ।

ব্যস্তসমস্ত বিশ্বরূপ ঢুকছেন, সাথে একটা বুড়ো মতো লোক। উঁকিঝুঁকি মেরেও কোনো পুলিশের মতো লোক চোখে পড়ল না মালবিকার। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বুড়ো লোকটা মালবিকার দিকে ইশারা করে মুচকি হেসে বিশ্বরূপকে বললেন, ”স্যার, ইনি-ই?”

বিশ্বরূপ মৃদু হেসে সংক্ষেপে মাথা হেলালেন, কিন্তু সেটা মালবিকার দৃষ্টি এড়াল না। কি হচ্ছে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করার আগেই বিশ্বরূপ মালবিকার কাছে এসে কেজো গলায় বললেন, ”মালি, ডিজি সায়েবের সেক্রেটারিকে ফোন করেছিলাম, মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে পড়বেন, তুমি এখনো তৈরি হওনি!”

মালবিকা অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন, বুড়ো মতো লোকটা কেমন জুলজুল করে চেয়ে রয়েছে, অস্ফুটে বললেন, ”আমি আবার কি তৈরি হবো! ডিজি তো আসছেন ওদেরকে দেখতে!”

বিশ্বরূপ মাথা নাড়লেন, ”আহা! ওদের দেখতে আসছে বলে কি তুমি ওয়েল ড্রেসড হবে না নাকি! সবসময় অকেশন অনুযায়ী প্রপার অ্যাটায়ার মেনটেইন করবে বুঝলে!”

মালবিকা আর কিছ না বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। বিশ্বরূপ নেভি থেকে রিটায়ার করে গেলেও ডিফেন্সসুলভ মানসিকতাটা আর গেল না! সব কিছু একদম নিয়মমাফিক চাই। উপরে এসে কাউকে দেখতে পেলেন না, সব গেল কোথায়! চাঁপাটা নাহয় কানে একটু খাটো কিন্তু সবিতাই বা কোথায় গেল!

*

একঘণ্টা বাদে যখন সাদর অভ্যর্থনা করে ডিজি সায়েবকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে এলেন বিশ্বরূপ, মালবিকা হাঁ হয়ে গেলেন। একী, এ যে তার কলেজের বন্ধু দেবপ্রিয়! দেবপ্রিয় পুলিশের উঁচু পদে আছে সেটা মালবিকা জানতেন, বছর কয়েক আগে টিভিতেও দেখেছিলেন দু-একবার, কিন্তু এখন যে দেবপ্রিয় ডিজি হয়েছে সেটা তো মালবিকা জানতেনই না! টিভি দেখা তো এখন আর হয়েই ওঠে না।

একেই চাঁপা আর সবিতা মিলে একটা ঢাকাই জামদানি পরিয়েছে জোর করে, মালবিকা বারণ করলেও কিছুতেই শোনেনি, শুধু তাই নয়, চুলটাকে চুড়ো করে সুন্দরভাবে বেঁধে মুখে ফেস-পাউডার দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে, তার ওপর এতদিনের পুরনো বন্ধুকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে মালবিকা হকচকিয়ে গেলেন। বিশ্বরূপ তো তাহলে জানতেনই দেবপ্রিয় ডিজি, কলেজে ওঁদের থেকে দু-ক্লাস সিনিয়র ছিলেন বিশ্বরূপ, তবু মালবিকাকে বলেননি কেন!

বাড়ির পেছনের ছোট্ট বাগানটায় এর মধ্যেই ছেলেগুলো সুন্দর একটা স্টেজ করে ফেলেছিল, তাতে তিনটে চেয়ার পাতা, সামনে দর্শকের আসন প্রায় পঞ্চাশটা, সবই প্রায় ভর্তি, হোক ঘরোয়া অনুষ্ঠান, তবু ছেলেগুলো খুব যত্নে সাজিয়েছে। দেবপ্রিয় মালবিকার দিকে তাকিয়ে হাসল, ”চিনতে পেরেছিস মনে হচ্ছে? কেমন আছিস?”

মালবিকা মনের খুশিটা চাপতে পারলেন না, ”তুই এখন পুলিশের বড়সায়েব হয়েছিস! কই বিশ্বরূপ আমাকে বলেনি তো!”

দেবপ্রিয় স্টেজের মাঝের চেয়ারটায় বসে পড়ে মুচকি হাসল, ”বিশ্বদা তো তোকে আরো অনেক কিছুই তো বলেনি মালবিকা! সেই কলেজের দিনগুলোতেও দুঃখ করত তোকে কিভাবে ভালোবাসার কথা জানাবে, আর এখনো দুঃখ করে!”

মালবিকা এতগুলো ছেলের সামনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন, এসব কি বলছে দেবপ্রিয়!

দেবপ্রিয় আবার হাসলেন, গলা চড়িয়ে ডাকলেন, ”কই গো বিশ্বদা, এসো, আর কতক্ষণ ঝুলিয়ে রাখবে? আমার সময় বেশি নেই। এমন দুর্দান্ত ঘটনার সাক্ষী হয়ে পাত পেড়ে খেয়ে যাই!”

মালবিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন, স্টেজের সামনেটা ততক্ষণে একটা টেবিল এনে রেখেছে রতন আর মিন্টু। তার ওপর একটা প্লেটে দুটো রজনিগন্ধার মালা, টেবিলের একপাশে সেই খিটকেল দেখতে বুড়োটা একটা জাবদা খাতা বের করেছে। ‘ঝরা পাতা’ থেকে আমন্ত্রিত সুবলবাবু আর ত্রিদিববাবু হাসি হাসি মুখে টাবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন আর সেখানকার অ্যাটেন্ডেন্ট সুদীপ হাতে একটা ক্যামেরা নিয়ে লেন্স ঠিকঠাক করছে।

মালবিকা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে সেই সুযোগ না দিয়ে স্টেজের ডানদিক দিয়ে নাটকীয়ভাবে উঠে এলেন বিশ্বরূপ। লম্বা ঋজু সৌম্যকান্তি চেহারা থেকে ব্যক্তিত্ব ফুটে বেরোচ্ছে, তসরের পাঞ্জাবি থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আভিজাত্য, ধীর লয়ে কাছে এসে মালবিকার একটা হাত তুলে নিলেন বিশ্বরূপ, আবেগমথিত কণ্ঠে বললেন, ”মালি, ছেচল্লিশ বছর আগে আমি নিজের অজান্তেই যে দেরিটা করে ফেলেছিলাম, সেটা আর করতে চাই না। এই দেড়বছরে আমরা শুধু আমাদের পুরনো ভালোবাসাই ফিরে পাইনি, এতগুলো ছোট ছোট ফুলগুলোকে বাঁচিয়ে তোলার এই যজ্ঞে আমরা সার্থক মানসসঙ্গী হয়েছি। ঠিক যেমনটি আমি চেয়েছিলাম। জীবনের সায়াহ্নে এসে শেষ ক-টা দিন তোমাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে ধন্য হতে চাই মালি!”

মালবিকা এতক্ষণে বুঝতে পারলেন রজনিগন্ধার মালা, ওই লোকটার ম্যারেজ রেজিস্টার খাতার গূঢ়ার্থ! তার মানে ‘ঝরা পাতা’ থেকে ওঁরা ছেলেদের দেখতে আসেননি, এসেছেন বিশ্বরূপ মালবিকার বিয়ে দেখতে? দেবপ্রিয়ও তাই! চাঁপা, সবিতা, ওরা সব জানে, তাই এমনভাবে সাজাল! সবাই তার মানে আজকের এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য জানে শুধু মালবিকা ছাড়া! সব কিছু অতিক্রম করে বিশ্বরূপের এই পুরো ব্যাপারটা গোপন করে যাওয়াতে মালবিকার মন অভিমানে ভরে গেল, বললেন, ”এসবের মানে কি! স্ত্রী মানে! কি বলছ তুমি বিশ্বরূপ! অর্পণ জানলে কি বলবে! তোমার ছেলেই বা শুনলে কি ভাববে!”

বিশ্বরূপ মালবিকার থেকে এরকম প্রত্যাখ্যান আশা করেননি, আহত হয়ে বললেন, ”সারাজীবন তো ওদের কথাই ভাবলাম মালি, ওদের জন্যই তো সারাটা জীবন পরিশ্রম করলাম, এখন শেষ ক-টা দিন যদি আমাদের পুরনো ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতে চাই, সেটার মধ্যে অন্যায় কোথায়!”

মালবিকা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন, ”এ হয় না!”

মুহূর্তের মধ্যে আনন্দের অনুষ্ঠানে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগলো। প্রথম কথা বলল দেবপ্রিয়, ”মালবিকা, বিশ্বদা তোকে তো সেই কলেজ লাইফ থেকেই ভালোবাসে, তুইও তো বাসতিস! এখন তোরা ঘটনাচক্রে একইসাথে এত ভালো একটা কাজ করছিস, জীবনটা আরেকবার নতুন করে শুরু কর না!”

মালবিকা কোনো উত্তর দিলেন না।

ত্রিদিবেশবাবু বললেন, ”মালবিকাদি, আপনারা দুজনে ঝরা পাতা থেকে বেরিয়ে এসে যে কাজটা করে চলেছেন, তাতে আমরা সবাই গর্বিত। এতগুলো নষ্ট হতে যাওয়া জীবনকে নতুন দিশা দেখাচ্ছেন আপনারা! আপনারাই দেখিয়ে দিয়েছেন আমরা সত্যিই সমাজের শুধুমাত্র ঝরে যাওয়া পাতা নই। আর সেখানে নিজেদের পুরনো ভালোবাসাটাকে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে অতৃপ্তি নিয়ে না-ই বা শেষ করলেন জীবনটা! দেখুন আমরা সবাই এসেছি আপনাদের এক করে দেওয়ার জন্য!”

‘ঝরা পাতা’র অ্যাটেন্ডেন্ট সুদীপ চিরকালই একটু ছটফটে, চুপি চুপি পাশে দাঁড়ানো সুবলবাবুকে বলল, ”যাহ, ছবি তোলা হবে না? এত কষ্ট করে চেয়েচিন্তে আনলাম ক্যামেরাটা!”

দেবপ্রিয় উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলল, ”একটাই তো জীবন, আফসোস রাখিস না মালবিকা! পরের জন্মে বিড়াল হবি না ছাগল হবি কিছুই তো জানিস না, এই মানুষজন্মটায় কোনো অতৃপ্তি রাখিস না।”

মালবিকা উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে চাইলেন, দেখলেন তাঁদের দুজনেরই হাতে তৈরি করা ছোট ছোট সবুজ পাতাগুলো প্রত্যাশাভরে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। মালবিকা চোখ ফিরিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভাবলেন, ছেলে যাওয়ার পর থেকে এই একবছরে ঠিক তিনবার ফোন করেছে, সেই কথোপকথনের মধ্যেও মায়ের প্রতি ছেলের কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসার থেকে অনেক বড় হয়ে উঠেছে মালবিকা বাড়ির ঠিকমতো খেয়াল রাখছেন কিনা সেই খবর জানাটা! যে ছেলেকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করেছিলেন, পরম যত্নে দিনের পর দিন বড় করে তুলেছিলেন, সে আজ কত দূরে চলে গেছে! ছেলের কাছ থেকে পাওয়া একের পর এক আঘাতও আজ বিশ্বরূপের সাথে এই কাজে ব্যস্ত হবার পর কত ফিকে হয়ে গেছে! আসলে সময়ই হল আসল, সময়ের সাথে সাথে আনন্দ, দুঃখ, শোক সবই ফিকে হয়ে যায়! সত্যিই তো, সেই সময় অনেক নষ্ট করেছেন মালবিকা, গত ছেচল্লিশ বছর ধরে, আর দেরি করা যায় না। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মালবিকা বিশ্বরূপের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের ওপর হাত রাখলেন। তাঁদের দুজনের যে এখন অনেক কাজ, চলে যাওয়ার আগে গাছে আরও অনেক সবুজ পাতা ধরাতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *